কাকতাড়ুয়া বৃত্তান্ত
কর্নেলের জীবনে এ যাবৎ কালের একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি, মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে একটি জটিল রহস্য ফাঁস। বলছি এক ঘন্টা। এটা নেহাত কথার কথা। কারণ সেই সময় আমি ঘড়ি দেখিনি। তবে আমার স্মৃতিতে একঘন্টা শব্দটা কেন কে জানে মাপজোক হয়ে থেকে গিয়েছে।
কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, সেই জটিল রহস্যটা একটা সাংঘতিক খুনখারাপির। পুলিশ খবর পেয়ে দ্রুত অকুস্থলে গিয়েছিল। লালবাজারের বাঘা গোয়েন্দারা গিয়ে তাদের পেশাগত দক্ষতার চূড়ান্ত প্রয়োগ করেছিলেন। একজনকে পাকড়াও করে শিগগির চার্জশিট তৈরিতেও তারা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। অথচ কর্নেল গিয়ে সবাইকে অবাক করে প্রকৃত খুনীকে শনাক্ত করার পর দেখা যায়, ধৃত লোকটি। খুনী নয়। নিতান্ত নিরীহ এক গোবেচারা এবং নির্বোধও বটে।
কর্নেলের টুপিতে গোঁজা এই উজ্জ্বল পালকটি সম্পর্কে এতকাল আমাকে নীরব থাকতে হয়েছিল। সেটা কর্নেলেরই নির্দেশে। আজ বিকেলে আমাকে অবাক করে তিনি টেলিফোনে বললেন–বৈজয়ন্তী ভিলার ঘটনাটা এবার সাতকাহন করে। লিখে তোমাদের কাগজে ছাপতে পারো জয়ন্ত!
উত্তেজিতভাবে বললুম–সে কী! ওটা তো বাসি ঘটনা!
-রহস্য কখনও বাসি হয় না। শুধু চাই কলমের জোর।
–ঠিক আছে। কিন্তু তিন বছর পরে হঠাৎ আজ আপনার মত বদলাল কেন?
–আজ দুপুরে ওই এলাকায় একটা কাজে গিয়ে চোখে পড়ল, বিশাল বাড়িটা কোনো প্রমোটারের লোকেরা ভেঙে ফেলছে। যাই হোক, আর কথা নয়। রাখছি।….
রিসিভার রাখার পর উত্তেজনা মিইয়ে গেল। তারপর চোখে ভেসে উঠল ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেস এলাকার একটা বিশাল বনেদি বাড়ি। সামনে সুদৃশ্য লন। গাড়িবারান্দা। প্রায় দুএকর জমির দক্ষিণাংশে বৈজয়ন্তী ভিলা নামে বাড়িটার পশ্চিমে একতলা কয়েকটা ঘর এবং টানা বারান্দা। ঘরগুলিতে ঠাকুর-চাকর দারোয়ান-ড্রাইভার-মালী এইসব মানুষের বাস। পূর্বে ফুলবাগিচা আর দেশি বিদেশি বিচিত্র উদ্ভিদ। উত্তরে সুইমিং পুল। তার পাশে টেনিস লেন। টেনিস বল যাতে জলে না পড়ে, সেইজন্য সুইমিং পুলের কিনারা ঘেঁষে টেনে বাঁধা লম্বাটে তেরপল। সাত-আট ফুট উঁচু।
হ্যাঁ। তিন বছর আগে মার্চের এক রবিবারে কর্নেলের সঙ্গে বৈজয়ন্তী ভিলায় গিয়ে ওইরকম টেনে বাঁধা তেরপলের পর্দাটা দেখেছিলুম।
কিন্তু কাহিনীটা গোড়া থেকেই শুরু করা উচিত।
আগেই বলেছি, মার্চ মাসে এক রবিবার সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে যথারীতি আড্ডা দিতে গিয়েছিলুম। ছাদের বাগান পরিচর্যা করে এসে কর্নেল তাঁর জাদুঘর সদৃশ ড্রয়িংরুমে সবে কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়েছেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল বললেন–ফোনটা ধরো জয়ন্ত।
রিসিভার তুলে সাড়া দিলুম। কেউ ভারিক্তি গলায় বলল-কর্নেল সায়েবের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওঁকে দিন।
বুঝতে পারলুম যিনি ফোন করছেন, কর্নেলের কণ্ঠস্বর তার খুব পরিচিত। তবু একটু মজা করার জন্য পাল্টা উঁট দেখিয়ে বললুম–আপনি কোত্থেকে বলছেন? নামটা বলুন।
ভদ্রলোক খাপ্পা হয়ে বললেন–ধুর মশাই! এই সাংঘাতিক ঘটনার সময় কোত্থেকে, নামটা বলুন? কে আপনি? শিগগির কর্নেল সায়েবকে দিন! হাতে সময় কম। পুলিশ এসে গিয়েছে! যা ভেবেছিলুম, তাই হলো।
–কী আশ্চর্য! পুলিশ এসেছে কেন? কী ভেবেছিলেন আপনি?
—মোলোচ্ছাই। কর্নেল সায়েবকে দিন।
কর্নেল আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন–গুড মর্নিং মিঃ সান্যাল! জয়ন্তকে আপনি তো চেনেন। ভেঁপো ছোকরা। তো পুলিশ এসেছে এবং আপনি যা ভেবেছিলেন তাই ঘটেছে। তার মানে, অবনীবাবুর সত্যি কোনো বিপদ ঘটেছে। এই তো?…..সর্বনাশ! বলেন কী?…
এরপর কর্নেল ক্রমাগত হু হু করতে থাকলেন। তারপর একসময় রিসিভার নামিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে বললেন–ভবানীপ্রসাদ সান্যালের সঙ্গে তোমার রসিকতা করা ঠিক হয়নি জয়ন্ত!
একটু চমক খেয়ে বললুম–বি পি সান্যাল? মানে–সেই রিটায়ার্ড জজসায়েব?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–এক মিনিট। তৈরি হয়ে আসি। এখনই দুজনে বেরুব।
কিছুক্ষণ পরে নিচের লনে নেমে পার্কিং জোন থেকে আমার গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে নিয়ে এলুম। কর্নেল আমার বাঁপাশে তার প্রকাণ্ড শরীর গলিয়ে বসলেন। বললুম–জজসায়েব আমাকে জেলে ঢোকাবেন না তো? রসিকতা করে বিপদ বাধিয়েছি।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–সোজা ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেসে চলো। তারপর আমি রাস্তাটা দেখিয়ে দেবো।
ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেসে পৌঁছে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।
রাস্তাটা তত চওড়া নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক নির্জন। দুধারে বনেদি বিত্তবানদের বাড়ি। দুধারে ঘন গাছ। কয়েকমিনিট এগিয়ে দেখলুম, একটা পুলিশভ্যান আর লাল জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলের নির্দেশে একটা এগিয়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালুম। কর্নেল গাড়ি থেকে নামলেন। দেখলুম, রিটায়ার্ড জজসায়েবের হাতে ছড়ি এবং মুখে পাইপ তিনি তাঁর বাড়ির গেটেই যে দাঁড়িয়ে আছেন, তা বোঝা গেল গেটের গায়ে বসানো মার্বেল প্লেটে তাঁর নাম খোদাই দেখে।
দুজনের মধ্যে চাপা স্বরে কিছু কথা হলো। তারপর মিঃ সান্যাল তার বাড়িতে ঢুকে গেলেন। কর্নেল এসে ডাকলেন–জয়ন্ত! গাড়িতে চাবি এঁটে চলে এসো।
কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। পুলিশের জিপ থেকে একজন অফিসার ততক্ষণে বেরিয়ে এসে পাশের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে করজোড়ে নমস্কার করে সহাস্যে বললেন–এই কেসে আপনি ইন্টারেস্টেড তা ভাবতে পারিনি স্যার!
–প্রবীর! অবনী বসুরায় আমার চেনা মানুষ ছিলেন।
–আই সি!
বডি কি মর্গে পাঠানো হয়েছে?
–দুঘন্টা আগে। ভোর ছটায় আমরা খবর পেয়েছিলুম।
–তোমাদের ও. সি. সায়েব কোথায়?
–বাড়ির ভিতরে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে আছেন। এখনও জেরা চলছে। ডি. সি. ডি. ডি. লাহিড়িসায়েব এই কেসে ইন্টারেস্টেড।
–বাঃ! কাকেও অ্যারেস্ট করা হয়েছে?
–হ্যাঁ স্যার। ফটিক নামে একজন ইয়ং সারভ্যান্টকে কাস্টডিতে পাঠানো হয়েছে।
প্রবীরবাবুর নির্দেশে দারোয়ান গেট খুলে দিল। লনে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কর্নেলকে দেখে তিনি নমস্কার করে সহাস্যে বললেন–কী আশ্চর্য!
-মৃণালবাবু! মিঃ বসুরায় আমার বন্ধু ছিলেন। খবর পেয়ে আসতে হলো। এস. আই. প্রবীরের কাছে শুনে এলুম খুনী ধরা পড়েছে।
–হাঃ! মালী হরনাথ কাল সন্ধ্যায় সারভ্যান্ট ফটিককে বাড়ির ওপাশে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল। সেখানেই আজ ভোরে মিঃ বসুরায়ের বডি পড়ে ছিল। জেরার সময় ফটিক উল্টোপাল্টা কথা বলেছে। তার হাবভাবে বোঝা গিয়েছে খুনী সে-ই।
–মোটিভ?
–মিঃ বসুরায়ের কোনো শত্রুর কাছে টাকা খেয়ে সে খুন করেছে। তার ঘর সার্চ করে বালিশের তলায় দশ হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল পাওয়া গিয়েছে।
–ফটিকের বক্তব্য কী?
মৃণালবাবু হাসলেন।–সে নাকি জানে না তার বালিশের তলায় টাকা আছে।
কর্নেলও হাসলেন। অর্থাৎ তার বক্তব্য, তার অজ্ঞাতসারে কেউ টাকাগুলো তার বালিশের তলায় রেখেছে।
দ্যাটস্ রাইট কর্নেল সরকার!
–লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কে কে এসেছেন?
–আপনি চিনবেন। নরেশ ধর আর মুস্তাক আমেদ। হলঘরে এখনও ওঁরা জেরা করছেন।
–চলুন। আগে দেখা যাক, বডি কোথায় পড়েছিল।
দোতলা বাড়ির পূর্বদিকে নিয়ে গেলেন মৃণালবাবু। ইনিই যে অফিসার-ইন-চার্জ তা বুঝতে পেরেছিলুম। এদিকে বাড়ির দেওয়ালের নিচে ফুট চার-পাঁচ জায়গা সিমেন্ট করা সরু পথের মতো উত্তরে সুইমিং পুলের দিকে চলে গিয়েছে। এই পথের ডানদিকে বাউন্ডারি পাঁচিল অবধি ফুলবাগিচা, ক্যাকটাস এবং নানা উঁচুনিচু দেশি-বিদেশি বিচিত্র সব উদ্ভিদ ও গুল্মলতার স্তূপাকৃতি ঝোপ।
কর্নেলকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন মৃণালবাবু। দেখলুম, এখনও চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে সিমেন্টের উপর। খড়ির দাগ দিয়ে জায়গাটা চিহ্নিত। কর্নেল বললেন–বডি কী অবস্থায় ছিল?
–উপুড় হয়ে পড়েছিল। মাথার পিছনে আঘাত করেছিল ফটিক। মোটা বেঁটে একটা লোহার রড় রক্তমাখা অবস্থায় ওখানে পড়েছিল।
ফুট ছয়েক দূরে ফুলের ঝোপের পাশে খুনের অস্ত্রটা কোথায় পড়েছিল, তা দেখিয়ে দিলেন মৃণালবাবু। সেখানে ভিজে ঘাসের ওপর রক্তের ছাপ দেখতে পেলুম। কর্নেল বললেন–মার্ডার উইপনটা কি নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
–হ্যাঁ। ফরেন্সিক টেস্ট হবে।
কর্নেল ঝুঁকে জায়গাটা দেখার পর সোজা হয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কিছু দেখে নিলেন। তারপর পা বাড়িয়ে সিমেন্ট-বাঁধানো সরু রাস্তার উপর উঠে বললেন–ওটা কী?
মৃণালবাবু বললেন–কোনটা?
কর্নেল পাশের ঝোপে নেতিয়ে পড়ে থাকা যে জিনিসটা তুলে ধরলেন, অবাক হয়ে দেখলুম, সেটা একটা ছোট্ট কাকতাড়ুয়া। কালো পোশাক পরানো কাকতাড়ুয়ার কালো মুণ্ডুতে সাদা চোখ-মুখ আঁকা। মৃণালবাবু হাসতে হাসতে বললেন–কাকের খুব উপদ্রব। তাই মালী হরনাথ কাকতাড়ুয়াটা তৈরি করে এখানে পুঁতে রেখেছিল। কীভাবে উপড়ে গিয়েছে। এই দেখুন গর্ত।
কর্নেল বললেন–হরনাথকে এখন পাওয়া যাবে? নাকি তাকে জেরা করা হচ্ছে?
তার জেরা শেষ। এক মিনিট। তাকে ডেকে আনছি।
মৃণালবাবু বাড়ির সামনে লন ঘুরে অদৃশ্য হলেন। কর্নেল তাকে অনুসরণের ভঙ্গিতে লনে গিয়ে তখনই ঘুরে এলেন। বললুম–কী ব্যাপার?
–গেট থেকে এখানটা দেখতে পাওয়া যায়।
–তাতে কী?
–কিছু না। বলে কর্নেল কাকতাড়ুয়াটার দিকে মনোযোগ দিলেন।
অবাক হয়ে ওঁর ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করছিলুম। একটু পরে মধ্যবয়সী একটা হাফপ্যান্ট-গেঞ্জিপরা লোক কাচুমাচু মুখে মৃণালবাবুর সঙ্গে এলো। মৃণালবাবু বললেন কর্নেল সরকার! এই হচ্ছে মালী হরনাথ।
কর্নেল বললেন–আচ্ছা হরনাথ! এই কাকতাড়ুয়াটা কবে তৈরি করেছিলে?
হরনাথ বলল–আজ্ঞে স্যার, কাকের খুব উপদ্রব। তাই কাল দুপুরে মেমসায়েব বললেন, কাক তাড়ানোর ব্যবস্থা করো! আমি ভেবেচিন্তে তখন এই কাকতাড়ুয়া তৈরি করে এখানে পুঁতে দিলুম।
কাল কখন পুঁতেছিলে?
–আজ্ঞে, বিকেলে।
–তোমার সায়েব কাল কখন বাড়ি ফিরেছিলেন?
সায়েবের বাড়ি ফিরতে রাত্তির হয়। অফিস থেকে ক্লাবে যান। সায়েব কাল রাত্তিরে কখন বাড়ি ফিরেছিলেন আমি দেখিনি। নিজেই গাড়ি চালিয়ে ফেরেন।
দারোয়ান তাহলে জানে?
মৃণালবাবু বললেন–হ্যাঁ। দারোয়ান মোতিং সিং বলেছে, সায়েব গত রাত্রে প্রায় বারোটার সময় বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপর সে গেটে তালা এঁটে তার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।
মিসেস বসুরায় কী বলেছেন?
–উনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে রাত দশটায় শুয়ে পড়েন। ওঁর নার্ভের অসুখ আছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখেছি। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ।
–মিসেস বসুরায়ের সঙ্গে একটু কথা বলতুম।
–দেখছি।
বলে মৃণালবাবু চলে গেলেন। কর্নেল বললেন–আচ্ছা হরনাথ, তোমার কাকতাড়ুয়া ওই ঝোপে পড়েছিল দেখলুম।
হরনাথ বলল–আজ্ঞে স্যার, হতচ্ছাড়া ফটিকের কাজ ওটা। সায়েবকে মারবে বলে ঝোপে ওত পেতে বসেছিল। সে-ই এটা উপড়ে ফেলেছে। আর কে ওপড়াবে?
–তোমার সায়েব রাত দুপুরে এখানে কেন এসেছিলেন? কী মনে হয় তোমার?
হরনাথ মুখ তুলে দোতলার একটা জানালা দেখিয়ে বলল–আমার কথা পুলিশকে বলেছি স্যার। আমার মনে হয়েছে, ওই জানালা থেকে সায়েব নিচে ফটিককে দেখতে পেয়েছিলেন। ফটিকের স্বভাব-চরিত্র ভাল না। কাজের মেয়ে ললিতার সঙ্গে ওর ভাব আছে। সায়েব হয়তো দুজনকে হাতে-নাতে ধরতে চুপিচুপি নেমে এসেছিলেন। তখনই ফটিক তার মাথায় রড মেরেছে। পেছনকার খুলি ফেটে ঘাড় ভেঙে পড়ে গিয়েছিলেন সায়েব।
–ঘাড় ভেঙেছিল?
–পুলিশবাবুরা তাই বলছিলেন স্যার!
—হুঁ। টেনিসের কোর্টের পাশে, তেরপলের পর্দা দেখছি। কাল কারা টেনিস খেলেছিল?
–আজ্ঞে, মেমসায়েব আর ওনার ছেলে মানসবাবু।
–শুনেছি, মানসবাবু তোমার সায়েবের ছেলে নয়?
–আজ্ঞে না স্যার! আগের মেমসায়েব ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। তারপর সায়েব আবার বিয়ে করেছিলেন। এই মেমসায়েবের ছেলে মানসবাবু।
–তার মানে তোমার এখনকার মেমসায়েবেরও আগে বিয়ে হয়েছিল। সেই পক্ষের ছেলে?
হরনাথ চাপাস্বরে বলল–বড়লোকের ব্যাপার স্যার! ছেলেসুষ্ঠু মেমসায়েব এ বাড়িতে এসেছিলেন।
–কত বছর আগে?
–তা বছর কুড়ি হবে। মানসবাবুর বয়স তখন মোটে চার-পাঁচ বছর।
কর্নেল কথা বলার সময় এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে বললেন–ছাদে তোমাদের মানসবাবুকে দেখলুম মনে হচ্ছে?
হরনাথ দ্রুত মুখ তুলেছিল। বলল–হ্যাঁ। খুব বদরাগী স্যার। হয়তো দেখছিল, এখানে কী হচ্ছে।
আমিও মুখ তুলে এক সেকেণ্ডের জন্য একটা মুখ সরে যেতে দেখছিলুম। মুখটা ফর্সা এবং চোখের দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ণ। কিংবা আমারই দেখার ভুল।
কর্নেল এবার ফুলের ঝোঁপগুলির দিকে ঘুরে বললেন–বাঃ! প্রত্যেকটা ঝোপের চারদিক ঘিরে পাথর বসানো দেখছি।
–হ্যাঁ স্যার। সায়েব কোত্থেকে এইসব পাথরের চাঙড় ট্রাকবোঝাই করে এনেছিলেন।
এই সময় মৃণালবাবু এলেন।–আসুন কর্নেল সরকার! মিসেস সোহিনী বসুরায় উপরের ঘরে আপনাকে যেতে অনুরোধ করলেন।
–এক মিনিট! বলে কর্নেল ফুলের ঝোপে ঢুকে একটু ঝুঁকে কী দেখতে থাকলেন।
মৃণালবাবু বললেন–কী দেখছেন?
–পাথরগুলো সব ঝোঁপ ঘিরে বৃত্তাকারে সাজানো আছে। শুধু এই ঝোপের একটা পাথর বৃত্তরেখা থেকে সরে এসেছে। কেন?
বলে তিনি দু-হাতে একটা পাথরের চাঙড় তুললেন। তখনই মৃণালবাবু বলে উঠলেন–মাই গড! পাথরের তলায় লাল রঙ। মাটিতেও লাল রঙ!
–লাল রঙ নয় মৃণালবাবু। রক্ত। এই পাথরই মার্ডার উইপন। লোহার রডটা আপনাদের ভুল পথে চালাতে ওখানে ডেডবডির কাছে রক্ত মাখিয়ে ফেলে রেখেছিল খুনী।
–কী আশ্চর্য! কিন্তু পাথরটা তো ভারী। ওটা দিয়ে মাথার পিছনে—
কর্নেল তাঁর কথার উপর বললেন–খুনের রহস্য আমি ফাঁস করেছি মৃণালবাবু!
–অ্যাঁ? বলেন কী!
কর্নেল হাসলেন।–এই পাথরটা এখান থেকে খুনী সন্ধ্যার পর কোনো একসময়ে তুলে নিয়ে দোতলার ছাদে রেখেছিল। আর এই দেখুন কাকতাড়ুয়া। এটি এখানে পোঁতা ছিল। মিঃ বসুরায় কাল দুপুররাত্রে গেটে গাড়ি ঢোকানোর সময় এটা দেখতে পান। তিনি গ্যারাজে গাড়ি ঢুকিয়ে জিনিসটা কী, তা-ই দেখতে আসেন এবং ক্ষীণ আলোয় স্বভাবত তাকে একটু ঝুঁকে এটা দেখতে হয়েছিল। উনি লম্বা মানুষ। যেই উনি ঝুঁকেছেন, তখনই দোতলার ছাদ থেকে খুনী এই ভারী পাথরটা ওঁর মাথায় ফেলে দেয়। মাথার পিছনে ঘাড় অবধি তাই আঘাত লেগে মিঃ বসুরায় ওয়াজ স্পট ডেড। হরনাথ! কাল তুমি বিকেলে এখানে জলসেচ করেছিলে?
হতবাক নালী বলল–হ্যাঁ স্যার!
–তা হলে চলুন মৃণালবাবু। দোতলার ছাদে যাই। এই পাথরের তলায় ভিজে মাটি ছিল। সেই চিহ্ন দোতলার ছাদে খুঁজে পাব। আর এ-ও বোঝা যাবে, খুনী খুব ধূর্ত। কিংবা তার পরামর্শদাতাই ধূর্ত।…
.
দোতলার ছাদে গিয়ে নীচে অবনী বসুরায়ের মৃতদেহ যেখানে পড়েছিল, তার সোজাসুজি উপরে একটা জায়গায় ড্রেনপাইপের পাশে মাটির ছাপ দেখা গিয়েছিল। খুনী কল্পনাও করেনি, তার মোর্ভুস অপারেন্ডি এভাবে কেউ ধরে ফেলবে। তাই জল ঢেলে মাটির ছাপ ধুয়ে ফেলেনি।
ছাদে শর্টস এবং সাদা টি-শার্ট পরা মানস তখন যোগব্যায়ামের ভঙ্গি করছিল। কর্নেল একটু হেসে বলেছিলেন–গায়ে জামা পরে কেউ যোগব্যায়াম করে না মানস!
মানস ঘুষি পাকিয়ে বলেছিল–হু আর ইউ?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। মানস! রোদে ঘেমে জামা ভিজে গেছে। যোগব্যায়ামের নিয়মই তুমি জানো না। মৃণালবাবু! অ্যারেস্ট দি কিলার।
মৃণালবাবু মানসের ঘুষি থেকে মাথা বাঁচিয়ে তার টি-শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে পিঠে কনুই দিয়ে আঘাত করতেই মানস বশ মেনেছিল।
তারপর কর্নেল নিচে এসে লালবাজারের ডিটেকটিভ এস. আই. নরেশবাবুকে বলেছিলেন–নরেশ! তুমি অবিলম্বে পাশের বাড়ির রিটায়ার্ড জজসায়েব মিঃ সান্যালের সঙ্গে দেখা করো। খুনের মোটিভ পেয়ে যাবে। মিঃ বসুরায়ের লইয়ার তপন পাল তাকে বলেছেন, কিছুদিন আগে মিঃ বসুরায় তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে সম্পত্তির অর্ধেকটা মানসের নামে উইল করেছেন। কিন্তু মিসেস সোহিনী বসুরায়ের আগের পক্ষের পুত্রটির হাবভাব তার ভাল ঠেকছে না। তাই উইল তার। মিসেসের অজ্ঞাতসারে বদলাতে চান। কাল সোমবারই তিনি উইল বদলানোর দিন ঠিক করেছিলেন।
নরেশবাবু হাসলেন।–তা হইলে হেই ছ্যামড়া খবর রাখত। উইল বদলাইবার আগে সৎ বাবারে হেভি পাথর মাইর্যা খুন করল। কী কন?
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন– মিসেসও সন্দেহের উর্ধে নন নরেশ! তুমি এখনই মিসেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কাগজপত্র সার্চ করো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কাল শনিবার দশ হাজার টাকা ওঁর অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়েছে।
-আর হেই ট্যাহা ফটিকের বালিশের তলায় রাখছে। কী কন?
–নিছক অঙ্ক। তবে মিলে যাবে। চলি এবার।
ফেরার পথে কর্নেল বলেছিলেন–খুব ধূর্ত মাথার প্ল্যান। যেন নিচে দাঁড়িয়ে খুনী মাথার পিছনে মেরেছে।…
এর পরের ঘটনা আমি জানতাম। অঙ্কটা মিলে গিয়েছিল। কিন্তু কেন কর্নেল এই ঘটনা সম্পর্কে আমাকে নীরব থাকতে বলেছিলেন, তা জানতে পারলাম তিন বছর পরে খবরটা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় প্রকাশের পরদিন। বৈজয়ন্তী ভিলা। প্রমোটার ধ্বংস করছে, এটার চেয়ে বড় কারণ কর্নেল আমাকে মুখোমুখি জানিয়েছেন। মিসেস সোহিনী বসুরায় ছিলেন একসময় সিনেমা জগতের নামকরা নায়িকা। তার দাদা প্রশান্ত সিংহ ঘটনাচক্রে কর্নেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। মিঃ সিংহ কর্নেলকে ঘটনাটা চেপে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। প্রভাবশালী মিঃ সিংহের অনুরোধে কলকাতার অন্যসব পত্র-পত্রিকার মালিকরাও ঘটনাটা চেপে যান।