কাকতাড়ুয়া – ১৫

পঞ্চদশ অধ্যায়

‘আপনি মোটামুটি কত বছর বয়স থেকে মদ খাচ্ছেন মিস প্রামাণিক?’ চেয়ারের উপরে জমিয়ে বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। টেবিলের একদিকে বসে আছে মানিক। সে একটা কাগজে কীসব যেন লিখে রাখছে। বিশ্বাসের ঘরের একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে একটা বছর পঁচিশের ছেলে। মিস প্রামাণিকের সঙ্গেই এসেছে সে। তার পরনে কালো শার্ট প্যান্ট। একটা বই হাতে নিয়ে পড়ছে সে। কিন্তু কান সজাগ রয়েছে ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের দিকে।

‘সাত আট বছর আগে থেকে শুরু করি। কলেজে পড়ার সময় থেকে…আগে বেশি খেতাম, ইদানীং ছেড়ে দিয়েছি প্রায়।’

‘মানে নিয়মিত খেতেন বলা যায়। দোকানের বিল দেখে বুঝতে পারছি সেদিন ক্যাম্পে মোট তিনটে সাড়ে সাতশোর বোতল নিয়ে গেছিলেন আপনারা। সঙ্গে কয়েকটা বিয়ারের ক্যান। গার্গী বসু নিজে বলেছেন তিনি একটা গোটা বোতলের খানিকটা বেশি খেয়েছিলেন। অভিরূপা দত্ত তার কাছাকাছিই। সকালে আমি যখন আপনাদের ঘরে যাই সেখানে হুইস্কির বোতল উল্টেছিল। অর্থাৎ সেখানেও নষ্ট হয় কিছুটা। আপনি স্বাভাবিকের থেকে কিছু বেশি খেলেও স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার মতো মদ খেয়েছিলেন বলা যায় না, তাই না?’

বিশ্বাসের চোখের দিক থেকে চোখ সরানোর অছিলায় ঘরের চারপাশটা একবার দেখে নেয় ঈশানী, ‘র’ খেয়েছিলাম, ইদানীং আর অতটা খেতাম না তাই একটু চড়ে গিয়ে…’

‘সাধারণত র’ খেতেন? নাকি সেদিন…’

‘সেদিন খেয়েছিলাম, ইচ্ছা করছিল তাই…’

‘কেন? হঠাৎ এরকম ইচ্ছা?’

উত্তর দিতে একটু সময় নেয় ঈশানী, ‘জানতাম আর হয়তো সবাই মিলে খাওয়া হবে না। তাই বাড়াবাড়ি কিছু…’

‘কী করে জানলেন আর হবে না?’

‘আমাদের তিনজনের সম্পর্কটা আর আগের মতো ছিল না। মাসে একবার কথা হত কী হত না। বুঝতে পারছিলাম দূরত্ব বাড়ছে। খানিকটা সেই কারণেই এই ট্রিপটা…’

‘দূরত্ব বাড়ার কারণ কী বলুন তো?’ বিশ্বাস ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকান।

‘আমার বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার আর কিছু ভালো লাগত না। ফোন রিসিভ করতাম না দিনের পর দিন। কোথাও যেতে বললে যেতাম না। সারাদিন অফিস করে মনমেজাজও খারাপ থাকত। ওরা অনেকবার চেষ্টা করেছিল। আমারই…’

‘সেই জন্যেই ঘুমের ওষুধ খেতে হত?’

মুখ তোলে ঈশানী, চোখে ঝিলিক খেলে যায় তার, ‘আপনাকে কে বলল আমি ঘুমের ওষুধ খেতাম?’

বিশ্বাস একটা বাঁকা হাসি হাসেন, ‘আপনার ব্যাঙ্ক ট্রানজাকশন। কী জানেন, কাঁচা অপরাধীরা ফোনের কললিস্ট আর চ্যাট ডিলিট করতে যতটা তৎপর হয় ব্যাঙ্ক ট্রানজাকশন নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না। আপনার সে সময়ের পাসবুক বলছে আপনি আলাদা আলাদা ওষুধের দোকান থেকে ইউপিআই দিয়ে আনন্যাচারাল নাম্বার অফ ঘুমের ওষুধ কিনেছেন। সেই সঙ্গে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট। ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো আপনার?’

ঈশানী অস্বস্তিতে পড়ে, মুখের সামনে থেকে চুল সরাতে সরাতে বলে, ‘বললাম তো, বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই…’

‘আপনার বাবা মারা গেছেন ছ’মাস আগে, ট্রিপে যাওয়ার আগে হুট করে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট খাওয়ার মতো কী হয়েছিল আপনার?’ বিশ্বাসের গলা কঠিন শোনায়। প্রশ্নটা প্রতিধ্বনিত হয় ঘর জুড়ে। ঘরের বাতাস আচমকাই ভারী হয়ে ওঠে। আড়চোখে একবার বেঞ্চের দিকে তাকায় ঈশানী। ছেলেটা এখনও আগের মতোই বসে আছে ওর দিকে চেয়ে।

‘আচ্ছা বাদ দিন, ওসব আপনার পারসোনাল ব্যাপার। না বলতে চাইলে নাই বলবেন। আমি বরঞ্চ অন্য একটা পারসোনাল প্রশ্ন করি, কেমন?’

টেবিলের উপর দুকাপ চা রাখা আছে। এখনও অবধি কেউ চুমুক দেয়নি তাতে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

‘সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পে যারা ছিল তাদের মধ্যে একাধিক লোক বলেছে যে সেদিন আপনার আর মিস দত্তের মধ্যে মদ খাওয়ার সময় একটা হিটেড ডিবেট হয়। দুজনের কথা-কাটাকাটি হাতাহাতির জায়গায় পৌঁছায়। ঠিক কী নিয়ে ঝগড়া করছিলেন আপনারা বলতে পারবেন?’

‘ওর সম্পর্ক নিয়ে, দেবজ্যোতি বলে একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল ওর। তার সঙ্গে একরকম জোর করে ব্রেক আপ করেছিল। ছেলেটা ভালো ছিল। আমাকে ফোন করে মাঝে মধ্যে কান্নাকাটি করত, ওকে বোঝাতে বলত।’

‘আপনি বোঝাতেন?’

‘চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। ও বুঝতে চাইত না। ওর কথা শুনতেই চাইত না। দেবুও বারবার ফোন করে যেত আমাকে। আমি মাঝে পড়ে গেছিলাম।’

‘আপনারও তো ওরকমই একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তাই না?’ বিশ্বাসের গলা অতিরিক্ত নরম শোনায়, ‘মানে আপনার ব্রেক আপ তো অ্যারাউন্ড ওই টাইমেই হয়।’

উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ঈশানী।

‘তো সেদিন সন্ধ্যায় সেই নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়। আপনি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ও বুঝতে চায় না। মদের ঘোরে হালকা মারপিট হয়। তারপর?’

‘তারপর আমার মনে নেই।’ মুখ তুলে তাকায় ঈশানী, ‘আমি মনে হয় উঠে চলে এসেছিলাম ওখান থেকে।’

‘তারপর তক্কে তক্কে ছিলেন কখন ও পুকুরপারে যাবে, তাই না?’

ঈশানী হাসে, ‘ওকে খুন করব বলে? অভিকে খুন করে আমার লাভ কী?’

হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘সে তো আপনি বলবেন আমাকে। আমি বড়জোর অপশন দিতে পারি। যেমন ধরুন, আপনার এবং মিস দত্তর ব্রেক আপ হয় এই দেবু বলে ছেলেটিকে নিয়েই। ছেলেটি আপনাকে ভালোবেসে ফেলে এবং আপনার সঙ্গে একটা অ্যাফেয়ার হয় ওর। সেটা জানতে পেরে মেয়েটি আপনাকে কনফ্রন্ট করে এবং তখন থেকেই আপনাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটি কিন্তু মিস দত্তকে ছাড়তে চায় না। উল্টে সে আপনার সঙ্গেই দূরত্ব বাড়াতে শুরু করে। যৌন ঈর্ষা থেকে সেদিন রাতে মিস দত্তকে খুন করে জলে ফেলে দেন আপনি।’

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস আড় চোখে লক্ষ করেন চেয়ারে বসা ছেলেটা এখন বই থেকে মুখ তুলে সটান তাকিয়ে আছে এদিকে।

‘মদের হিসেব বলছে সেদিন যতটা প্রিটেন্ড করছেন ততটা নেশা আপনার হয়নি, আপনার সঙ্গে মিস দত্তের সম্পর্ক খারাপ ছিল সেটা সহজেই বোঝা যায়, আপনার বান্ধবি গার্গী বসুর জবানবন্দী অনুযায়ী সেদিন সন্ধে থেকে আপনার বিহেভিয়ারের মধ্যে কিছু চেঞ্জ আসে। আপনার মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। এতদিনের নেশাড়ু হয়েও মদ ঢালতে গিয়ে পেগ উল্টোপাল্টা করে ফেলেন বারবার। জয়েন্ট রোল করতে গিয়ে হাত কাঁপছিল আপনার। আমার যতদূর মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তায় ছিলেন আপনি, তাই না? কিছু হারিয়ে ফেলেছিলেন?’

অবাক চোখে মুখ তুলে তাকায় ঈশানী, ‘হারিয়ে ফেলেছিলাম! কই না তো।’

‘আপনি শিওর?’ বিশ্বাসের গলায় ব্যঙ্গ ঝড়ে পড়ে। একবার গলা ঝাড়া দিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা, এই ধরনের ট্রিপে বেড়াতে এলে লোকে কী কী জিনিস আনছে তার একটু লিস্ট করে আনে। আপনি এনেছিলেন?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ঈশানী, ‘করেছিলাম। গুগল ডকে লিখে সেভ করে রেখেছিলাম।’

‘এতদিনে সেটা নিশ্চয়ই ডিলিট করে ফেলেননি?’

‘না…’

‘দেখি একটু।’

পকেট থেকে ফোনটা বের করে গুগল ডকটা খুলে ওর দিকে এগিয়ে দেয় ঈশানী। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস ভালো করে চোখ বোলান তাতে। তারপর মুখ তুলে বলেন, ‘এখান থেকে কিছু ডিলিট করেননি আপনি, তাই তো?’

‘না।’

টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া ছুরি বের করে ওর সামনে রাখেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা…’

ঈশানী এক নজর সেদিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়।

বিশ্বাসের গলায় ব্যঙ্গটা আরও ধারালো হয়, ‘ছুরিটা যে আপনার সেটা প্রমাণ করতে আমাদের দু’মিনিটও লাগবে না। ক্যাম্পের অন্তত তিনজন লোক আপনাকে এটা দিয়ে হুইস্কির বোতল খুলতে দেখেছে। তো এনেছিলেন যখন লিস্টে লিখলেন না কেন বলুন তো?’

আমতা আমতা করে ঈশানী, ‘ভুলে গেছিলাম…’

‘হতে পারে, আবার এও হতে পারে, ছুরি দিয়ে মেয়েটাকে খুন করাই উদ্দেশ্য ছিল আপনার। কোনও কারণে ছুরি দিয়ে খুনটা করতে পারেননি আপনি। এও হতে পারে খুন করার আগে কোনওভাবে হারিয়ে যায় ওটা। মদ্যপ অবস্থায় মিস দত্তকে খুন করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি আপনাকে। খুনটা করে বডি জলে ফেলে আপনি ঘরে চলে আসেন।’

এতক্ষণে গলার স্বরে একটা কাঠিন্য এসে মেশে ঈশানীর, ‘আপনি কি এরেস্ট করতে চাইছেন আমাকে?’

‘উঁহু, তাতে লাভ নেই। ওরকম দুম করে কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না। তার উপর আপনি আবার মহিলা, দু’মিনিটে বেল পেয়ে যাবেন। আমি শুধু বলছি…’ টেবিলের উপর ভর দিয়ে এগিয়ে আসেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘একটা ভালো উকিলের খোঁজ করে রাখুন। খারাপ দিন আসছে…’

মিনিট পাঁচেক পর থানা থেকে বেরিয়ে যায় ছেলেমেয়ে দুটো। ওরা চলে যেতে বিশ্বাসের দিকে সরে আসে মানিক, ‘আপনার কী মনে হচ্ছে স্যার? খুনটা এ-ই করেছে?’

ওর পিঠে একটা হাত রাখেন বিশ্বাস, ‘ভুল করছ মানিক, খুনি খুঁজে বের করা ফেলু মিত্তিরের কাজ। পুলিশের কাজ এভিডেন্স জোগাড় করা। এক্ষেত্রে সেটা নেই। ভিক্টিম ছাড়া সাতজন সেদিন ওই ক্যাম্পে ছিল। দুজন কেয়ারটেকার কিছুই জানে না, দুজন মদের ঘোরে চুর হয়ে ছিল, একজন ঘর থেকে বেরোয়নি, একজন বেরিয়েই কিছু দেখার আগেই ঢুকে গেছে, আর একজন বলছে ভূতের গল্প। একমাত্র আকাশে চাঁদ ছাড়া আর সাক্ষী দেওয়ার মতো কেউ নেই…তবে আমার কী মনে হচ্ছে, জানো?’

‘কী?’

‘খুন না করে থাকলেও এই মেয়েটা এমন কিছু জানে যা ও বলতে চাইছে না।’

সিঁড়ি দিয়ে জরাজীর্ণ বাড়িটার দোতলায় উঠে আসে ওরা। একটা কালো শার্ট আর কালো রঙের জিন্স পরেছে চারু। ঈশানী শখ করেই কিনে দিয়েছে এটা। গায়ে একটু টাইট হয়েছে তাও মোটামুটি মানিয়ে গেছে।

অন্ধকারে ঢেকে আছে বাড়িটা। চারপাশে কোথাও তাকালে কিছু দেখা যায় না। শুধু মাইলের পর মাইল ঘন জঙ্গল। আর তার মাঝে মোট চারটে ভাঙাচোরা বাড়ি, একটা ছোট নাটমন্দির, একটা কুয়ো, আর বাড়িগুলোর মাঝে যাতায়াত করার মতো সিমেন্টের রাস্তা। এখান থেকে ক্যাম্পে যেতে মিনিটদশেকের বেশি সময় লাগে না।

যে বাড়িটায় ওরা উঠেছে সেটা অন্যগুলোর থেকে অপেক্ষাকৃত কম ভাঙাচোরা। নিচে একটা ছোট্ট চাতাল করা। তার উপর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চারটে চেয়ার। সেই চেয়ারের মাঝে একটা ছোট্ট টেবিল। তিনশো বছর আগে এখানে বসে দাবা খেলা হত। দাবার বোর্ডের পাশেই রাখা থাকত সুরাপাত্র। এখন সেই দাবার বোর্ড দাবাড়ুদের নিয়ে কোথায় উধাও হয়েছে যেন। হার জিত শেষ হয়েছে, জং ধরেছে চেয়ার টেবিলে।

এর ঠিক উপরেই একটা ঝুলবারান্দা। আপাতত সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই বারান্দাতেই এসে বসে ওরা দুজন। আকাশের চাঁদটা বেড়ে উঠেছে। চারদিকে কোথাও আলো নেই বলে জ্যোৎস্না খেলা করছে নিশ্চিন্তে।

চারু একদিকের ভাঙা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে, ‘এরকম ফাঁকা জায়গায় না এলে চাঁদটা দেখাই হয় না। একসময় কী অদ্ভুত ভালো লাগত দেখতে!’

‘ওসব বাজে কথা, জীবনে একটা এত মিষ্টি চাঁদ আছে তাই ওদিকে নজর পড়ে না সেটা বল…’

হেসে ওর দিকে তাকায় চারু, ‘তুই এই ক’দিনে না একটু বদলে গেছিস রুনু।’

‘কেমন বদল?’

‘আগে একটু হার্ডকোর রাফ-এন্ড-টাফ টাইপের ছিলি। এখন একটু নিব্বি গোছের লাগে মাঝে মাঝে…’

‘রোদে ঘোরার পর ছায়ায় এসে বসে আর কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে থাকে না।’ বাইরের দিকে তাকায় ঈশানী, ‘অন দ্যা কন্ট্রারি সামনের শুক্রবার আমার জন্মদিন। বুড়ি হয়ে গেলাম শালা…’

‘তাতে দুঃখের কী আছে? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গ্ল্যামারটাও তো বাড়ছে…’

সত্যি ওর মুখের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না সহজে। চারু মাঝে মাঝে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে। যখন ও অফিস থেকে ফেরে, কিংবা সারারাত এখানে ওখানে ঘুরে ছুটে বেড়ানোর পর যখন চারুর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বোজে, কী ভীষণ প্রাচীন গুহার দেওয়ালে আঁকা কারুকার্যের মতো দেখায় ওর মুখটা। এখনও ও সেদিকে চেয়ে থাকে।

‘আমার চিরকাল মনে হয়েছে জানিস, আমার এরকম তিনশো বছর আগেই জন্মানো উচিত ছিল। এত লোকজন, হইচই, চিৎকার চেঁচামেচি থাকবে না। জঙ্গলের মাঝখানে ছোট একটা বাড়ি। একটা কুয়োতলা, ঠাকুরতলা, লালপাড় সাদা শাড়ি আর আলতা পরে দৌড়ে যাব…’

‘তারপর দুম করে বর্গীরা আক্রমণ করবে, আর গলাটি কেটে দিয়ে চলে যাবে…’

ঈশানী বিরক্ত হয়, মেজাজটা খিঁচে যায় তার, ‘তুই কীসের দেবতা ছিলিস বল তো? মুড খেঁচিয়ে দেওয়ার?’

‘হতে পারে, বেশি মুড উঠে গেলে তোর আবার চুমু খেতে ইচ্ছা করবে।’

‘না না, আমি আর তোকে চুমু খাব না।’

‘কেন?’

‘রোজ নতুন নতুন চেহারার লোককে চুমু খেতে ভালো লাগে? বারোভাতারি মনে হয় নিজেকে।’

‘বেশ চোখ বন্ধ করেই খাস।’

হঠাৎ ওর দিকে চোখ তুলে তাকায় ঈশানী, কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থেকে বলে, ‘আমার চোখ বন্ধ করতে ভয় লাগে। যদি তুই না জানিয়ে চলে যাস, আমার সবকিছু ভেস্তে যাবে।’

হাতটা ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে নেয় চারু। ওর বুকে পিঠ রেখে বসে ঈশানী। হাত রাখে ওর গালে। তারপর দুজনে চেয়ে থাকে দূর প্রান্তের দিকে। চাঁদটা আগের থেকে একটু সরে এসেছে, যেন আকাশের ভিতর এদিক-ওদিক করে ওদের খোঁজার চেষ্টা করছে এই পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপের খাঁজে।

‘চারু…’

‘বল।’

‘আমাদের তো একসঙ্গে থাকা হবে না। হলে একটা এরকম বাড়িতে থাকতাম আমরা, বুঝলি?’

জঙ্গলের ভেতর থেকে কিচকিচ করে কীসের যেন শব্দ আসছে। আকাশের বুকে অচেনা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। চোখ বন্ধ করে চারুর বুকে মাথা রেখে ঈশানী ভাবে, এখন এখানে যদি ও ঘুমিয়ে পড়ে আস্তে আস্তে ভোর হলে শুনতে পাবে একতলার কাঠের দরজা ক্যাচ করে খুলে যাওয়ার আওয়াজ। রেকাবি হাতে ফুল কুড়াতে যাবে কেউ নিজের ঘর থেকে। স্নানের শব্দ আসবে, রান্নার জোগাড়যন্ত্র করতে বসবে কেউ। আর ওদেরকে দেখে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকবে। ওর চোখদুটো বন্ধ হয়ে যায়…

‘ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? স্বপ্ন দেখছিস?’ চারু ঠেলা দেয় ওকে।

‘হুম, স্বপ্ন দেখছিলাম। এই পৃথিবীর সব থেকে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন—ঘর বাঁধার স্বপ্ন।’

কোথা থেকে যেন আওয়াজ আসে একটা, একতলার ঘরে উপর থেকে কিছু খসে পড়ে বুঝি। চারু কান পেতে শোনে, ‘কীসের শব্দ বল তো?’

কাঁধ ঝাঁকায় ঈশানী, ‘কী জানি, বাড়িটা হয়তো কিছু বলতে চাইছে আমাদের।’

‘আচ্ছা? কী বলছে?’

‘বলছে কয়েকশো বছর ধরে ওরা শান্ত হয়ে পড়ে আছে। তার মধ্যে একদিন আমরা এসেছি। ওরা আমাদের বলতে চায় এটা আমাদের জায়গা নয়। এখানে আমাদের থাকার কথা নয়। যার থাকার কথা তার অপেক্ষা করছে। সে ছেড়ে চলে গেছে বলে অভিমানে ভেঙেচুরে পড়েছে বাড়িটা। এমন করে কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে তাও কাউকে থাকতে দেবে না তার ভিতরে।’

‘ধুর, বাড়ি অত কিছু ভাবে না। কেউ এসে যত্ন নিলে সেভাবে থাকতে শুরু করলে, কে জানে এখানেও হয়তো মানুষ থাকতে পারবে। বাচ্চার হাসি শোনা যাবে, বুড়োদের রাগারাগি শোনা যাবে, শুধু একটু যত্ন নিতে হয়…’

চারুর বুক থেকে উঠে পড়ে ঈশানী, ‘চল, বাইরেটা দেখে আসি। পুরোনো বাড়ির কুয়োতলা দেখতে ভারি ভালো লাগে আমার।’

দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। এখানে আলো কম। তাও ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালায় না ওরা। কেবল শক্ত করে চারুর হাত ধরে পথ খুঁজে নেয় ঈশানী। একসময় হুট করেই ওর হাতের উপর চাপটা বেড়ে ওঠে, ‘এই, এখানে কিন্তু অনেকগুলো অপমৃত্যু হয়েছে চারু, একদল মানুষ কচুকাটা হয়েছে। ভূত-টুত নিশ্চয়ই আছে এখানে।’

‘তো? আমি কী করে জানব?’

‘না জানার কী আছে? তুইতো হাঁড়ি হয়ে পড়েছিলি এখানে। কিছু দেখিসনি? অবশ্য ভগবানের নামে ভূত পালায়…’ খিলখিল করে হেসে ফেলে ঈশানী, ‘ছোটবেলায় ভয় পেলে মা একটা মন্ত্র বলতে শিখিয়েছিল—ভূত আমার পুত/ পেত্নী আমার ঝি/ রাম লক্ষণ বুকে আছে/ ভয়টি আমার কী? এখন কী বলব? কালো হাঁড়ি বুকে আছে ভয়টি আমার কী?’

‘কালো হাঁড়ি বুকে আছে শুনতে কেমন অশ্লীল লাগছে না?’

ওরা দুজনে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই ঈশানী বলে, ‘সত্যি রে, অনেক বছর আগে যদি জন্ম হত…।’

‘কেন?’

‘এই যে ধর এই বাড়িগুলোতে কারা থাকত, তাদের দেখতে কেমন ছিল, স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল, কাকে ভালোবাসত, কীসে দুঃখ পেত, কোনও কিছুই আর জানতে পারব না আমরা। আর আমাদের দেখ, আজ থেকে তিনশো বছর পর সবাই সবকিছু জানবে। জাস্ট ইন্টারনেটে একবার সার্চ করলেই আমাদের ইনফরমেশন বেরিয়ে যাবে…’

‘তাতে ক্ষতি কী তোর?’

‘ক্ষতি নেই? লোকে জানবে ঈশানী প্রামাণিক তার বান্ধবি অভিরূপা দত্তকে মদ খেয়ে যৌন হিংসার চোটে গলা টিপে খুন করেছে।’

‘সত্যি করেছিস নাকি?’

‘আমি কী করে বলব? আমি তো মাল খেয়ে ছিলাম। তুই বল।’

চারু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘তুই খুন-টুন করতে পারিস বলে আমার বিশ্বাস হয় না। তবে যৌন হিংসা মারাত্মক জিনিস, মাথায় উঠলে কাকে কী করে দেয়…’

ঈশানী বাঁকা চোখে ওর দিকে চায়, ‘যাহ্ শালা! তুই কী করে জানলি? তোর কবে যৌন হিংসা হল?’

‘যখন তুই আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিস।’

‘সে তো তোরই শরীর…’

‘কোনও শরীরই তো আমার নয়…’

ঈশানী হাওয়ায় হাত তোলে, ‘তো কী করব?’

‘আমার হাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিবি।’

ঈশানী খিকখিক করে হেসে ফেলে। কপাল চাপড়ায় একবার। কোনরকমে হাসির দমক থামিয়ে বলে, ‘আমি অভিকে খুন করিনি চারু। তবে আমার আফসোস হয়।’

‘কী নিয়ে?’

‘ওকে তেমন করে ভালোবাসতে পারিনি। বাসলে হয়তো এতটা ডেস্পারেট হয়ে যেত না। আর আফসোস হয়…’

‘কীসে?’

‘বাবা এতদিন অসুস্থ ছিল, কষ্ট পেয়েছে, ছটফট করেছে। এমনকী আমি জানি আসন্ন মৃত্যুর ভয়ও পেয়েছে। বারবার বলেছি দেখো, সেরে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাবাকে কোনওদিন বলা হয়নি—দেখো, আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দেব না। তুমি শুধু ভয় পেয়ো না বাবা। তোমার মেয়ে আছে…কারণ আমি ভেতরে ভেতরে জানতাম আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই।’

ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আরও কিছুদূর এগিয়ে আসে ওরা। চারটে পুরোনো বাড়ি চারটে ক্ষুধার্ত দানবের মতো ঝুঁকে এসেছে মাঝখানটায়। চারটে নরখাদক মিলে দুটো মানুষের দিকে লোলুপ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে যেন।

চত্বরটা পেরিয়ে গেলে এক ধারে একটা ছোট জলাশয়। খানিকটা স্থির জলও আছে তাতে। তার শ্যাওলা ধরা সিঁড়ির উপর কিছুক্ষণ বসে ওরা গল্প করে। জলের উপরে দুলন্ত গাছের ছায়া ধীরে ধীরে ওদের মুখের উপর এসে দুলতে থাকে। কিছুক্ষণ সেই ভাবে গল্প করে ওরা উঠে আসে।

চারদিক ঘুরতে ঘুরতে পুরোনো কুয়োটার কাছে এসে উপস্থিত হয় একসময়। কুয়োটা বড়। উপর দিকে একটা তারের জাল দিয়ে ঢাকা। সেটাও মধ্যে মধ্যে ছিঁড়ে গেছে। উঁচু পাঁচিলের একদিক খসে পড়েছে নিচে।

চারুর হাত ধরে সেদিকে এগিয়ে যায় ঈশানী। একবার ভেতরে উঁকি মেরে উঠে বসে পড়ে পাঁচিলের উপর। চারু বাধা দেয়, ‘এই নেমে দাঁড়া। নিচে পড়ে যাবি তো…’

ঈশানী মুখ ঘুরিয়ে নেয়, ‘অতই যখন চিন্তা তখন বেঁধে দে।’

‘বাঁধব কী করে? এখানে দড়ি কোথায়?’

সামনে ঝুঁকে চারুর দুটো হাত ধরে কোমরে টেনে নেয় ঈশানী, ‘বোকা কোথাকার, দড়ি দিয়ে নয়, হাত দিয়ে।’

ওর শরীরের ঠেলায় কুয়োর ভিতর প্রায় ঝুঁকে পড়ে চারু। ওর মাথাটা ঢুকে আসে ভেতরে। আর একটু হলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভিতরে গিয়ে পড়ত দুজনে। বুকের ভিতরটা গরম হয়ে ওঠে ঈশানীর। কোনরকমে হাত দিয়ে একটা প্রান্ত খামচে ধরে নিজেদের আটকে নেয় সে।

কিন্তু ততক্ষণে চারুর চোখ পড়েছে কুয়োর নিচের দিকে। তার মুখটা হঠাৎ করেই লাল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে সরে আসতে চাই ও। চিৎকারটা ছড়িয়ে পড়ে ফাঁকা চত্বর জুড়ে।

‘কী হল চারু?’ দু’গালে হাত রেখে ওকে শান্ত করতে চায় ঈশানী। ছেলেটার সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। যেন এইমাত্র একটা বিদ্যুতের শিখা স্পর্শ করে গেছে ওকে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতেই বসে পড়ে ও। ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকে কুয়োর দিকে, মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আতঙ্ক জড়ানো কথাগুলো, ‘ওই লোকগুলো…লোকগুলো…’

‘কোন লোক? কাদের কথা বলছিস?’

‘এখানে…এখানে ওদের জড় করেছিল লোকগুলো।’ আঙুল তুলে দেখাল চারু, ‘লোকগুলোর মাথা পাঁচিলে আর উল্টোদিকে ওদের বাড়ির মেয়েদের মাথা। জ্যান্ত! তারপর চোখের সামনেই মেয়েগুলোকে পেছন থেকে তলোয়ার দিয়ে…আর মাথাগুলো ওই পাঁচিলের উপরে রেখে…আঃ…’ আবার ছিটকে পড়ে চারু। নিজের বুক খামচে ধরছে ও বারবার। ঈশানী দৌড়ে যায় ওর দিকে। ও বিড়বিড় করে বলেই চলে, ‘একজন একজন করে…সমস্তটা ভেসে যাচ্ছিল রক্তে…’

চারপাশে তাকায় সে, ‘এত চিৎকার করছে কে? এত আওয়াজ কেন? চুপ…সবাই চুপ…ওই যে ওই ঝুলছে ওদের গলাকাটা শরীর…ওই বাড়ির বারান্দা থেকে…ওই যে পড়ে আছে দেহ…আর রক্ত…’ স্প্রিং-এর মত ছিটকে বারবার সরে যায় চারু।

আবার ছুটে গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ঈশানী। ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মাথায়। চারুর চোখ হারিয়ে গেছে আকাশে, ‘আমার…আমার কষ্ট হচ্ছে খুব রুনু…’

ও চেয়ে দেখে ছেলেটার নাক কান আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। সেটা মুছতে মুছতে ওকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে ঈশানী, ‘এই জায়গাটা ভালো নয়। চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই…’

ওর হাতটা ধরে প্রাণপণে দৌড় দেয় ঈশানী। আশপাশের প্রত্যেকটা বাড়ির ভেতর থেকে যেন চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ওরা। হাহাকার করছে সবাই, সেই সঙ্গে তলোয়ারের আওয়াজ, মেয়েদের বুকভাঙা কান্না, রক্তের গন্ধ, লাশের গন্ধ, সেইসঙ্গে কারা যেন আকাশ ফাটিয়ে হাসছে…

‘আমাকে ছেড়ে দে রুনু…’ প্রবল যন্ত্রণায় সিমেন্টের চাতালের উপরে বসে পড়ে চারু। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে ওর।

ওর সামনে গিয়ে বসে পড়ে ঈশানী। তারপর দুহাতে ঢেকে দেয় ওর চোখ, ‘ছাড়ব না।’

‘আমাকে চলে যেতে হবে, আমি আর এখানে থাকতে পারব না রুনু, এই জগৎটা আমার নয়…আমাকে চলে যেতে হবে…’ হাঁপাতে হাঁপাতেই ক্লান্ত গলায় বলে ছেলেটা।

এতক্ষণে ওর শারীরিক যন্ত্রণাটা কমে এসেছে। বুকটা ওঠানামা করছে দ্রুত। চোখের মণিদুটো এখনও ঝাপসা হয়ে আছে।

ঈশানী ওর গালে নরম করে হাত রাখে একবার। তারপর কপালে ঠোঁট ঠেকায়, ‘বেশ, চলে যাস…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *