কাকতাড়ুয়া – ৬

ষষ্ঠ অধ্যায়

রুনু যখন চোখের জল মুছতে মুছতে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে এল ততক্ষণে স্কুল চত্বর ফাঁকা হয়ে গেছে। কেবল উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী গেটের কাছে বসে গল্প করছে। ঝাপসা চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে নেয় রুনু। তারপর যেদিকে দু’চোখ যায় হেঁটে কিছুদূর এগিয়ে আসে। ওর হাঁটু অবধি নীল স্কার্টের কোমর ছাড়িয়ে শার্ট বেরিয়ে আছে বাইরে। মাথার চুল আধখাওয়া কটন ক্যান্ডির মতো এলোমেলো হয়ে আছে। চোখের কোণে চিকচিক করছে জল।

দুলে দুলে হাঁটছে বলে ব্যাগের ভিতর ফাঁকা জলের বোতল আর টিফিন বক্সে ঘষা লেগে খটখট করে আওয়াজ হচ্ছে। জুতোর ভেতর দুপুরবেলা খেলতে গিয়ে জল ঢুকে গেছে। মোজা ভিজে স্যাঁতস্যাঁত করছে। তাতে ওর ভিতরের অস্বস্তিটা বেড়ে উঠছে ক্রমাগত।

পাঁচিলের দিকে তাকাতেই চেনা মুখটা দেখতে পেল রুনু। ওকে দেখতে পেয়েই বাবা সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসছে। মেয়ের বেরোতে এত দেরি হচ্ছে দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে।

‘কী রে কাঁদছিস কেন ব্যাটা?’ ওর সামনে এসে জিগ্যেস করেন সঞ্জীবন। মেয়ের চোখের কোণে শুকনো জলের দাগটা নজর এড়ায়নি। রুনু প্রশ্নটার উত্তর দেয় না। ব্যাগটা সাইকেলের কেরিয়ারে রেখে সামনের রডে উঠে বসে।

‘বকা খেয়েছিস, না গার্জেন কল?’

রুনু আবারও কোনও উত্তর দেয় না। খালি একবার নাক টানে। সঞ্জীবন বোঝেন মেয়ে কথা বলতে চাইছে না। এখন ওর পেট থেকে কিছুই বের করা যাবে না।

সাইকেলে উঠে প্যাডেল করতে গিয়েই ওর হাঁটুর দিকে চোখ পড়ে যায় সঞ্জীবনের। দুটো হাঁটু লাল হয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘নিল ডাউন করিয়েছিল কেন?’

‘তলপেটে লাথি মেরেছিলাম বলে।’ এতক্ষণ পরে রুনুর গম্ভীর গলা শোনা যায়।

‘কাকে মেরেছিলি?’

‘চিন্ময়ীকে…’

‘মেরেছিলি কেন?’

‘ও বলেছিল আমরা গরিব। সবার বাবা গাড়ি করে নিতে আসে, শুধু আমার বাবা সাইকেলে করে নিতে আসে…’

সঞ্জীবন হাসেন। সাইকেলটা চালিয়ে মাঠের ধার দিয়ে স্কুল চত্বরের বাইরে বের করে আনেন। একটা বাম্পার পড়ে এখানে। ধীরে সুস্থে পার হয়ে যান সেটা, ‘তো মারলি কেন?’

‘মারব না? আমাকে গরিব বলবে কেন?’

‘গাড়ি থাকলে কি এমন বাবার কোলের কাছে বসে যেতে পারতিস? আলাদা আলাদা সিটে বসতে হত। তাছাড়া শুধু গাড়ি করে ঘুরলে এই শহরটাকে চিনবি কী করে?’

এইবার মনটা খুশি হয় ঈশানীর। ওর কাছে ওর বাবা হিরো হওয়ার সবথেকে বড় কারণ ছিল এইটাই। গোটা কলকাতা শহরটা যেন বাবার হাতের তলায়। কী সব ভারী ভারী নাম! রাসবিহারী, ওয়েলিংটন, লেলিন সরনি, কালীঘাট! ভয় লাগত ঈশানীর। জায়গাগুলো কোথায় কে জানে। ওখানে ছেড়ে দিলে বাবা না থাকলে কী করে বাড়ি ফিরতে হবে কিছুই জানে না ও।

অথচ বাবা সব জানে। বাড়ির কেউ কোথাও যাওয়ার আগে বাবার কাছেই জিগ্যেস করতে আসে, ‘মেসো, অমুক জায়গার বাস কী করে ধরব? তমুক জায়গায় যেতে গেলে কোথায় নামতে হবে?’

বাবা পটাপট বলে দেয়। তখনই বুকটা চওড়া হয়ে যায় ঈশানীর। ওর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে একদিন ও কলকাতাটাকে এভাবে চিনবে। একদিন ও নিজেও কাউকে চেনাবে এই শহরটা। সেদিন ও নিজেও হিরো হবে।

বিকেলের রোদ মরে আসছে শহরের বুক থেকে। সাইকেলের ঘণ্টির টুংটুং আওয়াজ আসছে মাঝে মাঝে। বাবা ওকে বেল কখন বাজাতে হয় শিখিয়ে দিয়েছে। বাবা সাইকেল চালালে, সামনে কোনও গাড়ি এলেই ও বেল বাজিয়ে দেয়।

‘আমরা কি সত্যি গরিব বাবা?’ রুনু রাস্তার উপর নজর রাখতে রাখতেই বলে, ‘ম্যাম বলে যারা ভালো করে পড়াশোনা করে না তারা সারাজীবন গরিব থেকে যায়। তাদের বাড়ি গাড়ি কিছুই হয় না…’

শোভাবাজারের রাস্তার পাশে বস্তি ঘরগুলোর দিকে চোখ যায় রুনুর। নীল রঙের নোংরা দেওয়াল, ঘরের দরজার বাইরেই ড্রেন। বাইরের রেলিঙয়ে ঝুলন্ত ন্যাকড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছেঁড়া তোশক, মশারি, আর বাসনকোসন। একগাদা বাচ্চা ছেলেমেয়ে গিজগিজ করছে ঘরের ভিতর।

ওদের দিকে দেখায় রুনু, ‘ওরাও তাহলে পড়াশোনা করেনি বাবা?’

কী ভেবে রাস্তা থেকে একটু সরে আসেন সঞ্জীবন। দাঁড় করান সাইকেলটাকে। তারপর খানিক দূরে হাতিবাগানের মোড়ের দিকটা দেখিয়ে বলে, ‘দেখ তো এই রাস্তায় যত লোক দেখতে পাচ্ছিস, তারা কী করছে?’

রুনু একবার চারদিকটা ভালো করে তাকিয়ে দেখে নেয়। তারপর বলে, ‘ওই তো একটা লোক ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। একটা লোক আইসক্রিম বিক্রি করছে, আর ওই লোকটা কাঁধে করে গামছা বেচছে, ওই টাকমাথা লোকটা অফিস যাচ্ছে…আর ওই খালি গায়ের লোকটা শুয়ে আছে…’

‘মানে এরা সবাই হয় কাজ করছে, না হয় কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাউকে ফাঁকি মারতে দেখছিস?’

ভালো করে সরেজমিন করে নেয় রুনু, ‘কই, না তো। সবাই খুব ব্যস্ত। কেউ একটু দাঁড়াতেই চাইছে না।’

‘এদিকে স্কুলে কিন্তু ফাঁকি মারতে দেখেছিস, তাই না?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তাতে কী হল?’

‘বুঝলি রুনু,’ ওর পিঠে হাত রাখে বাবা। ‘পড়াশোনা করতে কারও ভালো লাগতেও পারে, নাও লাগতে পারে। অঙ্ক কষতে ইচ্ছা হয়, আবার হয় না। কিন্তু খিদে সবার পায়। পাবেই…তাই যারা খেতে পায় না, জামাকাপড় পরতে পায় না, থাকার মতো জায়গা নেই, তারা পয়সা রোজগারে ফাঁকি দেয় না। যে যতটা পারে, যার বুদ্ধিতে যতটা সম্ভব, ততটা পয়সা রোজগার করতে চায়। গাড়ি বাড়ি হোক না হোক পরের কথা, কিন্তু কেউ যদি খেতে না পায়, চাকরি না পায়, দিনের শেষে ঘুমানোর মতো ছাদ না পায়, শরীর খারাপ হলে ওষুধ না পায়, তাহলে ধরতে হবে…’

‘কী ধরতে হবে বাবা?’

‘তোকে তো ফেলুদা পড়ে শুনিয়েছি, নিজেই বল। তুই আইসক্রিম খেতে চাইলি না অথচ তুই আইসক্রিম খাচ্ছিস, এর মানে কী হতে পারে?’

‘মানে আমাকে কেউ জোর করে খাওয়াচ্ছে।’

সঞ্জীবন খুশি হয়ে মাথা নাড়ান, ‘ঠিক বলেছিস। ওদের কেউ জোর করে গরিব বানিয়ে রেখেছে…’

‘কে বানিয়ে রেখেছে?’

সঞ্জীবন বোঝেন এইবার মেয়ের প্রশ্নগুলো আরও দূরূহ হয়ে উঠছে, তিনি তাও বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘দুনিয়ায় কারও দুঃখ হয় বলে কারও আনন্দ হয়, পৃথিবীর একদিকে অন্ধকার হয় বলে অন্যদিকে দিন আসে। আর কেউ বড়লোক হবে বলে কাউকে জোর করে গরিব করে রাখা হয়…’

‘আমাদের গরিব করে যে বড়লোক হয়েছে তাকে তুমি চেনো?’ বাবার মুখের দিকে চেয়ে জিগ্যেস করে ঈশানী।

সঞ্জীবন হাসেন, মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি, তিনি উত্তর দেন, ‘চিনি, বড় হলে তুইও চিনবি।’

‘তারপর কী করব?’

‘করার অনেক কিছু আছে। বড় হলেই বুঝতে পারবি…’

‘আর কিছুতেই যদি কাজ না হয়?’

সঞ্জীবনের মুখে একটা আদুরে হাসি খেলে যায়, ‘কিছুতেই কাজ না হলে আজ চিন্ময়ীকে যা করেছিস তাই করবি, কেমন?’

হাতিবাগানের মোড়ের কাছে একটা আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সেটার সামনে সাইকেল দাঁড় করান সঞ্জীবন। তারপর দুটো অরেঞ্জ কাঠি আইসক্রিম কিনে একটা মেয়েকে দেন, একটা নিজে নেন। রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট সিঁড়ি খুঁজে নিয়ে তার উপরেই বসে পড়েন দুজন।

সেটা কয়েকবার মুখে দিয়েই হো-হো করে হেসে বাবার দিকে তাকায় রুনু, ‘বাবা, তোমার মুখ কমলা হয়ে গেছে…’

জিভ বের করে নিজেরও মুখ দেখায় রুনু। সামনে হাতিবাগানের সচল রাস্তাটা পড়ে আছে। গাড়িঘোড়ার শব্দে কান পাতা দায়। তাও বাবার পাশে বসে ভারি নিশ্চিন্ত লাগে ওর। মুখের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভিতরের রাগটাও কমে আসে ধীরে ধীরে।

‘একটা কথা মনে এসেছে আমার বাবা।’ রুনু আইসক্রিম খেতে খেতে হুট করেই বলে বসে।

‘কী কথা…’

‘এই রাস্তায় সবাই কাজ করছে শুধু আমরা ফাঁকি মারছি। বাড়ি না গিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছি…আমরা কি পয়সা রোজগারে ফাঁকি দিচ্ছি বাবা?’

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়েন বাবা, ‘উঁহু, আমরা মজা করায় মন দিচ্ছি। আর যারা মজা করায় মন দেয় তারা সত্যিকারের বড়লোক…বুঝলি?’

সেদিন চেনা পথে বাড়ি ফেরে না ওরা। হাতিবাগানের মোড় থেকে অন্য গলিঘুঁজি ধরে সাইকেল চালাতে থাকেন বাবা। রুনুর মজা লাগে। একই রাস্তায় রোজরোজ যেতে ভালো লাগে না। অকারণেই দুবার সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে ও বলে, ‘আচ্ছা বাবা, এই যে তুমি রাস্তাঘাট কত কিছু চেনো, আমি বড় হয়ে গেলে আমাকে এত রাস্তা চেনাবে কে?’

‘কেন, বড় হলে আমিই শিখিয়ে দেব। নাহলে নিজেই শিখে নিতে পারবি…’

‘আমি সত্যি পারব?’

‘নিশ্চয়ই। তুই তো টাফ গার্ল। একদম অমিতাভ বচ্চনের মতো।’

আরও কিছুদূর সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে যান সঞ্জীবন। রুনু আবার পেছন থেকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা, আর একটা প্রশ্ন এসেছে মনে, করব?’

‘কর না…’

‘যে লোকগুলো আমাদের গরিব করে বড়লোক হয়েছে তুমি বড় হয়ে তাদেরকে কিছু করলে না কেন?’

সঞ্জীবনের সাইকেল থেমে যায়। কিছুক্ষণ ফাঁকা রাস্তার উপরেই সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি। তারপর নিচে নেমে মেয়েকে কোলে তুলে নেন, ‘আমি বড় হওয়ার পর একদিন তুই এলি। তারপর আর আমার যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করল না। বুঝতে পারলাম, আমার যা যুদ্ধ করার ছিল করা হয়ে গেছে। এবার অস্ত্র তৈরি করতে হবে…’

কথাটা বলে মেয়েকে আবার সাইকেলে বসিয়ে সিটে উঠতে যাচ্ছিলেন সঞ্জীবন। হঠাৎ করে বুক চেপে ধরে কাশতে শুরু করে সে। হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে গিয়ে লাল হয়ে যায় হাতটা। সেটা মেয়ের থেকে লুকাতে দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে দেন তিনি…

‘বাবা, কী হয়েছে বাবা?’ রুনু অসহায় হয়ে প্রশ্ন করে।

‘ভাই সামনে পুলিশ আছে, তোরা নেমে হেঁটে আয়। আমি এগিয়ে যাচ্ছি।’ কথাটা বলে কোনও উত্তর পেল না ঈশানী। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ওর দুই বান্ধবি একে অপরের পিঠের উপর মাথা দিয়ে পড়ে আছে।

বিরক্ত হয়ে আবার মুখ ঝামটা দেয় ও, ‘দু’হাজার টাকা খসে যাবে আমার…নাম আবালগুলো…’

মাথা নাড়ে অভিরূপা, ‘তুই আমাকে বাড়ি দিয়ে আয় ভাই। আমি মায়ের কাছে যাব।’

গার্গীর মুখটা লাল হয়ে আছে। তার তরল গলা শোনা যায়, ‘তোর কথা শুনে শালা মাল খেতে এসেছিলাম। বাড়ি নিয়ে যাবি না মানে?’

‘নিয়ে যাব না বলিনি। এইটুকুনি রাস্তা হেঁটে আয়। একে ট্রিপল ক্যারি করছি, তার উপর মাথায় হেলমেট নেই, তারপর মাল খেয়ে আছি। কত টাকার ফাইন হবে আইডিয়া আছে?’

গার্গী অভিরূপাকে আরও ভালো করে আঁকড়ে ধরে, ‘তোর শালা যদি আইডিয়া থাকত তাহলে বানচোদটার সাথে প্রেম করতে যেতিস? বড় এসেছে আইডিয়ামারানি…’

‘দেখ, এসব ফালতু কথা বলার সময় নেই। নাম তোরা।’

‘নামব না। কর তুই কী করে নিবি…’ অভিরূপা তরল গলায় বলে।

‘তাহলে গাঁড় মারা।’ বাইক থেকে নেমে ওদের দুজনকে একটা ধাক্কা দেয় ঈশানী। দুজনেই ব্যালেন্স হারিয়ে খসে পড়ে রাস্তার উপরে। মাথায় আর কোমরে চোট লাগে ওদের।

নেশার আলস্য কেটে গিয়ে রাগ আরও চড়ে যায় ওদের মাথায়, ‘শুয়োরের বাচ্চা, নেশা হয়নি বলে গরম দেখাচ্ছিস, না?’

গার্গী এগিয়ে এসে ঈশানীর চুল খামচে ধরে, ‘তোর এক কথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। রাত দশটায় পেট ভর্তি করে মাল খাওয়ালাম। আর তারপরে রাস্তার উপর ফেলে চলে যাচ্ছিস, বেইমানের বাচ্চা?’

ধাক্কা দিয়ে ওকে সরানোর চেষ্টা করে ঈশানী, ‘আমি বেইমানি করেছি?’

‘করিসনি? আমরা মরি-বাঁচি খোঁজ নিয়েছিস এতদিন? ক’বার ফোন করলে রিসিভ করেছিস? আজ এখানেই মেরে দেব শালা তোকে…’ অভিরূপা আবার ধাক্কা দেয় ওকে। ঈশানী বোঝে ওর নেশাটা বেশি চড়েছে আজকে। বড়লোকের মেয়ে, ছোট থেকে একা একা মানুষ হয়েছে। ফলে একবার কিছু মাথায় ঢুকলে করতে পারে না এমন কাজ নেই। তার উপরে এখন আবার পেটে মদ পড়েছে।

ঈশানী বাইকের উপর চড়ে বসে, ‘জেনে বুঝে নাটক করিস না। তোরা খুব ভালো করে জানতিস ও কারও সঙ্গে আমায় কথা বলতে দিত না।’

‘দিত না মানে? দাসী হয়েছিলি বাঁড়া ওর? মজা পেলি না? খুব মজা পেলি আমাদের মুখে মুতে দিয়ে?’

অভিরূপা এগিয়ে এসে চেপে ধরে ঈশানীর হাতটা। কবজি থেকে কনুই অবধি অনেকগুলো সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। কিছু পুরোনো কিছু নতুন। অনেকগুলো দাগ দাঁতের। বুক, পিঠ, থাই থেকে শুরু করে কোমর অবধি ঈশানীর সারা শরীর ভরে আছে আগুনের দাগে।

আজ সন্ধেবেলায় নতুন দাগগুলো দিয়েছে অভিষেক। ঘাড়ের কাছে দাঁতের ক্ষতগুলো এখনও ব্যথা হয়ে আছে। চুলের মুঠি ধরে এত জোরে টেনেছে যে মাথাটা ঝিমঝিম করছে এখনও।

সম্পর্কটা দীর্ঘদিন ধরেই নোংরা হয়ে গেছে। আজ ঈশানী শেষবারের মতো বলতে গিয়েছিল যে ও আর এই সম্পর্কে থাকবে না। এর আগেও বহুবার বলেছে এই একই কথা। এগুলো শুনলেই অভিষেক ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। আছড়ে কামড়ে ওর শরীরটাকে শেষ করে দিতে চায়। আজ সঙ্গে আরও দুটো বন্ধু নিয়ে এসেছিল, ওদের সামনেই দেওয়ালে চেপে ধরে হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে গেছে। বন্ধুদুটো ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসিহাসি করছিল তখন। ঈশানী কিছুই বলতে পারেনি। চোখ থেকে জল বেরিয়েছিল শুধু।

বাড়ি আসার সময় ফোন করেছিল গার্গীকে, ‘তোরা বেরোতে পারবি আজ একটু? মাল খাব।’

ঈশানীর গলা শুনে গার্গী বুঝেছিল কিছু একটা হয়েছে। বাড়িতে কোনরকমে ম্যানেজ করে বেরিয়েও এসেছিল অভিরূপাকে নিয়ে। তবে বেশি মদ খায়নি ঈশানী। হাতের জ্বালাটা যন্ত্রণা দিচ্ছে ক্রমাগত। সেটা শুধুমাত্র রামে কমবে না।

ওরা দুজন মদ খেতে খেতে কখনও ওকে গালাগাল করেছে, কখনো হাত বুলিয়েছে মাথায়, কখনো ফোন করে খিস্তি মারতে চেয়েছে অভিষেককে। ঈশানী কেবল চুপ করে বসেছিল। ওর ভিতরে অনুভূতিগুলো আজ সন্ধ্যা থেকেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার উপরে অতিরিক্ত মদ খেয়ে দুটোই হ্যাল হয়ে গেছে। এখন কোনরকমে ওদের বাড়ি দিয়ে আসতে পারলে শান্তি।

মনে মনে নিজেকেই গাল দেয় ঈশানী। ও নিজেও বাড়ি ফিরলে আজ কপালে দুঃখ আছে। আজকাল দেরি করে বাড়ি ফিরলে মায়ের বাক্যবাণ শতছিন্ন করে দেয় ওকে।

ও দুজনকে শান্ত করার চেষ্টা করে, ‘দেখ, আমাকে নিয়ে তোদের যা অভিযোগ সব বাড়ি গিয়ে করবি। রাস্তাটা এসব করার জায়গা নয়…’

‘কেন? কেন করব না? এই যে…’ নাটকীয় ভঙ্গিতে ঈশানীর দিকে হাত মেলে দেয় গার্গী, ‘ইনি হচ্ছেন দি গ্রেট বিল্পবী ঈশানী প্রামাণিক, ছোটবেলা থেকে যাকে স্কুলে-কলেজে সবাই ভয় পেত, ছেলেরা চোখ তুলে দেখতে সাহস পেত না, স্যারেরা বকাঝকা দেওয়ার আগে দুবার ভাবত, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বস্তির জানোয়ার ছেলের সিগারেটের ছ্যাঁকা খেল আর একটাও শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না…’ ঈশানীর দিকে ফিরে তাকায় গার্গী, ‘তোর লজ্জা করল না রুনু?’

‘করেছে লজ্জা…’

গার্গী শুনতে পায় না কথাটা, ‘কী বললি?’

‘করেছে লজ্জা!’ চিৎকার করে ওঠে ঈশানী, ‘বেঁচে থাকতে লজ্জা করে আমার। যদি পারতাম আগুনে পুড়ে মরতাম। কিন্তু পারি না…তাই ছ্যাঁকা খাই, দিনের পর দিন খাই। কী করব বল? আজ তোদের এই মাতাল অবস্থায় বাড়ি পৌঁছানোর সময় তোদের বাপ-মা-দাদা যে দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইবে তাতেও লজ্জা লাগবে, কী করব আমি?’

গার্গী আর অভিরূপা আর কিছু বলে না। বাধ্য পুতুলের মতো ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। হেলমেটটা মাথায় গলিয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দেয় ঈশানী।

ওদের দুজনকে বাড়ি পৌঁছে ঈশানী যখন বাড়ি ঢুকল তখন রাত বারোটার কাছাকাছি। ওর সারা শরীরে মদের গন্ধ। সেই সঙ্গে কাটা ছেঁড়া দাগ। জামাকাপড় দু-এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। সেগুলো ঢাকা দেওয়া মুশকিল।

স্কুটিটা বাইরে পার্ক করে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে মায়ের ঘরে উঁকি দিল ঈশানী। টেবিলের উপর খাবার রাখা নেই। তার অবশ্য দরকার হবে না। তেমন খিদে পাচ্ছে না ওর। কিন্তু মা আজ এত চুপচাপ? ওর সাড়া পায়নি নাকি?

বাবার ঘরের বাইরে ঝুলন্ত আয়নার সামনে এক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়ায় ঈশানী। উশকোখুশকো চুলগুলো ঠিক করে নেয়। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকে আসে।

দরজা খুলে দেখে কমলিকা শুয়ে আছেন বিছানায়। গলা অবধি চাদর মুড়ি দেওয়া। একটু অবাকই লাগে ঈশানীর। এখন তো চাদর মুড়ি দেওয়ার মতো ঠান্ডা পড়েনি।

ও এগিয়ে এসে হাত রাখল মায়ের কপালে। ছেঁকা লাগল হাতে। সঙ্গে সঙ্গে এক চটকায় হাতটা সরিয়ে দিলেন কমলিকা।

‘এ কী! তোমার তো জ্বর, ওষুধ খেয়েছ?’ গায়ে হাত রেখে বলল ঈশানী।

‘তোকে জানতে হবে না। গিয়ে শুয়ে পড়।’

‘ফোন করে তো বলবে একবার আমাকে! আমি চলে আসতাম।’

‘বললাম তো, ভাবতে হবে না।’ কথাটা বলে চাদরটা আবার গায়ে টেনে নেন কমলিকা।

ঈশানী টেবিলের ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার নিয়ে এসে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, ‘বলে রেখেছি ওষুধপত্র সব আমার ড্রয়ারে থাকে। জ্বর এলে অন্তত একটা খেয়ে নেবে।’

‘ভয় লাগে হাত দিতে। জীবনে যা ফুর্তি করছিস তাতে কন্ট্রাসেপ্টিভ ছাড়া অন্য কিছু রাখিস বলে তো মনে হয় না।’

একটা হাত দিয়ে মায়ের শরীরটা তুলে খাটের একদিকে সোজা করে বসায় ঈশানী। আবার একটা ধাক্কায় এক হাত ছিটকে আসে ওর, ‘জামাটা বদলে আয়। মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।’

‘ওষুধটা খাও, আমি চেঞ্জ করে আসছি।’

ওষুধটা হাতে নিয়ে মুখে পুরে দেন কমলিকা, গলায় জল ঢেলে সেটা গিলে নিয়ে বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় তোর বাবা ভাগ্যিস আগে চলে গেছে, না হলে তাকেও এসব দেখতে হত…’

মায়ের মুখে থার্মোমিটার গুঁজে দেয় ঈশানী। খানিকটা যেন তাকে চুপ করানোর জন্যেই। ঘড়ির দিকে নজর রাখে সে।

‘মদ খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। ভালো লাগে না আর। আজ একটু দরকার পড়ে গেল বলে…তোমার যদি কাল শরীর খারাপ লাগে বোলো, অফিসটা যাব না তাহলে…’

মুখ থেকে থার্মোমিটার সরিয়ে ফেলেন কমলিকা, ‘কী করবি বাড়িতে বসে? আমার সেবা?’

‘না, দেখব।’

‘কী দেখবি?’

‘তোমাকে আফসোস করতে। আমাকে জন্ম দিয়েছিলে বলে।’

‘তো হবে না আফসোস?’ কমলিকার মুখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ে, ‘যার তার বিছানায় ল্যাংটো হওয়া মেয়ের জন্ম দিয়েছি।’

ঈশানী কয়েক পলক নিঃস্পৃহ চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে, ঠোঁটদুটো কেঁপে ওঠে কয়েকবার, ‘তোমার সামনে কি ল্যাংটো হয়েছি মা?’ মাটির উপর দুটো হাঁটু রেখে মায়ের পায়ের কাছে বসে ঈশানী, ‘তুমি জানো আমার গায়ে কতগুলো ক্ষত আছে? পেটে আর বুকে আমি কতবার ব্লেড চালিয়েছি? যাতে যন্ত্রণাটা পাই। ওগুলো তুমি দেখতে পাও না।’

কমলিকা চুপ করে থাকেন। ওর শরীরের উত্তাপ ঘরের ভিতরেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। মাথার ফেট্টিটা খুলে পাশে নামিয়ে রাখে ঈশানী, ‘তুমি ভুলেই গেছ আমায় মা। তাও এসবের জন্য আমি তোমায় দোষ দিই না। আমি কী করব বলো? আমি তোমার পছন্দের বার্বি ডল হতে পারিনি। আমি তোমার সেই মেয়েটা হতে পারিনি যাকে তুমি ভালোবাসতে পারতে…’ মাটিতে বসেই একটু এগিয়ে মায়ের পায়ের পাতা চেপে ধরে ঈশানী, ‘কিন্তু প্লিজ এটুকুনি বোঝ, আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। ভালো হই, খারাপ হই, নোংরা হই, আমাকে নিয়ে চালাতে হবে তোমাকে। আই অ্যাম সরি মা, কিন্তু আমাকে নিয়েই চালাতে হবে তোমাকে…’

উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়েন কমলিকা। ঈশানী উঠে পড়ে মেঝে থেকে। কিছুক্ষণ সেভাবেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। সারা গা থেকে উগ্র মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। আসার সময় অভিরূপা একবার বমি করেছিল ওর গায়ে, সেটাও মিশে আছে সেই মদের সঙ্গে। এক্ষুনি স্নান করা দরকার।

ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাথরুমে চলে যায় ঈশানী। জামাকাপড় খুলে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ঝিমঝিমিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ওর মাথা থেকে বুকে, পেটে…সিগারেটের দাগ ছাইয়ের মতো ধুয়ে গিয়ে শুধু ক্ষতগুলো জেগে থাকে। বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখে ঈশানী।

একটা গান ভেসে আসছে কোথা থেকে যেন। হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটখাটো লোক। অঞ্জন দত্তর গান। বাবা খুব শুনত এই গানটা। ছোট ক্যাসেটে গান চালিয়ে বাপ-মেয়েতে শুয়ে পড়ত বিছানায়। তারপর সারাদুপুর বাবার বুকের কাছে শুয়ে অঞ্জন দত্তর গান শুনত ঈশানী। কবে যেন হারিয়ে গেছে সেই পুরোনো ক্যাসেটগুলো। এখন লোকে আর সেই ক্যাসেটে গান শোনে না। অঞ্জন দত্তকেও দেখতে কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে।

তেল আর সাবান যেখানে রাখা থাকে সেখান থেকে একটা ব্লেড হাতে তুলে নেয় ঈশানী। জল ধুয়ে দিচ্ছে ওর হাতটা। মোটামুটি আন্দাজে শিরাটা খুঁজে নিয়ে তার কাছাকাছি ব্লেডটা নিয়ে যায় ও। কিছুক্ষণ সেখানেই ধরে থাকে…

এখনও গান আসছে। হরিপদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অন্য গ্রহ থেকে আসা কিছু বিচিত্র জীব। হরিপদ স্পেসশিপে ওঠার আগে ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ঈশানীর জন্য। কার্নিশ বেয়ে নেমে আসা এলিয়েনরা অপেক্ষা করছে, বিরক্ত হচ্ছে, ঠিক শাওয়ারের শোঁশোঁ শব্দের মতোই আওয়াজ করছে ওদের স্পেসশিপ, দেরি হয়ে যাচ্ছে…

কেউ কোনও দিন তার খোঁজ করেনিকো আর

ছিল নাকো কেউ তার কোনও খোঁজ করবার

কেউ করেনিকো কোনও শোক

গানটা শেষ হওয়ার আগেই জানলা দিয়ে ব্লেডটা বাইরে ফেলে দেয় ঈশানী। তারপর স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে আয়নায়। হরিপদ ওকে ফেলেই চলে যায়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *