কাজারি অ্যান্ড ইয়োকো

কাজারি অ্যান্ড ইয়োকো

মা যদি আমাকে কখনো খুন করতে চায়, তাহলে সেটা কিভাবে করবেন? হয়তো কিছু একটা দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করে, যেমনটা তিনি সবসময়ই করেন। কিংবা গলা চিপে ধরে যেটা তিনি মাঝে মাঝেই করেন। কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারেন, আত্মহত্যা হিসেবে দেখানোর জন্য।

শেষেরটাই ভাল হবে। তার জন্য সবচেয়ে ভাল হয় যদি আমি আত্মহত্যা করেছি এরকম কিছু দেখানো যায়। কেউ যখন আমার ক্লাসমেট কিংবা টিচারদের কাছে আমার ব্যাপারে জানতে চাইবে, তারা তখন বলবে :

“ইয়োকো এনদো কোন একটা সমস্যা নিয়ে সবসময় অন্যমনস্ক থাকত। ওর সমস্যা নিশ্চয়ই ওর মাথায় চড়ে বসেছিল। যে কারনে ও নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।”

কেউ সন্দেহ করবে না আমার আত্মহত্যা করা নিয়ে।

ইদানিং মা আমার উপর প্রত্যক্ষ নির্যাতন করা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর অনেক সময়ই শারীরিকভাবে আঘাত করেন। যখন ছোট ছিলাম তখন ব্যাপারটা ছিল পরোক্ষ ধরণের। আমার বোনের জন্য কেক রাখা হত, আমার জন্য রাখা হত না। আমার বোনের জন্য কাপড় কেনা হত, আমার জন্য কেনা হত না। মা যতভাবে সম্ভব আমার উপর মানসিক অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছেন।

“ইয়োকো তুমি তো বড়, তাই না? মানিয়ে চলতে শিখো,” তার কথা ছিল এরকম।

কাজারি আর আমি জমজ। কাজারি দেখতে সুন্দর আর হাসিখুশি। ও হাসলে মনে হত ফুল ফুটলো। স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা, সব টিচাররা ওকে পছন্দ করত। আমিও ওকে পছন্দ করতাম কারন মাঝে মাঝে ও ওর রাতের খাবার থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার আমাকে দিত।

মা কখনো আমার জন্য রাতের খাবার বানাতেন না, তাই আমি সবসময় ক্ষুধার্ত থাকতাম। আমি যদি কখনো ভুলেও রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলতাম তাহলে মা একটা অ্যাস্ট্রে হাতে ছুটে আসতেন। আমি তাকে এতটাই ভয় পেতাম যে এমনকি স্ন্যাক্সও খেতে পারতাম না। মাঝে মাঝে এত ক্ষুধার্ত লাগত যে মনে হত মরে যাব। আমি খাবি খেতে শুরু করতাম, কাজারি একটা প্লেটে করে ওর বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে আসত তখন। সত্যি বলতে কি, আমার কাছে ওকে তখন স্বর্গদূত মনে হত। এক প্লেট আধ খাওয়া ম্যাকারনি আর চিজ কিংবা কয়েক টুকরা গাজর হাতে ওকে মনে হত সাদা ডানা ওয়ালা স্বর্গদূত।

মা যদি দেখতেন কাজারি আমাকে খাবার দিচ্ছে তাহলে কিছু বলতেন, রাগতেনও না। তিনি কখনো কাজারিকে বকতেন না। সবসময় কাজারির যত্ন নিতেন।

কাজারির ঝুটো খেয়ে আমি ওকে ধন্যবাদ দিতাম আর ভাবতাম আমার বোন আমার কাছে কতটা মূল্যবান ছিল। ওকে রক্ষা করার জন্য কাউকে খুন করতে হলে আমি সেটাও করতে এক পায়ে খাড়া ছিলাম।

***

আমাদের পরিবারে কোন বাবা ছিল না। যতদিনে আমি এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছি ততদিনে শুধু আমরা তিনজন ছিলাম-মা, কাজারি আর আমি। এভাবেই আমরা চলেছি, আমি জুনিয়র হাইয়ের দ্বিতীয় বর্ষে উঠা পর্যন্ত।

বাবা না থাকার কারনে আমার জীবনে কি কি প্রভাব পড়েছে তা আমার জানা ছিল না। যদি বাবা থাকতেন তাহলে মা হয়ত আমার দাঁত ভাংতেন না কিংবা সিগারেট দিয়ে ছ্যাকা দিতে না। কিংবা হয়ত তখনো করতেন। কে জানে। হয়তো আমিও কাজারির মত হাসিখুশি কেউ হতাম। সকাল বেলা মাকে যখন এক প্লেট টোস্ট আর ডিম ভাজা হাতে নিয়ে হাসতে দেখতাম, তখন এসব চিন্তা আমার মাথায় আসত। তিনি প্লেটটা অবশ্যই কাজারির সামনে নিয়ে রাখতেন। আমার জন্য কিছু থাকত না। আমি জানতাম যে আমার তাকানো ঠিক নয়। কিন্তু আমি জেগে আছি, কিচেনে দাঁড়িয়ে আছি, কিভাবে না তাকিয়ে থাকা যায়?

মা আর কাজারির আলাদা আলাদা রুম ছিল। আমার ছিল না। আমার জিনিসপত্রগুলো ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আর অনেক হাবিজাবি জিনিসপত্রের সাথে একই সাথে ক্লজিটে রাখা হত। কপাল ভাল যে আমার এমনিতেও বলার মত কিছু ছিল না। থাকার জন্য আমার খুব বেশি জায়গার প্রয়োজনও ছিল না। স্কুলের বই আর স্কুল ড্রেস ছাড়া কিছু ছিলই না বলা যায়। আমার অন্য কাপড়গুলো ছিল কাজারির দেয়া পুরোনো কাপড়। কখনো যদি আমি পড়ার জন্য কোন বই বা ম্যাগাজিন হাতে নিতাম তাহলে মা এসে ছোঁ মেরে কেড়ে নিতেন। নিজের বলতে একমাত্র যা ছিল সেটা হল একটা যাবতোন বালিশ (চেয়ারে রাখার বালিশ)। কিচেনের ময়লার ঝুড়ির পাশে বালিশটা বিছিয়ে তার উপর বসে আমি পড়াশুনা করতাম, কিংবা চিন্তা করতাম, অথবা গুনগুন করে কোন গান গাইতাম। মা কিংবা কাজারির দিকে যেন চোখ না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার চেষ্টা করতাম। মায়ের সাথে চোখাচোখি হলে তিনি হয়ত আমার দিকে ছুরি ছুঁড়ে মারতে পারেন। আমার যাবুতোনটা আমার ফুটোন (জাপানি বিছানা) হিসেবেও কাজ করত। আমি বিড়ালের মত গুটিসুটি মেরে ওটার উপর ঘুমাতাম আর সব কষ্ট ভুলে যেতাম।

প্রতিদিন সকালে নাশতা না করে বের হতাম। বাসা থেকে কখনোই দ্রুত না বের হয়ে পারতাম না কারন আমাকে দেখলেই মা চোখ গরম করে বলতেন, “এই মেয়ে এখনো কি করছে এখানে?” দরজা দিয়ে বের হতে কয়েক সেকেন্ড এদিক ওদিক হলেই শরীরে নতুন একটা কালশিটে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। আমি কিছু না করলেও মা কোন একটা ছুতো বের করে আমাকে পেটাতে যেতেন।

হেঁটে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে কাজারি আমার পাশ কাটিয়ে যেত আর আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও যখন হাঁটত ওর চুল সামনে পেছনে দুলত। আমি, মা, কাজারি যখন একসাথে থাকতাম তখন আমাদের মধ্যে প্রায় কোন কথাই হত না। এমনকি মা আমাদের সাথে না থাকলেও দুই বোনের মধ্যে যেরকম কথা হওয়ার কথা তাও হত না।

স্কুলে কাজারি খুব জনপ্রিয় ছিল। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। তারা একত্রে অনেক ভাল সময় কাটাত। আমার হিংসা হত, কিন্তু কখনো ঐ সার্কেলে ঢোকার মত সাহস আমার হয়নি।

কোন টিভি প্রোগ্রাম বা কোন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সম্পর্কে আমার কিছু জানা ছিল না। টিভি দেখতে গেলে মা আমার উপর ক্ষেপে যেত, যে কারনে টিভির জীবন সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আর তাই সবাই যে বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে কথা বলত, সে সম্পর্কে আলাপ করার মত কোন প্রত্যয় আমার মধ্যে ছিল না। আমার কোন বন্ধু ছিল না। বিরতির সময় আমি ডেস্কের উপর মাথা নামিয়ে ঘুমানোর ভান করতাম।

কাজারির উপস্থিতি আমার কাছে বিশাল স্বস্তির বিষয় ছিল। সবাই কাজারিকে ভালবাসত, ওর বোন হতে পেরে, একই রক্ত বহন করতে পেরে আমার গর্ববোধ হত।

আমার সাথে কাজারির চেহারার অনেকটাই মিল ছিল। কেউ হয়ত শুনলে বলবে যে তোমরা তো জমজ, মিল তো থাকবেই। কিন্তু কেউ আমাদেরকে চিনতে ভুল করত না। কাজারি ছিল প্রাণখোলা, হাসিখুশি। আমি গোমড়ামুখি, চুপচাপ। এমনকি আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম এক হলেও আমারটা ছিল নোংরা আর দুর্গন্ধযুক্ত।

একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে টেলিফোনের খাম্বায় একটা হারানো কুকুরের বিজ্ঞাপন দেখলাম। একটা মেয়ে টেরিয়ার, নাম আসো। সাধারণ একটা হাতে আঁকা ছবি, সাথে সুন্দর হাতের লেখায় লেখা ছিল, “কুকুরটা পেয়ে থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করুন, সুজুকি।”

আমি পোস্টারটা পড়লেও সেটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালাম না। সত্যি কথা হল আমার হাত আগেরদিনের মারের কারনে ভয়াবহ রকমের ব্যথা করছিল। ঐদিন ক্লাসে এতটা ব্যথা করছিল যে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে স্কুল নার্সের সাথে দেখা করতে গেলাম। সে আমার হাতের কালশিটে দেখে চমকে গেল।

“কিভাবে হল এসব?” সে জানতে চাইল।

“সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।”

ডাহা মিথ্যা কথা যদিও। সত্যি হল, মা দেরি করে বাসায় ফিরেছিলেন। গোসল করতে গিয়ে টাবে একটা বড় চুল পান আর ক্ষেপে গিয়ে আমাকে মারেন। সেভাবে হাতে দাগটা পড়েছিল। আমি ছিটকে পড়ে টেবিলের এক কোণায় গুঁতো খাই। মনে মনে নিজেকে লাথি মারছিলাম এরকম কপালের জন্য।

“টাবের মধ্যে ওটা তোর চুল ছিল। আমার শরীরে এসে লাগল, কি ঘেন্নার বিষয়! ছিঃ! তুই কেন তোর মাকে এত ঘৃণা করিস? কাজ করে বাসায় ফিরেছি, আমি একদমই ক্লান্ত। কেন আমার সাথে এমন করিস?”

আগেও এমন ঘটেছে। সমস্যার সমাধানের জন্য আমি মা গোসল করার আগে কখনো গোসল করি না। তাই আমি জানতাম মা যেই চুল নিয়ে অভিযোগ করছিল সেটা আমার না কাজারির ছিল। কিন্তু আমার আর কাজারির চুল একই সমান, আর আমি সেটা বোঝাতে গেলে মা আরো রেগে যাবে। তাই কিছুই বললাম না চুপ করে থাকলাম।

“দেখে মনে হচ্ছে না কোন হাড় ভেঙেছে, কিন্তু তোমার যদি এখনো ব্যথা থাকে তাহলে হাসপাতালে যাওয়া উচিত, নার্স বলল। “মিস এনদো, তুমি কি নিশ্চিত যে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলে? তুমি আগেও এসে বলেছ সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছ, বলনি?”

হাতের ক্ষতে ব্যান্ডেজ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে নার্স আমাকে এই প্রশ্নগুলো করল। আমি কিছুই বললাম না। মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম। পরেরবার আসলে আমাকে অন্য কোন অজুহাত বানিয়ে তারপর আসতে হবে।

মায়ের নির্যাতনের কথা লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে আমি খুবই সিরিয়াস ছিলাম। মা আমাকে বলেছেন কেউ যেন এসব কথা না জানে। আমি যদি কাউকে কখনো বলি তাহলে মা আমাকে খুন করবেন।

“তুই কি বুঝতে পারছিস না? আমি তোকে মারি কারন তুই খারাপ। এখানে আমার কিছুই করার নেই। কিন্তু তুই কিন্তু কাউকে বলবি না। বুঝেছিস? কথাটা শুনলে আমি তোর একটা উপকার করব, আর সেটা হল এই ব্লেন্ডারের সুইচ অন করব না।”

আমি সে সময় ইলিমেন্টারি স্কুলে পড়তাম। চোখে পানি নিয়ে কোনরকমে শুধু মাথা ঝাঁকালাম। মা সুইচ থেকে আঙুল সরিয়ে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি তাড়াতাড়ি ব্লেন্ডারের ভেতর থেকে হাত বের করে নিলাম।

“ছোট্ট একটা চাপ দিলে আর তোর হাতটা জুস হয়ে যেত।”

মা হাসলেন, তার মুখ থেকে চকলেট আইসক্রিমের গন্ধ আসছিল। এত মিষ্টি গন্ধ যে আমার বমি পাচ্ছিল।

মা নিজে লোকজনের সাথে ভালভাবে মিশতে পারতেন না। কিন্তু আমার সামনে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ শয়তান। বাড়ির বাইরে বলার মত তার কিছু ছিল না। দুই সন্তানকে পালার জন্য তাকে কাজ করতে হত কিন্তু অন্য লোকজনের সামনে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারতেন না। ভেতরে ভেতরে আমি আর মা একই রকম ছিলাম। একটা ব্যাপারে আমাদের মধ্যে মিল ছিল, সেটা হল আমরা দুজনই সদা হাসিখুশি কাজারিকে ভালবাসতাম। কাজে যখন কোন কিছু ঠিকমত হত না তখন মা ভয়াবহ খারাপ মেজাজ নিয়ে বাসায় ফিরতেন। বাসায় ফিরে আমাকে খুঁজে বের করে লাখি ঘুষি মারতেন।

“আমি তোর জন্ম দিয়েছি। তোর জীবন, তোর মৃত্যু আমার হাতে। কেউ এর কিছুই বদলাতে পারবে না!”

অন্তত আমি তার সন্তান না বলার চেয়ে ভাল। মা যখন আমার চুল মুঠি করে ধরতেন তখন আমি এরকমটাই ভাবতাম।

ক্লাস রুম পরিস্কার করার সময় একজন ক্লাসমেট আমার সাথে কথা বলল। গত তিন দিন ছয় ঘন্টার মধ্যে এই প্রথম কোন ক্লাসমেট আমার সাথে কথা বলল। আসল কথা হল, তিন দিন আগের কথাবার্তা যেটা হয়েছিল সেটা ছিল এরকম: “অ্যাই এনদো, তোমার ইরেজারটা একটু ধার দাও,” “দুঃখিত, আমার কোন ইরেজার নেই।” “ধ্যাত।” ব্যাস ওইটুকুই। আজকের কথাবার্তা খানিকটা লম্বা ছিল।

“ইয়োকো এনদো, তুমি কি জানো তুমি ক্লাস ১ এর কাজারি এনদোর হুবহু কপি? তাই না? কিন্তু কোন কারনে তোমাদের দুজনকে দেখে দুই বোন মনে হয় না।”

ঝাড়ু হাতে আমার ক্লাসমেটটা বলল। আশেপাশের অন্য মেয়েরা হেসে উঠল। ওর কথাগুলো আমার কাছে নতুন কিছু না, তাই আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কিন্তু অন্য মেয়েদের হাসির ব্যাপারটায় আমার অদ্ভুত লাগছিল।

“এরকম কোরনা, তুমি ওর মনে আঘাত দেবে।”

“আমি দুঃখিত। আমি নিষ্ঠুর হতে চাইনি।”

“ঠিক আছে।”

অন্তত আমি এরকম বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনেকদিন কোন কথা না বলায় আমার গলা কাজ করছিল না। আমি ঝাড়ু দিতে থাকলাম, আশা করছিলাম তারা চলে যাবে। ক্লাসরুম পরিস্কার করার কাজ সবার কিন্তু সত্যিকার অর্থে শুধু আমি একাই ফ্লোর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম।

“আচ্ছা এনদো, তুমি তো আজকে নার্সের অফিসে গিয়েছিলে তাই না? আরেকটা কালশিটে পড়েছে নাকি? তোমার পুরো শরীরটাই কি একটা বড় কালশিটে না এখন? হু আমি সব জানি। জিমে, সাঁতার ক্লাসে তোমাকে বেদিং স্যট পরার সময় আমি সব দেখেছি। কিন্তু ওরা কেউ আমাকে বিশ্বাস করছে না। তোমার পোশাক খুলে ওদেরকে দেখাও তো।”

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। এমন সময় দরজা খুলে টিচার ভেতর ঢুকলেন। যে মেয়েগুলো আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, সরে গিয়ে ঝাড়ু দেয়ার ভান করতে লাগল। বাঁচা গেল, আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলাম।

স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময় পার্কের একটা বেঞ্চে বসে ঐ মেয়েদের হাসাহাসি করার ব্যাপারটা চিন্তা করছিলাম। লোকজনের এমন কিছু বলা উচিত না যাতে করে অন্য কেউ কষ্ট পায়। চিন্তা করতে গিয়ে আমার বমি বমি লাগছিল। ওদের ব্যাপারটা আজব লাগছিল। সবাই কাজারির সাথে যেমন ব্যবহার করে, তেমন ব্যবহার আমার সাথে করানোর জন্য আমাকে কি করতে হবে? আমি অন্য সবার মত হতে চাই। আমি চাই পরিস্কারের কাজে ফাঁকি দিতে, কিছু কাগজ একসাথে দলামচা করে বল বানিয়ে ঝাড়ু দিয়ে হকি খেলতে।

যখন মুখ তুললাম দেখি একটা কুকুর আমার পাশে বসে আছে। গলায় একটা কলার ছিল। তাই প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এর মালিক হয়ত আশেপাশেই কোথাও আছে, কুকুরটাকে খুঁজছে।

পাঁচ মিনিটের মত পার হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম কাহিনী ভিন্ন। কুকুরটা আমার জুতো কছিল। আর আমি সাবধানে ওটার পিঠ চুলকে দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কুকুরটা আঁতকে উঠেনি, তার মানে বোঝা যাচ্ছিল লোকজনের সাথে থেকে অভ্যস্ত। তারপর আমি খেয়াল করলাম যে কুকুরটা একটা মেয়ে টেরিয়ার। আমার মনে হল এটাই হয়ত আসো, যেই কুকুরটার পোস্টার সকালে দেখেছিলাম।

আমি কুকুরটা নিয়ে পোস্টারে লেখা সুজুকির ঠিকানায় গেলাম। ছোট একটা বাড়ি। সূর্যাস্তের আলোয় আকাশ তখন লালচে হয়ে ছিল। আমি বেল চাপলাম, আর সাদা চুলের একজন ছোটখাট বুড়ি দরজা খুললেন।

“ওহ আসো! আমার আসো! এটা তো দেখি আসলেই আমার আসো!”

তিনি কুকুরটাকে জাপটে ধরলেন। আনন্দে বুড়ির চোখগুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছিল। আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে ইনিই সেই সুজুকি যিনি পোস্টারটা লিখেছেন।

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি কুকুরটার জন্য অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। কিছুক্ষণের জন্য ভেতরে আসবে?”

আমি সায় জানিয়ে ভেতরে গেলাম। স্বীকার করতে লজ্জা লাগছে কিন্তু আমি আশা করছিলাম কোন ধরনের পুরষ্কার হয়ত পাব। হয়ত খানিকটা মিষ্টি, অল্প কিছু টাকা, যে কোন কিছুতেই আমি খুশি। আমি সবসময়ই ক্ষুধার্ত, তাই কোন কিছুতেই সমস্যা নেই। কিছু একটা হলেই আমি খুশি।

আমরা দুজন লিভিং রুমে গিয়ে দুটো যাবুতোনে বসলাম।

“তো তোমার নাম ইয়োকো। আমি মিসেস সুজুকি। আমি মাত্র কালকেই পোস্টারগুলো লাগিয়েছি আর এখনই আসোকে ফেরত পেয়ে গেলাম। একদম বিশ্বাস হচ্ছে না।”

মিসেস সুজুকি আসোর গালের সাথে নিজের গাল ঘষলেন, তারপর উঠে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেখে মনে হচ্ছিল এই বাড়িতে তিনি একাই থাকেন।

ট্রেতে কিছু কুকিজ আর কফি নিয়ে ফিরে এলেন। আসো তার পায়ের সাথে লেগে ছিল। ট্রেটা নিচু টেবিলটায় রেখে আবার আমার পাশে এসে বসলেন। তিনি জানতে চাইছিলেন কুকুরটাকে ঠিক কোথায় পেয়েছি। বলার মত নাটকীয় কোন কাহিনী তো ছিল না, কিন্তু আমি যখন বলছিলাম তখন তিনি হাসি মুখে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন।

আমি কয়েকটা চিনির ছোট প্যাকেট আর দুধের কন্টেইনার খলে সব কফিতে ঢেলে ঢকঢক করে গিলে ফেললাম। দুই কামড়ে সব কুকিজ উধাও। কফি আর কুকিজ দুটোই খুব মজার ছিল। আমার খাবারের মধ্যে সাধারণত মিষ্টি কিছু পড়ে না, যদিনা স্কুলের লাঞ্চে মাঝেমধ্যে কোন ডেজার্ট দেয়। বাসায় আমি খুবই কম খাওয়ার মত কিছু পাই, যদি কাজারি না খায় শুধু তখনই। আমাকে যদি এমন কোন হাই স্কুলে যেতে হয় যেখানে কোন লাঞ্চ দেয় না, তাহলে জানি না কিভাবে বাঁচব। হ্যাঁ, আমার এখনই সেটা নিয়ে। দুশ্চিন্তা হয়।

মুখে দয়ালু একটা অভিব্যক্তি নিয়ে মিসেস সুজুকি আমাকে আরেক কাপ কফি ঢেলে দিলেন। এবার আমি কফি গেলার সময় একটু সময় নিলাম। “আমি খুশি হব যদি তুমি ডিনার পর্যন্ত থাক,” তিনি বললেন।

এক সেকেন্ড চিন্তা করে আমি রাজি হলাম। কিন্তু মনের ভেতর কোথাও ছোট একটা কণ্ঠ গজগজ করে আমাকে বলল, এর আগে কখনো এই মহিলার সাথে আমার দেখা হয়নি, একে আমার এত চাপ দেয়া ঠিক হচ্ছে না।

“সত্যি বলতে কি ডিনার বানানোর জন্য আমি কিছুই এখনো করিনি। আসোকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম।”

তিনি কুকুরটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। কুকুরটার সুখে আমার রীতিমত হিংসা হচ্ছিল।

“ওহ, আমার তোমাকে পুরষ্কার ধরণের কিছু একটা দেয়া উচিত। কি দেয়া যেতে পারে। দাঁড়াও আমি একটু দেখে আসি। একটু অপেক্ষা কর।”

মিসেস সুজুকি কুকুরটাকে রেখে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার জন্য কি নিয়ে আসতে পারেন ভেবে আমার উত্তেজনা হচ্ছিল যার সাথে আমি অভ্যস্ত নই। আমি অনেক সময় ছটফট করি কিন্তু উত্তেজনা হয় না। আমার মনে হল আমাকে হয়ত আরো কয়েকটা কুকিজ দেয়া হবে যেগুলো চাবাতে চাবাতে আমি বাড়ি যেতে পারব। বাড়িতে নিয়ে গেলে ওগুলো আমার থেকে কেড়ে নেয়া হতে পারে।

আসো আমাকে শুকছিল। আমার মনে পড়ল আগের রাতে গোসল করা হয়নি, বাজি ধরে বলতে পারি আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছিল। রুমের মধ্যে চোখ বোলালাম। একটা টিভি আছে, কিন্তু কোন ভিসিআর ছিল না। মিসেস সুজুকির মত একজন বয়স্ক মহিলা সম্ভবত জানেনও না ভিসিআর কি করে ব্যবহার করতে হয়। আমি শুনেছি ভিসিআর চালানো নাকি বেশ কঠিন। আমি নিজে কখনো কোন টিভি কিংবা ভিসিআর ছুঁয়ে দেখিনি।

লিভিং রুমে একটা পুরো দেয়াল জুড়ে বিশাল একটা বুক কেস ছিল। আমি বইগুলোর নাম দেখছিলাম এমন সময় সমস্যাগ্রস্থ চেহারা নিয়ে মিসেস সুজুকি ফিরে এলেন।

“আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় রেখেছি ভুলে গিয়েছি। খুঁজতে হবে। তুমি কালকে আবার আসতে পারবে না? আমি তোমার জন্য ডিনার তৈরি করে রাখব।”

আসব কথা দিয়ে আমি বাসায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে গিয়েছে। মিসেস সুজুকি আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আমার মাথায় নতুন একটা চিন্তা এল: আহ এটাকেই কি তাহলে ‘সি অফ’ করা বলে? আগে কখনো আমার জীবনে কেউ কখনও আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়নি।

***

পরদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আবার মিসেস সুজুকির বাড়িতে গেলাম। বেল চাপার আগেই বাসার ভেতর থেকে খাবারের সুগন্ধ ভেসে এসে আমার নাকে লাগছিল। আমাকে দেখে মিসেস সুজুকি খুশি হলেন। আমিও যেতে পেরে খুশি ছিলাম। আগের দিনের মতই তিনি আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন আর আমি যাবতনের উপর বসলাম। আসো আমাকে চিনতে পারল। সবকিছু আগের দিনের মতই লাগছিল।

“ইয়োকো, আমি দুঃখিত। যে মূল্যবান জিনিসটা আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম তা এখনো খুঁজে পাইনি। সব জায়গায় খুঁজলাম, বুঝতে পারছি না কোথায় গেল। আশা করছি তুমি রাগ করবে না যদি এখনো একসাথে ডিনার করি? তুমি কি হ্যামবার্গার পছন্দ কর?”

উনি কি আমার সাথে মজা করছেন? আমি হ্যামবার্গারের জন্য পাগল ছিলাম। অন্য কিছু চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই। হ্যামবার্গারের জন্য আমি আমার একটা কিডনি বেচতেও রাজি। আমি তাকে বললাম যে হ্যামবার্গার অনেক পছন্দ করি। তিনি এত জোরে হাসলেন যে তার ভাঁজ পড়া মুখটায় দয়াল অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ল।

খাওয়ার সময় আমি চিন্তা করছিলাম হ্যামবার্গার কেন? মিসেস সুজুকি কি হ্যামবার্গার অনেক পছন্দ করেন? আমার মনে হল না। হয়ত তিনি ধরে নিয়েছেন আমি পছন্দ করি। একটা বাচ্চাকে খুশি দেখার জন্য হ্যামবার্গার বানানোটা মানা যায়।

“তো ইয়োকো, তোমার সম্পর্কে কিছু বল,” আমরা খেতে খেতে তিনি বললেন।

উমম কি বলব উনাকে?

“তোমার পরিবার সম্পর্কে বল।”

“আমার পরিবারে মা আর একটা জমজ ছোট বোন আছে।”

“সত্যি? জমজ?”

তার চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি কাজারি সম্পর্কে আরো প্রশ্ন করতে চাইছিলেন কিন্তু সত্য এতটা নিষ্ঠুর আর অন্ধকারচ্ছন্ন যে আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না, এবং মিথ্যা বললাম।

আমি তাকে বললাম যে আমার বাবা না থাকলেও আমরা তিনজন সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। আমি বললাম আমার মা খুবই চমৎকার একজন মহিলা। প্রতি বছর আমাদের জন্মদিনে তিনি আমার আর আমার বোনের জন্য নতুন কাপড় চোপড় কিনে আনেন। সবসময় একই রঙ। কটকটে রঙ না, সুন্দর হালকা রঙ, বড়রা যেরকম পড়ে। ছুটির দিনে আমরা তিনজন একসাথে চিড়িয়াখানায় যাই কাছ থেকে পেঙ্গুইন দেখার জন্য। আমি তাকে বললাম, আমি আর আমার বোন একই রুম শেয়ার করে থাকি, কিন্তু এখন আমি নিজের একটা রুম চাচ্ছি। আমি বললাম আমি আর কাজারি যখন ছোট ছিলাম তখন টিভিতে একটা ভয়ের শো দেখে রাতে ঘুমাতে পারিনি, মা আমাদের হাত ধরে ছিলেন। আমি নিজেকে থামাতে পারছিলাম না। তাকে অনেক কিছু বললাম যা কখনো হয়নি, হওয়া সম্ভব নয়।

“শুনে মনে হচ্ছে তোমার মা খুবই চমৎকার একজন মানুষ,” তিনি বললেন।

মিসেস সুজুকি খানিকটা বিড়বিড় করলেন, মনে হচ্ছে হচ্ছে, মুগ্ধ হয়েছেন। আমি উনার কথা শুনলাম আর ভাবলাম আমার সব মিথ্যাগুলো যদি সত্যি হত।

তিনি আমার স্কুল সম্পর্কে জানতে চাইলে, সুতরাং আমি আরো কিছু মিথ্যা কথা বললাম। তাকে বললাম যে আমার স্কুলের কিছু বন্ধুদের নিয়ে সাগর তীরে গিয়েছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে তার হাসি দেখে আমি নিজেকে মনে মনে বললাম উনি যেন কখনো সত্যিটা জানতে না পারেন। কিন্তু আমার ব্রেন এত সব মিথ্যা তৈরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, আমার কণ্ঠ মাঝে মাঝে একটু চড়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম টপিকটা বদলানো দরকার।

“আহ, আপনার তো দেখি প্রচুর বই!”

হ্যামবার্গারের যে টুকরাটা মুখের ভেতর চাবাচ্ছিলাম সেটা গিলে ফেলে দেয়ালের সাথে রাখা বুক কেসের দিকে তাকালাম। মিসেস সুজুকিকে খুব আনন্দিত দেখাল।

“আমি আসলেই বই অনেক পছন্দ করি। আমার সংগ্রহের অল্প কিছু এখানে। অন্য রুমগুলোতে আরো অনেক বই আছে। আমরা কমিকস পড়তেও ভাল লাগে। ইয়োকো, তুমি কি ধরনের মাঙ্গা (জাপানি কমি) পছন্দ কর?”

“আসলে, বলতে কি…আমি…আমি জানি না, আসলে…”

“ওহ?”

মিসেস সুজুকি দুঃখি চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, তাই আমার কিছু করা উচিত। জানি না কেন, কিন্তু এই বয়স্ক মহিলা আমাকে অপছন্দ করুক তা আমি চাইছিলাম না।

“আচ্ছা, আপনার কাছে যদি কোন ইন্টারেস্টিং বই থাকে, তাহলে সেটা সম্পর্কে আমাকে বলবেন?”

“নিশ্চয়ই, তোমার যা খুশি। তোমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বই ধার দিতেও আমার ভাল লাগবে। সেটাই করা যাক। তুমি যখন আবার আসবে তখন ফেরত দিও।”

মিসেস সুজুকি আমার সামনে বসে ইন্টারেস্টিং দেখতে নভেল আর মাঙ্গার একটা স্তূপ বানালেন। আমি একটা কমিক বুক নিয়ে বেরিয়ে এলাম। একটা নিয়েছি যাতে আমি তাড়াতাড়ি সেটা শেষ করে কালকে আবার আসতে পারি। আমি যদি সেটা করি, তাহলে একজন লোভী রাজকন্যার মত হিসাব করলাম, যে তিনি হয়ত আমাকে আবারও মজার কিছু খেতে দিতে পারেন। আর আমিও মিসেস সুজুকি আর আসোকে আবার দেখতে পাব। অনেক কিছু আছে যা নিয়ে আমি তার সাথে আলাপ করতে চাই। কল্পনায় দেখতে পেলাম আমি আসো আর মিসেস সুজুকির সাথে এত বেশি সময় কাটাচ্ছি যে আমার পিঠ মেঝের যাবুতোনের সাথে পাকাপাকিভাবে জোড়া লেগে গিয়েছে।

***

এভাবে আমি বারবার মিসেস সুজুকির বাসায় যেতে থাকলাম, যদিও এর মধ্যে যন্ত্রণাদায়ক অনেক কিছু ঘটেছিল। প্রতিবার, চলে আসার সময় আমি একটা বই ধার নিতাম, যাতে করে ফেরত দেয়ার অজুহাতে আবার ফিরে আসতে পারি। আর যতই খোঁজাখুঁজি চলুক না কেন, মিসেস সুজুকি মনে হচ্ছিল না তার সেই মূল্যবান সম্পদটা আমাকে দেয়ার জন্য আর খুঁজে পাবেন।

যদিও বই ফেরত দেয়ার বিষয়টা তার সাথে আবার দেখা করার জন্য একটা অজুহাত ছিল কিন্তু অজুহাতটা না থাকলে নিজেকে আমার স্রেফ একজন আগন্তুক মনে হত, যার দেখা করতে যাওয়ার সত্যিকারের কোন কারন ছিল না। আমার জীবনে মিসেস সুজুকিই প্রথম মানুষ যার পাশে আমি নিজের মত থাকতে পারি। আমি চাইনি কোন কারন ছাড়া বার বার আসার কারনে তিনি আমাকে অপছন্দ করুন।

যতবারই আমি গিয়েছি, মিসেস সুজুকি প্রতিবারই আমার জন্য ডিনার বানিয়ে রেখে অপেক্ষা করতেন। প্রতিদিন আমি ধার নেয়া বই কিংবা মাঙ্গাটা পড়ে আমার মতামত তাকে শুনাতাম। তিনি, আসো আর আমি অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। যেদিন স্কুল তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত সেদিন আমি আসোকে নিয়ে হাঁটতে বের হতাম। আলু ছিলতে কিংবা পুড়ে যাওয়া বা বদলানোর মত টুকটাক কাজে আমি মিসেস সুজুকিকে সাহায্য করতাম।

“এরপর যেদিন তোমার স্কুল ছুটি থাকবে, সেদিন কি আমরা একটা মুভি দেখতে যেতে পারি?”

কথাটা শুনে আমি আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলাম।

“কিন্তু আমি ভাবছিলাম তোমার মা আবার এতে কিছু মনে করবেন না তো? ইদানিং মনে হচ্ছে আমি তোমাকে আমার কাছে অনেক বেশি সময় আটকে রাখছি। পরেরবার, তোমার সাথে কাজারিকেও নিয়ে এসো কেমন?”

হুমম। আমি মাথা ঝাঁকালাম, কিন্তু মনে মনে বুঝতে পারছিলাম না কি করব। মিসেস সুজুকি আমার সমস্ত মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে বসে আছেন।

মুভির পর মিসেস সুজুকি আর আমি ঐ কনভেয়ার বেল্ট সুশি রেস্টুরেন্টগুলোর একটায় গেলাম। আমি না যাওয়ার জন্য কিছু অজুহাত দাঁড় করাতে চাইছিলাম, কিন্তু উনি জোর করলেন। আমি আমার জীবনে সুশি খেয়েছি না খাওয়ার মতই। আমি এমনকি ঐ বিভিন্ন ধরনের মাছগুলোর নামটা পর্যন্ত জানতাম না। কনভেয়ার বেল্ট সুশি রেস্টুরেন্টগুলো কিভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে কিছুটা ধারণা আমার ছিল, আর আমি বেছে বেছে কম দামি খাবারগুলো তুলে নিতে চাইছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা হল আমি আসলে জানতাম না কোনটা দামী আর কোনটা কম দামী। খাবারের প্লেটগুলো আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, মিসেস সুজুকি তার পরিবার নিয়ে কথা বলছিলেন।

“জানো, প্রায় তোমার বয়সি আমার একটা নাতনি আছে।” তাকে হঠাৎ নিঃসঙ্গ দেখাল।

“তোমার চেয়ে এক বছরের ছোট হবে হয়ত। ও খুব বেশি দুরে থাকে না কিন্তু তিন বছর বা তারও বেশি হবে ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।”

“আপনি কি আপনার পরিবারের সাথে একসাথে থাকতে পারেন না?”

মিসেস সুজুকি কোন উত্তর দিলেন না। নিশ্চয়ই কোন কারন ছিল।

“আপনি যদি ওকে চিঠি পাঠান? আমি তোমাকে দেখতে চাই। আমি তোমার জন্য রান্না করতে চাই। তুমি যা খেতে চাও তাই তৈরি করব। এরকম কিছু লিখলে আমি নিশ্চিত ও আপনাকে দেখতে অবশ্যই আসবে।”

এক পর্যায়ে আমি সিরিয়াসলি চিন্তা করতে শুরু করলাম যে কেউ যদি আমাকে বলে তুমি কি খেতে চাও তাই খাওয়াবো, তাহলে আমার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। মানে বলতে চাইছি ঐটা হয়ত ‘জীবনে একবারই আসে। ধরনের প্রশ্ন হতে পারে। যদি এরকম প্রশ্ন কখনো আসে তবে তার জন্য আমার এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত। এসব যখন ভাবছিলাম তখন সুশিগুলো আমার সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছিল।

“তুমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে, ঠিক কিনা,” মিসেস সুজুকি দম আটকে বললেন। “আসলে তোমাকে আমার একটা জিনিস বলবার আছে। আসোকে ফিরিয়ে আনার জন্য যে জিনিসটা তোমাকে দেব বলেছিলাম, সেটার ব্যাপারে। সত্যি কথা হল এরকম কোন জিনিস আসলে নেই। আমি বানিয়ে বলেছিলাম। আমি তোমাকে আবারও দেখতে চাইছিলাম, তাই একটা অজুহাত বানিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর সেটার প্রতিদান হিসেবে তোমাকে এটা দিতে চাই।”

তিনি আমার হাতে একটা চাবি দিয়ে মুঠে বন্ধ করলেন।

“আমার ঘরের চাবি। আমাদের আর কোন অজুহাতের প্রয়োজন নেই। তোমার যখন ইচ্ছা হবে তখনই আসতে পারবে। কারন তোমার সঙ্গ আমি খুবই উপভোগ করি।”

আমি বার বার নড করলাম। সুন্দর একটা চিন্তা আমার মাথায় এলো। জীবনে কতবার আমি আফসোস করেছি জন্ম নেয়ার জন্য, কতবার চিন্তা করেছি কোন উঁচু বিল্ডিঙের মাথায় গিয়ে ছাদের কোনার বেড়ায় উঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু যতবারই সেরকম মনে হোক না কেন আজকের মত একটা দিন আমি বারবার পেতে চাই।

সেদিন থেকে প্রতিদিন, যখনই আমার সাথে কষ্টদায়ক কিছু হয়েছে, মিসেস সুজুকির দেয়া চাবিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরেছি। আর সেটা আমাকে মাটির উপর আমার পা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে, চাবিটা যেন ছিল কোন ‘ডাবল এ এলকালাইন ব্যাটারির মত, ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে শক্তি সরবরাহ করত আর দুনিয়াতে ফিরিয়ে আনত।

চাবিটা আমি যখন যে বইটা ধার করতাম, সেটার মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম, একটা বুকমার্কের মত।

মিসেস সুজুকি চাবিটা দেয়ার দুই সপ্তাহ পর এক শুক্রবার দিন স্কুলে একটা ঘটনা হল। বিরতির সময়ে কাজারি আমার ক্লাসরুমে এল। ও ওর অংকের বই আনতে ভুলে গিয়েছিল তাই আমারটা ধার নিতে এসেছিল।

“প্লিজ। আমি তোমার জন্য ভাল কিছু একটা করব।।”

অনেকদিন পর কাজারি আমার সাথে কথা বলল, তাই আমি আনন্দিত বোধ করছিলাম। ঐ দুপুরে আমারও অংকের ক্লাস ছিল, কিন্তু ও কথা দিয়েছিল আমার ক্লাসের আগেই এসে বইটা ফেরত দিয়ে যাবে, তাই আমিও ওর হাতে বইটা তুলে দিয়েছিলাম।

লাঞ্চের সময় কাজারির ক্লাসরুমে গেলাম বইটা আনতে কিন্তু ও সেখানে ছিল না। আমাকে আমার বই ছাড়াই অংক ক্লাস করতে হল।

আমাদের অংকের টিচার চমৎকার একজন মানুষ ছিলেন। আমি যদিও খুব কমই তার সাথে কথা বলেছি, তবে প্রায়ই তাকে দেখেছি করিডোরে দাঁড়িয়ে কাজারির সাথে হাসতে হাসতে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলতে। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি যদি তাকে বুঝিয়ে বলি কেন আমার বই সাথে নেই তাহলে কোন সমস্যা হবে না।

ক্লাসের একদম শুরুতে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, “কেন তোমার সাথে বই নেই?” তারপর আমাকে ডেস্কের পাশে দাঁড় করালেন।

“আ..আমি বইটা আমার বোনকে ধার দিয়েছিলাম।”

“আমি আমার কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছি না! নিজের সমস্যার জন্য আরেকজনের উপর দোষ চাপাচ্ছ। তুমি কি আসলেই ক্লাস ১-এর কাজারির জমজ বোন? আর তোমার কি মনে হয় না তোমার উচিত নিজের চেহারা-সুরত, পোশাক-আশাকের উপর একটু নজর দেয়া?”

টিচার যখন এসব বলছিলেন তখন ক্লাসের ভেতর থেকে চাপা হাসির শব্দ আসছিল। টের পেলাম আমার মুখ গরম হয়ে যাচ্ছে, আমার ইচ্ছা করছিল ছুটে পালিয়ে যাই। আমি জানি আমার চুলগুলো অগোছালো আর পোশাক-আসাক নোংরা। কিন্তু যে মানুষটা কিচেনে ঘুমায় তার পক্ষে এ ব্যাপারে কি করার ছিল?

সেদিন ক্লাস শেষে রুম থেকে বের হয়ে কাজারির সামনে পড়লাম।

“আমি দুঃখিত যে তোমার বই ফেরত দিতে দেরি হয়ে গেল। আমি সেটার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চাই। আমি আর আমার বন্ধুরা ম্যাকডোনাল্ডস-এ যাচ্ছি। তুমিও আমাদের সাথে চল? আমি তোমাকে হ্যামবার্গার খাওয়াবো।”

কাজারি সুন্দর একটা হাসি দিল। আগে কখনো ও আমাকে এরকম কোন কিছুতে ডাকেনি। শুনে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, আর অবশ্যই রাজি হয়েছিলাম। কাজারি আর ওর বন্ধুদের সাথে কোথাও যাওয়া মানে আমার কাছে স্বপ্নের মত। ভুলে নিজের বাম পায়েই এত জোরে পাড়া দিয়ে বসলাম যে অনেক ব্যথা করছিল।

তো আমরা চার জন মিলে ম্যাকডোনাল্ডস-এ গেলাম : কাজারি, ওর দুই বন্ধু, আর আমি। কাজারি সবার জন্য একসাথে অর্ডার দিল। আমি ওর বন্ধুদেরকে চিনতাম না। তারা আমার সাথে তেমন একটা কথাও বলেনি। তবে ওরা কাজারির সাথে অনেক কথা বলল আর অনেক হাসল।

“এটা কি সত্যি যে তোমার কাছে কখনোই টাকা থাকে না? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কাজারি হাত খরচ পায় আর তুমি কিভাবে পাও না?” ক্যাশ রেজিস্টারের সামনে আমরা যখন লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলাম তখন কাজারির একজন বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করল। কাজারি আমার হয়ে উত্তর দিল।

“এটা আমাদের মায়ের সিদ্ধান্ত। তিনি আমার বোনকে কোন টাকা দিলে ও সাথে সাথে সব খরচ করে ফেলে।”

আমাদের অর্ডার রেডি হলে আমরা সেগুলো নিয়ে দোতালায় গিয়ে একটা টেবিলে বসলাম। কাজারি যথেষ্ট পরিমাণ জুস, ফ্রেঞ্চ ফাইজ আর হ্যামবার্গার নিয়ে এসেছিল, তবে সেটা তিনজনের জন্য। কাজারি আর ওর বন্ধুরা খেতে শুরু করল আর আমি শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সাহস করে প্রশ্ন করতে পারলাম না, “আমারটা কোথায়?” ব্যাপারটা চিন্তার বাইরে যে আমি কখনো সরাসরি মা কিংবা কাজারিকে নিজে থেকে কোন কথা বলব।

“আমার খাওয়া শেষ।”

কাজারির একজন বন্ধু তার আধ খাওয়া হ্যামবার্গারটা আমার সামনে ছুঁড়ে রাখল।

“ইয়োকো, আমি শুনেছি তুমি নাকি অন্যদের ফেলে দেয়া খাবার খাও? সত্যি নাকি?”

কাজারি আনন্দের সাথে ওর বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর দিল।

“সত্যি কথা। ইয়োকো সবসময় আমার স্কুটো খাবার গপগপ করে খায়। কাজারি আমার দিকে ঘুরল। “তাই না ইয়োকো? এই দুইজন আমার কথা বিশ্বাসই করে না। চল ওদেরকে দেখিয়ে দাও। নাও, এটা খাও।”

কাজারি ওর আধ খাওয়া হ্যামবার্গারটা আমার দিকে ঠেলে দিল। ও আর ওর বন্ধুরা চোখে আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি লোভীর মত সব খাবার গপাগপ করে খেলাম, একটা শুকর যেভাবে করে। আমার খাওয়া শেষ হলে ওরা তিনজন হাততালি দিয়ে উঠল।

ওখান থেকে বের হয়ে ওরা তিনজন আমাকে বিদায় জানিয়ে কাছের ট্রেন স্টেশনের দিকে চলে গেল। একা হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে আমি চিৎকার করে উঠলাম, “হায় খোদা!”

মিসেস সুজুকির বাসায় পৌঁছানোর পর আমার মাথা যেন ফেটে যাচ্ছিল। কিভাবে কাজারি পারল ওর বন্ধুদের একত্রিত করে আমার সাথে এরকম করতে? আসলে কাজারি সবসময়ই আমার সাথে এরকম করে এসেছে। পার্থক্যটা শুধু হল, আগে করত বাসার ভেতর, আর এখন করল বাইরে। আমি এটা ভেবে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু আমার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল। হয়ত আমি স্কার্ফ বেশি পেঁচিয়ে ফেলেছিলাম।

মিসেস সুজুকি আমার জন্য এক কাপ কফি ঢালতে গিয়ে একটু কাশলেন।

“আমি মনে হয় একটু ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফেলেছি,” আরেকটু কেশে তিনি বললেন। “কি হয়েছে ইয়োকো? তোমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। সবকিছু ঠিক আছে তো?”

“উম, আসলে, আমার মনে হয় একটু বেশি…”

“একটু বেশি?”

তিনি সরাসরি আমার চোখের ভেতর তাকালেন। বয়স্ক মানুষদের চোখ কেন এত স্পষ্ট হয়? আমি বুকে হাত রেখে মনে মনে ভাবছিলাম।

“আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ব্যথা হচ্ছে….এখানে।”

কোন রকমে শব্দগুলো মুখ থেকে বের করতে পারলাম। আমার মাথার ভেতর আবারও কাজারি আর ওর বন্ধুদের চিন্তা ঘুরছিল। মিসেস সুজুকি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কিছু বললেন না।

“নিশ্চয়ই তোমার সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে।” তিনি আমাকে বেডরুমের দিকে নিয়ে গেলেন এবং আয়নার সামনে বসালেন।

“আমার জন্য হাসো। তুমি কি জানো, তুমি আসলে খুবই সুন্দর দেখতে।” তিনি আমার গালে হাত বুলিয়ে আলতো করে চিমটি কাটলেন। আমাকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করছিলেন।

“থামুন,” আমি বললাম। “প্লিজ, থামুন! আমি শুধু আয়নায় একটা ভাঁড়কে দেখতে পাচ্ছি। আমার বুকে একটু ভাল বোধ হচ্ছে অবশ্য, আপনি এখন আমার গাল টানা বন্ধ করতে পারেন।”

“একটু ভাল? তাহলে তো ভালই,” তিনি বললেন, আবার কাশতে লাগলেন। আর সেটা গলা পরিস্কার করার মত কাশি ছিল না। বাজে রকমের খসখসে কাশি যা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল।

“আপনি কি ঠিক আছেন?”

“আমি ঠিক আছি। হ্যাঁ, ঠিক আছি। আমি চিন্তা করছিলাম আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত। একটা টিপ। জানো তো, ইয়োকো, তুমি আমার কাছে পরিবারের একজনের মতই, অন্য যে কারো চেয়ে অনেক কাছের মানুষ তুমি।”

“আমরা কি এমন কোথাও যেতে পারি যেখান থেকে আর ফিরে আসতে হবে না?”

“নিশ্চয়ই। আমরা দুনিয়ার যে কোন জায়গায় গিয়ে থাকতে পারি। আমরা তোমাকে আমার নিজের নাতনি বলে চালাতে পারি।”

আমি জানতাম আমি যাতে ভাল বোধ করি সেজন্য শুধু মিসেস সুজুকি এই কথাগুলো বলছিলেন। কিন্তু তারপরেও আইডিয়াটা আমার কাছে খুব ভাল লাগল। আমি শুধু কল্পনা করছিলাম, তিনি যদি আমার আপন নানি হতেন তাহলে কতই না ভাল হত।

মিসেস সুজুকি আয়নার দিকে ইশারা করলেন। ওখানে আমার ছায়াটা হাসছিল। আমাকে দেখতে লাগছিল ঠিক কাজারির মত।

বাসায় ফেরার সময় আমি কাজারির মত করে হাঁটার চেষ্টা করলাম। মাথা উঁচু করে হাসিখুশি মুখ করে রাখলাম। উপলদ্ধি করলাম যে আমি এতদিন সবসময় মাথা নিচু করে হাঁটতাম।

***

কিচেনের ময়লার ঝুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম আর মিসেস সুজুকির বাড়িতে যা যা হল সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। মা ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অফিসের কাজের জন্য তার ল্যাপটপের প্রয়োজন হয়। তিনি সবসময় জিনিসটার ভাল যত্ন নিতেন। একবার তিনি ওটা কিচেনের টেবিলে রেখে গিয়েছিলেন আর আমি আঙুল দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দেখেছিলাম।

“তোর নোরা হাতগুলো ওটার থেকে দুরে রাখ!” তিনি চিৎকার করে পাতিল দিয়ে আমার মুখে বাড়ি মেরেছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার চেয়ে ল্যাপটপটার গুরুত্ব অনেক বেশি।

মাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিলেন। লিভিং রুম থেকে কাজারি মাকে ডাক দিলে তার চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। কাজারি আমার আগে বাড়িতে ফিরেছিল আর লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছিল। আমার ঐ রুমে ঢোকা মানা আছে তাই আমাদের আর কোন কথা হয়নি। আমি যদি মায়ের নিষেধ ভেঙে লিভিং রুমে ঢুকে টিভি দেখি তাহলে তিনি আমাকে নিশ্চিতভাবে ন্যাংটো করে পুরো শহর ঘোরাতেন।

মা লিভিং রুমের দিকে গেলেন আর আমি আমার ব্লাউজের ভাঁজ ডলে সমান করতে করতে খুশি মনে ভাবলাম আজকে রাতে হয়ত মার খাওয়া থেকে বেঁচে যাব। লিভিং রুম থেকে মা আর কাজারির কথাবার্তা ভেসে আসছিল। আমি একটা অংকের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এক কান ওদিকে দিয়ে রেখেছিলাম।

“আচ্ছা মা, তুমি কি খেয়াল করেছ যে ইয়োকো আজকাল দেরি করে বাসায় ফেরে?” কাজারিকে কথাটা বলতে শুনে আমি পেন্সিল নামিয়ে রাখলাম। “মনে হচ্ছে ওর একটা বন্ধু হয়েছে। ওর ক্লজিটের মধ্যে ও অনেকগুলো বই লুকিয়ে রেখেছে। আমি ভাবছিলাম ওগুলো কেনার টাকা ও কোথায় পেল।”

আমার মনে হল নিমেষেই যেন শরীরের সব রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। লিভিং রুম থেকে মা কিচেনে রীতিমত উড়ে এলেন। আমাকে পেরিয়ে গিয়ে ক্লজিটের দরজা খুললেন। আমার দিকে তাকালেনও না, যেন আমার কোন অস্তিত্ব ছিল না। ক্লজিট থেকে আমার স্কুলের বইগুলো বের করে ছুঁড়ে ফেললেন, তারপর নিচে লুকানো তিনটা বই আবিষ্কার করলেন যেগুলো আমি মিসেস সুজুকির কাছ থেকে ধার এনেছিলাম।

“এই বইগুলো তুই কোথায় পেয়েছিস?” তিনি সরু গলায় উত্তর দাবি করলেন। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম, কিন্তু কোন রকমে কথা বলতে পেরেছিলাম। উত্তর না দিলে মার খেতে হত তাতে কোন সন্দেহ নেই।

“ওগুলো ধার করেছি…”

তিনি বইগুলো ছুঁড়ে নিচে ফেললেন।

“তোর কোন বন্ধু নেই যে তোকে এরকম বই ধার দিতে পারে। আমি জানি কি করেছিস তুই। তুই ওগুলো চুরি করেছিস, তাই না? প্রতিদিন আমি তোর জন্য কষ্ট করি, আর তুই আমার জন্য খালি শুধু সমস্যার উপর সমস্যা তৈরি করিস!” তিনি হিসহিস করে কথাগুলো বললেন আর চেয়ার দিয়ে আমাকে আঘাত করলেন। “তুই সবসময় এমন ছিলি। সবসময় অকাজের কাজী। কাজারি আর আমার জন্য সমস্যা তৈরি করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তোর।”

কাজারি লিভিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখে সমবেদনা টেনে বলল, “মা, মাফ করে দাও ওকে। আমার মনে হয় ও না বুঝে করে ফেলেছে।”

মা কাজারির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “তুমি একটা লক্ষ্মী মেয়ে কাজারি,” তারপর আমার দিকে ঘুরলেন। “আর অন্যদিকে এটা, ভেতর থেকে পঁচন ধরা। আমি জানি না আর কী বলব। কাজারি যাও তো, লিভিং রুমে ফিরে যাও।”

কাজারি আমার দিকে শব্দ না করে মুখ নাড়িয়ে বলল “ভাল থেকো,” তার পর বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে থাম্বস আপ দিল। রুমে ফিরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। আমি টিভির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

মা এসে আমার পেছনে দাঁড়ালেন। হাতগুলো আমার কাঁধে রাখলেন। আমি শক্ত হয়ে বসে ছিলাম, কারন জানি একটু নড়লেই তিনি আবারও মারবেন।

“আমি কি কখনো তোর জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করেছি? হয়তো মাঝে মধ্যে দুই-একটা চড় থাপ্পড় দিয়েছি, কিন্তু সেটা তো তোর ভালোর জন্যই।”

তিনি আস্তে করে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে আমার গলার উপর উঠিয়ে আনলেন।

“থা-থামো!” আমি গুঙিয়ে উঠলাম।

“তুই যখন ওভাবে কথা বলিস তখন আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়। আমি তোকে বড় করছি। তোর কি মনে হয় না আমার খানিকটা সম্মান পাওনা আছে?”

আমি টের পাচ্ছিলাম তার হাতের চাপ বাড়ছে। আমি আর কোন শব্দ করতে পারছিলাম না। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। বলতে পারছিলাম না, “থামো, মা, আমাকে মাফ করে দাও। তুমি যা বলবে তার সবকিছু করতে আমি রাজি আছি। আমি ক্ষমা চাইছি।”

আমার মনে হয় এক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম মেঝেতে পড়ে আছি, মুখ থেকে লালা ঝরছে। মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, প্রাচীন কোন মন্দিরের প্রহরীর মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

“তোর মরে যাওয়াই ভাল। একদিন আমি তোকে ঠিকই খুন করে ফেলব। আমি কোনভাবেই বুঝতে পারি না দুজন জমজের মধ্যে এত পার্থক্য কি করে হয়। তোর সবকিছু আমার মাথা গরম করে তোলে, তোর কথা বলা থেকে শুরু করে হাঁটা পর্যন্ত সবকিছু।”

মা বই তিনটা তুলে নিয়ে তার রুমে চলে গেলেন। আমার হৃদপিণ্ড তুমুল গতিতে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত আমার মাথার ভেতর পাঠাচ্ছিল।

মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। এখানে থাকলে আমার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ছোট কোন জিনিসেও মা রাগে ফেটে পড়েন, আর আমি নিশ্চিত তিনি আমাকে খুন করে ফেলবেন।

আমি মিসেস সুজুকিকে দেখতে চাইছিলাম। আমি চাইছিলাম আমরা তিনজন মিসেস সুজুকি, আসো আর আমি, দূরে কোথাও চলে যেতে।

মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার আমার মনে পড়ল। মিসেস সুজুকির বাসায় ঢোকার যে চাবিটা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, সেটা ঐ বইগুলোর একটায় লুকানো ছিল, যেগুলো মা তার রুমে নিয়ে গিয়েছেন।

পরদিন ছিল শনিবার। স্কুল ছিল না। মা বাইরে গিয়েছিল, বলে গিয়েছিলেন তার কিছু কাজ আছে, ছয়টার আগে ফিরবেন না। দুপুরের দিকে কাজারি ওর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হল। একা বাসায়, আমি মায়ের রুমে গেলাম।

মায়ের রুমে আমি প্রায় কখনোই যাইনি। এমনিতে ঐ রুমে পা দেয়ার মত সাহস নেই আমার। তিনি যদি টের পান তাহলে কঠিন মার খেতে হবে। সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে মৃত্যু। বিপদ জেনেও আমি সেখানে গিয়েছিলাম শুধু একটা কারনে, মিসেস সুজুকির বাসার চাবিটা উদ্ধারের জন্য। ঐ চাবিটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন ওটা মিসেস সুজুকি আর আমার মধ্যের সম্পর্কের একটা চিহ্ন। বইগুলো না পাওয়া গেলে আমি জানি মিসেস সুজুকি আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু চাবিটা না পেলে আমি নিজেকে নিজে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।

মায়ের রুমটা একদম নিখুঁতভাবে গোছানো। কোথাও এক বিন্দু ধুলোও পড়ে নেই। ডেস্কের উপর ফুলদানিতে ফুল রাখা, পাশেই তার ল্যাপটপ। একটা বড় বিছানার, এক মিনিটের জন্য আমার অস্বাভাবিক একটা অনুভূতি হচ্ছিল যে তিনি ওখানেই আছেন, বিছানা থেকে উঠছেন মাত্র। বিছানার পাশে একটা পোর্টেবল সিডি/রেডিও ক্যাসেট প্লেয়ার আর বুককেসে একটা তাকে সিডির সারি। মিউজিক শোনার অভ্যাস আমার ছিল না, তবে মা আর কাজারি প্রায়ই মিউজিক নিয়ে কথা বলত যে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।

মিসেস সুজুকির বইগুলো এক কোণায় অযত্নে ফেলে রাখা ছিল। আমি শুধু চাবিটা নিয়ে হাতের মুঠিতে আলতো করে চেপে ধরে রাখলাম। আমার শুধু এখন দরকার যত দ্রুত সম্ভব রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া। বইগুলো ওখানেই ফেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওগুলো নিলে মা বুঝে যাবেন যে আমি তার রুমে ঢুকেছিলাম।

দরজার নবটা মাত্র ঘুরিয়েছি এমন সময় আমি মূল দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম। একদম কাঠের মত শক্ত হয়ে গেলাম, শব্দ করতে ভয় পাচ্ছিলাম। রুম থেকে বের হতে গেলে ধরা পড়ে যাব। দরজায় কান লাগালাম। শুনতে পারছিলাম কেউ একজন এদিকে আসছে।

এদিক ওদিক তাকালাম কানোর জায়গার জন্য। বিছানাটা দেয়ালের সাথে লাগানো তবে একটা ফাঁক মতন আছে যেখানে আমার জায়গা হয়ে যাবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফাঁকটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আমাকে এভাবে দেখলে মনে হবে যেন ঘুমের মধ্যে নিচে পড়ে গিয়েছি। কিন্তু ফাঁকটা আমার জন্য একদম ঠিক সাইজের ছিল, যেন কেউ আমার জন্যই ওখানে ওটুকু ফাঁক আগে থেকে পরিকল্পনা করে রেখেছিল।

দরজা খোলার শব্দে আমার পুরো শরীর শক্ত হয়ে গেল। আমার বুক এত জোরে ধকপক করছিল যে আমি চাইছিলাম ওটা থেমে যাক। আমি মাথাটা একটু বাঁকালাম যাতে বিছানার নিচ থেকে দেখতে পাই। রুমের অন্য পাশে একটা ফুল সাইজ আয়না ছিল। আয়নাতে কাজারির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। কাজারি এসেছে। আমার জানা নেই ও মায়ের রুমে কি করছে কিন্তু যেটার জন্যই এসে থাকুক না কেন, আমি চাইছিলাম ও যেন তাড়াতাড়ি সেটা করে বেরিয়ে যায়। কাজারি বুককেসের সামনে দাঁড়িয়ে সিডিগুলো দেখছিল। গুনগুন করতে করতে কয়েকটা সিঁড়ি বের করল। অবহেলার সাথে ওগুলো ডেস্কের উপর রাখছিল। আবারও বুক কেসের দিকে ঘুরে কয়েকটা সিডি বের করল, আবারও নিয়ে ডেস্কের উপর রাখল।

বিছানার নিচ থেকে আমি আয়নায় দেখতে পেলাম ওর হাত ফুলদানির সাথে গিয়ে লাগছে। মুহূর্তেই আমার মুখ থেকে, “আহ!” বেরিয়ে এল। ফুলদানিটা উলটে গিয়ে সব পানি গড়িয়ে মায়ের ল্যাপটপের উপর পড়ল। কাজারি মনে হয় না আমার গলা শুনতে পেয়েছে কারন ও নিজেও একই সময়ে “আহ!” করে উঠেছিল। দ্রুত ও ফুলদানি সোজা করে ফেললেও যা ক্ষতি হওয়ার ততক্ষণে হয়ে গিয়েছে। ভেঁজা চুপচুপে ল্যাপটপটার দিকে তাকিয়ে ওর মুখ যে ভুতের মত সাদা হয়ে গিয়েছে তা আমি আয়নাতে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।

ও পাগলের মত রুমের মধ্যে এদিক ওদিক তাকাল তারপর আবার ওর মুখে হাসি ফিরে এল। ও রুমের মধ্যে এমন একটা জায়গায় গেল যেটা আমি আয়নায় দেখতে পারছিলাম না কিন্তু বিছানার নিচ থেকে ওর গোড়ালি আর মোজা চোখে পড়ছিল। ওর পাগুলো রুমের মধ্যে ঘুরে বেড়াল, কোণায় ফেলে রাখা তিনটা বইয়ের সামনে গিয়ে থামল। মিসেস সজকির বাড়ি থেকে যেই বইগুলো এনেছিলাম, মা যেগুলো আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। কাজারির হাতগুলো ওগুলো তুলে নিল।

তারপর ও গিয়ে ডেস্ক থেকে সিডিগুলো তুলে আমার বুককেসে ঢুকিয়ে রাখল। দেখে মনে হচ্ছিল ওগুলো নেয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে। বরং মিসেস সুজুকির বইগুলো হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলে। ওর রুমে কিছুক্ষণ থাকার পর আমি ওর পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, লিভিং রুমে গেল। কয়েক মিনিট পর আবার ওর রুমে ফিরে গেল। এরপর আর আমি কোন পায়ের শব্দ পেলাম না।

আমার বুঝতে বেশি সময় লাগেনি কেন কাজারি বইগুলো নিয়েছিল। মা যখন ফিরে এসে দেখবে তার কম্পিউটার পানিতে ভেঁজা, তখন নিশ্চয়ই চিন্তা করবে আমি কিংবা কাজারির কেউ একজন কাজটা করেছে। কিন্তু যদি তার রুম থেকে বইগুলো উধাও হয়ে যায় তাহলে মা ধরে নেবে যে আমি তার রুমে বইগুলো আনতে গিয়েছিলাম, আর আমিই ফুলদানিটা ফেলে দিয়েছি।

আমি যতখানি দেখেছি মা তারচেয়েও কতখানি রেগে যেতে পারে তা আমি কল্পনা করতে পারছিলাম। এরকম ভয়াবহ কিছু আগে কখনো ঘটেনি। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে এর মুল্য আমাকে আমার জীবন দিয়ে চুকাতে হবে। গতরাতে দেখা মায়ের চেহারাটা মনে পড়ল। তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হাতগুলো ঈষৎ পেছনের দিকে বাঁকিয়ে কোমরের উপর রাখা। মন্দিরের গেটে থাকা নিও (বুদ্ধর রক্ষী)-এর মূর্তির মত নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার অভিব্যক্তি ছিল কঠোর এবং ক্ষমাহীন।

খুব সাবধানে আমি বিছানার ফাঁক থেকে বের হয়ে এমনভাবে রুম থেকে বের হলাম যেন কাজারি আমার পায়ের শব্দ শুনতে না পায়। মূল দরজা খুলে দৌড়ে মিসেস সুজুকির বাড়িতে চলে গেলাম। মিসেস সুজুকির আশ্রয়ই আমাকে একমাত্র জীবিত রাখতে পারে এখন। কিন্তু দরজার বেল বাজালে মিসেস সুজুকি নন, বরং মুখে মেকআপ দেয়া একটা কমবয়সি মেয়ে দরজা খুলল।

মেয়েটা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে বলল, “কে তুমি?”

আমি মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম যে এই মেয়েটা মিসেস সুজুকির সেই নাতনি।

“আঃ…আমি মানে…মিসেস সুজুকি কোথায়?”

“তুমি বলতে চাইছ আমার নানি? তিনি মারা গিয়েছেন। আজ সকালে তার প্রতিবেশী এসে আমাদেরকে জানান যে কুকুরটা অসম্ভব চিৎকার করছে। আমরা এসে তাকে সামনের দরজার কাছে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাই। বাজে ঠাণ্ডা থেকে সৃষ্ট জটিলতায় মৃত্যু। আজকে আমার স্কুলও বন্ধ ছিল। এখন এসব সামলাতে হবে। ঝামেলা ছাড়া কিছু না।”

***

আমার মনে আছে মিসেস সুজুকি মাত্র আগের দিনই বলেছিলেন যে তার মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে মেয়েটার পেছনে আমি কিছু লোকজনকে ভেতরে নড়াচড়া করতে দেখতে পাচ্ছিলাম।

“এরি! কে এসেছে?” ভেতর থেকে একজন নারীর কষ্ঠ ভেসে এল।

মেয়েটা ঘুরে বলল, “চিনি না। একটা মেয়ে, আগে কখনো দেখিনি।” তারপর আমার দিকে ঘুরল। “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তিনি এভাবে মারা গিয়ে আমাদের ঘাড়ে ঝামেলা চাপিয়ে দিলেন। কী যন্ত্রণা বল তো। এখন এই কুকুরটাকে নিয়ে কি করব? ভাবছি বাসায় নিয়ে যাব নাকি কোন এনিম্যাল সেন্টারে পাঠিয়ে দেব?”

এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল, খোদা, এই মেয়ের গলা টিপে ধরলে কি কোন ভুল হবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি যা করলাম তা হল মাথা নিচু করে মিসেস সুজুকির বাসার সামনে থেকে চলে এলাম।

পার্কে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। ঐ একই বেঞ্চ যেখানে আসোকে খুঁজে পেয়েছিলাম। পার্কে অনেক বাচ্চা-কাচ্চা খেলাধুলা করছিল, স্লাইড বেয়ে নামছিল, দোলনায় দোল খাচ্ছিল, খেয়াল খুশি মত হাসছিল। আমি বলের মত গুটিসুটি মেরে চোখ বন্ধ করলাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে মিসেস সুজুকি দুনিয়াতে আর নেই। ব্যাপারটা আমার জন্য সহ্য ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

পার্কের ঘড়িতে ছয়টা বাজছে। শিগগিরি মা বাসায় ফিরবে। আন্দাজ করলাম প্রায় তিন ঘন্টার মত হবে পার্কে বসে আছি। ঐ সময় আমার পায়ের কাছে কাদার মত দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার অশ্রু থেকে সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু পরে খেয়াল করলাম কাছের একটা ফোয়ারা থেকে পানি বয়ে এসে কাদা হয়েছে।

উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক করলাম পালিয়ে পৃথিবীর শেষ সীমানায় চলে যাব। কিন্তু সেই মুহূর্তে চোখের কোণা দিয়ে কাজারিকে চোখে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল দেখেছি, কিন্তু না, পার্কের পাশের ফুটপাথ দিয়ে কাজারিই হেঁটে যাচ্ছিল, হাতে স্থানীয় কনভিনিয়েন্স স্টোর থেকে কেনাকাটার ব্যাগ ঝুলছে। আমি ওর দিকে দৌড়ে গেলাম।

“কাজারি! দাঁড়াও!”

ও থেমে ঘুরে দেখল আমি দৌড়ে আসছি। ওর চোখগুলো গোল হয়ে কোটর থেকে বের হয়ে আসছিল মনে হল।

“কাজারি, আমি চাই তুমি মায়ের রুমে যা করেছ তার সত্যিটা মাকে বলে দাও আর ক্ষমা চাও।”

“তুমি ওটার সম্পর্কে জানো?”

“আমি ওটার সম্পর্কে সবকিছু জানি। তাই তুমি মাকে সত্যিটা বলে। দাও, যে তুমিই কাজটা করেছ।”

“অসম্ভব। আমি চাই না মা আমার উপরে রেগে যাক!” কাজারি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছিল। “তুমি কেন দোষটা তোমার ঘাড়ে নিচ্ছ না? তোমার তো এর অভ্যাস আছে। মা আমার উপর রাগ করলে আমি সহ্য করতে পারব না। এটা লজ্জাজনক। আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব না।”

আবারও আমার বুক চেপে আসছিল মনে হল। আমার কাছে যদি একটা ছুরি থাকত তাহলে খুশি মনে নিজের হৃদপিণ্ডে একটা ছিদ্র করে দিতাম। তাহলে শান্তি হত।

“…কিন্তু তুমি, তুমি নিজে পানিটা ফেলেছিলে, তাই না?” আমি অনুনয় করলাম।

“তুমি কি কানে শুনো না? আমি কি মাত্রই বললাম না যে তুমি বলবে কাজটা তুমি করেছ? মা যখন বাসায় ফিরবেন, তুমি গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইবে, বুঝেছ?”

“কিন্তু আমি…” আমি আমার হাতগুলো পকেটে ঢুকালাম।

“হ্যাঁ?” ও তাড়া দিয়ে বলল।

পকেটে রাখা চাবিটা এত জোরে চেপে ধরেছিলাম যে মনে হচ্ছিল রক্ত বেরিয়ে আসবে।

“আমি…”

হৃদয়ের গভীর থেকে আমি ওকে ভালবাসতাম, কিন্তু সেটা দশ সেকেন্ড আগের কথা। আর আমার বুকের উপর থেকে চাপটা সরে গিয়েছিল। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস আবার নিয়মিত হয়ে এল।

“আচ্ছা ঠিক আছে। ব্যাপারটা ভুলে যাও। কাজারি, আমার কথা শোন…” আমি মনস্থির করে ফেলেছি। “তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু মা ইতিমধ্যে জানেন যে কাজটা তুমিই করেছ। কথাটা সত্যি। তিনি জানেন তুমি আমাকে দোষী দেখানোর জন্য বইগুলো নিয়ে গিয়েছ। তুমি দোকানে যাওয়ার জন্য বের হওয়ার সাথে সাথেই মা বাসায় ফিরেছিলেন। আমি সামনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর তার রুম থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপর দৌড়ে পার্কে চলে আসি। কিন্তু মা এর মধ্যেই বুঝে ফেলেছেন যে তুমি ফুলদানি উলটে পানি ফেলেছ।”

কাজারির মুখ আবারও ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

“তার পক্ষে জানার কোন সুযোগই নেই!”

“কিন্তু তিনি জেনেছেন। আমি সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন সিডিগুলো উল্টোপাল্টা হয়ে আছে, তারমানে নিশ্চয়ই তুমি করেছ। সেজন্যই তিনি চিৎকার করছিলেন। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, দয়া করে যাও আর তিনি যা চান তা কর।”

কাজারি আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, বিহ্বল।

“মা সবকিছু জানে তারমানে?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

“তিনি যদি রেগে যান আর তোমাকে যেভাবে মারেন সেভাবে যদি আমাকে মারেন তাহলে সেটা আমি সহ্য করতে পারব না!”

আমি ভান করলাম যে আমিও বিহ্বল, তারপর ব্যাপারটাকে সামনে নিয়ে গেলাম।

“ঠিক আছে। আমি জানি কি করতে হবে। আমি তোমার জায়গায় গিয়ে তার কাছে মাফ চাইব।”

“তুমি তাকে কি বলবে?”

“শুধ আজ রাতের জন্য, চল পোশাক অদলবদল করি। আমি ভান করব যে আমিই তুমি। আমি তোমার পোশাক পরব, তুমি আমারগুলো পরবে। কাল সকাল পর্যন্ত আমি অভিনয় চালিয়ে যাব, আর তুমি আমি সেজে চুপচাপ থাকবে।”

“তোমার ধারণা তিনি তা বুঝতে পারবেন না?”

“সেটা চিন্তা কোর না। আমরা দেখতে হুবহু একই রকমের। কিন্তু তোমার মনে রাখতে হবে যে আমার মত খানিকটা দুঃখী দুঃখী অভিনয় করতে হবে। সেটা ঠিক মত করলে কোন সমস্যা হবে না। তিনি আমার উপর চিৎকার করবেন আর আঘাত যা করার আমাকে করবেন। তোমাকে সেটা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”

পার্কের রেস্টরুমে আমরা পোশাক বদলালাম। আমি কাজারির পোশাকগুলো পরে চুল ঠিক করে নিলাম। কাজারি আমার নোংরা পোশাক পরে মুখ কুঁচকে ফেলল।

“তোমার পোশাক থেকে অদ্ভুত গন্ধ আসছে!”

কাজারির পোশাকগুলো ছিল পরিস্কার আর সুন্দর। আমি ওর মোজাগুলো পড়লাম। ওর ঘড়ি পড়লাম। জানি না কতখানি ভাল করতে পেরেছি কিন্তু রেস্টরুমের আয়নায় তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আমাকে কম বেশি কাজারির মতই লাগছে। নিজেকে হাসতে দেখে আমার মিসেস সুজুকির কথা মনে পড়ল। হাত দিয়ে মুখে স্পর্শ করলাম। চোখ দিয়ে পানির মত কিছু বেরিয়ে আসছিল। কাজারির থেকে আমার অশ্রু লুকানোর জন্য বেসিনের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললাম।

“কি করছ তুমি?” কাজারি বাইরে অপেক্ষা করছিল। রেস্টরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল, ওকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল। আমরা পার্ক থেকে বেরিয়ে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে গেলাম। গোধূলির সময়, পুরো বাড়িটা আমাদের সামনে লাল আলোতে স্নান করছিল। উপরে তাকিয়ে আমি দশ তলায় আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের জানালার দিকে তাকালাম। একটু আগে কাজারিকে আমি মিথ্যে বলেছিলাম যে মা বাসায় চলে এসেছেন। ও আমাকে সন্দেহ করেনি।

যদিও আমার নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই, কিন্তু আমার বিশ্বাস মা এতক্ষণে অবশ্যই বাসায় চলে এসেছেন। এসব ব্যাপার মা বেশ মেনে চলেন। তিনি যদি বলেন ছয়টার মধ্যে বাসায় ফিরবেন, তাহলে তাই করবেন।

“কাজারি, বাসায় গিয়ে তুমি ভান করবে যেন তুমি আমি।”

কাজারিকে দেখে মনে হচ্ছিল না পরিকল্পনাটা নিয়ে সে খুশি। মিনমিন করে বলল, “আমি জানি। তো কে আগে ঢুকবে? সেই সেকেন্ড গ্রেডের পর থেকে আমরা কখনো একসাথে বাসায় ফিরিনি। ব্যাপারটাকে ভাল দেখাবে না।”

আমরা রক-পেপার-সিজার খেলোম সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। টানা ত্রিশ বার করলাম, পনের বার ও জিতল, পনের বার আমি। সম্ভবত আমরা জমজ বলে একইভাবে অনুমানও করি। একত্রিশ তম বার আমি জিতলাম। সুতরাং কাজারি, আমি সেজে আগে যাবে। আমি ওকে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে ঢুকতে দেখলাম। বিল্ডিঙের সামনের একটা গাছে হেলান দিয়ে ডুবতে থাকা সুর্যের আলোয় ভেসে থাকা শহরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার হাতে কনভিনিয়েন্স স্টোর থেকে আনা কাজারির ব্যাগটা। হাঁটুর সাথে ঘষা লেগে প্লাস্টিক খচখচ করে উঠল।

একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে গেল, পেছনে লম্বা ছায়া ফেলে। আকাশের মেঘগুলোকেও লাল দেখাচ্ছিল, যেন ভেতর থেকে জ্বলছিল। কেউ একজন “কাজারি!” বলে ডাক দিল। আমি ঘুরে দেখি আমাদের বিল্ডিঙের এক মহিলা। “স্কুল কেমন চলে?” তিনি জানতে চাইলেন। “তুমি ভাল করছ তো?”

“মোটামুটি,” আমি উত্তর দিলাম। এর পরপরই কিছু একটা উপর থেকে নিচে ধপ করে আছড়ে পড়ল, আর মহিলাটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। মাটির উপর, ময়লা পোশাক পরা একটা মেয়ে পড়ে আছে, যে দেখতে একদম আমার মত ছিল।

আমি অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার পর, মৃত কাজারির হয়ে আমাকে একটা নোট লিখতে হল। মা আমাকে লিখতে বাধ্য করলেন। তিনি বললেন পুলিশ আসার আগে আমার হাতে কমবেশি পাঁচ মিনিটের মত আছে। আমি রাজি হলে তিনি বললেন আমি কত লক্ষ্মী একটা মেয়ে, আর তিনি আমাকে কতখানি ভালবাসেন। এই কথাগুলো আমি এর আগে শুধু গভীর রাতে শুনেছি, আমার স্বপ্নে।

নোটটা হতে হবে আত্মহত্যার আগে ইয়োকোর লিখে যাওয়া চিঠি, যেটা আমার জন্য লেখা সহজ ছিল। আমার শুধু দরকার ছিল আমি যখন মরতে চাইতাম তখন যা ভাবতাম তা লিখে ফেলা।

কেউ ইয়োকোর আত্মহত্যা নিয়ে কোন সন্দেহ করেনি। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর যখন আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল, আর সেই অন্ধকারে লোকজন অ্যাপার্টমেন্টের সামনে জড়ো হয়ে ছিল, পুলিশ আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমরা তাদের আমাদের গল্প শোনালাম। মা আমার সত্যিকারের পরিচয় ধরতে পারেননি। আমি জানি শিগগিরি তিনি বুঝতে পারবেন এবং তখন আতংকিত হয়ে পড়বেন বা রেগে যাবেন। আমি ঠিক করলাম ব্যাগ-ট্যাগ প্যাক করে সে রাতেই বেরিয়ে পড়ে দূরে কোথাও চলে যাব।

পুলিশের সাথে কথাবার্তা অনেক রাত পর্যন্ত চলল, আমাকে আর মাকে দুজনকেই ভুতের মত দেখাচ্ছিল। আমি সত্যি সত্যি ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু মায়েরটা সম্ভবত অভিনয় ছাড়া কিছু ছিল না। পুলিশ যাওয়ার পর তিনি আমার কাঁধ ডলতে ডলতে আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। আমি মারা গেলে আমার মনে হয় না মার মন খারাপটাও হবে। কি দুঃখজনক রকমের একটা মানুষে পরিণত হয়েছি আমি। মনের ভেতরে আমি আসলেই কাজারির জন্য দুঃখিত ছিলাম, যে আর আমাদের সাথে নেই।

মা তার রুমে গেলেন। আমি কাজারির রুমে গেলাম, যেটা অনেক কিউট কিউট জিনিস দিয়ে ভর্তি। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমি মনে হয় কিচেনের ময়লার ঝুড়ির পাশে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। যখন আমি নিশ্চিত হলাম যে মা রাতের জন্য বিশ্রাম নিয়েছেন, একটা ব্যাগে কিছু জিনিসপত্র ঢুকিয়ে রাখলাম। একটা ঘেঁড়া যাবুতোন যেটা আমি শোয়র জন্য ব্যবহার করতাম, সেটা ব্যাগে ঢোকানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ঢুকল না। কাজারির কিছু জামা কাপড় বের করে বালিশটা ঢোকার জায়গা করলাম।

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে মিসেস সুজুকির বাসায় গেলাম আসোকে নিতে। আমার মনে ছিল যে কেউ একজন নির্দোষ কুকুরটাকে এনিম্যাল সেল্টারে দিয়ে আসার কথা বলছিল। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আসো তখনো ঐ বাসায় আছে কিনা। গিয়ে দেখি আসোকে মূল দরজার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাড়ির ভেতরে মনে হচ্ছিল মিসেস সুজুকির ছেলেমেয়ে আর নাতি নাতনিরা আছে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রস্তুতির জন্য। আসোকে সেজন্য বাড়ির বাইরে বের করে দেয়া হয়েছে। আমারও একই অবস্থা, আমি ভাবলাম।

আমাকে দেখে আসো এত জোরে লেজ নাড়াতে লাগল যে ভয় হচ্ছিল টর্নেডো না শুরু হয়ে যায়। আমি দড়িটা খুলে কুকুরটাকে কিডন্যাপ করলাম।

কুকুরটাকে নিয়ে ট্রেন স্টেশনের দিকে গেলাম। আমি দুঃখিত যে মিসেস সুজুকি আর ইয়োকো এনদো দুজনেরই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মিস করব। আমার জীবন কিভাবে চলবে সে ব্যাপারে আমার কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। আমার কাছে কোন টাকা ছিল না, হয়ত না খেয়ে মরতে হবে। কিন্তু ক্ষুধার্ত থাকার অভ্যাস আমার আছে, আর নিজের লোহার মত শক্ত পেটটার উপরও আমার ভরসা আছে, সুতরাং রেস্টুরেন্টের ফেলে দেয়া যে কোন কিছু, যেমন গাজরের ছিলকা পর্যন্তও খেয়ে বাঁচতে পারব। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে চাবিটা চেপে ধরলাম। ওটা আমাকে চলার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন তা সরবরাহ করছিল। মনে মনে বলে উঠলাম, “হ্যাঁ! আমি মুক্ত!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *