কাকতাড়ুয়া – ১৪

চতুর্দশ অধ্যায়

উত্তর কলকাতার স্কুল থেকে কার্টুনিস্ট খুঁজে বের করার ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হয়েছিল ততটা হয়নি। কে কবে কোন প্রাক্তনী ভালো ছবি আঁকতে পারত সেটা স্কুল অথরিটি বলতে পারেনি। কয়েকজনের নাম তারা বলেছিল বটে, কিন্তু তারা কেউই উত্তর কলকাতার আশেপাশে থাকে না।

অগত্যা দিনকতক হল রাতবিরেতে বাইক নিয়ে এলাকাটায় টহল দিচ্ছেন অনির্বাণ। রাত মোটামুটি এগারোটার পরে সন্দেহজনক লোকজনকে স্কুটি নিয়ে যেতে দেখলেই ফলো করছেন কিছুদূর। এই ক’দিন সেটা করে কিছু লাভ হয়নি। আজ একটু হতাশ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। এত সুন্দর একটা লিড পেয়েও ধরতে পারবেন না!

বাগবাজারের মোড় পার করে একটা কচুরির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন অনির্বাণ। কাল রাতে একেবারে টিপু সুলতান মসজিদের গায়ে কার্টুন এঁকে গেছে কেউ। দু-একজন লোক নাকি দুটো ছেলেমেয়েকে ছবি আঁকতে দেখেওছে। কিন্তু তাদের মুখ ঢাকা ছিল বলে চিনতে পারেনি। তারা হইহই করে তেড়ে আসতেই একটা দাঁড় করিয়ে রাখা স্কুটিতে উঠে চম্পট দিয়েছে দুজনে।

এতদিন তেমন আমল না দিলেও এখন নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। দেশের যা পরিস্থিতি, কোথাকার জল কোথায় গড়ায় ঠিক নেই। দুম করে কাদা ছোড়াছুঁড়ি করে একটা দাঙ্গা শুরু হয়ে যেতে পারে। ছেলেমেয়ে দুটোকে গোরুখোঁজা খুঁজতে শুরু করেছে পুলিশ।

অনির্বাণ আজ কলেজ স্ট্রিটে এসেছিলেন একটা বইয়ের রয়াল্টির চেক নিতে। প্রকাশনের অফিসে বসে গল্প করতে করতে বেলা হয়ে গেছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এসেছেন বাগবাজার। এখানে এলেই পটলার কচুরির গন্ধে গন্ধে এদিকে চলে আসেন।

কচুরির ভিতর আলুর তরকারি পুরে মুখে সবে চালান করতে যাবেন এমন সময় একটা অল্পবয়সি ছেলে হুড়মুড়িয়ে প্রায় ওর গায়ের উপরে এসে পড়ল। আর একটু হলে গরম তরকারি ছলকে পড়ছিল ওর গায়ে, কোনরকমে সামলে নিলেন অনির্বাণ।

‘ইয়ে স্যার! আপনি!’ ছেলেটা হাঁ করে তাকাল ওর মুখের দিকে।

অনির্বাণ একটু থতমত খেলেন, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি আপনার অনেক বই পড়েছি। সেই যে প্রাচীন ভারতের যৌনজীবন নিয়ে যেটা লিখেছিলেন, তারপর রবীন্দ্রনাথের জীবনের নারী নিয়ে যেটা…’

চারপাশটা একবার দেখে নিলেন অনির্বাণ, একটু ধমকের সুরে বললেন, ‘আঃ, হয়েছে সেসব। তোমার চাইটা কী?’

‘অনেকদিন কচুরি খাইনি, আপনি যদি খাওয়ান আপনাকে একটা দরকারি ইনফরমেশন দেব আমি।’

অনির্বাণের হাতটা নিজে থেকেই আবার শালপাতার উপরে নেমে আসে। হাঁক পেড়ে আর এক প্লেট কচুরির অর্ডার দেন তিনি। তারপর জিগ্যেস করেন, ‘কী ইনফরমেশন?’

ছেলেটা একটু কাছে সরে এসে ফিসফিসে স্বরে বলে, ‘আজ রাতে ওরা কোথায় ছবি আঁকবে আমি জানি।’

‘তাই নাকি? তা তুমি কী করে জানলে?’

‘কারণ আমি ওদের একজন স্যার…’

ছেলেটার মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন অনির্বাণ। ভরদুপুরে ইয়ার্কি করতে এসেছে নাকি। অবিশ্বাসের গলায় বলেন, ‘এতটা বোকা তোমরা নও মনে হয়। এই যে আমি তোমাকে চিনে গেলাম এবার যদি পুলিশে ধরিয়ে দিই? বিশেষ করে কাল রাতে যা করেছ তোমরা তারপর পুলিশ তোমাদের চুঙ্কুমুনু করে ছেড়ে দেবে বলে তো মনে হয় না।’

‘কী এমন করলাম?’ তেমন হাসি মুখেই জিগ্যেস করে ছেলেটা।

‘মসজিদের গায়ে ছবি এঁকে কী প্রমাণ করতে চাও? এবার যদি ওই ছবির জন্য হুট করে একটা দাঙ্গা লেগে যায় তার সমাধান আছে তোমাদের কাছে?’

‘এরোসল পেন্ট রিমুভার…’ বলে ছেলেটা কচুরিতে কামড় বসায়। চাকুম চুকুম করে চিবানোর আওয়াজ শোনা যায়।

‘মানে?’

‘মানে আমাদের আঁকা কার্টুন পেন্ট রিমুভার দিলেই উঠে যাবে। কিন্তু মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তোলা এই ধর্মগুলোকে কী করে তুলে ফেলবেন স্যার?’

অনির্বাণ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ছেলেটা হুট করে একটা প্রশ্ন করে বসে, ‘ইয়ে, ধর্মের কথায় মনে পড়ল স্যার। আপনি নেফথিসের ব্যাপারে কিছু জানাতে পারবেন?’

আচমকা প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিলেন না অনির্বাণ। কচুরির প্লেটটা শেষ করে সে ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দেন। তারপর বলেন, ‘সে তো ইজিপ্টের একজন দেবী।’

ছেলেটা আগ্রহে ঘাড় নাড়ে, ‘হ্যাঁ, আপনি দু’বছর আগে একটা বই লিখেছিলেন। ইজিপ্টের দেবতা ও তাদের মিথ। ভালোমতো পড়াশোনা করে লিখেছিলেন বোঝা যায়, কিন্তু তেমন একটা চলেনি। তো সেখানেই আপনি নেফথিসের কথা লিখেছিলেন। তবে বড্ড অল্পের উপর লিখে বেরিয়ে গেছেন। গোটাটা যদি আমাকে বলতেন…’

পাশেই একটা সিমেন্টের বেঞ্চের উপর এসে বসে পড়ে ওরা দুজন। ছেলেটা এর মধ্যে আরও গোটাচারেক কচুরি সাঁটিয়ে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ খিদে পেয়েছিল তার।

ওর খাবার দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন অনির্বাণ। ছেলেটা সেটা লক্ষ করেই মিষ্টি করে একগাল হেসে বলে, ‘এত খাচ্ছি দেখে অবাক হচ্ছেন, না? আসলে খেলেও গায়ে লাগে না তো, তাই ইচ্ছামতো খেয়ে যাই। শরীরটা তো বেশিক্ষণের নয়…’

‘মানে?’

‘আপনি নেফথিসের কথা বলুন। কে ছিলেন ভদ্রমহিলা?’

অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরান। সামনে ব্যস্ত রাস্তা। চতুর্দিকে কলকাতা শহরের কোলাহল। তার মধ্যে এ কথাগুলো বলতেও কেমন জিভ আটকে যায়।

‘ইজিপ্টের ছদ্মবেশের দেবী ছিলেন নেফথিস। মানুষ মরে গেলে তার শরীরের মধ্যে যে বদলগুলো আসে সেগুলো নাকি তিনিই পরিচালনা করেন। ইজিপ্টের অন্য দেবতাদের নিয়ে লেখালিখি হয়, কেবল নেফথিস একটু অবহেলিত থেকে যান। সে কারণেই আমি একটু ভালোরকম পড়াশোনা করেছিলাম। সেটা করতে গিয়েই জানতে পারি নেফথিসকে নিয়ে একটা মিথ চালু আছে। সে মিথ একাধিক পিরামিডের গায়ে ছবি দিয়ে লিখে রেখেছিল ইজিপশিয়ানরা। খুব একটা জনপ্রিয় নয়, তবে আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল গল্পখানা…’

‘কী রকম গল্প?’

‘স্বর্গের বড় দেবতা আমুন-রা একদিন মানুষের উপরে খুশি হয়ে ভারি বিচিত্র এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। তিনি স্বর্গের দরজা উন্মুক্ত করে দিলেন। কাতারে কাতারে মর্ত্যের মানুষ স্বর্গে ঢুকে পড়তে লাগল। এটা ভাঙল, ওটা ছুড়ল, সাজানো বাগান তছনছ করে দিল। সমস্ত কিছু নষ্ট করার পর তাদের চোখ গিয়ে পড়ল স্বর্গের নিচুতলায় থাকা বারোজন দুর্বল অন্ধকারের দেবতাদের উপর। তাদের ক্ষমতা় খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু তাও দেবতা তো। মানুষ গিয়ে সেই দেবতাদের আক্রমণ করল। আচড়ে কামড়ে শাবল দিয়ে গেঁথে রক্তাক্ত করে দিল তাদের। সেই দুর্বল দেবতাদের তখন প্রাণ যায় যায়।

‘তাই দেখে মানুষ হইহই করে এটা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে দেবতারাও একেবারে অজর অমর অক্ষয় নয়। তাঁদের মৃত্যু আছে, আক্রমণ করলে তাঁরাও ধ্বংসও হবে।

‘দেবতারা পড়লেন বিপদে। মানুষের মনে যদি এই ধারণা জন্মায় যে ঈশ্বরও তাদের মতো নশ্বর তাহলে কোনওদিন হয়তো স্বর্গ জয় করে ফেলবে তারা। এ অবস্থায় দেবতারা শরণাপন্ন হল নেফথিসের। নেফথিস আর উপায় না দেখে তাঁর উপাস্য দেবতার মূর্তি ভেঙে বারো ভাগ করে সেই বারো খণ্ড মাটি দিয়ে বারোটা হাঁড়ি তৈরি করলেন।’

‘হাঁড়ি?’

‘হ্যাঁ। তার জাদু বলে সেই হাঁড়ির উপর যারই মুখ ভাবতে ভাবতে আঁকা হবে সে-ই স’শরীরে হাজির হবে। দেবতারা সেই বারোটা হাঁড়িতে বারোজন দেবতার মুখ এঁকে দিলেন। মানুষও দেখল এত মারধোর করে যে দেবতাদের তারা আধমরা করে দিল তারা একেবারে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন…

‘সে যাত্রা কোনওরকমে বাঁচলেও পরে ওই দেবতারা সেরে উঠলে তাদের বডি ডাবলের আর দরকার রইল না। ফলে হাঁড়িগুলোকে আবার নেফথিসের কাছে ফেরত দিয়ে দেওয়া হল। নেফথিস বুঝলেন এ হাঁড়ির যা ক্ষমতা তাতে ওগুলো হাতে পেলে যে কেউ আমুন-রা সেজে স্বর্গ শাসন করতে পারবে। ফলে তিনি হাঁড়িগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শোনা যায় সব হাঁড়িগুলো নাকি ধ্বংস হয়নি। স্বর্গ থেকে ফেরত আসার সময় মানুষের মধ্যে কেউ কেউ নাকি সেই হাঁড়ির খোঁজ পেয়ে সেগুলো চুরি করে এনেছিল…’

একটু থেমে জল খেয়ে আবার বলেন অনির্বাণ, ‘এমনকী নেফথিসের ছবিতেও দেখতে পাবে তাঁর মাথার উপর একটা বিশেষ লম্বাটে আকৃতির হাঁড়ি আঁকা হয়। কথিত আছে যেহেতু নেফথিস তাঁর নিজের উপাস্য দেবতার শরীরের মাটি দিয়ে এই হাঁড়িগুলো বানিয়েছিলেন তাই এদের মধ্যেও ঈশ্বরের অংশ আছে। এগুলোও এক একটা দেবমূর্তি। এদের সামনে অসহায় হয়ে মন থেকে কিছু চাইলে ইচ্ছাপূরণ হয়…তাছাড়া…’ স্মৃতি হাতড়ান অনির্বাণ, ‘আরও কিছু লেখা ছিল। কিন্তু আমার এখন মনে পড়ছে না…’

বাগবাজার মোড়ের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো থম হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা, তারপর বলে, ‘বাপ রে! এ তো ভয়ঙ্কর গল্প!’

মুচকি হেসে ছেলেটার দিকে তাকান অনির্বাণ, ‘এই যে তুমি এতক্ষণ কার্টুনের কথা বলছিলে, আধুনিক কার্টুন বলতে আমরা যা বুঝি তার সব কিছুই শুরু হয়েছে প্রাচীন ইজিপ্টে। মানুষের শরীরে শেয়ালের মাথা, অর্ধেক সিংহ অর্ধেক মানুষ, সুকুমার রায়ের ঢের আগে এসব ইজিপশিয়ানরাই তৈরি করে গেছিল। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কী?’

কচুরির প্লেটটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা। তারপর জলের জগটা নিয়ে এসে হাত ধুতে ধুতে বলে, ‘সব এখন শুনে নিলে কী করে হবে? আজ রাতে কাউকে নিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটে আসুন। দেখা হবে…’

‘ছোটবেলায় আমাদের ইতিহাসের স্যার একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন—রাজাদের শুধু মৃত্যুদিন মনে রাখতে হয়। জন্মদিন মনে না রাখলেও চলে। পরে বড় হতে হতে খেয়াল করেছি ব্যাপারটা। কোন রাজা কবে জন্মেছেন বইতে লেখা থাকত না। কিন্তু মৃত্যুর সালটা পরীক্ষায় আসত…’

আজ সকাল হতেই বেরিয়ে পড়েছিল ঈশানী। প্রোফেসর বলেছিলেন, ওনাকে কাজের ব্যাপারে পাকড়াও করতে হলে সব থেকে ভালো জায়গা ওর কলেজ। দুটো ক্লাসের মাঝে কলেজের বাগানে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন ভদ্রলোক। তার মধ্যেই ভাবনার অবকাশ থাকে।

‘কারণ রাজাদের জন্ম সিগনিফিকেন্ট নয়, কিন্তু রাজার মৃত্যুতে ইতিহাসের গতিপথ বদলে যায়…’ ঈশানীর মুখে উত্তর খেলে যায়।

‘এক্স্যাক্টলি।’ অপরেশ মহাপাত্রের ফর্সা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ইউনিভার্সিটির করিডোর ছেড়ে বেশ কিছুদূর বেরিয়ে এসেছে ওরা। প্রোফেসর মহাপাত্রের এই এক সমস্যা। স্থির হয়ে বসতে তিনি কিছুতেই পারেন না। তার উপরে ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করলে আরওই অস্থিরতা ভর করে তার শরীরে।

এখনও খোলা ঘাসের বাগিচার উপরে হেঁটে চলেছেন তিনি। মাঝে মাঝে দু-একজন ছাত্র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে চেয়ে হালকা হাসি ছুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেদিকে বেশি মন নেই বৃদ্ধ প্রোফেসরের। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ইতিহাসের গল্প বলে চলেছেন তিনি।

‘এবং ইতিহাসের গতিপথ পালটে যাওয়া মানে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রাতারাতি বদলে যাওয়া। ধরো আজ হুট করে আবার ভারতে ইংরেজ আক্রমণ হল। আবার কোম্পানি ক্ষমতায় এসে কর্তৃত্ব শুরু করল, তাতে তো দেশের সোয়া’শো কোটি মানুষের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে যাবে, তাই না?’

‘তা তো বটেই।’

‘কিন্তু আসল সর্বনাশটা হবে কাদের?’

‘যারা এতদিন আগের রাজার ছায়ায় বসে করে খাচ্ছিল। মানে মন্ত্রী, আমলা, সেনাপতিদের…নতুন রাজা ভালোও হতে পারে, নাও পারে। সে আগের মন্ত্রীসভাকে রাতারাতি বরখাস্ত করে দিতে পারে, এমন কোনও আইন আনতে পারে যাতে মন্ত্রী সান্ত্রীদের ক্ষমতা হ্রাস পায়…’

‘শুধু তাই নয়, এক এক জন রাজার এক এক রকম চরিত্র থাকত। কারও প্রবল পরাক্রমশালী বলে রেপুটেশন ছিল, তার আমলে কোনও বহিঃশত্রু আক্রমণ করার সাহস পায়নি। আবার কেউ কামিনি কাঞ্চন নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। কয়েক বছর পরেই পাশের রাজ্য আক্রমণ করে জয় করে নিয়েছে তার সাম্রাজ্য…ইতিহাস বই খুললে দেখবে একজন রাজা মারা গেছে মানে তার সাম্রাজ্যের ধরন পাল্টে গেছে। কারও উপর দেশের মানুষের রাগ ছিল, কাউকে দেশের মানুষ ভালোবাসত। এবং এই সমস্ত রাগ পছন্দ অপছন্দ ভালোবাসা—রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ফলে কোনও একটা দেশের রাজার আচমকা মরে যাওয়া দেশের রাজনীতিতে অভাবনীয় বদল আনত…’

ঈশানী চুপ করে থাকে। কথা শুনে বোঝা যায় প্রোফেসর মহাপাত্রের কথা এখনও শেষ হয়নি।

‘তো রাজার মৃত্যু, অসুস্থ হয়ে মরণাপন্ন হওয়া, বা সন্ন্যাসগ্রহণ—এই সব কিছু আটকানোর জন্য একটা উপায় ছিল…সেটা কী গেস করতে পারবে?’

ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবে ঈশানী। মাথা নাড়ে, ‘উঁহু…’

‘বডি ডাবল। ঝিন্দের বন্দী সিনেমাটা তো দেখেছ। সেকালের এই হিস্টোরিকাল ফিকশনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও সত্যিকারের ঘটনাকে চড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হত। এন্থনি হোপ অবশ্য প্রিজনার অফ জেন্দা ঠিক কোথা থেকে লিখেছিলেন সে নিয়ে কিছু বলে যাননি, তবে ইতিহাসের চরিত্রদের বডি ডাবল ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। স্বয়ং জোসেফ স্টালিন মোট তিনটে বডি ডাবল ব্যবহার করতেন, যার মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত ছিল ফেলিক্স দাদায়েভ। এমনকী স্টালিনের কমরেডরাও নাকি দাদায়েভকে দেখে স্টালিন বলে ভুল করত। হিটলারের নাকি একাধিক বডি ডাবল ছিল। বার্লিনে তার আত্মহত্যার পর রাশিয়ানরা দাবি করে হিটলারের বাসস্থান ও তার আশেপাশে প্রচুর লোকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে যাদের চেহারা ও সাজগোজ অবিকল হিটলারের মতো। এমনকী স্টালিনও প্রথমে দাবি করেন হিটলার মোটেই সুইসাইড করেননি। তার বদলে স্পেনে পালিয়ে গেছেন…

‘এলা স্ল্যাক নামক এক মহিলা ব্রিটেনের রানির ঘোষিত বডি ডাবল। তিরিশ বছর ধরে নাকি রানিকে অবিকল মিমিক করার ট্রেনিং নিয়েছেন তিনি। এসব উদাহরণ দিতে গেলে শেষ হবে না। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে আজকের ইন্টারনেট আর মিডিয়ার জুগে এ জিনিসটা সহজ হলেও আজ থেকে কয়েক শো বছর আগে ব্যাপারটা ভাবাই যেত না…’

‘কেন?’

‘কারণ লোকে তখন রাজার কেবল নামটাই জানত। ছবি দেখার উপায় ছিল না। একমাত্র সম্বল হাতে আঁকা ছবি। তাও রাজার আসল চেহারাকে বাড়িয়ে চড়িয়ে আঁকার ফলে সত্যিকারের চেহারাটা চেনা যেত না। ফলে কার সঙ্গে রাজার মুখের অবিকল মিল আছে সেটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আবার মন্ত্রী সান্ত্রীদের পক্ষেও সারা দেশ খুঁজে রাজার লুক এলাইক বের করে আনা সম্ভব নয়…’

‘আচ্ছা, বাংলায় এরকম বডি ডাবলের কোনও গল্প চালু নেই?’

প্রোফেসর মহাপাত্র ওর মুখের দিকে চেয়ে হাসেন। মাথায় একটা হাত রেখে বলেন, ‘তোমার মাথাটা কিছু নিয়ে খারাপ হয়েছে বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি ভুল লোকের কাছে এসেছ মনে হচ্ছে। আমি কেবল ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করি…তবে…’ কী যেন মনে পড়তে কথা বলতে বলতেও থমকে যান মহাপাত্র, ‘তুমি ভাস্কর পণ্ডিতের নাম শুনেছ?’

‘হ্যাঁ, কেন শুনব না?’

‘তাহলে মূল ঘটনায় চলে আসি। মন দিয়ে শুনবে আর মনে মনে কল্পনা করবে…’

মাঠের একপাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রোফেসর মহাপাত্র। দুটো হাত সামনে তুলে যেন ছবি আঁকার চেষ্টা করেন তিনি। ওদের সামনের কলেজ গ্রাউন্ড মুহূর্তে পরিণত হয়ে যায় কয়েকশো বছর আগের মুর্শিদাবাদের গ্রামে। যে গ্রামের মানুষ আতঙ্কে জড়সড় হয়ে আছে। যে-কোনও সময় হতে পারে বর্গী আক্রমণ।

‘সতেরোশো বিয়াল্লিশ সালের পনেরোই এপ্রিল। বাংলার বুকে ভয়ঙ্কর দিন। নাগপুর থেকে চল্লিশ হাজার বর্গী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলেন ভাস্কর পণ্ডিত। নবাব আলিবর্দী খাঁ তখন কটকের যুদ্ধ সেরে ফেরার পথে বর্ধমানের রাণীনগরের কাছে তাঁবু ফেলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই সময় গোপনে ভাস্কর পণ্ডিত তাঁর তাঁবু আক্রমণ করলেন। নবাব কোনরকম বেঁচে কাটোয়ায় চলে আসেন। নবাব পালিয়ে যাওয়ার আক্রোশে ভাস্কর পণ্ডিত মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে লুটপাট চালান। নবাব আবার সেনাবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদ রওনা দিলে ভাস্কর পণ্ডিত আবার ঘুরপথে কাটোয়ায় চলে আসেন। এখানেই নৃশংস লুটপাট চালিয়ে বর্ধমান রাজার বাড়িটা আয়ত্তে এনে ঘাঁটি গেড়ে বসেন তিনি। একশো বছর পরে সে বাড়িটা একেবারে ভেঙেচুরে গেলেও এখনও কয়েকটা দেওয়াল রয়ে গেছে সে বাড়ির…এবং রয়ে গেছে একটা কামানের গোলার দাগ…’

‘কিন্তু আমার প্রশ্নটা…’

হাত তুলে ওকে বাধা দেন প্রোফেসর, ‘এই বাড়িতেই নাকি একটা সোনার দুর্গা বানিয়ে পুজো শুরু করেন ভাস্কর পণ্ডিত। কিন্তু সে পুজো সম্পূর্ণ হতে পারে না। ওই বছরই সাতাশে সেপ্টেম্বর পুজোর মধ্যেই আলিবর্দী ভাস্কর পণ্ডিতের ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যেভাবে তাঁবুতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় আলিবর্দীকে আক্রমণ করেছিলেন, সেভাবেই নবমীর রাতে নাচে গানে ক্লান্ত থাকা বর্গীসেনার উপর মুহুর্মুহু কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকেন নবাব। বর্গীবাহিনি ছারখার হয়ে যায় সে গোলার আঘাতে। পুজো অসমাপ্ত রেখেই পালানোর চেষ্টা করে তারা। এই সময় সোনার মূর্তি বুকে চেপে ধরে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন ভাস্কর পণ্ডিত। এরপর থেকে তার আর কোনও খবর পাওয়া যায় না…’

‘মারা গেছিলেন?’

প্রোফেসর হাসেন, ‘তোমার সেটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? ধার্মিক মানুষ। মুসলমান নবাবের গোলায় দুর্গামূর্তি ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে মূর্তি নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু বর্ধমানের উত্তাল গঙ্গায় অত ভারী একটা জিনিস নিয়ে ঝাঁপ দিলে বেঁচে থাকার আদৌ কোনও সম্ভবনা থাকে?’

‘তাহলে এর পরের বর্গী আক্রমণগুলো…’

‘এর ঠিক দেড়বছর পর আবার বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমণ করে। তাদের নেতৃত্ব কে দিয়েছিল গেস করো…’

‘ভাস্কর পণ্ডিত!’

উপরে নিচে মাথা নাড়েন প্রোফেসর, গলা ধরে এসেছে তাঁর, ‘বলিউডি নায়কদের মতো ইতিহাসে মরে গিয়ে ফিরে আসা চরিত্রের প্রচুর উদাহরণ আছে। এখন সবগুলো বলতে গেলে আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে…’

‘আপনি বলতে চাইছেন এগুলো সব বডি ডাবল?’

‘তুমি গল্প শুনতে চেয়েছিলে আমি বলে দিলাম। এরপর যা বোঝার তুমি নিজের মতো হিসেব করে নাও…’

ঈশানী বুঝতে পারে প্রোফেসর তাড়াহুড়ো করছেন। ক্লাস শুরু হতে চলেছে তার। উল্টোদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি, থেমে জিগ্যেস করেন, ‘তা তোমার অফিস নেই আজকে?’

ঈশানী একটু থতমত খায়, ‘না, না সকালে শরীরটা আসলে…’

প্রোফেসর হাসেন, ‘বুঝতেই পারছি। আগে তুমি বলতে এখন আপনি বলছ। সব ভুলে মেরে দিয়েছ দেখছি…’

ঈশানী একটু খাবি খায়। সেও উল্টোদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী যেন মনে করে একটু থেমে যায়।

‘প্রোফেসর…’ পেছন থেকে ডাকে সে।

‘হ্যাঁ বলো…’

‘আর একটা ছোট দরকার ছিল। জানি না আপনি হেল্প করতে পারবেন কিনা, কিন্তু তাও…’ সে পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে ওর সামনে তুলে ধরে। তার উপরে কয়েকটা মামুলি চিহ্ন পেনসিলে আঁকা আছে। সেগুলো দেখিয়ে জিগ্যেস করে, ‘এই চিহ্নগুলো দেখে কিছু মনে পড়ছে আপনার?’

‘একটা ঘুড়ি, একটা ডানা ছড়ানো ঈগল…’ গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবেন প্রোফেসর। বিড়বিড় করে বলেন, ‘ডানা ছড়ানো ঈগল অনেক কিছুরই সিম্বল হতে পারে। কিন্তু ঘুড়ি ব্যাপারটার মধ্যে একটা বাঙালি-বাঙালি ব্যাপার…মাই গড!’ শেষ কথাটা বলে থমকে একটুক্ষণ চেয়ে থাকেন সেদিকে।

ঈশানী কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করে, ‘কিছু বুঝলেন স্যার?’

‘এটা একটা দেবতার চিহ্ন। তবে বাঙালি নয়, এমনকী ভারতীয়ও না। উড়ন্ত ঘুড়ি আর ডানা ছড়ানো ঈগল নেফথিসকে সিম্বলাইজ করে…’

‘নেফথিস?’ ঈশানী কৌতূহলী গলায় জিগ্যেস করে।

‘ইজিপ্সিয়ান গড অফ ম্যাজিক এন্ড কেমোফ্লাজ!’

বাবুঘাট ফেরির কাছে এসে বাইকটা দাঁড় করালেন অনির্বাণ। হেলমেট মাথা থেকে খুলে একবার চারপাশটা দেখে নিলেন। তারপর মাথাটা পেছন ঘুরিয়ে পেছনে বসে থাকা রাজেনের উদ্দেশে বললেন, ‘সামনের স্কুটিটাই মনে হচ্ছে…’

রাজেনও সামনের ফাঁকা রাস্তাটার উপর দাঁড় করিয়ে রাখা স্কুটিটাকেই দেখছিল, সে চাপা গলায় বলল, ‘শালা, এত দূরে রেখে চালাচ্ছে যে নম্বরটাও দেখতে পাচ্ছি না।’

বাবুঘাটের কাছাকাছি এসেই স্কুটিটা দেখতে পেয়েছিল অনির্বাণ। একটা অল্পবয়সি ছেলে। তার পিঠে একটা অস্বাভাবিক বড় ব্যাগ। এত রাতে স্কুল কলেজ, টিউশনির বালাই নেই। তাহলে এত বড় ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? এখান থেকেই সন্দেহ জমাট বাঁধে ওর মনে।

আজ একা বেরোননি অনির্বাণ। সঙ্গে রাজেনকে নিয়েছেন। রাজেন আগে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করত, মাসকয়েক আগে কী একটা কারণে সেসব ছেড়ে এখন একটা প্রাইভেট এঞ্জেন্সি চালাচ্ছে। রাত বিরেতে এইসব অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হলে ওকে সঙ্গে নেন অনির্বাণ।

হুট করেই একেবারে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছে ছেলেটা। হাত তুলে ওদের ইশারা করছে। হাতটা গ্লাভসে ঢাকা। মুখ পেছনে না ঘুরিয়েই হাতছানি দিয়ে ডাকে সে। অনির্বাণ বাইক থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে যান।

ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে হেলমেট খোলে ছেলেটা। অনির্বাণ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। সকালের ছেলেটা নয়। কেমন যেন চাকমা চাকমা দেখতে। টানাটানা চোখ, ফর্সা গায়ের রং, মুখটা ভারি মিষ্টি। ওর মনে হয় এই মুখ ও আগেও দেখেছে। কোনও বিদেশি সিনেমায় সম্ভবত।

‘আমাকে খুঁজছেন আপনারা?’ ছেলেটা পরিষ্কার বাংলায় জিগ্যেস করে।

‘তোমাদের একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই আমরা।’

‘বেশ তো নিন। প্রশ্ন করুন, উত্তর দিচ্ছি।’

অনির্বাণ একবার রাজেনের দিকে তাকান, তারপর ওর চোখ নেমে আসে ছেলেটার মুখের দিকে, ‘ঠিক এভাবে নয়। যদি তোমাদের মুখ দেখাতে অসুবিধা না থাকে…’

‘আমরা কখন বললাম মুখ দেখাতে অসুবিধা, আপনারা দেখতে চাননি তাই আমরা দেখাইনি…অবশ্য মুখ জিনিসটা থেকে থেকে বদলে যায়। যেটা বলতে চাইছি সেটাই আসল…’

‘মাঝরাতে শহরের নামি দামি জায়গায় কার্টুন আঁকছ কেন তোমরা?’

‘আপনারা কার্টুনকে বছর শেষে গিয়ে ভোট দিয়ে আসবেন আর আমরা দেওয়ালে একটু আঁকতে পারব না?’

‘শাট আপ…’ ধমক দেন অনির্বাণ, ‘খুব বড় বড় কথা? থাবড়ে বাঁদরনাচ দেখিয়ে দেব তোমাকে…’

‘বাঁদরনাচের কথায় মনে পড়ল…’ কী মনে করে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করতে থাকে ছেলেটা, ‘আপনি কিন্তু স্যার ইন্সটাগ্রামে ভাইরাল হওয়া থেকে জাস্ট এক পা দূরে…’

ফোনে একটা ভিডিও চালিয়ে দেয় ছেলেটা। সেটা দেখেই বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় অনির্বাণের। একটা সবুজ পর্দা ঝুলছে ব্যাকগ্রাউন্ডে, আর তার সামনে তিনি নিজে প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে নাচছেন।

ছেলেটা একটা অহঙ্কারি হাসি হাসে, ‘আমি বানিয়েছি, ভালো হয়নি না স্যার? আসলে নাচটা আমার এখনও ঠিক…’

‘এ সবের মানে কী?’ গর্জে ওঠেন অনির্বাণ, ‘করতে কী চাইছ তোমরা?’

‘সিম্পল। আপনাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে স্যার।’ নির্লিপ্ত স্বরে বলে ছেলেটা।

‘তোমার লজ্জা করে না আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ?’

অবাক হয় ছেলেটা, ‘আরে ব্ল্যাকমেইল কোথায় দেখছেন? এসব জিনিস ইনস্টাগ্রামে ছেড়ে দিলে কী লেভেলের ভাইরাল হবেন ভাবতে পারছেন? পেছনটা যা দুলিয়েছেন। উফ…’

‘কী করতে হবে আমাকে?’ বরফের মতো শীতল স্বরে বলেন অনির্বাণ।

‘খুব সিম্পল। আগামী রবিবার আপনাকে এখানে একটা ভ্যালেন্টাইনস ডে অ্যারেঞ্জ করতে হবে। সঙ্গে আরও দু-একটা টুকটাক ব্যবস্থা…কিছুই অসম্ভব নয়…’ কথাটা বলে অনির্বাণের হাতে একটা বাক্স তুলে দেয় সে, ‘এতে টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনার শুধু ঝক্কির দায়িত্ব…’

‘মানে? এসব আমার কাজ নাকি?’

‘সে আপনি জানেন। আপনার তো পলিটিকাল লেভেলে ভালো যোগাযোগ আছে। রাজনীতি করার সময় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজও করেছেন বলে শুনেছি। কিছু একটা মোচ্ছব লাগিয়ে দিন। ছেলেমেয়েরা মিষ্টি করে সেজে এখানে আসবে। হাতে গোলাপ নিয়ে প্রেম টেম করবে, একটু নাচ গান হবে…ব্যাস…’

‘তাতে তোমাদের লাভ কী?’ অনির্বাণ অবাক হয়ে জিগ্যেস করেন।

‘সবসময় লাভ-লাভ করেন কেন বলুন তো? আপনি সাংবাদিক না ব্যবসায়ী?’

অনির্বাণ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় প্রিন্সেপ ঘাটের বাগানের দিকে কী যেন একটা নড়ে ওঠে। রাজেন হঠাৎ সেদিকে দেখিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘স্যার, ওই দিকে একজন ছবি আঁকছে বলে মনে হচ্ছে…’

কথাটা বলেই সে ছুটে যায় সেদিক লক্ষ্য করে। একটা মেয়েলি শরীর বাগানের দিক থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে ওকে দেখে। মেয়েটার পিঠে একটা ঢাউস ব্যাগ।

রাজেন সেখানে পৌঁছানোর আগেই একটু আগের ছেলেটা স্কুটি নিয়ে অন্ধকারটার সামনে ব্রেক কষে। মেয়েটা দ্রুত উঠে পড়ে স্কুটিতে। গড়গড় শব্দে আওয়াজ তুলে স্কুটিটা ছুটে বেরিয়ে যায় ওদের ছাড়িয়ে।

পেছন না ফিরেই হাত তুলে টাটা করে মেয়েটা। অনির্বাণ আর রাজেন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওদের দৃষ্টি সরে আসে প্রিন্সেপ ঘাটের ভিতরের দেওয়ালের দিকে। সেখানে নতুন একটা ছবি আঁকা হয়েছে…একঝাঁক রং চঙে মানুষের মাঝে হাতে একটা গোলাপ নিয়ে হাঁটছে একটা মেয়ে আর তার হাত ধরে ওদের দিকে পেছনে ঘুরে হাঁটছে একটা কাকতাড়ুয়া…

হাসতে হাসতে গলির পথ ধরে দৌড়ে আরও কিছু দূর এগিয়ে আসে ওরা। ঈশানীর নূপুর ফাঁকা গলির ভিতর রুমঝুম বাজতে থাকে। উত্তর কলকাতার সরু গলির এই সুবিধা। কোনওটার ভিতরে দুটো মানুষ ঢুকে অন্ধকারে লুকিয়ে দাঁড়ালে আর কোনও ভাবেই খুঁজে পাওয়ার কোনও সম্ভবনা নেই।

স্কুটিটা দাঁড় করানো আছে একটু দূরে। গলির ভিতর দিয়ে একসঙ্গে হাসতে হাসতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে সেদিকে এগোতে থাকে ওরা দুজনে।

‘এত কী কথা বলছিলি ওদের সঙ্গে?’ ঈশানী জিগ্যেস করে।

‘দরকার ছিল।’

‘কীসের?’

ছেলেটা ভুরু তোলে, ‘আমি ভগবান। আমার কাজকর্ম নিয়ে অত প্রশ্ন করা চলে না।’

‘আর আমি শুনেছিলাম, মানুষের মধ্যেই ভগবান থাকেন।’

চারুর হাতটা দুহাতে জড়িয়ে হাঁটতে থাকে ঈশানী। মাথাটা রাখে ওর বাহুতে। এভাবে হাঁটতে ভারি নিশ্চিন্ত লাগে ওর। কয়েক পা নিঃশব্দে হেঁটে আসে ওরা। রাতের কলকাতা থমথম করছে ওদের দুপাশে।

‘আমি কোনওদিনও ভাবিনি, জানিস কারও সঙ্গে এইভাবে হাঁটব…’

‘এইভাবে বলতে?’

‘এইভাবে গায়ের উপর লেগে। আমি ছোটবেলা থেকে একটু রুক্ষশুষ্ক গোছের। লোকজনকে প্রেম করতে দেখলে কেমন ন্যাকান্যাকা লাগত। আর দেখ, তোর সাথে মিশে আমি নিজেই কেমন ন্যাকা হয়ে গেলাম…’

‘কী করে হলি?’

‘কী জানি, হয়তো সবার ভেতরেই সব কিছু থাকে। এক একটা মানুষের ছোঁয়ায় এক একটা মুখ বেরিয়ে আসে। ভিতরের জিনিসটা একই থেকে যায়…’

‘ভিতরের জিনিস? কোন জিনিস?’

‘কারও সঙ্গে থাকতে চাওয়া। ছোট ছোট গল্প, একটুখানি হাসি, একটু কান্না। চারু…’ ওর দিকে ফিরে চায় মেয়েটা, ‘আমি সব সুখ ছেড়ে দিতে রাজি, শুধু সব দুঃখগুলো তোর সঙ্গে কাটাতে দে…’

‘কিন্তু আমি তো চলে যাব…’

ঈশানী নরম করে হাসে, ‘দুর্গাপুজোয় তোর সঙ্গে হাঁটতে পারব না। সরস্বতী পুজোয় প্রিন্সেপ ঘাটে প্রেম করতে পারব না। যে রাস্তাগুলো আমরা সাজিয়েছি, সেই সব রাস্তাগুলোয় অন্য লোকে হাঁটবে। শুধু তুই আর আমি থাকব না…’

‘তুই তো থাকবি, তুই একা একা আঁকতে পারবি না?’

ঈশানী ওর হাতটা আর একটু শক্ত করে ধরে, ‘জানি না। ওরা আমাদের সব আঁকা তুলে দেবে। হয়তো রয়েও যাবে কোথাও কোথাও। তার উপরে হাত বুলিয়ে যাব মাঝে মাঝে।’

চারু ওর কাঁধে একটা হাত রাখে, ‘আমি চলে গেলেও তোর কাছে থেকে যাব রুনু?’

‘তুই চলে গেলেও তুই যাবি না…’

অর্থহীন শব্দ খেলা করে ওদের মাঝে। আর কেউ নেই কোথাও। কলকাতার ফাঁকা গলি পুরোনো হিসেবের খাতা খুলে ভুল হয়ে যাওয়া কোনও অঙ্ক মেলায়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *