কাকতাড়ুয়া – ১৭

সপ্তদশ অধ্যায়

‘আজ আর আমার চালাতে ইচ্ছা করছে না। তুই চালা, আমি বসে থাকি…’ কথাটা বলে ঈশানী সাইকেলের সামনে উঠে বসে পড়ে। চারু বসে ওর পেছনে। তারপর প্যাডেল করতে থাকে একমনে। ওর মুখে আজ বিশেষ কথা ফুটছে না। কী যেন ভাবনায় ডুবে রয়েছে সকাল থেকে।

আজ স্কুটিটা বের করেনি ওরা। তার বদলে ওর বাবার পুরোনো সাইকেলটা বের করেছে ঈশানীই। আগে অনেকবার ভেবেছিল বিক্রি করে দেবে। তাও অবহেলায় রয়ে গিয়েছিল সিঁড়ির এক পাশে। আজ অনেকদিন পর সেটা চড়তে ইচ্ছা করেছে।

খোলা রাস্তা দিয়ে প্যাডেল করতে থাকে চারু। ঈশানীর মাথাটা বারবার ওর বুকে ধাক্কা খাচ্ছে। ওর ঠোঁট গিয়ে লাগছে ঈশানীর মাথায়। রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে ঘিরে ধরছে ওদের বারবার।

আজ একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছে ঈশানী। চারু আলতা লাগিয়ে দিয়েছে ওর পায়ে। মাঝে মাঝে সাইকেল জোরে চললে হালকা হাওয়ায় উড়ছে শাড়িটা। তেলের গন্ধ আসছে ওর চুল থেকে। এতকিছুর মধ্যেও কপালের ফেট্টিটা মানিয়ে গেছে ওকে। চুলের ঢল অভিমানি চোখের জলের মতো কোনরকমে সামলে রেখেছে। মাঝে মাঝে অকারণেই সাইকেলের ঘণ্টি বাজাচ্ছে সে। টুংটাং আওয়াজটা মন ভালো করে দেয়। যেন অজান্তেই বলে যায় আজ খারাপ কিছু ঘটবে না। আজ ভালো কিছু ঘটার দিন।

‘তোর আমাকে মনে থাকবে চারু?’ হঠাৎ করে জিগ্যেস করে ঈশানী। ওর মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

‘আমার মন বলে কিছু থাকবে কিনা তা-ই জানি না। তোর কষ্ট হবে না?’

‘আমার কষ্ট বলে কিছু আছে কিনা তা-ই জানি না…’ হাতে ধরা জয়েন্টে টান দেয় ঈশানী, ‘তবে এই ক’দিন মজা হল বল? কত কী করলাম, দু’একটা লোকের পেছনে লাগলাম, দু’একজনকে ছুট করালাম, একটা ছোটখাটো আন্দোলন টাইপের শুরু করে দিলাম…নিজের জীবনটা কোথায় গিয়ে যেন ঠিক হয়ে গেল…একটা পারফেক্ট জীবন, সবকিছু ঠিকঠাক। মায়ের সঙ্গেও ক্যাচাল নেই। হারামির বাচ্চার অফিসটা ছেড়ে দিলাম, সাংবাদিকটা ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য গরুখোঁজা খুঁজছে, মনে হয় একটা ভালো চাকরিও পেয়ে যাব। কী বল?’

চারু ঘাড় নাড়ে, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, তুই যা চাইবি ঠিক তাই হবে…’

ঈশানীর মুখে চওড়া করে একটা হাসি ফোটে, ‘তুই তো এক রকমের ভগবান। যে যা চাইবে তাকে তাই দিয়ে দিতে পারিস…’

‘ধুর, আমার বিশ্বাস হয় না। আমি অত বড় কিছু নই।’

‘তুই আমার কাছে তার থেকে বড় কিছু ছিলিস। বন্ধু ছিলিস। আচ্ছা…’ কী যেন ভেবে ঈশানী প্রশ্ন করে, ‘তোর কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবি?’

‘কী?’

‘আমাকে বিয়ে করবি?’

থতমত খায় চারু, ‘বিয়ে…মানে…’

হেসে ফেলে ঈশানী। তারপর জয়েন্টে আরেকটা লম্বা টান দেয়, ‘ইয়ার্কি মারছিলাম, তোকে তো বলা হবে না আর। আমি জীবনে কাউকে এরকম নিব্বি টাইপের কথাবার্তা বলিনি।’

‘বিয়ে করতে চাওয়ার সঙ্গে নিব্বির কী সম্পর্ক? বিয়ে একটা সিরিয়াস ব্যাপার, ঠিকঠাক হলে জীবন বর্তে যায়।’

‘তোকে যে ক’দিন পেয়েছিলাম তাতেই বর্তে গেছি, আরও রেখে দিলে কী হত কে জানে…এই একটা গান শোনা আমাকে…’

‘এখানে? সাইকেলে যেতে যেতে?’

‘হ্যাঁ, সেই যে গানটার কথা বলেছিলাম তোকে? বাবা শোনাত আমায় গুনগুন করে? ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস…’

চারু মিহি স্বরে গাইতে থাকে গানটা। কিছুক্ষণ মন দিয়ে শোনে ঈশানী। দুপাশের বাড়িগুলোর দিকে মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আকাশের দিকে। এক সময় মুখ না ফিরিয়েই জিগ্যেস করে, ‘এই, মানে কী বলত গানটার? গানটা শুনলে কোন দৃশ্য মাথায় আসে?’

একটুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয় চারু, ‘মনে হচ্ছে একটা লোক যে বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না। কিন্তু তাও তাকে যেতে হচ্ছে। সে জানে অনেক অনেক বছর পর অবধি শুধু তার ট্রেনের হুইসল শোনা যাবে…’

‘ট্রেনের হুইসল জিনিসটা কী অদ্ভুত! তাই না? শুনলেই মনে হয় কাকে যেন ডাকছে। যেন কাছে আসতে বলছে। শুধু যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে, সে সেই ডাক শুনে ছুটে যেতে পারে না। অন্য সবাই পারে, শুধু সে নয়…সে শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। হুইসলটা ওকে বলে—আমি তোমার জীবনে কষ্ট হব না, দুঃখ হব না, আমার কাছে কখনও আসতে ইচ্ছা করবে না, পাশে বসে গল্প করতে ইচ্ছা করবে না, শুধু শুনতে পাবে আমি ডাকছি। পাঁচশ মাইল দূর থেকেও ডাকছি…’

সাইকেল চালিয়ে শোভাবাজার ঘাটের ধারে এসে পড়ে ওরা। এত রাতে সমস্ত ঘাট শুনশান হয়ে গেছে। কোথাও একটা জনপ্রাণীর দেখা নেই। এর আগে যতগুলো জায়গায় ওরা গিয়েছিল তার কোথাও কেউ না কেউ ছিল। অন্ধকারের আড়ালে ওদের লুকানোর দরকার পড়েছে। আজ লুকানোর কোনও কারণ নেই।

ঘাটের একধারে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে দেয় চারু। ঈশানী চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে, ‘আমি কখনও রাতের গঙ্গা দেখিনি। চল, একটা জায়গা দেখাই তোকে। ওখানেই ছবি আঁকব আজ। কেউ দেখতে পাবে না হয়তো, শুধু আমাদের জন্য…’

‘কিন্তু কী আছে ওখানে?’

‘কিচ্ছু নেই, শুধু আমার যখন খুব মন খারাপ হত ওখানে এসে বসে থাকতাম। গঙ্গার ধারে অনেকের সঙ্গে ঘুরতে এসেছি। আমার এক্স, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার ক্রাশ, কলেজে পড়তাম যখন বন্ধুরা মিলে এখানে এসে গান বাজনা করতাম, গাঁজা খেতাম। কিন্তু এই জায়গাটায় আমি কখনও কারও সঙ্গে আসিনি। আমার মন খারাপের ঠিকানাটা তুই ছাড়া আর কাউকে জানাব না আমি…’

গঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে কিছু দূর চলে আসে ওরা। শ্মশান পেরিয়ে, পুতুলবাড়ি পেরিয়ে হাঁটতে থাকে। একটু সন্ধের দিকে এলে জমজমাট হয়ে থাকে জায়গাটা। লোকচলাচল করে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা সেলফি তোলে জড়ো হয়ে। আইসক্রিম আর মোমোর দোকানে হট্টগোল, অটোর হাঁকডাক। রেলগেট পড়ে যাওয়ার পর লোকের ভিড়ভাট্টা। এখন সব শান্ত হয়ে গেছে। জীবন্ত প্রাণী বলতে কয়েকটা কুকুর আর রাস্তার ধারে ব্যোম হয়ে পড়ে থাকা কয়েকটা ছোকরা গাঁজাখোর।

সেসব ছাড়িয়ে একটা বাঁধানো ঘাটের কাছে চলে আসে ওরা। দু-চারটে মানুষের বসার মতো জায়গা করা আছে সেখানে। এখানে বসলে গঙ্গাটাকে দেখা যায় পুরোপুরি। অথচ গঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া লঞ্চ থেকে কেউ চাইলেও দেখতে পাবে না ওদের।

এ জায়গাটায় এমনিতেই কিছু গ্রাফিতি করা আছে। পুরোনো কলকাতার বাবুদের ছবি। তার মধ্যে ওদের ছবি আলাদা করে চিনে নেওয়ার উপায় প্রায় নেই বললেই চলে।

তবু তার মধ্যে একটা ফাঁকা দেওয়াল খুঁজে নেয় ঈশানী। আলতো করে হাত বুলায় সেই দেওয়ালে। তারপর হাতের ব্যাগ খুলে রংয়ের কৌটোগুলো বার করতে থাকে। আজ বড় করে ছবি আঁকবে বলে দুটো রঙের বালতি এনেছে ঈশানী। সেগুলো চারুই ব্যাগ থেকে বের করে দেয়।

‘আজ এতগুলো রঙ এনেছিস কেন? ক’টা ছবি আঁকবি?’

‘একটাই, তবে বড় করে। আজ চলে যাবি তো, তাই ইচ্ছা হল…’

ঝমঝম শব্দ করে সাইকেলটা নিয়ে একটু পেছনে সরে এসে দাঁড়াল চারু। ফেট্টিটা মাথার উপরে তুলে চুলগুলো বেঁধে নিল ঈশানী। তারপর রং চড়ালো দেওয়ালে।

‘কথা বলছিস না কেন বল তো? আমার উপর রাগ হচ্ছে, না তোর?’

‘কেন?’ আঁকতে আঁকতেই জিগ্যেস করে ঈশানী।

‘এই যে আমি আজ চলে যাচ্ছি।’

‘ধর, যেতে দিলাম না তোকে…ধরে রাখলাম।’

চারুর মুখে করুণ হাসি ফোটে, ‘আমার কষ্ট হবে জেনেও আমাকে আটকে রাখবি না তুই। আমি চিনি তোকে…’

যেটুকু রং চড়েছে সেটা ভালো করে দেখে ঈশানী, ‘আমাদের কন্টেন্ট ভাইরাল হয়েছে কিন্তু। ইন্সটাগ্রাম খুললেই চারিদিকে হ্যাশ ট্যাগ দেখতে পাচ্ছি।’

‘ওটাকে বন্ধ হতে দিস না। আমি জানি তুই একাই পারবি।’

আবার তুলি টানতে থাকে ঈশানী, ‘আমি কোনওদিন কিছু একা পারিনি। আমি, আর একটা মানুষের অনুপস্থিতি, কখনও বাবার, কখনও বান্ধবির, কখনও তোর। তুই চলে যাওয়ার পর যে ছবিটা আঁকব সেটাও আমার মাথায় ঘুরছে, বুঝলি?’

‘কী ছবি?’

