দ্বিতীয় অধ্যায়
পানের দোকানটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে আসতেই একটা লাল স্কুটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তুহিরণ। রেলস্টেশন থেকে নেমে রিকশা করেই এতদূর এসেছে। এরপর থেকে নাকি আর রিকশা যাবে না। রাস্তায় কীসব কাটাকাটির কাজ হচ্ছে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল ও। স্কুটির উপরে একটা মেয়ে বসে আছে। মাথা হেলমেটে ঢাকা থাকলেও দেখে বোঝা যায় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
একটু ইতস্তত করে হাত তুলে ইশারা করল তুহিরণ। মেয়েটার শরীরে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তার গায়ে একটা স্যন্ডো গেঞ্জি গোছের কালো জামা, তার সঙ্গে বারমুডা হাঁটুর একটু নিচ অবধি নেমেছে। তুহিরণকে হাত তুলতে দেখে স্কুটিটা চালিয়ে ওর কাছাকাছি এসে পড়ল মেয়েটা।
গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল তুহিরণ। মেয়েটা হেলমেট না খুলেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম তুহিরণ সেন?’
‘ইয়ে…হ্যাঁ…’
‘মেয়ে দেখতে এসেছেন?’
একটু অপ্রস্তুতে পড়ল তুহিরণ। প্রশ্নটা শুনলেই কেমন জানি গা শিরশির করে। হালকা খোঁচা ছিল কি? ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে একটা বোকাবোকা কায়দায় ঘাড় নেড়ে দিল।
স্কুটির ব্যাকসিটটা দেখিয়ে মেয়েটা বলল, ‘এত লজ্জা পাওয়ার কী হয়েছে? মেয়েই তো দেখতে এসেছেন, বাইজি নাচ তো দেখতে আসেননি…উঠে পড়ুন।’
তুহিরণের অপ্রস্তুত ভাবটা আরও বেড়ে গেল, ‘না, আমি মানে…অন্য কিছুতে যদি…’
‘পেছনে টোটোতেও যেতে পারেন। সাতজন না হলে ছাড়বে না। আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।’
‘না, ঠিক আছে। আমার কোনও অসুবিধা নেই…’ না চাইতেও কথাটা বেরিয়ে গেল তুহিরণের মুখ দিয়ে।
মেয়েটা স্কুটি ঘুরিয়ে নিতে ওর পেছনের সিটটায় উঠে বসল সে। গুমগুম শব্দ করে স্কুটি স্টার্ট দিল।
মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় এই প্রথম তাকে ভালো করে দেখার সাহস পেল তুহিরণ। রোগাটে ছিপছিপে চেহারা। ডান হাতের কবজির কাছে দুটো লাল তাগা জড়ানো। মাথার চুল হেলমেট ছাড়িয়ে পিঠের মাঝ বরাবর নেমেছে। গায়ের রং ফর্সার দিকে। বারমুডার দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় স্কেচ পেন দিয়ে কীসব আঁকা হয়েছে তার উপর। নড়বড়ে আঁকা নয়, পাকা হাতের কাজ।
এর আগে বাড়ির চাপে পড়ে কয়েক জায়গায় মেয়ে দেখতে গেছে তুহিরণ। তার মধ্যে কোথাও ওকে স্কুটিতে করে কেউ নিতে আসেনি। এখানে অবশ্য মা-বাবা আগেই দেখে গেছে। পছন্দ হওয়ায় ও নিজেই দেখতে এসেছে। বিশেষ করে মেয়েটার মুখশ্রীটা নাকি ভারি মিষ্টি। তবে ট্যাঁকট্যাঁক করে দু’কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ে না। সব মিলিয়ে একটা টু-ইন-ওয়ান ফ্লেভার আছে। বাড়ির লোকও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মা-বাবার সামনে ওর একটু লজ্জা লজ্জাই লাগে। একা আসায় সেইসব বালাই নেই।
তাও অস্বস্তিটা রয়েই যায় তুহিরণের। সেটা কাটানোর জন্য সে আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমি কিন্তু নিজেই চলে যেতে পারতাম, আপনার আবার…’
‘তাতে এক্সট্রা লাভ কিছু হত না। আপনি তো আর গাড়ি নিয়ে আসেননি, যে মেয়েপক্ষ দেখে হ্যাল খেয়ে যাবে…’
আবার বোধহয় খোঁচা দিচ্ছে মেয়েটা। একটু অসন্তুষ্ট হয় তুহিরণ, বলে, ‘হঠাৎ আপনাকে আনতে পাঠিয়েছে যে, বাড়িতে আর কেউ ছিল না?’
মেয়েটা আগের মতোই নিঃস্পৃহ গলায় বলে, ‘মেয়ের বাবার ক্যানসার। মা বাতের রোগী। আত্মীয়স্বজন, বুঝতেই পারছেন আসতে আসতে আপনার কানে ফুসমন্তর দেবে, ছেলেবন্ধু কিছু আছে, তারা এলে আপনার আবার মেল ইগোয় সুড়সুড়ি ধরবে, নিতে আসার মতো বাড়িতে কেউ নেই। অগত্যা…’
‘কেউই নেই বাড়িতে দেখছি, মেয়ে নিজে আছে তো?’ প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুরেই বলে সে।
‘আজ্ঞে না।’
‘সে কী? আমি তো বলেই এলাম। কোথায় গেল?’ এবার সত্যিই রাগ হয় তুহিরণের।
‘আপনাকে নিতে।’
উত্তরটা বুঝতে একটু সময় নেয় সে। তারপর তুতলে বলে, ‘তা…তার মানে আপনি…’
স্কুটি চালাতে চালাতেই একহাতে হেলমেটটা খুলে ফেলে ঈশানী। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই সেটা পেছনে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা ধরুন তো। বেশিক্ষণ পরে থাকলে শালা মাথা কুটকুট করে…’
‘কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে…’ তুহিরণ খাবি খায়।
‘আরে ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিতে বলছি না। হেলমেটটা ধরতে বলেছি শুধু।’
তুহিরণ আর কথা না বাড়িয়ে হেলমেটটা পায়ের উপর চেপে ধরে বসে। এতক্ষণ চুইংগাম গোছের কিছু চেবাচ্ছিল ঈশানী। সেটা ফুঁ করে কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। তুহিরণ লক্ষ করে কপালের আড়াআড়ি একটা ফেট্টি বাঁধা আছে তার। মুখটা ভারি নরম গোছের। রোগাটে চেহারায় গোল পাতার মতো মুখ আর পুরু ঠোঁট দিব্যি মানিয়েছে। চলন্ত স্কুটির দু’টো হ্যান্ডেল থেকে হাত তুলে নিয়ে হাওয়া আড়াল করে একটা সিগারেট ধরায় মেয়েটা। সেটাতে একটা টান দিয়ে বলে, ‘আপনি পার্টি করেন?’
‘পার্টি বলতে ওই বন্ধুরা ডাকাডাকি করলে মাঝেমধ্যে। বা ধরুন অফিসে…’
‘আরে ধুর মরা, সে পার্টির কথা বলছি না। সিপিএম তৃণমূল কিছু করেন না?’
‘আমি ঠিক রাজনীতির ব্যাপারটা…’
‘ব্যাস, হয়ে গেল, ফোর নাইন্টিএইট এ…’ মেয়েটা হতাশ গলায় বলে।
‘মানে?’
‘মানে আর কী, আগে লোকে আদর্শ ফাদর্সর জন্য পার্টি করত। এখন সন্ধেবেলা একটু গালাগাল দেওয়ার জন্য করে। মানে আপনি সিপিএম হলে তৃণমূলকে, তৃণমূল হলে সিপিএমকে সন্ধেবেলা একটু খিস্তিখামারি করে গা গরম করা আর কী। বা ধরুন সপ্তাহে একদিন পাড়ার মোড়ে একটু ক্যালাকেলি। যারা পার্টি করে না তারা খিস্তানোর লোকও পায় না। তারা বউ, প্রেমিকা কিংবা ধরুন ছেলেমেয়েকে ধরে ক্যালায়। মানে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, মানে ফোর নাইন্টিএইট এ…’
তুহিরণের হাসি পায়। মেয়েটা মজাদার। এতক্ষণ ধরে কথা বলছে অথচ মুখটাই ভালো করে দেখা হয়নি। সে সামনের আয়নায় উঁকি মারার চেষ্টা করে ভালো করে মেয়েটার মুখ দেখবে বলে। পরক্ষণেই ভয়ে মুখ সরিয়ে নেয়। মেয়েটা দেখতে পেলেই চিত্তির।
‘বডি কাউন্ট?’
‘ইয়ে…কার বডি?’
মেয়েটা এবার আরও বিরক্ত হয়, ‘ধুর বালটা। বলছি সেক্স টেক্স করেছেন কিছু?’
এমন কিম্ভূত প্রশ্নের জন্যও তৈরি ছিল না তুহিরণ, ঢোঁক গিলে বলে, ‘ওটা…মানে…’
‘এত লজ্জার কী আছে বলুন তো? আমি করেছি। তবে কিসটা করিনি বুঝলেন, ওই এক সমস্যা আমার। করতে গেলেই মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে…কানাডার এক মহিলা ক্রিস্টিনা ডিফোরজেস কিস করতে গিয়ে দম আটকে মারা গেছিলেন, জানেন?’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, মহিলার পি-নাট বাটারে এলার্জি ছিল। এদিকে বাঞ্চত বয়ফ্রেন্ডটা সেই খেয়ে এসেছে কিস করতে। ব্যাস, ওই গন্ধে এলার্জি, সেই এলার্জি থেকে শ্বাসকষ্ট তারপর খাল্লাস…সেই থেকে শালা হেব্বি ভয় ধরে গেছে আমার…’
কী বলবে বুঝে পায় না তুহিরণ, ‘আপনি এত কিছু জানলেন কেমন করে বলুন তো?’ সে সোজা হয়ে বসতে বসতে জিগ্যেস করে।
‘একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল…’ সিগারেটে একটা টান দেয় ঈশানী, ‘শালা টক্সিক মাকাল ছিল শুয়োরের বাচ্চাটা। তিন বছর ধরে জ্বালিয়ে খেয়েছে…’ কথাটা বলেই ধোঁয়া ছাড়ে সে, ‘বা শুধু জ্বালিয়েছে বলতে পারেন। খাওয়ার মতো দম ও মালের বান্টুতে নেই। কী জানেন, যারা মুখে বেশি বাঘ মারে তারা বিছানায় কিছুই মারতে পারে না…আপনি মারবেন?’
‘অ্যাঁ? মানে আমি…’ খাবি খায় তুহিরণ।
‘আহা কাউন্টার, নিন নিন…’
হেসে মাথা নাড়ে তুহিরণ, ‘না, না আমার কাছে আছে…’
মেয়েটা এগিয়ে দেওয়া সিগারেট ধরা হাতটা আবার গুটিয়ে নেয়, ‘আপনার এত নেকুপুসু মডেস্টি মারানোর কী আছে কে জানে, এমনিও তো বিয়ে হবে না। কী করবেন ফালতু এসব করে?’
‘বিয়ে হবে না জানলেন কী করে?’
‘সিম্পল, আমার আপনাকে পছন্দ হয়নি।’
‘তাহলে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
‘আপনি যেতে চাইছেন তাই।’
‘বেশ, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি আমার ইচ্ছা নেই।’
মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকায়, ‘তাতে লাভ নেই।’
‘লাভ নেই কেন?’
মেয়েটা এতক্ষণে স্কুটির গতি একটু কমিয়েছে, গলা তুলে বলে, ‘আপনার কী মনে হয় আপনাকে মেয়ে দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’
‘হচ্ছে না?’
‘আজ্ঞে না, নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য।’
‘কীসের ভয়?’
ধোঁয়ার রিং ছাড়ে ঈশানী, ‘দেখুন আমি কলেজ পাশ করেছি নয় নয় করে বছরচারেক হতে চলল। বাবার ক্যানসার, মা পেনসনের অল্প কিছু টাকা পায়, তাও লোকাল বদ্দাদের কাটমানি দিয়ে। এখন আমার উচিত একটা চাকরি-বাকরি করে সংসারে দুটো পয়সা দেওয়া। বাবার একটা অপারেশন হওয়ার কথা আছে। পয়সার অভাবে সেটাও দিনের পর দিন পিছচ্ছে। মা কিছুটা আমার মুখ চেয়েই বসে আছে…’
‘আপনি চাকরি করছেন না?’
‘একটা পাড়ার স্কুলে আঁকা শেখাই। মাঝে মাঝে আর্ট এক্সিবিশান হয়। সেখানে প্রাইজ টাইজ পাই। ব্যাস ওই অবধি। আমার একটা জেদ বলতে পারেন, আঁকা নিয়েই থাকব…ওই সকাল থেকে কর্পোরেট বসের পেছনে তেল দেওয়া আমাকে দিয়ে হবে না বাল…’
‘কিন্তু ভয় দেখানোর ব্যাপারটা…’
‘আঃ আপনি এত গাড়ল কেন বলুন তো?’ ঈশানী বিকৃত গলায় খুলে বলতে থাকে ব্যাপারটা, ‘মায়ের আসল উদ্দেশ্য প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে একটা পাত্রপক্ষ এনে আমাকে এটা বোঝানো যে চাকরি-বাকরি না করে বসে থাকলে যে কোনওদিন আমার বিয়েটা হয়ে যেতে পারে…’
কথাটা বলে একটা পুরোনো তিনতলা বাড়ির সামনে স্কুটিটা দাঁড় করায় ঈশানী। তুহিরণ নেমে আসে। তারপর বাড়িটা ভালো করে দেখতে দেখতে বলে, ‘আপনাদের বাড়িটা বেশ পুরোনো, না?’
‘কেন আপনার পুরোনো বাড়ির জামাই হওয়ার শখ ছিল নাকি?’
তুহিরণ থতমত খায়। ঈশানী স্কুটিটা সিঁড়ির তলায় ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘শরিকি বাড়ি, শালা কিছুই আমাদের না। সাত ভূতে খাচ্ছে। নাহলে কবে এ মাল বেচে ফ্ল্যাট উঠে যেত।’
‘আপনি তার মানে নিশ্চিত আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না?’
মেয়েটা ওর দিকে দু’পা এগিয়ে আসে, কয়েক সেকেন্ড অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, ‘দেখুন আপনাদের ছেলেদের না এই এক পা হড়কানো স্বভাব। মুখ দেখেই হ্যাল খেয়ে যান। আমাকে বিয়ে করলে দুদিনও সামলাতে পারবেন না। আমি ঠিক ম্যারেজ মেটিরিয়াল নই…আপনার প্রিয় রং কী?’
একটু ভাবে তুহিরণ, তারপর গাল চুলকে বলে, ‘নীল, কেন বলুন তো?’
‘তাহলে ওই রঙের শাড়ি পরব না, আরও পছন্দ হয়ে গেলে জোঁকের মতো পেছনে পড়ে যাবেন, যাগ্যে, আপনি উপরে যান, আমি আসছি…’
‘কিন্তু একসঙ্গে গেলেই তো…’ তুহিরণ বলতে গিয়ে থেমে যায়।
‘আহা-হা…’ মেয়েটা ভেংচি কাটে, ‘শখ কম নয়, না আপনার? এখন থেকেই পেছন পড়ে গেছেন! বাড়ির পেছনে সিঁড়ি আছে ওটা দিয়ে উঠব। সামনে দিয়ে উঠলে দোতলায় বাবার ঘর পড়ে, সিগারেটের গন্ধ পেয়ে যাবে ঠিক।’
মেয়েটা বাড়ির পেছন দিকে গায়েব হয়ে যেতে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে তুহিরণ। ভারি তাজ্জব ব্যাপার। মেয়েটা একই সঙ্গে নিজের মা-বাপ আর মেয়ের ভূমিকা পালন করছে। তবে একটু খ্যাপাটে হলেও মুখটা ভারি মিষ্টি। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে।
ওদের বাড়ির একদম উপরের তলার একটা ঘরে থাকে ঈশানী। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই ছাদ। কমলিকা আর সঞ্জীবন থাকেন তার নীচের তলায়। একদম নীচতলার অন্যান্য ঘরগুলোতে বাড়ির অন্য শরিকরা থাকে।
নীচে নেমে বাবার ঘরে ঢোকার আগে একটু থমকায় ঈশানী। নিজের জামাটা টেনে কাছে নিয়ে এসে গন্ধ নেবার চেষ্টা করে। না, সিগারেটের গন্ধটা এই জামাটায় নেই। বাবার ঘর থেকে আগে কাশির আওয়াজ ভেসে আসত। ক’দিন হল সেটা কমেছে। শেষ কেমোটা নেওয়ার পর শরীরটা আগের থেকে কিছুটা ভালো হয়েছে।
দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এসে বিছানার পাশে বসে ঈশানী। মানুষটার শরীর প্রায় বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। গাল ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা হাড়টার দিকে তাকালে ভারি মায়া লাগে ঈশানীর। ওই হাড়টাই যেন বারবার বলে দেয় বাবা বুড়ো হয়ে গেছে। ওকে দেখে সেই হাড়ের নিচে একটা হাসি ফোটে। ওই একটা হাসিরই কারণ হতে ভালো লাগে ঈশানীর। শীর্ণ হাতগুলো তুলে পাশের জায়াগটা দেখিয়ে সঞ্জীবন বলেন, ‘বস, বাবার কাছে তো আর আগের মতো আসিস না।’
ঈশানী জানে কথাটা মিথ্যে নয়। ও এখন বেশিরভাগ সময়টাই হয় সিগারেট নাহলে জয়েন্ট চড়িয়ে থাকে। বাবার নাক ভীষণ চলে। সব থেকে বড় কথা ছোট থেকে বাইরে যত অন্যায় করে আসুক, মা বুঝুক না বুঝুক, বাবা ঠিক বুঝে ফেলত। তবে এসব ছাড়া আরও কিছু কারণ আছে হয়তো। ঈশানী বুঝতে পারে না। মনে পড়ে পরশুদিন শেষ এসেছিল বাবার ঘরে। চুল আঁচড়ে দিয়ে গেছিল, সেই চুল এখন উসকোখুসকো হয়ে গেছে। চিরুনি নিয়ে অবিন্যস্ত চুল আঁচড়াতে থাকে ঈশানী, ‘এই বেগুনি জামাটায় কী সুন্দর দেখায় তোকে…’
ঈশানী নরম হাসি হাসে, ‘তোমার আমাকে কবে সুন্দর লাগেনি বলো তো?’
মানুষটা কী যেন ভাবে, তারপর বুকের উপরে হাত রেখে বলে, ‘যবে প্রথম তোকে দেখেছিলাম। সারা গায়ে রক্ত মাখামাখি, মাংসের ড্যালার মতো। চিৎকার, কান্নাকাটি, ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডের গন্ধ। সব বাপেদের সন্তানকে প্রথম দেখে আনন্দ হয়। আমার ভয় লেগেছিল…’
‘কীসের ভয়?’
‘একটুখানি একটা রক্তের ডেলা, তার দায়িত্ব নিতে হবে। তাকে এত বড় একটা মেয়ে করে তুলতে হবে। ভয় লাগবে না? আমি কোনওদিন অত রেসপনসিবল ছিলাম না।’
ঈশানী হাসে, ‘তারপর ভয়টা কাটল কী করে?’
মেয়ের মাথায় একটা হাতে রাখেন ভদ্রলোক, ‘মেয়েকে নিয়ে বাপের ভয় কখনও কাটে না। মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাপের থেকে ভয়টা মেয়ের মধ্যে চলে যায়। এই যেমন তুই এখন আমাকে নিয়ে ভয় পাস…’
চিরুনিটা একপাশে সরিয়ে রাখে ঈশানী, ‘সত্যি ভয় পেলে এইসব ফেরেব্বাজি ছেড়ে একটা চাকরি করতাম। তোমার জন্য তো কিছুই করতে পারি না।’
‘আমার জন্য যদি কিছু করতে চাস…’ হাত বাড়িয়ে মেয়ের কান মুলে দেন লোকটা, ‘তাহলে এই ফোঁকার অভ্যাসটা ছেড়ে দে এবার।’
ঈশানী একটু লজ্জা পায়, কান লাল হয়ে ওঠে ওর, সেটা সামাল দিতেই বলে, ‘কী হবে ছেড়ে? তুমি সারা জীবনে ক’টা সিগারেট খেয়েছিলে? কী লাভ হল বলো তো?’
করুণ হাসি হাসে মানুষটা, ‘ক্যানসার কোনও রোগ নয় রে মা, ক্যানসার হল জাস্ট ব্যাড লাক। কখন হবে, কার হবে, কীভাবে হবে কেউ জানে না। গ্রিভেন্স করার কোনও জায়গা নেই। বাদ দে ওসব, তোর সেই আর্ট গ্যালারির কী হল?’
‘ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। আজ কল এলে যাওয়ার কথা ছিল। সে আর আসবে না। আমার আর ওসব হবে না বাবা, মা রোজ কথা শোনাচ্ছে, ভাবছি বিয়ে করে নেব…’ কথাটা বলে ঈশানী মুখ ফিরিয়ে নেয়।
মেয়ের হাতের উপর একটা হাত রাখে মানুষটা, ‘এই তুই মন খারাপ করছিস কেন বল তো? আরে তোর বাপ থাকতে মা কারো সঙ্গে বিয়ে দিতে পারবে না…’
মুখ ফেরায় ঈশানী। বাবার কপালে একটা হাত রাখে, ‘আমি সত্যি সত্যি কী চাই জানো বাবা?’
‘কী?’
‘আর্ট গ্যাল্যারির চাকরি না, বিয়ে না, টাকাপয়সা না, কিচ্ছু না। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না বাবা…’ হুট করেই বাপের রুগ্ন বুকের উপরে আছড়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ওঠে ঈশানী, ‘বাকি সব কিছুর সঙ্গে আমি লড়াই করে নেব, মায়ের বকাঝকা, পাশের বাড়ির তানা, সব…শুধু তুমি চলে যেও না কোথাও…’
সঞ্জীবন বুঝতে পারেন মেয়ের মনটা ভালো নেই। ওর পিঠে দুটো চাপড় মারেন তিনি, ‘আরে সিপিএমের কাকারা অত সহজে ছেড়ে যায় না কমরেড…’ হাত বাড়িয়ে ঈশানীর চোখ থেকে জল মুছে দেন তিনি, ‘সত্তর সালে পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। লাল ঝান্ডা দেখলেই গুলি করে মারত গুন্ডাগুলো। তখন পার্টিটাকে ছেড়ে গেলাম না, আর তোকে ছেড়ে চলে যাব?’
ঈশানী বাবার বুকে মুখ রেখে ফোঁপাতেই থাকে, সঞ্জীবন একরকম জোর করেই তার মুখটা তুলে ধরে, ‘আরে এই দেখো, আবার কান্নাকাটি করে ফেলে, আমার ডাকাবুকো মেয়েটা কান্নাকাটি করলে একদম ভালো লাগে না। তুই আমার চাম্পিয়ন মেয়ে না?’
ঠোঁট ফুলিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই কাতরাতে থাকে ঈশানী, ‘আমার ততক্ষণই সাহস থাকে যতক্ষণ তুমি আছ। তোমাকে ছাড়া আমি খুব ভিতু হয়ে যাব বাবা…’
ঈশানীর পিঠে হাত রাখে সঞ্জীবন, ‘একদিন আমিও আমার বাপকে জড়িয়ে এমন করে কেঁদেছিলাম, জানিস? তুই একদম আমার মতো হয়ে গেলি কবে বল তো?’
কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই পড়ে থাকে ঈশানী। তারপর মুখ তুলে চোখ থেকে জল মুছে নেয়। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘ছেলেটা দেখতে এসেছে। ভাগিয়ে দিয়ে আসি। রাতে আবার আসব, তুমি ঘুমিয়ে নাও…’
‘মন খারাপ করে দিলাম না তোর?’
দুপাশে মাথা নাড়ে ঈশানী। উঠে দাঁড়ায়।
সঞ্জীবনের চোখে মুখে একটা ক্লান্তির ছায়া নামে, পাশ ফিরে শুতে শুতে বলেন, ‘আচ্ছা, আজ রাতে একটা গল্প বলব তোকে। খুব মজার গল্প। মন খারাপ কেটে যাবে…আসিস কিন্তু…’
‘পছন্দ হয়নি?
‘না।’
‘পছন্দ না হওয়ার মতো কী আছে ওর মধ্যে?’
‘যা যা আছে সবকিছু আর দেখলাম কোথায়?’
কানের পাশ গরম হয়ে ওঠে কমলিকার। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন মেয়ের সঙ্গে। এবার ধপ করে বিছানার উপরেই বসে পড়েন। দিনকতক হল বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে পা ধরে যায়। তার উপরে এই মেয়ে এমনিতেই মাথা গরম করিয়ে দিয়েছে।
পাশের ঘরেই বুলির সঙ্গে বসে আছে ছেলেটা, সেটা মাথায় রেখেই গলাটা নিচে নামিয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলেন কমলিকা, ‘মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে নোংরা কথা বলতে লজ্জা করে না?’
‘ঠিকাছে, আমি শুয়ে শুয়ে নোংরা কথা বলছি…’ বিছানার অন্য দিকে শুয়ে পড়ে ঈশানী। হাতটা আড় করে চোখের উপরে রাখে।
‘ইয়ার্কি মারছিস তুই? বুলিমাসি একটার পর একটা ভালো ছেলে খুঁজে নিয়ে আসে আর তুই একটার পর একটা রিজেক্ট করে যাস। তার কারণ জানি না ভেবেছিস?’
‘মহা মুশকিল তো! আমি রেন্ডি নাকি যে একটার পর একটা ছেলে নিয়ে আসবে আর আমি একটার পর একটা একসেপ্ট করে নেব?’
রাগে বিছানার চাদর খামচে ধরেন কমলিকা, ‘আস্তে কথা বল। পাশের ঘরেই আছে ওরা…’
‘লোকের পাশের ঘরে গিয়ে বসে থাকা ছাড়া বুলিমাসির কোনও কাজ আছে? যত্তসব গুড ফর নাথিং মিডল ক্লাস…’
‘তো কী করবে? তোর মতো এখানে ওখানে ছবি এঁকে নেচে বেড়াবে আর মায়ের পেনশন ধ্বংস করবে? মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়ে দিই ওসব ছবিতে। আর মিডল ক্লাসের উপর অতই যখন রাগ তখন একটু আপার ক্লাস হওয়ার চেষ্টাটা করো না। বাড়ির আরামে গিলে কুটে ওসব অনেক স্বপ্ন দেখা যায়…’
ঈশানীর শরীরে কোনও বিকার দেখা যায় না, অন্য হাতটাও চোখের উপরে রাখে, ‘হয়েছে তোমার খাওয়া নিয়ে তানা মারা? মাইরি বলছি শালা, বিয়ের জন্য ছেলে দেখার মতো যদি মা বাবা সিলেক্ট করার অপশন থাকত না, তুমি শালা জন্ম জন্মান্তর আঁটকুড়ে বাঁজা থেকে যেতে…’
‘তাও শান্তি থাকত জীবনে…’
‘জন্ম দিয়ে ভুল করেছ, তাই তো? আচ্ছা, নতুন কিছু শোনাতে পারো তো। রোজ রোজ ভাঙা রেকর্ড ভালো লাগে মানুষের?’ কথাটা বলে বিছানার উপরে উঠে বসে ঈশানী, ‘দেখো ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে ঝামেলা মেটাও। আমি একটু বেরব…’
‘কোথায় বেরবি?’
‘একটা থিয়েটার গ্রুপের স্টেজ ডিজাইন আছে…’
‘তুই নাটক করছিস কবে থেকে?’
‘করছি না, দেখছি, জন্ম থেকে, তোমার।’
কথাটা বলে কোমরে ভর দিয়ে উঠে পড়ে ঈশানী। তারপর গটগটিয়ে পাশের ঘরে এসে তুহিরণের পাশের সোফায় বসে পড়ে। ওদের ঠিক উল্টোদিকেই বসেছে বুলিমাসি। এতক্ষণ ওকে ফাঁকা পেয়ে এটা সেটা প্রশ্ন করছিলেন। ঈশানীকে ঢুকতে দেখে একটু তটস্থ হয়ে বসেন।
তেমন কিছু সাজগোজ করেনি ঈশানী। হালকা কাজল পরেছে, সঙ্গে বেগুনি জর্জেট শাড়ি, প্রায় অদৃশ্য কালো টিপ কপালে। চুলগুলো মাথার পেছনে খোঁপা করে বাঁধা। হাতের লাল তাগাটা তার মধ্যেও যেন মানিয়ে গেছে।
তুহিরণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। সে দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসে ঈশানী। বিড়বিড় করে বলে, ‘কী ব্যাপার, আপনি পিছলে গেলেন নাকি?’
তুহিরণ লাজুক গলায় বলে, ‘না, আপনাকে দেখতে ভালো সেটা অস্বীকার করি কী করে?’
‘তার থেকেও ভালো জয়েন্ট রোল করতে পারি সেটাই বা অস্বীকার করবেন কী করে?’
বুলিমাসি গোটা কথাটা শুনতে পাননি। কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে বললেন, ‘জয়েন্টে, দারুণ রাঙ্ক হয়েছিল ওর। সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছিল। পড়া শুরুও করেছিল, কিন্তু ওই, মাথার ক্যাড়াপোকাটা নড়ে গেল। তবে ওর কিন্তু গুণের শেষ নেই…’ বুলিমাসির মুখটা রসোগোল্লার মতো মনে হল ঈশানীর, তেমন রসালো গলাতেই বলে চললেন তিনি, ‘ওর বাবা তো অসুস্থ, মায়েরও শরীরটা ভালো নয়। এইটুকু মেয়ে একা হাতে গোটা সংসারের দায়িত্ব সামলায়…’
ঠোঁটের কোণে বিড়বিড় করে ঈশানী, ‘আমার মায়ের বাক্যবাণ সামলানোর কাছে সেটা কিছুই নয়…’
তুহিরণ আড়চোখে তাকায় ঈশানীর দিকে। টেবিলের উপরে একটা প্লেট আর দুটো চামচ পড়েছিল। তার মধ্যে কাঁটাচামচটা তুলে নিয়ে নড়াচড়া করে দেখতে শুরু করেছে মেয়েটা। কেমন যেন চিকচিক করছে চোখের মুণিদুটো।
‘ওর কথায় তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ও একটু ওরকম। তোমার বাবা-মার তো ভালোই পছন্দ ছিল। ফোন করে বলেছে আমাকে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে…’
তুহিরণ খাবি খায়, ঈশানী ঝুঁকে আসে ওর দিকে। বাঁ দিকের ভ্রুটা উপর দিকে তুলে বলে, ‘আছে? আপত্তি?’
আবার থতমত খায় তুহিরণ, গলকণ্ঠটা একবার ওঠানামা করে। কাঁটাচামচটা এবার টেবিলের উপর ধীরে সুস্থে ঘষছে ঈশানী। সেটার দিকে একবার তাকিয়ে দুবার খাবি খেয়ে ধরা গলায় তুহিরণ বলে, ‘ইয়ে…আসলে আমার একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে। যদি একটু…’
উঠে বারান্দার দিকে হেঁটে যায় ঈশানী। তুহিরণ পায়ে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। মাথাটা মেঝের দিকে নেমে আসে ওর। আধো স্বরে বলে, ‘ইয়ে…সিদ্ধান্ত তো আগেই হয়ে গেছে, আই মিন এটা একরকম গট আপ ম্যাচ বলা যায়। তাও যদি একটা ফেয়ার গেম…আমি কিন্তু পিনাট বাটার খাই না। বিশ্বাস করুন…’
ছেলেটার কথার দিকে মন নেই ঈশানীর। হাতের উপর ফোনটা রেখে তার স্ক্রিনে কী যেন দেখছে সে। যেন কথাগুলো কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। তুহিরণ এবার সত্যিই হতাশ হয়, আশ্চর্য কঠিন মেয়েটা। মনের ভিতরে কী চলছে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই।
সে আবার চেষ্টা করে, ‘মানে, আমি ওনাদের জানিয়ে দিচ্ছি যে আমাদের কারোরই তেমন পছন্দ নেই, কিন্তু আপনি শুধু জেনে রাখুন, আমার দিক থেকে পছন্দ আছে, আপনার যদি আমাকে পছন্দ…’
‘হয়ে গেছে…’ শব্দদুটো উচ্চারণ করেই লাফিয়ে ওঠে ঈশানী। এই হঠাৎ উত্তরের জন্যও প্রস্তুত ছিল না তুহিরণ। সে আঁতকে উঠে বলে, ‘অ্যাঁ! সেকী! আমাকে পছন্দ হয়ে গেছে আপনার?’
ঈশানী রাগত চোখে তাকায় ওর দিকে, ‘আরে অদ্ভুত ল্যাবা তো! সারাক্ষণ নিজের ধান্দায় থাকেন নাকি? আমার চাকরিটা হয়ে গেছে আর্ট গ্যালারিতে। এই দেখুন, এক্ষুনি যেতে বলেছে…’
এক্ষুনি আসা ই-মেলটা ওর সামনে তুলে ধরে ঈশানী, ‘উফ, ইচ্ছা করছে বাবাকে এক্ষুনি জানিয়ে আসি…’ ছুটে বাবার ঘরের দিকে যেতে গিয়েও থমকে যায় ও, ‘ঘুমাচ্ছে মনে হয়। থাক, একেবারে এসে জানাব…’
মুখে খুশির আলো খেলা করছে তার। সমস্ত শরীর থেকে এতক্ষণের ঝিমিয়ে পড়া ভাবটা অন্তর্হিত হয়েছে। শাড়ির আঁচলটা গুটিয়ে কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘চলুন, আপনাকে স্টেশন অবধি ছেড়ে দিই। রাস্তায় ভালো মেয়ে পেলে ঝুলে পড়বেন। নাহলে আপনার এ জম্মে বিয়ে-টিয়ে হবে বলে মনে হচ্ছে না…’
তুহিরণকে স্টেশনে ড্রপ করে আর্ট গ্যালারির দিকে স্কুটিটা ছুটিয়ে দিল ঈশানী। মনের ভিতরে অদ্ভুত ফুর্তি হচ্ছে ওর। আর্ট গ্যালারির কিউরেটরের চাকরিটা যে হয়ে যাবে সেটা ও আগে ভাবতে পারেনি। ইন্টারভিউ মোটামুটি খারাপ যায়নি। কিন্তু মনে হয় একটু বেশিই বকে ফেলেছিল। তাও পছন্দ হয়ে গেছে মানে তেমন ভুলভাল কিছু…
দুপুরের রাস্তা প্রায় ফাঁকা। ওর গায়ে জড়ানো বেগুনি জর্জেট শাড়িটা এখন আলুথালু হয়ে আছে। হাওয়ায় মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে সেটা। উৎসাহের চোটে হেলমেটটাও নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে যদি পুলিশে এসে পাকড়াও করে বিপদের আর শেষ থাকবে না। সতর্ক হয়ে স্কুটি চালাতে লাগল ঈশানী।
খানিক দূর যেতে ওর ফোনটা বেজে উঠল। পেছনটা একবার দেখে নিল সে। না, ওর ঠিক পেছনে কোনও গাড়ি নেই। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কানে চেপে ধরল ঈশানী। ওপাশ থেকে বুলিমাসির গলা ভেসে এল, ‘রুনু, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। তোর বাবা কেমন করছে…’
মিনিট পনেরো পর ঊর্ধ্বশ্বাসে স্কুটি চালিয়ে ঈশানী যখন বাড়ি ঢুকল তখন হুট করেই দুপুরের আলো কমে এসেছে। পাশের বাড়ি থেকে ঠং ঠং করে হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজ আসছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হল যেন একটা নরম গন্ধ হাওয়ার মতো জড়িয়ে ধরছে ওকে।
অনেকগুলো সিঁড়ি একধাপে পেরিয়ে যখন দোতলায় উঠে এল ঈশানী তখন দরজার ভেতরটা ফিকে অন্ধকারে ভরে আছে।
ফ্রিজটা খোলা আছে কি? এত ঠান্ডা হয়ে আছে কেন ভিতরটা?
বাবার ঘরের দরজায় এসে থমকে দাঁড়ায় ঈশানী। খাটের পায়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মা আর বুলিমাসি। বিছানার একপাশে এলিয়ে পড়ে আছে বাবার মৃতদেহটা। মুখে থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মেঝেতে জলরঙের মতো মিশে গেছে।
সেই রক্তের ঠিক সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ঈশানী, বিড়বিড় করে বলে, ‘তুমি আমায় গল্পটা বললে না বাবা…’