কাঞ্চনপুর-রহস্য

কাঞ্চনপুর-রহস্য

হত্যা সম্বন্ধে সাধারণের আগ্রহ প্রায়ই দেখা যায় ভ্রমাত্মক অথবা আমার মতে, ভ্রান্তির সম্ভাবনা বিশিষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ সেই সামন্তঘটিত কাহিনিটাই ধরা যাক। সতের বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল এবং এখনও সে ঘটনা প্রত্যেকের কাছে যেন গতদিনের স্মৃতি–এখনও জনসাধারণ সে কাহিনি নিয়ে গভীর আগ্রহে আলোচনা করে। তবুও যে-কোন দিক দিয়ে বিচার করাই যাক না কেন, কোনও মতেই এটাকে প্রথম শ্রেণির হত্যাপর্যায়ে ফেলা যায় না। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই রকম?

ইন্ডিয়ান কেমিক্যালস কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী মিঃ কে. ডি. সামন্ত জীবন-সঙ্গিনীরূপে পেয়েছিলেন একজন অতি খিটখিটে এবং বদমেজাজী মহিলাকে। কাজেই তাঁর অন্তরের যে গভীর অনুরাগ স্ত্রীর প্রাপ্য ছিল–সেই অনুরাগের সবটুকুই দিলেন তার সুন্দরী টাইপিস্ট মিস সান্যালকে। আর তারপর তিনি মিসেস সামন্তকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করলেন এবং দেহটিকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে কয়লার গাদার নীচে সমাধিস্ত করলেন। প্রাথমিক হলেও এই অবধি ব্যাপারটা করলেন তিনি সুন্দরভাবে; আর এরপর যদি মূর্খ মিস্টার সামন্ত আর কুটোটি না নেড়ে চুপচাপ থাকতেন, তাহলে সুখেই সারা জীবনটা কাটিয়ে ইহলোক ত্যাগ করতেন। কিন্তু কিসের তাগিদে জানি না নির্বোধের মতো তিনি বাড়ি থেকে উধাও হলেন–প্রেমিকার সঙ্গে ছদ্মবেশে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রা করলেন। এই কাজটি যদি তিনি না করতেন, তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় এই হত্যাটিকে অতুলনীয় আখ্যা দিতে বিলম্ব করতাম না। পরিণামে কি হল? বেতারের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় পুলিশ তাকে জাহাজেই গ্রেপ্তার করলে। এই হত্যা-ঘটিত বিষয়ে এইটুকুই হল সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক–কিন্তু জনসাধারণ এখনও পর্যন্ত এই অপ্রাসঙ্গিকটুকু নিয়েই করছে মাতামাতি। একজন বিখ্যাত চিত্রসমালোচক যখন কোনও চিত্র সম্বন্ধে একটি প্রথম শ্রেণির সমালোচনা করেন, তখন অল্পজনেই তা পড়ে। কিন্তু যেই কোনও সবজান্তা সংবাদদাতা খবর দেয় যে চিত্রশিল্পী ক্যানভাস সাজানোর সময়ে শেক্সপীয়ারের সনেট আবৃত্তি করতে থাকেন অথবা একাহারী হয়ে এই সব বিখ্যাত চিত্র সৃষ্টি করেন–তখনই সমস্ত জগৎ একবাক্যে স্বীকার করে যে, তিনি বড় দরের শিল্পীই বটে।

যা অপ্রয়োজনীয়, তা আর কিছু করতে না পারলেও অকৃত্রিম সত্যটুকুকে চিরকালই অস্পষ্ট করে তোলে। জনতা যদি মিথ্যার পেছনে ধাওয়া করে, তাহলে সত্য তো অবহেলিত হবেই। সুতরাং বুদ্ধিভ্রষ্ট মিঃ সামন্তর জটিল কার্যকলাপ যখন সংবাদপত্র প্রায় ভরিয়ে রেখে দিয়েছে, সেই সময়ে অত্যাশ্চর্য আলিপুর-হত্যা-রহস্যকে স্থান দেওয়া হল কাগজে চক্ষুর অগোচরে ক্ষুদ্র এক কোণে। বাস্তবিকই, খুঁটিনাটি তথ্যগুলি থেকে এমন ভাবে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল যে, এই স্মৃতিতে তা গেঁথে নেই; ঘটনাটা প্রায় এই : আলিপুরের ছোটখাটো একটি ফ্ল্যাটের দোতলায় একজন যুবক একটি অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলছে, অভিনেত্রীর বয়সের সীমারেখা, যতদুর আমার মনে পড়ছে, তিরিশ কি চল্লিশের মধ্যে হবে এবং বিগতযৌবনা হওয়ার পরিণামস্বরূপ চিত্রজগতেও খ্যাতি বিলীন হয়েছে অনেকদিন। কথাবার্তার মাঝখানে আচম্বিতে শোনা গেল একটা ফায়ারিংয়ের শব্দ–খুব কাছ থেকেই। যুবকটি ফ্ল্যাট থেকে ছিটকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল এবং বাড়ির সদর দরজায় দেখতে পেল একটি মৃত পুরুষকে তার আপন পিতা–গুলি তাঁর বক্ষে বিদ্ধ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, পিতাও এক সময়ে অভিনেতা ছিলেন এবং ওপরতলার অভিনেত্রীটি তার পুরোনো বান্ধবী। কিন্তু তারপরেই আসছে হত্যার অভিনব এবং আশ্চর্য অংশটুকু। মৃতের পাশে অথবা মৃতের হাতে কিংবা মৃতের কোটের পকেটে–আমার ঠিক মনে পড়ছে না কোনওখানে–ভারি তারের তৈরি একটা অস্ত্র পাওয়া গেল–জঘন্য এবং অত্যন্ত সাংঘাতিক এক মারণাস্ত্র, নিখুঁত নৈপুণ্যে অতি অদ্ভুতভাবে গঠন করা হয়েছে সেই বিচিত্র অস্ত্রটি। তখন রাত্রি, কিন্তু প্রতিপদের শুভ্র চন্দ্রকিরণে চতুর্দিক আলোকিত। যুবকটি বললে, একজনকে সে দৌড়ে গিয়ে পাঁচিল টপকে পালাতে দেখেছে।

কিন্তু লক্ষ্য করুন পয়েন্টটি? মৃত অভিনেতা তাঁরই পুরোনো বান্ধবীর ফ্ল্যাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন, অন্তরালে থেকে অপেক্ষা করছিলেন, হাতে ছিল তার সেই নির্মম অস্ত্রটি। তিনি কোনও শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার প্রত্যাশায় ছিলেন। যাকে খুন করবার অভিপ্রায় না থাকলেও যার মারাত্মক অনিষ্টের অভিপ্রায় নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিলেন।

কে সেই শত্রু? মৃত ব্যক্তির বর্বর ও সুচিন্তিত অভিপ্রায়ের চেয়েও দ্রুতগামী ওই বুলেটটি কার দ্বারা নিক্ষিপ্ত?

খুব সম্ভব আমরা কোনওদিন তা জানতে পারব না, যে হত্যা প্রথম শ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার উপযুক্ত ছিল, যে হত্যা বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার দিক দিয়ে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করতে পারত, সেই হত্যাই বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যেতে বাধ্য হল–মূর্খ জনতা ততধিক মূর্খ সামন্ত আর তার প্রেমিকাকে নিয়ে সৃষ্টি করলে বছরব্যাপী আলোচনার।

স্বভাবতই এই ধরনের অবহেলার জন্য যুদ্ধ অনেকাংশে দায়ী। সেই আতঙ্কভরা দিনগুলিতে মানুষের মাথায় শুধু একটি চিন্তাই জাগ্রত ছিল–বাদবাকি সব হয়েছিল উপেক্ষিত। সুতরাং ঢাকুরিয়া লেকে যত্ন করে বস্তায় জড়ানো মৃত মহিলাটির বিকৃত দেহটির ওপর খুব অল্পই মনোযোগ দেওয়া হল এবং বেশি বাগাড়ম্বর না করে একটি লোককে ফাঁসিতে দেওয়া হল ঝুলিয়ে। এ কেসে দু-একটি চিত্তাকর্ষক পয়েন্ট প্রত্যেকেরই দৃষ্টি গেল এড়িয়ে।

আর, তারপর শোনা গেল ভবানীপুরে এক আশ্চর্য হত্যা-কাহিনি। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার একটা বড় বাড়িতে নতুন ভাড়া এলেন। তখনও তাঁদের সমস্ত মালপত্র খোলা হয়নি–একরাত্রে গৃহকর্তাকে কে খুন করে কয়েকটি জিনিস নিয়ে সরে পড়ল। লুণ্ঠন সামগ্রীর মধ্যে ছিল কী? একজোড়া বুট জুতো, খুব জোর, পনের টাকার বেশি দাম হওয়া উচিত না। আর একটি ঘড়ি–সেটার দামও পঁচিশ টাকার ওদিকে নয়। এক্ষেত্রেও হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করে বিনাবাক্যব্যয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। আর বলতে বাধ্য হচ্ছি, তার গতিবিধির যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ছিল। কিন্তু যুদ্ধপূর্ব অথবা যুদ্ধকালীন যাবতীয় কেসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ যে কেসটি লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছিল, সেটি হল কাঞ্চনপুর-রহস্য। অশ্রুতপূর্ব এই কাহিনি শোনাবার আগে প্রথমেই আমি কাহিনির ঘটনাস্থান ও পাত্রপাত্রীর নাম পরিবর্তনের অবাধ অনুমতি পাঠকের কাছ থেকে চেয়ে রাখছি। কারণ, এই কাহিনি সম্পর্কিত ব্যক্তিরা কোথায় বর্তমান আছেন, তা জানি না, জীবিত কি মৃত, তাও জানি না। সুতরাং পূর্ব থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা যুক্তিযুক্ত মনে করে এইটুকু অধিকার আমি চেয়ে নিলাম। সংবাদপত্রে যখন এই কাহিনির ছোট্ট একটি শিরোনামা প্রকাশিত হল, তখন অতি ব্যস্ত জগতের নজরই পড়ল না সেদিকে। সংবাদপত্র মারফৎ উজবেক শিল্পীদের নৃত্যকলা প্রদর্শন বা নিখিল ভারত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মিলন বা ওই জাতীয় কিছু বৈচিত্র্যময় সংবাদ পরিবেশিত হত কিনা মনে নেই, হলেও জনগণ তখন সে সংবাদ রাখার চেয়ে ট্যাঙ্কার, ভি-টু অথবা প্যারাসুট বাহিনীর খবরটাই জেনে রাখা উচিত বলে মনে করত।

কাঞ্চনপুরের রহস্যের সূত্রপাত হয় এইভাবে। প্রথমেই ধরে নেওয়া যাক যে কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে অতি মনোহর ক্ষুদ্র একটি কলোনি আছে–মনে করা যাক, সেই সুসজ্জিত কলোনিটার নাম কাঞ্চনপুর। ক্ষুদ্র হলেও প্রয়োজনীয় কিছুরই অভাব সেখানে রাখা হয়নি। থানা, বাজার, পোস্টাফিস ইত্যাদি যাবতীয় সুবিধাই সেখানে সহজ লভ্য। শহরের উপকণ্ঠে থাকায় যাতায়াতেও কোনও অসুবিধা নেই–ট্রাম, বাস এবং ট্রেন, এই ত্রিবিধ যানই যাতায়াতের পথকে সুগম করে তুলেছে। এ হেন কাঞ্চনপুরে চৌরাস্তা থেকে স্টেশনের বিপরীত দিকের পথটায় মিনিট তিনেক হেঁটে গেলে লাল পয়েন্টিং করা যে দোতলা বাড়িটা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে বাস করতেন জগদীশ সরকার এবং তাঁর স্ত্রী। প্রাচীন দুর্গফটকের মতো লোহার বড় বড় কীলক মারা সদর দরজার ওপরেই একটা চকচকে আমার প্লেটে লেখা আছে, Taxidermist : Skeletons Articulated মৃত জন্তুজানোয়ারের চামড়া অবিকৃত রেখে ভেতরে শুষ্ক জিনিস ঠেসে কৃত্রিম জীবন্ত-দর্শন জানোয়ার তৈরির আর্টকেই Taxidermy বলে। এর বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। জগদীশ সরকার শুধু যে এই শিল্পতেই দক্ষ ছিলেন তা নয়, তিনি বিভিন্ন অস্থির জোড়া লাগিয়ে কঙ্কাল নির্মাণেও সমান পারদর্শী ছিলেন। তার বাড়ির পেছনে ছিল ছোট্ট একফালি বাগান–এই বাগানের একপ্রান্তে জগদীশ সরকার নির্মাণ করেছিলেন ছোট্ট কারখানাটি তাঁর যন্ত্রপাতি থাকত এইখানেই। নিভৃতে প্রতিবেশীদের সাদা-অনুসন্ধিৎসু চক্ষুর অন্তরালে তিনি তাঁর শিল্প নিয়েই দিনের পর দিন যেতেন কাটিয়ে।

যতদূর জানা গেছে, এই অস্থি সংযোজনকারী ট্যাক্সিডারমিস্ট ভদ্রলোকটি নিতান্ত নিরীহ এবং নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। প্রতিবেশীরা এই ছোটখাটো মানুষটিকে পছন্দ করতেন। পাশের বাড়ির সরকারি চাকুরে অময়বাবু, মোড়ের স্টেশনারি দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী হরিহরবাবু এবং আরও দুজন ভদ্রলোক সুখেন্দু দাস আর রবিপ্রসাদ মুখার্জি–এঁরা সবাই জগদীশ সরকারের বৈঠকখানায় বহু বিকেল দাবা খেলে, চা পান করে এবং গল্প করে কাটিয়ে গেছেন। যুদ্ধপূর্ব শান্তির দিনে বহুবার এই কজন নিরীহ ভদ্রলোক ইডেন গার্ডেনে বেরিয়েছেন এবং গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত দেখেছেন।

তাঁদের কেউই খুব বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন না এবং একমাত্র বিকাল ছাড়া কখনই একত্রে বাজে সময় নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। বৈঠকখানায় তারা নীরবে বসে দাবা খেলতেন, দু-একটি কথা বলতেন আর না হয় শান্ত দৃষ্টি মেলে দেওয়ালে প্রলম্বিত সোনালিফ্রেমে বাঁধান রবীন্দ্রনাথের ছবিটা দেখতেন। অথবা বড় টেবিলটার ওপর রক্ষিত দুটি লালাভ প্রায়-জীবন্ত কুকুরের মধ্যস্থিত অদ্ভুত দর্শন ঘড়ির দোদুল্যমান পেণ্ডুলামটি নির্নিমেষ চোখে লক্ষ্য করতেন। জগদীশবাবু এই শান্ত পরিবেশের কেন্দ্রস্থল ছিলেন–তার স্মিত বদন এবং সৌম্যমূর্তি দিয়ে এই কজনের মনকে তিনি একেবারেই জয় করে নিয়েছিলেন। জগদীশবাবুর স্ত্রী ছিলেন যেমন কটুভাষিণী, তেমনই তীব্র-স্বভাবা। এই শান্তি-চক্রের পাঁচজন সভ্যই তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। প্রতিবেশিনীরাও জগদীশ-গিন্নি সম্বন্ধে ছিলেন শঙ্কিত। নির্বিরোধী জগদীশবাবুর জীবন তিনি বিষিয়ে তুলেছিলেন। লৌহকীলক মারা মজবুত দরজা ভেদ করেও তীক্ষ্ণ বামা-কন্ঠ প্রতিবেশীদের সচকিত করে তুলত–একবার শুরু হলে যে পর্যন্ত না দম ফুরিয়ে আসত, জগদীশবাবুর প্রতি কণ্ঠনিঃসৃত সেই বিষেণচাঁদগার আর থামতে চাইত না; আর বেচারি জগদীশবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে আসতেন–কেননা রসনার চেয়েও কার্যকরী আরও কিছুর আশঙ্কা তিনি করতেন।

কুখ্যাত এই মহিলাটি ছিলেন শ্যামবর্ণা, মধ্যমাকৃতি, কুঞ্চিতকেশী। নিমফুল খেলে মুখের ভাব যেরকম হয়, তার মুখে সর্বদাই সেই ভাব থাকত ফুটে। তিনি হাঁটতেন দ্রুতগতিতে, কিন্তু বেশ একটু খুঁড়িয়ে। তাঁর অন্তরের তেজ ছিল প্রচুর–প্রতিবেশীদের কাছে তিনি ছিলেন একটি মূর্তিমান উৎপাত আর হতভাগ্য জগদীশবাবুর কাছে তিনি ছিলেন উৎপাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

রণ-দামামা বেজে ওঠার পর ইডেন গার্ডেনে ও গঙ্গার ধারে এই কজন শান্ত-পরিবেশ-প্রিয় ভদ্রলোকের বৈকালিক ভ্রমণটা প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হল এবং তাঁদের নিবিড় স্বাচ্ছন্দ্যানুভূতিরও ব্যাঘাত ঘটল প্রচুর। তা সত্ত্বেও এই শান্তি-চক্রের বৈকালিক অধিবেশন পুরোপুরি ভাবে স্থগিত রইল না এবং এক সন্ধ্যায় জগদীশবাবু ঘোষণা করলেন যে তাঁর স্ত্রী এলাহাবাদে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন এবং খুব সম্ভবত বেশ কিছু সময়ের জন্য আর ফিরবেন না।

ওখানেও হাওয়া পরিবর্তনের জন্য খুব বেশি লোক না গেলেও, অময়বাবু বললেন, আমার একবার যথেষ্ট উপকার হয়েছিল।

অপর কয়েকজন কিছু বললেন না। কিন্তু অন্তরের সঙ্গে জগদীশবাবু জানালেন অভিনন্দন। তাঁদের মধ্যে একজন পরে মন্তব্য করেছিলেন যে জগদীশবাবুর স্ত্রীর পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে বৈতরণীর ওপারে এবং সকলেই তাতে একমত হয়েছিলেন। তখন তারা কেউই জানতেন না যে প্রস্তাবিত চিকিৎসার সকল সুবিধাই সে সময় জগদীশগিন্নি উপভোগ করছিলেন।

যতদূর মনে পড়ছে, জগদীশ-গিন্নির এক ভগ্নি, অন্নপূর্ণা মিত্রের আবির্ভাবের পর থেকেই জগদীশবাবু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এই মহিলাটি ছিলেন তাঁর ভগ্নির মতো প্রায় একই রকম বদমেজাজী এবং সন্দিগ্ধমনা। একটি অভিজাত পরিবারের নার্স হয়ে কয়েক বছর তিনি ব্রহ্মদেশে বাস করছিলেন। তারপর পরিবারটি কলকাতায় ফিরে এলে, তিনিও সেই সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন। প্রথমে এই মহিলাটি তাঁর ভগ্নিকে খান দু-তিন চিঠি লিখেছিলেন, কোনও উত্তর পাননি। এইখানেই তাঁর কীরকম খটকা লাগল, কেননা জগদীশ-গিন্নি পত্র-লেখিকা হিসাবে বড় নিয়মিত ছিলেন এবং প্রতি পত্রই তার স্বামী সম্বন্ধে নোংরা কথায় পরিপূর্ণ থাকত। সুতরাং কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পরের সন্ধ্যাতেই অন্নপূর্ণা মিত্র সশরীরে এসে হাজির হলেন বোনের মুখে প্রকৃত সত্যটুকু জানতে। জগদীশবাবু চিঠিগুলো যে সরিয়ে ফেলেছেন, এ বিষয়ে তার আর কোনও সন্দেহই ছিল না। প্রায়ই বিড় বিড় করে তাঁকে বলতে শোনা যেত, হতভাগা জানোয়ার; মজা আমি দেখাব তোমায়! আর তাই কাঞ্চনপুরে এসে হাজির হলেন অন্নপূর্ণা মিত্র–এসেই কারখানা থেকে টেনে বের করলেন জগদীশবাবুকে। মহিলাটিকে দেখবামাত্র বেজায় দমে গেলেন জগদীশবাবু। চিঠিগুলো তিনি পড়েছিলেন। কিন্তু কলকাতায় ফিরে আসাটা এমন আকস্মিক যে আগে থেকে খবর না পাওয়ায় তিনি প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি। যাই হোক, মিস্ মিত্র এ সম্বন্ধে একটি কথাও বললেন না। জগদীশবাবু ভেবেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর এই বোনটি অন্তত আরও দশ-কুড়ি বছর সুদূর ব্রহ্মদেশে বাস করতে থাকবেন- ইতিমধ্যে নাম পরিবর্তন করে বছর খানেকের মধ্যে তিনিও সরে পড়বেন। আর তাই আচম্বিত মিস মিত্রকে সামনে দেখে তিনি গেলেন দারুণ দমে।

অন্নপূর্ণা মিত্র সোজা কাজের কথা পাড়লেন।

কমলা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ওপর তলায়? ঘণ্টা বাজানোর পর, দরজায় কড়া নাড়ার পর তার তো নেমে আসা উচিত ছিল।

না। জগদীশবাবু বললেন। তার গোপন রহস্য নিয়ে তিনি যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করছেন, তার কথা চিন্তা করে তিনি স্বস্তি বোধ করলেন; এই গোলকধাঁধাঁর ঠিক কেন্দ্রস্থলে তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ? না, সে ওপরতলায় নেই সে বাড়ি নেই।

ও তাই নাকি? বাড়িতে নেই? তাহলে নিশ্চয় কোনও বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে গেছে? কখন ফিরবে বলে মনে হয় আপনার?

সত্য কথা বলতে কি অন্নপূর্ণা, সে আর ফিরবে বলে আমি আশা করি না। আমাকে সে ছেড়ে গেছে–তিন মাস আগে সে চলে গেছে।

এই কথা আমায় বলতে চান আপনি! আপনাকে ছেড়ে গেছে। তার সঙ্গে কী ব্যবহারটা তাহলে করেছিলেন? কোথায় গেছে সে?

বিশ্বাস কর অন্নপূর্ণা, আমি জানি না। একদিন সন্ধ্যায় আমাদের মধ্যে একটু ঝগড়া-ঝগড়ি হল, কিন্তু তা নিয়ে আমি বেশি কিছু ভাবিনি। কিন্তু সে বললে যে যথেষ্ট হয়েছে, বলে কয়েকটি জিনিস গোছ-গাছ করে ব্যাগে পুরে বেরিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু অনেকটা ছুটে গেলাম, বার বার মিনতি করে বললাম ফিরে আসতে–কিন্তু সে একবারও ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে না–সোজা স্টেশনের দিকে চলে গেল। আর সেই দিন থেকে তাকে আর দেখিও নি, তার কথাও শুনিনি। আর যত চিঠি এসেছে, সব আমি পোস্ট-অফিসে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।

ভগ্নিপতির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অন্নপূর্ণা মিত্র। দোষটা কার, কমলার না জগদীশবাবুর–এই নিয়ে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, সবশেষে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। আর জগদীশবাবু ফিরে গেলেন কারখানায়। কয়েকটি ময়ূর ঠাসা বাকি ছিল, সেইগুলো সেরে ফেলতে! আবার তিনি সুস্থ বোধ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের জন্য তার বুকের স্পন্দন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল–আশঙ্কা করেছিলেন তাঁর গোলকধাঁধার রহস্য বুঝি গেল ফাঁস হয়ে। কিন্তু তারপরে আবার ফিরে এল তাঁর চিত্তের শান্তি।

এর পর সব কিছু মোটামুটি মানিয়ে যেত, যদি না চৌমাথার কাছে অন্নপূর্ণা মিত্রের সঙ্গে রেবা রায়ের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হত। রেবা রায় সরকারি চাকুরে অময়বাবুর স্ত্রী। ইতিপূর্বে জগদীশবাবুর বাড়িতে দুজনের আলাপ হয়েছিল–কাজেই দেখামাত্র দুজনেই দুজনকে চিনতে পারলেন। কয়েকটি বাজে কথার পর মিস্ মিত্রকে রেবা রায় জিগ্যেস করলেন যে কলকাতায় ফেরবার পর ইতিমধ্যে তার বোনের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন কিনা।

সে যে কোথায় তাই যখন জানি না, তখন কী করে আমার সঙ্গে তার দেখা হতে পারে? বেশ কিছুটা উন্মা প্রকাশ করে মিস মিত্র উত্তর দিলেন।

কী মুসকিল, আপনি তাহলে জগদীশবাবুর সঙ্গে দেখা করেননি?

এই মুহূর্তে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসছি।

কিন্তু তিনি তাহলে নিশ্চয় এলাহাবাদের ঠিকানাটা ভুলে যেতে পারেন না?

আর এইভাবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গড়িয়ে গেল কথাবার্তার গতি এবং মিস মিত্র পরিষ্কার জানতে পারলেন যে জগদীশবাবু তার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বলেছেন যে তার স্ত্রী অনেক দিনের জন্য এলাহাবাদে আত্মীয়-স্বজনের কাছে বেড়াতে গেছেন। প্রথমত মিত্র-ভগ্নিদ্বয়ের কোনও আত্মীয়ই এলাহাবাদে থাকত না–তাদের আদিবাস ছিল ময়মনসিংহে, আর দ্বিতীয়ত, জগদীশবাবু তাঁকে বলেছেন, কমলা ক্রুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় বেরিয়ে গেছেন তা তিনি জানেন না। প্রথমে মিস মিত্র ভাবলেন এখুনি ফিরে গিয়ে ভগ্নিপতিকে এক হাত নেবেন–তারপর তিনি মত পরিবর্তন করলেন। দেরি হয়ে যাচ্ছিল, কাজেই তৎক্ষণাৎ আর দেখা না করে তিনি কলকাতাতেই ফিরে গেলেন,–সারাপথে কি ভাবে জগদীশবাবুকে শায়েস্তা করবেন, সেই কথাই লাগলেন ভাবতে।

পরের হপ্তায় আবার তিনি আবির্ভূত হলেন কাঞ্চনপুরে। কাঁচা মিথ্যা কথনের অপরাধে তিনি জগদীশবাবুকে অভিযুক্ত করলেন তাঁর সামনে ধরে দিলেন দুটি বিভিন্ন কাহিনি। আর, আবার আগের মতো জগদীশবাবুর বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। ভয়ানক আতঙ্কে হাত-পা প্রায় অবশ হয়ে আসার উপক্রম হল। কিন্তু তার সংযম নিতান্ত অল্প ছিল না।

সত্যিই, তিনি বললেন, আমি তোমায় কোনও মিথ্যেই বলিনি অন্নপূর্ণা। ঠিক যা ঘটেছে তোমায় বলেছি। কিন্তু এখানকার লোকদের জন্যে এলাহাবাদের ওই কাল্পনিক গল্পটা আমায় বানাতে হয়েছিল। এ বিষয় নিয়ে প্রত্যেকে আলোচনা করুক, এ ইচ্ছা আমার ছিল না–বিশেষ করে কমলার ফিরে আসার সম্ভাবনা যখন রয়েছে–আমার তো মনে হয় আর কিছুদিনের মধ্যেই সে ফিরে আসবে।

সন্দেহপূর্ণ চোখে মুহূর্তের জন্য মিস্ মিত্র জগদীশবাবুকে এক দৃষ্টে লক্ষ্য করলেন আর তারপরেই দ্রুতপদে উঠে গেলেন দোতলায়। কিন্তু অচিরেই তিনি নেমে এলেন।

কমলার ড্রয়ার আমি দেখে এলাম। এমন ভাবে তিনি কথা শুরু করলেন যেন জগদীশবাবুকে যুদ্ধে আহ্বান করছেন। অনেকগুলো জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না। চুণীর লকেট বসান নেকলেশটা নেই, কৃষ্ণার দেওয়া হীরার আংটিটাও দেখতে পেলাম না, কানপাশা, চুড়ি আর তাগাও দেখতে পেলাম না।

কমলা চলে যাবার পর আমি ওর সব কটা ড্রয়ারই বাইরের দিকে খুলে ঝুলতে দেখেছি। নিশ্বাস ফেললেন জগদীশবাবু। আমার বিশ্বাস, সে যাবার সময়ে সব গয়নাই নিয়ে গেছে।

এটা স্বীকার করতেই হবে যে জগদীশবাবু প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়ের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন–এ গুণটি বোধহয় তাঁর শিল্প-দক্ষতা থেকেই জন্মেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যাবার সময়ে স্ত্রী যাবতীয় অলঙ্কার ফেলে চলে গেছে–এ গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না। আর কাজেকাজেই যাবতীয় অলঙ্কার-সম্পত্তি গেল অদৃশ্য হয়ে।

প্রকৃত পক্ষে, এ ক্ষেত্রে কি যে আর করা উচিত, তা মিস্ মিত্র আর ভেবে উঠতে পারলেন না। দুটি বিভিন্ন রকমের কাহিনি বলার তাৎপর্য জগদীশবাবু এমন সুন্দরভাবে যুক্তির সাহায্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সে যুক্তি তিনিও না মেনে পারেননি। সুতরাং জগদীশবাবু যে যে-কোনও কৃমি-কীট মনুষ্যের চেয়েও জঘন্য–এই পরম সত্যটুকুই তাকে জানিয়ে দিয়ে তিনি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে প্রস্থান করলেন। পুনরায় দ্রুত-স্পন্দিত বক্ষ নিয়ে জগদীশবাবু ফিরে গেলেন তাঁর কারখানায়। গোলকধাঁধা তখনও নিরাপদ, রহস্য তার অনাবিষ্কৃত৷ দ্বিতীয়বার আবার যখন মিস্ মিত্রের অগ্নি-মূর্তির সম্মুখীন তিনি হলেন, প্রথমটা তাঁর হৃৎপিণ্ডটা বড় বেশি রকম লাফালাফি করছিল–কিন্তু এখন বুঝলেন এ আতঙ্ক সম্পূর্ণ আকার বিহীন। তার কোনও বিপদ আর নেই। আমাদের মতো তিনিও তখন ভাবলেন সামন্ত ঘটিত মামলার বিবরণটি। সামন্ত দৌড়োদৌড়ি করছিলেন বলেই ধ্বংস হয়ে গেলেন। যদি সামন্ত চঞ্চল না হয়ে এক স্থানে জেঁকে বসে থাকতেন, তাহলে তার কেশাগ্র স্পর্শ করবার সাহস কারও হত না এবং কয়লার গাদার নীচে সমাধিও কোনওদিন হত না আবিষ্কৃত। জগদীশবাবু অবশ্য মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন যে সন্দিগ্ধমনা যে কোনও ব্যক্তি আসুক তার গৃহে, খুঁজে দেখুক প্রতিটি কোণ, চোর-কুঠরি এবং কয়লার গাদা। বাগানের প্রতিটি ফুলগাছের মাটি খনন করুক, প্রতিটি দেওয়াল ভেঙে তন্নতন্ন করে দেখুক। এই কথাই ভাবতে-ভাবতে তিনি তুলে নিলেন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ একটি দাঁড়কাক। সকালের দিকে এ অর্ডারটি এসেছিল–সমস্ত মন নিবিষ্ট করে তিনি কৃষ্ণ-প্রাণীটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইলেন।

ভগ্নীর অসাধারণ অন্তর্ধান রহস্যের সংবাদ বহন করে মিস মিত্র ফিরে এলেন কলকাতায় আর ক্রমাগত চিন্তা করতে লাগলেন। আগাগোড়া বিষয়টা বারংবার তোলপাড় করেও তিনি চিন্তার কোনও কূল-কিনারা পেলেন না। তিনি জানতেন না যে এরকম ভাবে নানা কারণে বহু নারী এবং পুরুষ উধাও হয়ে যায় প্রতি বছরে–কেউই তাদের সন্ধান পায় না, যে পর্যন্ত না দৈব এসে কল-কাঠি নেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কী জানি কেন, মিস্ অন্নপূর্ণা মিত্রের কাছে এই ব্যাপারটি মনে হল একটি রীতিমতো অলুক্ষুণে, বিস্ময়-জনক, অতুলনীয় এবং ভয়াবহ ঘটনা। অনবরত এই বিষয় নিয়ে ভেবে ভেবে তিনি মাথা গুলিয়ে ফেললেন, তবুও স্বল্প-বা জগদীশ সরকার যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছেন, তার প্রবেশ পথেরই হদিশ পেলেন না খুঁজে। অবশ্য ভগ্নিপতি সম্বন্ধে মিস্ মিত্রের কোনও সন্দেহ ছিল না। কেননা তার ব্যবহার এবং কথাবার্তা খুবই সরল, স্পষ্ট এবং অতীব বোধগম্য। তিনি একজন কৃমি-কীট–এই সংবাদ তাকে জানিয়ে দিয়েছেন–কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি অবশ্যই সত্য কথাই বলেছেন। কিন্তু মিস্ মিত্র তার একমাত্র বোনটিকে ভালোবাসতেন। এবং কমলা সরকার কোথায় গেছেন এবং তাঁর কী হয়েছে–এই সংবাদ জানার জন্যে তিনি আকুল হয়ে উঠলেন। আর তাই সর্বশেষে তিনি পুলিশের সমীপে এই ঘটনাটি হাজির করলেন।

অন্তর্হিত মহিলার যতটুকু বর্ণনা সম্ভব, মিস্ মিত্র স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে তা দিতে কসুর করলেন না; কিন্তু এই কেসের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীটি মিস্ মিত্রের দৃষ্টি একটি বিষয়ে আকর্ষণ করলেন–যেহেতু তিনি তাঁর ভগ্নীকে বহু বছর যাবৎ দেখেননি, অতএব এ ক্ষেত্রে জগদীশ সরকারের পরামর্শ অপরিহার্য। সুতরাং পুনরায় শিল্পকর্ম থেকে টেনে আনা হল ট্যাক্সিডারমিসট ভদ্রলোককে। মিস্ মিত্রের আনা সংবাদটুকু এবং তার দেওয়া কমলা সরকারের দৈহিক বর্ণনার ওপর ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল। তিনি আর একবার তার ছোট্ট জটিলতাবিহীন গল্পটি বললেন, বিশ্রী কানাঘুষো এড়াবার জন্যে প্রতিবেশিদের কাছে কেন মিথ্যা বলেছেন–সে কথারও উল্লেখ করলেন এবং সর্বশেষে মিস্ মিত্র বর্ণিত কমলা সরকারের ফটোগ্রাফে নিজেরও দু-একটি খুঁটিনাটি পরিবর্তন সংযোজন করে দিলেন। তারপর তিনি কনস্টেবলটিকে দুটি ফটোগ্রাফ দিলেন। ফটো দুটির মধ্যে যে যে স্থানে সাদৃশ্য চোখ এড়ায় না, সেগুলিও তর্জনী নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন এবং তারপর প্রসন্ন-বদনে স্মিতহাস্যে তাকে দিলেন বিদায়।

পুলিশের জোর তদন্ত চলল–Missing Squad ফটোগ্রাফ দুটি নিয়ে সম্ভব অসম্ভব সব জাতীয় স্ত্রীলোকের সঙ্গেই দেখতে লাগল মিলিয়ে। কিন্তু তা হতোস্মি! মিস্ মিত্র যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রইলেন। তখন তিনি নিজেও নিজের প্রচেষ্টা আর অর্থ নিয়োগ করে অনুসন্ধানকে ব্যাপকতর করে তুললেন; প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রেই ফটো সহ নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপন ছাপা হল–কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল আর ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন মিস অন্নপূর্ণা মিত্র। সবশেষে পুলিশের সঙ্গে এবং আরও কয়েক জনের সঙ্গে পরামর্শ করে দেওয়াল-বিজ্ঞাপন ছাপালেন এবং কাঞ্চনপুর ও শহরের সর্বত্র দিলেন ছড়িয়ে। শহরের বাইরেও কিছু গেল। বাড়ির দেওয়ালে, গাছের গুঁড়িতে, পার্কের বেঞ্চে–সর্বত্র দেওয়াল প্রলম্বিত শ্রীমতী কমলা সরকারের ফটোগ্রাফ বহু পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল–এ সেই ফটোগ্রাফ যেটি জগদীশবাবু নিজে নগর-রক্ষীবাহিনীর হাতে দিয়েছেন তুলে, সেই সাথে তার দেওয়া বিশদ দৈহিক বর্ণনাও হয়েছে মুদ্রিত বর্ণনার মধ্যস্থানে লেখা আছে বেশ একটু খুঁড়িয়ে চলেন–এই কয়টি শব্দ মোটা মোটা হরফে ছাপা। প্লাকার্ডের ফল কিছু দেখা গেল না–কিছুই চাঞ্চল্যকর সংবাদও এল না। শেষবারের মতো তাঁকে কাঞ্চনপুর স্টেশনের দিকে যেতে দেখা গেছে–এই বিবৃতিও সরকারি গোয়েন্দার কাছে খুব আশাজনক সূত্র বলে মনে হল না। এ ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিতও সংবাদপত্রে হল না প্রকাশিত; আর তারপর ধীরে ধীরে আমরা আবার নিজস্ব সংবাদদাতা পরিবেশিত সম্মুখ-রণাঙ্গনের চাঞ্চল্যকর বিবরণে হয়ে গেলাম মগ্ন। একটি মুখরা স্ত্রীলোকের গতিবিধি নিয়ে আলোচনা করবার মতো অবকাশ আমাদের আর কারুরই রইল না–কাঞ্চনপুর কলোনিও তাঁর কথা বিস্মৃত হয়ে এল ধীরে ধীরে।

আর তারপর হল এই রহস্যের উপসংহার এবং সেটা নিছক দৈবঘটিত ছাড়া আর কিছুই নয়। কাঞ্চনপুর কলোনির একপ্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বিতল ভবনের দোতলায় ততোধিক নির্জন এক কক্ষে অলস মধ্যাহ্নে পদচারণা করছিলেন শ্রীকান্ত মিত্র–একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। হাতে বিশেষ কোনও কাজ ছিল না এবং পড়াতেও বিশেষ মন বসছিল না। কাজেই উদাসীন এবং অলস ভঙ্গিমায় তিনি জানলা দিয়ে রাস্তার ওপারে দোকানের সাইনবোর্ডটি লক্ষ্য করলেন, রাস্তার মোড়ে দুটি ছোট মেয়েকে দেখলেন বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতে। তারপর দেখলেন এক স্থূলাঙ্গী মহিলা বহুকষ্টে রিক্সা থেকে নেমে প্রবেশ করলেন পার্শ্ববর্তী দোকানে। তখন তিনি শো-কেসের মূল্যবান হস্তীদন্ত নির্মিত নটরাজের মূর্তির শিল্পকৌশল দেখলেন, এবং ভাবলেন যে এরকম একটি মূর্তি কিনে তার পড়ার টেবিলে সদ্যক্রীত মড়ার মাথার খুলি ওপর রেখে দিলে কীরকম দেখাবে; আর তারপর তার ভ্রাম্যমান দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে এসে স্থির হল পথপার্শ্বের একটি গাছের মোটা গুঁড়ির ওপর; গুঁড়িটির ওপরে দুটিমাত্র শাখা ঠিক ইংরাজি Y-এর মতো উর্ধে উঠে গেছে। এই দুটি শাখার সংযোগস্থলে দেখতে পেলেন একটি নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপন এবং কমলা সরকারের দৈহিক বর্ণনা।

বেশ একটু খুঁড়িয়ে চলেন।

শ্রীকান্ত মিত্রের শ্বাস-প্রশ্বাস মুহূর্তের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল। জানলার একটি গরাদ চেপে ধরে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি আর একবার ওই বিস্ময়কর শব্দগুলি পড়লেন। আর তারপর তিনি সোজা হাজির হলেন কাঞ্চনপুর পুলিশ ফাঁড়িতে।

ব্যাপারটা এই : কমলা সরকারকে শেষবার দেখা যাওয়ার তিন হপ্তা পরে শ্রীকান্ত মিত্র জগদীশ সরকারের কাছ থেকে কিনেছিলেন একটি স্ত্রী-নরকঙ্কাল। উরুর একটি হাড়ের গঠন বিকৃত থাকার ফলে তিনি কঙ্কালটি খুব সুবিধা দরেই পেয়েছিলেন। আর এখন তাঁর আচম্বিতে মনে হল যে কঙ্কালের ভূতপূর্ব অধিকারিণী একসময়ে নিশ্চয় বেশ একটু খুঁড়িয়ে চলতেন।

মামলা চলার সময়ে সোমদেব চৌধুরি তাঁর সুনাম বজায় রাখলেন। জমকালো বাগ্মীতার সাহায্যে তিনি জগদীশ সরকারের পক্ষ সমর্থন করলেন। আমি আদালতে ছিলাম–সে সময়ে প্রায় আদালতে যাওয়া আমার অন্যান্য কাজের অন্যতম ছিল এবং কয়েদির পক্ষাবলম্বন করে তিনি প্রথমেই বাকপটুতায় যে নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, তা আমি কোনওদিন ভুলব না। ধীরে-ধীরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং সমস্ত আদালত-গৃহের চতুর্দিকে বুলিয়ে নিলেন তাঁর মসৃণ চক্ষু। সর্বশেষে তার গাম্ভীর্যময় প্রশান্ত দৃষ্টি স্থির হল জুরির ওপর। অনেকক্ষণ বাদে কথা শুরু করলেন তিনি। মৃদু, স্পষ্ট ও সতর্ক তাঁর স্বর, প্রত্যেকটি শব্দ উচ্চারণ করবার পূর্বে যেন মনে মনে গুঞ্জন করে নিয়ে তবে বলছেন।

 ভদ্রমহোদয়গণ, তিনি শুরু করলেন, একজন অত্যন্ত মহান্ পুরুষ এবং অত্যন্ত জ্ঞানবান পুরুষ এবং অত্যন্ত সৎ পুরুষ একবার বলেছিলেন যে, সম্ভাবনাই হল জীবনের পথপ্রদর্শক। এটা যে একটি রীতিমতো অর্থব্যঞ্জক বাক্য, এ সম্বন্ধে, আমার বিশ্বাস, আপনারা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন। বিশুদ্ধ গাণিতিক পরিধি একবার আমরা অতিক্রম করে এলে যা পাই–তার মধ্যে অতি অল্পই থাকে নিশ্চিত। ধরা যাক, লগ্নী করার মতো যথেষ্ট অর্থ আমাদের আছে : প্রথমে পরিকল্পনাটিকে আমরা সর্বপ্রকার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করি এবং তারপর একটি সম্ভাবনাময় বিষয় সম্বন্ধে মনস্থির করে ফেলি। নতুবা ভাগ্যের হাতে ক্রীড়নক হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। দায়িত্বপূর্ণ পদে কোনও ব্যক্তিকে অধিষ্ঠিত করার আগে আমরা তাঁর সততা এবং বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার কার্যকরী সম্ভাবনা সম্বন্ধে চিন্তা করে নিই। আবার সম্ভাবনাই আমাদের পথ দেখিয়ে মীমাংসার দিকে, চিত্ত সঙ্কল্পের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একজনের সম্বন্ধে আর একজন কখনই নিশ্চিত ও অভ্রান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারে না : সম্ভাবনার ওপর বারংবার আমাদের নির্ভর করে এগিয়ে যেতে হয়।

কিন্তু প্রত্যেক নিয়মের আছে ব্যতিক্রম। যে নিয়ম আমরা এইমাত্র বর্ণনা করলাম, এরও ব্যতিক্রম আছে। এই মুহূর্তে আপনারা সেই ব্যতিক্রমের সম্মুখীন হচ্ছেন ভয়াবহরূপে। আপনারা হয়তো মনে করতে পারেন–আমি বলছি না যে আপনারা মনে করেন–হয়তো মনে করতে পারেন, কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান ওই জগদীশ সরকার দ্বারা তাঁর স্ত্রী কমলা সরকারকে খুন করার সকল সম্ভাবনা থাকা বিচিত্র নয়।

এই স্থানে হল ক্ষণের বিরতি। তারপর?

আপনারা যদি তাই মনে করেন, তবে কাঠগড়াস্থিত আসামিকে মুক্তি দেওয়া আপনাদের এখন অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য। একটি মাত্র রায় আপনারা প্রকাশ করতে পারেন এবং সে রায় হল–নির্দোষ।

এই মুহূর্ত পর্যন্ত সোমদেব চৌধুরী যেভাবে তার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, ঠিক একই প্রকার শীতল, কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন রক্ষা করে–থেমে থেমে, এবং প্রতিটি শব্দ ঠোঁটের আগায় আসার আগে শব্দটির গুরুত্ব মনে মনে বিবেচনা করে নিচ্ছিলেন। আচম্বিতে তাঁর কণ্ঠস্বর উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে তারায় উঠে গেল, প্রতিটি শব্দ প্রত্যেকের অন্তরে যেন গেঁথে যেতে লাগল–সমস্ত আদালত-কক্ষটি গম্ করে উঠল তার তীক্ষ্ণ এবং গম্ভীর কণ্ঠস্বরে। দ্রুতবেগে একটির পর একটি শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল তার মুখ থেকে?

মনে রাখবেন, এটা সম্ভাবনার আদালত নয়। এখানে সম্ভাবনার কোনও স্থান নেই, সে তর্কের কোনও অবকাশ এখানে নেই। এই স্থান নিশ্চিত সত্য নিয়ে আদান প্রদান করে–এই স্থানের নাম আদালত। যতক্ষণ না আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন যে আমার মক্কেল দোষী এবং দুয়ে দুয়ে যোগ করলে চার হয়–এই নিশ্চিত সত্যটুকুর মতো নিশ্চিত যে পর্যন্ত আপনারা না হতে পারছেন, ততক্ষণ আপনারা ওঁকে মুক্ত করে রাখবেন।

আবার, এবং তবুও আবার আমি বলছি–এটা আদালত, নিশ্চিত সত্যের স্থান। আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রায়, আমরা প্রায় দেখি, সম্ভাবনাই আমাদের পথপ্রদর্শক। কখনও কখনও আমরা ভুল করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে ভ্রম সংশোধন করতে পারি। ক্ষতিযুক্ত লগ্নীকরণকে সামলে নেওয়া যায় লাভযুক্ত লগ্নীকরণ দিয়ে; অসৎ ভৃত্য সরিয়ে সেস্থানে সৎ ভৃত্য আনা চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে –যেখানে হাতের দাঁড়িপাল্লায় একদিকে রেখেছেন জীবন, অপর দিকে মৃত্যু–সেখানে ভ্রান্তির কোনও অবকাশ নেই, কেননা, এ ভ্রান্তি হবে অসংশোধনীয়। মৃত পুরুষকে জীবন দান করে আপনারা জীবিত করতে পারবেন না। এই লোকটি সম্ভবত হত্যাকারী, অতএব এ দোষী, এই কথা কখনই আপনাদের বলা চলে না। এ ধরনের রায় প্রকাশ করার আগে, এই লোকটি হত্যাকারী এই কথা বলার মতো নিশ্চয়তা আপনাদের থাকা উচিত। আর ওকথা আপনারা বলতেই পারবেন না–কেন পারবেন না, তা আমি বলছি।

তারপর সোমদেব চৌধুরী একটির পর একটি প্রমাণ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। বিশেষজ্ঞের রিপোর্টে প্রকাশ, ঊরুর হাড়ে যে বিকৃত-গঠন দেখা গেছে, তার ফলে নরকঙ্কালটির পক্ষে বিজ্ঞাপন–বর্ণিত ভাবে অবিকল ওই রকম খুঁড়িয়ে চলা উচিত–আর এই বিশেষ ভাবে খোঁড়ানোটাই হল কমলা সরকারের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাদীপক্ষ বিবিধ যুক্তিতর্কের সাহায্যে ডাক্তারদের স্বীকার করতে বাধ্য করেছে যে এ ধরনের বিকৃত গঠন অস্বাভাবিক হলেও অদ্বিতীয় নয়। শুধু বলা চলে এটা অসাধারণ। কিন্তু আবার খুব অসাধারণ নয়। শেষকালে, একজন ডাক্তার স্বীকার করলেন যে তাঁর তিরিশ বছর হসপিটাল এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিশকালে, ঊরুর বিকৃত-গঠন অস্থির কেস তিনি মাত্র পাঁচবার শুনেছেন। সোমদেব চৌধুরী ছোট্ট একটি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন; তিনি যেন অন্তর দিয়ে অনুভব করলেন যে এরপর বিচারকের রায় কি হবে।

জুরির কাছে এই সব খুঁটিনাটি তথ্য তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন। যতক্ষণ না অপরাধ সম্পর্কিত অন্যান্য বস্তু, দেহ অথবা দেহের সনাক্তকরণযোগ্য কোনও অংশ প্রমাণরূপে উপস্থাপিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে যে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া অনুচিত–এই যুক্তিটির ওপর বারংবার জোর দিতে লাগলেন। বিষ্ণুপুরের সেই কাহিনীটা তিনি বললেন, হত্যাপরাধে তিনটি লোকের ফাঁসি হয়ে যাবার দু-বছর পর কীভাবে নিহত ব্যক্তি শিশ দিতে দিতে গ্রামে ঢুকেছিল। ভদ্রমহোদয়গণ, তিনি বললেন, সবশেষে আমি যা জানি, এবং আপনারাও যা জানেন, তা হল এই যে, যে কোনও মুহূর্তে কমলা সরকার প্রাকুটি করে এই আদালত-কক্ষ প্রবেশ করতে পারেন। (কয়েকটা শ্রোতা ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে বারকয়েক লক্ষ্য করল) আমি নির্ভীকভাবে শুধু এই কথাই বলব যে তিনি মৃত, এই ধরনের কোনও অনুমান করা আমাদের কোনওমতেই উচিত নয়।

জগদীশবাবুর আত্মপক্ষ সমর্থন অবশ্য খুবই সংক্ষিপ্ত। যে কঙ্কালটি তিনি শ্রীকান্ত মিত্রের কাছে বিক্রয় করেছেন, সেটি গত তিন বছর যাবৎ বিভিন্ন অস্থি সংযোজন করে ধীরে-ধীরে তৈরি করেছিলেন। দুটি হাতে যে হুবহু মিল নেই, এদিকেও তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আর, বাস্তবিকই এই ছোট্ট বৈষম্যটুকুও তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি।

সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার আগে জুরিবর্গ আধঘণ্টা ধরে নিজেরা আলোচনা করলেন। তারপর ঘোষিত হল, জগদীশ সরকার নির্দোষ।

কিছুদিন বাদে শুনেছিলাম জগদীশবাবু দিল্লিতে চলে গেছেন, সেখানেই তাঁর শিল্পনৈপুণ্য এবং নব বিবাহিতা নম্র স্বভাবা একটি বন্ধু নিয়ে সুখে আছেন। একজন পুরোনো বন্ধুর সাথে তার দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় সৌম্যমুর্তি জগদীশবাবু স্নিগ্ধ স্বরে বলেছিলেন, আমার বিচক্ষণ আইনজ্ঞটি আমায় একথাও বলেছিলেন যে, বেচারী কমলার মৃত্যু হয়েছে, একথা অনুমান করে নিলেও আমায় আর কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। প্রসন্নভাবে তিনি হেসে এরপর অন্য বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন।

সর্বশেষে একথা আমি বলে রাখতে চাই যে, আমার এ বর্ণনা হয়তো আংশিক কাহিনি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সোমদেব চৌধুরীর অপূর্ব বাগ্মীতা স্মরণ করে যতটুকু আমি বলতে পারি, তা হল এই যে জগদীশবাবু নির্দোষ। খুব সম্ভব তাঁর কাহিনি সম্পূর্ণ সত্য। কমলা সরকারও বহাল তবিয়তেই জীবিত আছেন, বিষ্ণুপুরের মতো তিনিও হয়তো একদিন সাদা নিমফুল ভক্ষিত মুখ নিয়ে ফিরে আসতে পারেন। আমার এ কাহিনিতে যদি কিছু সংশয়ছায়া কারও ওপর আমি ফেলে থাকি, তখন তা হয়তো শূন্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

যুক্তির পথে দেখলে কাঞ্চনপুর-রহস্য তাহলে মীমাংসিত রহস্য। নিশ্চয় তাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে?

* রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত। ফাল্গুন, ১৩৬৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *