কাকতাড়ুয়া – ১৯

উনবিংশ অধ্যায়

‘তুই সব জানতিস? তাহলে এতদিন আমাকে বলিসনি কেন? কী করতে চেয়েছিলি তুই?’ চারু ওর দিকে ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে আসে। শরীরে অদ্ভুত অস্থিরতা ভিড় করেছে তার।

‘তুইও তো জানতিস। তাও বলিসনি আমায়…সেদিন রাতে কে তোকে ছুরি মেরেছিল…’

হাতটা নিজের শরীরেই আছড়ায় চারু, ‘লোকটা বারবার বলছিল তুই করেছিস খুনটা। তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে…তাই আমি ভেবেছিলাম সত্যিই তুই…’ চারু চিৎকার করে ওঠে।

‘যে আমি খুন করেছি অভিকে, তাই তো?’

চারু উত্তর দেয় না। ওর বুকের ভিতর অজানা রক্তক্ষরণে ফোঁটা পড়তে থাকে। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না। ঈশানীর মুখে আজ সন্ধে থেকে যে অদ্ভুত হাসিটা লেগে আছে সেটা এতদিনে একবারও দেখেনি ও। হুট করেই ভীষণ অচেনা লাগতে শুরু করেছে ওকে। উত্তর দেয় না মেয়েটা। কেবল রঙের কৌটোগুলোর উপর আনমনে হাত বুলাতে থাকে। গুনগুন করে কী যেন একটা গান গাইতে থাকে। খোলা চুলের ঝালর হাওয়া এসে অল্প অল্প উড়িয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে।

হাত দিয়ে মাথার উড়ন্ত চুল ঠিক করে ঈশানী, নরম গলায় বলে, ‘ধুর, এত খুনখারাপির গল্প ভালো লাগছে না। এমনিতেই আমাকে একা একা ফিরতে হবে বলে মন খারাপ করছে…’ কী যেন ভেবে চারুর হাতে নিজের ফোনটা দেয় ঈশানী, ‘ফেরার সময় আমি একা বাড়ি যাব না। গার্গীকে ফোন করে লোকেশন দিয়ে বলে দে—ও যেন মাকে নিয়ে এখানে চলে আসে…’

চারু কথা বাড়ায় না। তাই করে। ফোনটা রেখে ওর দিকে এক পা এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করে, ‘কী চাইছিস তুই?’

‘স্নান করতে।’ রঙের কৌটোগুলোকে আদর করতে করতেই উত্তর দেয় ঈশানী, ‘আজ আমার জন্মদিন, একবার মাঝরাতে স্নান না করলে হয়?’

কথাটা বলে ছড়িয়ে থাকা রঙের কৌটগুলোর মধ্যে একটা তুলে নেয় ঈশানী। মুখে বলে, ‘সব বলব, আগে স্নান করে নিই। তুই ততক্ষণ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রাখ।’

কথাটা বলে ওর কাছে এসে মাথা থেকে ফেট্টিটা খুলে ফেলে ঈশানী। তারপর পরিয়ে দেয় চারুর মাথায়। ঘন চুলের বোঝা এসে পড়ে ওর মুখের উপর। দুটো ভুরুর মাঝে কালো টিপটা আরও বেশি ফুটে ওঠে। ভরাট কালো দুটো চোখ তুলে ওর দিকে চেয়ে থাকে ঈশানী। চোখের পলক ফেলতে চায় না যেন। কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! চারু মোহিত হয়ে চেয়ে থাকে। এত প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসছিল, এই কাজল কালো চোখদুটো কোন মায়ায় বুঝি সব প্রশ্ন ভুলিয়ে দেয় ওকে।

চোখ নামিয়ে নিয়ে রঙের বালতি হাতে ঈশানী এগিয়ে যায় ঘাটের দিকে। চারু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর ছিপছিপে শরীরটার দিকে। মেয়েটা কী করছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

এতদিন ধরে সব জানত ও? নিজেই ইচ্ছা করে জাগিয়েছিল কাকাতাড়ুয়াটাকে? এতদিন অভিনয় করছিল ওর সঙ্গে? কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী?

কিছুটা গঙ্গার জল আঁজলা করে তুলে মাথায় ঢালে ঈশানী। ভিজে শাড়িটা লেপ্টে যায় ওর গায়ে। ওর নরম মুখে একটা অচেনা হাসি ফোটে। কয়েক সেকেন্ড নিজের শরীরেই পরম মমতায় হাত বোলায়।

তারপর ওর হাতে ধরা রঙের কৌটোয় ভরা জলটাও ঢেলে দেয় নিজের মাথায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে স্নান হয়ে যায় মেয়েটা। চাঁদের আলো এসে পড়ে ওর মুখের ওপর। দেখে মনে হয় জল থেকে উঠে আসা রূপকথার মেয়ে চাঁদের রুপোলি আলো মেখে স্নান করেছে। জল ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর কপাল, বুক, পিঠ। চুল চুইয়ে ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে দু-এক ফোঁটা। ঘন চোখদুটো তুলে তাকালে ভয় লাগে, যেন একবার সে চোখের নজর পড়লেই বুক অবধি চিরে ফালাফালা করে ফেলবে।

চারু চোখ সরাতে পারে না, মনে হয় অনন্ত জীবন থাকলে চিরকাল এই জ্যোৎস্নামাখা মেয়ের মুখের দিকে চেয়েই ও কাটিয়ে দিতে পারে।

কোনরকমে মুখ চোখের উপর থেকে জলটা মুছে নিয়ে ঈশানী সরে আসে চারুর দিকে। গা দিয়ে জল ঝরতে থাকে ওর।

ঈশানী ঝুঁকে পড়ে ওর ব্যাগ থেকে বের করে একটা সিগারেট মুখে দেয়। পকেট থেকে বার করে একটা দেশলাই জ্বালায় চারু। চারু এগিয়ে যেতে যাচ্ছিল ওর দিকে। হঠাৎ করে একটা চেনা গন্ধ আসে ওর নাকে। এখানে তো গন্ধটা আসার কথা নয়।

‘এখানে কেরোসিন কোথা থেকে…’ চারু কথাটা শেষ করতে পারে না। হঠাৎই ঈশানী প্রায় দৌড়ে আসে ওর দিকে। হাতের একটা ধাক্কায় জ্বলন্ত দেশলাইটা গিয়ে পড়ে ওর শরীরে। চারু দেশলাইটা সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু ততক্ষণে ঈশানীর সমস্ত শরীর হলদে আলোয় ভরে উঠেছে। ঝলসে যায় চারুর চোখ। আলো বের হচ্ছে যেন ঈশানীর শরীর থেকে। এভাবেই কি কল্পনা করেছিল ওকে?

উত্তেজনার মুহূর্তে এতক্ষণ গন্ধটা ও খেয়াল করেনি। একটু আগেই ঈশানী নিজের মাথায় যেটা ঢেলেছে, সেটা জল নয়…

দু-পা পিছিয়ে দাঁড়ায় ঈশানী। ওর শরীর জুড়ে জ্বলে উঠেছে আগুন। সাদা শাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে নীলচে শিখা। আলতা পরা পা বেয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে উঠছে। পুড়িয়ে দিচ্ছে চুল, পিঠ…লেলিহান শিখার উত্তাপে ভরে ওঠে ঘাটটা।

‘চারু…’ অসহায় দুটো হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে দেয় ঈশানীর জ্বলন্ত শরীর, ‘আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে চারু…খুব…যন্ত্রণা…চারু…’

আগুনে পুড়তে থাকা মানুষটার মুখ থেকে কি কান্নার আওয়াজ আসছে? নাকি হাসছে? চারু বুঝতে পারে না।

‘কেন করলি তুই এটা?’ চারু দৌড়ে ওকে ধরতে যায়। কিন্তু পারে না। তার আগেই ঈশানী গায়ের আগুন নিয়ে সজোরে দৌড়াতে শুরু করেছে ঘাটের ধার দিয়ে। ঊর্ধ্বশ্বাসে, উদ্ভ্রান্ত জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে সে।

জলের উপর দিয়ে ভেসে আসা জোলো হাওয়ার স্পর্শে ওর শরীরে আগুন আরও জ্বলতে শুরু করে। বুকে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাস করে ওকে। যন্ত্রণায় উন্মাদের মতো চিৎকার করে মেয়েটা।

‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে চারু…আমি শেষ হয়ে গেলাম…’ হাওয়ায় ভাসা শব্দগুলো জলের মতো ভেসে আসে ওর কানে।

একটা আলোয় ঘেরা জোনাকি-মানুষ হাওয়ায় আঁচল ছড়িয়ে বাতাসের উপরে দিয়ে উড়ে চলেছে।

‘কেন করলি তুই এটা?’ হাঁপাতে হাঁপাতেই প্রাণপণে ওর পেছনে দৌড়তে শুরু করে চারু।

গভীর রাতের উত্তর কলকাতার রাস্তা ধরে ছুটে চলে গাড়িটা। পেছনের সিটে কমলিকাকে নিয়ে বসে আছে গার্গী। গাড়িটা চালাচ্ছে তন্ময়। ওদের দুজনেরই চোখ রাস্তার দিকে। বুকের ভিতরে অসহ্য টেনশন খেলা করে যাচ্ছে ওদের।

‘মেয়েটার ক’দিন ধরে যে কী হয়েছে…’ কমলিকা জানলা দিয়ে বাইরে তাকান, ‘অবাধ্য ছিল, বদরাগী ছিল। এখন কেমন যেন হয়ে গেল।’

‘অভির চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি একদম। তাছাড়া এই ইনভেস্টিগেশনটা এই ক’দিনে…’

‘লোকটা তো বউ সমেত ধরা পড়েছে শুনলাম। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…’

জানলা থেকে মুখ সরিয়ে নেয় গার্গী। মোবাইলের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর বলে, ‘এক বছর আগে অনলাইন ক্লাস করতে করতেই হুট করে ইউনিভার্সিটির এক বছর কুড়ির বড় প্রফেসরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে অভি। অনেক চেষ্টা করে সরে আসার, কিন্তু কিছুতেই অবশেসন থেকে সরে আসতে পারে না। বরঞ্চ যত চেষ্টা করে তত লোকটার প্রতি টান বাড়তে থাকে।

‘অভি ছোট থেকেই প্রচণ্ড জেদি। একবার কোনও কিছু মাথায় ঢুকলে সহজে সেখান থেকে ওকে সরানো যেত না। প্রফেসরের কাছে ও কমপ্লিটলি সারেন্ডার করে। প্রফেসর বুঝতে পারেন বড়লোকের বোকা-সোকা জেদি মেয়েটাকে তিনি শারীরিক বা মানসিক যে কোনরকমভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। সেটাই করতে শুরু করেন। তবে নিজের সেফটির ব্যাপারটা মাথায় ছিল তার। প্রোফেসরের শর্ত ছিল সম্পর্ক রাখতে গেলে অভিকে তার টার্মেই চলতে হবে। নিজের ফোন থেকে যোগাযোগ করা যাবে না। একটা আলাদা নম্বর ব্যবহার করতে হবে। দেখা হবে গোপনে, এবং নিকটতম বন্ধুকেও জানানো যাবে না। অভি ব্যপারটা মেনে নেয়।

‘কিন্তু কিছুদিন পরেই অভি বুঝতে পারে এভাবে চলবে না। ওকেই সম্পর্কটাকে কোনও একটা পরিণতির জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। প্রথমে একটু গাঁইগুঁই, সেখান থেকে সাড়া না পেয়ে ওর জেদ আরও আরও বেড়ে ওঠে। প্রোফেসরের কিছু আচরণে ওর সন্দেহও হয়। ও বোঝে গোপনে লোকটার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে ওকে।

‘কিন্তু খোঁজ নেওয়ার উপায় কী? এসব কাজের জন্য ওর কাছে একমাত্র পরিচিত লোক হল অভিষেক। কিন্তু সে টাকাপয়সার বিনিময়ে এ কাজ করতে চায় না। ততদিনে অভির মাথাটা খারাপ হয়েছে। জেদের চরম পর্যায় পৌঁছে গেছে। অভিষেককে ঠিক কী দিয়ে টোপ দেওয়া যায় সে আগে থেকেই জানত। সেই টোপটাই গিলে ফেলে অভিষেক।

‘তো এইভাবে খবর নিতে গিয়েই ও জানতে পারে ও ছাড়াও আরও বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে প্রফেসরের। ওর বিশ্বাসভঙ্গ হয়। সেই এক জেদের বশেই ও বিদ্রোহ করে।

‘দিনের পর দিন ঝগড়াঝাঁটির পর প্রফেসর শেষবার ওর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হন। কিন্তু প্রফেসর জানতেন না এই অ্যাফেয়ারের খবর ওর স্ত্রীয়ের কাছে কোনভাবে পৌঁছেছিল। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বিজলিমারি সামারক্যাম্পে আসেন।

‘সে রাতে পুকুরের ধারে যখন অভিরূপা প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন হঠাৎ করেই পেছন থেকে প্রফেসরের স্ত্রী অভিরূপার গলা টিপে ধরেন। খুনের প্ল্যান তার আগে থেকে ছিল কিনা জানি না। কিন্তু হঠাৎ করেই তার রাগ সপ্তমে ওঠে এবং প্রফেসরের সামনেই অভিরূপাকে খুন করেন তিনি।

‘ছুরিটা পকেটে থাকলেও সেটা বার করতে যাওয়ার আগেই প্রফেসর সম্ভবত ওর হাতটা ধরে নেন। যেহেতু ছুরিটা ওদের নয় এবং অভির শরীরে ততক্ষণে প্রাণ নেই তাই পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেন সেটা। তারপর বডিটাও একইভাবে…’

সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে একটু সময় লাগে কমলিকার, কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই চুপ করে থেকে একটা প্রশ্ন করেন তিনি, ‘কিন্তু রুনু যখন সবকিছু জানত তাহলে ও আমাদের সেটা বলল না কেন?’

‘বলেছে…’ গার্গী জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়, ‘আপনাকে যা বললাম, তার কিছুটা আমার নিজের আন্দাজ করা। আর বাকিটা ও নিজেই আজ সন্ধ্যায় বলেছে আমাকে।’

‘কিন্তু এতদিন পর বলল কেন?’ কমলিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।

‘জানি না, ও কী করছে আমি বুঝতে পারছি না।’

‘পাগল মেয়ে…কী জানি কী করছে…’ কমলিকার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হয়।

‘কেন করলি তুই এটা?’ ফাঁকা গঙ্গার ঘাট জুড়ে চারুর গলার আওয়াজ ভেসে যায় দূরে। গনগনে আগুন আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে ঈশানীকে। আরও জোরে, আরও হরিণপায়ে ও দৌড়াতে শুরু করে। ওর পা, কোমর, বুক, পিঠ, মুখ, সব ঝলসে দিতে থাকে লেলিহান শিখা। কানের পাশ দিয়ে সেই গরম হাওয়াই দৌড়াতে থাকে চারুর। একটু আগের আঁকা ছবির মতো, শরীরে আলো মেখে দৌড়ায় একটা শাড়ি পরা মেয়ে আর অন্ধকারে ওর পিছু ধাওয়া করে চলে একটা কাকতাড়ুয়া।

কিছুক্ষণ পর ঝলসে যাওয়া শরীরেই রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ঈশানী। উন্মাদ চিৎকার এতক্ষণে গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। পোড়া শরীরে কাতরাতে থাকে মাটির উপর শুয়ে। এখন আর চেনা যায় না ওকে।

চারু দৌড়ে গিয়ে ওর সামনেই বসে পড়ে। মাথার চুলগুলো আর একটাও অবশিষ্ট নেই। পেট আর বুকের কাছে মাংস বেরিয়ে পড়েছে। সমস্ত শরীরময় পোড়া রক্তের গন্ধ। দুহাতে ওকে ধরতে যায় চারু, কিন্তু স্পর্শ করতেই আগুনের উত্তাপে নিজে থেকেই হাত সরে আসে ওর।

‘কেন করলি তুই এরকম?’ হাহাকার বেরিয়ে আসে চারুর গলা দিয়ে। দুহাতে ঈশানীর মাথাটা নিজের কোলের উপরে তুলে নেয় সে, ‘এখানে কাছাকাছি কোথায় হসপিটাল…’

ঈশানীর বুকটা শব্দ করে ওঠানামা করছে। মাংস পুড়ে ভিতরের লাল পাঁজরা দেখা যাচ্ছে। চারুর কোলের উপর হাত রাখে ঈশানী, ছেঁড়া ছেঁড়া যন্ত্রণামাখা শব্দ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, ‘আর কষ্ট দিস না আমাকে। একটু…একটু থাক…’

কী বীভৎস দেখাচ্ছে মুখটা! নরম দুটো গাল পুড়ে গিয়ে গালের হাড় বেরিয়ে এসেছে বাইরে। যেন পরিচিত মুখটায় কেউ আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছামতো।

‘তুই কেন করলি এরকম রুনু?’ চারু আছড়ে পড়ে ওর বুকের উপরে।

তেমনই হাঁপাতে থাকে ঈশানী, পোড়া মুখে হাসি ফোটে তার, ‘কারণ…কারণ…আমার এখানে থাকার কথা নয় চারু…’

চারু ওর কথা বুঝতে পারে না, ওর ক্ষয়ে আসা শরীরটাকে ধাক্কা দিয়ে সচল করার চেষ্টা করে, ‘সব তো ঠিক হয়ে গেছিল। আমরা দুজনে মিলে…তোর মা, কেরিয়ার, তোর স্বপ্ন…’

বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে মেয়েটা, এত যন্ত্রণার মধ্যেও ওর মুখে হাসি ফুটে আছে, বিকৃত হয়ে গেছে পরিচিত মুখ অথচ এই হাসিটা যেন জন্মজন্মান্তর ধরে হেসে আসছে ও, ‘রুনু বড় হতে হতে শুধু বুঝেছিল এই জগৎটা ওর জন্য নয়। এই মৃত্যু, এই লোভ, নিঃসঙ্গতা…’ রুনুর দেহটা আর স্পর্শ করা যায় না। সে ক্ষয়ে আসা হৃৎপিণ্ডের কাছে কয়েকটা মুহূর্ত ভিক্ষা করে নেয়, ‘আমি যতদিন বেঁচেছি চারু, শুধু বুঝেছি এ জগৎ আমার জন্য নয়…তাই…আমি এখানে কারোর কেউ নই…’

দুটো কালচে হয়ে যাওয়া হাত উঠে আসে উপরে। চারুর দুগাল চেপে ধরে সেগুলো, ‘তাই আমি নিজেকে তোকে দিয়ে গেলাম। শুধু আমার স্মৃতি ছাড়া, অনুভূতি ছাড়া, এই বোধ ছাড়া যে আমি এই সংসারের কেউ নই…তুই পারবি না আমার হয়ে থাকতে?’

‘চুপ কর…’ চিৎকার করে ওঠে চারু, ‘তুই কোথাও যেতে পারবি না। এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে গেলে…’

হাসতে হাসতেই মাথা নাড়ে ঈশানী, ‘চুপ…চুপ কর বোকা কোথাকার, অনেকটা পুড়ে গেছি। আমার এতদিনের প্ল্যান ভেস্তে দিবি তুই?’

শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে চারু, ‘সব প্ল্যান ছিল না তোর? প্রথম দিন থেকে। আমাকে জাগানো থেকে, কান্না থেকে, বাড়ি নিয়ে যাওয়া থেকে…সব…সব…’

একটা যন্ত্রণার ঢেউয়ে শরীর কুঁকড়ে যায় ঈশানীর, সেটা সামলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ও আবার মুখ তুলে তাকায়, ‘তুই…তুই…রাগ করিস না আমার উপর। আমার কাছে আর কী উপায় ছিল বল?’

দুহাতে ওর শরীরটাকে সজোরে বুকে চেপে ধরে চারু। বুক ঠেলে কান্নার দমক বেরিয়ে আসে ওর। গঙ্গার শান্ত জল বয়ে চলে ওদের পাশ দিয়ে। তাতে ভেসে যায় দূর থেকে বয়ে আসা লতার চাদর। সে চাদরে কখনও উড়ে এসে বসে একটা ফিঙে। কিছুদূর ভেসে আবার উড়ে কোথায় চলে যায় তারা।

‘কাঁদিস না, একটা কাজ আছে তোর…’ দুটো অক্ষম হাতে চারুকে ঠেলা দেয় ঈশানী, ‘রঙের বালতিগুলো নিয়ে আয়, আর দড়িটা…যা…’

‘কী হবে ওগুলো?’ চারু চোখের জল না মুছেই জিগ্যেস করে।

ঈশানী কথা বলতে পারে না। চারু ওকে ঘাটেই রেখে দ্রুত পায়ে দৌড়ে গিয়ে রঙের বালতিগুলো দুহাতে বয়ে নিয়ে আসে। এতক্ষণ ঈশানীর শরীরটা আরও ঝিমিয়ে এসেছে। ওকে দড়ি নিয়ে আসতে দেখে খুশি হয় সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ফুসফুসটা ঝিমিয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে, ‘এবার ওগুলো আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে দে…’

‘পায়ের সঙ্গে…’ কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় চারু। এরপর কী হবে সেটা এতক্ষণে বুঝতে পারে ও। হাঁটু গেড়ে মাটিতেই বসে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে চারু। ঈশানী সেদিকে চেয়ে বিরক্ত হয়, ‘আঃ, শুধু কাঁদে। এত কাঁদলে রুনু হতে পারবি না…’

মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায় চারু। ঈশানীর কাঁপতে থাকা দুটো পায়ে শক্ত করে বাঁধে দুটো দড়ি। অন্য প্রান্তটা বাঁধে দুটো রঙের বালতিতে। তারপর আবার গিয়ে বসে ওর মাথার কাছে। ওর মাথাটা আবার তুলে নেয় কোলে।

‘মায়ের যত্ন নিস…আমি ছাড়া আর কেউ নেই মায়ের…’

‘নেব…’ চারুর গলা কেঁপে যায়। কোনরকমে উচ্চারণ করে শব্দটা।

‘ওদের কখনও বুঝতে দিস না।’

‘দেব না।’

ঈশানী কাঁদছে কিনা ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, বিকৃত স্বর বেরিয়ে আসে গলা দিয়ে, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে চারু…’

চারু আচমকাই ওর তপ্ত শরীরটাকে সজোরে চেপে ধরে, আবার হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে ও, ‘তুই কেন এমন করলি রুনু, কেন এমন করলি…’

একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে ঈশানীর বীভৎস মুখ জুড়ে, ‘আমার সব দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে গেলাম চারু। যা কিছু আমার ছিল, আমার স্কুল, আমার ছেঁড়া জামা, আমার ঘর, আমার একলা কাঁদার জায়গা, আমার লাল পতাকাগুলো, আমার অভাব, আমার মা…ভালো থাকবি তো?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ে চারু। দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘাটের উপরের রাস্তাটাও হালকা আলোকিত হয়ে ওঠে। ঈশানী তাড়া দেয়, ‘এবার আমাকে জলে ফেলে দে। তাড়াতাড়ি কর, ওরা এসে গেলে…’

ঈশানীর গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এসেছে। যন্ত্রণায় শরীরটা ছোট হয়ে গেছে তার। জোলো হাওয়ার স্পর্শে ক্ষতগুলো আরও লালচে হয়ে উঠছে।

ওর শরীরটা জলের ধারে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় চারু। কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে একবার। ওর চোখের দিকে একবার অবাক চোখে তাকায় ঈশানী। শেষবারের মতো হাসি ফোটে মেয়েটার মুখে, ‘বিশ্বাস কর, আমি জীবনে কাউকে আটকে রাখিনি। শুধু তোকে আমি যেতে দিলাম না কোথাও…তোর কষ্ট হবে জেনেও যেতে দিলাম না তোকে…’ ঈশানীর মুখটা চারুর কানের কাছে আসে, চওড়া হাসি হাসছে সে। শেষ শব্দগুলো বেরিয়ে আসে ধীরে ধীরে, ‘আমাকে ছেড়ে যাস না কোথাও…’

হাতের আলতো ঠেলায় ঈশানীর দগ্ধ শরীরটাকে জলের ভিতর ঠেলে দেয় চারু। মুহূর্তে দেহের ভারে জলের ভিতরে ডুবে যায়। কালচে চামড়ায় নরম জলের স্পর্শ লাগে। দেহ পোড়া ছাই মিশে যায় জলে। ওর পায়ে বাঁধা দড়িগুলোও দেহের টানে গিয়ে পড়ে জলের ভিতর।

মুহূর্তে গঙ্গার গভীরে তলিয়ে যায় সমস্ত কিছু। বাতাসে পোড়া গন্ধ ভাসে। ঘাটের চাতালে কালচে পোড়া দাগ দেখা যায়। জলের স্রোত বেড়ে উঠে আবার কমে আসে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পর…একটা মানুষের চলে যাওয়ার আর কোনও চিহ্ন পড়ে থাকে না কোথাও…

ঘাটের ঠিক উপরেই একটা গাড়ি এসে থামে। নিস্তব্ধতার মাঝে জলের ছপছপ আওয়াজ ঢেকে দেয় ইঞ্জিনের হিংস্র শব্দ। কমলিকাকে নিয়ে নিচে নেমে আসে গার্গী। চারু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে দ্রুত।

গাড়ি থেকেই দেখতে পেয়েছে ওরা। গার্গীই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, ‘কী হয়েছে বল তো তোর? কাঁদছিস কেন?’ কথাটা বলতে বলতেই এক হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দেয় সে।

কমলিকাও নেমে এসেছে। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসেন তিনি। দুটো হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন রুনুকে, ‘এভাবে হুট করে বেরিয়ে যায় কেউ বাড়ি থেকে? মা বুড়ো হয়েছে, চিন্তা হয় না? চল, বাড়ি চল, তোর হচ্ছে আজ…’

দুটো মানুষ দু’দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে রুনুকে। গঙ্গার উপর দিয়ে ভেসে আসা হাওয়া এখনও আগের মতোই বইছে। ভোর হবে কি একটু পরে? কে জানে?

‘মায়ের উপরে অভিমান করে বোকা মেয়ে? কে আছে আমার তুই ছাড়া?’ কমলিকা নিজের চোখের জল মোছে।

‘আচ্ছা, আমার বাড়ি চল দুজনে, একসঙ্গে অনেক গল্প করব, কেমন? আর ওই কী যেন সাংবাদিকটা, ও তোর ইন্টারভিউ নেবে বলেছে…খবরের কাগজে…’ হাসি মুখে ঈশানীর দিকে চেয়ে কথাগুলো বলছিল গার্গী। হঠাৎ ঘাটের ভিতরের দিকে দৃষ্টি গিয়ে পড়ে তার। ভালো করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে সে, ‘এই, তুই কী পুড়িয়েছিলি এখানে?’

‘তুই কী পুড়িয়েছিলি এখানে?’ ফাঁকা ঘাটে যেন প্রতিধ্বনিত হয় শব্দগুলো।

দুটো মানুষের মাঝে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে চারু। ওদের কোনও কথা কানে ঢুকছে না ওর। চোখদুটো গঙ্গার জলের উপর স্থির হয়ে গেছে। যে জলের উপর আর কোনও আলোড়ন নেই। একই ভাবে ভেসে যাচ্ছে একগুচ্ছ লতা। তার উপরে এসে বসছে ঘাটের পাখি। কী যেন খুঁজে নিয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে দূরে।

চোখ বন্ধ করেও চারু দেখতে পায় ভাসতে ভাসতে জলের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে ঈশানীর শরীরটা। যেখান থেকে আর কখনও ফিরে আসবে না সে, আর কখনও ভেসে উঠবে না জলের উপরে। পুড়ে যাওয়া শরীর আর কোনও প্রমাণ রাখেনি তার অস্তিত্বের।

কেবল জলের ভিতর ওর পায়ে বাঁধা রঙের বালতিগুলোর ঢাকনা খুলে গেছে। আর সেই বালতি থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য রং। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো সে রামধনু বেরিয়ে এসে গঙ্গার ঘোলাটে জলকে রঙিন করে উঠে আসছে উপরের দিকে।

চারু দেখতে পায়, ওইটুকু বালতির রঙে একটু একটু করে রঙিন হয়ে যাচ্ছে ঘোলাটে জলের নদীটা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *