কাঞ্চনের দুঃখ
বাবা ডাকলেন, কাঞ্চন, এই কাগজটা নিয়ে যাও।
কাঞ্চনের কোনো সাড়া নেই।
কাঞ্চন, কাঞ্চন! বাবার গম্ভীর গলা গমগম করতে লাগলো, কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। বাবা ইজি—চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে এসে বললেন, রত্না, দ্যাখ তো, কাঞ্চন নিচে আছে কি না।
একটু খুঁজে এসে রত্না বললো, না, কাঞ্চন তো নিচে নেই। কোথায় গেলো?
কাঞ্চনকে বিষম ডাকাডাকি পড়ে গেলো। ঠাকুর, চাকর, ছোটকাকা, দিদি, বাবা সকলে ডাকছে, কাঞ্চন, কাঞ্চন! না কাঞ্চনের কোনো পাত্তা নেই। সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
বাইরে গেছে কি?
না, কাউকে বলেনি তো। না বলে সে তো কখনো কোথাও বেরোয় না।
কে কাঞ্চনকে শেষ দেখেছে? কেউ মনে করতে পারছে না। দুপুরে খাবার পর কেউ কাঞ্চনকে দেখেনি। তবে কাঞ্চন গেলো কোথায়?
এক ঘণ্টা বাদেও যখন কাঞ্চনকে পাওয়া গেল না, তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। একতলা—দোতলার ঘর সব খোঁজা হলো, বাথরুমে, ছাদের ঘরে; এমনকি দিদি জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির অনুপমকে জিজ্ঞেস করলেন, কাঞ্চনকে দেখেছে কি না।
কোথায় কাঞ্চন!
থানায় খবর দেওয়া হলো, হাসপাতালে টেলিফোন। বাবা রেগে গেলে গম্ভীর হয়ে যান। তাঁর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু বাড়িতে কাঞ্চনকে নিয়ে ব্যস্ত সাড়া—শব্দ পড়ে গেছে। ও কোথায় যাবে, কেনই বা যাবে। তবে কি কেউ ওকে ভুলিয়ে—ভালিয়ে নিয়ে গেলো? না, ও তো বেশ চালাক ছেলে—এগারো বছর বয়েস। বিকেল বেলা মাসিমারা এলেন; নিমুদা, সত্যদা, বড়ো জ্যাঠামশাই, ছোটো কাকার বন্ধুরা সব এসেছে, অনেক দিন কাঞ্চনদের বাড়িতে এত লোক আসেনি।
ছাদের আলসে ধরে দাঁড়িয়ে বেলামাসি ছোড়দিকে বললেন, ভাবতেও বুক কেঁপে ওঠে। কোথায় গেল রে ছেলেটা? শুনেছি নাকি গুণ্ডাগুলো ছোট ছেলেদের ধরে ভিখিরি করে দেয়! কাগজে বিজ্ঞাপন দিবি নাকি রে টুলু? হঠাৎ কি ভেবে আঁচলে চোখ চাপা দিয়ে বেলামাসি খানিকটা কেঁদে ফেললেন। তারপর বললেন, আমার আবার রাত্তিরের দিকে মাথা ঘোরে। পাওয়া গেলে খবর দিস কিন্তু।
বাবা কোথায় খুঁজতে গিয়েছিলেন কে জানে, দশটার পর বাড়ি ফিরে এলেন। কারুর সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘরে আলো জ্বলতে দেখা গেলো। মাঝে মাঝে জানলার কাছে ছায়া পড়ছে। তিনি পায়চারি করছেন। কাঞ্চন জানতো, ওকে কেউ খুঁজে পাবে না।
যদি কেউ নিজে হারিয়ে যেতে চায়, তবে কেউ তাকে আটকাতে পারে না ও জানে। ছাদের পাঁচিল ডিঙিয়ে কার্নিসের উপর শুয়ে আছে কাঞ্চন। পাশের মিত্তিরদের বাড়ির ছাদে জলের ট্যাঙ্কটা খানিক বেরিয়ে আছে। সেখানে অন্ধকার মতন! ওখানে কাঞ্চন আছে কারুর পক্ষে ভাবাও সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে কাঞ্চন নিচের গলির দিকে তাকাচ্ছিলো। যদি একবার পড়ে যায়, তবে এমন জায়গায় ও হারিয়ে যাবে যেখানে ও নিজেই নিজেকে খুঁজে পাবে না।
দুপুরবেলা খাবার পর সকলেই যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, কাঞ্চন তখন এক পাউন্ড পাউরুটি আর রেফ্রিজারেটার থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিলো। কারুর ওপর রাগ করে আসেনি, ভয় দেখাবার জন্যও নয়। মজা করতে চায়নি কাঞ্চন। ঠিক কেন এসেছে ও নিজেই জানে না। এমনিই, হঠাৎ ওর মনে হলো সকলের চোখের আড়ালে একা হয়ে যাই। তাই বেছে বেছে এখানে এসেছে। বিদেশে যায়নি, রেলে—স্টিমারে যায়নি, এখান থেকে বাড়ির সকলের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, দেখাও যাচ্ছে কে কী করছে কিন্তু তবু যেন কতদূরে আছে কাঞ্চন, অন্য জগতে।
বেশ লাগছে এখানে। ভয়—ভয় করছে, আর সেই ভয়ের নেশাতেই ভালো লাগছে। অবশ্য হঠাৎ পড়ে, যাবে না কাঞ্চন। কোমরের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ছাদের পাঁচিলের সাথে বেঁধে রেখেছে। বিকেলের দিকে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও। খানিকটা বাদে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উপরের আকাশের দিকে চেয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যেন চারপাশের এক বিশাল শূন্যের মধ্যে ও শুয়ে আছে। আকাশের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরই ভয় কেটে গিয়ে কাঞ্চনের ভালো লাগতে লাগলো।
ছেলেবেলায় চন্দননগরে ওর মামাবাড়িতে কিছুদিন ছিলো কাঞ্চন। গঙ্গার ধারে রাজপ্রাসাদের মতো বড়ো বাড়ি। সামনে বিশাল বাগান। সেই বাগানে একবার সারাদিন একটা গোলাপ ফুলের চারার পাশে বসে ছিলো কাঞ্চন। ওর ইচ্ছে ছিলো কুঁড়ি থেকে কী করে আস্তে আস্তে একটা ফুল ফোটে তাই দেখবে।
সেবার দেখা হয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মা এসে ওকে কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো বিছানায়।
কাঞ্চনের মনে হলো, আজও যেন সে সেই রকম এক বাগানের মধ্যে শুয়ে আছে। বিকেলবেলায় ধুলো রঙ কেটে গিয়ে এক—একটা তারা ফুটলো আকাশে। ঠিক যেন ফুল ফুটছে। কোনো চিরহরিৎ গাছের ফুল এগুলো, শুকোয় না, ঝরে না। আকাশটা টলমলে নীল, মা ঠিক এই রঙের শাড়ি পরতে ভালবাসতেন। গায়ে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে। কোত্থেকে আসে হাওয়ারা? কোথাও কি হাওয়াদের দেশ আছে? এই হাওয়া মায়ের হাতের ছোয়ার মতো। মা কি তাকে আজও কোলে করে তুলে নিয়ে যাবেন?
কাঞ্চন হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর এই কান্না দিয়ে সে যেন অস্ফুট গলায় কারো বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চাইলো, অথচ একটা কথাও ওর গলা দিয়ে বেরুেলো না। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগতে লাগলো কাঞ্চনের অভিমানী মুখে।
সে মনে মনে বললো, মা, আমাকে তুমি একেবারে একা করে দিলে। আমি যে বিষম একা। বাড়িতে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ বলছে, কাঞ্চন, পড়াশুনা কর; কেউ বলছে, কাঞ্চন, খেয়েছিস; কেউ বলছে, কাঞ্চন, জামা—কাপড় গুছিয়ে রাখ; ব্যস, আর কিছু না। কতদিনে আমি তত বড়ো হবো যখন নিজেকে নিয়ে নিজে ব্যস্ত থাকতে পারবো? বাড়ির সব ঘরগুলো ফাঁকা, সব লোকগুলো ফাঁকা। মা, আমি কারুর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি না।
সারাদিন বাড়ির সকলকে কাঞ্চন খোঁজাখুঁজি করতে, ব্যস্ত হয়ে ছুটতে দেখেছে। তবে কি ওরা তাকে ভালোবাসে? বড়োদের মনের কথা বুঝতে পারা যায় না। ছোটকাকা সব সময় ওকে বকুনি দেয়, আজ কেন এত ছোটাছুটি করছিলো? একরকমভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে কাঞ্চনের শরীর ব্যথা করতে লাগলো। পাশ ফিরে শুতে পারছে না, যদি দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায়। অসম্ভব ক্ষিদেও পেয়েছে, কিন্তু শুকনো পাঁউরুটি চিবোতে ইচ্ছে করছে না। ওর উচিত ছিলো খানিকটা মাখন কিংবা জেলি নিয়ে আসা। কাঞ্চন কোনোদিন শুধু পাঁউরুটি খায়নি।
একটা পুলিশের গাড়ি তাদের বাড়ির সামনে থামলো। একজন দারোগা কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে নেমে ওদের দরজায় কড়া নাড়লো। বাবা বেরিয়ে এলেন। কাঞ্চন যথাসম্ভব শরীর বেঁকিয়ে, মুচড়ে দেখবার চেষ্টা করলো! ওরা কী যেন বলাবলি করলো, তারপর দারোগাটি হা—হা করে হেসে বললো, এই নিন আপনাদের ছেলে। বোম্বে যাবে ঠিক করেছিলো। গাড়ি থেকে একটা ছেলেকে ওরা নামিয়ে আনলো।
ভয়ে—দুঃখে কাঞ্চনের শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। অনেকটা কাঞ্চনের মতোই দেখতে। যদি বাবা—কাকা—দিদি ওকেই কাঞ্চন বলে মেনে নেয়? যদি এই ছেলেটি এখন থেকে কাঞ্চন হয়ে থাকে, ওর জামাকাপড় পরে, ওর বই নিয়ে ইস্কুলে গিয়ে ওরই জায়গায় বসে? তাহলে আমি কে হবো? আমার নাম কী হবে? আমি যদি তখন বাবার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলি, বাবা আমাকে কী শাস্তি দেবেন দিন, কিন্তু আমিই আপনাদের কাঞ্চন! তখন কেউ কি আমাকে বিশ্বাস করবে? মা ছাড়া আমাকে আর কেউ চিনতে পারবে না। মা আমার শরীরের গন্ধ শুঁকে আমাকে চিনতে পারতেন।
একটু বাদে পুলিশের গাড়িটা চলে গেলো। না, ওরা সেই ছেলেটাকে নেয়নি। বাবা এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ছেলেটা আবার গাড়িতে উঠলো। ঘ্যান ঘ্যান করে বিশ্রী সুরে ছেলেটা কাঁদছিলো, যেন এখান থেকে ফিরে যাওয়া ওর পছন্দ হয়নি।
কাঞ্চনের ইচ্ছে হলো, এবারও উঠে গিয়ে ওর নিজের নরম বিছানায় শুয়ে পড়ে। এখন কত রাত হলো কে জানে। কিন্তু ফিরে গেলে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ও কী বলবে? কেন ও চলে গিয়েছিল? কেন ও ফিরে এলো? ও কি সকলকে বলবে, তোমরা সকলে আমার সঙ্গে আরেকটু বেশি কথা বলো! না, এ—কথা কাউকে বলা যায় না। শুতে শুতে কাঞ্চন আবার সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।
এক—এক করে কলকাতার সব বাড়ির আলো নিবে গেলো। কাঞ্চনের ছোট্ট শরীরটা ডুবে গেল ঘন অন্ধকারে। পাঁউরুটির গন্ধে কোত্থেকে এক ঝাঁক পিঁপড়ে এলো সেখানে। পিঁপড়েগুলো কাঞ্চনের সারা গায়ে ঘুরতে লাগলো।
খানিকটা বাদে আবার কাঞ্চনের ঘুম ভাঙলো। ঠাণ্ডা লাগছে, মশা কামড়াচ্ছে, পিঁপড়ে ঘুরছে সারা গায়ে। ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে দড়িতে টান পড়লো। আবার অভিমানে তার কান্না পেলো, কিন্তু সে কাঁদবে না। অতি কষ্টে খুব সাবধানে দড়ি খুলে কাঞ্চন পাঁচিল টপকে ছাদের এ—পাশে এলো। তারপর এগুতে গিয়ে দেখলো সিঁড়ির দরজার কাছে কে বসে আছে। মা নাকি? না, মা নয়। মায়ের শরীর কাঞ্চন নিজের চোখে পুড়ে যেতে দেখেছে। রত্না বসে আছে। বাড়ির সকলকে সে শুধু শুধু দুঃখ দিয়েছে এই ভেবে কাঞ্চন লজ্জা পেলো।
আস্তে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে লাজুক গলায় বললো, দিদি, এই দিদি।
রত্না কান্নাভরা চোখ তুলে ওকে দেখলো, তারপর বললো, এত রাত্রে এখানে কী করছিস? যা শুয়ে পড়।
কাঞ্চন অবাক হয়ে গেলো।
তক্ষুনি রত্না আবার চোখ তুলে বললো, একি! কোথায় ছিলি সারাদিন? শুধু শুধু আমাদের ভাবনায় ফেলেছিলি।
তাড়াতাড়ি রত্না চোখ মুছে নিলো, তারপর বললো, দিন দিন গুণধর দস্যি হচ্ছো। চলো বাবার কাছে। রত্না অন্য কথা ভাবছিলো। অন্য কোনো অজানা দুঃখে এত রাত্রে সে ছাদের সিঁড়িতে বসে একা কাঁদছিলো, কাঞ্চনের জন্য নয়।
দিদির হাত ধরে কাঞ্চন ফাঁকা বুক নিয়ে নিচে নেমে এলো। আমাদের বাড়ির সবাই একা, কাঞ্চন ভাবলো। বাবা নিজের ঘরে পায়চারি করছেন, দিদি ছাদের সিঁড়িতে বসে কাঁদছে, ছোট কাকা নিজের ঘরে কি করছেন কী জানি। দিদির পাশে শুয়ে থাকলেও আমকে একাই থাকতে হবে যতদিন না আমি বড়োদের মতো কোনো গোপন দুঃখ নিয়ে ভুলে থাকতে পারি।