দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১৮

আঠারো

স্কুল থেকে বেরিয়ে বনবিহারী বুঝতে পারছিলেন না তাঁর কী করা উচিত? তারপর একটা রিকশা ডেকে থানায় যেতে বললেন। সন্তানের কী হল তা না জেনে তিনি বাড়িতে স্থির থাকতে পারবেন না। রিকশা চলছিল মফসসল শহরের পথ দিয়ে। সন্তানের শেষ প্রশ্নটা আবার মনে এল তাঁর। ছেলেটা কী করে জানল সুন্দরবনে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে একজন মহিলা ছিল! কালীচরণ যে এ কথা বলতে পারে না সে-ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তাহলে? এমন কেউ নিশ্চয়ই আছে যে তাঁদের সুন্দরবনে দেখেছে এবং এই তল্লাটে পৌঁছে গেছে। এতগুলো বছর পরে সেই লোক কী করে এখানে এল? তাঁর এখন কী করা উচিত? সোজা হয়ে বসলেন বনবিহারী। নাঃ, আর লুকোচাপা করে কোনও লাভ নেই। যা সত্যি তা খোলাখুলি সন্তানকে বলে দেওয়া উচিত। বয়স বেশি না হলেও ও পরিণত বয়স্ক মানুষের মতোই কথা বলেছে। সত্যি কথা শুনলে নিশ্চয়ই ছেলেমানুষের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না।

কিন্তু ঠিক কী বলবেন তিনি? তোমার বাবা এবং মা উগ্রপন্থীদের দলে ছিল। এনকাউন্টারে তোমার বাবা মারা যায়। তোমার মাকে হাসপাতালে ভরতি করি আমি। সেখানে তোমার জন্ম হয়। তোমরা আমার বাড়িতেই ছিলে। কিন্তু একসময় দেখা গেল তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গীরা পিছু ছাড়ছে না। পুলিশ জানতে পারলে আমরা বিপদে পড়ে যাব বলে সব ছেড়ে তোমাদের নিয়ে সুন্দরবনে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে এক এনজিও-তে ডাক্তারি করতাম। হঠাৎ একদিন তোমার মা তোমাকে ফেলে রেখে আগের পরিচিত কারও সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তুমি আমার কাছেই থেকে গেছ। তোমাকে আমি যত্ন করে বড় করছিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, তুমি যখন হোস্টেলে থেকে ওইসব ব্যাপারে জড়িয়ে যাচ্ছ ঠিক তখনই তোমার মা ফিরে এল আমার বাড়িতে। ওকে কোনও প্রশ্ন করলে লাভ হয় না। কারণ সে কথা বলতে পারে না।

এসব শোনার পরে সন্তানের কী প্রতিক্রিয়া হবে? যে মা তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল তার সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে তার? যাই হোক, বনবিহারী ঠিক করলেন, যা সত্যি তা আর লুকোবেন না। একমাত্র সমস্যা, পুলিশ যদি জানতে পারে তাহলে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। উগ্রপন্থী দলের একটি মেয়েকে শেল্টার দেওয়ার অপরাধে তাঁকে জেলেও যেতে হতে পারে। কী করবেন তিনি? তারপরেই মনে হল, সন্তান যেমন সব খবর একটু একটু করে জানছে, যারা জানাচ্ছে তারা তো পুলিশকেও জানিয়ে দিতে পারে। কার কাছে লুকোবেন তিনি?

থানায় ঢোকা মাত্র একজন সাবইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন, কী চাই?’

‘সেকেন্ড অফিসার কি থানায় আছেন?’

‘ওঁকে চেনেন?’

‘আজই পরিচয় হয়েছে। ওঁর নাম তো রমেন দত্ত।’ বনবিহারী বললেন, ‘আমার নাম বনবিহারী, পেশায় ডাক্তার।’

‘ও। বসুন। উনি এখন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। ওই চেয়ারে বসুন।’

অপেক্ষার যেন আর শেষ নেই। ঘণ্টা দেড়েক কেটে যাওয়ার পর বনবিহারী যখন আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না তখন রমেন দত্ত বেরিয়ে এলেন, ‘একী! আপনি এখানে বসে আছেন?’

‘ছেলেটাকে থানায় রেখে যাই কী করে!’ বনবিহারী বললেন।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বনবিহারীর সামনে বসে সিগারেট ধরালেন রমেন দত্ত, ‘আপনি যার জন্যে এত উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ডক্টর বনবিহারী তোমার কে হন? সে জবাব দিয়েছে, উনি আমার অভিভাবক ছিলেন। কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। কথাটা কি সত্যি?’

ম্লান হাসলেন বনবিহারী, ‘হ্যাঁ। কিন্তু রক্তের বাইরের কোনও কোনও সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের থেকেও বেশি আপন হয়ে ওঠে।’

মাথা নাড়লেন রমেন দত্ত, ‘হয়। কিন্তু সন্তানের কথার ধরন থেকে সেটা মনে হল না। আচ্ছা, সত্যি ও আপনার কেউ হয় না?’

‘রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়।’

‘কোথায় পেয়েছিলেন ওকে?’

শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা এল। বনবিহারী খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, আর মিথ্যে বলবেন না। বললেন, ‘ওর মা তখন গর্ভবতী। প্রসব বেদনা উঠেছে কিন্তু প্রসব হচ্ছে না। আমাকে কল দেওয়া হয়েছিল। একটু পরীক্ষা করে বুঝতে পারলাম সিজার করতে হবে। অপারেশন না করলে বাচ্চা ও মা কেউ বাঁচবে না। এটা জানাতেই মেয়েটির সঙ্গীরা যেন বিপাকে পড়ল। ডাক্তার এবং মানুষ হিসেবে ওর দায়িত্ব না নিয়ে পারলাম না। সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম ওকে। সেখানে অপারেশনের পর সন্তানের জন্ম হল। কিন্তু ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে কেউ এগিয়ে এল না। ভর্তির সময় হাসপাতালের খাতায় অভিভাবক হিসেবে আমার নাম না লিখে উপায় ছিল না।’

image18.jpg

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন রমেন দত্ত, ‘ওর সঙ্গীদের আপনি চিনতেন?’

‘না। আমি কখনও দেখিনি।’

‘তারা কোথায় থাকত তা জেনেছেন?’

‘আমাকে একটা জঙ্গলের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাচ্চা হওয়ার পর তাদের আর দেখিনি। শুনেছি পুলিশের গুলিতে তারা মারা যায়।’

‘আই সি। মেয়েটি উগ্রপন্থীদের একজন!’

‘আমার জানার কোনও উপায় ছিল না।’

‘কেন? মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেই তো—।’

‘জানা যেত না। মেয়েটি বাকশক্তিরহিত। ওর নাম পর্যন্ত আমি জানি না।’

‘ব্যাপারটা থানায় জানিয়েছিলেন?’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘না। মনে হয়েছিল পুলিশ তো মেয়েটির সঙ্গীদের যা শাস্তি দেওয়ার দিয়েই দিয়েছে। যে বাচ্চা জন্মেছে সে তার মাকে ছেড়ে বাঁচতে পারে না। মেয়েটিকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম সে কাউকে ভালোবেসে ওই দলে ছিল, নিজে কোনও অন্যায় করতে পারে না। তা ছাড়া সেসময় খুব ধরপাকড় চলছিল। আমি ভয় পেয়েছিলাম, পুলিশ আমাকে বুঝতে না পেরে গ্রেপ্তার করবে ওদের সাহায্য করার অভিযোগে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, একটি মেয়েকে মরে যেতে দেখেও আমি যদি ফিরে আসতাম তাহলে পরের দিন অন্য কোনও পেশেন্টকে দেখতে পারতাম একজন ডাক্তার হয়ে?’

‘হয় তো। তবু বলব, আপনি কাজটা ঠিক করেননি। পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। সন্তানের সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্ক কীরকম?’

‘সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কোনও সুযোগ হয়নি। ওর হামাগুড়ি দেওয়ার আগেই মেয়েটি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল তা জানি না। হঠাৎ কয়েকদিন হল, এতগুলো বছর পরে সে ফিরে এসেছে।’

‘সন্তানের মায়ের নাম কী?’ রমেন দত্ত সিগারেট শেষ করলেন।

‘জানি না। আমরা তার নাম রেখেছি মামণি।’

‘আমরা মানে?’

‘আমি আর আমার কাজের লোক, কালীচরণ।’

‘ওই মহিলার আচরণ কীরকম?’

‘একদম স্বাভাবিক।’

‘এই যে উনি আবার ফিরে এসেছেন, এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি জানেন না। ওঁর উগ্রপন্থী সঙ্গীরা এখনও যোগাযোগ রেখে চলেছে কিনা তা আপনি জানেন?’

‘বোধহয় যোগাযোগ নেই। উলটে সে সঙ্গীদের ভয় পাচ্ছে বলে কালীচরণের কাছে শুনেছি। কালীচরণকে এড়িয়ে কেউ ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না।’

‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, আপনার উচিত ছিল, এবারে ও আসার পর থানায় গিয়ে সব কথা খুলে বলা। জেলে ও বেশি নিরাপদ থাকত। আচ্ছা, সুজয় মাস্টারকে তো আপনি চেনেন। আপনার বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় কিছুদিন ছিল। তার কী ভূমিকা?’

‘কী ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন?’

‘সন্তানের ব্যাপারে।’

‘ব্যাপারটা আমার কাছে অস্পষ্ট। তবে ওদের মধ্যে কথা হয়েছে। বিশেষ করে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার খবর সন্তান ওর কাছেই জানতে পায়।’ বনবিহারী বললেন।

‘সুজয় মাস্টার স্কুলে এসে সন্তানের সঙ্গে দেখা করেছেন।’

‘হ্যাঁ। খবরটা আজই শুনলাম।’

‘দেখুন ডাক্তারবাবু, সন্তানকে এখনই ছেড়ে দিতে পারছি না। ওকে আরও জেরা করা প্রয়োজন। কিন্তু আপনি ভেবে দেখুন কী করবেন। আমার মনে হয় ফিরে গিয়ে আপনাদের থানায় পুরো ব্যাপারটা লিখিত ভাবে জানিয়ে দিন।’ রমেন দত্তের কথা শেষ হওয়া মাত্র থানার ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এল, ‘ধর-ধর, পালাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে।’

রমেন দত্ত দ্রুত দৌড়ে গেলেন ভেতরে। বনবিহারী বুঝলেন কোনও ধৃত ব্যক্তি পালাবার সুযোগ করে নিয়েছে। হঠাৎ তাঁর মনে হল এত কথা খোলাখুলি অফিসারকে না বললেই হত। সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নাড়লেন তিনি, না, বলে ঠিক কাজই করেছেন। থানা থেকে কিছু লোক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। রমেন দত্ত ফিরে এলেন চিন্তিত মুখে, ‘ডাক্তারবাবু, আমাকে একদম বোকা বানিয়ে দিল ছেলেটা।’

‘মানে?’

‘ওর বিরুদ্ধে কোনও চার্জ এখন পর্যন্ত নেই, কথা বলার জন্যে থানায় নিয়ে এসেছি তাই বন্দিদের যেভাবে রাখা হয় তা রাখিনি। সেই সুযোগটা নিয়ে পেছনের উঠোনে নেমে পাঁচিল টপকে পালিয়ে গেল। আরে পালিয়ে তুই কোথায় যাবি? এখন তো ওর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ তৈরি হয়ে গেল।’ রমেন দত্ত সিগারেট ধরালেন।

‘সন্তান থানা থেকে পালিয়ে গিয়েছে!’ উঠে দাঁড়ালেন বনবিহারী।

‘হ্যাঁ। কোথায় যেতে পারে বলে আপনার ধারণা।’

‘আমি কী বলব! আমার মাথা কাজ করছে না। ও পালাল কেন? ওইটুকুনি ছেলে! আঃ। ঈশ্বর!’ বনবিহারী ছটফট করছিলেন।’

‘আরে! এখন ঈশ্বরকে ডেকে কী হবে। শুনুন। সন্তান যদি আপনার বাড়িতে যায় তাহলে ওকে আটকে রেখে থানায় খবর দেবেন। আপনার লোকাল থানাকে সব জানিয়ে দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস সে বাড়িতে ফিরবেই। যান।’ রমেন দত্ত ভেতরে চলে গেলেন।

আজ স্কুল ছুটি। সুজয় ভাতেভাত বসিয়ে দিয়েছিল স্টোভে। রাতের খাবার সে এইভাবেই সারে। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় সদানন্দর হোটেলে একবেলা খাওয়ার মাসচুক্তি করে নিয়েছে।

দরজায় শব্দ হল। বলাইচাঁদবাবুর স্ত্রী ঘরে এসে দাঁড়িয়ে একটা হাত কোমরে রাখলেন, ‘কি! হাত পুড়িয়ে রান্না হচ্ছে?’

সুজয় হাসল, ‘রান্না হচ্ছে, তবে হাত পোড়েনি।’

‘একটা বিয়ে করলেই তো হত। বউ রেঁধে দিত।’ মুখে পান বাড়িওয়ালির।

‘কপালে না থাকলে যা হয়—। বলুন।’

‘কী আর বলব। দেখতে এলাম। কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

‘বিন্দুমাত্র না। বলাইবাবু কেমন আছেন?’

‘থাকা আর না থাকা। তবে হ্যাঁ, ও আছে বলে আমি অনেক সমস্যা থেকে বেঁচে আছি। ভগবানকে রোজ বলি, হাঁটতে না পারুক, এমনকী কথা যদি না বলতে পারে তাও আচ্ছা, কিন্তু লোকটাকে প্রাণে মেরো না।’ হাসলেন মহিলা।

‘সে কী!’

‘আমি তো এখনও বুড়ি হয়ে যাইনি। অনেক দেরি সেটা হতে। মাথার ওপর পুরুষ মানুষ থাকা মানে একটা ছাদ থাকা। কাক চিল শকুন ঠোকরাতে পারবে না। স্বামী কথা না বলতে পারুক, এই সিঁদুর-শাঁখা হল বর্মের মতো। আপনি জানেন না, এখানকার বিবাহিত লোকদেরই নোলা বেশি। আহা, এলাম, বসতে বলছেন না যে?’

সুজয় উঠে দাঁড়াল, ‘সরি। বসুন। এটা তো আপনারই বাড়ি।’

‘বাড়িটা আমার তাতে সন্দেহ নেই।’ বাড়িওয়ালি সুজয়ের তক্তাপোশের একপাশে শরীর রাখলেন, ‘কিন্তু ঘরটা তো আপনার। যদ্দিন ভাড়া দেবেন তদ্দিন এই দরজার এপাশে বিনা অনুমতিতে ঢোকার অধিকার আমার নেই।’

‘বাঃ। বেশ সুন্দর কথা বলেন তো।’

‘যাক গে, আমি এলাম একটু সাবধান করে দিতে।’

‘আমি কি কোনও অন্যায় করেছি!’

শব্দ করে হেসে উঠলেন মহিলা, ‘এ যে ঠাকুরঘরে কে-র মতো হল। না, আপনি কেন অন্যায় করবেন! এখানকার আইবুড়ো মেয়েগুলো আপনাকে একা পেলে চিবিয়ে খেয়ে নিতে রাজি। ওই ঠিকে মাস্টারনি তো এর মধ্যেই গলা অবধি ডুবে গেছে। আমি বলে দিয়েছি, দেখা করতে হলে বাইরে গিয়ে দেখা করো, আমার বাড়িতে এসে লীলা করা চলবে না। হয়তো কথাটা শুনে আপনার খারাপ লাগছে—!’

‘না। প্রত্যেক বাড়ির নিজস্ব নিয়ম থাকে। এটাও তেমনি।’

‘ঠিক। তা ছাড়া একজনকে আসতে দিলে অন্যদের ঠেকাবো কী করে?’

সুজয় লক্ষ করছিল মহিলার একটা মুদ্রাদোষ আছে। কথা বলার সময় মাঝে মাঝেই বুকের আঁচল টানেন। আর যতবার টানেন ততবার সেটা আরও এলিয়ে পড়ে। মধ্যতিরিশের এই মহিলার শরীর-স্বাস্থ্য বেশ মজুবত, বুকের গড়নে টোল পড়েনি বলেই মনে হচ্ছিল। মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার নাম জানা আছে?’

‘বলাইচাঁদবাবুর স্ত্রী বলেই সবাই—।’

‘উঃ। আমার বাবা-মা একটা নাম রেখেছিলেন। শিউলি। স্কুলের নাম ছিল শেফালিকা। আপনি আমাকে শিউলি বউদি বলে ডাকবেন।’

‘বেশ। এটাই ভালো হল।’

‘কী রান্না হল?’

‘দুরকমের সেদ্ধ আর ভাত।’

‘ওম্মা! এই জোয়ান বয়সে বিধবার খাবার কেন? ঠিক আছে, আমি তরকারি আর মাছ পাঠিয়ে দিচ্ছি। আজ আমার পার্লার বন্ধ।’

‘কেন?’

‘বেস্পতিবার যে। চুলে নখে কাঁচি ছোয়াবে না মা-ঠাকরুনেরা। আচ্ছা, চলি।’ উঠে পড়লেন শিউলি। এক পা এগিয়ে সুজয় বলল, ‘সময় পেলে আসবেন।’

‘পার্লারের বাইরে তো মুখ বন্ধ করে বসে থাকি। আসতে বললে তো কথা বলে বাঁচব। তখন তাড়িয়ে দেবে না তো!’ চোখ ঘোরালেন শিউলি।

‘কী যে বলেন!’

‘এই যা। তোমাকে তুমি বলে ফেললাম। আচ্ছা, তুমিও আমাকে তুমি বোলো। কাল রাত্রে দেখলাম অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছিলে, আলো জ্বলছিল।

‘হ্যাঁ। পড়ছিলাম।’

‘আমি জেগে থাকি। ঘুম আসে না বলে। তখন চলে এসে তোমার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করব। রাজি?’

‘নিশ্চয়ই।’

শিউলির চলে যাওয়া দেখল সুজয়। আচমকা যেন মহিলার শরীরের বয়স অনেক কমে গিয়েছে।

ঠিক দুপুর দুটোয় সুজয়ের কানে এল, ‘উনি ওই ঘরে আছেন। যান।’ সম্ভবত কাজের লোকের গলা। তারপরেই দরজায় টোকা পড়ল।

দরজা খুলল সুজয়। খুলেই অবাক হল, ‘একী! তুমি?’

টুক করে ঘরে ঢুকে পড়ল সন্তান। নিজেই দরজা ভেজিয়ে বলল, ‘সুজয়দা, আমি পালিয়ে এসেছি। বাঁচান।’

‘কোত্থেকে পালিয়ে এলে? হোস্টেল থেকে?’

‘না। থানা থেকে।’

‘থানা?’

তক্তাপোশে বসে পুরো ব্যাপারটা বলল সন্তান।

‘খুব অন্যায় করেছ। পুলিশ যখন তোমাকে অ্যারেস্ট করেনি তখন তুমি পালাতে গেলে কেন?’ চিন্তিত হল সুজয়।

‘আমাকে এমন চাপ দিচ্ছিল অফিসারটা যে মনে হচ্ছিল বেশি চাপ দিলে সব কথা বলে ফেলব। জয়ন্তদা মারা গিয়েছে কিন্তু অন্যদের নাম ঠিকানা জানতে চাইছিল। আপনার কথাও। তখন পালাবার কথা ভাবলাম।’ সন্তান বলল।

‘কাজটা ঠিক করোনি। তোমার বিরুদ্ধে ওদের কাছে কোনও অভিযোগ ছিল না। অনুমানে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। এখন তো অভিযোগ তৈরি হয়ে গেল। তুমি এখানে কীভাবে এলে?’ সুজয় তাকাল।

‘বাসে।’

‘চৌমাথায় নেমে এখানে হেঁটে এলে?’

‘না। গঞ্জে ঢোকার আগেই বাস থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এসেছি। কেউ দেখতে পায়নি। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এখানে আসার সময় দু-তিনজন দেখেছে।’

‘এখান থেকে কোথায় যাবে?’

‘জানি না।’

‘আশ্চর্য! তুমি ছেলেমানুষ কিন্তু এতটা তা ভাবিনি।’ সুজয় বলল, ‘এক কাজ করো। তুমি ফিরে যাও। যে থানা থেকে এসেছ সেখানে গিয়ে বলো মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল বলে না বলে চলে গেছ। ওরা তোমাকে একটু-আধটু মারধোর করতে পারে। সহ্য করবে। কিন্তু হাজার যন্ত্রণা দিলেও কোনও কথা, যা তুমি জানো, ওদের বলবে না। তোমাকে ওরা একসময় ছেড়ে দেবেই। তোমাকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না। সঙ্গে টাকাপয়সা আছে?’ সুজয় জিজ্ঞাসা করল।

‘না।’ মাথা নাড়ল সন্তান।

সুজয় ব্যাগ খুলে কুড়িটি টাকা সন্তানকে দিল, ‘যাও। সোজা গিয়ে বাস ধরো। পরে যোগাযোগ করবে। এখানে যে এসেছিলে তা ওদের বলবে না।’

‘মায়ের, মানে যিনি আমাকে পৃথিবীতে এনেছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করব না?’

‘সময় নষ্ট করার কী দরকার?’

‘কিন্তু ওরা তো জিজ্ঞাসা করবে মায়ের সঙ্গে কী কথা হল?’

‘ডাক্তারবাবুর বাড়িতে যে মহিলা আছেন তিনি কথা বলতে পারেন না।’

‘সেকী! আপনি জানলেন কী করে?’

‘সেটা জানার দরকার নেই তোমার। তুমি বলবে বাড়িতে গিয়ে দেখেছ দরজা বন্ধ। অনেক শব্দ করলেও কেউ দরজা খোলেনি। তাই ফিরে এসেছ। যাও।’

সন্তান একটু দ্বিধা নিয়ে তাকাল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুজয়ের মনে হল তার এখনই কিছু করা উচিত। যে-কোনও সময় পুলিশ তার কাছে আসতে পারে। তারপরেই সে শ্বাস ফেলল। আশ্চর্য। এখন পর্যন্ত সে আইনের চোখে যা অন্যায় তেমন কোনও কাজ করেনি।

বিকেল চারটের সময় স্কুলের দারোয়ান এল, ‘মাস্টারমশাই, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে এখনই যেতে বললেন।’

‘কেন? অবাক হল সুজয়।

‘জানি না।’ দারোয়ান বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *