কাজের সময় কাজি
সব জীবেরই একটা সমাজ আছে। বাঘের আছে। সিংহের আছে। পাখির আছে। কুকুরেরও আছে। সাধারণ কিছু নিয়ম তারা মেনে চলে। ঝাঁকের পাখি, ঝাঁকের মাছ কদাচিত নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে। ক্যানিবলিজম নেই বললেই চলে। বাঘে বাঘ মারে না। গোয়ালে দুটো গরু পাশাপাশি বাঁধা থাকলে রাতে একটা আর একটাকে খেয়ে ফেলে না, বা গুঁতিয়ে মেরে ফেলে না। গোয়ালে দরজা খুলে মুংলী গাই প্রতিবেশীর গোয়ালে ঢুকে ঝুমরী গাইকে বলে না, চল মাধুকে বাঁশ দিয়ে আসি।
মানুষ খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। ভাবতে জানে, ভাবাতে জানে। সারা পৃথিবী তার পায়ের তলায়। আকাশের দূর প্রান্ত তার দখলে। সুচারু চেহারা। বড় বড় দাঁত নেই। নখওয়ালা সাংঘাতিক থাবা নেই। মানুষের গ্রন্থাগারে জ্ঞানঠাসা বই। মগজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বীজ। মুখে বড় বড় কথা। প্রেম, ভালোবাসা, আত্মোৎসর্গ, হিতসাধন। তবু মানুষের মতো অনিশ্চিত প্রাণী জীবজগতে আর দুটি নেই।
সাপ ছোবল মারবে জানা আছে। বাঘ ঘাড় মটকাবে ধরে নিতেই পারি। কাকের বাসায় খোঁচাখুঁচি করলে ঠুকরে চাঁদি ছ্যাদা করে দেবে, অজানা নয়। মানুষ কী করতে পারে জানা নেই। নির্জন পথে ট্যাক্সি-ড্রাইভার হঠাৎ পেটে ভোজালি চেপে ধরে যাত্রীর সব কেড়ে নিতে পারে। ট্রেনের সহযাত্রী হঠাৎ সশস্ত্র ডাকাতের চেহারা নিতে পারে। ক্ষমতালোভী নেতা মায়ের কোল থেকে তার শিশুটিকে কেড়ে নিয়ে ধড় মুণ্ডু খণ্ড করতে পারে। মানুষ মানুষের হাত ধরে টেনে তুলতে পারে, আবার গলায় ছুরিও চালাতে পারে।
মানুষের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মানুষের ওপর বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাসই এসে যায়। ইতিহাসের ধারায় মানুষ যত শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে, ততই মানুষ সংকীর্ণ আর স্বার্থপর হয়েছে। মানুষের সমাজ বলে আর কিছু নেই। সকলেই আমরা অসামাজিক, আত্মসেবী প্রাণী। স্বার্থ ছাড়া মানুষের সম্পর্ক আজকাল আর টেঁকে না। যতদিন স্বার্থ ততদিন আসা-যাওয়া। স্বার্থের আদানপ্রদান শেষ হয়ে গেলেই আর টিকির দেখা নেই। প্রবাদটি ভারী সুন্দর ‘কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি’। অমুককে ধরলে ছেলের চাকরি হতে পারে। সকাল বিকেল আসা-যাওয়া। কুশল বিনিময়। বাড়ির কে কেমন আছে, এমনকী কুকুরটা কেমন আছে! কতই যেন হিতৈষী বন্ধু! তারপর আর পাত্তা নেই। যাকে মনে হয়েছিল মরলে খাটের সামনের দিকে কাঁধ দেবে, দেখা গেল সে বাঁশ নিয়ে তেড়ে আসছে। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কালে ছিল, এখনও তাই আছে। বরং আরও বেড়েছে। অমুকের পাড়ায় খুব হোল্ড আছে, হবু নেতার হাত এসে পড়ল একেবারে কাঁধে। ভাই সম্বোধন। নেতা যেই এম. এল. এ. হয়ে টাটে বসলেন, অমনি অমুক হয়ে গেল লোফার। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কও স্বার্থের সম্পর্ক। প্রেম, প্রীতি, সাতপাকের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, ‘যদিদং হৃদয়ং মম’ একটা মানসিক সান্ত্বনা, হ্যালুসিনেসান, বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। যতদিন করতে পারবে ততদিন খাতির। স্বার্থের রোদে প্রেমের শিশির শুকোতে থাকে। শেষটা পরস্পর পরস্পরকে দন্ত প্রদর্শন করে বেঁচে থাকা। স্ত্রী আগে সরে পড়লে, বয়েস থাকলে আবার পিঁড়িতে গিয়ে বোসো। স্বামী আগে গেলে হাতড়াও বিত্ত কী পড়ে রইল। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে তবে একসেপসান ইজ নো ল। প্রচলিত প্রথা আর বিশ্বাসের তলায় নগ্ন সত্য চাপা পড়ে থাকে। সত্যপ্রকাশে সভ্যতা এখনও লজ্জা পায়।
আমি মানুষ বড় ভালোবাসি। কখন? যখন বোঝার ভারে ক্লান্ত। তখন শক্তসমর্থ একজন মানুষ চাই। তার মাথায় মালটি তুলে দিয়ে পেছন পেছন চলো, ঝাড়া হাত-পায়ে। আমি মানুষ বড় ভালোবাসি। কখন? আমার জমিতে ফসল ফলাবে কে? কে আমার গোলা ভরে দেবে! কারা আমাকে, আমার বাছাকে দুধে-ভাতে রাখবে! খেতমজুর। কে আমার উৎপাদন যন্ত্রের চাকা ঘুরিয়ে আমাকে শিল্পপতি বানাবে? দিনমজুর। আমি মানুষ বড় ভালোবাসি। কখন? যখন আমার কুটোটি নাড়ার অভ্যাস থাকে না, তখন মানদা আর মোক্ষদারা আমার বড় প্রিয়। আমার এশট্যাবলিশমেন্টের দরজায় বন্দুকধারী মানুষ, আমি ওপরে উঠব আমার পায়ের তলায় মানুষের পিঠ। আমি তীর্থে যার পুণ্যসঞ্চয়ে মানুষের কাঁধে চড়ে। এমনকী চিতায় চড়তে যাব চার কাঁধে চেপে; কিন্তু মনেপ্রাণে আমি চার দেওয়ালের বাসিন্দা। তোমরা সবাই থাকো আমার প্রয়োজনে। তোমার প্রয়োজনে আমি নেই।
আবার জন্মের জন্যে একজন পিতা ও একজন মাতার প্রয়োজন ছিল। বুদ্ধি না-পাকা পর্যন্ত তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল। যেই আমার পিপুলটি পাকল তখন আমি এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। হাত খরচের টাকা না পেলে সন্তান পিতার কান কামড়ে দিতে পারে। পিতাও সন্তানের হাত কামড়ে দিতে পারে। শেষে দুজনেই হাসপাতালে। এ যুগের প্রকাশিত ঘটনা। যা প্রকাশ পায়নি তা আমরা মনে পুষছি। সকলেরই এক বক্তব্য, আমরা এক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছি। সমাজ বলে আর কিছু থাকবে কি? আমরা প্রত্যেকেই উদাসীনতার শেষ সীমায় হাজির। পরস্পর মারমুখী। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে হাতাহাতি! আইনস্টাইন ঠিক এই আলোচনাই করতে গিয়েছিলেন আর-এক বিখ্যাত চিন্তাবিদের সঙ্গে। আর একটি বিশ্বযুদ্ধ মানেই মানবজাতির সম্পূর্ণ ধ্বংস। তাতে সেই জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘Why are you so deeply opposed to the disapperance of the human race?’
সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্যে বিজ্ঞান অনেকাংশে দায়ী। মানুষ আর মানুষের ওপর নির্ভরশীল নয়। তৈরি হয়েছে যন্ত্রসমাজ। দয়া, মায়া, প্রেম, প্রীতি বেরিয়ে চলে গেছে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হল মানুষও এক যন্ত্র। থিংকিং অ্যানিম্যাল। আহার, নিদ্রা, মৈথুন, প্রজনন। সংখ্যায় বাড়ো। রাষ্ট্রনায়ক সৈনিক চায় প্রতিবেশী রাজ্যে হামলার জন্যে। ক্যাপিট্যালিস্ট মানুষ চায় ক্রেতা হওয়ার জন্যে। যন্ত্রের উৎপাদন জৈব মানুষের ভোগে লাগাতে হবে, তবেই না মুনাফা! তবেই না আমার গাড়ি, বাড়ি, ফ্যান, ফোন, ফ্রিজ। সংখ্যায় বাড়ো। রাজনীতি ঝাণ্ডা তোলার মানুষ চায়। মানুষের মধ্যে জাতিভেদ না থাক, ধনভেদ থাকা চাই। একের পেছনে আর-এক যদি লেগে না থাকে শাসনের সহজিয়া পদ্ধতি ভেঙে পড়বে। নীতিটা যে, এলোমেলো করে-দে মা, লুটেপুটে খাই। মানুষকে মানুষ দিয়েই মারতে হবে। মানুষ দিয়েই ভয় দেখাতে হবে। কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা আঙুল তুলে দেখাবে, দ্যাখো দ্যাখো, কমপালসান আর টেরার—বাধ্যবাধকতা আর ভীতির কি যাদু! আমাদের শক্তি আজ কোথায় উঠেছে। সোস্যাল ডেমক্রেসি পৃথিবীতে অচল। Full intellectual growth is dependent of the foundation of open on concealed slavery।
এই বিশাল, বৈরী পৃথিবীতে মানুষ কখনই একা বাঁচতে পারবে না। জীবন একটা যৌথ প্রচেষ্টা। চাঁদির চাকতি ছুঁড়ে আলু, পটল, ঢ্যাঁড়শ পাওয়া যায় ঠিকই। সেবাও হয়তো পাওয়া যায়। তার মানে এই নয়, সামাজিক সদ্ভাবের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। জনপদ মধ্যরাতে যখন ঘুমে অচেতন মানুষ তখন কার ভরসায় চার দেওয়ালের আশ্রয়ে পড়ে থাকে! চৌকিদার! বিজ্ঞানের যুগে কোনও কোল্যাপসিবল গেট, রোলিং শাটার, কি থান্ডার লক নিরাপত্তার শেষ কথা নয়। তবু ঘুম আসে, স্বপ্ন আসে। কেন আসে? সেই বোধ থেকে আসে, আমি মানুষের সমাজে বাস করছি। মহাশুন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি না। ভারী সুন্দর একটি ইহুদীপ্রবাদ আছে—A man can eat alone, but not work alone.
জ্ঞানের অভাব নেই তবু চিন্তাশীল মানুষ আজ একঘরে। কে কার কথা শোনে! যন্ত্রের যুগে মানুষ এক বোধশূন্য গতি। কোনও কিছুতেই আর আস্থা রাখা যায় না। সমস্ত প্রতিষ্ঠান মর্যাদা হারিয়েছে। সমস্ত ইজম খড়ের পুতুল। সমস্ত আশ্বাস এক ধরনের ভাঁওতা। পৃথিবী এখন বড় বেশি উত্তপ্ত। মানুষ যেসব বাঁধন দিয়ে পশুটিকে খাঁচায় আটকে রেখেছিল সে বাঁধন খুলে গেছে। পশ্চিমের দেহবাদ আর জড়বাদ আমাদের মগজ ধোলাই করে দিয়েছে। সংস্কৃতি মৃত। সহবত অদৃশ্য। সংকর মতবাদে মানুষ একটি ফুটো চৌবাচ্চা। মুখ দিয়ে ঢোকাও, পেছন দিয়ে বের করে দাও আর ইন্দ্রিয়ে পাখার বাতাস মারো। ও মরছে মরুক, আমি তো বেঁচে আছি! দুটো হাত নিজের সেবাতেই ব্যস্ত। দুটো পা শুধু নিজের লক্ষ্য-বস্তুর দিকেই ছুটছে। চোখ দুটো নিজের ভালো ছাড়া কিছুই দেখতে পারে না। মগজ কু-চক্রে ঠাসা। এমন জীবের সমাজ থাকে কী করে! তাই যেকোনও বাড়িতে সারা রাত ধরে ডাকাতি হতে পরে। নিত্য বোমবাজি যেন মন্দিরের সন্ধ্যারতি। দশজন ধরে একজনকে পেটাতে পারে। কেউ মাথা ঘামাবে না। গৃহবধূর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া চলে। রামের ঘর সামলাতে শ্যামের উপদেশ পাওয়া যাবে না। শিক্ষিত মানুষ শুধু একটি কথাই বলতে শিখেছে—নান অফ মাই বিজনেস। আমি বেশ থাকলেই বেশ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু অভিযোগ-পাড়ায় আর টেঁকা যায় না ভাই। কুকুর আর অ্যান্টি-সোস্যালস এত বেড়েছে! চতুর্দিকে করাপসান। অ্যান্টি-সোস্যালস তো আমরা সকলেই। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনেই তো এক শ্রেণিতে। আমরা নিজের ত্বকে ক্রিম ঘষছি, আয়নায় মুখ দেখছি, বড় বড় উপদেশ ছুঁড়ছি আর শ্যান পাগল বুঁচকি আগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সমাজের ত্বকে খড়ি ফুটছে, চুল উসকো, চোখ লাল। নিজের পেটে ভিটামিন, অন্যের পেটে বাতাস। এক ধরনের ধর্মও বেঁচে আছে। বাঁক কাঁধে তারকেশ্বর। কালীর মন্দিরে দীর্ঘ লাইন। হাতে চ্যাঙারি, লটকানো জবার শুঁড় দুলছে, কোণে গোঁজা ধুপ ধোঁয়া ছাড়ছে। এদিকে ভিখিরি দেখলে গৃহকর্তা তেড়ে উঠছেন। চিবিয়ে চিবিয়ে উপদেশ ঝাড়ছেন—চাকরি করতে পারো না! মহাশয় এদেশে চাকরি আছে! ক্ষমতা থাকলেও বঙ্গসন্তানের জন্যে আপনার বুক কাঁদবে! আমি ছাড়া সবাই লোফারস, স্কাম অফ দি আর্থ।
মানুষ যতটা অমানুষ হয়েছে, অমানুষ তার চেয়ে বেশি অমানুষ হয়নি। কুকুর কুকুরই আছে। বাঘের স্বভাব বাঘের মতোই আছে। মধ্যাহ্নে পাখির জটলায় ঝাঁকের ধর্ম বজায় আছে। মানুষ জানে, আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনঞ্চ; সামান্যমেত পশুভির্নরাণাং।। ধর্ম্মো হি তেষামধিকোবিশেষ্যে ধর্ম্মেণ হীনা: পশুভি: সমানা:।। তবু মানুষ যেন কেমন আচ্ছন্ন। সূর্যে গ্রহণ লেগেছে।