কাকতাড়ুয়া – ১৬

ষোড়শ অধ্যায়

সোমবারে কাজের প্রেশার এমনিতেই বেশি থাকে। নিজের চেম্বারে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দ্রুত কাজ সারছিলেন গোস্বামী। এমন সময় বাইরে থেকে মেয়েলি গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘স্যার, আসব?’

গোস্বামী উত্তর দিলেন না। একবার মুখ তুলে আবার মাথা নামিয়ে নিলেন। প্রশ্নটা আবার আসবে ভেবেছিলেন, কিন্তু এল না। উল্টে কাচের দরজাটা একটা লাথিতে খুলে গেল।

জিন্সের সঙ্গে জ্যাকেট গোছের একটা জামা পরে ঢুকে এল মেয়েটা। গোস্বামী অবাক হয়ে তাকালেন তার দিকে, ‘একী! তুমি নক না করে ঢুকে পড়লে কেন?’

‘আপনি এখানে বসে হস্তমৈথুন করেন নাকি যে নক করে ঢুকতে হবে?’ ঈশানী এগোতে এগোতে বলল।

‘স্কাউন্ড্রেল! তোমার লজ্জা করছে না, বসের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলতে?’

চুকচুক করে মেয়েটা একটা শব্দ করে মুখ দিয়ে, ‘ওই দেখুন, আপনারা এই ইংরেজি গালি দেন, ফ্রাস্ট্রেশন ক্লিয়ার হয় না। উপরের বদলে নিচে দিয়ে বের করতে হয়…’

কথাটা বলে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে দেশলাই দিয়ে ধরায় ঈশানী। তার ধোঁয়াটা উড়ে যায় উপর দিকে। দেশলাইটা নিভিয়ে ফেলে দেয় দূরে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান গোস্বামী। কী ভয়ঙ্কর স্পর্ধা মেয়েটার! চিৎকার করে ওঠেন তিনি, ‘হাউ ডেয়ার ইউ! তুমি অফিসের মধ্যে বিড়ি ধরাচ্ছ! এক্ষুনি ফায়ার অ্যালার্ম বাজবে।’

‘বাজুক, ভালোই তো। কারণ এক্ষুনি এখানে আগুন লাগতে চলেছে।’ কথাটা বলে পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে এনে তার উপর বসে পড়ে ঈশানী।

ওর দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলেন গোস্বামী, ‘তুমি জানো? তোমাকে আমি চাকরি থেকে বের করে দিতে পারি…’

‘আজ্ঞে না স্যার। ওটা আমি নিজেই ম্যানেজ করে নিতে পারব। সব থেকে বড় কথা আমাকে চাকরি থেকে বের করার অবস্থায় আপনি নেই। কারণ এই মুহূর্তে আপনার ব্যাংকের যা কন্ডিশন তাতে এই কোম্পানি আর কতদিন চালাতে পারবেন জানি না।’

‘মানে! কী বলতে চাইছ তুমি?’

ঈশানী বিড়িতে বড় করে টান দেয় একটা, ‘ওই যে বললাম, এখানে আগুন লাগতে চলেছে। তবে ঘরে নয়, আপনার গাঁড়ে।’ কথাটা বলে গোস্বামীর ফোনের দিকে বিড়ি ধরা হাতেই ইশারা করে ঈশানী। রোবটের মতো ফোনটা তুলে সদ্য আসা মেসেজটা চেক করেন গোস্বামী। এবং করতেই তার বুকের রক্ত জল হয়ে যায়।

‘এ…কী এসব! আমার সব টাকা…’

খিকখিক করে হাসে ঈশানী।

ফোনটা কাঁপা হাঁতে টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখেন গোস্বামী, ‘কী? কী করেছ তোমরা? কে আছে এর পেছনে?’

‘আপনার পেছনে? বাঁশ পড়ে গেছে স্যার। ও আর বার করা যাবে না।’ বিড়িতে টান দেয় ঈশানী, একটা পায়ের উপর অন্য পা’টা তুলে দিয়ে বলে, ‘আপনার হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ, চোখের মণির ছাপ, আরও কিছু বাজে বাজে জায়গার ছাপ জাল করে কেউ বা কারা আপনার অ্যাকাউন্টের সমস্ত টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে কোনও অফসোর একাউন্টে। অফসোর বোঝেন তো স্যার? সুইস ব্যাঙ্ক? যেখানে আপনার বাবুরা কালো ধোন রাখে। আর আপনারা মাঝে মাঝে মুখে নেন…’

গোস্বামীর সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিছু বলতে পারেন না তিনি। হতবাক চোখে নিজের ফোনের দিকে চেয়ে থাকেন। ঈশানী বলে চলে, ‘তারপর ধরুন আপনার যত শেয়ার, সব ডীম্যাট অ্যাকাউন্ট ভেঙে কোথায় ভোগে গেছে কে জানে…চাইলে আপনার বাড়িতে পরা ছেঁড়া হাফপ্যান্টটাও টেনে নিয়ে যেত শালারা। আপনার ভালো গামছা আছে তো স্যার? বাঙালির আবার ওইটা নিয়েই একটা ফ্যাসিনেশন ছিল এককালে…’

‘আমি…আমি তোমাকে পুলিশে…’

টেবিলের উপর একটা চাপড় মারে ঈশানী, ‘আমি তো আপনাকে শুধু খবর দিতে এসেছি। আমার উপর রাগ দেখাচ্ছেন কেন বলুন তো? অ্যাঁ?’ কথাটা বলে বিড়িতে টান দিয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয় সে, ‘এবার দেখুন, আপনি আর যেহেতু আমাকে পয়সা দেবার মতো অবস্থায় নেই, তাই এই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছি…’

রেজিগনেশন লেটারটা গোস্বামীর সামনে ছুড়ে ফেলে দিল ঈশানী। গোস্বামী দেখেন তাতে বড় করে লেখা, ‘আমি চললাম, আপনি বাল ছিঁড়ুন।’

চেয়ার থেকে উঠে এসে ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে মেয়েটা বলল, ‘আপনাকে আমরা কিনে নিয়েছি স্যার। ইউ উইল লিভ দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, স্পিক দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, ফাক দ্যা ওয়ে…’ কথাটা বলতে গিয়ে থেমে যায় ঈশানী, ‘থাক, আজকের পর থেকে ও আর এমনিতেই হবে না আপনার।’

এতক্ষণে সত্যি বাজতে শুরু করেছে ফায়ার অ্যালার্মটা। কথাগুলো বলে লাথি মেরে চেয়ার উল্টে দিয়ে দরজার দিকে হাঁটা লাগায় ঈশানী। কিছুদূর এসে আবার থেমে যায় সে। পেছন ঘুরে বলে, ‘আপনি আমার বাপ হতে চেয়েছিলেন না? আমার বাপ খুব ছোটবেলায় একটা সাজেসশন দিয়ে গেছিল আমাকে। পিতৃআজ্ঞা পালন না করে যাই কোথায় বলুন…’

এগিয়ে এসে গোস্বামীর তলপেটে একটা লাথি মারে ঈশানী। নিজের চেয়ারের উপরেই উল্টে পড়েন গোস্বামী। পানের পিক ফেলার একটা বালতি রাখা ছিল চেয়ারের পাশে, সেটা উল্টে যায়। নিজের পানের পিকে নিজেই মাখামাখি হন। বিড়িটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ঈশানী।

স্কুটি করে বাড়ি আসতে আধঘণ্টা লাগে ওর। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন চারু ঘরেই ছিল। কিন্তু ওকে আর দেখতে পায় না ঈশানী। ঘরের দরজা খুলে ও অবাক হয়ে দেখে বিছানার উপর একটা নীল শাড়ি রাখা আছে কেবল। আর তার ঠিক পাশেই কলকাতার ম্যাপে একটা বিশেষ জায়গায় পিন গাঁথা। এটা চারুই করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? ওকে কি ওখানে যেতে বলছে? হঠাৎ হলটা কি ছেলেটার?

সাতপাঁচ ভেবে শাড়িটা পরে চোখে হালকা কাজল দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঈশানী।

স্কুটি করে বাবুঘাটের কাছে পৌঁছতেই সমস্ত জায়গাটায় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল ও। অন্যদিন এখানটা গাড়িঘোড়ার জ্যামে ভর্তি থাকে। আজ সেসবের চিহ্নমাত্র নেই। তার বদলে কাতারে কাতারে ছেলেমেয়ে শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে হেঁটে চলেছে। বাসগুলোতেও অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়। বাইকে করেও যাচ্ছে কেউ কেউ।

অবাক লাগল ঈশানীর। এরকম দৃশ্য সাধারণত ভ্যালেন্টাইনস ডে আর সরস্বতী পুজোয় দেখা যায়। আজ তো সেসব কিছুই নয়, তাহলে রাস্তায় এমন যুগলের ঢল নেমেছে কেন? এত প্রেম করার হিড়িক পড়েছে কেন?

অবাক হয়ে সমস্তটা দেখতে লাগল ঈশানী। কেউ হাসছে, কেউ গান গাইছে, কেউ হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। সবারই মুখে হাসি। সবার গায়ে রঙিন জামাকাপড়। তাদের মধ্যে একজনকে হঠাৎ থামাল ঈশানী, ‘এ ভাই, এখানে হঠাৎ হচ্ছেটা কী?’

‘কার্নিভাল হচ্ছে দিদি। জানেন না?’

‘কার্নিভাল! কীসের?’

‘রোজ কার্নিভাল। লোকে গোলাপ নিয়ে আসবে আর গিফট করবে, ব্যাস। এই কেস…আপনি ফেসবুক করেন না? এতদিন ধরে অ্যাড দিল…’

‘আমার আসলে ফেসবুক টেসবুক…’ কথাটা শেষ না করেই আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটের গেটের কাছে এসে পড়ল ও।

স্কুটিটা বাইরে পার্ক করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ঈশানী হাঁ হয়ে গেল। চারিদিকে গিরগিজ করছে ছেলেমেয়ের দল। হাসছে, গান গাইছে। ঠিক যেন শহরের বুকে একখণ্ড সরস্বতী পুজো ভুল করে ঢুকে পড়েছে কোনও ফাঁক দিয়ে। অল্পবয়সি ছেলে মেয়েদের কলকাকলিতে ভরে আছে জায়গাটা।

মনে মনে ভাবল ঈশানী, এখানে এতকিছু আয়োজন হয়েছে! চারু জানত, অথচ ও জানত না!

লোকজনের কাউকেই ও চেনে না। কী করবে ভেবে না পেয়ে গোল করে একবার চারদিকটা ঘুরে ফেলল ও। মনটা খারাপই হয়ে গেল। এত কিছুর মাঝে, এত প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে ও একা দাঁড়িয়ে। সেই ছেলেবেলায় যেমন…

‘ম্যাডাম, আপনি কি আমাকে খুঁজছেন?’

পিছন থেকে ডাকটা শুনে ঘুরে তাকাল ঈশানী। তাকাতেই মুখটা হাঁ হয়ে গেল ওর। চারুর গায়ে আপাতত একটা কালো পাঞ্জাবি। এটা তো বাড়িতে ছিল না! নিশ্চয়ই আজ বেরিয়ে কোথাও থেকে কিনেছে।

ওকে দেখে মনে শান্তি পায় ঈশানী, ‘এসব কী হচ্ছে বল তো? এখানে আসবি আমাকে আগে থেকে তো জানাবি…’ কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। কয়েক সেকেন্ড পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, ‘চারু, এসব তুই করিসনি তো?’

চারু হাসে। তারপর হাতের একটানে কাছে টেনে নেয় ওকে। হাতের সাদা ফুলটা গুঁজে দেয় ওর কানের পাশে। বড় মাঠটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, কয়েকশো ছেলেমেয়ের মাঝে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে। ওদের ঘিরে যেন মেলা বসেছে একটা। দেওয়ালে ঝলমল করছে ওদেরই এঁকে যাওয়া কার্টুন। লাল গোলাপে ভরে আছে জায়গাটা। কেবল ঈশানীর নীল শাড়ি, চারুর কালো পাঞ্জাবি আর মাথায় গোঁজা সাদা ফুলটা যেন তার মধ্যে থেকে অদৃশ্য রেখা দিয়ে আলাদা করে দিয়েছে কেউ।

অল্প অল্প দুলতে থাকে ঈশানী, চারু ওর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, ‘চুপ করে আছেন যে, কিছু জিগ্যেস করবেন ম্যাডাম?’

ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকায় ঈশানী, ‘কী খবর তোর?’

‘তুই জানিস না? যার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকিস তার খবর জানিস না?’

‘জানি তো, তাও হাঁড়ির খবর নিচ্ছিলাম…’

চারু হাসে না, মুখে ছদ্ম বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলে, ‘বলি হাঁড়ি যাই তোর কথার মার প্যাঁচ। হাঁড়ি স্বীকার করলাম…’

খিলখিল করে দুজনে হেসে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই নাচতে থাকে সবাই। মুহূর্তগুলো ডুবে যায় চরাচরে। কিছুক্ষণের জন্যও ঈশানীর মনে হয় ওদের আশপাশ ফাঁকা হয়ে হয়ে গেছে। কোথাও কেউ নেই। কেবল চারুর নরম আদুরে দুটো চোখ আর বাতাসে হালকা জুঁই ফুলের গন্ধ জড়িয়ে দিয়েছে কেউ।

কিছুক্ষণ পর বাইরের রাস্তা থেকে একটা অপরিচিত যান্ত্রিক শব্দ আসতেই একটা হইহই পড়ে যায় ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে। কী যেন একটা এসেছে বাইরে!

আওয়াজটা শুনতে পেয়েই ঈশানীর হাত ধরে দৌড় দেয় চারু। ঈশানী ওকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘কী ব্যাপার? আবার কী হল? দৌড়াচ্ছিস কেন?’

কোনও উত্তর দেয় না ছেলেটা। ওর হাত ধরে প্রাণপণে টানতে থাকে মেইন গেটের দিকে।

প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই ঈশানী অবাক হয়ে দেখে একটা দোতলা বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরের রাস্তায়। একটা আস্ত দোতলা বাস! কিন্তু কলকাতায় কি এখনও দোতলা বাস চলে?

অবাক হয়ে ও একবার বাসটার দিকে, একবার চারুর মুখের দিকে তাকাতে থাকে। সে তাড়া দেয়, ‘হাঁ করে দেখছিস কী? তাড়াতাড়ি না গেলে সিট দখল হয়ে যাবে…’

ওর হাত ধরেই চারু আবার টান দেয়। দুজনে মিলে একরকম লাফাতে লাফাতে উঠে পড়ে বাসের দোতলায়। ছুটে গিয়ে একদম সামনের সিটে বসে পড়ে চারু। হাত দিয়ে রিজার্ভ করে রাখে পাশের সিটটা। ঈশানী সেখানে বসে পড়তেই ধীরে ধীরে গতি নেয় বাসটা।

‘তুই আমার জন্য কেন এত কিছু…’ থমথমে গলায় হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে ও।

চারু ওর চুলে হাত রাখে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে ওর, ‘কারণ তুই আমার শহর জোড়া লাল গোলাপের মাঝে, বাঁচিয়ে রাখা ভোরের শিউলি…’

ওর ফোনটা হাতে নিয়ে ইউটিউবে গিয়ে একটা বিশেষ গান চালিয়ে দেয় ছেলেটা। তারপর ইয়ারফোনটার দুটো দিক দুজনের কাণে গুঁজে দেয়।

Georgia, wrap me up in all your

I want you in my arms

Oh, let me hold you

I’ll never let you go again like I did

Oh, I used to say

সামনে বিশাল কাচের জানলার দিকে চোখে মেলে দেয় ওরা। দেখে মনে হয় ড্রাইভার নেই, তাও চলছে বাসটা। শহরটা সিনেমার পর্দার মতো ফুটে ওঠে চোখের সামনে।

ওদের কানে বাজতে থাকে গানটা।

Love her, once again

You fell, I caught you

I’ll never let you go again

বাস ভর্তি হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রথমে বাবুঘাটের দিকে, তারপর সেটা ছাড়িয়ে কলকাতার অলিতে গলিতে রাজপথে ঘুরে বেড়াতে থাকে বাসটা।

বাসের দোতলার জানালা থেকে হাঁ করে সেই শহরের দিকে তাকিয়ে থাকে দু’জন। কখন যেন ঈশানীর হাতটা এসে জড়িয়ে যায় চারুর হাতে। চোখ বেয়ে জল নামে তার…

I was lost within the darkness, but then I found her

I found you…

অভিষেকের যখন ঘুম ভাঙল তখন ওর সারা শরীরে একটা ঝিমঝিম ভাব। মাথাটা চেপে ধরে ও মনে করার চেষ্টা করল কাল রাতে কোথায় ছিল। হ্যাঁ, ফেসবুকে ক’দিন ধরে কথা হচ্ছিল একটা মেয়ের সঙ্গে। কাল তার সঙ্গেই ডেট ছিল। দেখাও করেছিল। তারপর সিগন্যাল পেতে দুজনে মদ খেতে গেছিল কোথায় যেন…খাওয়া সবে শুরু করেছে…

আর কিছু মনে নেই ওর। তারপর চোখ খুলেছে এই বন্ধ ঘরের ভিতরে।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল অভিষেক। ঘরটা দেখে মনে হয় একটা হসপিটালের মধ্যে শুয়ে আছে ও। মাথার উপরে এসি মেশিন থেকে হাওয়া বেরোনোর শোঁশোঁ শব্দ। দূরে একটা টেলিফোন বেজে উঠল ক্যানক্যান করে। অজানা কোনও মেশিন বিঁপবিঁপ শব্দ করে চলেছে। কাল রাতে কি তাহলে মদ খেয়ে কোনও অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল? গায়ে হাতে পায়ে অবশ্য কোনও ব্যথা অনুভব করতে পারল না।

‘কেউ আছেন? কেউ…’ দুবার ডাকার চেষ্টা করলে অভিষেক। জামা থাবড়ে দেখল ফোনটা পর্যন্ত ওর কাছে নেই। তারপরই মনে পড়ল কাল সকালেই পকেটমারি হয়েছে। তারপর থেকে তাড়াহুড়োয় সিমটাও ব্লক করা হয়নি।

কয়েকবার চিৎকার চেঁচামেচির পর হুট করেই খুলে গেল দরজাটা। দরজা খুলে একটা মেয়ে ঢুকে এল ঘরে। তাকে দেখে মনে কিছুটা স্বস্তি পেল অভিষেক। এই মেয়েটার সঙ্গেই তো কালকে ছিল। এখন তার গায়ে সেই একই জামা। সেই একই রকম নরম দৃষ্টি চোখে। চোখ থেকে সহানুভূতি ঝরে পড়ছে।

এগিয়ে এসে অভিষেকের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল মেয়েটা। তারপর ওর কপালে একবার হাত বুলিয়ে বলল, ‘কেমন আছ এখন?’

অভিষেক উঠে বসার চেষ্টা করল, ‘আমার কী হয়েছে?’

মেয়েটা ওকে আশ্বস্ত করে মাথা নাড়ে, ‘আরে নানা, নতুন করে কিছু হয়নি। সমস্যাটা অনেকদিনের…’

‘কীসের সমস্যা?’

‘আলুর।’ হালকা হেসে বলে মেয়েটা।

‘তুমি কী বলতে চাইছ?’ অভিষেকের গলার স্বর কঠিন হতে থাকে।

‘আলুর চাষ খুব কঠিন জিনিস। যেমন লাভ, তেমন ক্ষতি। একবার রোগ লাগলে পুরো মাঠ কে মাঠ শেষ। চাষিকে গলায় দড়িও দিতে হয়। তাই রোগ লাগা আলু তুলে ফেলাই ভালো।’

‘দেখ ভাই…’ অভিষেক হাত তুলে বাধা দেয় ওকে, ‘আমার এসব ভালো লাগছে না। আমি এখান থেকে কাটব।’

‘হ্যাঁ, কাটাকাটির জন্যই আনা হয়েছে তোমাকে এখানে।’

অভিষেক ছটফটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। মেয়েটা বুকের উপর একটা ধাক্কা মেরে ওকে আবার বিছানাতেই ফেলে দেয়, ‘আপনি চাইলে অপারেশন নাই করাতে পারেন। আপনার বডি, আপনার চয়েজ। কিন্তু সেক্ষেত্রে কী হবে সেটা একবার ভালো করে বুঝে নিন, কেমন?’

হাতের ফোনটা তুলে ধরে স্ক্রিনটা ওকে দেখায় মেয়েটা। অভিষেক চমকে ওঠে। এটা তো ওর নিজের ফোন! এমনকী ওর ফেসবুক প্রোফাইলটাও খোলা আছে সেখানে। কিছু ছবি আপলোড হয়েছে প্রোফাইল থেকে।

‘আপনি তার মানে চুরি করেছিলেন ফোনটা। কিন্তু আমার লকটা…’

‘আঃ, যা বোঝাচ্ছি চুপ করে বুঝুন।’ স্ক্রল করতে থাকে মেয়েটা। অভিষেক অবাক হয়ে দেখে ছবির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভিডিও পোস্ট হয়েছে ওর নিজের প্রোফাইল থেকে। ভিডিওতে ও নিজেই ক্যামেরার সামনে বসে চোখে জল নিয়ে কীসব যেন বলে চলছে। এই ভিডিওগুলো কবে শুট করল মনে পড়ছে না তো? বলছেটাই বা কী?

‘এই ভিডিওগুলোতে আপনার এতদিনের কৃতকর্মের সমস্ত কনফেশন আছে। আপনি নিজে মুখে স্বীকার করছেন আজ অবধি কী কী পাপ করেছেন। সঙ্গে প্রমাণও দিয়েছেন। ফলে অবিশ্বাস করার কোনও জায়গা নেই।’

অভিষেক এক ঝটকায় ফোনটা নিতে যায়, মেয়েটা আবার ধাক্কা মেরে শুইয়ে দেয় ওকে, ‘এখন এগুলো সব “ওনলি মি” করে পোস্ট করা আছে। আপনি যদি চান পুলিশের এখানে হাজির হতে কুড়ি মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। তারপর ধরুন পাবলিকের হাসাহাসি, জেল, পুলিশের ক্যালানি, সোশ্যাল লিঞ্চিং-এর চক্করে আপনার মায়ের আত্মহত্যা…কেসটা কি খুব ভালো হবে? তার উপর জেলে আবার আপনাকে সেক্স অফেন্ডারদের সেলে রাখা হবে। তারা এমনিতেই আপনার আলু চটকে দেবে…তার থেকে কী দরকার? এখনই ওসব মোহমায়া ত্যাগ করে ফেলুন না হয়…’

অভিষেক হতবাক মুখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। মুখে কথা ফোটে না তার। শরীরটা দুবার কেঁপে ওঠে থরথর করে। বিড়বিড় করে বলে, ‘আপনি…আপনি কেন আমাকে…’

পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরায় মেয়েটা, অভিষেকের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে অল্প হেসে বলে, ‘আরে নানা। এটা আমার খাবার জন্য নয়। আমি সিগারেট খাই না। এটা আপনার জন্য…’ কথাটা বলেই যেন কী মনে পড়ে তার, ‘আহঃ! এখানে তো সিগারেট খাওয়া বারণ! কোথায় ফেলি বলুন তো? একটা এসট্রে…’

চারপাশে তাকিয়ে সিগারেটের জ্বলন্ত দিকটা চকিতে অভিষেকের হাঁ করা মুখের ভিতর ঢুকিয়ে মুখটা চেপে ধরে মেয়েটা। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারে না অভিষেক। ওর গোটা শরীর ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে যায়।

কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই ধরে রেখে উঠে পড়ে মেয়েটা। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ থমকে যায়, ঘুরে তাকিয়ে বলে, ‘ভালো কথা, আপনার অপরেশনের বিলটা আপনার অ্যাকাউন্ট থেকেই পে করে দিয়েছি আমি। দেড় লাখ চাইছিল, এক লাখ কুড়িতে রফা হয়ে গেছে…’

কথাটা বলে আর একবার মুচকি হেসে সটান ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটা…

সন্ধ্যাবেলা বিজলিমারি ক্যাম্প সাইটে এসে পৌঁছালো মানিক। যতদিন এখানে পোস্টিংয়ে আছে, দিনের বেলা ছাড়া আসা হয়নি। তাও পুলিশের কাজে।

আজ সকাল থেকেই মাথাটা ভার হয়েছিল ওর। এই খুনের কেসটার আদতে কোনও লিড পাওয়া যাচ্ছে না। খুনি একটা ছোট এভিডেন্স অবধি ফেলে যায়নি, যাতে তাকে খুঁজে বার করা যাবে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে দেখেও মনে হচ্ছে না খুব একটা আশার আলো দেখছেন বলে।

অগত্যা বিকেলে মাথাটা একটু পরিষ্কার করতে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল মানিক। বিশ্বাসের সঙ্গে একটু আগেই কথা হয়েছে। তিনি নাকি কী একটা অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।

বাইকটা একটু দূরে দাঁড় করিয়ে ক্যাম্পের কাছাকাছি আসতেই নাদু নস্করের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে কী যেন কাজে বেরোচ্ছিলেন তিনি। মানিকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতে হেসে জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার? ক্যাম্প ফাঁকা নাকি?’

বিমর্ষ দেখাল নাদু নস্করের মুখটা, ‘ওই ঘটনার পর থেকে আর লোক আসছে না স্যার। এখানকার কাজকর্ম বোধহয় তুলতে হবে।’

মানিক ওকে আশ্বস্ত করে, ‘লোকে খুন হতে চায় না বটে, কিন্তু খুনের গল্প ভালোবাসে। ক’দিন অপেক্ষা করুন। কাস্টমারদের খুনের গল্পই শোনাতে হবে।’

দাঁত বের করে হাসে নাদু নস্কর, ‘আজ্ঞে গল্পের শেষে যদি খুনি ধরা পড়ে তাহলে শুনিয়ে আরও শান্তি।’

মানিক বোঝে কথাটার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে। আগের হাসিটা আবার মুখে ফিরিয়ে এনে ক্যাম্পের ভেতরের দিকে হাঁটতে থাকে সে। কয়েক পা ভেতরে আসতেই একটা দোতারার শব্দ কানে আসে।

ক্যাম্পের পেছনের খেত থেকে আসছে আওয়াজটা। সেই বাউলটা কি আবার এসেছে আজকে? আওয়াজটা লক্ষ্য করে ক্যাম্প ছেড়ে এগিয়ে আসে মানিক। এখানে আলো বিশেষ নেই। ক্যাম্পের ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলোই তেরচা হয়ে এসে পৌঁছায় এখানে।

দোতারার আওয়াজটা লক্ষ্য করে চরণদাসকে খুঁজে পায় মানিক। মাঠের উপরেই বসে টুংটাং করে দোতারা বাজিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে লোকটা। কোথাও কেউ নেই। এই ফাঁকা মাঠের মাঝে কাকে গান শোনাচ্ছে কে জানে!

মানিক ওর দিকে হেঁটে আসতে দেখে দোতারা থামিয়ে লোকটা একটু হাসে। মানিক বসতে বসতে বলে, ‘থামলে কেন? ভালোই তো লাগছিল।’

একটা দেঁতো হাসে হাসি চরণদাস, ‘পুলিশ দেখলে ভয় লাগে স্যার। আর ভয় লাগলে গান গাওয়া যায় না।’

কথাটায় মজা পায় মানিক, ‘এখন তো পুলিশের উর্দি পরে নেই, তাও ভয় লাগছে?’

‘আমি তো বাউলের আলখাল্লা পরে নেই স্যার। তাহলে কি আমি গান গাইতে পারি না?’

মানিক বোঝে চরণদাস খ্যাপাটে হলেও কথার মারপ্যাঁচ বোঝে। সে ঘাসের উপরে হাত রেখে মাঠের প্রান্তের দিকে চায়। এই ক’দিনে যতগুলো জবানবন্দী শুনেছে তার মধ্যে কোথাও অসংগতি আছে, কোথাও সন্দেহের অবকাশ আছে। একমাত্র চরণদাসের কথার মধ্যে হালকা অবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।

তার নাকি বারবার মনে হয়েছে যে কাকতাড়ুয়াটার সামনে বসে সে গান গায় সেটা জীবন্ত। আবার সেটাই খুনের পর মাঠ থেকে উধাও হয়ে যায়। এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও যোগসূত্র আছে?

একটা ব্যাপার মনে হয়েছিল মানিকের, তবে ইনস্পেক্টর বিশ্বাস হাসাহাসি করবেন বলে সেটা বলতে পারেনি মুখ খুলে। এই মুহূর্তে মাঠে আর কেউ নেই, এই বাউলটাও খ্যাপাটে গোছের, একে কথাটা বলা যেতেই পারে।

একহাতে ভর দিয়ে বসে আলাপ জমায় সে, ‘আচ্ছা ধরো কাকতাড়ুয়াটাই খুন করে পালিয়ে গেছে…’

চারণদাসের মুখে হাসি ফোটে, ‘আপনি সে জিনিস দেখেননি বলে বলছেন। ও কাকতাড়ুয়ার মুখ দেখলেই বুঝবেন খুন টুন করা তার কম্মো নয়।’

‘দেখব আর কী করে…’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানিক, ‘তার ছবি আর কে তুলে রেখেছে?’

‘আমার কাছে আছে স্যার…’ কথাটা বলেই নিজের স্মার্ট ফোন বের করে চরণদাস, ‘আমি একবার তুলে রেখেছিলাম। এই যে সেই ছবি…’

কাকতাড়ুয়ার ছবিটা মানিকের সামনে মেলে ধরে চরণদাস। সত্যিই একটা কালচে হাঁড়ি আর তার নিচে একটা বাঁশের খুঁটির উপর জামা পরানো।

পাশে আরও ছবি আছে কিনা দেখতে স্লাইড করে মানিক। অন্য একটা ছবি চলে আসে ওর সামনে। ছবিটা চরণদাসের সামনে তুলে ধরে মানিক, ‘এই যে মেয়েটা…একে আপনি চিনতেন?’

জায়গাটা একটা স্টেজের ধার। সেখানে একটা অল্পবয়সি মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলেছে চরণদাস। মেয়েটাই হাসি মুখে তুলেছে সেলফিটা।

‘চিনি বলতে…’ মনে করার চেষ্টা করে চরণদাস, ‘কলকাতায় দেখা হয়েছিল একবার। তারপর থেকে ফোনও করেছিল ক’বার…’

‘মানে, তুমি ছ’মাস ধরে এই মেয়েটিকে চেনো?’ মানিকের মাথার ভিতরে একটা সমুদ্র স্রোত আছড়ে পড়ে। পকেট থেকে ফোন বের করে ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের নম্বরটা ডায়াল করে সে।

ফোনটা বেজেই চলেছে। আজ ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার কেউ ছিল না। এদিকে চারটের সময় স্কুল ছুটি। তারপর কেউ না গেলে একা একা ফিরতে পারবে না ছেলেটা। ফলে বিশ্বাসকে নিজেকেই আসতে হয়েছে।

ভেবেছিলেন ছেলেকে তুলে বাড়িতে দিয়ে আবার কাজে ফিরবেন। কিন্তু পথে আসতে আসতে বমি করল ছেলেটা। স্কুলে মনে হয় আজে বাজে কিছু খেয়েছিল। তাকে সেখান থেকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে যেতে সন্ধে হয়ে গেছিল। হালকা জ্বরও এসেছিল বোধহয়।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে ছেলেকে নিয়ে সবে বাইকে উঠে একটু এসেছেন। এমন সময় বাজতে শুরু করল ফোনটা। বিশ্বাস ভেবেছিলেন ধরবেন না। শেষে বার তিনেক রিং হওয়ার পর ধরতেই হল। আননোন নম্বর।

‘হ্যালো ইনস্পেক্টর সুজিত বিশ্বাস বলছি।’

‘আমি গার্গী বসু বলছি। অভিরূপা দত্ত খুনের…’

‘হ্যাঁ। বলুন। আমি একটু রাস্তায় আছি আসলে। পরে…’

আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে আসে গার্গী, ‘মিস্টার বিশ্বাস, আমি জানি খুনটা কে করেছে…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *