কাজ নেই
মেঘলা ভাঙা রোদ আকাশে।
ছাড়া ছাড়া উড়ন্ত কালো মেঘ, ধারে ধারে তার ঝিকিমিকি করে রোদ। মেঘবতী গলায় পরেছে ঝকমকে রুপোর হাঁসুলী। তার ছটা চোখে বেঁধে। রুপো আবার কখনও শ্যামল অঙ্গে সোনার ধারে ঝলমল করে।
রোদের পিছনে পাল্লা দিয়ে ছায়া দৌড়োয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে। উত্তর দক্ষিণ লম্বালম্বি রেল লাইনের উঁচু জমি, মাথায় তার সচল আকাশ। মেঘ নেই জল, রোদে আছে শুধু পোড়ানি। পুবের নাবিতে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত যেন লক্ষ্মীছড়ি! পোড়া পোড়া পাঁশুটে মরকুটে ধানের ছড়া, সরু সরু গুছি, লম্বায় হাত দেড়েকও নয়। পশ্চিমে শুকনো নয়ানজুলি হ করে রয়েছে। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে বিস্তৃত ঘেসো জমি আর জলা। ঘেসো জমিতে ঘাস নেই। তবু পশ্চিমা রাখালটা ওইখানেই সমস্ত গরু চরাতে নিয়ে আসে। বাদবাকি সমস্ত জমিই কোনও-না-কোনও কোম্পানির করায়ও। গরুগুলো ঘাস পায় না, খালি মাঠ চষে বেড়ায়।
সামনেই যে গ্রামটা দেখা যায় পশ্চিমে, গরুগুলো সেখানকার গৃহস্থদের। লোকে বলে গ্রাম, কিন্তু গ্রাম নয় ওটা। আবার পুরোপুরি শহরও নয়। গ্রামটার আরও পশ্চিমে গঙ্গার ধারে ভিড় করে আছে। কলকারখানা। এটা একটা আধখ্যাঁচড়া জায়গা।
দুপুরটাকে দুপুর বলে বোঝাবার জো নেই মেঘের জন্য। এমন সময় রেললাইনের উপরে পুবে ওই কিম্ভুতকিমাকার কালো মেঘটার আড়াল থেকে একটা চিতাবাঘের মতো মুখ উঁকি মারল। তার লোলুপ দৃষ্টি এ পারের মাঠের গরুগুলোর দিকে। একটু একটু করে সন্তর্পণে সে মুখ পুরোটা বেরিয়ে এল যেন মেঘের আড়াল ছেড়ে।
বসন্তের কতগুলো বড় বড় ক্ষতের দাগ সেই মুখে। চোয়াল দুটো ছুঁচলো পাথরের মতো। নাকের মাঝখানটা বসা, সামনেটা তোলা। মাকুন্দ বলতে যা বোঝায় তেমনি তার মুখে গোঁফদাড়ির বদলে কয়েকগাছা পাতলা চুল। তার ম্যালেরিয়াগ্রস্ত হলদে চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, চিতাবাঘটা বুঝি এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে এ পারের গরুগুলোর উপর। কিন্তু মানুষটা অর্থাৎ ওই আধ-খ্যাঁচড়া জায়গার দুলেপাড়ার ফটিকচাঁদ নিঃশব্দে হেসে উঠল দাঁড় বের করে। বসল পশ্চিমা রাখালটাকে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ঘুমোতে দেখে।
তার পর যেন জাদু করছে এমনি করে ফটিক একটা অদ্ভুত শব্দ বের করে তার গলা দিয়ে : অ…অ…গ…গ.. .
অমনি কয়েকটা গরু উৎসুক চোখে তাকায় তার দিকে।
সুযোগ বুঝে ফটিক পায়ের কাছ থেকে তুলে নেয় বিচুলির আঁটিটা। আটি সামনে বাড়িয়ে দোলায় আর মিহিমোটা গলায় অদ্ভুত শব্দ করে।
সারা তেপান্তর জনহীন। দূরের কারখানা থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে শোঁ শোঁ করে। টেলিগ্রাফের তারে কলরবর করছে কয়েকটা ল্যাজঝোলা পাখি।
লাইনের সামনের কয়েকটা গরু আতুর চোখে ঘাড় তুলে তাকায় ওই সোনা র বিচুলির আঁটিটার দিকে। বার কয়েক ফোঁসফোঁস করে নাকের পাটা ফুলিয়ে যেন এক মুহূর্তে গন্ধ শোঁকে খাবারের। পরমুহূর্তেই লেজ তুলে ছোটে বিচুলির আঁটি লক্ষ করে।
ফটিকের নজর রাখালের দিকে। সে টের পেলেই সব ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু সেরকম দুর্ঘটনা কিছু ঘটল না।
গরুগুলো কাছে আসতেই বিচুলির আঁটি ফেলে দিয়ে কোমর থেকে পাটের দড়িটা খুলে ফটিক গোটা তিনেক গরুকে লহমায় বেঁধে ফেলল। বিচুলিতে গরু মুখ দেওয়ার আগেই সে আটিটা বগলদাবা করে বলল, ডাঁরা বাপু, আবার কোথাও টোপ ফেলতে হবে তো। বলে গরু তিনটেকে নিয়ে মুহূর্তে সে পুবের নাবিতে জঙ্গলের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এ-পারের মাঠ থেকে একটা বকনা ডেকে উঠল— হাম্বা। রাখাল ঘুমচোখেই বলে উঠল, হহ! তারপর মুখের ঢাকনাটা সরিয়ে ঠোঁট উলটে থুক করে ফেলে দিল খইনির ছিবড়ে। দেখল একবার এ-দিক-ও-দিক। দেখে আবার নিশ্চিন্তে মুখ ঢাকল।
.
ফটিকচাঁদ ততক্ষণে নবগাঁয়ের সড়কে। সে কেবলি পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখছে আর বেঁকে বসা পোয়াতি গাইটার লেজ মলছে। বাকি দুটোর বিশেষ আপত্তি দেখা যাচ্ছে না। তাদের নজর ফটিকের বগলের দিকে। পেট বড় দায়। সে দুটোকে ফটিক বলছে, র, র, একেবারে লক্ষ্মী কুণ্ডুর ঘরে গে খাবি।
বাজার-ফেরতা এক তরকারি-চাষী ফিক করে হেসে জিজ্ঞেস করল, কার সব্বেনাশ করলে গো?
এ বিষয়ে ফটিকচাঁদ চেনা যোগী। তবু হেসে বলল, হি হি, সব্বোনাশ আর কী, নাইনে উঠে ছালো তাই ধরে নে এলুম। আইনের ব্যাপার কি না, হুঁ হুঁ..।
হাসল তরকারি-চাষীও। রেললাইনে, রাজপথে, পরের বাড়ি বা বাগানে পোষা গরু গেলেই বে-আইনি।
ফটিক গরু তিনটেকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসে তুলল নবগাঁয়ের খোঁয়াড়ে। এখন লক্ষ্মী কুর খোঁয়াড়। ইউনিয়ন বোর্ডের তিনটে খোঁয়াড়ের ডাক সে নিয়েছে।
খোঁয়াড়ের পাশের ছোট ঘরটাকে সবাই বলে আপিস। সেখান থেকে খালি গা নাদুসনুদুস গৌরবর্ণ লক্ষ্মী কুণ্ডু চাবির গোছাটা নিয়ে বেরিয়ে এল। গলায় এঁটেবসা তুলসীর মালাটা একবার ঘুরিয়ে দিল আঙুল দিয়ে। চাবি দিয়ে খোঁয়াড়ের দরজা খুলতে খুলতে বিষণ্ণ ঠোঁট দুটো উলটে বলল, এত ক্ষণে মাত্তর তিনটে।
নাঃ, তোমার জন্যে সবাই পথে-ঘাটে গরু ছেড়ে রেখে দিয়েছে।
বলতে বলতে ফটিক গোরু তিনটেকে খোঁয়াড়ে পুরে বাঁধন খুলে দিল।
নবাগতা গোরু তিনটে বাদে আর একটা ছাগী ছিল। সে একবার হুঁ হুঁ হুঁ করে ডেকে উঠল সরু গলায়। বোধ হয় তার একাকীত্বের অবসানে।
ফটিকের গরম কথাতেই লক্ষ্মী কুণ্ডর গাল ভরে ওঠে হসিতে। তালা বন্ধ করতে করতে বলে, তোর মতো কাজের লোকের যে কেন কাজ জোটে না, আমি তা-ই ভাবি।
তা হলে তোমার একাজ কে করত, সেটাও ভাবো, প্রায় কুকুর মতোই হাসতে গিয়ে বিকৃত মুখে বলে ফটিক। এখন পসা ছ আনা ছাড়ো দিকি চট করে।
গরু-পিছু তার দু আনা পাওনা। কুণ্ডু পাবে গরুর মালিকের কাছ থেকে বারো আনা। আবার একদিন ছেড়ে দুদিন হলেই কুণ্ডুর পাওনা ডবল হয়ে যাবে। আইনত অবশ্য একটা খরচ আছে কুণ্ডুর, ওই পশুগুলোকে খাওয়ানো। কিন্তু কথায় বলে, সেকথা জানে মা ভগা, আর জানে পশুগুলো। সেদিক থেকে বরং ফটিক, কুণ্ডুর সঙ্গে হাতাহাতি করে হলেও খোঁয়াড়ের প্রাণীগুলোকে কিছু দেয়। বলে, কুণ্ডুবাবু, পুণ্যি করে করে তো সপ্নের সিঁড়ি সব ভেঙে ফেলে দিলে, নরকের দরজায় এটুখানি থুতু ফেলে তো যাও।
কুণ্ড চিপটেন বোঝে, কিন্তু সেটা বুঝতে দেয় না। তা যা বলেছিস। রাধাকৃষ্ণ বল।
এখন ফটিকের কাছ থেকে পয়সার দাবি আসতেই কুণ্ডুর ফোলা গালের হাসিটুকু মিলিয়ে যায়। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, এব্যবসা আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। আর পোষাচ্ছে না।
আমারও না, ফটিক বলে আরও গম্ভীর হয়ে। দু আনা রেটে আর চলে না।
অমনি কুণ্ডু খ্যাঁক করে হেসে ওঠে। বোধ হয় অস্বস্তিতে। বলে, কী যে বলিস। তা পয়সা এখুনি নিয়ে যাবি? আর একটা চক্কর দিবি নে?
টাইম নেই।
কুণ্ডু আর একটি কথাও না বলে গদিতে গিয়ে খতেন খুলে বসে। পিটপিটে চোখে হিসেব দেখতে দেখতে বলে, সুদে সুদে কিন্তু তোর দেনাটা অনেক জমে যাচ্ছে ফটকে।
তা সেকথা এখন কেন? ফটিকের চোয়াল-ঊচোনো মুখ কঠিন হয়ে ওঠে।
বলে রাখলুম। বলে কুণ্ডু ছ আনা পয়সা বাক্স থেকে বের করে ছুড়ে দিল ফটিকের দিকে।
পয়সাগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে ফটিক প্রায় একদমে বলে ফেলল, পরশুঁকের তিন আনা; তার আগে পাঁচটা গরু, দুটো মোয, চারটে ছাগল, জগাইয়ের এঁড়ে দুটো, এগুলোর দরুন পাওনা রয়েছে আমার। তা ছাড়া…
কুণ্ডু হাঁটু চাপড়ে হেসে উঠল। তুই তো লেখাপড়া জানলে দিগগজ হতে পারতিস্ রে ব্যাটা।
সে কথার জবাব না দিয়ে ফটিক বলল, তা ছাড়া খুচরো আছে বারো আনা।
কুণ্ডু চোখের মণি কোণে তুলে গাল ফুলিয়ে বলল, বাঃ! সেদিনে যে তাড়িয়ালাকে দিলুম সাত আনা, ক দিন গাঁজা নিলি ক পুরিয়া…?
ফটিক একেবারে জল হয়ে গিয়ে চোখ বুজে হেসে উঠল, তাই বলো! মাইরি, ও-শালার নেশাই আমাকে শেষ করেছে। পরমুসুর্তেই চোখ ছোট করে হাসি টিপে আবার বলল, তবু যে তিন আনা বাকি থাকে মশাই!
শুনে কুণ্ডু খ্যালখ্যাল করে এমন হেসে উঠল যে মনে হল তার গলার শিরা ফুলে না আবার তুলসীমালা ছরকুটে যায়। কেষ্ট কেষ্ট বল, বলিহারি তোর হিসেব। তোকে ঠকাবে যে, সে এখনও জন্মায়নি।
বোঝো সেটা, বলতেই মনের মধ্যে কীসের ছটফটানিতে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। ব্যাকুলতা ফুটল তার হলদে চোখে, ঊচোনো চোয়ালের কোলে দেখা দিল বিচিত্র ব্যথার হাসি। বলল, তিন আনা পয়সা পয়সা দেও বাবু, আর দেরি করতে পারিনে। ঘরে আমার মেয়ে মরছে খিদেয়।
তা দিচ্ছি, কিন্তু আর একটা চক্কর দিস ফটকে, নইলে মারা পড়ব। বলে কু চারটে আনি নিয়ে একটা করে ফটিকের হাতে তিনটে দিয়ে পরে বলল, আর এক আনা দিলুম তোর মেয়ের জলপানি।
মুহূর্তে কী যেন ঘটে গেল। কুণ্ডুর চোখে ভয়, মুখে হাসির একটা অদ্ভুত ভাব; আর ফটিকের হলদে চোখ জ্বলে উঠল ধ্বক্ ধ্বক করে। সে-ভাবও এক মুহূর্ত।
আনিটা কুণ্ডুর কোলের উপর ছুড়ে দিয়ে ফটিক বলল, আমার মেয়ে তোমার দেয়া সোনাও পায়ে মাড়াবে না। অমন পসা আবার যদি কোনওদিন দ্যাও
বাকিটা কুণ্ডু বুঝে নিল ফটিকের সর্বনেশে মুখটার দিকে তাকিয়ে। তবু হাঁফ ছেড়ে কুণ্ডু হাসল আর আনিটা রেখে দিল একটা কৌটোতে। এমনি ফিরিয়ে দেওয়া সব পয়সাই কুণ্ডু ওই কৌটোতে রাখে। উৎসর্গীকৃত বস্তু তো আর বাক্সে রাখা যায় না। শুধু মনের মধ্যে একটা গোপন হাসির ধার চকচকিয়ে ওঠে তার।
ফটিক ততক্ষণে কুণ্ডুর বিচুলির গাদা থেকে তিনটে আঁটি নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল খোঁয়াড়ের মধ্যে।
কুণ্ডু হা-হা করে ছুটে এল। কে কার কথা শোনো। ফটিক ততক্ষণে আবার কর ঝাঁপাল কাঁঠাল গাছে উঠে মট করে ভেঙে ফেলল একটা পাতাভরা বড়সড় ডাল, তার পর ছুড়ে দিল ছাগীটার দিকে।
কুণ্ডু তো খেপে মরে। খেঁকিয়ে উঠল, শালা দিচ্ছিস, এর দাম দেবে কে?
ফটিক হাসে হিহি করে, ওরা আইনের মারপ্যাঁচে তোমার খোঁয়াড়ে আসে, তা বলে আইন তো আমার পরেও আছে গো, বলে সে সোজা ঘরের পথ ধরে।
ফোলা গ্যালে একটু থমকে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে কুণ্ড, আর একটা পাক কিন্তু দিস।
ফটিকের কোনও জবাব শোনা গেল না। কুণ্ডু তখন মনে মনে হিসেব করছে, তিন আঁটি বিচুলি আনা আর কাঁঠালপাতা আট আনা, একুনে চোদ্দ আনা। ওই হরেদরে এক টাকা। ঘরে গিয়ে খতেন খুলে ফটিকের ধারের পাতায় এক জায়গায় লিখে রাখল–দফায় এক টাকা।
.
ফটিক এসে পড়েছে প্রায় রেললাইনের উপরে। পশ্চিমদিকে মিউনিসিপ্যালিটির এলাকা, এদিকটা ইউনিয়ন বোর্ডের। ফটিকের কারবার সর্বত্রই।
লাইন পেরিয়ে সে দেখল পশ্চিমা রাখাল বহাল তবিয়তে গান ধরেছে। মনে মনে হেসে ভাবল, ব্যাটা এখনও টের পায়নি। আর একটু এগোতেই চোখে পড়ল, ঝোপের পাশে একটা গাই একলা ঘাস খাচ্ছে। অমনি থেমে পড়ল সে। মুহূর্তে তার চোখে ফুটে উঠল মতলব হাসিলের চিহ্ন। কিন্তু চকিতে মনে পড়ে মেয়েটার কথা। আপন মনে মাথা ঝেকে আবার সে বাড়ির পথ ধরে। বলে, যা বেটি, ছেড়ে দিলুম।
এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে, এই পথে-ঘাটে, ঝোপেঝাড়ে আকা গোরু-ছাগল দেখলেই থেমে যাওয়া। অমনি তার চোখে-মুখে ফোটে ধূর্তের সতর্কতা। ফস্ করে কোমর থেকে দড়ি দিয়ে বেঁধেই পথ ধরে খোঁয়াড়ের। এজন্য অনেকবার তাড়া খেতে হয়েছে তাকে লোকের। গালাগাল-খিস্তির তো কথাই নেই। ঘুম থেকে উঠে তার মুখ দেখলে লোকে প্রমাদ গনে। ছোটখাটো বিপত্তি ঘটলে বলে, এঃ ফটুকে শালার মুখ দেখেছি আজ। তা ছাড়া লাঠি তো উচিয়েই আছে তার মাথার উপর। কেবল হাতেনাতে ধরা যাচ্ছে না বলেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ ফটিক পথের পরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। দাঁড়ায় মনের ভারে। নিজের উপর ধিক্কার আসে তার, ঘেন্না হয়। মনে মনে বলে, এ শালার জীবন তো আর সইতে পারিনে। বলে আর হাতের মুঠোয় ঘেমে-ওঠা পয়সাগুলো কচলায়।
তার দিকে চোখ পড়তেই পশ্চিমা রাখাল ভাবে, গোরুচোট্টাটা দাঁড়াল কেন? সে অমনি সতর্ক হয়।
কিন্তু ফটিকের মনে জলুনিটা এতই তীব্র যে, তাকে একেবারে ন যযৌ নতস্থেকরে দেয়। ছিল চটকলের মিস্তিরি, বাড়তি সংখ্যার গুণতিতে বেরিয়ে এল ছাঁটাই হয়ে। তা-ও আজ সাত বছর হয়ে গেল, কিন্তু এ-সংসারে কাজ নেই কোথাও কাজের মানুষের জন্যে। উপরন্তু অভাবে স্বভাব নষ্ট। ফটিক মিস্তিরি কি না আজ গরু-ভেড়া-ছাগল দেয় খোঁয়াড়ে। …
মনের জ্বালা থেকে নিষ্কৃতির জন্যই যেন সে হঠাৎ মোড় ফিরে ছুটতে আরম্ভ করে তাড়িখানার দিকে। অমনি কে যেন ডেকে ওঠে পিছন থেকে, বাবা গো। চকিতে সে আবার ফেরে। মনই তার মেয়ে হয়ে ডাক দিয়েছে। ইস্! ছুঁড়ি যে খিদেয় মরছে এতক্ষণে। মাঠের পথ ছেড়ে দিয়ে জলার কাদা মাড়িয়ে আবার ঘরের পথে ছোটে। কথায় বলে, যেন একটা লম্বা গেছে ভূতের মতো।
সতর্ক রাখাল গোঁফ মুচড়ে মনে মনে হাসে আর ভাবে, ব্যাটার সাহসে কুলোল না।
মাঠ পেরিয়ে পাড়ায় ঢোকবার ঝোপঝাড় ছাওয়া বাঁকের মুখে পড়তেই ফটিকের কানে এল মিহি মিষ্টি গলার ডাক, আমার বাবা না কি গো!
থমকে দাঁড়াল ফটিক। ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে বুলা, মুখভরা নীরব হাসি নিয়ে।
বুলা অন্ধ। ভ্রূর তলায় মস্ত বড় বড় দুটো চোখের গর্ত। টানা চোখের পাতা, কিন্তু সেই পাতার তলে চোখ নেই, গভীর অন্ধকার। মাজা রং, বসন্তের দাগ তার মুখে। বোঁচা নাক। রূপসী না হলেও অন্ধ বুলার এক অপূর্ব শ্রী ফুটে রয়েছে তার সাদা ঝকঝকে অনুক্ষণ হাসি ও কালো টানা ভুতে। তা ছাড়া, পাড়ার কথায় বলি, কানি বুলার শরীলে যে লেগেছে বয়সের ধার। লেগেছে প্রথম যৌবনের মায়া।
সে এমনভাবে ফটিকের সামনে এসে দাঁড়াল যে, কে বলবে এ মেয়ে অন্ধ।
হুতোশে ফটিক চোখ বড় করে বলে, ঘর থেকে কী করে এলি এত পথ?
বুলা হাসে, পথ যে আমার চেনা গো বাবা।
কী করে তুই বুইলি যে, তোর বাপ আসছে?
বুলা বলে স্বাভাবিক মিষ্টি গলায়, কী করে আবার যেমন করে সবাই বোঝে, বলে সে চোখের পাতা খোলে। পাতার তলায় ঝাপসা অন্ধকারে হাসির মতো কী যেন কাঁপে তিরতির করে। বলে, আমি ঠিক বুঝি। তুমি ছুটে এয়েছ, পায়ে তোমার কাদা।
পায়ে কাদা? অবাক ফটিক নিজের কাদাভরা পায়ের দিকে দেখে বুলার চোখের অঙ্ক কোলের দিকে তাকায়। বলে, কী করে বুইলি?
পাঁকের বাস লাগছে যে নাকে? বাপের হাত ধরে বলে, চলো, ঘরে যাই।
ফটিকের ছ্যাঁচড়া জীবনের হট্টগোলের মধ্যে তাকে যেন ঠিক চেনা যায় না, তেমনি তার এ-মেয়েটির কাছে এলে সেও ভুলে যায় বাইরের কথা।
বাগানের গাছগাছালির ছায়ায় যেতে যেতে বুলাকে একটু কাছে টেনে বলে, হ্যাঁ রে, পেটের জ্বালায় বুঝিন ছুটে এয়েছিলি, বাপ আসে কি না দেখতে?।
ভ্রূ টেনে বুলা বলে, না। তোমার দেরি দেখে মনটা ঘরে রইলনি, তাই।
এমনি কথা বুলার। নিজের খিদে বলল, শখ বলল, বলো দুঃখ-জ্বালার কথা, তার হ্যাঁ নেই।—কেবলি না। কিন্তু ফটিক বুঝি কিছু বোঝে না? তার বুকটা মুচড়ে ওঠে, স্বর বন্ধ হয়ে আসে গলার। এমন করে মেয়েটা সব লুকোয়। যেন সব দেখতে পেয়েও ওর চোখ দুটো অন্ধ করে রাখার মতো। বুঝি ফটিকেরই দায়িত্ব নিয়েছে একানা মেয়ে। কানা মেয়ের শুধু বাপের ভাবনা।
এ-সংসারে ফটিকের জন্য আবার ভাবনা! মা বাপের কথা তো তার মনে পড়ে না। যেটুকু পড়ে, সে তার এক আবাগী পিসি, থাকত ফটিকের বাপের সংসারে। সে মরে যেতে ফটিক এনেছিল বুলার মাকে। বিয়ে দেবার তো কেউ ছিল না, তাই বুলার মাকে ফটিক কেড়ে এনেছিল এক মাতালের কাছ থেকে। বুলা তখন ছ মাসের অন্ধ শিশু। তার পর সেও মরল, রইল বুলা। তখন মনে হত, এটা গেলেই বাঁচি। কিন্তু বুলা তার মনটা আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে, এখন পা বাড়াতেই ভাবনা লাগে, কেমন করে ওর প্রাণটুকু ধরে রাখি।
এই ধরে রাখতে গিয়ে ফটিকের যে ছটফটানি, সেই ভাবনাতেই আবার হাড়মাস কালি হচ্ছে বুলার। তার ভাবনা যে অনেক। এই যে চলেছে বাপের সঙ্গে, এর জন্য পাড়ার সবাই কতই না মুখ বাঁকাচ্ছে, ঠোঁট উলটোচ্ছে, মনে মনে টিপে টিপে তাদের গালাগাল দিচ্ছে। কেউই তাদের ভালবাসে না। সে শুধু ফটিকের ব্যবহারের জন্য নয়, তাদের বাপ-বেটির জীবনকে ওরা কুনজরে দেখে। বালাই-ছাড়া জীবনের সবই বুঝি এমনি হয়।
তবু পাড়ার রোগে-শোকে লোক মরলে বুলা তার বাপকে জোর করে পাঠায়। সকলের বিপদে আছে ফটিক। তখন সবাই বুঝি ভুলেও একবার ভাবে, ড্যাকরাটার মায়া-দয়া খানিক আছে। কিন্তু কোনও আনন্দের উৎসবের মধ্যে তার ডাক পড়ে না। রাত দুপুরে চোর এলে ফটিক যায় আগে, পরদিন সকালে ফিসফিস গুলতানি হয়, চোর যে ফটকে হারামজাদা, তা কারও বুঝতে বাকি নেই।
তা শুনে ফটিক খেপে ওঠে, লাঠি নিয়ে ছুটে যেতে চায়, খিস্তি করে, গালাগাল দেয়। তাড়াতাড়ি বুলা বাপের মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরে রাখে। বলে বাবা যেয়োনিকে। এ শুধু ওদের ঝগড়ার ফিকির। গেলে যে আরও বলবে।
কিন্তু বলি বলি করেও বলতে পারে না যে, এক গরু চুরিই যে সব বাজিমাত করেছে। এই বাজিমাতের মধ্যে আর এক নিদারুণ জ্বালা আছে বুলার মনে, কুণ্ডুবাবুর জন্যে। শুধু জ্বালা নয়, অন্ধ মেয়ের সে এক দারুণ বেদনভরা লজ্জা ও অপমান। যে অপমান রাখবার ঠাঁই নেই, বুকটার মধ্যে শুধু অসহায় অভিশাপের ঝড় বয়ে যায়।
কোনও কোনও সময়ে নিজের যৌবনকে সে অভিশাপ দিতে গিয়ে থেমে যায়। অদেখার আড়ালে যে এসেছে তার শরীরে শিরায় শিরায় রক্তের ঢেউ তুলে, সে যে তার দুটি চোখের মতোই এসেছে তীব্র অনুভূতি নিয়ে। সে যেন না দেখাকে দেখার মতো, না ছোঁয়াকে ছোঁয়ার মতো। তবু কি নেই একটুখানি কাঁটায় খচখচানি? আছে। সেকাঁটা তো বিশ্ব-সংসার ছেয়ে আছে মনে মনে বুকে বুকে। সেকাঁটা এ-জীবনের বেড়াজাল, যে বেড়াজাল সরাবার জন্য সে, তার বাপ ফটিক, এ দুলেপাড়ার সবাই দিনের পর দিন ধরে ভাবে, কাজ করে, বিবাদ করে, এক ফোঁটা আনন্দ পেলে ধরে রাখতে চায় চিরদিনের জন্য।
কুণ্ডুকে সে ভয় পায় না, ঘেন্না করে। সে কানা হোক, হোক বোবা, তবু মন বলল, শরীর বলল, সবই তার নিজের। সেখানে বেঁকে যাবে না কুণ্ডুর শয়তানি।
বুলাকে দাওয়ায় বসিয়ে ফটিক বলে এটুস বস, বাসুর দোকান থেকে দুটো চাল নিয়ে আসি, বলে ফটিক বেরিয়ে যায়।
বুলা ছাড়া ফটিকের সম্বল এই ভিটেটুকু। বেঁকে-পড়া একখানি ঘর। তার গায়ে মাথায় নারকেল-খেজুরপাতার অনেক গোঁজামিল দেওয়া। দাওয়ার এক কোণে উনুন। এ-ভিটেও যে কবেই কুণ্ডুর খতেনের অঙ্কে ড়ুবে গেছে, তা ফটিক জানে, তবু মুখে কিছু বলে না।
বুলা বসে বসে হাসে আর আপন মনে গুনগুন করে। ওই তার স্বভাব।
বেলা যায় মেঘে মেঘে। হিঞ্চেকলমির শাকটুকু নিয়ে ভাত বেড়ে বসে বাপ-বেটিতে একই পাতে। খেতে বসে একজন ভাবে, ঘুড়িটার দিকে দুটো বেশি ঠেলে দি। আর একজন ভাবে, তার জোয়ান বাপের এই কটা ভাত তো একলারই লাগে, সে আর কী খাবে। রোজই তারা এমনি ভাবে আর খায়। কেউই কাউকে ফাঁকি দিতে পারে না।
খাওয়ার পরে ফটিক কোনও কোনও দিন বেরোয়। বেলার দিকে তাকিয়ে আজ আর বেরুল না। দাওয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বুলা বাপের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আপন মনে বলে, পালের গরু ফিরছে।… তার পর হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলে, ঘরের পেছন দে কে যায় গো। নোটন পিসি না কি?
জবাব আসে, হ্যাঁ লো কানি।
কানি! বড় অদ্ভুতভাবে হাসে বুলা।…মনে পড়ে একদিন এক ভিখিরি এসে ভিক্ষে চাইতে বুলা তাড়াতাড়ি একমুঠো চাল দিতে গিয়েছিল। ভিখিরিটাও ছিল অন্ধ। সে যখন টের পেল বুলা অন্ধ, তখন সে হাত গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যেতে যেতে বলেছিল, ধুর, কানির হাতে ভিক্ষে লোবনি।
সেটা পাড়ায় আজও একটি হাসির গল্প হয়ে আছে। বুলা লজ্জায়, অপমানে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু কোত্থেকে একটা গরু এসে তার প্রসারিত হাত থেকে চালগুলো খেয়ে নিয়েছিল। তখন চোখে জল থাকলেও ওমা ওমা করে হেসে সারা হয়েছিল বুলা।
হঠাৎ একটা চিৎকারে বুলার ভাবনা ভেঙে গেল, তন্দ্রা ভেঙে গেল ফটিকের। কী ব্যাপার? কান পাতল ওরা।
চিৎকার করছে চরণ মিস্ত্রির প্রৌঢ়া স্ত্রী। নামহীন গালাগালি ও অভিশাপে ভরে উঠল দুলেপাড়ার আকাশ— যে আমার পোয়াতি গাই পণ্ডে দিয়েছে, সে আঁটকুড়োর শরীল গলে গলে পড়বে, আর জন্মে সে গরু হবে…।
শুধু ফটিক নয়, মুহূর্তে বুলাও বুঝতে পারল এ-গালাগাল কাদের উদ্দেশে।
চারণের বউয়ের গালাগালে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার শত্রুর চেহারা। আঁটকুড়ো মেয়েমেগো, কানি ঘুড়ি নিয়ে সোহাগ করে। ওর কানি যেন পোয়াতি হয়ে পেট খসে মরে পড়ে। ওকে পোড়াতে কাঠের দাম না জোটে, ও যেন মুখ দে রক্ত উঠে মরে। ভগবান যেন ওর দুচোখ কানা করে। কানি রাঁড় নিয়ে যেন ওকে ভিক্ষে
ফটিক হঠাৎ ফুঁসে লাফিয়ে ওঠে, হারামজাদীকে আজ
বাবা! কান্নাভাঙা গলায় চিৎকার করে ওঠে বুলা, বাবা গো!
ফিরে দেখে ফটিক, বুলার অন্ধ চোখের গর্ত থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ছি ছি, বাবা, তুমি যেয়োনি কো।
ওরা আমায় গালাগাল দিক, তোকে কেন?
দিক, আমি যে তোমার মেয়ে। বলে সে ফটিকের পায়ের কাছে এসে মাটিতে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে উঠল। উপোসে মরব, তবু এমন কাজ তুমি আর করো না বাবা। ওদের শাপে তুমি যদি অন্ধ হও…তা হলে আমায় কে দেখবে?…
একটা অসহ্য যন্ত্রণায় ফটিকের মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল, ফুলে উঠল গলার শিরাগুলো। বসে পড়ে বুলার মাথায় হাত রাখল সে। বলল ফিসফিস করে, আমি কী করব বল! একটা কাজের জন্য কার কাছে না গেছি, রোজ হাজিরা দিচ্ছি কলেকারখানায়। ঘুষ চায় একশো টাকা। একটা ঘরামির কাজও পাইনে। কাজ নেই এ-সংসারে, তবে কেমন করে বাঁচি বল?
জবাব নেই বুলার। সত্যি কেমন করে বাঁচা যায় এ-সংসারে। ফটিকরা কেমন করে বাঁচবে, এ-সংসারে সেকথা বলে দেওয়ার কি কেউ নেই? লোকে পরামর্শ দিয়েছে বুলাকে নিয়ে ভিক্ষে করে খেতে। তার চেয়ে ফটিক ঠ্যাঙাড়ে বৃত্তি করে খাবে, তবু ভিক্ষে করতে পারবে না।
ইতিমধ্যে চরণের বউয়ের সঙ্গে সারা দুলেপাড়া গলা মিলিয়েছে। সে এক অদ্ভুত হট্টগোল। বেলা যায়, সন্ধ্যা নামে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসে ফটিকের ঘরে। কিন্তু ওরা বাপ-বেটিতে বুঝি বাঁচার ভাবনাতেই অন্ধকারে বসে থাকে মুখ গুঁজে। অস্থির চিন্তায় আড়ষ্ট, জীবনমরণের সংশয়ে যেন ভীত বিহুল দুটো পাতালগর্তের অভিশপ্ত জীব।
হঠাৎ ফটিক বলে ওঠে, না খেয়ে মরলে তো কোনও শালা দুটো কথা বলতেও আসে না, তবে কীসের খাতির ওদের?
অন্ধকারের দিকে মুখ তুলল বুলা। বুঝি জল লেগেই তার চোখের গর্ত দুটো চকচক করে। বলে, বাবা, কে কাকে দেখবে? অভাব যে বড় শত্রুর। ওদের যেটুকু আছে, সেটুকুই পুতুপুতু ভেসে করে ধরে রাখতে পারে না। আমাদের মতো ওরাও কোনও রকমে বেঁচে থাকতে চাইছে।
গর্তে-ঢোকা হলদে চোখ দুটোতে ফটিকের ব্যথিত স্নেহ ঝরে পড়ে। বলে, চোখ দুটো নেই, তবু এত কী করে বুঝিস তুই বুলি?
চোখ দুটো আমার নেই বলেই। বলে সে হাসে তেমনি করে। যেন কত দূর থেকে তার গলা ভেসে আসে, বাবা, আমার চোখ দুটো নেই, তাই মনটা সব্বোখন যেন হাঁ করে থাকে দেখবার জন্যে। সব বোঝা আমার ওইভেনে। ভাবি, যাদের চোখ মন দুই-ই আছে, তাদের বুঝিন কোনওটাই পুরো নয়; আমার যে একটাই সব, বলতে বলতে তার চক্ষুহীন গর্ত থেকে আবার জল পড়ে, তবু ভাবি, চোখ দুটো থাকলে চটকল বা চালকলে কোনও কাজকর্ম করতে পারতুম।
ফটিক বোঝে, এ হল বুলার বাপের গঞ্জনা, অপমানের ব্যথা। সে চোয়াল উঁচিয়ে উঁচলো মুখে ঢোক গিলতে থাকে আর মনে মনে বলে, তোকে যন্তন্না দিতে আর যাব না গরু ধরতে, যাব না…
হঠাৎ পরিষ্কার গলায় বলে বুলা, বাবা, চাঁদ উঠেছে বুঝিন?
ফটিক চমকে উঠে দেখে, তাই তো, কখন তার দাওয়া পেরিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে অন্ধকার কাঁচা মেঝেয়। আলোভরা উঠোনে যেন কালো রঙে লেগে আছে পিপুলের ছায়া। মনে হয় যেন দু চোখ মেলে নির্বাক জ্যোৎস্না ঘরে এসে তাদের বাপ-বেটির কথা শুনছে। ফটিক বলে, কী করে বুইলি?
বুলা বলে, দ্যাখো না, সারাদিনের পর হাওয়া দিচ্ছে, কাগ ডেকে উঠছে, নক্কীপ্যাঁচা ডাকছে। তা ছাড়া কাল যে একাদশী গেছে।…চলো বাবা, বাইরে যাই।
চল্। বুলাকে নিয়ে ফটিক বাইরে এসে বসে।
শরতের রাতে কালো আকাশ। তারা দেখা যায় না। আকাশে তিন পো চাঁদ। শরতের এই আলো-আঁধারির কুহেলিতে মনে হয় যেন কোনও এক নির্বাক অশরীরী ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই মুহূর্তটিতে তারা ভুলে যায় তাদের দৈন্য ও উৎপীড়নের কথা। বুলা বকবক করে আপন মনে। ফটিকের মনে পড়ে যায় বুলার মাকে। তার পরে চকিতে মনে আসে চরণের বউয়ের গালাগালি, ওর কানি যেন পোয়াতি হয়ে পেট খসে মরে।..হঠাৎ সে বলে, বুলা, তোর বে বসতে মন চায় না?
এক মুহূর্ত থমকে বুলা খিলখিল করে হেসে উঠে। অন্ধ মেয়ের সে হাসিতে সারা দুলেপাড়ায় যেন বিচিত্র স্বপ্ন নেমে আসে। সামনে বাপ হলেও শরীরের কাপড় গুছোয় সে। দশজনের চোখের মধ্যে যে সে নিজেকে দেখেছে। পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে বিস্মিত মুগ্ধ মুখে চোখের পাতা মেলে ধরে আকাশের দিকে। যেন কান পেতে শুনছে কার পদধ্বনি। তার পর আস্তে যেন আপন মনেই বলে, হ্যাঁ বাবা, মন চায়। বলে ফেলেই মাটিতে মুখ লুকোয় দুরন্ত লজ্জায়। ফটিক হো-হো করে হেসে ওঠে হেঁড়ে গলায় আর তার চোখ ছাপিয়ে হঠাৎ জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
এমন সময় একটা ছায়া পড়ে উঠোনে! চোখের জল মুছে ফটিক বলে, কে গা?
এই আমি। যেন খানিকটা ভয়ে ভয়েই বলে কুণ্ডু একটু হেসে হেসে।
কুণ্ডুবাবু? ফটিক বলে, কী মনে করে?
কী মনে করে? আর কিছু না বলে কুণ্ডু এক পা এক পা করে এগোয়–এই এলাম একটু তোকে দেখতে। কুণ্ডুর গলায় কথা আটকে যায়। ফটিক মনে মনে দাঁত পেষে আর বুলা মনে মনে বলে, নচ্ছার এসেছে ওর মরণ দেখতে।
ফটিক বলে তা এসেই যখন পড়েছ তখন বসো।
এ কথার হুলটুকু খেয়েও কুণ্ডু বলে, না, এসেছিলাম তোকে বলতে যে, আর একটা পাক তো দিলিনে।
বুলা কী যেন বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ফটিক বলল, শখানেক টাকা দেবে কুণ্ডুবাবু, ঘুষ দিয়ে একটা চাকরি পাই তবে।
এবার কুণ্ডু হাসে একটু পরিষ্কার গলায়, তোর চাকরি হলে আমার কাজ করবে কে?
বুলা এবার তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, তোমার অমন কাজের মুখে ছাই। কাজ না ছ্যাঁচড়ামো? ভ্যালা ধম্মের খোঁয়াড় খুলেছ।
কুণ্ডর রঙ যেন আর একটু চড়ে। বলে, পয়সার কাছে আবার চড়ামো কী! মা লক্ষ্মী যেমন দেবে। এই দ্যাখ না, ফটকেকে তোর জন্যে কতদিন জলপানির পয়সা দি, আনে না। আনলে তো একটা বেলা…
কথার মাঝেই ধীর গলায় ফটিক বলে ওগঠ, রামদাটা কোথায় রে বুলা?
অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে হেসে জবাব দেয় বুলা, ঘরে আছে। নিয়ে আসব? হাসলে অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা ফোটে বুলার গলায়।
কুণ্ডু তাড়াতাড়ি বলে, আচ্ছা, তা হলে আসি ফটিকচাঁদ। কালকে যা, বলেই সে চকিতে পিপুলের ঘন অন্ধকারে মিশে যায়।
অমনি তারা বাপ-বেটিতে এক সঙ্গে গলা ছেড়ে হেসে ওঠে। তাদের ছন্নছাড়া জীবনের এ দরাজ হাসি শুনে সারা দুলেপাড়া যেন চমকে ওঠে। যেমন হঠাৎ হাসি, তেমন হঠাৎই তা থেমে যায়। এহাসি যে তাদের অভিশপ্ত জীবনের অন্ধকারকে উড়িয়ে নিতে পারবে না।
না, পারে না। অন্ধকার যেন আরও জমাট হয়ে আসে। কতবার ফটিক মনে মনে ভেবেছে গরু ধরতে আর যাবে না। কিন্তু কোথায় ভেসে গেছে সেই প্রতিজ্ঞা। কারখানায় ঘুষ ছাড়া কাজ হবে
। ঘুষের টাকাও দেবে না কুণ্ডু। সারা গাঁয়ের সমস্ত এঁদো পুকুরের কলমি-হিঞ্চে ঝেড়ে-মুছে বিক্রি করেছে ফটিক। তা-ও আর নেই।
মাঠে মাঠে পথে পথে ঘোরে। আকাশে শরতের ঝিমমারা মাথাধরা রোদ। গায়ে কম্প দেয়। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে-পড়া মাথাটা দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে পথে পথে ঘোরে! কেবলি যেন কানে আসে, বাবা গো!…মরছে মরছে কানা মেয়েটা খিদেয়। নাকি বুঝি নিজের পেটের জ্বালাই বার বার মনে করিয়ে দেয় মেয়েটার কথা! বারে বারে সে ছুটে যায় কুণ্ডুর কাছে।
কুণ্ডু বলে, দেনা তো তোর অনেক চড়েছে, নিজে না খাস, সেটা শুধবি তো?
জ্বরের ঘোরে লাল চোখে একটু তাকিয়ে থেকে আবার ছুটে যায় ফটিক। না, আজকাল আর গরুও নেই পথে। পশ্চিমা রাখালটা চাকরির ভয়ে সব সময় সজাগ। সজাগ সকলে। শুধু ধর্মের ষাঁড় ঘোরে পথে পথে। একটা জাদুশিঙেও যদি থাকত! যেন ফুকলেই সব গরু-ভেড়া ছুটে আসত তার কাছে। কিন্তু মেয়েটা? মেয়েটা কী খাবে? ভাবে আর নিজের পেটে হাত দিয়ে বসে থাকে।
কুণ্ডু বলে, দেনা তো তোর অনেক চড়েছে, নিজে না খাস, সেটা শুধবি তো! তার পর চোখ ঘুরিয়ে বলে, আর, লোকের গোয়ালেও কি গোরু নেই?
অর্থাৎ গোয়াল থেকে চুরি করতে বলছে।
মেয়েটা উদ্বেগে মাঠের ধরে শুকনো মুখে বসে থাকে। কখন শুনবে মাঠের মাঝে সেই পায়ের শব্দ। মনে মনে বলে, বাবা গো, আমি খাবনি, তুমি ফিরে এসো।..তবু হু-হু করে কেঁদে ওঠে পেটের ব্যাথায়।…
যদিও ফটিক ঘরে আসে, বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।
.
দিকে দিকে বাজে শারদোৎসবের বাজনা। পুজো এসে পড়েছে। চারিদিকে কেনাকাটার রব।
বিকালবেলা ফটিক নবগাঁ পেরিয়ে শ্যামপুরের পথে পড়ে। একটা গরু হা-হা করে ছুটে আসে তার সামনে। ফোঁসফোঁস করে। দিক ভুলেছে গোরুটা। থমকে দাঁড়ায় ফটিক। দেখে এ-দিক-ও-দিক। তারপরে হঠাৎ কী মনে করে কষে এক ঘা লাগায় গরুটার পিঠে। বলে, পালা, পালা হারামজাদী, নইলে মরবি গিয়ে কুণ্ডুর খোঁয়াড়ে। বলে সে নিজেই পালায়। পালায় যেন সেধে-আসা পয়সা ফেলে।
তার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় একটা চালার কাছে। চালাটা গাঁয়ের প্রান্তে। খেজুর গুড় জ্বাল দেওয়ার উনুন ঘর—আর একটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে এক পাল গোরু। অদুরেই উঁচু পাড়-ঘেরা একটা নতুন-কাটানো ডোবায় জলের ছপছপ শব্দ শোনা গেল। ফটিক উঁকি মেরে দেখল, একটা মুনিষ চান করছে, বোধ হয় ফেরার পথে। চকিতে সে একবার এদিক-ওদিক দেখে অসীম সাহসে ভর করে খুঁটি থেকে খুলে ফেলে গরু কটাকে। গাইবাছুর মিলিয়ে সাতটাকে এক দড়িতে বেঁধে লহমায় সে নেমে পড়ে পথে। একটা গাছ থেকে ছপটি ভেঙে, সপাং সপাং করে মারতে মারতে, ধুলোর ঝড় উড়িয়ে সে খোঁয়াড়ের পথ ধরে।
কুণ্ডুর খোঁয়াড়ে যখন এল, তখন ঘামে ধুলোয় তাকে আর চেনাযায় না। কিন্তু ফটিক জানে এ-ঘাম মরে গেলেই কম্প দিয়ে জ্বর এসে পড়বে। তার আগেই সে পয়সা নিয়ে চলে যাবে। তিন দিন ধরে যে নির্জলা উপোস চলেছে।
কুণ্ডু মহা খুশি হয়ে চাবির গোছাটি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে এসেই চোখ ছানাবড়া করে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্ত চুপ থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে শালা, এ যে আমার গরু সব গোয়ালসুদ্ধ ধরে এনেছিস! শালা, কোত্থেকে এনেছিস?
প্রথমটা একটু ভড়কে গেল ফটিকও। কিন্তু চকিতে নিজেকে শক্ত করে ফটিক বলল, গোয়াল-টোয়াল নয়, রাস্তা থেকে ধরে এনেছি। আইনের ব্যাপার। সে তোমারই হোক, আর যারই হোক। একটা টাকা ফেলো নয় তো বললো আমাদের পণ্ডে দে আসি।
অর্থাৎ মিউনিসিপালিটির আওতায়।
ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ কুণ্ডু কেমন করে ছেড়ে দেয় নিজের গরুগুলো অথচ ফটিককেও তার বিলক্ষণ চেনা আছে। তাড়াতাড়ি সে একটা টাকা এনে দিয়ে গোরুগুলোকে নিজের হাতে নেয়।
ফটিক বলে, রাগ করোনি কুণ্ডবাবু, খেতে তো হবে।
সে তাড়াতাড়ি ছুটে চলে ঘরের পথে। না, ঘরের পথে নয়, বাজারের দিকে। মনে মনে বলে, একটু থাক মা, এলুম বলে।
কুণ্ডও তখনি চাকরের উপর সব ভার দিয়ে চাবির গোছা কোমরে বেঁধে থানার পথ ধরে।
সে যখন দারোগাবাবু আর সেপাইয়ের সঙ্গে বাজারের কাছাকাছি এসেছে, সেই সময়টিতেই ফটিক বেরোয় বাজার থেকে, কোঁচড়ে চাল নিয়ে।
কুণ্ডু চেঁচিয়ে উঠল, দাবোগাবাবু, ওই যে শালা গরু-চোর।
বলতে না বলতেই যমদূতের মতো সেপাই একটা ঝাপিয়ে পড়ে ফটিকের উপর। এ আচমকা আক্রমণে কোঁচড়ের চালগুলো ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে।
দারোগাবাবু বললেন, যাক, আর অদুর যেতে হল না।
সেপাই বলল, চল শালা।
চালগুলোর সঙ্গে যেন ফটিকের প্রাণটাই ছড়িয়ে পড়েছে। দিশেহারা হয়ে সে বলল, কোথায়?
কুণ্ডু বলল দাঁতে দাঁত পিষে, শালা, সরকারের খোঁয়াড়ে।
হঠাৎ সে বেঁকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, বাবু, আমার কানা মেয়ে যে একলা রয়েছে।
কুণ্ডু ফোলা গালে হাসি ফুটিয়ে বলল, সেটা যাবে আমার ধম্মের খোঁয়াড়ে।
এতক্ষণে যেন সব হৃদয়ঙ্গম করে সে ভাঙা হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, বুলা-রে…।
ততক্ষণে তার মুখটা উলটো মুখে থানার দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
.
আর বুলা তার নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে টুকটুক করে চলেছে মাঠের পথে। দিনেও যেমন, রাতেও তেমন চলেছে চেনা পথে, বাগানের ভিতর দিয়ে! হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আকাশের দিক মুখ করে বলে, চাঁদ উঠেছে বুঝিন?
সত্যি, চাঁদ উঠেছে আকাশে। বিষঃ জ্যোৎস্না যেন অবাক হয়ে চেয়ে আছে অন্ধ মেয়েটার দিকে। গাছের ভেজা পাতায় কাজলের চকচকানি। সেখান থেকে বুকভরা নিশ্বাসের মতো হঠাৎ হাওয়া বয়ে যায় বুলার মাথার উপর দিয়ে।
বুলা থমকে দাঁড়ায় খসখস আওয়াজে। নিজেই বলে, দূরদুর শেয়ালগুলো। সত্যি একপল শেয়াল চলে গেল। কিন্তু বেঁকে পড়ে বুল। পেটটা পিঠে ঠেকে যেন দুমড়ে পড়তে চায় মুখ থুবড়ে।
মুখ করে তুলে পাকিয়ে যখন পেটের মধ্যে কয়নি। তোমার করে আর ফিফা
কোত্থেকে ডাল-সম্বরার মিঠে ঝাঁজের গন্ধ আসে হাকা। গলা ভিজে ফুলে ফুলে ওঠে বুলার নাসারন্ধ্র। তাতে যেন নির্বাক জ্যোৎস্নারই গোঙানি উঠল হঠাৎ ঝিকির ডাকে।
মাঠের ধারে এসে বসে পড়ল বুলা। যেদিক থেকে তার বাবা আসবে, সেদিকে মুখ করে তুলে রাখল চোখের পাতা। চোখের সেই অন্ধ গর্তে যেখানে দলা পাকিয়ে আছে কতকগুলো শিরা-উপশিরা, সেখানটা কাঁপতে থাকে থরথর করে; আর ফিসফিস করে বলে, বাবা গো, খেপলে যে তোমার মাথার ঠিক থাকে না। তোমার বুলা খেতে চায়নি, তুমি ফিরে এসো
কিন্তু পেটের মধ্যে কারা যেন ব্যথার ধাক্কা দিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে। শেষটায় অনেকক্ষণ বসে থেকে যখন সে শুনল থানার পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বেজে গেল, তখন সে ভাবল, বাবা তো তার এত দেরি কোনও দিন করে না। তবে কি বাবা মাঠের ও-পারে তাড়িখানায় পড়ে আছে? তার অন্ধ চোখ ফেটে জল গড়িয়ে এল। গলা ফাটিয়ে ডাক দিল আমার বাবা গো..। লাইনের উঁচু জমিতে তার প্রতিধ্বনি ফিরে এল।
আর আশ্চর্য, যে চরণের বউ ওদের বাপ-বেটিকে এত গালাগালি করেছিল, সে নিজের অন্ধকার ঘরে শুয়ে বুলার ডাক শুনে আপন মনে বকবক করে উঠল, বাপ না, সে হারামজাদা কশাই। নইলে অমন সোমত্ম কানি মেয়েটাকে কেউ এমনি ফেলে রেখে যায়! বলে সে চরণকে বলল, মনটা খারাপ গাইছে চলো তো এট্টুস দেখে আসি। বলে সে মাঠের পথ ধরল। আর মাঠের উপর তখন দেখা যায়, অন্ধকারে কুণ্ডু এদিকে আসছে দ্রুতপদে–নিঃশব্দে।