ষোলো
দুটি বাহু যেন অজস্র লতা হয়ে বনবিহারীকে আঁকড়ে ধরেছিল। মামণির শরীরের যত উত্তাপ যেন ওর শ্বাসের সঙ্গে মিশে বেরিয়ে এসে তাঁকে অবশ করে দিচ্ছিল। বনবিহারী বুঝতে পারছিলেন এমন অভিজ্ঞতা তাঁর যাবতীয় শিক্ষা, ভদ্রতা, সংযমকে ধীরে ধীরে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। তিনি কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এরকম কেন করছ? কী চাও তুমি?’
সঙ্গে সঙ্গে মামণির একটা আঙুল বনবিহারীর বুকে তিরের মতো বারংবার আঘাত করল যার অর্থ তোমাকে চাই।
পরিত্রাণের আশায় বনবিহারী শেষ চেষ্টা করলেন, ‘ওঃ, আমার খুব লাগছে।’
মাথাটা এমনভাবে দোলাল মামণি যার একটাই অর্থ, লাগুক। তারপর সশব্দে চুম্বন করল বনবিহারীর গলায়। শব্দটা কানে আসতেই ঝিমঝিম করল শরীর। বনবিহারীর মনে হল তাঁর শরীরে কোনও শক্তি নেই। তাঁর মনের সব আগল ওই শব্দ ভেঙে চুরমার করে দিল। দু-হাতে সজোরে টেনে নিলেন মামণিকে। ঠিক তখনই বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে হর্ন বাজল বাড়ির সামনে।
সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে গেল তাঁর হাত। ফিশফিশিয়ে বললেন, ‘কেউ এসেছে। এসময় কে এল?’
মামণি তবু ছাড়ছে না বনবিহারীকে। বাইরের দরজায় শব্দ বাজল। প্রায় জোর করেই নিজেকে মুক্ত করলেন তিনি। নীচু গলায় বললেন, ‘তোমার ঘরে চলে যাও। একদম শব্দ করবে না।’
মামণি কথা শুনল। পলাতকা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল সামনে থেকে। বুক খালি করে বাতাস বের হল বনবিহারীর। তিনি এগিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘কে? কে এত রাতে?’
‘আমি খুব দুঃখিত ডাক্তারবাবু! বাধ্য হয়ে এসেছি।’
এই কণ্ঠ থানার বড়বাবুর। দরজা খুলে বললেন, ‘আসুন।’
‘আপনি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু—।’
‘বসুন।’
‘না বসব না। আপনার নাতি নীচের যে স্কুলে পড়ে, কী নাম যেন—।’
‘সন্তান।’
‘হ্যাঁ, সেই স্কুলের প্রিন্সিপাল ফোন করেছিলেন থানায়। উনি আপনাকে জানাতে বলেছেন যে সন্তান যা করছে তাতে এভাবে চললে স্কুলে রাখা সম্ভব হবে না।’
‘কী করেছে সে?’
‘সে নাকি প্রায়ই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে মিথ্যে কথা বলে। উনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ওর চেয়ে অনেক বড় কিছু রহস্যজনক যুবকের সঙ্গে দেখা করে।’
‘রহস্যজনক মানে?’
‘ওই যুবকেরা স্থানীয় কোনও পরিবারে থাকে না।’
‘কারা তারা?’
‘এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছেন ওখানকার থানার বড়বাবু। আমাদের এখানে পুলিশ সক্রিয় বলে হয়তো তাদের কেউ কেউ নীচে নেমে গেছে।’
প্রচণ্ড ভয়ে আক্রান্ত হলেন বনবিহারী, চেঁচিয়ে বললেন, ‘অসম্ভব। হতে পারে না।’
‘হচ্ছে ডাক্তারবাবু। ওই ছেলেদের একজন আজ সকালে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে বলে সন্তান নাকি সারাদিন উপোস করে রয়েছে। প্রিন্সিপাল বললেন, আপনি যেন কাল সকাল ন’টার মধ্যে ওঁর সঙ্গে দেখা করেন।’
‘বেশ যাব।’
‘ওহো আপনার কাজের লোক তো এখন জঙ্গলের ধারের বস্তিতে বাসা নিয়েছে।’
‘শুনলাম। ও এসেছিল সন্ধেবেলায়। এখানে ফিরে আসতে চাইছে।’
‘ফিরিয়ে নিন। চোখের সামনে থাকলে আমাদের সুবিধে হবে। আচ্ছা চলি।’ ফিরে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই যে আমরা দিন নেই রাত নেই ঝড়বাদল মাথায় নিয়ে জনসাধারণের সেবা করে চলেছি কিন্তু পাবলিক তবু আমাদের বন্ধু বলে মনে করে না।’
দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়লেন বনবিহারী। রক্ত না পরিবেশ, কে বেশি চরিত্রগঠনে শক্তিশালী? এতটা কাল ভাবতেন দ্বিতীয়টাই আসল। তাহলে সন্তান এসব করছে কেন? কী এমন বয়স ওর? জন্মাবার পর থেকে তিনি ওকে দু-হাতে আগলে রেখে বড় করেছেন। বাবা-মায়ের ইতিহাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ওর যাতে না-হয় তাতে সতর্ক ছিলেন। তাহলে এরকম করছে কেন সন্তান?
এই যুবকেরা কারা? কোত্থেকে এল? অল্পবয়সি ছেলেরা এইরকম যুবকদের সম্পর্কে আগ্রহী হয় যেসব কারণে তার একটা হল নেশা। ওদের কাছে সন্তান কি ড্রাগের নেশার টানে যাওয়া-আসা করছে? কিন্তু সেটা করলে তো স্কুল কর্তৃপক্ষ জানতেই পারত। তাহলে কি ওর বাবার রক্ত কথা বলছে?
ভেতরে চলে এসে বনবিহারী দেখলেন ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে মামণি। ওর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। গম্ভীর মুখে বললেন, ‘খুব খারাপ কথা শুনলাম। তোমার কি সে কথা শোনার আগ্রহ আছে?’
নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি।
‘তুমি তো কখনও নিজের ছেলের কথা ভাবোনি। তার প্রতি কোনও টান যদি অনুভব করেও থাকো তাহলে সেটা আমি জানি না। আমি ওকে আমার মতো বড় করতে চেষ্টা করেছি। পড়াশুনা যাতে আরও ভালো করতে পারে তাই সমতলের একটি ভালো বোর্ডিং স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছি। সব ভালো চলছিল কিন্তু ওর শরীরে যে রক্ত আছে তার কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’ বনবিহারী শ্বাস ফেললেন।
মামণি বাঁপাশে মুখ ফেরাল। যেন এসব শুনতে তার ভালো লাগছিল না।
‘তার বাবা পুলিশের গুলিতে মরে গেছে। তোমাকে নিয়ে দিনের পর দিন জঙ্গলে লুকিয়ে থেকেছে ভারতবর্ষে বিপ্লব আনবে বলে। তার ফল কী হয়েছে? তোমার ছেলে যাকে চোখে দেখেনি, সে কী চেয়েছিল তা জানেও না তবু বাবার মতো নিয়ম ভাঙতে চেষ্টা করছে। জানি না, তুমি যদি ওকে আমার কাছে ফেলে উধাও না হয়ে যেতে তাহলে ওর এই পরিণতি হত কিনা! তোমার সবচেয়ে বড় সুবিধে হল, তুমি কথা বলতে পারো না।’
বনবিহারীর কথা শেষ হওয়ামাত্র পাশের ঘরে ছুটে গেল মামণি। বনবিহারী সেখানে গিয়ে দেখলেন উত্তেজিত ভঙ্গিতে কিছু লিখছে মামণি। তারপর লেখা কাগজ এগিয়ে দিল। বনবিহারী পড়লেন, ‘ছেলের বাবা আমার স্বামী নয়।’
চমকে তাকালেন বনবিহারী, ‘একী? কী লিখেছ?’
ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল মামণি, ঠিকই লিখেছে।
‘তাহলে ওর বাবা কে?’
কিছুক্ষণ চিন্তা করল মামণি। তারপর কাগজটাকে টেনে নিয়ে লিখল, ‘চা-বাগানে যাকে আমি মারতে বাধ্য হয়েছিলাম সে একসময় জোর করে—! কেউ জানে না।’
বনবিহারীর মনে পড়ল। চা-বাগানের ভেতরে এক যুবকের থেঁতলানো মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। মামণি তার আগে উধাও হয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। ফিরে এসেছিল বিধ্বস্ত অবস্থায়। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও সেই যুবকের খুনিকে ধরতে পারেনি।
কাগজটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বনবিহারী বললেন, ‘যাও, শুয়ে পড়ো। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও।’
বিছানায় শুয়ে বনবিহারীর মনে হল মানুষের জীবন নিয়ে একজন পরম শক্তিমান নাট্যকার প্রতিনিয়ত নাটক লিখে চলেছেন। আজ মামণির সংস্পর্শে যখন তাঁর সব কিছু ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল ঠিক তখন থানার বড়বাবুকে পাঠিয়ে দিলেন সেই নাট্যকার। সন্তানের খবরটা এত মারাত্মক মনে হল যে মামণিকে নিয়ে যে মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল তা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল। আবার সন্তানকে নিয়ে তিনি যখন বিব্রত তখন জানতে পারলেন মামণির সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছিল সে সন্তানের বাবা নয়। এমনকি সেই লোকটা জানত না যে তাদের দলের এক যুবকের জন্যে মামণি গর্ভবতী হয়েছে। এইভাবে মোচড় দিয়ে জীবনটাকে নিয়ে ছেলেখেলা করে যান সেই নাট্যকার।
খবর যখন পেয়েছেন তখন আগামীকাল সন্তানের স্কুলে যেতেই হবে। কিন্তু আজ বনবিহারীর মনে হল, এসব তাঁর নিজের তৈরি করা সমস্যা যাতে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত নেই। কিন্তু এখন তিনি আর কী-ই-বা করতে পারেন!
গোটা রাত আধাঘুম-আধাজাগরণে কেটে গেল। ভোর হতেই বনবিহারী বাথরুম থেকে তৈরি হয়ে বাইরের দরজা খুলতেই দেখতে পেলেন কালীচরণ বসে আছে। তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়াল। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একী! এত ভোরে কেন?’
‘আপনি বলেছিলেন সকালে আসতে।’ কালীচরণ মুখ নামিয়ে কথা বলল।
‘বেশ। বলো কী বলতে চাও!’
‘বাবু, আমাকে মাপ করে দিন।’
‘তুমি মিথ্যে কথা বলে এবাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলে কেন?’
‘আমি আর কোনও উপায় দেখতে পাইনি।’
‘মানে?’
‘ওরা মামণিকে মেরে ফেলত।’
‘কারা?’
‘ওই জঙ্গলের ছেলেরা। মামণি ওদের চোখে ধুলো দিয়ে মাঝরাতে এই বাড়ির পেছন দিকে এসে পড়ছিল। শব্দ শুনে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখতে যাই। সে আমাকে দেখে খুব কাঁদে। ইশারায় বোঝায় ওকে ওরা মেরে ফেলবে। আমার মনে দয়া এল। আমি ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসে লুকিয়ে থাকতে বলি। তারপর দুদিন ও এই বাড়িতেই থাকে কিন্তু ওর থাকার কথা আপনাকে জানাইনি। দ্বিতীয় দিনে আমি যখন বাজারে যাচ্ছি তখন একজন অচেনা ছেলে জিজ্ঞাসা করে কোনও বোবা মেয়েকে দেখেছি কিনা! আমি অস্বীকার করি। সে তখন জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় কাজ করি? আমি বলি যে বাড়িতে কাজ করতাম তারা আমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। আমি জঙ্গলের ধারে ঘর ভাড়া করে চলে যাচ্ছি।’
কালীচরণকে থামালেন, বনবিহারী, ‘তার মানে তুমি এর আগেই সেখানে গিয়ে ঘরের ব্যবস্থা করে এসেছিলে?’
‘না, আমি শুনেছিলাম ওখানে সস্তায় ঘর ভাড়া পাওয়া যায় তাই বলেছি।’
‘তারপর?’
‘আমার মনে হয়েছিল বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে ওরা মামণি আপনার বাড়িতে আছে বলে আর সন্দেহ করবে না। যাওয়ার আগে মামণিকে বলেছিলাম আপনার কাছে সব কথা জানাতে। কিন্তু ওখানে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম। ওই ছেলের সঙ্গে আরও দুজন রাত্রে আমার ঘরে চলে আসত, রান্না করে খেতে দিতে বলত। ওরা মামণির কথা বলত। তার জন্যেই নাকি পুলিশ ওদের একজনকে ধরে ফেলতে পেরেছে। কিন্তু মামণি কোথায় গিয়েছে তা জানত না ওরা। কাল আমার মনে হল পুলিশ যদি আমায় ধরে তাহলে ওদের লোক ভাববে। আমি আর ওদের সঙ্গে থাকতে চাই না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন বাবু।’ দু-হাত জড়ো করে কেঁদে ফেলল কালীচরণ।
বনবিহারী বললেন, ‘আগে হলে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করতাম। এখন অনেক গলদ দেখতে পাচ্ছি। তুমি এক কাজ করো, পুলিশের কাছে সব কথা বলো যাতে ওরা রাত্রে তোমার ঘরে এলে ধরা পড়ে যায়।’
‘কিন্তু—!’
‘আবার কিন্তু কেন?’
‘মামণির কথা বললে তাকেও পুলিশ ধরবে।’
‘কী বলবে না বলবে তা তুমি ঠিক করো।’
‘ওরা আজ শেষরাত্রে ঘরে ঢুকেছে। অনেকক্ষণ মড়ার মতো ঘুমাবে। এখন থানায় যাই। কিন্তু পুলিশ যদি আমাকেও ধরে? খুব ভয় লাগছে বাবু।’
বনবিহারী চিন্তা করলেন একটু, তারপর বললেন, ‘তুমি থানার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।’ কালীচরণ চলে গেলে বনবিহারী চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ কোথাও নেই। এত ভোরে থাকার কথাও নয়।
টাকাপয়সা, কলম এবং স্টেথো নিয়ে বনবিহারী মামণির ঘরের দরজায় টোকা মারতে সেটা আধখোলা হয়ে গেল। ভেতরে পা রাখতেই ফিরে দাঁড়ালেন তিনি। মামণি পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার রাতবস্ত্র হাঁটুর অনেকটা ওপরে উঠে যাওয়ায় সেখান থেকে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ যেন বনবিহারীকে স্পর্শ করল। তিনি দরজার বাইরে এসে শব্দ করলেন। একটু পরে উঠে এল মামণি। বনবিহারী বললেন, ‘আমি নীচের শহরে যাচ্ছি। ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। যা আছে তা রান্না করে খেয়ে নিও। আর খবরদার, কোনও জানলা-দরজা তো খুলবেই না, শব্দও করবে না। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি।’
মামণি নীরবে ঘাড় নাড়ল।
অথচ থানার দিকে হাঁটার সময় বনবিহারী একটু আগে দেখা মামণির ঘুমন্ত শরীরটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না।
এই সময় থানায় কোনও অফিসারের থাকার কথা নয়। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে তাঁর পরিচিতির কারণে একজন সেপাই পাশের কোয়ার্টার্স থেকে বড়বাবুকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে নিয়ে এল। পাজামার ওপর গেঞ্জি পরে বড়বাবু বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
কালীচরণ এই সময় ঢুকেছিল থানায়। তাকে দেখিয়ে বনবিহারী ব্যাপারটা জানালেন বড়বাবুকে। বড়বাবু তাকালেন কালীচরণের দিকে, ‘দেশে যাওয়ার নাম করে তুমি ওখানে ঘর ভাড়া করেছিলে কেন?’
কালীচরণ উত্তর দিতে দ্বিধা করায় বনবিহারী বললেন, ‘অনেককাল ও আমার কাছে চাকরি করে বোধহয় টায়ার্ড হয়ে গিয়েছে। ভেবেছে বাকি জীবন স্বাধীনতা ভোগ করবে।’
‘খাবে কী?’
‘ওর মাইনের টাকা জমা রয়েছে পোস্ট অফিসে।’
‘আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না! আপনার বাড়িতে ও রাজার মতো ছিল! অন্য কারণ নেই তো?’ বড়বাবু প্রশ্ন করা মাত্র কালীচরণ মাথা নাড়ল, ‘না, না। আমি বাবুর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আর কোথাও যাব না।’
‘হুম। এখন দুজন তোমার ঘরে ঘুমাচ্ছে?’
‘তাই দেখে এসেছি।’
‘ওদের সঙ্গে আর ক’জন আছে?’
‘আমি জানি না, দেখিনি।’
‘কোনও মেয়েছেলেকে দেখেছ?’
‘না তো!’
‘তখনই লোকজনকে জোগাড় করে বড়বাবু জিপে উঠলেন, ‘ওঠো।’
‘আমি যাব?’ কালীচরণ কেঁপে উঠল।
‘নইলে তোমার ঘর চিনব কী করে?’
‘কিন্তু ওরা তো জেনে যাবে আমি ধরিয়ে দিয়েছি।’
‘তাতে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। ওঠো।’
দুটো গাড়ি বেরিয়ে গেল।
থানা থেকে বেরিয়ে বাজারের চৌমাথায় এসে বনবিহারী দেখলেন তখনও রোদ ওঠেনি, দোকানপাট খোলেনি শুধু সদানন্দর হোটেলের উনুন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাঁকে দেখে সদানন্দ বেরিয়ে এল, ‘আপনি এই ভোরে?’
‘একটু নীচের শহরে যাব।’
‘তার বাস তো ঘণ্টাখানেক পরে পাবেন।’
‘তাই নাকি!’
‘আসুন আসুন। এক কাপ চা খেয়ে যান।’
‘হোটেলে চা হয় নাকি?’
‘না, ওটা শুধু কর্মচারীদের জন্যে। কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমার ওয়াইফ কাল খুব কষ্ট পেয়েছে। আপনি আর খাবার দিতে নিষেধ করেছেন!’
‘দরকার হবে না। কালীচরণ ফিরে এসেছে।’
‘ও তাই বলুন। আপনার নতুন মাস্টার তো নতুন বাসায় চলে যাচ্ছে।’
‘শুনলাম।’
‘বাসাটা ভালো বাছল না। মহিলার তো সুনাম নেই।’
‘মাথা গোঁজার জায়গা তো দরকার। ভালোমন্দ জানবে কী করে!’
‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমার কোনও দোষ নেই, ওয়াইফ আপত্তি করল। আসলে নন্দলালদার মেয়ে হুটহাট একটা আইবুড়ো ছেলের কাছে চলে আসত তো, সেটা ওয়াইফ ভালো চোখে দেখল না।’ সদানন্দ বলল।
চা তৈরি হতে সময় লাগল। একটু একটু করে চৌমাথায় লোক জমছে, দোকান খুলছে। শেষ চুমুক দিয়ে পকেটে হাত ঢোকাতেই এক হাত জিভ বের করল সদানন্দ, ‘ছি ছি, আর পাপের ভাগী করবেন না। ছোটভাইকে এটুকু আনন্দ দিন।’
ঠিক তখনই পুলিশের দুটো গাড়িকে ফিরে আসতে দেখলেন বনবিহারী। গাড়ি দুটো যখন সামনে দিয়ে চলে গেল তখন সদানন্দ নীচু গলায় বলল, ‘আরও দুটো খতম হল।’
বনবিহারী এবার লক্ষ করলেন, গাড়ির বাইরে দু-জোড়া পা ঝুলছে।