তৃতীয় অধ্যায়
‘আপনাদের এখানে সিসিটিভি নেই, তাই না?’ ইনস্পেক্টর বিশ্বাস পুকুরপাড়টা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলেন।
‘সিসিটিভি বলতে…’ নাদু নস্কর গলা চুলকে বলল, ‘আগে একবার লাগানোর কথা হয়েছিল। কিন্তু গ্রাম সাইড তো, অত গুরুত্ব দিইনি। তারপর তো চোর ছ্যাঁচড়ের উৎপাত…কখন কী হয়ে যায়…’
‘হয়ে গেল তো?’ বাঁকা স্বরে কথাটা বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হরির দিকে তাকালেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। সে অনেকক্ষণ থেকেই মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলাচ্ছিল। চোখে চোখ পড়তেই যেন আরও কিছুটা জড়সড় হয়ে দাঁড়াল।
‘আশেপাশে সবটাই তো ফাঁকা মনে হচ্ছে। আপনারা বাজার দোকান করেন কোথা থেকে?’
‘আজ্ঞে বারো কিলোমিটারের মধ্যে আর কিছুই নেই। শুধু এই জঙ্গল। বাবুই বাইকে করে গিয়ে সকালবেলা বাজার করে আনেন। তাছাড়া ওই পেছনে খেত আছে। সবজিপাতি যা লাগে ওখান থেকেই হয়ে যায়।’
ঘণ্টাখানেক আগেই বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের লোকজন এসে পুকুরপাড় থেকে বাঁশবন অবধি খুঁটিয়ে দেখেছে। কোথাও উল্লেখযোগ্য কিছুই প্রায় পাওয়া যায়নি। দুজন হাবিলদার গোছের লোক ক্যাম্পের একদিকে দুটো টুলের উপরে বসে ঢুলছিল। এতক্ষণ ইনস্পেক্টর বিশ্বাস তাদের সঙ্গে কিছু কথা বলছিলেন। আপাতত পুকুরপাড়টা সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন তিনি। তাকে অনুসরণ করছেন নাদু নস্কর আর হরি। আর একটা লোক খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে ওদের ঠিক পেছনেই। এই লোকটার সঙ্গে একটু আগেই পরিচয় হয়েছে ইনস্পেক্টরের। অন্য তাঁবুর গেস্ট।
ক্যাম্পের দরজার পাশে রাখা নাদু নস্করের বাইকটার দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে নিলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘রাতে ওই সদর দরজাটা আপনারা বন্ধ করেছিলেন, তাই তো? তারপর থেকে আর খোলা হয়নি?’
‘আজ্ঞে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমিই খুলে পুকুর ধারে গেছিলাম। রাতে যেমন লাগিয়ে গেছিলাম সকালে তালা তেমনই ছিল। একটা আঁচও পড়েনি।’
পরের কথাটা ইনস্পেক্টর বিশ্বাস একটু চাপা স্বরেই বলেন, ‘মানে বাইরে থেকে দরজা খুলে কেউ ভিতরে আসেনি। অবশ্য বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে আসা কঠিন কিছু না। তাও…’
কথাটা শেষ না করেই আবার নাদু নস্করের দিকে ফেরেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘কাল রাতে আপনারা দুজন কোথায় ছিলেন?’
নাদু নস্কর আগের মতোই একবার গলা চুলকায়। তারপর টেবিলের উপর হাত ঘষে বলে, ‘আজ্ঞে আমাদের রোজই ঘুমাতে ঘুমাতে লেট হয়। সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাসন ধুয়ে, আরও টুকটাক কিছু কাজ করে শুতে শুতে বারোটা বেজে যায়। কিন্তু কাল দুজনেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওই ধরুন এগারোটার মধ্যে…’
‘কেন? কাল একটু বেশি পরিশ্রম গিয়েছিল?’
দুদিকে মাথা নাড়ে নাদু, ‘আজ্ঞে না, সত্যি কথা বলতে অন্য দিন এর থেকে বেশি পরিশ্রম হয়।’
‘তাহলে কাল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন?’
নাদুকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়। যেন প্রশ্নটার তেমন জোরাল উত্তর সে নিজেও হাতড়াচ্ছে, ‘কী জানি স্যার, মাথাটা বড্ড ব্যথা ব্যথা করছিল। মনে হল সারা শরীর জুড়িয়ে আসছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে…কীরে হরি, বল না…’
ইনস্পেক্টর বিশ্বাস আর তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেন না, পুকুরের অন্য প্রান্তটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘বাদ দিন, কালকে রাতে আর অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি?’
‘অস্বাভাবিক কিছু…’ কথাটা বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত করে নাদু নস্কর, ‘একটা ব্যাপার চোখে পড়েছে স্যার। কিন্তু তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও যোগ আছে কিনা…’
‘কী চোখে পড়েছে?’
‘মাসছয়েক আগে আমাদের ওই পেছনের খেতে কাকতাড়ুয়া লাগিয়েছিলাম। কাল বিকেলে খেতে গিয়েও দেখিছি ওটা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজ গিয়ে দেখলাম নেই।’
‘নেই মানে? মাটিতে পড়ে আছে?’
‘আজ্ঞে না, কোথাও নেই।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ বিড়বিড় করেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘যদি কেউ খুন করেই থাকে, সে একটা কাকতাড়ুয়া সরিয়ে কী করবে, কত বড় ছিল কাকতাড়ুয়াটা?’
‘ফুট ছয়েকের বেশি হবে। একটা হাঁড়ি, দুটো বাঁশ, কিছু বিচালি আর একটা জামা চাপিয়ে আমিই বানিয়েছিলাম।’
‘বেশ, কাকতাড়ুয়া গায়েব হওয়া। আর কিছু?’
হরি অনেকক্ষণ ধরে কী একটা বলার জন্য উশখুশ করছিল। নাদু নস্কর ওর হাত ধরে টিপে দিতে থেমে যায়। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস আবার নাদু নস্করের দিকে তাকালেন, ‘এখানে বাইরে থেকে টুরিস্টরা ছাড়া আর কে আসে?’
‘আসে বলতে গেস্ট বেশি থাকলে আমাদের দুজনের পক্ষে সামলানো একটু কঠিন হয়। তখন ভবা আসে।’
‘সেটা কে?’
‘ঝাঁটফাট দেয়, মাঝে মাঝে রান্নাও করে। তাছাড়া একজন বাউল আসে মাঝে মাঝে, চরণদাস…’
‘এই নির্জন প্রান্তরে বাউল কী করে?’
‘ক্যাম্পফায়ার হয় তো মাঝেমধ্যে। তো সেখানে কেউ কেউ বাউল গান শুনতে চায়। ফোন করলে আসে, আবার মাঝে মাঝে এমনি এমনিও আসে। বায়না না থাকলে নিজের মতো মাঠে বসে গান-বাজনা করে চলে যায়।’
‘কাল রাতে এদের দুজনের কেউ এসেছিল?’
দুপাশে মাথা নাড়ে নাদু নস্কর, ‘বাউলটা অনেকদিন হল আসে না। ডাকও পায় না তেমন। আজকাল তো লোকে ইস্পিকার টিকার নিয়েই আসে। মাথাতেও একটু গোলমাল আছে স্যার। মাঝে মাঝে উল্টোপালটা গল্প বলে, কেউ ওর কথা বিশ্বাস করে না। শিল্পী মানুষ তো, তাই একটু মাথা খারাপ। তবে ভবার আজ সকালে আসার কথা ছিল। যেরকম নোংরা করেছিল এরা…’
এই সময়ে পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকান ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। ওদের পেছনে থাকা লোকটা আপাতত জোরে পা চালিয়ে কাছাকাছি এসে পড়েছে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস তাকে দেখতে পেয়ে থামলেন, ‘আপনি সুব্রত ঘোষ?’
লোকটা উপরে নিচে মাথা নাড়ায়, ‘ফ্যামিলি নিয়ে ছুটি কাটাতে এসেছিলাম, দেখুন কী হয়ে গেল!’
‘আপনিও তো কাল রাতে এখানেই ছিলেন, কিছু দেখতে পাননি?’
ভদ্রলোক মনে হয় এ প্রশ্নটার উত্তর মনে মনে তৈরি করেই এসেছিলেন, সেটা একবার গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বারোটা বাজতেই আমরা ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিলাম সবাই। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসেছি। আমাদের তো আর মদটদের ব্যাপার নেই।’
‘বারোটা? মানে দশটার পর আরও দুঘণ্টা আপনারা বাইরে ছিলেন। তাও আবার মদ না খাওয়া অবস্থায়, কিছু দেখেননি?’
চারজন পুকুরের ধার দিয়ে আবার ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে শুরু করে, ‘দেখেছি বলতে মেয়ে তিনটে প্রথমে একটা টেবিলে বসে মদ খাচ্ছিল। আর ওই গল্পগুজব, হাসাহাসি যা হয় আর কী। যে মেয়েটা মারা গেছে সেই চিৎকার চেঁচামেচি করছিল বেশি। তারপর একজন মনে হয় বাইরে, বেড়ার ওপারে কী একটা দেখতে পায়…’
‘মানে বাঁশবনের ভিতর! কী দেখতে পায়?’
‘তা বলতে পারব না। কিন্তু দেখেই চিৎকার করে ওঠে। বাকি দুজনও সেদিকে তাকায়। তারপর তিনজনে মনে হয় ঝগড়া করছিল। নোংরা খিস্তিখাস্তা, আমার এই বয়সে আর ওসব ভালো লাগে না…তারপর মনে হয় জঙ্গলেও গেছিল।’
‘অত রাতে তিনটে মেয়ে জঙ্গলে গেছিল? আপনি জানালেন কী করে?’ বিশ্বাস একটু সন্দেহের গলাতেই বলেন।
হাত বাড়িয়ে নিজের কটেজের জানলাটা দেখান সুব্রত ঘোষ, ‘আমার একটু সিগারেটের নেশা আছে। তো ওই জানলায় বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তখনই দেখলাম জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে।’
‘সবাই?’
একটু মনে করার চেষ্টা করেন সুব্রত ঘোষ, তারপর বলেন, ‘অত মনে নেই। তবে দুজনকে দেখেছিলাম। আর একজন মনে হয়…’ দৃশ্যগুলো গুলিয়ে যায় তার মাথায়।
‘দুটো মেয়ে অত রাতে জঙ্গলে যাচ্ছে, আপনি বাধা দেননি?’
সুব্রত ঘোষ অপ্রস্তুতে পড়েন, ‘আমি কী বলব? এখানে সবাই ফুর্তিফার্তা করতে আসে। তার উপর আজকালকার শহুরে মেয়ে, মাতাল, কিছু বলতে গেলে যদি…’
‘বুঝতে পেরেছি, তারপর?’
‘তবে আমার কৌতূহল যে হচ্ছিল না বললে ভুল হবে। আমি জানলা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকিয়েছিলাম। ওরা মনে হয় ফোনে টর্চ জ্বালিয়েছিল। ফলে জঙ্গলের মধ্যেই আছে বুঝতে পারছিলাম…’
‘আপনার সঙ্গে কে ছিল তখন?’
‘কেউ না। আমার স্ত্রী আর ছেলে আগেই ঘরে ঢুকে গেছিল।’
‘বেশ, তারপর কী হল?’
‘মেয়েগুলো হইচই করতে করতে জঙ্গলে ঢুকল। চারপাশটা এতটাই নিস্তব্ধ ছিল যে দূর থেকেই ওদের কথাবার্তা কানে আসছিল। ওরা তিনজনে কিছু একটা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল।’
‘কী দেখেছিল সেটা দেখতে পাননি, তাই তো?’
‘আজ্ঞে না। বাঁশবনের বেশ কিছুটা ভেতরে চলে গিয়েছিল ওরা। আবছা আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। ছেলে হলে হয়তো পিছু নিতাম। কিন্তু মেয়ে তো, তার উপর আমার বউ আবার একটু…’
নাদু নস্কর এতক্ষণ মন দিয়ে সবটা শুনছিলেন। এবার খানিক জোর করেই হেসে বললেন, ‘মেয়েগুলো একেবারে গলা অবধি মদ গিলেছিল স্যার। অত নেশা করলে অন্ধকারে এটা-ওটা দেখতে পাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। মনে হয় তাই থেকেই…’
কথাটায় তেমন গুরুত্ব দিলেন না ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘তারপর?’
‘তারপর বুঝলাম ভিতরে একটা হট্টগোল হচ্ছে। কীসব যেন আওয়াজ আসছিল ভিতর থেকে। মিনিট পনেরো সেভাবেই কাটল। ভয় করল আমার। গভীর রাতে বাঁশবনের ভিতর মেয়েগুলো কোনও বিপদে পড়ল না তো?’
‘তারপর?’
‘তারপর সব আওয়াজ থেমে গেল স্যার। ওরা মনে হয় ফিরেও এসেছিল। আমি আর অত গা করিনি। ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিলাম।’
ইনস্পেক্টর বিশ্বাস পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছছিলেন। রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে চারপাশে তাকাতেই একটা বছর দশেকের বাচ্চাকে গাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চে বসে পা দোলতে দেখলেন। সুব্রত ঘোষকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওটা আপনার ছেলে?’
‘হ্যাঁ স্যার…’
হাতের লাঠিটা কোমরে গুঁজে সেদিকে এগিয়ে গেলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। ছেলেটার মুখটা ভারি মিষ্টি। একেবারে বাপের মতোই চেহারা তার। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে পাশে বসতে দেখে সে একটু জড়সড় হয়ে বসল। তার পিঠে একটা হাত রেখে বিশ্বাস বললেন, ‘কাল রাতে তুমি ঘুম থেকে উঠেছিলে একবারও?’
ছেলেটা একবার বাবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার গরম লাগছিল বলে উঠেছিলাম।’
‘তো গরম কমানোর জন্য কী করলে?’
‘বাইরে এলাম।’
‘আচ্ছা? বাবা মা কী করছিল তখন?’
‘ঘুমাচ্ছিল।’
‘বাইরে এসে তুমি কী দেখলে?’
ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর কী যেন ভেবে বলল, ‘দুটো দিদি ওইখানে চাতালে শুয়েছিল। একটা দিদি মরে গেছিল…’
শব্দটার মধ্যে একটা ধাক্কা ছিল। সোজা হয়ে বসলেন বিশ্বাস, ‘মরে গেছিল? কী করে বুঝলে?’
‘সারা গায়ে রক্ত ছিল। একদম মরার মতো পড়েছিল ওখানে। আর একটা দিদি ওর পাশেই শুয়েছিল। প্রথমে কাঁদছিল খুব। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ও মরেনি…’
‘তারপর?’
‘তারপর আমার খুব ভয় পেল। আমি ঘরে চলে এলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।’
‘আচ্ছা! অত রক্ত দেখে ভয় পেয়েছিলে, তাই তো?’
ছেলেটা দুদিকে মাথা নাড়ে, ‘রক্ত দেখে পাইনি।’
‘তাহলে?’
‘যে দিদিটা মরে গেছিল সে একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল…’
সুব্রত ঘোষ এগিয়ে এসে ছেলের পিঠে একবার চাপড় মারেন, ‘কী যা-তা বলছিস!’ বিশ্বাসের দিকে ঘুরে বলেন, ‘ও একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ, বুঝতেই পারছেন…কাল রাতে ওরা কান্নাকাটি করছিল সেটা আমিও শুনেছি স্যার। কিন্তু আমার ছেলের এসব আজগুবি কথা…’
‘ভয়ে ভুল দেখেছে বুঝতে পারছি, কিন্তু…’ ছেলেটার মুখের উপরে আবার ঝুঁকে পড়েন বিশ্বাস, ‘কোন দিদিটার গায়ে রক্ত ছিল বলতে পারবে?’
‘ওই যে ফেট্টি আছে যার মাথায়…’
সুব্রত ঘোষ স্বগতোক্তির মতোই বললেন, ‘ও যে এসব দেখেছে সকাল থেকে আমাদের বলেনি স্যার…এই এখন…’
‘অনেক সময় বাচ্চারা পরিচিত লোকেদের বলতে চায় না। জানে বিশ্বাস করবে না, যাক গে…’ নাদু নস্করের দিকে ফিরে তাকালেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘আপনারা এখানে রক্তের দাগ টাগ কিছু পাননি?’
দুদিকে মাথা নাড়লেন নাদু নস্কর।
‘যে জায়গার কথা ও বলেছে সেখান থেকে আপনাদের ঘরের দূরত্ব মিটারকুড়ির বেশি না। আপনারা কেউ এত কান্নাকাটির কিছু শুনতে পেয়ে বাইরে এলেন না?’
‘মদ খেয়ে মেয়েরা কান্নাকাটি করবে এতে আশ্চর্যের কী আছে স্যার? তাই আমরা শুনেও গা করিনি।’
পেছন ফিরে একবার নাদু নস্কর আর হরির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলেন সুব্রত ঘোষ। তারপর বিশ্বাসের কাছে সরে এসে চাপা গলায় বললেন, ‘উনি কিন্তু একটা কথা আপনার কাছে চেপে যাচ্ছেন।’
‘কী কথা?
‘ওই যে বাউলটার কথা উনি বলছিলেন, ও কাল রাতে এখানে এসেছিল। সারাদিন ছিল না, কিন্তু রাতে ছিল।’
‘তাই নাকি? আপনি দেখেছেন তাকে?’
‘দেখিনি, শুনেছি। আমি এমনি গান শুনতে শুনতে ঘুমাই। কালও ঘরে ঢুকে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনছিলাম। এমন সময় মনে হল বাইরে থেকে দোতারার আওয়াজ আসছে। ভাবলাম কান বাজছে হয়তো। ইয়ারফোন খুলে ভালো করে শুনে বুঝলাম সত্যি একটু দূর থেকেই আসছে আওয়াজটা। এখানে আর কাউকে দোতারা বাজাতে শুনিনি। ফলে বুঝতে পারলাম বাউলটাই এসেছে।’
‘বাইরে বেরিয়ে আর দেখেননি, তাই তো? তারপর?’
নাদু নস্কর আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের ক্যাম্পে একটা দোতারা আছে বটে স্যার…কিন্তু আমরা কেউ বাজাতে পারি না।’
‘হুম…’ ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে চিন্তিত দেখাল।
দুদিকে মাথা নাড়লেন সুব্রত ঘোষ, ‘তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালবেলা এদের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙার আগে অবধি আর কিছুই জানি না।’
পাড়টা খুব একটা শক্তপোক্ত না। তার উপরে কদিন আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। মদ্যপ অবস্থায় পাড়ে এসে পা হড়কে পড়ে যাওয়াটা বিচিত্র নয়। তবে জল তেমন একটা গভীর নয়। অন্তত সাঁতার জানে এমন কেউ সে জলে ডুবে মারা যাবে এটা একেবারেই অসম্ভব। কথার ফাঁকে যুক্তিগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।
‘আপনার কী মনে হচ্ছে স্যার?’ সাব ইনস্পেক্টর মানিক এতক্ষণ চারপাশটা ঘুরে দেখছিল। সে বিশ্বাসের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে।
ঠোঁট দিয়ে চুকচুক করে একটা আওয়াজ করলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘খুন যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে সবটা পোস্টমর্টেমের পরেই বোঝা যাবে। গলা টিপে না খুন হলে তাতে সাধারণত গলায় দাগ পড়ে না। এক যদি না খুনির হাতে ভীষণ জোর থাকে এবং খুব দ্রুত অতিরিক্ত প্রেশার দেওয়ার দরকার পড়ে। এখানে যেহেতু তাই হয়েছে, ফলে ধরে নেওয়া যায়…আপনি কী করেন?’
শেষ প্রশ্নটা আচমকাই ধেয়ে এসেছে সুব্রত ঘোষের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্য থতমত খেয়ে আবার মুখে আগের হাসিটা ফিরিয়ে আনলেন তিনি, ‘আজ্ঞে সরকারি কলেজে ইতিহাস পড়াই। কলকাতায়। হালকা রিসার্চ টিসার্চও করতে ভালো লাগে। সেই জন্যেই এই জায়গাটা ঘুরতে আসা…’
‘এই জায়গায় আবার কোনও ইতিহাস আছে নাকি?’
সুব্রত ঘোষকে চিন্তিত দেখায়, ‘ঠিক ইতিহাস বলা যায় না। তবে বছর পঞ্চাশেক আগে, আই মিন নকশাল পিরিয়ডে এ এলাকা নকশালরাই আবিষ্কার করে। ওই অ্যাবানডানড বাড়িগুলোই জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকার আদর্শ জায়গা। তার আগে ধরুন নবাবী আমলের সময়ে…’
নাদু নস্কর দুম করেই কথা কেটে দেন, ‘নেটে খুঁজলে দেখতে পাবেন স্যার, এই জায়গাটা নিয়ে কতরকম কথা চালু আছে। মাঝে মধ্যেই লোকজন কীসব যেন দেখতে পায়। আমাদের হরির বউও একবার এসেছিল এখানে, থাকতে পারেনি বেশিদিন। থাকলেই নাকি গা’টা ভারভার লাগে। আমার কী মনে হয় স্যার…’
বাকি কথাগুলো শোনার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে করলেন না ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। লোকটার কথার মধ্যে কেমন একটা গায়ে পড়ে গুজব রটানোর মতো ভাব আছে। বেশিক্ষণ শুনলে মনে হয় মিথ্যে কথা বলছে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছে ওরা। ক্যাম্পে ঢোকার দরজাটা একবার নিচু হয়ে পরীক্ষা করেন বিশ্বাস। কোনও রক্তের দাগ চোখে পড়ে না। কাল রাতে এখানে আদৌ কিছু হয়েছে বলে মনেই হয় না তার।
‘আপনি এখন ঘরে যান, আমাদের দরকার পড়লে আবার ডেকে নেব, কেমন?’
আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন সুব্রত ঘোষ। তার স্ত্রীর উৎসুক মুখটা জানলার কাছ থেকে একবার দেখা দিয়েই সরে গেল।
ওদের ঘরের ঠিক পাশেই ঈশানীদের কটেজ। একটু হেঁটে সেদিকে এগিয়ে এলেন তিনি। মেয়েদুটো আপাতত ঘরেই আছে। এখানে এসে সবার আগে ওদেরই বয়ান নেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই ওরা। গলায় একটা শব্দ করে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।
ঈশানী আর গার্গী বিছানার উপরেই শুয়েছিল। চোখের পাতা খোলা। একদিকের জানলা ধুয়ে আসা আলো ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে ওদের গায়ের উপরে এসে পড়েছে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসে ঈশানী। মুখের উপরে একবার হাত চালিয়ে নেয়। মাথার ফেট্টিটা চোখের উপর নামিয়ে এনেছিল। সেটা আবার কপালে তুলে নিয়ে মাটির দিকে চেয়ে বসে থাকে।
‘আপনাদের আজ দুপুরের মধ্যেই কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওর বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছে।’ বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।
‘জানি, কথা হয়েছে আমাদের। ওর বডিটা…’
‘পোস্টমর্টেমে গেছে। সেখান থেকে একেবারে কলকাতা চলে যাবে। আপনারা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তো?’
‘হ্যাঁ ওরই গাড়ি ছিল। আমি চালিয়ে এনেছিলাম।’
অন্য মেয়েটা এখনও আগের মতোই শুয়ে আছে বিছানায়, ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের গলার স্বর একটু নরম হল, ‘স্টেটমেন্ট আপনারা অলরেডি দিয়েছেন, ফলে এখন আর বিরক্ত করব না, শুধু কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আপনাদের কাছে।’
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘কাল রাতে জঙ্গলে গেছিলেন আপনারা? আই মিন ধরুন ওই এগারোটার দিকে।’
ঈশানী একটু ভাবার চেষ্টা করে, তারপর কাঁধ ঝাঁকায়, ‘গিয়ে থাকতে পারি, আমার যেতে ইচ্ছা করছিল, এটুকু মনে আছে।’
‘ইচ্ছা করছিল কেন?’
ঈশানীর ক্লান্ত মুখে হাসি ফোটে, ‘ছোট থেকে বাঁশবনে ভূতের গল্প শুনে এসেছি, কলকাতায় থাকতে কি আর চাইলেই রাতে বাঁশবনে যাওয়া যায়?’
‘আপনাদের কোথাও কোনও আঘাত লেগেছিল কাল রাতে? মানে এমন কিছু যা থেকে রক্ত বের হয়?’
একটু অবাক হয়েই ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের দিকে তাকায় ঈশানী, ‘কই না তো, গার্গীও তো তেমন কিছু বলেনি আমাকে।’
দু’সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। তারপর ঘরের দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন, ‘বেশ, আজ দুপুরে আপনারা ফিরুন। তবে দরকার পড়লে আবার ডেকে পাঠাব। তখন এতটা উজিয়ে আসতে হবে কিন্তু। হুট করে না জানিয়ে কোথাও যাবেন না, কেমন?’
বিশ্বাস বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে একটা প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ালেন, ‘ওকে কেন খুন করা হল বলতে পারবেন?’ পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটা উঠে বসেছে এতক্ষণে।
‘সেটা এক্ষুনি বলা শক্ত। দাগগুলো দেখে যতদূর মনে হচ্ছে আগে গলা টিপে খুন করে তারপর জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাইমারিলি দেখে যা বুঝলাম তাতে মেয়েটার সঙ্গে কোনও ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট হয়নি। স্রেফ গলা টিপে খুন করা হয়েছে। মদ খাচ্ছিল যখন পয়সাকড়িও কাছে খুব একটা ছিল না আই গেস। গলায় চেন জাতীয় কিছু…’
‘ছিল না। মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন সব এখানেই রাখা আছে।’
‘দেন পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমি আসছি এখন। আপনারা রেস্ট নিন।’
ইনস্পেক্টর বিশ্বাস ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বিছানার উপর উঠে বসে গার্গী। ঈশানী এবার মাথার রগদুটো টিপে ধরে, ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার একটু একটু মনে পড়ছে, জানিস?’
‘কী?’
‘কাল রাতে আমি চিৎকার করছিলাম। তোদেরকে চিৎকার করে বলেছিলাম—তোরা কেউ আমাকে ছেড়ে যাস না…’ কথাটা বলে আবার নিজের চুল খামচে ধরে ঈশানী, ‘আমি? না তুই? নাকি…তিনজন একসঙ্গেই চিৎকার করছিলাম মনে হয়…’
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরায় গার্গী, মাথা নিচু করে বলে, ‘বাড়ি গিয়ে কী বলি বল তো? অভির বাড়িতে…’
‘তোকে কিছু বলতে হবে না। সোজা নিজের বাড়ি ঢুকে যাবি। যা বলার আমি সামলে নেব।’
করুণ হাসি হাসে গার্গী, ‘তুই চিরকাল এরকমই রয়ে গেলি।’
‘কীরকম?’
‘এই সব কিছু আমি সামলে নেব ব্যাপারটা। সব কিছুতে তোকে হিরো হতে হবে…একরকম নেশার মতো হয়ে গেছে।’
ঈশানীর মুখে একটা অপরিচিত হাসি খেলে, ‘জীবনে জাস্ট একবার যদি সত্যি সত্যি হিরো হয়ে যেতাম না, আর এই নেশাটা থাকত না। হতে পারিনি বলেই…’
‘আজ থেকে শালা ভিলেন হয়ে যাব। আজকের পর থেকে সব পাল্টে যাবে, লোকে সন্দেহের চোখে দেখবে, জ্যান্ত মেয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেমে কাটাছেঁড়া লাশ নিয়ে এলাম।’
‘ধুর, কিছু পাল্টাবে না…’ একহাতে মুখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরায় ঈশানী, ‘ও শালা দু’দিন হইচই হবে। তারপর আবার যে কে সেই। সিনেমার সুপার হিরো আর সুপার ভিলেনদের সঙ্গে আমাদের একটাই তফাত। আমরা কেউ বেশি দিন হিরো আর ভিলেন হয়ে থাকতে পারি না…’
‘অভিকে ভুলে যাবে সবাই। আমরাও…’
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে ঈশানী। টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা জিনিসপাতি ব্যাগের ভিতর ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘এই বেঁচে থাকাটা অনেকটা আকণ্ঠ মদ খাওয়ার মতো। যতদিন বেঁচে আছ সবাই মনে রাখবে। বুকের ধুকপুকুনিটা কমে গেলেই ভুলে যাওয়া শুরু। মাথা থেকে একবার নেশা নেমে গেলে ওই ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যের মতো মনে পড়ে কেবল…’
সিগারেটে লম্বা টান দেয় গার্গী, ‘তাও ওর একটা ঠিকঠাক ফ্যামিলি ছিল, পয়সা ছিল, কেরিয়ার ছিল, বাড়িতে ভালোবাসার লোকজন ছিল। আমরা শালা মরে গেলে আমাদের কথা কেউ মনেও রাখবে না। চাকরি নেই বাকরি নেই, বাপের পয়সায় খেয়ে দেয়ে খ্যাপা কুত্তার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা মরে গেলেই বা কী যায় আসে বল তো?’
ওর হাত থেকে কাউন্টার নিয়ে একটা টান দেয় ঈশানী, ‘এসব ভাবলে শালা আঁকতে ইচ্ছা করে আবার। কতকিছু করব ভেবেছিলাম, কিছুই করা হল না।’
‘তুই বাল বেফালতুই ছেড়ে দিলি। তোর আঁকা কার্টুনের মধ্যে কিছু একটা ছিল, অভিও বল…’
‘হ্যাঁ, অনেককিছু ছিল। আলবাল লোকজনের কথা শোনানো, সংসারে অভাব, ইঁদুরের মতো আলমারির কোণে লুকিয়ে থাকা। রাস্তাঘাটে পরিচিত কাকিমা দেখলে লুকিয়ে পড়া…’
‘রাগ হয় না তোর?’ গার্গী ওর চোখের দিকে চেয়ে জিগ্যেস করে।
ঈশানী মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বা না তাতে কিছুই বোঝা যায় না। গার্গী আবার বলে, ‘বল, রাগ করে না তোর?’
‘করে…’ হুট করে ঈশানীর গলার স্বর পালটে গেছে। হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দেয় ঘরের এককোণে, ‘বিশাল রাগ হয় বাল আমার। কিন্তু তাতে কার কী ছেঁড়া গেছে ভাই? আমার বান্ধবিটাকে মাঝরাতে কেউ গলা টিপে মেরে দিল, আমি মাল খেয়ে উল্টে ছিলাম শালা, আমার বাপটা ঠিকঠাক চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেল…তারপর ছবি আঁকাটাও ছেড়ে দিয়ে বালের কর্পোরেট জব করছি সকাল বিকেল। কোন বালটা ছিড়তে পেরেছি আমি রাগ করে?’ গার্গীর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে ঈশানী, ‘কী জানিস ভাই, যেসব বাঞ্চোত হেরে যায়, তাদের রাগটা আরও বেশি করে হেরে যায়।’
কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ঈশানী। বাইরে থেকে একটা বাইকের আওয়াজ ভেসে আসে।
তন্দ্রা এসে গেছিল ঈশানীর। চোখ মেলে তাকাতেই গাড়ির সামনের সিটে তন্ময়ের মুখটা ফুটে উঠল। তন্ময় অভিরূপার দাদা। বছরখানেক হল ওর সঙ্গে রিলেশন গার্গীর। ভারি মিষ্টি সম্পর্ক ওদের।
খবরটা পেয়ে বাইকে করে দুপুরের আগেই এসে পৌঁছেছিল তন্ময়। সঙ্গে ছিল তার উকিল বন্ধু। সে সন্ধের দিকে কিছু কাজকর্ম মিটিয়ে বাইকটা নিয়ে ফিরবে।
বিকেল গড়াবার আগেই ওরা রওনা দিয়েছিল ওখান থেকে। সারাদিনের ক্লান্তিতে গাড়িতে ওঠার আধঘণ্টার মধ্যে ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
গাড়ির কাচেই মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল ঈশানী। পাশ ফিরে দেখল গার্গীর মাথাটা ওর কোলের উপরে পড়ে রয়েছে। ও সোজা হয়ে বসতে গার্গীও উঠে বসল।
‘কতদূর এসেছি জানো?’ তন্ময়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল সে।
‘ঘণ্টাখানেক লাগবে।’
একটা জংলি পিচরাস্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। দুপাশে গাছপালার সার রাস্তার উপরে ঝুঁকে রয়েছে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে জমাট বেঁধেছে তার ফাঁকে ফাঁকে। কোথাও জনবসতির কোনও চিহ্ন নেই। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল ঈশানী।
‘ডিকিতে কী আছে রে?’ ধরা গলায় প্রশ্নটা করল গার্গী।
‘কী আবার থাকবে?’
‘একটা আওয়াজ হচ্ছে, খেয়াল করে দেখ।’
কান পেতে শোনার চেষ্টা করে ঈশানী। পিচের রাস্তার উপর গাড়ির চাকার আওয়াজে শব্দটা এতক্ষণ ওর কানে যায়নি। হঠাৎ করেই ওর মনে হল গাড়ির ডিকিতে ভারী কিছু যেন এক দিক থেকে আরেক দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। চিন্তায় পড়ল ঈশানী। মদের বোতল রয়ে গেছে নাকি? কিন্তু আওয়াজটা ততটা গম্ভীর নয়। বরঞ্চ হালকা, ফাঁপা কিছু যেন গড়াচ্ছে গাড়ির ভেতরে।
‘গাড়িটা থামাও তো একবার…’ ঈশানী বলে।
‘কেন? কী হল আবার?’
গাড়ি থামতেই বাইরে বেরিয়ে এল ঈশানী। বাইরেটা থমথমে হয়ে আছে অন্ধকারে। অন্ধকারে দুপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দের অস্তিত্ব নেই। হাওয়ায় একটা শীতশীত আমেজ খেলা করছে এখানে। ও এগিয়ে এসে ডিকিটা তুলে ধরে। তারপর ফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে ভিতরে আলো ফেলে।
একটা কালো হাঁড়ি। তার উপরে চক দিয়ে কাঁচা হাতে মানুষের মুখ আঁকা। বাকি জায়গাটায় পড়ে আছে দুটো বাঁশ। একটা কালচে ছেঁড়া খোঁড়া জামা, আর কিছু খড় বিচালি গোছের জিনিস। ওর মুখ থেকে অজান্তেই একটা শব্দ বের হয়ে এল, ‘কাকতাড়ুয়া! কিন্তু এখানে কাকতাড়ুয়া কে রাখল…’
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে ঈশানীর। মনে হয় এই কাকতাড়ুয়াটাকে ও আগেও দেখেছে। সেটা অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের পাশে একটা খেত ছিল। সেখানে কাকতাড়ুয়া থাকা বিচিত্র নয়। কিন্তু সেটা গাড়িতে তুলে দিল কে? আর কেনই বা দিল?
হুট করে মাথাটা গুলিয়ে ওঠে ওর। কিছু পুরোনো স্মৃতি যেন হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ও। ডিকিটা এক ঝটকায় বন্ধ করে দিয়ে রাস্তার দিক থেকে দু’পা সরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র আলো এসে পড়ে ওর গায়ে। এতক্ষণ ক্রমশ বেড়ে ওঠা আওয়াজটা ওর কানে যায়নি। রাস্তার ঠিক উল্টোদিক থেকে ছুটে আসছে একটা লরি। ওর থেকে মাত্র মিটার পনেরোর দূরত্ব আপাতত সেটার।
প্রবল আওয়াজে ঈশানী মুখ ফিরিয়ে তাকায়। কিন্তু ততক্ষণে ওর হাত পা কোনও অজানা অসুখে অবশ হয়ে গেছে। ও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে সেই বেড়ে ওঠা হেডলাইটের আলোর দিকে। দূর থেকে কে যেন আর্তনাদ করে ওঠে।
খুট করে একটা আওয়াজ কানে আসে ওর। বুঝতে পারে ওর ঠিক পেছনে গাড়ির ডিকিটা খুলে গেছে। পরমুহূর্তেই একটা নরম হাত ওর কোমর চেপে ধরে ওকে দূরে সরিয়ে আনে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত লরিটার সামনে থেকে।
মাটির উপরে আছড়ে পড়ে ঈশানী। কোমর আর হাত ঠুকে যায় শক্ত পিচের রাস্তায়। সেই ধাক্কার প্রতিঘাতেই মাথার কোষে আবার রক্তসঞ্চালন শুরু হয় ওর। নোংরা একটা খিস্তি ভেসে আসে লরিটার দিক থেকে। ওদের গাড়িটা পেরিয়ে চলে যায় সেটা।
কোনরকমে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। কী হল এইমাত্র? ডিকির ভিতর কাকতাড়ুয়া ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। তাহলে লরিটার সামনে থেকে কে সরিয়ে ফেলল ওকে?
মাথা চেপে ধরে ঈশানী। কয়েক সেকেন্ড আগে শোনা একটা অপরিচিত গলার আওয়াজ ওর কানে বাজতে থাকে। পরিচিত, ভীষণ পরিচিত গলার আওয়াজটা! ওকে ছুটন্ত লরির সামনে থেকে সরিয়ে নিতে নিতে কেউ ওর কানের কাছে বলেছিল, ‘আপনি ভয় পাবেন না…আমি থাকতে কিচ্ছু হবে না আপনার…’