ত্রয়োদশ অধ্যায়
ক’দিন ধরেই মেয়ের আচরণে একটা অদ্ভুত খাপছাড়া ভাব লক্ষ করেছেন কমলিকা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরেই আগে বিছানায় পড়ে যেত। শরীর এত ক্লান্ত থাকত যে মায়ের সামনে এসে দু’মিনিট বসার সময় থাকত না।
কমলিকা আগে শখ করে মেয়ের জন্য এটা সেটা রান্নাবান্না করতেন। ক্লান্ত শরীরে ও কোনরকমে দুটো মুখে দিয়েই উপরে চলে যেত। কথা বিশেষ বলত না। ধীরে ধীরে কমলিকা নতুন কিছু রান্না করা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ওর নিজের খাওয়ার তেমন বাছবিচার নেই। দু’একটা সবজি ফুটিয়ে নিলেই হল।
ইদানীং মেয়েটা অফিস থেকে ফিরে উপর থেকে হাত মুখ ধুয়ে নিচের ঘরে চলে আসে। কমলিকার সঙ্গে বসে এটা সেটা নানান গল্প করে। কতরকম অদ্ভুত প্রশ্ন করে। মায়ের সারাদিনের কাজকর্মে যেন নতুন করে আগ্রহ জেগেছে ওর।
ছোট থেকে ঈশানীকে এরকম কখনো দেখেনি কমলিকা। সে বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের। একা একা থাকতেই ভালোবাসে। হঠাৎ করে হল কী মেয়েটার?
আজও সন্ধেবেলা রান্না চাপিয়েছিলেন কমলিকা। দরজার কাছে আওয়াজ হতে ঘুরে দেখলেন ঈশানী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মুখ ঘুরিয়ে বিরক্ত গলাতেই বললেন, ‘খিদে পেলে কিছু করার নেই। রান্না হতে একটু দেরি আছে…’
ঈশানী এগিয়ে আসে গ্যাসের কাছে, ‘ধুর, কীসব রান্না করো আজকাল। পরোটা খাব।’
শেষ কথাটার মধ্যে একটা আদুরে আবদার মিশে ছিল। কমলিকা অবাকই হন।
‘পরোটা খাবি! এখন?’
‘তাহলে পাঁজিটা নিয়ে এসে সময় দেখি একটা?’
কমলিকা কড়া থেকে মুখ না সরিয়েই বলেন, ‘এখন আবার পরোটা কে করবে? তাছাড়া ডাল ভাত পড়ে আছে…’
‘কাল সকালে খেয়ে নেব।’
কমলিকা এবার সত্যি বিরক্ত হয়। গ্যাসটা কমিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমি এখন আর অত খাটতে পারব না। মায়ের বয়স হয়েছে বুঝতে শেখ। খেলে খা, নাহলে খাস না।’
‘তোমাকে করতে বলেছে কে?’ মুখ বাঁকায় ঈশানী, ‘আমিই করে নেব। তোমাকে না দিয়ে খাব।’
দ্বিতীয়বার অবাক হন কমলিকা। ঈশানী আজ অবধি কোনওদিন যেচে পড়ে রান্না করতে চায়নি। হুট করে হল কী মেয়েটার?
‘তুই সত্যি রান্না করবি?’
‘তুমি শিখিয়ে দিলে।’
বিস্মিত হয়ে কৌটো থেকে ময়দা বের করেন কমলিকা। সেটা গামলায় ঢেলে তেল আর জল দিতে সেটা মাখতে শুরু করে ঈশানী। কমলিকা মেয়ের পিঠে একটা হাত রাখেন, ‘তোর কী হয়েছে বল তো? প্রেমে পড়েছিস নাকি?’
উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ঈশানী, ‘একটা মেয়ের…’
‘মেয়ের!’ ওর মুখের দিকে তাকান কমলিকা, ‘সে ভালোই করেছিস। এমনিতেও কোনও ছেলে বেশিদিন থাকতে পারবে না তোর সঙ্গে। তোর মনে আছে ছোটবেলায়…’ কথাটা বলেই হেসে থেমে যান কমলিকা, ‘ছোটবেলার কথা বলতে শুরু করলে আর তোকে রান্না শেখানো হবে না।’
‘তুমি বলো না, আমার ভালো লাগে শুনতে।’
কমলিকা আদুরে গলায় বলতে শুরু করেন, ‘ছোটবেলায় তুই মোটাসোটা ছিলি বলে বন্ধুরা রাগাত। তাদের মধ্যে কেউ তোকে বলেছিল মা মোটা হলেই নাকি মেয়ে মোটা হয়। তারপর তোর আমার উপর সে কী রাগ! আমি তখন একটু মোটাসোটাই ছিলাম। শেষে তোকে আমার বিয়ের আগের ছবি বের করে দেখালাম, যে আগে আমি রোগাই ছিলাম। তুই হবার পরে মোটা হয়ে গেছি। সেই প্রথম তুই বলেছিলি যে জীবনেও কোনওদিন বিয়ে করবি না…’
ঈশানী হাসে, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? সব খাওয়া ছেড়ে দিলি। এমনকি যে পরোটা খেতে এত ভালোবাসতিস সেটা দেখলেও লালা গিলে নিতিস। আমি ইচ্ছা করে তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে পরোটা বানাতাম।
‘শেষে একদিন আর লোভ সামলাতে পারলি না। আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একসঙ্গে ছ’টা পরোটা খেয়ে নিলি ওই বয়সে। খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলি সেদিন…’
কী যেন ভেবে একটু থমকে যান কমলিকা, মেয়ের দিক থেকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ‘তুই কবে বড় হয়ে গেলি জানিস রুনু?’
‘কবে?’
‘ছোটবেলায় নিজেকে খুব ভালোবাসতিস। কবে থেকে যেন আর বাসলি না। মানুষ যতদিন নিজেকে ভালোবাসতে পারে ততদিনই সে ছোট থাকে…’
ঈশানী কাঁধ ঝাঁকায়, ‘শুধু নিজের কথা ভাবলে তোমাদের খেয়াল রাখতাম কী করে? তোমরা জন্ম দিয়েছিলে, তোমরাই বড় করে দিয়েছ।’
মোক্ষম উত্তরটা কমলিকার ঠোঁটের কাছেই ঘুরঘুর করছিল, ‘বেশ, তাহলে এবার একটা মেয়েকেই না হয় বিয়ে কর। তার ঘাড়ে আমার দায়িত্ব দিয়ে আবার ছোট হয়ে যাবি।’
ঈশানীর হাত থেকে ময়দা ছাড়তে শুরু করেছে, সে ময়দার তালটাকে উলটে দিয়ে বলে, ‘দায়িত্ব অদ্ভুত জিনিস মা। কাউকে দেওয়া যায় না, শুধু নেওয়া যায়।’
মেয়ের মাথায় অনেকদিন পর হাত রাখেন কমলিকা, ‘তাহলে আগে নিজের দায়িত্ব নে।’
হুট করেই চোখ তোলে ঈশানী। চোখের মণিটা ভারি উজ্জ্বল দেখায় ওর। ঠোঁটের পাশে এক চিলতে হাসি খেলে যায়, ‘নিয়েছি, বিশ্বাস করো। তুমি শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না।’
কমলিকার আবারও অদ্ভুত লাগে। ঈশানী এমন কথা আগে কোনওদিন বলেনি। নিজের যত্ন নেওয়ার মেয়ে সে কোনওদিন না। চিরকালের অগোছালো, ভবঘুরে, খামখেয়ালি। বাপের মতো খেয়াল স্রোতে ভেসে যাওয়া উড়ন্ত পালকের মতো। হঠাৎ করে হলটা কী মেয়েটার?
ঈশানীর যখন ঘুম ভাঙে তখন রাত দশটা। আজ অফিস থেকে ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। বুঝতে পারে খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে। মুখের উপর হাত চালিয়ে একবার মাকে হাঁক পাড়তে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজায় একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুখ তুলে তাকায়।
মুখ তুলে দেখে চারু ঢুকছে ঘরে। হাতের প্লেটটা সে নামিয়ে রাখে ঈশানীর সামনে।
খাবারটা হাতে তুলে ঢাকনা খুলেই সে অবাক হয়ে যায়, উৎসাহী গলায় বলে, ‘মা পরোটা বানিয়েছে? আমার দুদিন ধরে খেতে ইচ্ছা করছিল…উফফফ…’
এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে মুখে দেয় ঈশানী। ওর চোখদুটো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে আসে, ‘এই জিনিসটা আমার মা যা বানায় না, কেউ করতে পারে না…’
‘তাই নাকি!’ চারু মুচকি হাসে।
‘তাই না? খেয়ে দেখ…’ জোর করে এক টুকরো পরোটা চারুর মুখে ঢুকিয়ে দেয় ঈশানী। সেটা চিবাতে চিবাতে চারু বলে, ‘ঠিকই আছে। কিন্তু ঠিক মায়ের মতো হয়নি।’
চোখদুটো গোল গোল করে হাত থেকে প্লেটটা নামিয়ে রাখে ঈশানী, ‘এই, এটা তুই বানিয়েছিস? তুই আমার জন্য রান্না শিখলি চারু?’
দুটো হাত দিয়ে ওর গাল টিপে দেয় ঈশানী, ‘তুই পুরো হাসব্যান্ড মেটিরিয়াল, দাঁড়া একটা ভালো মেয়ে দেখে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।’
‘তারপর তোকে পরোটা করে দেবে কে?’
ঈশানী হাঁটুর উপর মুখ রেখে ভাবুক গলায় বলে, ‘তোর বউ শালা আমাকে পরোটা খেতে দেবে না দেখছি। আমি তো ওকে তোর কলা খেতে দেব, ও পরোটা খেতে দেবে না কেন?’
মুখটা নিচের দিকে নেমে আসে চারুর। গাল চুলকে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘বলবি ছেলের কলা নয়, বাঁশ আছে…’
পরোটা মুখে আটকে বিষম খায় ঈশানী। খ্যাঁকখ্যাঁক করে কেশে ওঠে সজোরে। টেবিলের উপর থেকে জল তুলে ওর সামনে ধরে ওর পিঠে চাপড় মারে চারু।
ঈশানী কোনওরকমে দমক সামলে নিয়ে বলে, ‘দেখ শালা, খাবার সময় এইসব উল্টোপাল্টা হাসাবি না। দম আটকে মরব। আবার যদি হাসিয়েছিস…’
‘কী করবি হাসালে?’
দুহাতে ওর মুখ জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খায় ঈশানী। চারু এক ঝটকায় সরে আসে, ‘এই, আমার গালে তেল লাগাচ্ছিস কেন?’
‘তোর চিন্তার কী? পাল্টে দেবো…’ কথাটা বলেই মুখ তোলে ঈশানী, ‘আচ্ছা আমাকে কেমন লাগে তোর?’
চারু একটু ভাবে, কী যেন অনুভব করতে করতে বলে, ‘মদ খেয়ে মনে হয় লিভারটা গেছে। কিছু খেলেই হালকা ব্যথা হয়। কয়েকটা জায়গার লোম কিছুদিন কাটা হয়নি বলে খচখচ করছে, সেক্সুয়াল ডিজায়ারটা একটু বেশি, মাঝে মাঝেই কুটকুটানি বাড়ে, আর…’
হাঁই হাঁই করে ওকে বাধা দেয় ঈশানী, ‘এই চুপ কর শালা। এইসব কে বলতে বলেছে? জিগ্যেস করলাম আমি মানুষ হিসেবে কেমন?’
চারু ওর দিকে স্থির চোখ তুলে তাকায়, ‘তোকে ছাড়া আর কোনও মানুষকে চিনি না আমি।’
‘তো?’
‘চিনতে চাইও না…’ কথাটা বলে চারু হাসে। তারপর হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। ক্লান্ত মুখ থেকে ঘুম মুছে গিয়ে একটা আদুরে স্ফিত ভাব ফুটে উঠেছে সেখানে। সামনে এসে পড়া চুলগুলো নরম স্পর্শে ঘিরে আছে ওকে। ভারি মজা লাগে ওর।
হঠাৎই মুখ তুলে ওর দিকে তাকায় ঈশানী। করুণ মুখে বলে, ‘সত্যি চলে যাবি চারু? থেকে যেতে পারবি না?’
চারু মুখে কিছু বলে না। ওর পায়ের উপর মাথা রেখে শিশুর মতো কুঁকড়ে শুয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখে আবার পরোটা ছিঁড়ে ঢুকিয়ে নেয় ঈশানী, ‘রেখে দেব, দেখিস…ঠিক রেখে দেব…’
অন্ধকার রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে আসছিল ঈশানী। ওর আশেপাশে কেউ নেই। রাত ক’টা বাজে তা ও জানে না। দূর থেকে একটা হসপিটালের গেট দেখা যাচ্ছে। সমস্ত জায়গাটা ওষুধের গন্ধে ভরে আছে। হাঁটতে হাঁটতে কি তবে হসপিটালের সামনে এসে পড়ল? তাও এত রাতে? মাথার ভিতরে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে ওর। মাথাটা খামচে ধরে একবার।
হসপিটালের গেটে একটা দারোয়ান বসে স্থির ছবির মতো ঘুমাচ্ছে। একটা মাছি ভনভন করে উড়ে এসে বসছে তার দাড়িতে। এখান থেকে কী করে বাড়ি ফিরবে বুঝতে পারে না ও। কলকাতার রাস্তা তেমন একটা চেনে না।
সাত পাঁচ না ভেবেই ও এগিয়ে যেতে থাকে। মিটার পঞ্চাশেক হেঁটে গিয়ে শেষ হচ্ছে রাস্তাটা। যেখানে শেষ হচ্ছে তার ঠিক আগে একটা আবর্জনার স্তূপ। কারা যেন পুরোনো জিনিস ফেলে দিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কিছু নোংরা পুঁটলি। হসপিটালের আবর্জনার কাছে গেলেই গা গুলিয়ে ওঠে। তাও পায়ে পায়ে হেঁটে সেদিকে এগিয়ে গেল ঈশানী।
খানিকটা এগোতেই মনে হল স্তূপের ভেতর থেকে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওই নোংরা পুঁটলিগুলোর আড়ালে বসে কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মনের আগ্রহটা বেড়ে ওঠে ঈশানীর। হাঁটার গতি বেড়ে যায় ওর।
কান্নার শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় ঈশানী। একটু আগের ওষুধের গন্ধটা ভারি অসহ্য লাগে ওর। তাও নাকে চাপা দেয় না।
আর একটু এগোতেই একটা পুঁটুলির আড়ালে একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ের মুখ চোখে পড়ে ঈশানীর। অবাক চোখ তুলে তাকায় সে ঈশানীর দিকে।
গন্ধটা হুট করেই কমে যায়। ঈশানী অবাক হয়ে চেয়ে দেখে মেয়েটার হাতে একটা সাদা কাগজ। একটা ভাঙা পেন্সিল দিয়ে তার উপরে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করছে সে। আর আঁকতে আঁকতে অকারণেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এমন ফুটফুটে মিষ্টি একটা বাচ্চাকে রেখে দিয়ে গেল এখানে?
ঈশানী ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘নাম কী রে তোর?’
‘রুনু…’ মেয়েটা ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাক মুছে বলে।
‘তোকে কে রেখে গেছে এখানে?’
মেয়েটা ঠোঁট উল্টায়। তারপর কান্না থামিয়ে ওর দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? তোমার সঙ্গে?’
মেয়েটার চারপাশে তাকাতেই ঈশানীর চোখের মণি থমকে যায়। যে জিনিসগুলো পাশে পড়ে আছে সেগুলো ও চেনে। একটা উলের টুপি, একটা ভাঙা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি, একটা ফাঁকা পাখির খাঁচা…এগুলো সব ওর নিজের…
বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আবার নামিয়ে নেয় ঈশানী, অদ্ভুত নরম হাসি খেলে যায় ওর ঠোঁটে, বাচ্চাটার মাথায় হাত রাখে ও, ‘তোকে কোথায় নিয়ে যাই বল তো? তুই কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসিস?’
‘মাকে…’
ঈশানী পরিচিত হাসিটা হাসে, ‘আমিও। কিন্তু তোকে পেয়ে মা ভালো থাকবে না…কেউ ভালো থাকবে না। তুই যত বড় হবি, তত কষ্ট পাবে সবাই…’
‘তাহলে তোমার কাছে…’
ঈশানী হাসে, ‘আমারও যে থাকার জায়গা নেই রে…’
পাশে পড়ে থাকা একটা কাগজ তুলে নিয়ে ভারি আদুরে গলায় রুনু বলে, ‘আমাকে নিয়ে যাও, আমি ভাল্লুক আঁকতে পারি। তোমাকে এঁকে দেব।’
এগিয়ে ধরা ছবিটা হাতে নিয়ে পরম মমতায় তার উপরে হাত বোলায় ঈশানী। চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে ওর।
‘আমাকে তুমি নিয়ে যাবে না?’
‘আমি এখানে থাকলে তো মরে যাব একটু একটু করে…’
ঈশানী আর তাকায় না ওর দিকে। মেয়েটা তেমনই গোল গোল চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ঈশানী বুঝতে পারে পেছন থেকে মুছে যাচ্ছে ওর আঁকার খাতা, ওর পরিচিত মানুষ, ওর বাড়িতে পরা জামা, ওর জ্যামিতি বক্স, বিস্কুটের কৌটো, সেফটিপিন দিয়ে আঁটা স্কুলের ব্যাচ…
‘দিদি…’ পেছন থেকে শেষবারের মতো ডাকে মেয়েটা। ঈশানী থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু পেছন ফিরে তাকায় না। পেছন থেকে মিলিয়ে আসা গলা শোনা যায়, ‘তোমার আমাকে এখানে ফেলে যেতে কষ্ট হচ্ছে না দিদি? আমি কিন্তু আর তোমাকে ভাল্লুক এঁকে দেব না…’
শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ওর কানে। ঈশানী চোখ বন্ধ করে নেয়।
বিকেল থেকেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। অফিসে থাকলে বৃষ্টি পড়ছে কিনা বোঝা যায় না। বিকেলে বাইরে বেরোতেই বুকটা ধক করে ওঠে ঈশানীর। আজ কাকতাড়ুয়াটাকে শেডের তলায় ঢাকা দিয়ে রাখা হয়নি। একটা দুশ্চিন্তা দলা পাকিয়ে ওঠে ঈশানীর বুকের মাঝে। ছটফট করেই কেটে যায় বাকি সময়টা। বাড়ি ফিরে সবার আগে ছুটেছিল ছাদে। একটা চাদর দিয়ে কাকতাড়ুয়ার আগাপাস্তলা ঢেকে তবে শান্তি।
তারপর অনেকক্ষণ বসে চুপচাপ গল্প করেছে ওর সঙ্গে। মনের খেয়ালে কত রকম ছবি এঁকেছে ওর মুখে। সাজিয়েছে ইচ্ছামতো। ওর ভালো লাগে এই চারুকে সাজাতে। ও যখন কথা বলতে পারে না, ওর সঙ্গে কথা বলে যেতে ভালো লাগে। সব কথা মন খুলে বলা যায় ওকে।
আকাশের দিকে চেয়ে ঈশানী বুঝতে পারে আজ রাতে আর কোথাও বেরোনো হবে না। তাছাড়া মাঝেমধ্যে পাশের বাড়ির ছাদে লোকজন ওঠে। তারা কারোর সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখলে সন্দেহ করতে পারে।
ছাদে বসে কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশানী। ঘুমের মধ্যে মনে হয় স্বপ্নও দেখছিল একটা। সেটা দেখতে দেখতেই ভেঙে গেছে ঘুমটা। ঈশানী উঠে এসে কাকতাড়ুয়ার পাশে দাঁড়ায়। বৃষ্টির সঙ্গে বয়ে আসা হাওয়াতে ওর গায়ের চাদর সরে গেছে। সেটা আবার ভালো করে জড়িয়ে দেয় গায়ে। কালচে মাটির শরীরে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়।
‘সারাদিন কষ্ট হয় না আমাকে ছাড়া?’ নিজের মনেই বিড়বিড় করে জিগ্যেস করে, ‘কী করব বল, চাকরিটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু…’
ছাদের সিঁড়ির কাছ থেকে একটা পায়ের আওয়াজ পেয়ে ও মুখ ফিরিয়ে তাকায়। সরে এসে ভালো করে উঁকি মারতে দেখে মা উঠে এসেছে ছাদে। একটু অবাক হয় ঈশানী।
সময় তখন এগারোটার কাছাকাছি। এ সময় মায়ের ছাদে আসাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। বাতের ব্যথায় শেষ কয়েক মাসে মা হাতে গুনে দু-দিনবার ছাদে এসেছে।
সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ঈশানী বিরক্ত গলায় বলে, ‘একী! তুমি ঘুমাওনি এখনও? আমাকে যে বললে এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে?’
‘ঘুম আসছে না।’ সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে আসতে আসতে কমলিকা বলেন।
‘তাহলে অন্তত চিৎকার করে ডাকতে তো পারো!’
কমলিকা বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের হাঁটু চেপে ধরে বলেন, ‘তোকে ডাকতে আসিনি। নিজেই এসেছি ছাদে…’
আর একটু বেশি অবাক হয় ঈশানী, ‘তুমি হঠাৎ ছাদে…’
‘আজকাল বেশির ভাগ সময় তুই ছাদেই কাটাস। দেখতে এলাম কী করিস একা একা…আমাকে নিয়ে চিরকাল অভিযোগ ছিল তোর, মা সবকিছুতে ফোঁপরদালালি করে…’
কমলিকার ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। টিপটিপে বৃষ্টিতে ভিজলে আর দেখতে হবে না। ঈশানী ধরে ধরে মাকে এনে শেডের তলার বেঞ্চে বসায়। হাত দিয়ে পরিষ্কার করে দেয় বেঞ্চটা। নিজে দাঁড়ায় পাশে। ওর আর কাকতাড়ুয়ার মাঝে বসেছেন।
কাকতাড়ুয়ার দিকে একবার তাকান কমলিকা, ‘হঠাৎ এই অনামুখোটার গায়ে চাদর চাপিয়েছিস কেন?’
ঈশানী একটা বাঁকা হাসি হাসে, ‘সারাজীবন তো কারো যত্ন নিতে পারলাম না, অগত্যা কাকতাড়ুয়াটাকে দিয়েই একটু টেস্ট করে দেখি পারি কিনা…’
‘ঠিক বয়সে বিয়ে না হলে মেয়েদের মাথায় এমন অনেক খেয়াল চাপে…’ কালো হাঁড়িটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কমলিকা। হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। ছাদে এসে তো পড়েছেন, নামবেন কীকরে নিজেও জানেন না। তার উপরে এই টিপটিপে শীতের বৃষ্টি।
ঈশানী বুঝতে পারে আবার ছলেবলে বিয়ের প্রসঙ্গ আনতে চাইছে মা। বুলিমাসি মনে হয় আবার নতুন সম্বন্ধ এনেছে। সে বিরক্তিকর প্রসঙ্গটা বদলে ফেলতেই বলে, ‘কাল আমি রাতে বাড়ি থাকব না…’
‘কোথায় যাবি?’
‘অভির কেসটার ব্যাপারে মুর্শিদাবাদে যেতে হবে, থানা থেকে ডেকেছে। গেলে ফেরাটা চাপ হয়ে যাবে।’
‘একা যাবি?’
‘না, সঙ্গে অফিসের একটা বান্ধবি যাবে।’
‘বেশ, যাস…’ নিঃস্পৃহ গলায় কথাটা বলে দূরের দিকে চেয়ে তেমনই ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকেন কমলিকা।
‘ছোটবেলায় তিনজনেই ছাদে আসতাম, মনে আছে তোমার মা?’ ঈশানী বৃষ্টির ধারার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে।
‘তুমি, আমি আর বাবা। আমি বাবার কোল থেকে নামতেই চাইতাম না…’
কমলিকা ছাদের পাঁচিলে হেলান দেন, পায়ে হাত ঘষতে ঘষতে বলেন, ‘ছোটবেলায় তুই ওইরকম ছিলিস। কারো কোলে উঠতে পারলে আর নামতে চাইতিস না।’
ঈশানী হাসে, ‘তাই আর কেউ কোলে নিতেই চায়নি কোনওদিন। তাই না মা?’
‘না না, তা কেন? তোর বাবা অনেক বড় বয়স অবধি কোলে নিয়েছে তোকে। তারপর তুই বড় হয়ে গেলি। তখনও জেদ করতিস। কিন্তু বাবার গায়ে আর জোর ছিল না। যতদিন পেরেছে কোলে করে ছাদে নিয়ে এসেছে…’ কমলিকার গলা শান্ত হয়ে আসে, ‘ওর জীবনের ওই একটাই শখ ছিল। সন্ধ্যা হলেই মেয়েকে ছাদে নিয়ে বসে থাকা আর হাবিজাবি গল্প শোনানো…’
‘তোমার কি হিংসা হয়? তোমাকে নিয়ে আসত না বলে?’
‘নাহ, আফসোস হয়। পয়সাকড়ি রোজগার করার শখটা যদি থাকত আজ আমাদের এই অবস্থা হত না।’
কয়েক সেকেন্ড থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী, তারপর জিগ্যেস করে, ‘তোমার আফসোস হয় না, বাবার মতো একটা লোককে বিয়ে করার জন্য?’
ঘাড় নাড়ায় কমলিকা, ‘হবে না কেন? রোজ হয়। কলকাতা শহরের বড়বাড়ির মেয়ে ছিলাম। এখন এই সাতভূতের বাড়িতে একা একা পড়ে আছি…’
ঈশানীর মুখে বাঁকা হাসিটা খেলে যায়। উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘বাবাকে শেষবার যখন নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তুমি বাবার মুখ দেখতে চাওনি। শুধু একবার গলা তুলে বলেছিলে—আমাকেও তাড়াতাড়ি নিয়ে যেও। তখন খুব কষ্ট হয়েছিল, এখন ভাবলে মাঝে মাঝে খুব হিংসা হয় জানো…’
‘কীসের হিংসা?’
‘মনে হয়, আমি কাউকে এমন করে ভালোবাসতে পারব না কোনওদিন।’
‘হিংসা তো আমারও হয় তোকে…’
‘আমাকে! কীসের জন্য?’
‘তোর বাবার মরা মুখটা দেখতে পেরেছিলি। চুল্লিতে ঢোকানোর আগে একবার পা’টা ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিলি।’
‘কী লাভ হয়েছে তাতে? পা হাত সব ঠান্ডা হয়ে ছিল…’
‘লাভ লোকসান জানি না…তিরিশ বছর আগে কথা দিয়েছিলাম জীবনে সব অবস্থায় থাকব। পার্টি হেরে গিয়ে আবার নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও থাকব, যা দুপয়সার চাকরি করে সংসার চলত সেটা চলে গেলেও থাকব, অসুস্থ হয়ে হেগেমুতে রেখে দিলেও থাকব। সবেতেই থাকলাম, শুধু যে শরীরটাকে ছেড়ে রেখে গেল সেটাকে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়ার সময় থাকতে পারলাম না…’
ঈশানী চুপ করে থাকে। টপটপ বৃষ্টির জলের আওয়াজ আসছে শেডের উপর থেকে। ঠান্ডা হওয়ার ঝাপটা এসে ওদের ঘিরে বইছে মাঝে মাঝে, তারপর আবার হারিয়ে যাচ্ছে দূরে।
‘তবে এখন আর এটা ভেবে আফসোস হয় না…’
‘কেন?’
‘ওই যে, তুই ছিলিস বাবার মুখাগ্নির সময়। এমন একটা মেয়ে তৈরি করে দিয়েছি তোর বাবাকে। ওইটাই আমার থাকা…’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ঈশানী। তারপর হুট করে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে, ‘তোমার আমার উপর ভীষণ রাগ, তাই না মা?’
উপরে নিচে মাথা নাড়ান কমলিকা, ‘আজকের নয়। অনেক পুরোনো রাগ। ছোট থেকে তুই একদম তোর বাবার মতো। যেদিন হসপিটালে বেডে প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে আমার মেয়ে হয়েছে, খুব খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে একদম আমার মতো করে বড় করব। আমি যা যা পারিনি তুই পারবি, আমি যা যা বুঝিনি তুই বুঝবি। কিন্তু তুই হলি বাবার মতো। কবে যেন আমার থেকে তোকে কেড়ে নিল…তুই আমার থেকে বাবাকে বেশি ভালোবাসলি…’
ঈশানী মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দেয়, ‘তোমরা কোনওদিন আমাকে বুঝতে দাওনি তোমরা দুটো আলাদা টিমে খেলছ। তাই আমাকে কোনওদিন দল বেছে নিতে হয়নি।’
কমলিকা নিজের মনেই হাসে, ‘তোর বাবা দেড়হাজার টাকা মাইনে পেত। আমাদের আলাদা টিমে খেলার উপায় ছিল না রুনু…’
বৃষ্টির বেগ বেড়েছে এতক্ষণে। দূরের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে যায় তাতে। পাশের বাড়ির ছাদ, টেলিফোনের টাওয়ার, অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গিয়ে শুধু জলের চাদর জেগে থাকে ওদের চোখের সামনে।
হুট করেই ঈশানীর হাতটা চেপে ধরেন কমলিকা, ‘তুই আমাকে ক্ষমা করে দে রুনু…’
ঈশানী অস্বস্তিতে পড়ে। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চায় সে, ‘আমি! ক্ষমা! কী বলছ, কিছুই বুঝছি না…’
‘তুই এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি, এত শক্ত হয়ে গেলি, আমি কোনওদিন চেষ্টাও করে দেখলাম না—তোকে এখনও কোলে নেওয়া যায় কিনা…এমন করে চোখের জল লুকাতে শিখে গেলি যে ভেবেই দেখলাম না এখনও মুছিয়ে দিতে হয় কিনা…আমি তোর ভালো মা হতে পারিনি রুনু…তুই আমাকে ক্ষমা করে দে…’
মায়ের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নেয় ঈশানী। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ওর গলাতেও বাষ্প এসে জমা হয়। বৃষ্টির শব্দে মিশে কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ ছড়িয়ে পড়ে শেডের তলার জমাট হাওয়ায়, ‘আমি তো শুধু এটুকু বোঝাতে চেয়েছিলাম মা, যে আমি আর তুমি দুটো ভুল মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমাদের আর কেউ নেই…তুমি শুধু ভুলটাই দেখে গেলে, কখনও তোমার কখনও আমার…’
দুহাতে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয় ঈশানী, তারপর আবার শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। কমলিকার কান্না ভেজা গলা শোনা যায়, ‘বুলি আবার একটা ছেলের কথা বলছিল। আমি দূর দূর করে ভাগিয়ে দিয়েছি।’
ঈশানী হেসে ফেলে। এক ফাঁকে নিজের চোখের জলটা মুছে নেয়। মনটা হালকা হয়ে যায় ওর।
‘তোর কাউকে ভালো লেগেছে, নারে রুনু?’ হুট করে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করেন কমলিকা।
আচমকা প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায় ঈশানী, ‘তোমাকে কে বলেছে এসব?’
‘তোর অনেক কথাই জানি আমি…’
বুকের ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় ঈশানীর। থমথমে গলায় সে বলে, ‘যেমন?’
‘যেমন মাঝে মাঝেই গভীর রাতে তুই আমার পাশে শুয়ে পড়িস। মাথায় হাত দিয়ে দেখিস জ্বর এসেছে কিনা, শরীর খারাপ হয়েছে কিনা। তারপর বিড়বিড় করে কত কথা বলিস, কত গল্প করিস, ভাবিস মা ঘুমিয়ে পড়েছে…’
‘আমি?’ ঈশানী অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড সেভাবে তাকিয়ে থেকেই ওর দৃষ্টি ঘুরে যায় কাকতাড়ুয়াটার দিকে।
‘তুই পাশে এসে শুলে আমার ভারি নিশ্চিন্ত লাগে…তোর বকবক শুনতে শুনতেই কখন যেন ঘুম এসে যায়…’
ছাদের মেঝেতে জল জমেছে। বৃষ্টির ফোঁটা তার উপর পড়ে ছিটকে এসে লাগছে হাঁড়ির মুখে। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয় ঈশানী, নরম গলাতেই বলে, ‘আচ্ছা মা, যদি কোনওদিন জানতে পারো আমি এর কিছুই ছিলাম না। তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, যত্ন নেওয়া, সঙ্গ দেওয়া, এসবের কিছুই আমি করিনি, আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাহলে আমাকে কম ভালোবাসবে?’
কমলিকা মেয়ের কোলে মাথা রেখে প্রায় শুয়ে পড়েন, ‘তোদের বয়সের ছেলেমেয়েরা এইটাই ভুল করিস। তোরা জানিস না, বাবা-মা ছেলেমেয়েদের একবারই ভালোবাসে। যখন তাদের প্রথম দেখে, তখন। তারপর বড় হতে হতে কেউ ভালো হয়, কেউ খারাপ, কেউ মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করে, কেউ বখে যায়, তার সঙ্গে ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নেই। পৃথিবীর অন্য সব সম্পর্কে মানুষকে পরীক্ষা দিতে হয়। বারবার পাশ করতে হয়। তার নম্বর বাড়ে কমে। শুধু মা-বাবার কাছে ছেলেমেয়েরা শত চেয়েও অন্য কিছু হতে পারে না…’
ঈশানীর মাথাটা কমলিকার গালের উপর নেমে আসে। চোখের জলটা ঢেকে ফেলে ও।
‘আমার খুব আফসোস হয়, জানো মা? আমি বাবার জন্য কিছু করতে পারিনি। জানি না জীবনে কত টাকা-পয়সা রোজগার করব, কী হবে না হবে। কিন্তু আর যাই করি না কেন আমি আর আমার বাবাকে বাটিকের পাঞ্জাবি কিনে দিতে পারব না, আরও কয়েকটা কেমো ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করতে পারব না, বাবার পার্টিকে আবার ক্ষমতায় এনে দেখিয়ে দিতে পারব না। তুমি আমাকে আর একটু আগে থেকে কেন ভয় দেখালে না মা?’
কমলিকার শরীর জুড়ে ক্লান্তি নামে। চোখ বুজে আসতে থাকে তার, তার মধ্যেই বলেন, ‘আমি ওই লোকটার সঙ্গে তিরিশ বছর ঘর করেছি। তোর থেকে ঢের ভালো চিনি ওকে। রোজ সকালে উঠে আর ঘুমাতে যাওয়ার সময় তোর হাসি মুখটা দেখতে পেলে ওসব আদর্শ ফাদর্স জলের দরে বিকিয়ে দিত…’
ঈশানী আর কিছু বলে না। ওদের ঠিক পাশে দুটো হাত দুদিকে ছড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কাকতাড়ুয়াটা। যেন রক্ষা করে দুটো ভাঙাচোরা মানুষকে। বৃষ্টির শব্দ বেড়ে ওঠে…