‘একটা ফাঁকা ঘাট, শুধু মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। কাকতাড়ুয়া নেই। চাঁদ আছে, জল আছে, মেয়েটা হয়তো নাচছে, কিন্তু সব কিছুর মাঝখান থেকে কাকতাড়ুয়া গায়েব।’

ছবিটা ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছে দেওয়ালে। একে একে চড়েছে নীল, হলদে আর হালকা খয়েরি। ক্রমশ একটা ছবি ফুটে উঠছে তাতে। ফ্রেমের একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে মেয়েটা এগিয়ে যাচ্ছে আলোর দিকে। উল্টোদিকের অন্ধকারে কাকতাড়ুয়া মিশে যাচ্ছে…

ছবিটা দেখতে দেখতে একটা হাসি ফুটল চারুর মুখে, ‘তোকে কে বলল আমি অন্ধকারে যাচ্ছি? আমি যেখানে যাব সেখানে অন্ধকার তো নাও থাকতে পারে।’

‘তাতে কী? কোথায় যাচ্ছিস আমিও জানি না। ছবিটা আমি এঁকেছি, আমার কাছে তো থাকছিস না। আমার কাছে তুই এরপর থেকে অন্ধকার…’

‘তুই ভুলে যাবি আমাকে?’ চারুর গলা ধরে আসে।

ঈশানী মুখ বাঁকায়, ‘এইজন্যই বলেছিলাম বিয়ে করে নিতে। সুখে শান্তিতে ঘর করব একসঙ্গে। সেক্স করব, “ও মাই গড” বলে চিৎকার করলে তোর গায়ে লাগবে না। ইচ্ছা হলে তোর জন্য ভাত রান্না করব, ভাত পুড়ে গেলে তোকেই খাব। দুটো তিনটে আন্ডা বাচ্চা হবে, তাতা থই থই নাচবে…এই আমাদের বাচ্চা হলে কী নাম দেব বল তো?’

‘কী?’

‘নরহাঁড়ি পাতিল…’

দুজনেই হেসে ওঠে। চারু ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নদীর দিকে চায়, ‘বিয়ে কর আর যাই কর, কোনকিছুই চিরকাল থাকবে না। তুইও কি চিরকাল থেকে গেছিস কারও কাছে?’

‘আরে আজব তো! অন্য কাউকে দু’ঘা কিল মারার পর আমার পিঠে কিল পড়লে কি কষ্ট কম হয়? জীবনটা যদি ডেবিট ক্রেডিটের খেলা হয় তাহলে সব হিসাব মিলে যায়। কিন্তু আমি হিসাব মেলার কথা বলছি না। কষ্টের কথা বলছি। বেঁচে থাকতে খুব কষ্ট হয়। জাস্ট আত্মহত্যা করতে পারি না বলে বেঁচে আছি আমি…’

‘তোর মুখে এসব কথা শুনলে তোর বাবা খুব কষ্ট পেত।’

ঈশানী হাসে, ‘বাবা শুনতে পেলে কথাগুলোই থাকত না। বাবা শুনতে পায় না বলেই কথাগুলো জন্মেছে…’

চুলগুলো আবার খুলে দিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যায় ঈশানী। একটা সিঁড়ির পাঁচিলের উপর হাত রেখে বলে, ‘বাবা যখন মরে গেল, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল সত্তর বছর আগে বাবা যখন জন্মেছিল তখন যে মানুষগুলো বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদের কথা। তাদের কেউ হয়তো এসে দাদুকে ডেকে বলেছিল, শুনছ তোমার ছেলে হয়েছে, কেউ হয়তো শাঁখ বাজিয়েছিল। কেউ মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কেউ বাচ্চার নাড়িটা কেটেছিল তখন। সেই মানুষগুলোর কাছে আজকের দিনটা কী ভীষণ অবাস্তব ছিল, তাই না? আমি চাই আমার কাছেও ঠিক ততটাই অবাস্তব হোক বাবার চলে যাওয়াটা। ওই মানুষগুলোর মধ্যে মিশে যাওয়া যায় না চারু?’

‘জানি না…’ চারু এগিয়ে এসে ওর চোখের কোল থেকে জল মুছে দেয়। মাথাটা ধীরে ধীরে টেনে নেয় বুকে, ‘ভয় লাগছে তোর, তাই না?’

দুহাতে চারুকে জড়িয়ে ধরে ঈশানী। ওর জামা ভিজে যায় অবাধ চোখের জলে। ভেজা চুল ওড়ে বুকের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে কেঁপে ওঠে মেয়েটার শরীরটা। ও হাঁটছে না, তাও নূপুরের শব্দ শোনা যায়। তেলের গন্ধটা আরও ঘন হয়ে আসে। চারুর মনে হয় একটা নরম আবেশে ও ডুবে যাচ্ছে। ঝড়ে বাসাহারা উদ্ভ্রান্ত পাখির মতো মেয়েটা মিশে যেতে চাইছে ওর বুকে।

‘ধুর…’ ওর বুক থেকে মুখ তোলে ঈশানী, ‘আমি না, তুই ভিতু।’

ওর গাল টিপে দেয় চারু, ‘আমার তো আর কেউ নেই রুনু। ভয় পেলে শুধু তোকেই জড়িয়ে ধরার থাকে…’

‘আচ্ছা! তাই সেদিন রাতে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলি আমাকে?’

উত্তর দিতে যাচ্ছিল চারু। থেমে যায়। মাথার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন ফুটে উঠছে ওর। ও অবাক হয়ে ঈশানীর দিকে তাকায়, ‘তোর যদি সে রাতের কথা কিছু মনেই না থাকে, তাহলে তুই জানলি কী করে আমি তোকে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম?’

ঈশানীর চোখের কোণে কাজল এখন আগের চেয়ে আরও গাঢ় হয়েছে। ঠোঁটের কোণে একটা মিহি হাসি ফুটে ওঠে…

‘বাবা, ও বাবা, বলো না গল্পটা…ঘুমিয়ে পড়ছ কেন? বাবা…’ বাবাকে ঠেলা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে রুনু। সঞ্জীবনের ঘুম পেয়েছিল। তার উপর শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। তাও মেয়ের আবদারের সামনে কোনও ওজর চলে না।

‘আচ্ছা কীসের গল্প শুনবি বল।’ মেয়ের দিকে ফিরে শোন তিনি।

‘ভূতের গল্প।’ চোখ গোলগোল করে বলে রুনু।

‘কিন্তু ভূতে তো আমি বিশ্বাস করি না।’ মেয়ের হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে স্মৃতি হাতড়ান সঞ্জীবন, ‘তবে হ্যাঁ, একটা লোক আমাকে একটা ভূতের গল্প বলেছিল। সেইটার কথা আমার এখনও মনে আছে।’

‘কী রকম?’

কপালে হাত রেখে ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করেন সঞ্জীবন। এতকাল আগের ঘটনা ভালো করে মনে পড়ার কথা না। তাও ব্যাপারটা এতটাই চমকপ্রদ যে মনের ভিতরের পাতকুয়োর তলানিতে এখনও রয়ে গেছে। সেই কুয়োতেই বালতি ডোবান।

‘অনেক বছর আগের কথা, বুঝলি? আমি একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে লুকিয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের একটা গ্রামে।’

‘কোন গ্রাম?’

সঞ্জীবন আবার স্মৃতি হাতড়ান, ‘যদ্দূর মনে পড়ছে গ্রামের নাম ছিল বিজলিমারি…’

নামটা পছন্দ হয়ে রুনুর। ঠোঁটের কোণে কয়েকবার সেটা উচ্চারণ করে নেয়।

‘তো সেই গ্রামে ছিল এক বিশাল জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে ছিল কয়েকটা পুরোনো বাড়ি।’

‘জঙ্গলের মধ্যে? কে থাকত সেখানে?’

‘বাড়িগুলো কারা তৈরি করেছিল কেউ জানে না।’

‘ভূতুড়ে বাড়ি?’

সঞ্জীবন আপত্তি করেন, দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলেন, ‘ভূতুড়ে বাড়ি বলে কিছু হয় না রুনু। যে বাড়িতে মানুষ থাকে না, আর যে মানুষের কাছে অন্য মানুষ থাকে না তাদের লোকে ভূতুড়ে বলে ভুল করে। যাক গে, তো সেই বাড়িটায় আমরা মাসখানেক লুকিয়েছিলাম। তখন সেই বাড়িগুলোতে একটা অদ্ভুত লোক থাকত। কী করে থাকত কে জানে। জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচোরা বাড়ি। কোথাও কিছু নেই, ধুধু ফাঁকা। বাজার দোকান করতে গেলেই সাইকেল নিয়ে ঠেঙিয়ে অনেক দূর যেতে হয়। তো সেই লোকটা একবার একটা গল্প বলেছিল আমাদের…’

‘কীসের গল্প?’

‘একটা দেবতার। তার শরীরের মাটি থেকে তৈরি হয়েছিল একটা হাঁড়ি। লোকটা বলেছিল বিদেশ থেকে একবার কে যেন নিয়ে এসেছিল হাঁড়িটা। তারপর লুকিয়ে ফেলেছিল এদেশের এক রাজার কাছে। তারপর সেই রাজার মন্ত্রী সেই হাঁড়ি চুরি করে অন্য কাউকে দেয়। তারপর নানান হাত ঘুরতে ঘুরতে সেটা এসে পৌঁছায় বঙ্গদেশে। তো তখনকার বুদ্ধিমান কিছু লোক দেখল হাঁড়িটা যে-সে লোকের হাতে পড়লে তো মহা মুশকিল। তারা হাঁড়িটা লুকিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করল। আবার মাটির তলায় কি অন্য কোথাও লুকাতে দরকারে সেটা খুঁজে বের করে আনাও মুশকিল। তখন তারা এই জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি বানিয়ে কিছু লোককে দায়িত্ব দিল সেটার রক্ষণাবেক্ষণ করতে…’

‘হাঁড়িতে কী ছিল বাবা?’

সঞ্জীবন চোখদুটো নাটকীয় কায়দায় গোলগোল করে বলেন, ‘সেই হাঁড়িটা পুতুলের মতো করে সাজিয়ে যাকে খুশি তৈরি করা যায়। একদম আসলের মতো। শরীরটা এক, অবিকল হাত নাক মুখ চোখ পেট সব এক…শুধু আত্মাটা আলাদা।’

‘যাকে খুশি বানিয়ে ফেলতে পারব? যেমন খুশি মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারব? কী করে?’

‘নিয়ম হল…’ সঞ্জীবন কিছুটা স্মৃতি হাতড়ে আর কিছুটা আন্দাজে বলতে থাকেন, ‘আমরা যার শরীর বানাতে চাইছি তার কথা মনে মনে ভাবতে ভাবতে তার মতো করে একটা মুখ এঁকে দিতে হবে ওই হাড়ির গায়ে।’

‘তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে?’

‘উঁহু, শুধু আঁকলেই হবে না। তারপর সেই গোটা জিনিসটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে অন্ধকারের মধ্যে। যেই সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবে, পুতুলের গায়ে আর কোনও আলো থাকবে না, অমনি নিজে থেকেই পুতুলটা বদলে মানুষ হয়ে যাবে।’

‘যে-কেউ পুতুলটা ব্যবহার করতে পারবে?’ রুনু গালে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে। তার আগ্রহ আপাতত তুঙ্গে উঠেছে, ‘উঁহু, সে যেহেতু দেবতা, তাই তার সামনে কোনও ফাঁকি চলবে না। তাকে তুলে এনে পুজো করা যায় না। যেখানে সে থাকবে সেখানেই তার সামনে গিয়ে মনের সব কথা খুলে বলতে হবে। তাহলে সে সব ঠিক করে দেবে…’

‘কেন?’

‘কেন আবার কী রে? ওটাই তো দেবতার কাজ।’

রুনু অভিযোগ করে, ‘তুমি যে বলো ভগবান বলে কিছু নেই…’

হাত দিয়ে মেয়ের মাথার চুল ঘেঁটে দেন সঞ্জীবন, ‘যে মানুষ অন্য মানুষের কষ্টে পাশে থাকে, তাকে ভালোবেসে তার বেঁচে থাকাটা একটু সহজ করে দেয়, তাকে অনেকে অনেক নামে ডাকে। কেউ বন্ধু নামে ডাকে, কেউ ভগবান বলে ডাকে…’

‘হাঁড়িটা চিনব কী করে?’

এইবার একগাল হাসেন সঞ্জীবন, ‘এখনকার হাঁড়ি সাধারণত মিশমিশে কালো হয় না। কিন্তু ওই হাঁড়িটা ছিল কালো। তার পেছনে দুটো চিহ্ন ছিল।’

‘কীসের চিহ্ন?’

‘সেইটাই মনে পড়ছে না। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। দেখে বলে দেব নাহয়। এখন ঘুমা…’

চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে মেয়েটা। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে টুকটুক করে। ওর মনের ভেতর অদ্ভুত ভাবনাটা গেঁথে যায়। সত্যিই কি এরকম হয়?

বাবা আজ অবধি ওকে মিথ্যে কথা বলেনি কখনও। বাবা কি তবে জেনে বুঝে ওকে মিথ্যে বলল? অদ্ভুত বাড়ির সেই অদ্ভুত লোকটা কি বাবা মন থেকে বানিয়েছে? রুনু ঠোঁটে হাত রেখে গভীর ভাবনায় ডুবে যায়…

নাটক প্রায় শেষের দিকে। গরম গরম মনোলগ ডেলিভার করছে একটা ছেলে। এরপর নাটক শেষ হবে বাউল গান দিয়ে। কলাকুশলীরা সবাই গ্রিনরুমের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছে। কেবল বাউল চরণদাস বসে আছে স্টেজের একপাশে। তার মুখ কাঁচুমাচু। বিপদে পড়েছে সে।

আজ পেমেন্ট নিয়েই বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু প্রোডিউসার একটু আগে এসে জানিয়েছে আজ টিকিট তেমন বিক্রি না হওয়ায় সবার পেমেন্ট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আজ খালি হাতেই বাড়ি যেতে হবে তাকে। পরের শো’তে ডাবল পেমেন্ট হবে।

কিন্তু খালি হাতে বাড়ি ফেরার উপায় নেই চরণদাসের। সেই গ্রাম থেকে কলকাতা আসার পথে পকেটে যেটুকু টাকা ছিল সব বাস আর ট্রেন ভাড়ায় ফুরিয়ে গেছে। ওইটুকু টাকা অবশ্য চাইলে এরা দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু চরণদাসের ওই এক রোগ। সে মুখ ফুটে দরকারের কথা বলতে পারে না।

আপাতত না জুটেছে পেমেন্ট, না পেয়েছে খাবার দাবার। খালি পেটে কী আর মন থেকে গান আসে? অগত্যা দোতারাটা হাতে নিয়ে তারটা সুরে বাঁধছিল সে। এমন সময়ে একটা অল্পবয়সি মেয়ে এসে বসে পড়ল ওর পাশে, ‘টাকা লাগবে নাকি কাকা?’

মেয়েটার হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট। সেটা চরণদাসের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে সে, ‘আপনি এটা খেয়ে নিন। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে…’

খুশি হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল চরণদাস। ভারি মিষ্টি মুখ মেয়েটার। ততটাই নরম গলার আওয়াজ। সে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তোমাকে কে বলল টাকার দরকার?’

‘আপনি অনেকক্ষণ থেকে পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করে গুনছিলেন আর মুখ চুন করে আবার ঢুকিয়ে রাখছিলেন, তাই ভাবলাম…তবে এমনি এমনি পয়সা আমি দিই না…’ মেয়েটা জোর করেই কঠিন করল গলার স্বর, ‘আমাকে একটা গান শোনাতে হবে…’

মেয়েটাকে মনে ধরল চরণদাসের। ও গ্রামের বাউল। গান গেয়ে যে ক’টা টাকা পায় তাতেই ওর সংসার চলে যায়। তার বাইরে অতিরিক্ত আদর আপ্যায়ন কেউ করে না বললেই চলে। উল্টে গ্রামের দিকে ও নিজেই যেচে পড়ে গান শুনিয়ে বেড়ায়।

‘কেন শোনাব না? কী গান শুনবে বলো?’

‘এমন গান যেটা আমি আগে কখনও শুনিনি।’

চরণদাস হেসে ফেলে, ‘তোমরা শহরের ছেলেমেয়েরা আর তেমন বাউল গান শুনেছ কবে?’

দোতারা কোলে নিয়ে টুংটাং করে সে, ‘বাউল গান শুনতে গেলে আমাদের গ্রামে যেতে হবে।’

‘তুমি ওখানেই গাও?’

চরণদাস হাত ঘোরায়, ‘রাস্তাঘাটে গাই, হাটের লোক শোনে। কেউ ডাকলে গাই…আর সন্ধেবেলা মাঠে বসে গাই। তখন শুধু একটা কাকতাড়ুয়া শোনে…’

‘কাকতাড়ুয়া গান শোনে?’ ঈশানী হেসে ফেলে।

‘সত্যি গো!’ চোখ বড় বড় করে বলে চরণদাস, ‘আমাদের গ্রামের খেতে একটা কাকতাড়ুয়া আছে বুঝলে? আমি তারই সামনে বসে গান গাই। গাইতে গাইতে কেবল মনে হয় কালো হাঁড়ির মাথাটা আমার দিকে ঠায় চেয়ে গান শুনছে। যেন জীবন্ত…আগে আগে ভয় করত, এখন ভালো লাগে…’

‘কালো হাঁড়ি? কোন গ্রামে থাকো বললে তুমি?’

‘বিজলিমারি, নাম শুনেছ?’

মাথা চুলকায় ঈশানী, ‘চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় শুনেছি মনে পড়ছে না…’

‘এই তো, দেখো না। আমার কাছে ছবিও আছে।’ চরণদাস নিজের স্মার্ট ফোন বের করে তার গ্যালারিতে মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়ুয়ার একটা ছবি দেখায়। বোঝা যায় সেটা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ আছে তার। আবার একই চর্বিতচর্বন করতে থাকে সে, ‘খালি মনে হয় যেন সে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে গান শোনে। ক’দিন পরে গেলে মন খারাপ করে। দুঃখের গান গাইলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। আনন্দের গান গাইলে যেন দু’হাত তুলে নাচতে চায়। এত জায়গায় এত লোককে গান শুনিয়েছি…ওকে শুনিয়ে যা আনন্দ, তা আর কোথাও পাই না…’

একটা পুরোনো গল্প এতক্ষণে মনে পড়ে যায় ঈশানীর। এ গল্পটা বাবার কাছে অনেকবার শুনেছে। বাবা নিজেও অবশ্য বিশ্বাস করত না গল্পটা। ওর কী খেয়াল হয়, হুট করে চরণদাসের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় ও, ‘তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে কাকা?’

‘কী কাজ?’

‘এরপর যেদিন যাবে আমার জন্য একটা জিনিস দেখে দেবে? কাকতাড়ুয়াটার পিছনে কোনও চিহ্ন আছে কিনা?’

একটুও সময় নেয় না চরণদাস, ‘আছে তো…’

‘মানে?’

‘একদিন ওর মাথাটা খুলে আমি দেখেছি। ওর পেছনে একটা ঘুড়ি আর একটা পাখির ছবি আছে। কে খেয়াল বসে করে রেখেছে কে জানে…’

বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। ওর মাথার ভিতরটা ভোঁভোঁ করছে। বুকের ভিতর বহুদিন আগে বন্দী হওয়া একটা পাখি ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যেতে চাইছে বুঝি কোথাও।

ঝুমঝুম শব্দে বেল পড়ে গেল নাটকের। চরণদাস উঠে দাঁড়াল, ‘আসতে হবে দিদিভাই। গান গাওয়ার সময় হল…আমি চললাম। এরপর আবার শো থাকলে এসো…তখন কথা হবে…’

তটস্থ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী। চরণদাস স্টেজে উঠেছে। নাটকের শেষে তার গলায় খেলছে লালনের গান। মাঠে ঘাটে ঘুরে, মন্দিরে, মসজিদে, দরগায়, বাড়ির নিকোনো উঠোনে, পুকুরঘাটে কাকে যেন খুঁজে চলেছে ফকির লালন।

কিন্তু সেদিকে মন বসে না ঈশানীর। বাবা কি তাহলে মিথ্যে বলেনি? সেই লোকটাও কি মিথ্যে বলেনি তবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *