1 of 2

কাজিরাঙা

কাজিরাঙা

ক্যালকাটা ক্লাবে গত শনিবার হঠাৎ মণীসদার সঙ্গে দেখা সুব্রতর। সুদর্শন, প্রাণচঞ্চল মণীসদা এখনও সেরকমই আছেন। হাই কোর্ট থেকে সোজা আসছেন বলে মনে হল। সঙ্গে এক ভদ্রলোক।

কী ব্যাপার? স্টিল গোয়িং স্ট্রং সুব্রত বলল।

কী করব? তুমি তো জানো, তোমার বউদি কবে চলে গেছেন। ছেলে বম্বেতে গুজরাটি মেয়ে বিয়ে করেছ। এদিকে আর আসে না। মেয়ে বাঙ্গালোরে, IBM-এ চাকরি করে। অনেক টাকা মাইনে পায়। কোম্পানি থেকে পৃথিবীর সব জায়গাতে কাজে পাঠায়। তার বিয়ে করার সময় হয়নি। বাড়িতে যে পুরোনো চাকর ছিল আমার, সে-ই ছিল আমার বউ চলে যাবার পর বউ, ছেলে-মেয়ে দূরে যাবার পর থেকে ছেলে-মেয়ে। সেও সেদিন চলে গেল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে। এখন সাহেব হয়ে গেছি সুব্রত। নিজের প্যান্ট-কোট নিজেই ইস্ত্রি করি, নিজের ব্রেকফাস্ট নিজে বানাই। দুপুরটা ক্যালকাটা ক্লাব বা সুইমিং ক্লাবে লাঞ্চ খেয়ে নি-রাতে দুধ-মুড়ি।

টাকার দরকার নেই তো কাজ করেন কেন?

আরে কাজ করি বলেই তো মরিনি এখনও। আর টাকার জন্যে কে কবে কাজ করেছে সুব্রত? যাঁরা তা করেছে তাঁরা আদৌ কাজের লোক নয়–উদরপূর্তির দল।

তবে কীসের জন্যে করছে?

জব স্যাটিসফ্যাকশান, সুনাম, সম্মান–এইসবের জন্যে। তবে সেইসবেই এখন টান পড়েছে। বলে এবার আমিও কাজ ছেড়ে দেব ভাবছি। লুঙি-পাঞ্জাবি পরব, ঘরে কাচা, পায়ে চটি-আর এই সচার্ট দেওয়া সাদা পট্টি, কালো কোট, সাদা শার্ট আর ব্যারিস্টারস স্ট্রাইপ ট্রাউজার পরব না। ছাতা হাতে পথে পথে স্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা করে হেঁটে বেড়াব, পথের ষাঁড়ের মতো।

চলুন, লাঞ্চের আগে একটা কাম্পারি তো খাবেন? কতদিন পরে দেখা!

চলো। এই আমার বন্ধু। নাগপুর থেকে এসেছে। খুব ভালো প্র্যাক্টিস নাগপুর আর বম্বেতে, নাম কালাসকার, নীতিন কালাসকার। কলকাতার ট্রাইবুনালে এক ক্লায়েন্টের রিলেটেড ম্যাটার ছিল–আমাকে দিয়েছিল-আজই সন্ধ্যের ফ্লাইটে নাগপুর ফিরে যাবে।

কেস হয়ে গেল?  

বলছি পরে। তোমার কী খবর? তুমি তো হাই কোর্টে কখনোই আসবে না, কারণ তুমি তো চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কিন্তু ট্রাইবুনালে তো প্রায় রোজই যেতে, আজকাল একেবারেই দেখি না। কেন, সুব্রত?  

আমার মক্কেল তো অধিকাংশ বাঙালিই ছিল। তা বাঙালিদের এখন আর কী আছে কলকাতায় দাদা? অবাঙালি ব্যবসাদার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, উকিল, ব্যারিস্টার, সলিসিটর। ব্যারিস্টার এখনও কিছু আছেন, তবে যাঁরা আউটস্ট্যান্ডিং। আমাদের মতো সাধারণ বাঙালিদের আর কোনো পসারই নেই। বাঙালিদের আজ কিছুই নেই।

কেন? পার্টি আছে, সরকার আছে, জাতীয় ভাঁড়, বিদূষক আছে অনেক এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, শূন্যকুম্ভ দম্ভ আছে। কলকাতাতে এখন শতকরা মাত্র বেয়াল্লিশ ভাগ বাঙালি। বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালেরা এখন ছেলে-মেয়েকে কিশোর বয়েসে আমেরিকাতে পড়তে বা চাকরি করতে পাঠিয়ে বাংলা ভাষায় দোকানের নাম লিখুন স্লোগান তুলে পোস্টার সাঁটছে, খবরের কাগজে, টিভিতে নিজেদের দেখানো হবে বলে। বাঙালি গোরু-মোষেরাও এখন রবীন্দ্র সংগীত গাইছে, ক্যাসেট করছে, সি ডি করছে, চাইনিজ রেস্তোরাঁ ওপেন করছে।

প্রথম যৌবনে রবীন্দ্র-রচনাবলিতে লাথি মারছে, বার্ধক্যে এসে কাগজে লিখছে রবীন্দ্র সংগীতের সুর বাজে। কবে যে কলকাতার বার-এ বার-এ মিনি স্কার্ট পরা মেয়েরা রবীন্দ্রনাথের কথাতে নিজেদের সুর বসিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইবে তার অপেক্ষাতে আছি। তারপর সেইসব কদর্য রুচির অশালীন ভীমরতি-জীর্ণ মানুষেরা নিজেরাই রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট ও সি ডি বের করছে। দেখাবার জন্যে যে, গান গাওয়া এমন কঠিন কাজ কি? ও তো বাচ্চোঁকা খেল। ভার্সেটাইল জিনিয়াসে দেশ ভরে গেছে।

ওঁরা কারা দাদা? এই ভার্সেটাইল, জিনিয়াসেরা?  

এঁরা কেউ গ্রেড ডেন, কেউ পিকিনিজ, কেউ বুল ডগ-মালিকের Kennel আলো করে আছেন। মালিকরা যেমন, কর্মচারীরা তেমনই হবেন। এঁরা কেউ সরকারি কর্মচারী, কেউ NGO-র।

তারপর বললেন,–এই NGO শব্দটা বেশ চালু হয়েছে, তাই না?

যাই বলুন আর তাই বলুন, আমাদের সি পি এম আছে, বন্ধ এবং মহামিছিলের কালচার আছে, অজর অমর অক্ষয় পঃ বঃ সরকার আছে, অন্য সরকারেরা আছে, পবিত্র সরকারও আছে। আমাদের সঙ্গে কার তুলনা?  

মণীসদা বললেন, যা বলেছ!

ক্লাবের আবদার কাম্পারি নিয়ে এলে সোডা মিশিয়ে চুমুক দিয়ে মণীসদা বললেন, আমাকেও একজন খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বাঙালি ধরেছিল ওই পোস্টার-সাঁটা বাঙালিদের দলে ভিড়তে–বাঙালির পুনরুজ্জীবন করতে।

তা আপনি যোগ দিলেন না কেন?

আমি তাঁকে হেসে বলেছিলাম,–আপনাদের প্রচেষ্টা ভালো, কিন্তু Its very late in the day! মুমূর্ষ রোগীকে কোরামিন দিয়ে বাঁচানো যায়, কিন্তু যে মরে কবরে চলে গেছে, যার দাফন হয়ে গেছে-তাকে বাঁচাবে কী করে? সবাই তো আর যিশুকেষ্ট নন যে রেজারেক্টেড হবেন!

তাতে তিনি কী বললেন?  

কী আর বলবেন, বেজায় চটে গেলেন। বললেন, আপনি তাহলে এই গণসংগ্রামে সামিল হবেন না? আমি বললাম, ক্ষমা করো ভাই, আমায় খেটে খেতে হয়। আমার দ্বারা এইসব মৎলববাজি হবে না।

তারপর বলেছিলাম, এসবের পেছনে আসল মৎলবটা কী বলো তো ভায়া? প্রতিদিন। পাদপ্রদীপের আলোতে এসে রাজ্যসভার সদস্য হওয়া? বাকি জীবন মহানন্দে পায়ের ওপরে পা তুলে দু-কোটি টাকার থলে নেড়ে সকলকে বশে রাখা? কিন্তু সাধারণ মানুষ, মানে জনগণকে তোমরা যত বোকা ভাব তত বোকা তারা নয়। তাঁরা কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুসছে। যাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলেই নেই তাঁরাই কিন্তু মেজরিটি। তাদের যে অসহ্য হয়েছে তা কি তোমরা বুঝতে পারছনা এখনও?  

কী বললেন তিনি? আগের কথার উত্তরে?

তিনি চুপ করে রইলেন।

তারপর? সুব্রত বলল।

তারপর?–মণীসদা বললেন,–আমি বললাম, এই গণসংগ্রাম নামটা ভালো দিয়েছ তোমরা।

প্রমথ বিশী মশায়ের একটি লেখাতে পড়েছিলাম, কম্যুনিস্টগণ যাহাই করিয়া থাকেন তাহার পূর্বে একটি গণ শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকেন।

চীনারা যখন ভারতে আক্রমণ করল তখন উৎপল দত্ত মশায় একটি লিটল ম্যাগে লিখলেন যে চীনারা খুবই উত্তম কাজ করেছে। তখন কংগ্রেস রাজত্ব, দেশদ্রোহিতার দায়ে উৎপল দত্ত মশায়কে গ্রেপ্তার করা হল। অন্য রাজত্ব হলেও তিনি ওই অপরাধের জন্যে গ্রেপ্তার হতেনই। তারই প্রতিবাদে পাড়ার মোড়ে গণটেবিল পাতিয়া গণগণ সই সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে আরেকজন গণ গণবাঁশ হাতে লইয়া তাহাদের তাড়া করিলেন। তাহা দেখিয়া প্রথমোক্ত গণগণ গণদৌড়ে গণগলি দিয়া গণপলায়ন করিলেন।

সুব্রত হেসে উঠল। মিস্টার নীতিন কালাসকার না বুঝতে পেরেও হেসে উঠলেন। হাসিও কান্নার মতোই ছোঁয়াচে। মণীসদা বললেন-রোজই কাগজে দেখছি, পবিত্র সরকার নাকি ডক্টরেট নন? তাতে আমার কি এল গ্যাল?

না তা নয়, যিনি পাঠ্যক্রম থেকে ইংরেজি তুলে দিলেন, আবার এত বছর পরে ফিরিয়ে আনলেন সেই One Man Commission-এর মানুষের এমন তঞ্চকতা করাটা কি উচিত?

তঞ্চকতা কোথায় করেছেন? তিনি তো ডক্টরেট অবশ্যই, তবে ২০০৪-এর সেপ্টেম্বরে হবার কথা।

ওসব কথা ছাড়ো। ইংরেজি বিতাড়ন করে বাংলার যে রবরবা তিনি করেছেন তার একটু নমুনা শোনো। আমার এক বন্ধুর মেয়ে বাংলার টিচার। তার কাছে শুনলাম, বাংলা পরীক্ষার খাতাতে মেয়েরা কীভাবে উত্তর লিখেছে।

বলুন।–সুব্রত বলল।

প্রশ্ন. নিম্নলিখিত শব্দ ও প্রবাদ দিয়ে একটি করে বাক্য রচনা করো। (১) মৌজা (২) শিরে সংক্রান্তি (৩) ফলাও।

উত্তর লিখল বিভিন্ন ছাত্রীরা . (১) পি থ্রি-র সিল্কের মোজা অনেকদিন ট্যাঁকে। (২) আমার মা শিরে-সংক্রান্তির দিন চার রকম পিঠে তৈরি করেছিলেন। (৩) আমার বাবা আমার জন্মদিনে অনেক রঙিন বেলুন ফলাও করিয়াছিলেন।

সুব্রত হাসতে হাসতে বলল, আপনি বানাচ্ছেন।

বিলিভ মি। একেবারেই বানাচ্ছি না।

সুব্রত বলল, ভাষাবিদই তো শুধু নন তিনি, তিনি গায়ক, তিনি সাহিত্যিক।

ওঁর গান তো তো কখনো শুনিনি!

ক্যাসেট বেরিয়েছে তো, শুনে নিন।

কি গান? ভাওয়াইয়া?

না না, রবীন্দ্র সংগীত।

আর সাহিত্যিক? সাহিত্যিক আবার কবে হলেন? উনিত বৈয়াকরণ। কিছু গা-জোয়ারি ছড়া লিখেছেন দেখেছি।

আপনি কোনো খবরই রাখেন না। গত বছর উনি বাংলা সাহিত্যকর্মের জন্যে বাম সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন। উনি বাংলা আকাদেমিরও একজন হর্তাকর্তা।

বলেন কি? কোন বইয়ের জন্যে রবীন্দ্র পুরস্কার পেলেন?

বইয়ের নাম তো জানাননি পুরস্কার জ্ঞাপকরা।

ছি ছি! এ কী নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করছি আমরা? এই মানুষগুলোর গায়ে কি গণ্ডারের চামড়া? যে দেয়, সে-ই নেয়?

নৈরাজ্য বলবেন না, বলুন রৌরব।

ওসব প্রসঙ্গ থাক। খিদে নষ্ট হয়ে যাবে। আজ তো বুফে লাঞ্চ। খাবেন তো?  

খাব বলেই তো আসা।

আপনি আমার গেস্ট-আপনার গেস্ট সুষ্ঠু।

থ্যাঙ্ক য়্যু। মণীসদা বললেন, সুপ্রিয়দার কী খবর? তাঁকে তো একেবারেই দেখি না কোথায়ও।

উনি প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিয়েছেন।

তাই? সেকি? অমন ভালো উকিল! ইচ্ছে করলেই উনি হয়তো নারি পালকিওয়ালা হতে পারতেন। He had all the elements in him.

সে তো আমরা সকলেই জানি।

কিন্তু ছেড়ে দিলেন কেন?

ছেড়ে দিলেন, কারণ আর সম্মানের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয় বলে। তা ছাড়া ওঁর মুখটাও চিরদিনই খারাপ, মানে অপ্রিয় সত্য কথা বলেন বড়ো।

সে তো চিরদিনই বলতেন।

সেজন্যে কম ভুগতেও হয়নি। তবে গত মাসে মেম্বার গোদা সরকারকে মুখের ওপর বলেছিলেন শেষ কথা।

কী কথা?

বললেন, ট্রাইবুনালের মেম্বারকে মুখের ওপর . উ্য আর নট ফিট টু বি অ্যাড্রেসড অ্যাজ ইয়োর অনার। ঊ্য শুড বি অ্যাসেমড অফ ইওর সেল্ফ। ইউ ডু নট নো অ্যাকাউন্ট্যান্সি অ্যান্ড উ্য ডু নট নোল আইদার। ইওর কোর্ট-ম্যানারস আর ডিটেস্টেবল অ্যাজ ওয়েল। উ্য ক্যান গো টু হেল। বলে, ব্রিফটা সাহেবের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে এলেন। আর যাননি।

বাঘের বাচ্চা!

হ্যাঁ। আমাদের সকলেরই তাই হতে ইচ্ছে করে মনে মনে, কিন্তু আমরা পারলাম কই হতে?

তারপর?

তারপর কী? বিয়ে তো করেননি। কোনো পিছুটান নেই। এখন একটা ওল্ডএজ হোমে থাকেন। শুধু কোর্ট-কাছারি নয়, পুরো সমাজকেই ত্যাগ করেছেন।

বেশ করেছেন। এই দু-নম্বরি ফোরটোয়েন্টি লজ্জাহীনদের সমাজে কারও বাঁচতে ইচ্ছে করে? বিয়ে করা না-করার ওপর কিছুই নির্ভর করে না। উনি পেরেছেন, আমরা পারিনি, পারি না, লেটস অ্যাকসেপ্ট ইট অ্যাজ আ ফ্যাক্ট।

ইচ্ছে না করলেও আমাদের বাঁচতে হয়। বড়ো গ্লানির বাঁচা।

মণীসদা বললেন,-আমরা সবাই কুকুর-বেড়ালের মতো। চারদিকের সব অন্যায় মেনে নিই বলেই তো ওদের এত রবরবা। আমরা সবাই যদি সুপ্রিয়দার মতো Spade-কে spade বলতে পারতাম তবে কি জীবনের সব ক্ষেত্রেই কতগুলো খল, ভণ্ড, মিথ্যেচারী লজ্জাহীন মানুষ রাজত্ব করতে পারত? আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে কী রেখে যাচ্ছি বল তো? কোন আদর্শ?

সুব্রত অনেকক্ষণ মুখ নীচু করে রইল। তারপর প্রতিবাদ হিসেবে এক গালে কাম্পারিটা শেষ করে টাক করে কাচের গোল টেবিলের ওপরে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল। রেখে, ডাকল,–আবদার! ঔর এক রাউন্ড।

সুব্রত মুখ নীচু করেই রইল। ভাবছিল, ও নিজেও একটা গণ্ডার। ও যাদের চেনে-জানে তারাও অধিকাংশই গণ্ডার। গণ্ডারের দেশেই ওর বাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *