সপ্তম অধ্যায়
হালকা তন্দ্রা এসে গেছিল ঈশানীর। রাত দুটো বাজতে সেটা নিজে থেকেই কেটে গেল। সিঁড়ি দিয়ে এক ছুটে ছাদে চলে এল সে।
আজ সারাদিন ভাবনাটা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। কাল রাতে যা ঘটল সব কি সত্যি? সকালে ঘুম ভাঙতে দেখে ছাদেরই একটা পাঁচিলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল সে। কাকতাড়ুয়াটা ঠিক শেডের নিচে আগের মতোই দাঁড়িয়েছিল। সেটার সামনে গিয়ে একবার ঘুরেফিরে দেখেছিল ঈশানী। নাঃ, বিশ্বাস হয়নি। রাতের স্বপ্ন ভেবে নেমে গেছিল সিঁড়ি দিয়ে।
কিন্তু সারাদিন কথাটা বেরোতে চায়নি মাথা থেকে। এত জীবন্ত স্বপ্ন! মেয়েটার হাতের স্পর্শ এখনও যেন ওর হাতে লেগে। সন্ধে হতেই ঠিক করেছিল, রাতে এসে আর একবার পরীক্ষা করবে ব্যাপারটা। সেই তক্কে তক্কে ছিল সারাদিন।
ছোট আলোটা আজও জ্বলছে ছাদে। কালকের মতোই একটা মৃদু হাওয়া বইছে ধীরে। চাঁদের আলোয় কাকতাড়ুয়াটার দিকে এগিয়ে এল ঈশানী। বুকের ভিতরটা কোনও অজানা আশঙ্কায় ছমছম করে উঠল ওর।
সাদা আলোটা নিভিয়ে দিল ঈশানী। ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল শেডের তলাটা। আর ঈশানীর বুকের মধ্যে ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন বলে গেল—শেডের তলাটা জীবন্ত। দুটো অসহায় চোখে কেউ চেয়ে আছে ওর দিকে।
‘কেউ আছেন? কেউ…’
‘আপনি কাকে চাইছেন?’ অন্ধকার থেকে ভেসে আসা গলার স্বর আগের মতোই শিরশিরানি ধরিয়ে দেয় ওর বুকে। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা সেদিকে ফেলতেই কাল রাতের মুখটা আবার দেখতে পায়।
মাথায় হাত দিয়ে ছাদেরই এক কোণে বসে পড়ে ঈশানী। মাথার ভেতরটা ভোঁভোঁ করছে ওর। নিজের চোখে যা দেখছে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মেয়েটা শুধু ওর গলার স্বরেই কথা বলছে তাই নয়, শব্দগুলোও যেন ওরই ভোকাবুলারি থেকে বেরিয়ে আসছে।
মেয়েটা সেটা বুঝতে পেরেই একটু হাসে, তারপর এগিয়ে আসে ওর দিকে, ‘কী করলেন সারাদিন?’
ঈশানী নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়, ‘সকালে গার্গীর সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর অফিস। তুই?’
পরিচিত মুখ বলে সম্বোধন পালটে গেছে। মেয়েটা সেটা খেয়াল করেও করে না। দূর আকাশের দিকে তাকাল সে, ‘দাঁড়িয়ে থাকলাম এখানে। আমার আর কী কাজ? অপেক্ষা করলাম কখন দুপুর থেকে বিকেল হবে, বিকেল থেকে সন্ধে, তারপর রাত…’
‘আগে দেখিসনি? বিকেল, সন্ধে, রাত?’
ওর পাশে ঠিক ওর মতো করেই বসে পড়ে মেয়েটা, ‘মাঠে যখন দাঁড়িয়ে থাকতাম তখন দেখতাম। রোজ…’ ওর গলা হারিয়ে যায় দূরে, ‘দিনের পর দিন একই দৃশ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখবি এই দুনিয়ায় কেউই নিয়মিত নয়। মাঠের আল ধরে হেঁটে যাওয়া বউটা একদিন তার স্বামীকে নিয়ে পার হবে, বকরি ইদের পর গরু আর ছাগলগুলো পার হবে না, আকাশে ঝাঁক বেঁধে যে পাখিগুলো উড়ে যায় তারাও এক থাকে না…শুধু…’
‘শুধু?’
‘শুধু সূর্যটা একই থাকে। ও রোজ একাই ওঠে, একই রাস্তায় হেঁটে আবার একাই ডুবে যায়। সঙ্গী নেই, ছুটি নেই, বদল নেই। সারাদিনের এই অনিয়মিতের ঝাঁকে একমাত্র নিয়মিত। তাকে রোজ রোজ দেখেও কি মন ভরে, বল?’
ঈশানী অবাক হয়ে চেয়েছিল মেয়েটার দিকে। ঝাপসা অন্ধকারে কেবল তার শরীরের আউটলাইনটা দেখা যাচ্ছে। হুট করেই কাল রাতে গার্গীর বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। অভিরূপার মৃত্যুর সঙ্গে কি কিছু যোগ আছে কাকতাড়ুয়াটার? কথাটা মনে হতেই ওর দিক থেকে একটু সরে আসে ঈশানী। একটু দম নিয়ে জিগ্যেস করে, ‘তাহলে আগের রবিবার মাঠে তুইও ছিলিস, তাই না?’
উপরে নিচে মাথা নাড়ায় মেয়েটা, ‘তুইও ছিলিস। অবশ্য মনে থাকার কথা নয়…’
‘তুই তো কাকতাড়ুয়া অবস্থায় থাকলেও দেখতে পাস, অভিকে যে খুন করেছে তাকে দেখিসনি?’
মেয়েটা হুট করেই স্থির চোখে ওর দিকে তাকায়, ‘কাল দুপুরে যখন আমাকে ধরে কাঁদছিলি তখন এইসব প্রশ্নগুলো তো করিসনি! হঠাৎ প্রশ্নগুলো বদলে গেল কেন বল তো?’
ঈশানী হাঁটুর উপর হাত রেখে বসে, ‘তখন বলার মতো কেউ ছিল না। অগত্যা…’
‘আজ্ঞে না। তুই বলার মতো কেউ থাকলেই বলতে পারিস না। না থাকলে পারিস, তাই না?’ কথাটা বলে আবার আগের মতো হাসে মেয়েটা, ‘তুই প্রশ্নের উত্তর চাস, না নিজের…কী যেন বলেছিলি…গাঁড় মেরে যাওয়া জীবনটার কিছু ব্যবস্থা করতে চাস?’
ঈশানী অবাক চোখে ওর দিকে তাকায়, তারপর তাচ্ছিল্য ভরে মাথা নাড়ায়, ‘আমাকে হেল্প করা অসম্ভব…’
মুখ থেকে চুল সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা, ‘দুটো বাঁশের খুঁটি আর একটা কালো হাঁড়ির সঙ্গে মাঝরাতে কথা বলা সম্ভব ছিল?’
‘বলেছিলাম তো কাল। আমাকে মেরে ফেলতে হবে…’
‘কেন?’
মেয়েটা দূরে অন্ধকারে মুখ ডোবানো বাড়িগুলোর দিকে দেখিয়ে বলে, ‘আমার এখানে থাকার কথা নয় তাই। যার যেখানে থাকার কথা নয়, তার সেখানে থাকতে অসুবিধা হবে না?’
‘কিন্তু আমি মানুষ খুন করতে পারি না।’ ঈশানী কঠিন গলায় বলে।
‘করতে হবে না। শুধু ওই হাঁড়িটা ভেঙে ফেললেই হবে।’
‘ব্যাস?’ ঈশানী অবাক চোখে তাকায়, ‘এটুকু করলেই তুই সব ঠিক করে দিবি? আর কিচ্ছু চাইবি না?’
ঠোঁট কামড়ায় মেয়েটা, ‘চাইতে পারি অনেককিছু। তবে আপাতত একটা ইচ্ছা হচ্ছে খুব।’
‘কী?’
‘তুই তো স্কুটি চালাস। আমাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবি?’
প্রস্তাবটায় একটু ঘাবড়ে যায় ঈশানী, ‘ঘুরতে বলতে? কোথায়?’
‘ধর, এই শহরটা। আমি কোনওদিন শহর দেখিনি। তুই স্কুটি করে আমাকে শহর দেখাবি। কেমন?’
‘কিন্তু তাতে কী লাভ? সেই একই ঘরবাড়ি, একই ফাঁকা রাস্তা। একই হারামি লোকজন…’
‘উঁহু, আমার কাছে তো সবই নতুন। আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছি বছরের পর বছর। একটু না হয় ঘুরতে বেরোলাম।’
‘বেশ, সকালে অফিসে যাওয়ার আগে নাহয়…’
‘এখন…’ মেয়েটার গলার স্বর কঠিন শোনায়।
‘খেপেছিস নাকি? এত রাতে স্কুটি নিয়ে শহর দেখতে বেরোয় কেউ?’
‘তোর কাছে দুটো হেলমেট আছে?’
‘না…’
‘তাহলে কাল সকালে দুটো একই দেখতে মেয়েকে একই সঙ্গে রাস্তায় ঘুরতে দেখলে ব্যাপারটা ভালো হবে? তার থেকে এই রাতটাই ভালো…তাই না?’
ঈশানী আবার আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। কিন্তু থেমে গেল। বাইরে নরম একটা হাওয়া দিচ্ছে। সেটা গায়ে মাখতে মন্দ লাগবে না। এত রাতে মা-ও ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরের চাবিটাও ওর কাছে। স্কুটিটা বের করতে খুব একটা আওয়াজ হবে না। ওদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে যে সিঁড়িটা আছে সেটা দিয়ে নেমে গেলে কেউ টেরও পাবে না।
‘কিন্তু যাবি কোথায়?’
‘তোর যেখানে যেতে ইচ্ছা করে। বা ধর, যে জায়গাটা এড়িয়ে চলিস…’
‘আচ্ছা বেশ, চল…’
ঈশানী স্কুটিটা যখন বাইরে আনল ততক্ষণে রাত আড়াইটে ছাড়িয়েছে। মেয়েটা ওর ঠিক পেছনেই বসল। মৃদু আওয়াজ করে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল স্কুটিটা। দুপাশে ঘুমন্ত বাড়িগুলো সরে যাচ্ছে পেছন দিকে। ওদের ছুটন্ত শরীরদুটো ছাড়া বাকি শহরটাকে যেন কার্ডবোর্ড দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে কেউ।
বাজারের কাছে এসে নিজে থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে যায় ঈশানীর। সামনের আয়নায় সেটা লক্ষ করে মেয়েটা, বলে, ‘হাসছিস কেন বল তো?’
‘আমার চিরকাল একটা শখটা ছিল, জানিস? এই রাস্তাটা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে নিতাম। কসাইগুলো মুরগি কাটত। সহ্য হত না গন্ধটা। ভেবেছিলাম টাকা হলে এমন একটা জায়গায় থাকব যেখানে বাড়ি ফেরার সময় চোখ বন্ধ করতে হবে না…’
‘তারপর?’
‘এখন ভাবছি কী বোকা ছিলাম! রাতে বেরোলেই তো আর কিছু দেখতে হত না…’
স্কুটির গতি বাড়িয়ে দেয় ঈশানী। রাস্তা যতটুকু দেখা যাচ্ছে কোথাও কিছু নেই। সবটুকু জুড়ে নিস্তব্ধতা। হাতে আঁকা ছবির মতো স্থির হয়ে আছে সবকিছু। এমনকী রাস্তায় একটা কুকুরও নেই। সকালে যেখানে ভিখারি বসে থাকে সেখানেও কেউ নেই।
আবার পেছন থেকে মেয়েটার গলা ভেসে আসে, ‘রাতে বেরোসনি কেন?’
‘এ শহরে রাত্তিরবেলা মেয়েদের বেরোনো অতটা সেফ নয়। একা একা বেরোতে ভয় লাগে…’
‘আজকে ভয় লাগছে না?’
‘না, আজকে তুই আছিস…’
‘আমিও তো মেয়ে…’
হুট করেই স্কুটিটা থামিয়ে দেয় ঈশানী। কী যেন ভেবে নিয়ে বলে, ‘ভালো কথা, জিগ্যেসই করা হয়নি। তুই সত্যি মেয়ে? মানে আমি নিজেকে এঁকেছিলাম বলে না হয় আমার মতো দেখতে হয়েছে কিন্তু…’
‘আমি কাকতাড়ুয়া, তুই আমার খোলস যেভাবে আঁকবি, আমি ঠিক তাই…নিজের ব্যাপারে কিছুই মনে নেই আমার।’
‘বেশ, কাল তাহলে তোকে গং ইউ বানিয়ে দেব।’
‘সেটা কে?’
‘কোরিয়ান হিরো। আমার ক্রাশ ছিল একসময়।’
মেয়েটা হেসে ফেলে। ঈশানী বাগবাজারের সরু রাস্তার ভিতর দিয়ে স্কুটিটাকে ছুটিয়ে দেয়। এখানে বাড়িগুলো আরও ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ কাঠের জানলাগুলো আঁটসাঁটো করে বন্ধ, শুকনো কলতলা পড়ে আছে। ভাঙা ছাদের একদিকে নুয়ে পড়া বাসায় পাখিগুলোও স্কুটির আওয়াজে পাশ ফিরে শোয়। মাঝে মাঝে বাড়ির ফাঁক দিয়ে আকাশে ছুটন্ত চাঁদটাকে দেখা যায়। চাঁদটা অবিরত ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার লোভ দেখাচ্ছে বুঝি।
‘আচ্ছা তোকে দেখতে না হয় আমার মতো, কথাও আমার মতো বলতে পারিস। কিন্তু…’
‘তুই সাজতে যা যা দরকার তার সব জানি আমি। তার বেশি কিছুই জানি না। স্মৃতি না, দুঃখ না, অনুভূতি না…আমি একটা ছদ্মবেশ। আর কিছু না…’
‘তাহলে ভুল সময়ে এলি। আর ক’দিন আগে এলে আমার বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতাম। আর দুর্গাপুজো দেখাতাম তোকে। তখন এইসব গলিতে ঘোরার মজাই আলাদা…’ একটা বাঁক নিতে নিতে বলে ঈশানী।
‘দুর্গাপুজো কী?’
‘ওই তোর মতোই বলতে পারিস। মাটির মূর্তি বানিয়ে পুজো করে লোকে। ভাবে সে মূর্তিতে কোথাও প্রাণ আছে। তার কাছে এটা সেটা চায়…’
‘আর বদলে কী দেয়?’
ঈশানী কয়েক সেকেন্ড ভেবে উত্তর দেয়, ‘বদলে কিছুই দেয় না। মানে সম্পর্কটা মা মেয়ের মতো অনেকটা। আমরা ভক্তি শ্রদ্ধা করি, আর তার বদলে ইচ্ছাপূরণ চাই…’
‘তুই মাকে ভক্তি করিস?’
ঈশানী হাসে, ওর মুখের উপরে অচেনা কিছু রেখা খেলে যায়, ‘কী জানিস, জন্মের পর বাচ্চা যত বড় হয় তত সে একা হতে থাকে, তত তার মধ্যে খিটখিটে ভাব বাড়তে থাকে। বাবা-মা এদিকে ততটা একা হয় না। বাবার মা থাকে, মায়ের বাবা থাকে। তারপর একদিন মা-বাবার মধ্যে একজন মরে যায় আর ছেলে-মেয়ে কাউকে না কাউকে খুঁজে পেয়ে যায়। টেবিলটা জাস্ট ঘুরে যায়। আমরা বড়বেলায় ওদের একাকীত্বটা বুঝি না, ওরা কম বয়সে আমাদেরটা বোঝে না…’
কথাটা বলে মুখ ফেরায় ঈশানী, ‘তুই তো এত বছর একা একা দাঁড়িয়েছিলি। খিটখিটে হলি না কী করে?’
‘কারণ আমার শুধু ওই দাঁড়িয়ে থাকটুকুনিই ছিল। আমি কিছু চাইতাম না। না চাইলে হতাশও হতে হয় না। এই দেখ, এখন চাইছি—এখন আবার হতাশ হতে হবে…’
‘কী চাইছিস এখন?’
‘তুই কার্টুন আঁকাটা আবার শুরু কর। ওটা ছেড়ে দিলি কেন বল তো?’
ঈশানী কাঁধ ঝাঁকায়, ‘কী লাভ করে? টাকাপয়সা নেই ওতে। দুটো লোকে পিঠ চাপড়াবে। দুটো নিব্বা-নিব্বি কটা টাকা দিয়ে তাদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের কার্টুন আঁকিয়ে নেবে, বড়জোর অমুক স্মৃতি পুরস্কার, তমুক সিলভার জুবিলিতে একটা অ্যাওয়ার্ড দেবে। ওসব করে লাভ নেই…’
‘তাহলে তুই কী হলে খুশি হবি?’
‘আমি বড় স্কেলে কিছু একটা করতে চাই। মানে যেটার সত্যিকারের কিছু মূল্য আছে…’
কথাটা বলতে বলতে একটা মাঠের সামনে এসে স্কুটিটা দাঁড় করালো ঈশানী। তারপর চাবিটা লক করে নেমে এল মাঠের উপর।
‘এটা তো মাঠ। কী আছে এখানে?’
ঈশানী চাবিটা কোমরে গুঁজে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে, ‘আমার স্কুল…’ আঙুল তুলে মাঠের একপাশে একটা বিল্ডিং দেখাল সে, ‘টুয়েলভ অবধি এখানেই পড়েছিলাম। ইদানীং জানি না কেন আর আসতে ইচ্ছা করে না।’
‘করে না কেন?’
মাঠের মোটামুটি মাঝামাঝি হেঁটে আসে দুজনে। ঈশানী ঘাসের উপরেই বসতে বসতে বলে, ‘কী জানি, এখানে এলে খুব বাবার কথা মনে পড়ে যায়। পুরোনো বন্ধুদের কথা, স্যারেদের কথা, ওসব আর মনে করতে চাই না…’ মেয়েটার কাঁধে একটা চাপড় মারে ঈশানী, ‘এই জানিস স্কুলে পড়ার সময়ে একটা নিব্বি টাইপের শখ হয়েছিল আমার…’
‘কীরকম?’
‘সরস্বতী পুজোর দিন ছিল। সবে ইলেভেনে উঠেছি। চারিদিকে সবাই প্রেম করছে। সবাই প্রিন্সেপ ঘাট ছুটছে। বাড়িতে পুজো-টুজো দিয়ে ভাবলাম আমিও একটু ঘুরে আসি। দেখি কী হয়। ওমা! সেখানে গিয়ে দেখি বন্ধুরা সবাই আছে, কিন্তু কেউই একা নেই। সব শালা শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি পরে মাল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমিই শুধু একা এসেছি। কী লজ্জার কথা ভাব…’
‘তারপর কী হল?’
পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায় ঈশানী, ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘তারপর আর কী, প্রেস্টিজের পুরো গ্যামাক্সিন হয়ে গেল। ঘাটের থামের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম একদিন না একদিন আমিও শালা শাড়ি পরে পাঞ্জাবি পরা মাল নিয়ে আসব এখানে…’
‘এসেছিলি?’
‘ধুর…’ তাচ্ছিল্য ভরে হাত নাড়ায় ঈশানী, ‘সেসব আর হল কই।’
‘বেশ, আমাকে যা খুশি সাজাতে পারিস। মিটে গেল ঝামেলা।’
‘আর একটা শখ ছিল, সেটা অবশ্য চাইলেও হবে না।’
‘কী?’
ঈশানীর গলা উদাস শোনায়, ‘মায়ের কাছে শুনেছি কলকাতায় একসময় দোতলা বাস চলত। মা আর বাবা বাসের দোতলার সামনের সিটে বসে বাড়ি ফিরত। আমার খুব রোম্যান্টিক লাগে ব্যাপারটা…কানে গান চলবে, আর গোটা কলকাতা ঘুরে দেখব উঁচু থেকে…দোতলা বাস কলকাতা থেকে তুলে নেওয়া উচিত হয়নি…ধুর…’
ঈশানী করুণ হাসি হাসে। পাঁচিলের দিকে চেয়ে থাকে একটানা। গলাটা উদাস শোনায় তার, ‘ছোটবেলায় বাবা সাইকেলে করে স্কুল থেকে নিতে আসত আমাকে। আর ঠিক ওইখানটায় দাঁড়িয়ে থাকত, জানিস? আমি একা একা স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে এলেই সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসত আমার কাছে…’
সিগারেটের ধোঁয়া অপ্সরার আঁচলের মতো হাওয়া বেয়ে উঠতে থাকে উপরের দিকে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তারা। মাঠের ঘাসের ভিতর থেকে লুকিয়ে ডেকে চলেছে ঝিঁঝি। তাছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই কোথাও।
‘চল, দেখে আসি দেওয়ালটা…’ ঈশানীর হাত ধরে টান দেয় মেয়েটা।
‘কেন? দেওয়ালে কী আছে?’
মেয়েটা উত্তর দেয় না। গায়ের জোরে ঈশানীর হাত ধরে টানতে থাকে সে। তেমন করে টেনেই স্কুলের পাঁচিলের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা দুজনে।
পাঁচিলটা পুরোনো হলেও উপরে সিমেন্ট করা আছে বলে মসৃণ দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো ফুটে আছে আকাশে। তাতে চোখে পড়ে পাঁচিলের গায়ে বড় করে রং দিয়ে লেখা—এখানে বিজ্ঞাপন মারিবেন না।
মেয়েটা নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা ইটের ঢ্যালা কুড়িয়ে নেয়, তারপর সেটা ঈশানীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে, শুরু কর।’
‘কী শুরু করব?’
‘ওমা! এই যে বলছিলি বড় স্কেল চাই। আপাতত এর থেকে বড় স্কেল তো আর দেখতে পাচ্ছি না…’
ঈশানী অবাক হয়ে একটু পিছিয়ে আসে, ‘তুই বলছিস, আমি এখানে ছবি আঁকব?’
‘কার্টুন। কাল সকালে যারা এই মাঠে খেলতে আসবে তারা সবাই দেখবে। স্কুলের স্যারেরা দেখবে। ভেবে দেখ, এত বড় স্কেল, দর্শক, আর কী চাই?’
দেওয়ালটা দেখায় ঈশানী, ‘এখানে আঁকাজোকা করা নিষিদ্ধ।’
‘এত রাতে কে দেখতে আসছে?’ কথাটা বলে মেয়েটা একটু পিছিয়ে যায়, ‘তাছাড়া আমি আছি তোকে গার্ড দেওয়ার জন্য। কাউকে আসতে দেখলেই এলার্ট করে দেব।’
হাতে ইটের টুকরোটা নিয়ে হতভম্ব হয়ে ঈশানী দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেয়েটার নির্ঘাত মাথা খারাপ। এই রাতবিরেতে একটা আস্ত স্কুল বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে কার্টুন আঁকা…
ইটটা হাত থেকে ফেলে দিতে যাচ্ছিল ঈশানী, কিন্তু তার আগেই গোস্বামীর মুখটা মনে পড়ে যায়। সেই কিউবিকল, এপ্রেজাল, চিল্ড এসি, পরিপাটি করে পরা জামাকাপড়…ইউ উইল ওয়াক দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, লিভ দ্যা ওয়ে…মাথাটা গুলিয়ে ওঠে ওর। হাতের মুঠোতে ইটটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায় ঈশানী।
দেওয়ালের উপর খসখস করে কয়েকটা দাগ টানতে থাকে সে। রাতের হাওয়ায় সমুদ্রের গন্ধ এসে মেশে। ঝিমঝিমে অনুভূতি গ্রাস করে ওর মাথার ভিতরটা। মেয়েটা একটু পিছিয়ে গিয়ে একমনে লক্ষ রাখছিল চারপাশটা। আঁকতে আঁকতে একবারও তার দিকে ফিরে তাকায় না ঈশানী।
খানিকক্ষণ পর সেখানে ফুটে ওঠে একটা ভাঙাচোরা চেহারার স্কুটি এবং উপরে ততোধিক ভাঙাচোরা চেহারার একটি অল্প বয়সি মেয়ে। চোখদুটো গোলগোল করে মন দিয়ে স্কুটি চালাচ্ছে সে, আর মেয়েটির ঠিক পেছনেই বসে আকাশের দিকে হাত-পা তুলে গান গাইছে হাঁড়িমাথা আর লাঠির শরীরওয়ালা একটা বেখাপ্পা চেহারার কাকতাড়ুয়া।
ভারি মজার ছবিটা। দেখলে এক নিমেষে হাসি পেয়ে যায়।
ছবি আঁকা শেষ হতে ইটটা রাস্তার উপর ছুড়ে ফেলে মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসে ঈশানী, একটু হেসে ভুরু তুলে বলে, ‘ঠিকঠাক লাগছে?’
মেয়েটা আগের মতোই মিষ্টি করে হাসে, তারপর বলে, ‘সে আমি কেন বলব? কাল সকালে যারা এখানে আসবে তারা বলবে…’
মাথার চুলগুলো বেঁধে নেয় ঈশানী, বলে, ‘ধুর, রাস্তাঘাটের দেওয়ালে এসব ছবি কত আঁকা থাকে…ওসব দেখতে লোক আসে না।’
মেয়েটাও মাথা নাড়ায়, ‘ঠিকই। এমন কোনও জায়গা দরকার যেখানে লোকের চোখে পড়বে। আচ্ছা এখানে লোকজন জড়ো হয় কোথায়?’
‘কলকাতায়? তা সেরকম জায়গা বিস্তর আছে। ময়দান, ভিক্টোরিয়া, নন্দন, তারপর ধর এতগুলো মেট্রো স্টেশন, জোড়াসাঁকো…’
‘বেশ, পরদিন তাহলে যে কোনও একটা জায়গায় নিয়ে যাবি।’
‘মানে? আমি ওই জায়গাগুলোতেও ইট দিয়ে ছবি আঁকব নাকি?’
মেয়েটার মুখে ভাবান্তর দেখা যায় না, ‘ইট দিয়ে ঠিক ফুটছে না ব্যাপারটা। তোর কাছে অন্য কিছু নেই?’
ঈশানীর নিজের চুলই খামচে ধরতে ইচ্ছা করে, ‘থাকবে না কেন? একসময় দেওয়াল লিখতাম প্রচুর। তাছাড়া আলপনা দিয়েছি রাতের পর রাত। কিন্তু তুই নিজে জানিস কি বলছিস? একবার পুলিশে ধরতে পারলে…’
‘পারবে না, আমি পাহারা দেব বলছি তো…’
‘ধুর বাল। অত যখন কলকাতা রাঙানোর ইচ্ছা হয়েছে তখন শিখিয়ে দেব তোকে, নিজে গিয়ে এঁকে আসবি।’
ঈশানীর দিকে এক পা এগিয়ে আসে মেয়েটা, ‘শিখছি তো, তুই যখন আঁকছিলি তখনই শিখেছি। কিন্তু আঁকা না…’
‘তাহলে?’
মেয়েটার মুখে চাঁদের আলো এসে পড়ে, ঠিক যেমন করে এসে পড়ে জ্যৈষ্ঠের মাঠে দুলন্ত পাকা ধানের শিষে, ‘আমার মতো তুইও বদলে যেতে পারিস…’
‘কখন?’
‘যখন ছবি আঁকিস, তখন। তখন আর তোর সঙ্গে কিচ্ছু থাকে না। পুরোনো প্রেম, কষ্ট, বাবা, দুপুরবেলা যে এত কান্নাকাটি করছিলি…সবটুকু পাল্টে যায়…তখন আর তোর কোনও কষ্ট নেই, স্মৃতি নেই, দুর্বলতা নেই। সারাক্ষণ যে মুখোশটা পরে থাকিস তখন সেই মুখোশটাই হয়ে যাস তুই। আর তুই যদি পাল্টাতে পারিস, তাহলে এই শহরটাও পাল্টাবে…’
আঁকাটার দুপাশে ওরা দুজন বসে পড়ে। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া শহর বিছিয়ে থাকে ওদের সামনে। ঝিঁঝির আওয়াজটা এখন আর একটু বেড়ে উঠেছে। কোনও নির্দিষ্ট সুরে বাজছে কি? অস্বস্তি শুরু হয় ঈশানীর। সেটা কাটাতেই বলে, ‘একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, জানিস?’
‘কী ব্যাপার?’
‘এর আগেও তো এতদিন ওই মাঠে ছিলি তুই। এত মানুষ স্পর্শ করেছে, হঠাৎ সেদিনই জাগলি কী করে?’
‘স্পর্শে জাগে না কিছু।’
‘তাহলে কীসে জাগে?’
‘অসহায়তায়। সেদিন রাতে পাগলের মতো কাঁদছিলিস। মনে হচ্ছিল সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিস। অমন করে মনে হয় জীবনে কোনওদিন কাঁদিসনি। কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা বলছিলি বারবার…’
‘আমার কিছু মনে নেই। শুধু মন বলে সে রাতে অলৌকিক কিছু একটা ঘটেছিল।’
মেয়েটার গলা ফিসফিসে শোনায়, ‘মাঝে মাঝে এমন এক একটা রাত আসে আমাদের জীবনে, যখন আমরা বুঝতে পারি চারপাশে ইট কাঠ পাথরের মতো যা কিছু পড়ে আছে তা দিয়ে আর চোখের জল থামবে না। তখন আমরা অলৌকিকের খোঁজ করি…এমন কিছু যা কেবল পৃথিবীর নিয়মে চলে না…’
‘কিন্তু আমি তো অলৌকিকের খোঁজ করিনি…’
‘করেছিলি, সেদিন রাত্রিবেলা বারবার চিৎকার করে বলছিলি—তোমরা কেউ আমাকে ছেড়ে যেও না, কেউ একটা আমার কাছে থেকে যাও…’ ঈশানীর দিকে মুখ ফেরায় মেয়েটা, ‘এ পৃথিবীতে কারো থেকে যাওয়ার থেকে বেশি অলৌকিক আর কিছু হয় না…’
‘মানে তুই বলতে চাইছিস আমার এত বন্ধু-বান্ধব প্রেম করে, একে অপরকে ভালোবাসে। আমার বাবা মাকে ভালোবাসত, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত…সেসব কিছুই সত্যি নয়?’
মেয়েটা হাসে, ও গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এসেছে, ‘আমি তো বলিনি এ পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু হয় না…চল, ওঠা যাক এবার…’
ওরা দুজনেই উঠে পড়ে। স্কুটির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশানী বলে, ‘মানে আমার বিশ্বাস জাগিয়েছিল তোকে…’
‘না, তোর চোখের জল জাগিয়েছিল আমাকে…’
ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে স্কুটিটা। মেয়েটা দুটো হাত রেখেছে ওর পিঠে। নরম, পুরোনো আঁচলের মতো স্পর্শ। যেন কেবল স্পর্শ দিয়েই ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে ওকে। মোড় ঘোরার সময়ে একবার সে হাত যেন ঈশানীর গলা ছুঁয়ে যায়। হাতঘড়িতে সময় দেখে ও—প্রায় চারটে বাজতে যায়। ও জানে দেরি হলে অসুবিধা নেই। কেউ অপেক্ষা করছে না ওর জন্য। কখনই করছে না।
ফেরার সময় অন্য একটা রাস্তা ধরে ঈশানী। হরি ঘোষ স্ট্রিট ছাড়িয়ে গ্রে স্ট্রিট ধরে। এ রাস্তাটা একটু ঘুরপথে ওদের বাড়ি পৌঁছায়। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফোটে ওর।
মোটামুটি হাতিবাগানের মোড়ে এসে থেমে যায় ঈশানী। স্কুটিটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে দেয়। ওর পেছনে বসা মেয়েটা একটু অবাক হয়, ‘একী এখানে থামলি যে…’
‘যেখানে যেতে ইচ্ছা করে না সেখানে নিয়ে গেলাম, আর যেখানে ইচ্ছা করে সেটা বাদ দেব?’
চারপাশটা ভালো করে দেখে মেয়েটা। জমজমাট জায়গাটা আপাতত শুনশান ফাঁকা হয়ে গেছে। জুতো, জুয়েলারি আর জামাকাপড়ের দোকানগুলোর শাটার নামানো। ট্রাফিক পুলিশের দলও বাতি স্বয়ংক্রিয় করে দিয়ে চলে গেছে। নিজে থেকেই বদলে যাচ্ছে আলোগুলো। যেন গোটা হাতিবাগান এলাকাটা খালি করে দিয়ে এখানকার সব বাসিন্দারা কোথায় চলে গেছে।
‘এটা তো একটা বাজার মনে হচ্ছে, ছবি আঁকবি এখানে?’
‘উঁহু,’ ঈশানী ঘাড় নাড়ে। তারপর একেবারে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। চারদিকের পথঘাট একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, ‘শুধু একটু খেয়াল রাখবি, লরি এলে পাশ দিয়ে দিতে হবে, কেমন?’
‘কিন্তু করবিটা কী?’
‘স্কুল থেকে ফিরতে খুব জ্যাম হত এখানে। পরে পুজোর আগে এখানে জামা বানাতে আসতাম। তখন একটা ইচ্ছা হত…’
‘কী ইচ্ছা?’
ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় ঈশানী, ‘আপাতত তুই মেয়ে, আমার হাত ধরতে গা শিরশির করবে না। চলে আয়।’
মেয়েটা একরকম বোকা বোকা মুখ করেই এগিয়ে আসে ওর দিকে। ওর বাড়িয়ে রাখা হাতটা ভ্যাবলার মতো ধরে। দুজনেই কয়েক সেকেন্ড থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
কী যেন একটা গান গুনগুন করছে ঈশানী। পুরোনো কিশোর কুমারের গান। পল পল দিল কে পাস…
গানটা গাইতে গাইতে আচমকাই মেয়েটার হাত ধরে একটা টান দেয় ঈশানী। এক ঝটকায় ওর এক হাত থেকে অন্য হাতের দিকে চলে আসে মেয়েটা। হাতটা মাথার উপরে তুলে ওকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয় ঈশানী। মুখে একটা হাসি লেগে থাকে ওর। মেয়েটা পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর সেও হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে।
কাল তুঝকো দেখা থা ম্যায় আপনি আঙ্গন মে
জ্যাসে কেহ রাহি থি তুম ‘মুঝে বাঁন্ধ লো বাঁন্ধন মে’
ব্যস্ত একটা শহরের ব্যস্ততম মোড় আপাতত ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে। শোভাবাজার, শ্যামবাজার, কলেজস্ট্রিট, স্টার থিয়েটার, ভূতুড়ে, বিপজ্জনক ছাপপড়া বাড়িগুলো হাঁ করে দর্শকের চেয়ারে বসে থাকে। ওরা সব ভুলে বাতাসে ছন্দ তুলে কেবল নাচতে থাকে…
ইয়ে ক্যায়সা রিস্তা হ্যায়, ইয়ে ক্যায়সা সপনে হ্যায়
বেগানে হো কার ভি কিঁউ লাগতে আপনে হ্যায়
মধ্যে মধ্যে একটা দুটো লরি পাশ কাটিয়ে চলে যায় ওদের। তাদের ড্রাইভাররা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। দুটো জমজ বোন রাত তিনটের সময়ে হাতিবাগানের মোড়ে নাচছে কেন বুঝে পারে না ওরা।
দুহাতে শক্ত করে মেয়েটার কোমর চেপে ধরে ঈশানী। কাছে নিয়ে আসে ওকে। দুজনেরই চুল এলোমেলো। আচমকাই মেয়েটার চোখের মাঝে সেই হারিয়ে ফেলা ঈশানীকে দেখতে পায় ও। যাকে ও ভালোবাসতে চেয়েছিল। আয়নায় তাকিয়ে বারবার যাকে দেখতে চেয়েছিল। যাকে অন্যরা কেউ পছন্দ করেনি বলে নিজেই কবে যেন ভাসিয়ে দিয়েছিল ভাসানের ঘাটে। আজ অনেক বছর পর তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় ও…
উল্টোডাঙ্গার দিক থেকে ছুটে আসা লরির আলো এসে পড়ে ওদের গায়ে। দুটো নাচতে থাকা মানুষের দৈত্যাকৃতি ছায়া গিয়ে পড়ে ঘুমন্ত কলকাতা শহরের বুকে…
ম্যায় সোচ মে রেহতা হু, ডর ডর কে কেহতা হু
পল পল দিল কে পাস, তুম রেহতি হো…