কাকাবাবু বনাম মূর্তিচোর
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু একটা রাস্তা। দু-পাশের গাছের ডালপালা ঝুঁকে ঝুঁকে আছে, হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে এগোতে হয়। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এখনও একটু আলো আছে আকাশে। আকাশের এক দিকের রং লাল আর অন্য দিকটা ধূসর। জঙ্গলের মধ্যে যেন আলোছায়ার জাফরি কাটা।
কত রকম পাখির ডাক শোনা যায় এখন। সব পাখি বাসায় ফিরছে। পাখিদের কিচির-মিচির শোনা যায়, তাদের দেখা যায় না। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক বক।
বনমালি নামের লোকটি আর সন্তু যাচ্ছে আগে আগে। বনমালির রোগা লম্বা চেহারা, ধুতির ওপর ফতুয়া পরা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মুখে গোঁফদাড়ি নেই। চোখ দুটি সরু মতন, সে বারবার এদিক-ওদিক তাকায়। সন্তু পরে আছে প্যান্ট-শার্ট আর একটা নীল সোয়েটার। বাতাসে শীত শীত ভাব আছে। ফতুয়াপরা বনমালির কী শীত লাগে না?
কাকাবাবু পরে আছেন প্যান্টের ওপর একটা লম্বা কোট। দু-বগলে ক্রাচ নিয়ে তাঁর হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে এই জঙ্গলের মধ্যে। লতাপাতায় ক্রাচ জড়িয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
এক জায়গায় সন্তু থমকে দাঁড়িয়ে একটা গাছের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই থোকা থোকা লাল ফুলগুলো কী ফুল?’
বনমালি সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী জানি!’
সে ফুলের নাম জানে না, ফুল দেখার উৎসাহও তার নেই।
পেছন থেকে কাকাবাবু বললেন, ‘রঙ্গন।’
তারপরই কাকাবাবু খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সন্তু, মাথা নীচু কর। বসে পড়, বসে পড়!’
সন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। কাকাবাবু কেন ওই কথা বলছেন, তাও সে বুঝতে পারল না।
কাকাবাবু তাঁর হাতের ক্রাচটা তুলে খুব জোরে মারলেন একটা গাছের সরু ডালে।
তখনই বোঝা গেল, সেটা গাছের ডাল নয়। সবুজ ডালের মতনই সোজা হয়েছিল। এখন মাটিতে পড়ে কিলবিল করছে।
কাকাবাবু তাঁর হাতের ক্রাচটা তুলে খুব জোরে মারলেন একটা গাছের সরু ডালে।
সন্তু এবার ভয় পেয়ে এক লাফে সরে গিয়ে বলল, ওরে বাপরে, সাপ! ঠিক আমার মাথার ওপরে ছিল।
বনমালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘লাউডগা সাপ, কামড়ালে আর রক্ষা ছিল না। নির্ঘাত মৃত্যু।’
কাকাবাবু কিন্তু সাপটাকে আর মারলেন না। ক্রাচটা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলেন এক পাশে। আপন মনে বললেন, ‘শীত শেষ হয়নি, এর মধ্যে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। খিদের জ্বালায় আর থাকতে পারেনি।’
তারপর বনমালির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘লাউডগা সাপের বেশি বিষ নেই। কামড়ালে মানুষ মরবে কেন? অবশ্য অনেকে ভয়েই মরে যায়।’
সন্তু জিজ্ঞেস করল, ‘সাপ কামড়ালে মানুষ মরে না?’
কাকাবাবু বললেন, ‘সব সাপের কি আর বিষ থাকে? বেশির ভাগ সাপের বিষ থাকে না। কিন্তু ভয় পেতে নেই। ভয় না-পেলে খুব বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও চিকিৎসা করে বাঁচা যায়। ওহে বনমালি, আর কত দূর?’
বনমালি বলল, ‘এই তো আর একটুখানি মোটে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘তখন থেকেই তো একটুখানি একটুখানি বলছ। ভালো জিনিস পাওয়া যাবে তো?’
বনমালি জোর দিয়ে বলল, ‘খুব ভালো ভালো জিনিস পাবেন স্যার। আমি কী আর শুধু শুধু আপনাদের এতদূর টেনে আনছি? তবে দাম কিন্তুু বেশি পড়বে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘যতই দাম পড়ুক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু জিনিস পছন্দ হওয়া চাই। পছন্দ না-হলে তুমিও পয়সা পাবে না!’
আবার পথ চলা শুরু হল। এবার ঝুপ ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার। পাখিদের ডাক থেমে এসেছে।
কাকাবাবু পকেট থেকে টর্চ বার করে সন্তুর হাতে দিলেন। সাপটা দেখার পর সেই যে সন্তুর বুক কেঁপে উঠেছিল, এখনও থামেনি। সে টর্চের আলো ফেলে চারদিক ভালো করে দেখছে।
একটু বাদে পাতলা হয়ে এল জঙ্গল। খানিকদূরে দেখা গেল একটা আলো জ্বলছে মিটমিট করে।
আর একটু কাছে এগোতে দেখা গেল, ফাঁকা জায়গার মধ্যে রয়েছে একটা একতলা ছোটো বাড়ি।
বনমালি বলল, ‘এই তো এসে গেছি।’
সন্তু বলল, ‘এরকম জঙ্গলের মধ্যে শুধু একটা বাড়ি রয়েছে। আমার এরকম বাড়িতে খুব থাকতে ইচ্ছে করে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘বেশিদিন ভালো লাগবে না। বড়োজোর সাতদিন। তারপরই হাঁপিয়ে উঠবি। বন্ধুদের জন্য প্রাণ ছটফট করবে!’
বাড়িটার বাইরে দরজার পাশে জ্বলছে একটা হ্যারিকেন আর ভেতরে একটা ঘরে রয়েছে আর একটা জোর আলো। অস্পষ্টভাবে দেখা গেল, বাড়িটা আসলে একটা মন্দিরের আড়ালে। সেই মন্দিরের চূড়া অনেকখানি ভাঙা।
বনমালি চেঁচিয়ে ডাকল, ‘ভবেনদা, ও ভবেনদা!’
একটা কুকুর ভেতর থেকে ডেকে উঠল ঘেউ ঘেউ করে খুব জোরে।
দরজা খোলা। সেখানে এসে দাঁড়াল একটা বড়ো কুকুর। ডাক শুনলেই হিংস্র মনে হয়।
বনমালি ভয় পেয়ে পিছিয়ে এসে আবার চেঁচিয়ে বলল, ‘ও ভবেনদা, কুকুর সামলাও।’
এবারে ভেতর থেকে কেউ একজন হাঁক দিল, ‘কে?’
বনমালি বলল, ‘ভবেনদা, আমি বনমালি গো। মালদার বনমালি নস্কর। তোমার সঙ্গে কাজের কথা আছে।’
ভেতর থেকে কেউ একজন ‘ভোলা, ভোলা’ বলে দু-বার ডাকতেই কুকুরটা থেমে গেল। তারপর বেরিয়ে এল একজন লম্বা লোক, গেরুয়া রঙের লুঙ্গি পরা, আর গায়ে একটা চাদর জড়ানো, হাতে একটা সিগারেট।
সে প্রথমে সন্তু আর কাকাবাবুকে দেখতে পায়নি। বনমালির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিরে, হঠাৎ এসময় এলি যে? আমার তো আজ এখানে থাকার কথা ছিল না। ভালো কিছু জিনিসের খবর এনেছিস?’
বনমালি আমতা আমতা করে বলল, ‘এই একজন সাহেবকে এনেছি।’
ভবেন চমকে উঠে বলল, ‘কে? কাকে এনেছিস?’
কাকাবাবু সামনে এগিয়ে এসে বললেন, ‘নমস্কার। আমি সাহেব-টাহেব নই। আমি একজন বাঙালি। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আর এই আমার ভাইপো সন্তু। আমি পাথরের মূর্তি জমাতে ভালোবাসি। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে মূর্তি জোগাড় করি। শুনেছি, আপনার কাছে কিছু মূর্তি পাওয়া যেতে পারে।’
ভবেন ভুরু কুঁচকিয়ে বলল, ‘আমার কাছে? আমি মূর্তি কোথায় পাব? কীরে, বনমালি, তুই কী বলেছিস?’
বনমালি বলল, ‘ইনি ভালো দাম দেবেন বলেছেন।’
কুকুরটা কাকাবাবুর কাছে এসে ঘুরে ঘুরে গোঁ গোঁ গর্জন করছে। কাকাবাবুর কাছে ক্রাচ থাকে বলে সব জায়গায় কুকুররা তাঁকে অপছন্দ করে।
কাকাবাবু বললেন, ‘ভবেনবাবু, আপনার কুকুরটা আগে বাঁধুন, না-হলে ভালো করে কথা বলা যাবে না। এত দূর থেকে এলাম, বাড়ির মধ্যে বসতে বলবেন না?’
ভবেন বলল, ‘আর তো কোনো কথা নেই। আপনারা কেন এসেছেন জানি না। আমার কাছে মূর্তিটুর্তি নেই।’
সন্তু বলল, ‘আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। এক গেলাস জল পেতে পারি?’
ভবেন বলল, ‘ঠিক আছে। ভেতরে আসুন। আমি ভোলাকে সরাচ্ছি। আয় ভোলা, আয়-আয়-আয়!’
ঘরের ভেতরটা বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার। একটা খাট পাতা। বসবার জন্য রয়েছে কয়েকটি মোড়া। দেওয়ালে ঝুলছে একটি বাঘের ছাল। ভবেন গেরুয়া পরে থাকলেও তার ভাবভঙ্গি মোটেই সাধুর মতো নয়।
কুকুরটাকে অন্য জায়গায় বেঁধে এসে সে সন্তুকে এক গেলাস জল এনে দিল।
সন্তু চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘সেই সাপটাকে দেখার পর থেকেই আমার গলা শুকিয়ে এসেছিল।’
কাকাবাবু বলেন, ‘আপনি তো বেশ নিরিবিলিতে থাকেন, ভবেনবাবু। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অনেকটা আসতে হয়। পায়ে হেঁটে ছাড়া এখানে আসার আর অন্য উপায় নেই, তাই না?’
ভবেন শুকনো গলায় বলল, ‘আগে কাজের কথা হোক। দেখুন মশাই, আমি মূর্তি বিক্রি করি ঠিকই, কিন্তু আমার কাছে দু-শো-পাঁচ-শো টাকার কমদামি জিনিস পাবেন না। সবচেয়ে কম দামেরটা দশ হাজার। আরও দামি আছে, পঞ্চাশ হাজার, দু-লাখ, পাঁচ লাখ। যদি কমদামি জিনিসের খোঁজে এসে থাকেন, তাহলে আমার সময় নষ্ট করে লাভ নেই।’
কাকাবাবু বললেন, ‘সে কী, জিনিস দেখাবার আগেই দামের কথা? আমাদের দেখে বুঝি মনে হয় আমরা সস্তার খদ্দের? আমার একটা তেলের কল আছে, ভগবানের আশীর্বাদে টাকাপয়সার অভাব নেই। ভালো মূর্তি পেলে যত দাম লাগে দেব।’
ভবেন বলল, ‘ক্যাশ টাকা এনেছেন? আমি চেকটেক নিই না।’
কাকাবাবু কোটের পকেটে থাবড়া মেরে বললেন, ‘আছে, টাকাও সঙ্গে আছে। আমিও নগদ কারবারে বিশ্বাস করি।’
সন্তু আবদারের সুরে বলল, ‘আমার একটা সরস্বতীর মূর্তি চাই। আর একটা গণেশ।’
ভবেন এঘর থেকে একটা হ্যাজাক বাতি নিয়ে বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
ঘরের পিছন দিকে একটা চাতাল। তার ওপাশে ভাঙা মন্দির। ওরা এল সেই মন্দিরের মধ্যে। ছাদটা একেবারেই ভেঙে গেছে, সেখানে গজিয়েছে বটগাছের চারা। শিবলিঙ্গটি কিন্তু অক্ষতই রয়েছে। কিছু শুকনো ফুল বেলপাতাও ছড়ানো। মনে হয় মাঝে মাঝে এখনও পুজো হয়।
ভবেন শিবলিঙ্গের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রথমে প্রণাম করল। তারপর সেই শিবলিঙ্গ ধরে খুব জোরে ঠেলা দিতেই সেটা সরে গেল খানিকটা সেখানে দেখা গেল একটা অন্ধকার গর্ত।
সেই গর্তে হাত ঢুকিয়ে ভবেন একটা মূর্তি তুলে আনল।
কাকাবাবু সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। প্রায় এক হাত লম্বা একটা বিষ্ণুমূর্তি কালো পাথরের তৈরি।
ভবেন বলল, ‘এটার বয়েস সাড়ে পাঁচ-শো বছর। দাম পড়বে আঠারো হাজার।’
কাকাবাবু বললেন, ‘বা: বা:, খুব সুন্দর। খুব চমৎকার। দেখি আর কী আছে?’
ভবেন আর একটা মূর্তি তুলল। এটা একটা গণেশ, পাথরের নয়, মনে হয় পেতলের।
ভবেন বলল, ‘এটা পঞ্চ ধাতুর তৈরি বিষ্ণুপুরের গণেশ। তিন-শো বছরের পুরোনো। এটার দাম পড়বে বারো হাজার।’
সন্তু বলল, ‘ওটা আমি নেব। ওটা আমার চাই!’
কাকাবাবু বললেন, ‘নিবি, নিবি, আগে দরদাম ঠিক হোক। আর কী আছে দেখি?’
ভবেন এরপর আরও সাতটা মূর্তি বার করে দেখাল, বেশির ভাগই নারায়ণের, একটা রাধাকৃষ্ণর, একটা দুর্গার।
কাকাবাবু সব ক-টা খুঁটিয়ে দেখে ‘বা: বা:, কী সুন্দর, কী চমৎকার’ বলতে লাগলেন। সব ক-টা দেখা হয়ে গেলে বললেন, ‘আর নেই? মদনমোহনের মূর্তি নেই?’
ভবেন একটা নারায়ণের মূর্তি দেখিয়ে বলল, ‘এইটাই তো মদনমোহন!’
কাকাবাবু বললেন, ‘এটা তো বিষ্ণুপুরের। কুচবিহারের মদনমোহন নেই?’
ভবেন বলল, ‘আমার কাছে আর কিছু নেই।’
কাকাবাবু হতাশভাবে বললেন, ‘যা:, তাহলে কী হবে? এর একটাও যে আমার পছন্দ হল না।’
ভবেন বলল, ‘এতগুলো দেখালাম, একটাও পছন্দ হল না?’
কাকাবাবু দু-দিকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না:, একটাও না, কী করে পছন্দ হবে? গণেশের মূর্তিটা পঞ্চ ধাতুর বললেন, ওটা আসলে পেতলের। পুরোনোও নয়। নকল। পাথরের মূর্তিগুলো বড়োজোর পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরোনো। আর ওই যে বিষ্ণুমূর্তিটা, এটা একেবারে আসল আর পুরোনো, এটা বিষ্ণুপুর মন্দির থেকে চোরাই জিনিস। ওটাও আমার চাই না। কুচবিহারের মদনমোহনের মূর্তিটা পেলে যত দাম লাগে তাতেই রাজি। সেই মূর্তিটা কোথায়?’
ভবেন এবারে চোখ সরু করে কাকাবাবুর দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হিংস্র গলায় বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে ধোঁকাবাজি করতে এসেছ? তুমি পুলিশের লোক।’
কাকাবাবু নিরীহভাবে বললেন, ‘না না, আমি পুলিশের লোক নই। মদনমোহনের মূর্তিটা বার করো, তার জন্য যত টাকা চাও দেব।’
বনমালি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবারে চেঁচিয়ে বলল, ‘ভবেনদা, আমি এখানে আসতে চাইনি! এই লোকটা আমাকে ভয় দেখিয়ে জোর করে এনেছে। বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে আনিনি!’
ভবেন বলল, ‘তুই ওই খোকাটাকে জাপটে ধর তো। আমি এই বুড়োটাকে ধরছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছে!’
বনমালি সন্তুকে দু-হাতে জড়িয়ে চেপে ধরল। কিন্তু সে সন্তুকে চেনে না। সন্তু সঙ্গে সঙ্গে যুযুৎসুর প্যাঁচে তাকে উলটে দিয়ে দড়াম করে ফেলে দিল মাটিতে। দেওয়ালে বনমালির মাথা ঠুকে গেল খুব জোরে। সন্তু দু-হাতের ধুলো ঝেড়ে বলল, ‘একটুও গায়ের জোর নেই!’
ভবেন তার পেছনের দেওয়ালে ঝোলানো একটা মস্তবড়ো খাঁড়া তুলে নিয়ে কাকাবাবুকে বলল, ‘দেব শেষ করে!’
কাকাবাবু বললেন, ‘বা:, খাঁড়াটা তো বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে। দেখি দেখি দাও তো, ওটার কত দাম পড়বে?’
ভবেন বলল, ‘আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসো না। এক কোপে মুন্ডু উড়িয়ে দেব। সঙ্গে টাকাপয়সা কী আছে বার করো তো বুড়ো।’
কাকাবাবু বলেন, ‘আমাকে বুড়ো বুড়ো বলবে না। আমি খোঁড়া হতে পারি, কিন্তু বুড়ো নই। তোমার থেকে আমার গায়ে জোর বেশি। খালি হাতে লড়াই করার সাহস আছে তোমার?’
ভবেন এবার খাঁড়া দিয়ে কাকাবাবুর মাথায় একটা কোপ মারতে যেতেই কাকাবাবু পকেট থেকে রিভলবারটা বার করলেন। বকুনির সুরে বললেন, ‘তুমি এত বোকা কেন, ভবেন? আমাকে মারতে আসছিলে? জানো না। মানুষ খুন করলে ফাঁসি হয়? আমার হাতে এটা কী দেখছ? খাঁড়া দিয়ে কী আর বন্দুক-পিস্তলের সঙ্গে লড়াই করা যায়? খাঁড়াটা নামিয়ে রেখে আমার কথা মন দিয়ে শোনো!’
ভবেন এবার ভয় পেয়ে কাঁচুমাচু করে বলল, ‘পুলিশ?’
কাকাবাবু বললেন, ‘না, আমি পুলিশ নই। খোঁড়া পুলিশ তুমি দেখেছ কখনো? পুলিশ কী কখনো তার ভাইপোকে নিয়ে ঘোরে? মদনমোহনের মূর্তিটা কোথায়? কুচবিহার মন্দির থেকে যেটা চুরি গেছে? বড়ো জাগ্রত দেবতা। সেটা ওই মন্দিরে আবার ফেরত দিতে হবে!’
ভবেন বলল, ‘সে মূর্তি আমার কাছে নেই। সেই মূর্তি সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না!’
কাকাবাবু বললেন, ‘বেশ চোরাই মূর্তির ব্যাবসা ফেঁদে বসেছ, অ্যাঁ? ভাঙা মন্দিরে সাধু সেজে থাকো। পুলিশ এতখানি জঙ্গলের মধ্যে সচরাচর আসে না। এলেও শিবলিঙ্গ সরিয়ে দেখবে না। শিবলিঙ্গের গায়ে হাতই দেবে না। পুলিশও তো ঠাকুর-দেবতাদের ভয় পায়। শোনো, তোমার সামনে দুটো পথ আছে। হয় তোমাকে আমি এখনই পুলিশের কাছে নিয়ে গিয়ে ধরিয়ে দেব। তুমি চোরাই মাল রাখো, আর আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে। দুটোই বড়ো অপরাধ। তবে তুমি যদি কুচবিহারের মদনমোহনের মূর্তিটা আমাকে ফেরত দাও, তাহলে তোমাকে আমি আপাতত ছেড়ে দিতে পারি।’
ভবেন আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘সে মূর্তি আমার কাছে নেই।’
কাকাবাবু বললেন, ‘ফের মিথ্যে কথা?’
ভবেন বলল, ‘আপনার পা ছুঁয়ে বলতে পারি, স্যার। মিথ্যে নয়। আমার কাছে নেই।’
কাকাবাবু বললেন, ‘কার কাছে আছে?’
ভবেন বলল ‘আমি জানি না!’
কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তাহলে চলো থানায়! দশটি বছর জেলের ঘানি ঘোরাবে! ওহে বনমালি, তোমাকেও ছাড়ব না। তুমিও জেল খাটবে!’
বনমালি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আমি কিছু করিনি স্যার! আপনাদের পথ দেখিয়ে এনেছি!’
কাকাবাবু বললেন, ‘তুমি সন্তুকে জাপটে ধরেছিলে। আমাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা কেড়ে নেবার মতলব করেছিলে। এখন চলো—’
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু ভবেনের গালে এত জোরে একটা চড় মারলেন যে সে ঘুরে পড়ে গেল। কাকাবাবু বললেন, ‘আমার দিকে যে অস্ত্র তোলে তাকে আমি নিজের হাতে কিছু শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না। আমাকে বুড়ো বলছিলে, এখন দেখলে আমার হাতের জোর?’
ভবেন গোল গোল চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। সে এত অবাক হয়ে গেছে যে কথাই বলতে পারছে না। একটু পরে ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার, যদি আমি আপনাকে ভগলুর ডেরা চিনিয়ে দিই, তাহলে আমাকে ছেড়ে দেবেন?’
বনমালি ভয় পেয়ে বলে উঠল, ‘ওরে সর্বনাশ!’
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ভগলু বুঝি মদনমোহনের মূর্তি চুরি করেছে?’
ভবেন বলল, সে চুরি করেনি। ভালো ভালো মূর্তি ভগলুর কাছে জমা হয়। সেগুলো সে চোরাপথে বিলেতে পাঠায়। অনেক টাকা দাম পায়। ভগলু অতি সাংঘাতিক লোক, সে যদি টের পায় যে আমরা তার নাম বলে দিয়েছি, তাহলে সে আমাদের খুন করে ফেলবে। তার হাতে অনেক গুণ্ডা আছে। আমি দূর থেকে তার বাড়িটা দেখিয়ে দিতে পারি। তারপর আমি আর সেখানে থাকব না।’
কাকাবাবু হেসে বললেন, ‘তোমায় আমি বিশ্বাস করব কী করে? তুমি দূর থেকে কার-না কার বাড়ি দেখিয়ে সরে পড়বে আর আমি তাই মেনে নেব! তোমার মতন লোকদের তো মিথ্যে কথা বলতে বাধে না। এই সন্তু, ক্যামেরা বার কর।’
সন্তু অমনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট ক্যামেরা বার করে ফটাফট ছবি তুলতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, ‘ভবেন, তোমার আর তোমার এই চোরাই মালের আস্তানার ছবি তোলা রইল আমাদের কাছে। এই ছবি পুলিশের কাছে দিলে ধরা পড়ে যাবেই। বনমালিও পালাতে পারবে না। এবার চলো দেখি, কোথায় থাকে ভগলু!’
সেখান থেকে বেরিয়ে একবারে সামনে সামনে চলল সন্তু। তারপর বনমালি, তারপর ভবেন। কাকাবাবু পেছনে। তিনি রিভলবারটা রেখে দিলেন পকেটে। শুধু একবার বললেন, ‘ভবেন, মাঝপথে পালাবার চেষ্টা করলে কিন্তু তোমার একটা পা জন্মের মতন খোঁড়া হয়ে যাবে। তখন আমায় দোষ দিয়ো না। আমার হাতের টিপ খুব ভালো। এক-একটা গুলিতে তোমার এক-একটা পা খোঁড়া হবে।’
জঙ্গলের বাইরে রয়েছে একটা জিপ গাড়ি। ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়েছিল। সবাই সেই জিপ গাড়িতেই উঠল। সন্তু আর বনমালি পেছনে। ভবেন আর কাকাবাবু সামনে ড্রাইভারের পাশে। ভবেনের নির্দেশে গাড়িটা ছুটে চলল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ভগলুর আসল নাম কী?’
ভবেন বলল, ‘তা তো জানি না স্যার। সবাই ভগলু ভগলু বলেই ডাকে। ওর একটা থালা-বাসনের দোকান আছে। কিন্তু ওর আসল ব্যাবসা মূর্তি পাচার করা।’
‘ও কি নিজের লোক দিয়ে নানান মন্দির থেকে মূর্তি চুরি করিয়ে আনায়?’
‘না, স্যার। এ লাইনে অনেক লোক আছে। কুচবিহারের ওই মদনমোহন মূর্তি প্রথমে চুরি করে বিষ্টু দাস। সে পরের দিনই পাঁচ হাজার টাকায় সেটা বিক্রি করে দেয় শিলিগুড়ির অজিত সিংকে। অজিত সিং সেটা পনেরো হাজার টাকায় বিক্রি করেছে শেঠ সুরজমলকে।’
পেছন থেকে সন্তু জিজ্ঞেস করল, ‘প্রথম চোরটার নাম বিষ্টু দাস। সে কাকে বিক্রি করেছিল?’
সন্তু একটা ছোট খাতা খুলে নামগুলো লিখে নিচ্ছে।
ভবেন বলল, ‘শেঠ সুরজমল মূর্তিটা আমার কাছে এনেছিল। কিন্তু দাম চাইল পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। অত টাকা আমি দিতে পারিনি। তাই ভগলু নিয়ে নিয়েছে। ও বিলেত আমেরিকায় পাঠিয়ে লাখ-লাখ টাকা রোজগার করবে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘হুঁ, একেই বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। তোমরা সবাই সবাইকে চেনো!’
প্রায় এক ঘণ্টা গাড়িটা চলার পর সে থামল শ্রীপুর নামে একটা ছোট্ট শহরে। রেল- স্টেশনের পাশেই বাজার আর কিছু দোকানপাট ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। বেশ রাত হয়ে গেছে, তবু কয়েকটা দোকান খোলা আছে। একটা থালা-বাসনের দোকানের পাশ দিয়ে যখন জিপ গাড়িটা আস্তে আস্তে যাচ্ছে, তখন ভবেন বলল, ‘ওই দেখুন স্যার, কাউন্টারে ভগলু বসে আছে। খুব বড়ো গোঁফ।’
ভগলুর চেহারাটা দেখবার মতন। মাথায় একটা ও চুল নেই, চকচকে টাক। কিন্তু নাকের নীচে শেয়ালের লেজের মতন মোটা গোঁফ। মুখখানা গোল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। দোকানে আরও তিন-চারজন লোক রয়েছে, মনে হয় তারা খদ্দের নয়, ভগলুরই দলের লোক।
গাড়িটা বাজার পেরিয়ে যাওয়ার পর দু-খানি পাকা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। ভবেন বলল, ‘এই প্রথম বাড়িটা ভাগলুর, আর দ্বিতীয়টা ওর ভাইয়ের। দুটোই ভগলুর বাড়ি বলতে পারেন।’
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘চোরাই মূর্তিগুলো ও কোথায় রাখে?’
ভবেন বলল, ‘তা আমি বলতে পারব না স্যার। তবে আপনাকে আমি আর একটা খবর দিচ্ছি। কাছেই বাংলাদেশের বর্ডার। প্রত্যেক শনিবার সেখানে একটা বড়ো হাট হয়। সেই হাটের দিনে লোকজনের ভিড়ের মধ্যে ভগলু ভালো ভালো মূর্তি বাংলাদেশে পাচার করে দেয়। ওখান থেকেও কিছু জিনিস এদিকে আসে। এই শনিবার যদি নজর রাখেন, তাহলে মূর্তিটা হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারেন।’
কাকাবাবু বললেন, ‘মূর্তিটা এর মধ্যেই যদি পাচার করে দিয়ে থাকে?’
ভবেন বলল, ‘না, দেয়নি। আমাদের কানে তো সব খবর আসে। আরও বেশি দাম বাড়াবার জন্য ভগলু এখন সেটা আটকে রেখেছে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘হুঁ! ঠিক আছে, দেখা যাক! এখানে কোনো হোটেল আছে? রাতটা কাটাতে হবে তো!’
ভবেন বলল, ‘একটা ছোটো হোটেল আছে। কিন্তু সেখানে কি আপনারা থাকতে পারবেন? হাট-বাজারের লোকেরা এসে থাকে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘খুব থাকতে পারব। একটা ঘর পেলেই হল।’
ভবেন এবার হাত জোড় করে বলল, ‘আপনার কাছে দয়া চাইছি স্যার, এবার আমাকে ছেড়ে দিন। ভগলুর লোকজন আমাকে চিনতে পারবে, এখানে দেখলেই সন্দেহ করবে। যখন তখন খুন করতেও ওদের আটকায় না।’
বনমালি কাকুতি-মিনতি করে বললে, ‘আমাকেও মুক্তি দিন স্যার। নইলে ভগলু মেরে ফেলবে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে, ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু তোমাদেরও এই চোরাই মূর্তির কারবার ছাড়তে হবে। তিন-মাস পরে এসে আমি আবার খোঁজ নেব। তখনও যদি দেখি, তোমরা একই রকম চালিয়ে যাচ্ছ, তাহলে তোমাদের ছবি দিয়ে দেব পুলিশকে। এখন যাও, ভাগো!’
ভবেন আর বনমালি লাফিয়ে জিপ থেকে নেমে দৌড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে!
হোটেলটা খুবই সাধারণ, কিন্তু সেটার নাম তাজমহল হোটেল। ঘরভাড়া সতেরো টাকা। ভাত-ডাল, বেগুনভাজা আর বাটামাছের ঝোল ন-টাকা। সেই খাবারই খেতে বসে কাকাবাবু ম্যানেজারের সঙ্গে ভাব জমালেন। তিনি বললেন যে সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করে তিনি নিরিবিলিতে থাকতে চান। এই শ্রীপুরে তিনি জমি খুঁজতে এসেছেন। পছন্দ হলে এখানেই বাড়ি বানিয়ে এসে থাকবেন।
রাত্তিরে আর কিছু করার নেই, দোতলার ঘরটিতে এসে ওরা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।
সন্তু বলল, ‘কাকাবাবু, এখানকার থানায় তো কোনো খবর দেওয়া হল না? ভগলুর তো অনেক লোকজন। পুলিশের সাহায্য নিতে হবে নিশ্চয়ই।’
কাকাবাবু বললেন, ‘এখনই থানায় যাব না। কেন জানিস? থানাতেও নিশ্চয়ই ভগলুর লোক আছে। ছোটো জায়গায় সব জানাজানি হয়ে যায়। আমরা থানায় গেলেই লোকে আমাদের সন্দেহ করবে। ভগলুও খবর পেয়ে সাবধান হয়ে যাবে। আগে দেখা যাক না আমরা নিজেরা কী করতে পারি।’
সন্তু বলল, ‘কাকাবাবু, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কথাটা কাল থেকে আমার মনের মধ্যে খচখচ করছে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘কী কথা, বলে ফ্যাল।’
সন্তু বলল, ‘ছোটোবেলায় একবার মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে শিবঠাকুরের একটা মন্দির ছিল। একদিন মন্দিরের মধ্যে প্রসাদ নিতে গেছি, পুরুতমশাই বললেন, এই দেখো দেখো, যেন মূর্তি ছুঁয়ে দিয়ো না। ঠাকুরের মূর্তি ছুঁলে পাপ হয়।’
কাকাবাবু বললেন, ‘হুঁ, সেই কথাই তো সবাই বলে।’
সন্তু জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে এই যে লোকগুলো মূর্তি চুরি করছে, ওরাও তো ছুঁচ্ছে। ওদের পাপ হচ্ছে না?’
কাকাবাবু হেসে বললেন, ‘পাপ হওয়া তো মনের ব্যাপার। এইসব চোর-ডাকাতগুলোর কী আর সেরকম মন আছে? ওরা পাপ-পুণ্য মানে না। চুরি করা, মানুষ খুন করাও তো মহাপাপ। চোর-ডাকাতরা সে কথাও ভাবে না।’
সন্তু বলল, ‘আর একটা কথা। অনেক ঠাকুরই তো শুনেছি খুব জাগ্রত। এই যে চোর-ডাকাতরা ঠাকুরের মূর্তি চুরি করছে, যেখানে-সেখানে ফেলে রাখছে, জাগ্রত ঠাকুর নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না? ঠাকুর নিজেই চোরদের শাস্তি দিতে পারেন না?’
কাকাবাবু বললেন, ‘এটাও মনের ব্যাপার, বিশ্বাসের ব্যাপার! এইসব পাথরের বা কাঠের বা মাটির মূর্তি তো শিল্পীরা বানায়। যেমন সুন্দর সুন্দর পুতুল হয়। তারপর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার পর আমরা সেগুলোকে ঠাকুর মনে করি। শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, গণেশ এঁদের সকলেরই গল্প আমরা জানি। তাই মূর্তিগুলো দেখলেই আমাদের সেইসব মনে পড়ে। কিন্তু যারা ওসব কাহিনি জানে না? যেমন ধর, কোনো বিদেশি এসে যদি এই রকম মূর্তি দেখে, তার কাছে পুতুলই মনে হবে। আর আমাদের মধ্যেও যারা পূজা করে, তারা কেউ শুধু নিয়মরক্ষার জন্য মাথা ঠুকে প্রণাম করে যায়। কেউ বেশি ভক্তি নিয়ে পুজো করে। কেউ ভয়ে ভয়ে পুজো করে। যার যেমন বিশ্বাস। যার বেশি বিশ্বাস, সে মনে করে এই দেবতার মূর্তি মানুষের উপকার করতে পারে, অসুখ সারিয়ে দিতে পারে। ঠাকুরের পুজো ঠিকমতন না করলে মহাবিপদ হতে পারে। সবই বিশ্বাসের ব্যাপার। আসলে কিন্তু মানুষের উপকার করা কিংবা ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতাই কোনো মূর্তির থাকে না। নিজেকেই বাঁচাতে পারে না। চোর-ডাকাতদের ভক্তিও নেই, বিশ্বাসও নেই, তাই মূর্তিগুলোকে মনে করে পুতুল।’
সন্তু বলল, ‘শুনেছি, অনেক চোর-ডাকাতও পুজো করে?’
কাকাবাবু বললেন, ‘সেটাও একটা মজার ব্যাপার। আগেকার ডাকাতরা কালীপুজো করে তবে বেরুত। ডাকাতি করতে গিয়ে মানুষ খুন করত। যারা মানুষ মারে, অন্যের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়, কোনো দেবতা কী তাদের সমর্থন করতে পারেন? আজকালও দেখবি, যারা খাদ্যে ভেজাল দেয়, জোচ্চুরি করে, গরিবদের ঠকায়, তারাই আবার বড়ো বড়ো মন্দির বানায়, ঢাকঢোল বাজিয়ে পুজো দেয়। এ সবই মিথ্যে! মানুষকে ভালোবাসাই সবচেয়ে বড়ো পুণ্যের কাজ।’
পরদিন সকালে উঠে কাকাবাবু আর সন্তু হোটেলের একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে বেরুল। ছেলেটির নাম পরান। সে-ই সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিল যে এই খোঁড়াবাবুটি এখানে জমি খুঁজতে এসেছেন। জমি দেখার নাম করে পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখা হল।
শ্রীপুর জয়াগাটা বেশ ছিমছাম, সুন্দর। একটা পাতলা মতন নদীও আছে। পাতলা হলেও নদীটির বেশ তেজ, বেশ স্রোত আছে। খানিকদূরে একটা বড়ো নদীর সঙ্গে মিশেছে। ভগলুর বাড়ি এই নদীর ধারেই। বাড়ির পেছন দিকে একটা ঘর রয়েছে, সেটা একেবারে নদীর ওপরেই বলা যায়।
পরানের কাছ থেকে ভগলু সম্পর্কেও কিছু খবর পাওয়া গেল। তাকে এখানে সবাই ভয় পায়। সে স্থানীয় লোক নয়, বাইরের কোনো জায়গা থেকে এখানে এসে ব্যাবসা শুরু করেছে। একটা থালা-বাসনের দোকান করেই কী করে সে বড়োলোক হয়ে গেল, তা কেউ জানে না। চার-পাঁচজন গুণ্ডা মতন লোক সবসময় থাকে তার পাশে। থানার লোকজনের সঙ্গে তার ভাব আছে, পুলিশরা প্রায়ই তার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে যায়।
ভগলু নিজেও নাকি দারুণ পেটুক। সে একাই দুটো মুরগি খেয়ে ফেলতে পারে। দু-কিলো পাঁঠার মাংস খায়। গোটা একটা রুই মাছ না-হলে তার চলে না। দুপুরবেলা প্রায় রোজই সে একা একা নদীর ধারে ছোটো ঘরটায় বসে খায়। খাবার সময় অন্য লোক কাছে থাকা সে পছন্দ করে না। রাত্তিরে সে ওই ছোটো ঘরটাতে থাকে। সকালে নদীতে স্নান সেরে পুজো করে। পুজোর সময় সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মন্ত্র পড়ে, গান গায়। তারপর ওই ঘরেই তাকে খাবার দেওয়া হয়। প্রচুর খেয়ে, খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে তারপর বিকেলের দিকে সে দোকানে এসে বসে।
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে সব দেখে-বুঝে নিলেন কাকাবাবু। ভগলুর ধারেকাছেও গেলেন না।
রাত্তিরবেলা শুয়ে শুয়ে সন্তুকে বললেন, ‘একটা সমস্যা আছে রে, সন্তু। মদনমোহনের মূর্তিটা কোথায় লুকোনো আছে, সেটা খুঁজে বার করব কী করে?’
সন্তু বলল, ‘ওই নদীর ধারের ছোটো ঘরটায় ভগলু ঘুমোয় রাত্তিরে। মনে হয়, ওখানেই কোথাও আছে। অত দামি জিনিস নিশ্চয়ই সে চোখে চোখে রাখবে!’
কাকাবাবু বললেন, ‘অবশ্য ঠিক। ছোটো ঘরটা একবার ভেতরে ঢুকে দেখা দরকার। কিন্তু মাটির তলায় রেখেছে না কোথায় রেখেছে তা দেখতে অনেকটা সময় লাগবে। রাত্তিরে নিশ্চয়ই ওখানে কেউ পাহারা দেয়।’
সন্তু বলল, ‘একটা কাজ করব। সকালবেলা যখন ভগলু নদীতে স্নান করতে যায়, তখন এক ফাঁকে আমি ওই ঘরে ঢুকে পড়ব? তারপর দুপুরবেলা ও বেরিয়ে গেলে খুঁজে দেখব ঘরটা।’
কাকাবাবু বললেন, ‘খাটের নীচে কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবি? একটু নড়াচড়া করলে, কিংবা তোর যদি হাঁচি পেয়ে যায় হঠাৎ? গলা খুসখুস করে যদি? তাহলেই ধরা পড়ে যাবি। ভগলুর কীরকম গাঁটাগোট্টা চেহারা দেখেছিস তো!’
সন্তু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘ধরা পড়ব না আমি। ধরা পড়লেও ও আমাকে ধরে রাখতে পারবে না।’
কাকাবাবু বললেন, ‘উঁহু, তা হয় না। এতে ঝুঁকি খুব বেশি। অন্য কোনো উপায় ভেবে দেখতে হবে। এখন ঘুমো।’
ভোরবেলা কীসের যেন শব্দে কাকাবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চোখ মেলে দেখলেন, সন্তু জামা-প্যান্ট পরে বাইরে বেরুবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে প্রায়।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ‘এ কী সন্তু, কোথায় যাচ্ছিস?’
সন্তু বলল, ‘তুমি কিছু চিন্তা কোরো না, কাকাবাবু। আমি ভগুলর ওপর নজর রাখতে যাচ্ছি। নদীর ধারে বসে থাকব!’
কাকাবাবু বললেন, ‘তুই তো শুধু বসে থাকার ছেলে না! ভগলুর ঘরে ঢোকার চেষ্টা করবি ঠিক। ভগলু দুপুরের আগে ও-ঘর থেকে বেরোয় না। পুজো করে অনেকক্ষণ ধরে খাবার খায়। তুই এত সকাল সকাল গিয়ে কোথায় বসে থাকবি?’
সন্তু বলল, ‘আমার আর শুয়ে থাকতে একদম ইচ্ছে করছে না। আমি কাল একবার ও-ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি। পাশে একটা ভাঁড়ার মতন ছোট্ট ঘর আছে। যদি ভেতরে ঢুকতে পারি, তাহলে ওই ঘরটাতে থাকবার চেষ্টা করব। ভগলু বেরিয়ে যাবার পর খোঁজাখুজি শুরু করব।’
কাকাবাবু বললেন, ‘তখন নিশ্চয়ই বাইরে পাহারা থাকবে। ঠিক আছে, তুই যখন জেদ ধরেছিস, আমার রিভলবারটা নিয়ে যা। কারুকে মারবি না, শুধু আত্মরক্ষার দরকার হলে ভয় দেখাবি।’
রিভলবারটা পেয়ে সন্তু খুশিতে ছটফট করতে লাগল। কাকাবাবু সহজে সন্তুকে রিভলবারে হাত দিতে দেন না। সে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না, আমি বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসছি। তুমি ঠিক খবর পেয়ে যাবে।’
কাকাবাবু বললেন, ‘শোন, তুই মদনমোহনের মূর্তিটার সন্ধান পেয়ে গেলেও নিয়ে আসার চেষ্টা করিস না। চোরের ওপর বাটপাড়ি করা ঠিক নয়। ভগলুকে হাতে হাতে ধরতে হবে!’
সন্তু প্রায় ছুটে বেরিয়ে চলে গেল।
কাকাবাবু বিছনায় শুয়েই রইলেন। খানিক পরে একজন চা নিয়ে এল। কাকাবাবু চা খেতে খেতে একটা বই পড়তে লাগলেন।
বেলা গড়িয়ে গেল। এগারোটা বেজে যাওয়ার পর আর ঘরের মধ্যে থাকতে তাঁর ইচ্ছে হল না। বেরিয়ে এলেন হোটেল থেকে। প্রথমে ভাবলেন, জিপ গাড়িটা নিয়েই বেরোবেন। তারপর ঠিক করলেন, হেঁটেই যাবেন। আকাশ মেঘলা আজ, রোদ নেই, গরম নেই, হাঁটতে ভালোই লাগবে।
একটা চিঠি লিখে গাড়ির ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিলেন থানায়। তিনি যে এখানে এসেছেন তা পুলিশকে জানিয়ে রাখা দরকার। কীজন্য এসেছেন তা জানাবার দরকার নেই।
হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে এলেন নদীর ধারে। এইটুকু নদী কিন্তু হেঁটে পার হওয়া যায় না। এক জায়গায় খেয়া পারের ব্যবস্থা আছে। অবশ্য এখন লোকজন বিশেষ নেই।
ভগলুর বাড়ির পেছনে বাগান। তারপর একেবারে শেষের দিকে নদীর ধার ঘেঁষে একখানা ঘর। ঠিক ঘর নয়, সেটা একটা ছোটো বাড়ির মতন। ঘরের সঙ্গে বাথরুম আর একটা ছোটো ঘর, বারান্দাও রয়েছে।
সন্তুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সেই ভোর থেকে সে কোথায় রয়েছে? ভগলুর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে নাকি?
কাছাকাছি গিয়ে শুনলেন, একজন লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যেন বলছে। একঘেয়ে সুর। এই কী ভগলুর পুজো নাকি? কোন দেবতা পুজো করে ভগলু? এরা বিচিত্র লোক। রোজ সকালে ভক্তিভরে পুজো করে নানান ঠাকুরদেবতার মূর্তির ব্যাবসা করে।
সন্তু নিশ্চয়ই ধরা পড়েনি। তাহলে ভগলু এমন নিশ্চিন্তে পুজো করতে পারত না। সন্তুকে ধরে ফেললে ভগলু নিশ্চয়ই খোঁজখবর করত। সন্তুর সঙ্গে কে আছে সে সন্ধানও পেয়ে যেত।
আরও কিছুক্ষণ পর একজন লোক কয়েকটা খাবারের পাত্র নিয়ে ঢুকল ভগলুর ঘরে। কাকাবাবু ভাবলেন, সন্তু সকাল থেকে কিছু খায়নি বোধ হয়। বিকেল পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে?
সেই লোকটি বেরিয়ে এসে ভেতরের বাড়ি থেকে আবার দু-তিনটে ডেকচি ভরতি কীসব নিয়ে ফিরে এল। এইরকম আরও একবার। খাবার আসছে তো আসছেই।
কাকাবাবু একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। এত খাবার ভগলুর জন্য? একটা লোক কত খেতে পারে?
হঠাৎ তাঁর মাথার মধ্যে একটা ঝিলিক খেলে গেল।
সেই লোকটা যখন আর একবার কয়েকটা খাবারের ডেকচি নিয়ে ফিরে আসছে, কাকাবাবু তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। লোকটির পিঠে তাঁর একটা ক্রাচ ঠেকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এটা বন্দুকের নল। চেঁচালেই প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। যেমন যাচ্ছ, তেমনই যাও।’
লোকটা কাঠের পুতুলের মতন এক পা এক পা করে হেঁটে ঘরে ঢুকল।
কাকাবাবু ভেবেছিলেন, তিনি ঘরের মধ্যে আরও দু-তিন জনকে দেখতে পাবেন। কিন্তু ঘরে ভগলু ছাড়া আর কেউ নেই। টেবিলের ওপর মস্ত বড়ো একটা থালা, ভগলু একা একা বসে খাচ্ছে। ঠিক যেন একটা রাক্ষস। তার থালার পাশে মাছের কাঁটা আর মাংসের হাড়ের পাহাড় জমে আছে। সে একটা মস্ত বড়ো মাছের মুড়ো ধরে চিবুচ্ছে। ঝোল গড়াচ্ছে মুখের দু-পাশ দিয়ে। সে বোধ হয় দু-হাত দিয়ে খায়। দু-হাতেই লেগে আছে ঝোল।
কাকাবাবুকে দেখে সে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এ কে? এই মংলু, এ কাকে নিয়ে এলি?’
মংলু নামে সেই লোকটি বলল, ‘কী জানি। আমার পিঠে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রেখেছে।’
ভগলু দেখতে পাচ্ছে কাকাবাবুর হাতে বন্দুক-টন্দুক কিছু নেই। সে গর্জন করে বলে উঠল ‘হাঁদারাম। পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে দেখতে পারলি না? ধর ওই লোকটাকে।’
মংলুও বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা জোয়ান। সে ডেকচি দুটো টেবিলের ওপর রেখেই ঘুরে দাঁড়াল।
কাকাবাবু একটা ক্রাচ তুলে বললেন, ‘মারামারি করার দরকার নেই। আগে আমার কথা শোনো। ভগলু, তুমি কুচবিহারের মদনমোহন মূর্তিটা রেখে দিয়েছ কেন? এই নিয়ে যে কুচবিহারে দাঙ্গা বাধার উপক্রম। তুমি নিজে একজন ভক্ত হয়ে ঠাকুরদেবতার মূর্তির ব্যাবসা কর? ছি:! ওটা ফেরত দিয়ে দাও!’
ভগলু বলল, ‘কে বললো, ঐ মূর্তি আমার কাছে আছে?’
কাকাবাবু বললেন, ‘আমি ঠিক খবর নিয়েই এসেছি। মূর্তিটা আমায় দিয়ে দাও!’
ভগলু বলল, ‘এই মংলু, লোকটাকে ধরতে পারছিস না?’
সেই মুহূর্তে আর একটা লোক ঢুকল ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে সে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল কাকাবাবুকে। মংলুও ঝাঁপিয়ে পড়ে কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো কেড়ে নিল।
ভগলু খুশি হয়ে বলল, ‘বা-বা-বা-বা! বেচু-তুই ঠিক সময়ে এসে পড়েছিস! লোকটাকে বাঁধ। পকেটে দেখ বন্দুক-পিস্তল কিছু আছে কিনা!’
কাকাবাবু দু-হাত তুলে বললেন, ‘বাঁধতে হবে না। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। ভগলু, তুমি খাওয়া শেষ করে নাও। এই তোমার শেষ মাছের মুড়ো খাওয়া। এরপর তোমায় দশ বছর জেলে থাকতে হবে!’
ভগলু বলল, ‘তুমি একটা খোঁড়া, আমাকে জেলে পাঠাবে; হা-হা-হা-হা!’
কাকাবাবু বললেন, ‘কানাকে কানা বলতে নেই, খোড়াকে খোঁড়া বলতে নেই জানো না! জেলে তোমায় যেতেই হবে। তুমি কী ভাবছ, আমি একা তোমার এই বাঘের গুহায় ঢুকেছি? পুলিশ তোমার বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। এখানকার পুলিশ নয়, কলকাতার পুলিশ। দশখানা রাইফেল আছে। তোমার বাড়ির সব খুঁজে তারপর এই ঘরে আসবে। শুধু মদনমোহনের মূর্তিটা পেলেই তোমায় অন্তত দশ বছর জেলে থাকতে হবে!’
ভগলু উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘মদনমোহনের মূর্তি আমি নদীতে ফেলে দেব। কেউ খুঁজে পাবে না। তারপর আমায় কে ধরবে? কোনো প্রমাণ থাকবে না!’
একদিকের দেওয়ালে একটা বড়ো কুলুঙ্গি। তাতে এক জোড়া খুব ছোটো রাধাকৃষ্ণ মূর্তি। আর প্রচুর ফুল। ভগলু এই মূর্তির পুজো করে মনে হল।
সেই কুলঙ্গির ঠিক নীচে ধাক্কা দিতেই দেওয়ালের খানিকটা অংশ সরে গেল। ভগলু তার মধ্যে হাত গলিয়ে বার করে আনল একটা কালো পাথরের মূর্তি।, সেটা সে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য ছুটে গেল জানালার দিকে।
কাকাবাবু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘ভগলু, ভগলু, তুমি এঁটো হাতে ওই মূর্তি ধরলে। জাগ্রত ঠাকুর। জানো না, অপবিত্র হাতে ছুঁলে সেই হাতে কুষ্ঠ হয়।’
ভগলু বলে উঠল, ‘অ্যাঁ?’
সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে সেই মূর্তিটা খসে পড়ে গেল মাটিতে।
আর ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গেই একটা গুলির শব্দ হল। পাশের ঘরের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল সন্তু, তার হাতে রিভলবার। সিনেমার নায়কের কায়দায় সে রিভলবারের নলে ফুঁ দিতে দিতে বলল, ‘প্রথমবার কারুকে মারিনি। শুধু ভয় দেখিয়েছি। এরপর কেউ নড়লেই তার মাথায় গুলি করব!’
কাকাবাবু এগিয়ে মূর্তিটা তুলে নিলেন। টেবিলের ওপর থেকে জলের গেলাস নিয়ে এঁটো জায়গাটা ধুলেন ভালো করে। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছে নিয়ে বললেন, ‘বা:, এবারে ঠিক আছে। ভগলু, এবার বেরিয়ে পড়ো। সন্তুকে সাবধান। ও কিন্তু খুব ভালো গুলি চালাতে পারে।’
রাস্তার লোকেরা অবাক হয়ে দেখল, সন্তুর মতন একটা বাচ্চা ছেলের হাতে রিভলবার, আর তার সামনে সামনে মাথার ওপর হাত তুলে চলেছে ভগলু আর তার দুই চ্যালা। একটু পেছনে ক্রাচে ভর দিয়ে একজন প্রৌঢ় মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেল থানায়।
কাকাবাবুর জিপটা চলে এল খবর পেয়ে। খানিক বাদে থানা থেকে বেরিয়ে সেই জিপে উঠতে উঠতে কাকাবাবু বললেন, ‘যখন দেখলাম, অত খাবার যাচ্ছে ভগলুর ঘরে, তখন মনে হল, নিশ্চয়ই ওখানে আরও দু-তিনজন লোক আছে। অত খাবার কী একজন মানুষ খেতে পারে? তাহলে তুই নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছিস। তোকে আটকে রেখে ভগলু তার সঙ্গীদের নিয়ে কিছু পরামর্শ করছে খেতে খেতে।’
সন্তু বলল, ‘আমি তো ভোর থেকে ওর পাশের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে বসে আছি। ভগলু টেরও পায়নি। কিন্তু মূর্তিটা কোথায় রেখেছে বুঝতে পারিনি। অন্য একটা মূর্তির পুজো করছিল!’
কাকাবাবু বললেন, ‘পুলিশের কথা বলতেই কাজ হল। কিন্তু মূর্তিটা জলে ফেলে দিলে মুশকিল হত। তবে, হাতে কুষ্ঠ হবে বলামাত্র কীরকম ভয় পেয়ে গেল দেখলি!’
সন্তু বললো, ‘এরা ঠাকুরের মূর্তি ভয় পায়, আবার বিক্রিও করে।’
কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘সেই তো! কী বিচিত্র মানুষ এরা সব! ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস আছে। আবার টাকার লোভে সেই বিশ্বাসও চাপা পড়ে যায়!’
দুজনেই হাসতে লাগল প্রাণভরে।