দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১১

এগারো

বনবিহারী জানেন সন্তান বোর্ডিং-এ চলে যাওয়ার পর কয়েকদিন ধরে কালীচরণ স্বাভাবিক আচরণ করে না। তার বেশিরভাগ কাজেই ভুল হয়ে যায়, তরকারিতে দ্বিতীয়বার লবণ দিয়ে ফেলে এই ভেবে যে প্রথমবার দেয়নি। মুখে হাসি যেমন নেই, কথাও নেই।

সন্তান চলে গেলে বাড়িটা কীরকম খাঁ-খাঁ করে। যে ঘরেই যাও মনে হবে শূন্যতা যেন চারপাশ থেকে চেপে ধরছে। তার প্রভাব কালীচরণের ওপর পড়া অস্বাভাবিক নয়। কাল রাত্রে মাছের ঝোল বড্ড বেশি নোনতা হয়েছিল বলে ধমক দিয়েছিলেন বনবিহারী। মাথা নীচু করে ছিল। আজ সকালে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলল, ‘আমাকে মাসখানেকের ছুটি দিতে হবে।’

‘ছুটি? সেকী! ছুটি নিয়ে কী করবে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন বনবিহারী।

‘ছুটি নিয়ে লোকে যা করে! গ্রামে যেতে হবে। বাড়িঘর নিশ্চয়ই হাতছাড়া হয়ে গেছে এতদিনে। তবু গিয়ে দাঁড়ালে উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’ কালীচরণ বলল।

‘বহুবছর আগে বলেছিলাম ওগুলো বিক্রি করে দিতে। তখন শুনেছিলাম যে কেনার লোক নেই। এখন সেসব উদ্ধার করে কী হবে, কিনবে কে?’

‘আমি বিক্রি করব কেন? ইচ্ছে হচ্ছে শেষ জীবন ওই পৈতৃক ভিটায় কাটিয়ে দেব।’

‘অ।’ বনবিহারী চায়ের কাপ তুলে নিলেন, ‘ভালো কথা। কিন্তু অতদিন ছুটি দেওয়া সম্ভব নয়। ওই সদানন্দর হোটেলে দুবেলা খেলে আমার বারোটা বেজে যাবে।’

‘তা আমি কী করব? আপনার কাজে লাগার পর আমি একদিনের বেশি ছুটি কখনও নিয়েছি? আপনি কতকাল সুন্দরবনে গিয়ে পড়ে থাকলেন, আমি তো খেয়ে না খেয়ে আপনার বাড়ি পাহারা দিয়ে গিয়েছি। দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেশে চলে যাইনি তো!’ কালীচরণ ফিরে যেতে যেতে দাঁড়াল, ‘আপনি যদি বলেন তাহলে রান্না আর ঘর পরিষ্কার করার ঠিকে লোকের ব্যবস্থা করে যেতে পারি।’

বনবিহারী বললেন, ‘ভেবে বলব।’

‘চা শেষ করতে করতে ভাবলেন তিনি। খাওয়াটা এমন কোনও সমস্যা নয়। সকালে নিজেই ডাল-ভাত করে নিতে পারবেন। রাত্রে চেম্বার থেকে ফেরার সময় সদানন্দকে বললে সে-ই খাবার পাঠিয়ে দেবে টিফিন ক্যারিয়ারে করে। সমস্যা হবে ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, কাপড় কাচা যা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

গলা তুলে ডাকলেন বনবিহারী, ‘কালীচরণ!’

কয়েক সেকেন্ড বাদে ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়াল কালীচরণ, ‘বলুন।’

‘কবে যেতে ইচ্ছে করছে?’

‘সে যদি বলেন আজই যেতে পারি।’

‘তাহলে চেম্বারে চাবি পৌঁছে দিয়ে যেও।’

‘লোক দেখব কিনা বললেন না?’

‘না। যদি খুব দরকার হয় তাহলে আমি নিজেই দেখে নেব।’ মানিব্যাগ বের করলেন বনবিহারী, ‘গতমাসের মাইনে তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে গেছে। যা ইচ্ছে সেখান থেকে তুলে নিও। আর এই পাঁচশো রাখো, এ মাসের বাবদ।’

কালীচরণ এগিয়ে এসে পাঁচটা একশো টাকার নোট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বনবিহারীর মনে হল, এই কালীচরণকে তিনি চেনেন না। গোড়ার দিকে দেশগাঁয়ের কথা বলেছিল বটে কিন্তু তারপর এত বছরে একবারও নাম করেনি। কালীচরণ সত্যি সেই গ্রামে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ হল তাঁর। তারপরেই ভাবলেন, মরুক গে, যার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাক। এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে ধরে রাখতে পারে না।

বেলা সওয়া বারোটায় যখন চেম্বারভরতি পেশেন্ট তখন কালীচরণ উঁকি মারল। আড়চোখে তাকে দেখতে পেয়ে বনবিহারী বললেন, ‘টেবিলের ওপর রেখে যাও।’

কালীচরণ কোনও কথা না বলে একটা চাবির গোছা টেবিলে রেখে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খুব অসহায় বোধ করলেন বনবিহারী। আচমকা মনে হল তিনি একা হয়ে গেলেন। সেটা অতিক্রম করতে পেশেন্টদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যে পেশেন্ট তাঁর কথা শোনেনি তাকে বিস্তর বকাঝকা করলেন যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। দক্ষিণার টাকা একজন পুরো দিতে পারছিল না, তাকে বললেন, ‘কাল থেকে আর আসতে হবে না, দরকার বুঝলে অন্য ডাক্তার দেখাবে।’

দেড়টা অবধি এরকম চলার পর উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ‘এখন আর নয়। আমাকে আর অনুরোধ করে লাভ নেই। এখন শরীর ভালো লাগছে না, যার দরকার সে বিকেলে আসুক।’

পেশেন্টরাও বুঝল ডাক্তারবাবুর কিছু হয়েছে যা আগে হয়নি। তারাও কথা বাড়াল না।

রাস্তায় নেমে রিকশার জন্যে এপাশ-ওপাশ তাকাতেই বনবিহারী দেখতে পেলেন সদানন্দ হন্তদন্ত হয়ে আসছে। তাঁকে দেখতে পেয়ে দূর থেকে সে হাত তুলল। কাছে এসে সদানন্দ বলল, ‘আমি আগে জানলে অন্য ব্যবস্থা করতে পারতাম। এই কিছুক্ষণ আগে আপনার কাজের লোক এসে বলল, খাবার দরকার। হোটেলের তো সবই রিচ খাবার। শুকনো লঙ্কা না দিলে খদ্দেররা স্বাদ পায় না। তাই শোনার পর আমি ডাল, মানে মুসুরের ডাল, ভাত, আলুভাজা আর পাতলা মাছের ঝোল আপনার জন্যে করে দিতে বলেছি। আপনি বাড়ি যান, আমার লোক পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

‘কালীচরণ আজ দুপুর থেকেই খাবার দিতে বলে গেছে?’

‘তাই তো বলল।’

‘ঠিক আছে। যে নিয়ে যাবে তার হাতে বিল দিয়ে দেবেন। আর রাত্রে দুটো রুটি আর একটু তরকারি পেলেই চলবে। ন’টা নাগাদ চেম্বারে পাঠিয়ে দেবেন।’

‘রাত্রের রান্না হোটেল থেকে যাবে না। ওটা আপনার বউমা করে দেবে।’

‘না, না। তাঁর ওপর বোঝা চাপানোর কোনও দরকার নেই।’ বনবিহারী হাঁটতে লাগলেন।

খালি বাড়িতে স্নান সেরে নিজেই পরনের ধূতি-পাঞ্জাবি ধুয়ে মেলে দিলেন বনবিহারী। কালীচরণের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল তাঁর। আজ দুপুরের খাবারটা তো অনায়াসে করে রেখে যেতে পারত সে। এখন মনে হচ্ছে তাঁকে জব্দ করতেই কালীচরণ কাণ্ডটা করেছে। কিন্তু তাঁর ওপর ওর রাগের তো কোনও কারণ থাকতে পারে না। ক্রমশ মেজাজ খারাপ হচ্ছিল তাঁর।

সদানন্দর লোক সাইকেলে চেপে খাবার দিয়ে গেল, দাম নিল না। বলল, ‘বাবু পরে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।’

টেবিলে খাবার নিয়ে বসে খুশি হলেন বনবিহারী। কালীচরণের চেয়ে রান্না নিশ্চয়ই ভালো হবে, রং দেখে মনে হল তাঁর। মুখে দিয়ে মাথা নাড়লেন, আহা, চমৎকার! একটু বেশি মশলা দেওয়া কিন্তু কালীচরণের সেদ্ধমার্কা রান্না খেয়ে খেয়ে এর স্বাদ ভুলেই গিয়েছিলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর অনেকদিন বাদে বাসনপত্র ধুলেন তিনি। তারপর আর সাহস হল না, দুটো অ্যান্টাসিড বড়ি খেয়ে নিলেন। সাবধানের মার নেই।

আজ রাত ন’টায় চেম্বার বন্ধ করলেন ডাক্তার বনবিহারী। সন্ধে থেকেই যেসব পেশেন্ট তাঁর কাছে এসেছে তাদের অনেকেই বলাবলি করেছে টিভি-রেডিয়োতে নাকি বলেছে খুব জোর ঝড়-বৃষ্টি হবে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। মুখ তুলে দেখলেন আকাশে মেঘ হয়েছে। কালচে মেঘ। এখানে একবার বৃষ্টি নামলে থামতে চায় না, ক’দিন ধরে ভোগায়। কালীচরণ আর সময় পেল না দেশে যাওয়ার। ওর দেশটা যেন কোথায়? এখন নাম মনে করার চেষ্টা করেও বিফল হলেন। আজকাল চট করে পুরোনো নাম মনে পড়ে না।

সদানন্দর দোকানে এখন ভালো খদ্দের। তাঁকে দেখে এগিয়ে এল সে, ‘চেম্বার বন্ধ করেছেন? আমি তো জানতাম সাড়ে ন’টা অবধি আপনি ওখানে আছেন। চলুন।’

‘কোথায়?’

‘আমার বাড়ি।’

‘সেকী! কেন?’

‘আর বলবেন না। দুপুরে দোকান থেকে আপনাকে খাবার পাঠিয়েছি শুনে আপনার বউমার খুব খারাপ লেগেছে। আজকাল, মানে, ওই ঘটনার পরে সে বেশ মেজাজ দেখাচ্ছে কিন্তু আমি একটা কথাও বলি না। বললে যদি জেলে যেতে হয়! তা তিনি বলেছেন, এখন থেকে রাত্রে ওঁর হাতের রান্না খেয়ে তবে আপনাকে বাড়ি যেতে হবে।’ সদানন্দ হাসল।

‘অসম্ভব ব্যাপার। আমার রাতের খাওয়ার কোনও সময় ঠিক থাকে না। পেশেন্টের বাড়ি ঘুরে রাত এগারোটাও বেজে যায়। তা ছাড়া আপনার হোটেলের খাবারের একটা নির্দিষ্ট দাম ধরা আছে। সেইমতো টাকা দিতে পারব। বাড়ির খাবারের দাম কীভাবে ধরবেন?’

‘আমি অত বুঝি না ডাক্তারবাবু। যে বলেছে আপনি তার সঙ্গে কথা বলুন।’ সদানন্দর কথা শেষ হতেই ওর এক কর্মচারী এসে জানতে চাইল, ‘ক’টা অবধি দোকান খোলা থাকবে?’

‘যতক্ষণ খদ্দের বা খাবার থাকবে।’ সদানন্দ বিরক্ত হয়ে বলল।

‘কিন্তু খুব বৃষ্টি আসছে যে—!’

‘অ। দ্যাখো, বুঝে নিয়ে কাজ করো। আমি যাচ্ছি।’ বলে বনবিহারীকে বলল, ‘দোকানের খাবারের দাম যা হোক দিয়ে দেবেন। বাড়িরটার ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলবেন।’

‘তা হয় না সদানন্দবাবু। আপনি বউমাকে বুঝিয়ে বলুন। তা ছাড়া আজ দুপুরে খাওয়ার পর একটু হজমের গোলমাল হয়ে গেছে। রাত্রে কিছু না খাওয়াই মঙ্গল হবে। খুব দরকার বোধ করলে দুধ খেয়ে নেব।’ পকেটে হাত দিয়ে কুড়িটা টাকা বের করে সদানন্দের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি, ‘নিতে আপত্তি করার কারণ নেই। দোকানের খাবার তো দান করার জন্যে নয়।’

রিকশায় বাড়ি ফিরে তালা খুলতে না খুলতে প্রথম ফোঁটাটা পড়ল। বনবিহারী ঘরে না ঢুকে বারান্দায় দাঁড়ালেন। বাইরে পাতলা অন্ধকার। দূরের রাস্তার আলোর কারণে ওটা ঘন হয়নি। আকাশ থেকে দু-একটা ফোঁটা এপাশে-ওপাশে পড়ছে। পড়ামাত্র মাটি নিশ্চয়ই শুষে নিচ্ছে। একটু বাদে অন্ধকারে সোঁদা গন্ধ বের হল। মাথার ওপর তাকালেন তিনি। তাতে মুখটা বাইরে বের করতে হল। টপ করে একটা ফোঁটা পড়ল কপালে। না, কোনও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না।

এখন চারপাশে মাটির গন্ধ। এই গন্ধ ভারী ভালো লাগল বনবিহারীর। তারপরেই একটা বাতাস ঢেউয়ের মতো বয়ে যেতেই তিনি বাড়ির ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। জামাকাপড় ছাড়ার সময় বৃষ্টিটা তেমন আওয়াজ করছিল না। মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রিজ খুলে দেখলেন দুধের পাত্রটা অর্ধেক ভরা আছে। ওটাকে বাইরে বের করে রাখলেন। বদহজমে ঠান্ডা দুধ বেশ উপকার করে। চেয়ারে বসে মাথা নাড়লেন তিনি। নাঃ, এভাবে চলবে না। কালীচরণ যদি জেদের বশে চলে যেতে পারে তাহলে তিনিই বা কেন কাজের লোক রাখতে পারবেন না? এখানকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। তিনি চাইলে এরা নিশ্চয়ই একজনকে জোগাড় করে দেবে। আর সেটা কালকেই চাইবেন।

এই সময় তাঁর মনে হল বাইরের দরজার কড়া কেউ নাড়ছে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আওয়াজটা কানে এল। এত রাত্রে একমাত্র পেশেন্টের লোক ছাড়া কেউ তাঁর বাড়িতে আসে না। নিশ্চয়ই কোথাও কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অসুস্থ হওয়ার আর সময় পেল না। উঠে দাঁড়ালেন বনবিহারী। এইরকম বৃষ্টির রাতে আজকাল তিনি রোগী দেখতে বের হন না। এরকম রাতে কেউ এলেই বহুবছর আগের সেই রাতের কথা মনে পড়ে যখন তাঁকে সাইকেলে বসিয়ে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই রাতে না গেলে তাঁর জীবনে সন্তান আসত না। শব্দটা আরও জোরালো হলে তিনি বাইরের ঘরে এসে আলো জ্বাললেন, ‘কে?’

‘ডাক্তারবাবু, আমি, আমরা!’

‘না ভাই, সকালে আসুন। এই বৃষ্টিতে আমার পক্ষে রোগী দেখতে যাওয়া সম্ভব নয়।’

‘ডাক্তারবাবু, আমি সদানন্দ, হোটেলের সদানন্দ!’

হকচকিয়ে গেলেন বনবিহারী। দ্রুত দরজা খুলে দেখলেন সদানন্দ আধভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওপাশে ঘোমটা মাথায় যে রমণী সে যে ওর বউ তাতে সন্দেহ নেই।

‘কী ব্যাপার?’ কোনওমতে প্রশ্ন করলেন বনবিহারী।

‘আর বলবেন না। আমি বাড়িতে গিয়ে যখন বললাম আপনি রাতের খাবার খেতে আসবেন না তখন খেপে গিয়ে যা তা বলতে লাগল। আমিই নাকি ঠিকঠাক আপনাকে বোঝাতে পারিনি, দোষ আমার। কী বলব ডাক্তারবাবু, মেয়েছেলে যদি চোখ রাঙিয়ে কথা বলে তখন মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিন্তু জেলে যাওয়ার ভয়ে নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত করে রাখলাম। আমার বাপ-ঠাকুদরা এটা করতে পারত না। তো কী বলব, শেষে বায়না ধরল, নিজের হাতে বানানো খাবার আপনাকে পৌঁছে না দিলে ও শান্তি পাবে না। এত রাত্রে লোক পাই কোথায়? আমার আবার নিশুতি নির্জন পথে একা আসতে ভয় লাগে।

ও সঙ্গে আসতে চাইল। সাইকেলে চাপিয়ে আসতে আসতেই বৃষ্টি নেমে গেল।’ সদানন্দ থামল।

‘ছি, ছি, এসব কেন করলেন? এই ঝড়-বাদলায় কেউ বের হয়?’ বনবিহারী বললেন।

ঘোমটার আড়াল থেকে কাপড়ে বাঁধা একটা পুঁটুলি বেরিয়ে এল, ‘খেয়ে নেবেন।’

‘নিশ্চয়ই খাব, একশোবার খাব। কিন্তু আপনারা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন। আসুন, ভেতরে আসুন।’ পুঁটুলিটা নিয়ে বনবিহারী ভেতরের ঘরে চলে এলেন। ওটাকে খাওয়ার টেবিলের ওপর রেখে বললেন, ‘কী অন্যায় কথা। এরকম সময়ে—।’

তখনই প্রচণ্ড শব্দে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। সদানন্দর বউ মুখে হাত চাপা দিয়েও চিৎকারটাকে থামাতে পারল না। বনবিহারী দেখলেন মেয়েটার মাথা থেকে ঘোমটা খসে গেছে, থরথর করে কাঁপছে দাঁড়িয়ে।

‘সদানন্দবাবু ওঁকে চেয়ারে বসিয়ে দিন।’

সদানন্দ স্ত্রীকে চেয়ারে বসালে বনবিহারী বললেন, ‘আহা, ভয়ের তো কিছু নেই। ঘরের মধ্যে তো বাজ পড়বে না।’

সদানন্দ হাসল, ‘বাজের আওয়াজ ও সহ্য করতে পারে না।’

‘আপনাদের নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়া হয়নি?’

‘না। দোকান থেকে ফিরতেই তো এই কাণ্ড!’

‘তাহলে দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি ফিরে যান।’ বনবিহারী বললেন।

সদানন্দ বাইরের ঘরে গিয়েই ফিরে এল, ‘চারপাশ এখন সাদা হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি না কমলে ডবলক্যারি করে চালানো মুশকিল হবে।’

‘এটা আপনাদের ভাবা উচিত ছিল। আর বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বরে পড়বেন।’

সদানন্দ স্ত্রীর দিকে তাকাল, ‘এই জন্যেই বারংবার নিষেধ করেছিলাম। কথা কানে গেলে তো! সাইকেলে এখানে পড়ে থাক। চল ভিজে ভিজে হেঁটে চলে যাই।’

ততক্ষণে সদানন্দর স্ত্রী একটু ধাতস্থ হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘রান্নাঘর কোথায়?’

‘কেন?’ বনবিহারী তাকালেন।

‘বলুন।’

‘ওই ওপাশে।’

সদানন্দর বউ সেদিকে গিয়ে সুইচ অন করে আলো জ্বেলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল একটু বাদেই একটা থালা আর এক গ্লাস জল নিয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলে রাখল। তারপর পুঁটুলি খুলে একটু ভাত, দুটো রুটি, ডাল, ভাজা তরকারি আর মাছের ঝোলের বাটিগুলো থালার চারপাশে সাজিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন।’

‘তোমরা খাওনি, আমি কী করে খাব?’

‘আপনি খেতে শুরু করুন, আমরা বাড়ি ফিরে খেয়ে নেব।’ সদানন্দ বলল।

অগত্যা খাওয়া শুরু করলেন বনবিহারী। কালীচরণের রান্না নয়, হোটেলের মশলা দেওয়া রান্না নয় কিন্তু স্বাদে অতি উত্তম। মাথা নাড়লেন খেতে খেতে।

সদানন্দর বউ বলল, ‘আমাদের ওখানে গিয়ে খেতে অসুবিধে হলে আপনার চেম্বারেই রাত ন’টার মধ্যে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু দুপুর বেলায় কী হবে?’

বনবিহারী হাসলেন, ‘খুব ভালো হয় যদি একজন রান্নার লোক জোগাড় করে দাও।’

‘ঠিক আছে। যতদিন তাকে না পাই দুপুরের খাবারও চেম্বারে পাঠিয়ে দেব।’

‘এবার যেতে হয়।’ সদানন্দ বলল।

এঁটো হাতেই উঠে দুটো ছাতা নিয়ে এসে দুজনকে দিলেন বনবিহারী, ‘নিয়ে যাও, এতে কম ভিজবে।’

সদানন্দ খুশি হল। ওর বউ ছাতা হাতে নিয়ে বনবিহারীর দিকে তাকাল, ‘একটা কথা বলতে চাই।’

বনবিহারী চুপ করে রইলেন। সদানন্দ একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল।

‘আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। তারপর পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু তারপর থেকে যদি ক্রমাগত শুনতে হয় যে আমি আত্মহত্যা করলে ওকে জেলে যেতে হবে বলে সব কিছু গিলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তখন মনে হয় আপনি না বাঁচালেই ভালো করতেন।’ কথাগুলো শেষ করে দ্রুত বাইরের ঘর দিয়ে বেরিয়ে গেল সদানন্দর বউ। একটু ইতস্তত করে ছাতি নিয়ে ছুটল সদানন্দ।

খাওয়া শেষ করে বাইরের দরজা বন্ধ করতে এলেন বনবিহারী। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেয়েটি এই দুর্যোগ মাথায় করে তাঁকে খাবার দিয়ে গেল! কেন? শুধু তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বলে? কৃতজ্ঞতা? মাথা নাড়লেন বনবিহারী। বোধহয় তা নয়। যেটুকু খেয়েছিল তাতে প্রাণে মারা যেত না ও। হয়তো বেশ কিছুদিন ভুগত। কিন্তু পুলিশকে সরিয়ে দিয়েছিলেন জানার পরেই ও বুঝতে পেরেছে কী ভুল করতে গিয়েছিল। সেই জানতে পারার কারণে তাঁর ভালো করার বাসনা তীব্র হয়েছে। বেচারা সদানন্দ। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু এটা আর বেশি হতে দেওয়া অনুচিত হবে। কাল থেকে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন বনবিহারী। বৃষ্টির আড়াল ভেদ করে দুটো ঝাপসা আলো এই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ওটা যে গাড়ির হেডলাইট তা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হল। এই সময়ে তাঁর বাড়িতে গাড়ি নিয়ে কে আসছে?

প্রায় নৌকোর মতো গাড়িটা তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে যিনি নামলেন তাঁকে চিনতে অসুবিধে হল না। থানার মেজবাবু। পরনে এখন ইউনিফর্ম নেই।

‘নমস্কার ডাক্তারবাবু। এত রাত্রে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে, কাউকে এক্সপেক্ট করছেন নাকি?’ এ এস আই দৌড়ে বারান্দায় চলে এসে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘বৃষ্টি দেখছিলাম। আপনি?’ বনবিহারী শীতল হলেন।

‘আর বলবেন না। বৃষ্টি-ফিস্টি দেখার মন চলে গিয়েছে। আমাকে আসতে হল আপনার কছে। বড়বাবু ঝামেলায় আছেন বলে আসতে পারলেন না।’ মেজবাবু বললেন।

‘কী ব্যাপার?’

‘আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে।’ মেজবাবু রুমালে চুল মুছলেন।

‘কেন?’

‘বড়বাবু বললেন, একজন পেশেন্টকে দেখার জন্যে আপনাকে নিয়ে যেতে।’

‘পেশেন্ট? থানায় পেশেন্ট?’

‘আর বলবেন না। আমাদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে।’

‘কিন্তু আমি এরকম ঝড়-বাদলের রাত্রে পেশেন্ট দেখতে যাই না।’

‘ছেলেটাকে এখানে নিয়ে আসা যে সম্ভব নয়। গাড়িতে যাবেন, দেখবেন, তারপর চলে আসবেন। বেশিক্ষণ তো লাগবে না।’

‘না। বড়বাবুকে বলবেন কাল সকালে যেতে পারব।’

‘ডাক্তারবাবু, ছেলেটা উন্ডেড। কিন্তু ওটা কতখানি তা বোঝা যাচ্ছে না। যদি সিরিয়াস কিছু হয় তাহলে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। না হলে ওকে নিয়ে আজই আমরা একটা রেইডে বের হব। আপনি দেখলে সিদ্ধান্ত নেবেন বড়বাবু। যদি হাসপাতালে না পাঠানো হয় আর ব্যাটা মরে যায় তাহলে বহুৎ ঝামেলায় পড়তে হবে আমাদের।’ মেজবাবু হাসলেন। হেসে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।

বাধ্য হলেন বনবিহারী। দরজায় তালা লাগিয়ে খানিকটা ভিজে গাড়িতে উঠলেন তাঁর ব্যাগ নিয়ে। মেজবাবু সামনের সিটে বসে সিগারেট টানছিলেন। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে বনবিহারী বললেন, ‘গাড়ির কাচ নামানো যাবে না বৃষ্টির জন্যে, দয়া করে সিগারেট খাবেন না।’

‘ওঃ। সরি।’ সিগারেট বাইরে ফেলে দিলেন মেজবাবু।

বৃষ্টিতে গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছিল ড্রাইভারের। পিচের রাস্তায় ওঠার পরও গতি বাড়াতে পারেনি। কিছুক্ষণ চলার পর বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছেলেটি আহত হল কী করে?’

‘গুলিতে। পালাতে চেষ্টা করেছিল, পারেনি।’

‘কী করেছিল সে?’ বলেই মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘ঠিক আছে।’

মেজবাবু কথা বললেন না। বনবিহারী ভেবে পাচ্ছিলেন না। এই অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর কোনও উগ্রপন্থীর আনাগোনার কথা তিনি শোনেননি। থানায় ঢুকে ছেলেটিকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। বেঞ্চিতে শুয়ে থাকলেও মনে হল একে কোথাও দেখেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *