কাকতাড়ুয়া – ৯

নবম অধ্যায়

ঘাসের জমি থেকে এগিয়ে এসে সিংহদরজার কাছে যখন ভূপেন এসে দাঁড়াল তখন কলকাতার পথঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চারদিকটা অবশ্য এখনও আলোকিত। সাদা আলো দিয়ে আদ্যপান্ত মুড়ে ফেলা হয়েছে সমস্ত বিল্ডিংটা। চারদিকের জমি ফাঁকা পড়ে আছে, মধ্যে মধ্যে ঝোপঝাড়। তার ফাঁকে ফাঁকে আপাতত অন্ধকার জমেছে।

সমস্ত দিকটায় একবার সতর্ক চোখ বুলিয়ে নেয় ভূপেন। সাধারণত এ সময়টায় এদিকে কেউ আসে না। ওদের জনা পনেরো নাইট গার্ডের হাতে দায়িত্ব দেওয়া থাকে। তাছাড়া এখানে বেশ কয়েক জায়গায় সিসিটিভি লাগানো আছে। সেগুলো সর্বক্ষণ দৃষ্টি রেখে চলেছে।

ভূপেনের বয়স চল্লিশের আশেপাশে। তবে ছিপছিপে সুঠাম চেহারা বলে তাকে দেখে চল্লিশের একটু কম মনে হয়। বছর তিনেক হল এখানকার রাতের সিকিওরিটির দায়িত্ব ও নিজেই সামলাচ্ছে। আপাতত সমস্ত জায়গাটা টহল দিয়ে দেখছে ও। হাতের মোটা লাঠি দিয়ে মাঠের উপর পড়ে থাকা আবর্জনা সরিয়ে দিচ্ছে ইতিউতি। কখনও মাঠ ছেড়ে ঢুকে আসছে ভিতরের অফিস ঘরে। এখান থেকে সবক’টা সিসিটিভি কন্ট্রোল করা হয়। সেই স্ক্রিনের উপরে নজর রাখছে মাঝে মাঝে।

এত কিছুর দরকার নেই অবশ্য। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সিকিওরিটি নিয়ে তেমন বড় কিছু ঝামেলা হয়নি আজ অবধি। তাছাড়া মেমোরিয়ালের ভিতরের দরজা অনেকক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে চুরি হওয়ার মতো ছোট আর দামি জিনিস প্রায় কিছুই নেই।

বিল্ডিংয়ের সামনের দিকের মাঠের কাছে আসতেই ভূপেন একবার থমকে দাঁড়ায়। ওর ঠিক ডানদিকে ছোটখাটো ঝোপঝাড় হয়ে আছে। সেটা একবার নড়ে উঠল না? অদ্ভুত শব্দ আসছে কি ওদিক থেকে? অবশ্য এখানকার বাগানে কিছু রাজহাঁস ঘুরে বেড়ায়। তারাও হতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে তো অনেক আগেই ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঝোপটা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় ভূপেন। এত রাতে এখানে কে আসতে পারে? বিকেলে এখানে এসে কি কেউ বেরোয়নি?

ইচ্ছা করেই ঘাসের উপর পায়ের শব্দ তুলে সেদিকে এগিয়ে যায় ও। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিয়ে লাঠি দিয়ে ঝোপটা সরানোর আগেই পেছন থেকে একটা আওয়াজ আসে।

‘কিছু খুঁজছেন স্যার?’

পিছন ঘুরে অবিনাশকে দেখতে পায় ভূপেন। অবিনাশ সিকিউরিটিতে যোগ দিয়েছে। চৌকস ছেলে। সারারাত ছটফটে পায়ে গোটা চত্বরটা ঘুরে বেড়ায়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই সোজা হেড অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেয়।

‘ঝোপটা মনে হল দুলছিল।’ ভূপেন আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দেয়, ‘রাতে কেউ ঝোপের মধ্যে থাকলে মশার কামড় খেয়ে মরে যাবে।’

অবিনাশ নিজেই সেদিকে এগিয়ে যায়। তারপর হাত দিয়ে ঝোপটা একদিকে টেনে ধরে মুখ বাড়িয়ে দেয়, ‘কই কিছু নেই তো স্যার…’

ভূপেনের দিকে চোখ তুলে তাকায় অবিনাশ, থমথমে গলায় বলে ‘পিনাকিদা বলছিল, এই বিল্ডিংয়ে নাকি ভূত আছে স্যার। তাদের কেউ নয় তো?’

‘তুই তো দেখছি ভারি ভিতু ছেলে, এই জন্যেই রাতে ঘুম হয় না নাকি?’

অবিনাশ ভালো করে একবার চোখ রগড়ে নেয়। তারপর মুখে হাত ঘষতে ঘষতে বলে, ‘ঘুম হয় তো স্যার। দুপুরে ফার্স্ট ক্লাস ঘুম দিই রোজ।’

‘তাহলে তোর চোখ মুখ এরকম ঢুলু ঢুলু লাগছে কেন? নাহ, এরকম করে তুমি কাজ করবে কী করে?’

অবিনাশ বুঝতে পারে না। নিজের মুখেই বারবার হাত বুলিয়ে দেখতে থাকে। ভূপেনের মুখে একটা হাসি খেলে, হাতের ফ্লাস্ক থেকে একটা কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলে, ‘কফিটা খেয়ে নে। আপাতত আর ঘুম আসবে না…’

কথা না বাড়িয়ে কফিটা খেয়ে নেয় অবিনাশ। সিকিওরিটি হেড নিজের কফি থেকে ওকে ভাগ দিয়েছে, সে জিনিস চাইলেও রিফিউজ করা যায় না।

কফি খেয়ে আবার বিল্ডিংয়ের অন্যদিকে পা বাড়ায় অবিনাশ। যতক্ষণ সে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে ভূপেন ঠায় তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর ওর দেহটা দূরের দিকে মিলিয়ে আসতেই ঝোপের দিকে একটু সরে আসে। নরম গলায় হাঁক দেয়, ‘ডেঞ্জার ক্লিয়ার, তুই চলে আয়…’

পেছনের একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ঈশানী। ওর কাঁধে একটা ব্যাগ। সে ব্যাগের মধ্যেই আছে রঙের সরঞ্জাম, ব্রাশ আর স্প্রে পেন্ট।

ঈশানী বিদ্যুতের শিখার মতো দৌড়ে এসে দাঁড়ায় একটা গাছের আড়ালে। চারু এসে দাঁড়ায় ওর পাশে। বুকের ভিতরে এখনও টিপটিপ করে রক্তের ফোঁটা পড়ছে। ঈশানী হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে, ‘বাকিগুলোর কী অবস্থা?’

‘সব কটাকেই কফি খাইয়েছি। কয়েকটা খেতে চায়নি, সেগুলোকে অন্য ভাবে সাইজ করতে হবে। আমি খোঁজ নিয়েছি এইখানে সিসিটিভি নেই। এখানেই ছবি আঁক…’

‘ধুর…’ ঈশানী বিরক্ত হয়, ‘এখানে তো ক’টা থাম। লোকে দেখে আমল দেবে না। অন্য কোথাও চ…’

‘সিসিটিভি দেখে নিলে?’

‘তুই ওগুলো বন্ধ করিসনি?’

ভূপেন হাতের উপর ঘুষি মারে, ‘চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু শালা বন্ধ করতে গেলে কীসব কোড চাইছে, বিস্তর হ্যাপা।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী, তারপর কী যেন ভেবে বলে, ‘এক কাজ কর, ঝোপের ভিতর দিয়ে আয়। সামনে গিয়ে দেখি কিছু আছে কিনা…’

‘ওখানে সিসিটিভি দেখে নিলে?’

‘আঃ…’ বিরক্ত হয় ঈশানী, ‘ঝোপের ভিতর ছেলেমেয়ে বসে চুম্মাচাটি, গুচুপুচু করে। যদি সত্যি সিসিটিভি থাকত তাহলে এতদিনে দু’একটা ভাইরাল হত। সেটা হয়নি যখন ও জায়গাটা সেফ…চলে আয়…’

ঝোপের ভিতর দিয়ে সতর্ক বিড়ালের মতো এগোল দুজনে। কখনও ঝোপ খুব নিচু হয়ে গেলে মাথা নিচু করে হাঁটু মুড়ে গেল। কখনও নিজের শরীর দিয়ে ঈশানীকে ঢেকে দিল চারু। মিনিট দশেক সেভাবে চলার পর ভিক্টোরিয়ার বিশাল সিংহাসনে বসা মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।

এতক্ষণ ঝোপের মধ্যে গুড়ি মেরে চলে হাঁপিয়ে গেছিল ঈশানী। ঝোপের মধ্যেই বসে বিশ্রাম নিতে লাগল সে। সামনে বসে থাকা রানির মূর্তির দিকে চেয়ে বলল, ‘দেখ মাগিকে, এমন রেলা নিয়ে বসে আছে, যেন কত বড় বাল ছিঁড়েছে…’

‘তাও রানি বলে কথা…’

‘ওর জায়গায় আমি জন্মালে আমিও হতাম। রাজা-রানি হতে কোনও ক্ষমতা লাগে না। তাদের সিংহাসন থেকে হটিয়ে গলাটি কুচ করে কেটে দিতে পারলে তবে বুঝব, হ্যাঁ বাপের ব্যাটা।’

‘তাও এত বড় একটা মেমোরিয়াল তো আছে…’

‘বালের মেমোরিয়াল। বাঙালি এসব মেমোরিয়াল ফিয়ালকে পাত্তা দেয় না। ব্রিটেনের রানি রেলা নিয়ে সিংহাসনে বসে থাকে আর হাওড়ার হাবু শ্যাওড়াফুলির সীমাকে তার সামনেই রডে বসায়…’

চারদিকে একবার ভালো করে দেখে নেয় চারু। মুখে প্রশস্ত হাসি ফোটে তার, ‘এই এখানে মনে হচ্ছে কোনও ক্যামেরা ফ্যামেরা নেই। ওখানে তাও গাছ ছিল। এখানে ক্যামেরা লাগানোর জায়গাও নেই।’

‘আছে তো…’ ঈশানী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘ওই যে মাগি বসে আছে রেলা নিয়ে। সমস্ত বিধবা পিসিমারাই সিসিটিভি ক্যামেরা, জানিস না?’

‘বিধবা পিসিমা! ইংল্যান্ডের রানি?’

‘নয়?’ ঈশানী ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বড় বংশের মেয়ে বলে ছোট থেকে প্রেম ভালোবাসা হয়নি। রানির বিয়াল্লিশ বছর বয়সে স্বামী এলবার্ট মারা যায়। বছরদশেকের বিবাহিত জীবন। মেনোপজটা কোয়ি না সাথ, আপনা হাত হয়েই কাটাতে হয়েছে। আর একটু হলেই “আর কত রাত একা থাকব” গানটা ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে যেত…’

‘বিধবা তো বুঝলাম, কিন্তু পিসিমা কেন?’

‘আরে, এদের স্বভাবই হল নিজের ছেলে উচ্ছন্নে গেলেও পরের মেয়ে কোথায় কার সঙ্গে ওঠা বসা করে তার খবর রাখা। এই মহিলারও সে স্বভাব ছিল।’

‘তোকে কে বলল?’

স্ট্যাচুটার দিকে ধীরে পায়ে এগোতে এগোতে বলে ঈশানী, ‘আঠেরোশো নব্বইয়ের দিকে রানির শাসনকালে, একটা বছর পনেরোর ছেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পেশায় সে ডাক পিয়ন। চোদ্দটা শিলিং পাওয়া যায় তার কাছ থেকে। পুলিশ সন্দেহ করে ছেলেটা নাকি চুরি করেছে পয়সাগুলো। তো তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করা শুরু হলে তার কাছে থেকে যা জানা যায় তাতে শোরগোল পড়ে যায়। ছেলেটি বলে সে নাকি ক্লিভল্যান্ড স্ট্রিটের একটা পুরুষ পতিতালয়ে বেশ্যার কাজ করে। সে সময়ে ব্রিটেনে হোমোসেক্সুয়ালিটি ভয়ঙ্কররকম নিষিদ্ধ। রানির ওড়নায় আগুন লাগে যখন জানা যায় রানির ছেলের বিশেষ চাকর আর্থার সামারসেট নাকি সেই পতিতালয়ের ডেলি কাস্টমার। তার থেকে খোঁজ নিয়ে আরও বড় বড় কাস্টমারদের নাম উঠে আসে। সবাই রানির ঘরের লোক। যে রানি গে, লেসবিয়ানদের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন একটার পর একটা আইন জারি করে আসছেন, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে লোক গরম করছেন, তারই খাস লোকেরা পুরুষ বেশ্যাদের বিছানা গরম করছে। মজার না? এরপর কী হল গেস কর দেখি…’

‘কী?’

‘ওই পনেরো বছরের ছেলেটা দুম করেই একদিন ভীষণ স্বাভাবিক কোনও রোগে ভুগে মরে গেল…’

সিঁড়ি দিয়ে উঠে মূর্তির কাছে পৌঁছে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে ঈশানী। কয়েকটা রঙের কৌটো, একটা স্প্রে পেন্ট, একটা ব্রাশ আর একটা ছোট টুল। এই টুলটাকে অ্যাডজাস্ট করে উঁচু করে নেওয়া যায়। আগে দেওয়াল লেখার সময় উঁচু দেওয়ালে লিখতে হত মাঝে মাঝে। তখন পার্টি থেকেই দিয়েছিল এই টুলটা। তারপর থেকে ঈশানীর কাছেই পড়ে আছে।

সেটার পায়াগুলো খুলে টুলটাকে উঁচু করে চারু। ঈশানী সেটার উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। টুলটা তেমন পোক্ত নয়। ভালো করে ধরে না থাকলে নড়বড় করে।

শ্বেতপাথরের উপরে রং বসানো সহজ নয়। রঙ সহজে দাঁড়ায় না। চক পেন্ট ছাড়া অন্য কোনও রং বসে না তাতে। সেটা জোগাড় করতে আবার বেশ বেগ পেতে হয়। কাল সন্ধ্যায় নিজেই গিয়ে কিনে এনেছে ও।

কয়েক পোঁচ সাদা রং দিয়ে একটা মোটামুটি ছবি আঁকার মতো এক মিটারের সাদা সারফেস তৈরি করে ঈশানী। এই শীত শীত রাতেও পরিশ্রম আর উত্তেজনায় ওর কপালে ঘাম দেয়। চারু এখনও শক্ত করে ধরে আছে টুলটা। ঈশানীর নিজের থেকে যেন ওরই বেশি আগ্রহ গোটা ব্যাপারটায়।

ব্রাশটা হাতে নিয়ে রং বোলাতে বোলাতে ঈশানী বলে, ‘তুই আমার কাছে রয়ে তো গেলি, কিন্তু রাখব কী করে সেটাই ভাবছি…’

‘কেন? ছাদে যেমন আছি তেমন থাকব।’

‘সে তো আমি যতক্ষণ অফিসে আছি ততক্ষণ। ছাদের চাবি আমার কাছেই থাকে। ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার তো অফিস থেকে ফিরে তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করবে। তখন কী হবে?’

‘কী আবার হবে? তখন ছাদে চলে আসবি।’

‘আচ্ছা? ও পাশের বাড়ির লোকজন তাদের ছাদ থেকে দেখে ফেললে? ছাদে একটা উটকো ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছি—ব্যাপারটা মায়ের কানে আসতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সিসিটিভির অভাব এখানে থাকলেও আমার বাড়িতে নেই।’

‘তাহলে?’

রং করতে করতেই একটুক্ষণ ভাবে ঈশানী, ‘তাহলে আমি অফিস থেকে ফিরে তোকে ঘরে নিয়ে চলে আসব। বাড়িতে থাকলে তুই ঈশানী হয়ে থাকাই ভালো। হুট করে কেউ দেখে ফেললে সন্দেহ করবে না।’

‘কিন্তু একসঙ্গে দেখে ফেললে?’

‘তখন প্রমাণ হবে বাড়িতে আমি একাই গাঁজা খাই না…’ অন্য একটা রং হাতে তুলে নেয় ঈশানী, ‘ভালো করে একটা সিডিউল তৈরি করতে হবে বুঝলি। ভালো কথা, তোর খাওয়াদাওয়া করতে হয়?’

চারু টুল থেকে হাত সরিয়ে নেয়, ‘লোভ লাগে, কিন্তু না খেলে মরে যাব না…’

প্রাথমিক রংটা বসে যেতে সেটা শুকানোর জন্যও অপেক্ষা করে ঈশানী। তারপর সাদা রঙের অন্য দিকটায় হাত চালায়।

চারু চারিদিকটা আরেকবার দেখে নেয়। আশেপাশে কোনও গার্ডকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। একটু নিশ্চিন্ত হয় সে।

‘আচ্ছা, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার কথা তো মনে আছে তোর। তার আগের কিছু মনে নেই? মানে তার আগে তুই কোথায় ছিলি, কীভাবে ছিলি, কোন কোন মানুষদেরকে দেখেছিস?’

চারু কাঁধ ঝাঁকায়, ‘সবকিছু মনে থাকে না। কিছু ছোট ছোট ছবি মনে পড়ে…তার কোনও মানে বুঝতে পারি না…’

‘যেমন?’

‘যেমন ধর, একদল লোক। এখনকার মতো জামা পরে নেই। লম্বা ঝুলওয়ালা জামা, বেশ শক্তপোক্ত…তাদের হাতে তলোয়ার। একটা দরজা দিয়ে ঢুকে আসছে তারা। তলোয়ার চালাচ্ছে…ঠুংঠাং আওয়াজ, রক্ত…অনেক রক্ত…’

বলতে বলতে নিজের মাথা টিপে ধরে চারু, ‘ভাবলে খুব মাথা ব্যথা করে, আর মন খারাপ হয়ে যায়।’

ঈশানী বিড়বিড় করে, ‘তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে, গলা কাটছে, এসব তো মধ্যযুগে হত। তুই কি তখন থেকেই দুনিয়ায় আছিস?’

‘হতে পারে, আমি কী করে বলব?’

‘তোর মাথার পিছনে দুটো চিহ্ন আছে। একটা ঘুড়ি আর একটা পাখি। ওগুলোর মানে কী জানিস?’

‘উঁহু…’

হঠাৎ ঈশানীর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে, ‘আমার বাবার এক প্রফেসর বন্ধু আছেন। কলেজে ইতিহাস পড়ান। এইসব দিকে হেব্বি ইন্টারেস্ট। তার সঙ্গে যদি তোর একবার দেখা করানো যেত…ওই দৃশ্যগুলো ডিটেলে বলতে পারলে কিছু সাহায্য করতে পারত মনে হয়…’

দুজনের কেউই আর কোনও কথা বলল না। শুধু মাঝে মাঝে রঙের কৌটোয় ব্রাশ ডোবানোর ছপছপ আওয়াজ। আর সেই সঙ্গে দূরে ঘুমন্ত শহরের বুক দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা দুটো যানবাহনের আওয়াজ। ঈশানীর ব্রাশ বুলানোর সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা রং মাটিতে ছিটকে পড়ছে। কিছু কিছু এসে লেগেছে চারুর মুখে। ও হাত দিয়ে মুছে নিচ্ছে সেটা।

মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছে আঁকাটার দিকে। একটা ফাঁকা রাস্তার উপরে মনের খেয়ালে নাচছে সেই মেয়েটা আর সেই বিচিত্র চেহারার কাকতাড়ুয়াটা। তাদের দুজনের মুখেই হাসি। দুজনেরই অন্য কোনও দিকে খেয়াল নেই। দেখতে দেখতে চারুর মুখে ঠিক একইরকম হাসি ফোটে।

ঈশানীর আঁকা প্রায় শেষ। টুলটা তুলে নেবার জন্য ও মাটিতে নামতে যাবে, এমন সময় দূর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল, ‘হেই কন হে উধার…কী করছ তোমরা?’ সঙ্গে তীব্র হুইশলের শব্দে ভরে উঠল চত্বরটা।

‘গাঁড় মেরেছে!’ লাফিয়ে টুল থেকে নামতে গিয়ে চারুর গায়ের উপর হুড়মুড়িয়ে পরল ঈশানী। ধুলোতে মাখামাখি হল দুজন।

দূর থেকে একটা গার্ড দেখতে পেয়েছে ওদেরকে। চিৎকার করে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছে এদিকে। তার হাতে একটা মোটা লাঠি। হুইশলে ফুঁ দিয়েই চলেছে লোকটা। কিন্তু এদিকের বেশিরভাগ গার্ড আধোঘুমে তলিয়ে আছে। তাদের কানে গেল না সেই হুইশল।

চারু একটু ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল ঈশানীকে, ‘তুই লুকিয়ে পড়, বাকি আমি বুঝে নিচ্ছি।’

ঈশানী ওর হাত ধরে তাড়া দেয়, ‘লুকিয়ে কী হবে? চল পালাই, দৌড়ালে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারব।’

মুখ ঝামটা দেয় চারু, ‘হ্যাঁ, আমরা বেরোই আর ওরা দেখতে পেয়ে সব মুছে দিক। সকালে লোকজন না দেখতে পেলে কোনও লাভ নেই।’

‘তাহলে কী হবে?’

উত্তেজনার মুহূর্তে আর কিছু মাথায় আসে না ওদের। লোকটা আপাতত মিটার কুড়ির মধ্যে এসে পড়েছে। দুজনে দৌড়ে সামনেরই একটা অন্ধকার ঝোপের আড়ালে ঢুকে পড়ে। একটা বেরিয়ে থাকা লতায় পা আটকে চারুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঈশানী। দুজনের একটু ধস্তাধস্তিও হয়। জামাকাপড় ছিঁড়ে যায় কয়েক জায়গায়।

এতক্ষণে লোকটা দৌড়ে এসে পৌঁছেছে ঝোপটার কাছে। আক্রোশে ঝোপের উপর একটা লাঠি চালায় সে, ‘বেরিয়ে আয় শুয়োরের বাচ্চারা। আজ তোদের গাঁড়টি কেমন করে মারি দেখ।’

‘আমরা নিজেরাই ওটা করে নিতাম স্যার, আপনার আবার আসার কী দরকার ছিল?’ ঈশানী অন্ধকার থেকেই গলা তুলে উত্তর দেয়।

মেয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে লোকটা আরও রেগে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘ছিঃ ছিঃ, এরকম একটা জায়গায় এসে নোংরামি করতে লজ্জা করে না? বাড়িতে বাপ-মা নেই তোদের?’

‘কী করব স্যার? একটা কাকতাড়ুয়াও আছে…’

লোকটা মানে বুঝতে পারে না। আবার ঝোপের উপরে লাঠি চালিয়ে বলে, ‘বেরিয়ে আয়, আজ মজা দেখাচ্ছি তোদের।’

আর উপায় নেই। চারু ঈশানীকে অন্ধকারে রেখে নিজে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওকে দেখে লোকটা অবাক হয়ে যায়, ‘স্যার আপনি! ঝোপের মধ্যে মেয়ে নিয়ে…’

পিছন থেকে উত্তর আসে, ‘ছেলে নিয়ে বসলে তো আপনার রানি রেগে যেত…’

‘চুপ কর তুই মাগি…’ কথাটা বলে ভূপেনের দিকে তাকায় লোকটা, ‘আমি এটা আপনার থেকে এক্সপেক্ট করিনি স্যার। এটা আপনি করতে পারেন না…’

‘কেন? ওনার দাঁড়ায় না আপনি জানলেন কী করে? আপনিও ওনার সঙ্গে ঝোপে…’

লোকটা রাগত ভঙিতে এবার ভূপেনের কলার খামচে ধরতে যায়। কিন্তু তার আগেই থেমে গিয়ে তেমনি গড়গড়ে স্বরে বলে, ‘আমি এটা উপরমহলে রিপোর্ট করছি এক্ষুনি…’

‘তার আগে ওর নিচমহলটা একটু বাজিয়ে দে তো চারু…’

পেছন থেকে নির্দেশটা আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা পা উঠে আসে চারুর। লোকটার দুই পায়ের মাঝে আছড়ে পড়ে সেটা। প্রবল যন্ত্রণায় মুখ ধরে মাটিতেই বসে পড়ে সে। পায়ের মাঝখানটা চেপে ধরে মাটিতে শুয়েই কাতরাতে থাকে।

চারু ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে, ‘রিপোর্ট পরে করবেন নাহয়। আপাতত মাথা ঠান্ডা করে একটু কফি খান, কেমন?’ জোর করে ওর মুখে গরম কফি ঢেলে মুখটা চেপে বন্ধ করে দেয় চারু। তারপর দুটো পা ধরে টেনে ঢুকিয়ে নেয় অন্ধকার ঝোপের ভিতর। লোকটা তাও ছটফট করতে থাকে।

ঈশানী ওর গালে আলতো করে দুটো থাপ্পড় মারে। নরম স্বরে বলে, ‘দেখুন, বেশি ছটফট করবেন না। ঘণ্টাখানেকের মামলা, সালটে দিয়ে চলে যাব…’

হাঁপাতে হাঁপাতেই আবার প্রতিবাদ করে লোকটা, ‘আপনারা…আপনারা এইভাবে জায়গাটাকে নোংরা…’

মুখ দিয়ে চুকচুক করে আওয়াজ করে ঈশানী, ‘এই যে আপনি ব্রিটেনের রানির রক্ষী হয়ে বসে আছেন। এটা পয়লা নম্বরের বোকাচোদামি। আসলে কী জানেন, ইংরেজ আমলের নিয়ম এখন আর চলে না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল পয়সা কামাবে বলে, তারপর রাজনীতি শুরু করে। এখনকার দিনে ব্যাপারটা উল্টে গেছে। আগে লোকেরা রাজনীতি করে তারপর পয়সা কামায়। এই ঢেমনি মাগির গার্ড না হয়ে যদি কোনও কেষ্টবিষ্টুর বডিগার্ড হতেন তাহলে কোটি কোটি টাকা কামাতেন…আপাতত শুয়ে থাকুন, কাজ আছে আমাদের…’

চারুর হাতটা ধরে বেরিয়ে আসে ঈশানী। চারু মেইন গেটের দিকে টানতে থাকে ওকে, ‘চল, কাজ তো শেষ…’

ঈশানী অবাক হয়, ‘শেষ কীসের? সবে একটা ছবি এঁকেছি।’

‘তো তুই কি কমিকস্ট্রিপ বানাবি নাকি?’

চারুর পিঠে একটা হাত রাখে ঈশানী, ‘দেখ চারু, সেক্স হোক বা আর্ট—ঈশানী প্রামাণিকের একবার চড়ে গেলে আর সহজে নামে না।’

দুজনে যখন মেইন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তখন আকাশ নীল হতে শুরু করেছে। স্কুটিটাকে ইচ্ছা করেই একটা সরু গলির ভেতর দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল ওরা। সেখানে হেঁটে যেতেও অন্তত মিনিট দশেক লাগবে।

ওদের দুজনের শরীরই ধুলো মাখা। ঈশানীর গায়ে কয়েক জায়গায় ধাবড়া হয়ে রং লেগে আছে। ছিঁটে ছিঁটে সাদা রং লেগেছে চারুর গায়েও। মাথার চুলগুলো এলোমেল হয়ে আছে দুজনের। ক্লান্ত লাগছে বলে হাতটা ধরে হাঁটছে ঈশানী।

কিছুদূর হেঁটে এসে পিঠে ব্যাগটা ভালো করে চাপিয়ে নেয় সে। দু’পাশে বড়বড় রাস্তাগুলো নিঝুম হয়ে পড়ে আছে। নন্দন, রবীন্দ্রসদন পেরিয়ে এসে আরও কিছুদূর হাঁটতে থাকে ওরা। ওদের জুতোর মসমস শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই আশেপাশে। কলকাতার ঘুম ভাঙতে আরও ঘণ্টাখানেক দেরি।

চারু ঈশানীর পিঠে একটা হাত রেখে বলে, ‘এই, ক্লান্ত লাগছে না তোর, না?’

অবসন্ন মুখেই মাথা নাড়ায় ঈশানী, ‘ক্লান্ত না, ভালো লাগছে। আমার জীবনে এরকম দিন খুব একটা আসেনি।’

চারু হাসে, চোখ উল্টে বলে, ‘দেখে যাও গুরু, সবে তো শুরু।’

ঈশানীর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। আনমনে চলতে চলতে সে হঠাৎ করেই জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা, তুই ওই কথাটা কেন বলেছিলি?’

‘কোন কথাটা?’

‘এই জগতটা তোর নয়। এখানে তো সব ঠিকঠাকই চলছে। আমার সঙ্গে আছিস, মজা করছিস, রাত জেগে অনাসৃষ্টি করছিস, এমন করে চলে গেলে হয় না?’

একটু সময় নিয়ে দুদিকে মাথা নাড়ায় চারু, ‘তোকে ঠিক ব্যাপারটা বোঝাতে পারব না। চারপাশে যত তাকাই মনে হয় এর কোনটাই আমার জগৎ নয়। আমার এখানে থাকার কথাই নয়। এই অনুভূতিটা ঠিক বোঝানো যায় না। কিন্তু একবার বুঝে ফেললে আর নিস্তার নেই এর হাত থেকে। আর কোনভাবেই তাকে ধরে রাখা যায় না…ও তুই বুঝবি না…’

ঈশানী উপর নিচে মাথা নাড়ায়, ‘কিছু বুঝতে না পারলেই আমার আগে জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ত জানিস। ছোটবেলায় সিলেবাসে কবিতাগুলো ছিল যখন, শালা কিছু বুঝতে পারতাম না…তারপর বড় হতে বুঝলাম কবি ক্রমাগত তোকে এটা বুঝিয়ে যাবে যে এই লাইনগুলো আদৌ তোর জন্য লেখা নয়। তুই এখানে আউটসাইডার…স্ট্রেঞ্জার! এটা ওর আর ওর নিজের জগতের একটা কনভারসেশন। তুই যদি এখান থেকে আড়ি পেতে কিছু বুঝে নিতে পারিস তাহলে নে। কিন্তু আমি দরজা খুলে তোকে এখানে স্বাগত জানাচ্ছি না…’ ঈশানীর গলা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, ‘সারাজীবন তাকে একটা অচেনা শহরে, অচেনা মানুষের মধ্যে, অচেনা হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকতে হয়…তবে…’

‘তবে কী? বল…’

‘তোর দিকে তাকালে মনে হয় না। তুই রোজ পাল্টে যাস, তোকে চাইলে আমি যা খুশি করে ফেলতে পারি, কিন্তু তাও তোকে ভীষণ চেনা লাগে…’

চারু ওর কাঁধে হাত রেখে হাঁটে। ভোরের আগে বাড়ি ফিরতে হবে ওদের। তারপর ঈশানী ঘরে ঢুকে যাবে, আর ও দাঁড়িয়ে থাকবে ছাদে। ভাববে সূর্যের ওই আকশময় গতিপথের ঠিক কোনখানে ঈশানী অফিসে ঢুকেছে, ঠিক কখন কী বোর্ডের উপর ফড়ফড়িয়ে চলছে ওর আঙুলগুলো, কখন বসের ধাতানি খেয়ে মনটা খারাপ হয়েছে ওর। তারপর সূর্য ডুবে গেলে অপেক্ষা করবে ওর বাড়ি ফেরার। এতদিন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে এক জায়গায়, কিন্তু কোনওদিন এমন করে অপেক্ষা করেনি কারও জন্য…

আরও খানিকটা আলো ফোটে। কলকাতার ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দূরের দিকে হেঁটে যায় দুটো মানুষ। ক্লান্ত শরীরে একে অপরের আশ্রয়ে ঘন হয়ে আসে। বিড়বিড় করে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে ঈশানী—

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্‌ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *