কাকতাড়ুয়া – ১২

দ্বাদশ অধ্যায়

খবরের কাগজের অফিসে একগাদা কাগজপত্র নিয়ে ওলটপালট করছিলেন রানা সরকার। আর একটু হলেই মাথাটা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে তার। পরশু রবিবার, কাগজের স্পেশাল সেকশনে একটা ফিচার যাওয়ার কথা। যে সাংবাদিককে সেটা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিনি দস্তুরমতো ছড়িয়েছেন। এখন হয় তাকে নিজেকেই কিছু লিখতে হবে নাহলে এমন কোনও লোক জোগাড় করতে হবে যে একদিনের মধ্যে ব্যাপারটা নামিয়ে দিতে পারবে।

ভাবনাটা মাথায় আসতেই থমকালেন রানা সরকার। এই ধরনের রবিবাসরীয় ফিচার লেখার আদর্শ লোক একজন ছিল বটে, কিন্তু সপ্তাখানেক ধরে লোকটা ওর ফোন রিসিভ করছে না। উপায়ন্তর না দেখে একদিন তার বাড়িতেই ফোন করেছিলেন সরকার। তার স্ত্রী জানিয়েছেন তার হাসব্যান্ড নাকি কী একটা ব্যাপার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। সেটা থেকে যতদিন না কনক্লুসিভ কিছু পাচ্ছেন ততদিন কারও সঙ্গে তিনি কথা বলবেন না।

‘ধুর শালা! আমার হয়েছে যত জ্বালা…’ কথাটা বলে টেবিলে একটা চাপড় মারলেন সরকার। টেবিলটাকেই দু’ঘা দিয়ে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন। নিজে কিছু লিখতে গেলে আগে নার্ভকে আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে।

টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজের জন্যই যেন অন্য একটা শব্দ অপেক্ষা করছিল। দরজায় নক হতেই মুখ তুলে তাকালেন সরকার। খবরের কাগজের অফিসে সকালের দিকটায় চিৎকার চেঁচামেচি লেগেই থাকে। প্রতি মিনিটে কারও না কারও ফোন বাজছে, কেউ না কেউ কফির জন্যও চিৎকার করছে, তার মধ্যে হালকা টোকার শব্দ সহজে শোনা যায় না। কিন্তু এই নকটা আলাদা করে চেনেন সরকার। গলা তুলে হাঁক পাড়লেন, ‘শালা কী ভাগ্য আমার…ভিতরে এসো।’

ঘরের দরজা খুলে যে মুখটা উঁকি দিল সেটা আজ দিনসাতেক ধরে দেখার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন তিনি। এতদিনে গবেষণার গভীর তমসাজাল থেকে মুখ তুলে চেয়েছেন তিনি।

সাংবাদিক মহলে অনির্বাণ ঘোষালের নাম এবং দুর্নাম দুটোই পাশাপাশি হাঁটে। একবার লোকটার মাথায় কিছু ঢুকলে তার গভীরে ঢুকে ফর্দাফাই না করে ফেললে তার শান্তি হয় না। সে খুনের মামলা হোক, টলিউডে কালো টাকার খেলা হোক, কিংবা ঠাকুরপুকুরে সেলিব্রিটি জ্যোতিষীর বাটপাড়িই হোক। এসব করতে গিয়ে কম বিপদে পড়েননি। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার বান্দা অনির্বাণ ঘোষাল নন। একসময় অ্যাক্টিভ রাজনীতি করতেন। পরে ব্যক্তিগত কারণে সরে দাঁড়ান। তবে এখনও রাজনৈতিক মহলে ভয়ঙ্কর প্রভাব আছে বলে শোনা যায়।

‘শালা, এক সপ্তাহ যেভাবে তোমার বউয়ের থেকে তোমার খোঁজ নিচ্ছি তাতে মহিলা নির্ঘাত আমাকে গে-টে কিছু একটা ভেবে বসে আছেন।’ রানা সরকার বিরক্ত গলায় বলেন।

অনির্বাণ সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলেন, ‘গে কিনা জানি না, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আমার বউ সন্দেহ করছে আমি আর একটা প্রেম করছি।’

‘সে কী! কেন?’

‘সারাদিন মুখে ফোন গুঁজে বসে আছি বলে।’

ঠোঁট উল্টান রানা সরকার, ‘তা একটা আধবুড়ো দামড়া সাংবাদিক সারাদিন মোবাইল নিয়ে খুটখুট করলে সন্দেহ হবার কথা বইকি…কিন্তু তোমার বউ যে বলল তুমি নাকি কাজ করছ?’

টেবিলের উপর রাখা বাটি থেকে একটা ক্যান্ডি তুলে মুখে দিল অনির্বাণ, সেটা চুষতে চুষতে বললেন, ‘আপনি কোন পাথরের তলায় ঘর বানিয়ে থাকেন জানি না, কিন্তু আজকাল আমাদের বেশিরভাগ কাজ ফোনেই হয়ে যায়। তাতে সুবিধাও বেশি, সময়ও বেঁচে যায়…’

‘তা, কী এমন কাজ করছিলে তুমি?’

‘সিম্পল। ইন্সটাগ্রামে রিলস দেখছিলাম…’

সরকারের চোখ কপালে উঠে যায়, আবার টেবিলের থাবড়া মারবার উপক্রম করে বলেন, ‘তুমি এক সপ্তা বাড়ি বসে রিলস দেখছিলে?’

‘উঁহু…’ মাথা নাড়ায় অনির্বাণ, ‘শুধু ইন্সটা কেন? ফেসবুকেও দেখেছি। বেশ ভালো কন্টেন্ট। তারপর ধরুন ইউটিউব শর্টস…’

একটা পায়ের উপর অন্য পা তুলে বসেন অনির্বাণ, ‘দেখুন, সত্যিকারের পেজ থ্রি সাংবাদিকের কাজ না, অনেকটা অন্যের হেগো পোঁদ ছুঁচিয়ে দেওয়ার মতো। মানে মূল ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে, আপনাকে শুধু সব ঘটে যাওয়ার পর বাকিটুকু আঁচিয়ে নিয়ে ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে হবে। আগে মানুষ খবরের কাগজে হাগত, গল্পের বইতে হাগত, সিনেমা থিয়েটারে হাগত, এখন এই ইন্সটা, আর ফেসবুকে হাগে…’

‘সকাল সকাল যা সব শোনাচ্ছ লাঞ্চটা পেটে ঢুকলে হয়। তা ওসবে খুঁজে পেলেটা কী?’

‘স্কেয়ারক্রো চ্যালেঞ্জ।’ হাতের ফাইলটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে ফিতেটা খুলে দিলেন অনির্বাণ। তারপর ক্যান্ডিটা চুষতে চুষতে আচমকাই চিবিয়ে ফেলে বললেন, ‘এই মালটাই এখন ট্রেন্ডিং-এ যাচ্ছে…’

‘সেটা আবার কী?’

অনির্বাণ বিরক্ত হয়ে মুখ তোলেন, ‘আপনারও তো ইন্সটা আছে। সেখানে কি শুধু নাইটি পরা বউদিদের নাচ দেখেন?’

একঢোঁক জল খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নেন অনির্বাণ, একবার গলা চুলকে নিয়ে বলেন, ‘দিনকতক হল কলকাতার ছেলেমেয়েরা এক বিচিত্র খেয়ালে মেতেছে। রাস্তাঘাটে, লোকের বাড়ির দেওয়ালে, নর্থ কলকাতার সরু গলির মধ্যে হাতের সামনে চক, ইট কিংবা বাড়ি থেকে আনা রংতুলি যা পাচ্ছে তাই দিয়ে একটা বেখাপ্পা কাকতাড়ুয়া আঁকছে।’

‘যাহ্ শালা! কাকতাড়ুয়া কেন?’

‘অসুবিধাটা কোথায়? আর কতদিন লোকে শহরের দেওয়ালে কাস্তে হাতুড়ি, ঘাস আর পদ্ম দেখবে বলুন তো? চোখের আরাম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে?’

‘বেশ, তারপর?’

‘তারপর সেই কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে একটা সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে হ্যাসট্যাগ দিচ্ছে—স্কেয়ারক্রো চ্যালেঞ্জ। একজন অন্যজনকে চ্যালেঞ্জ ট্যাগ করে দিচ্ছে। ব্যাস চেইন রিঅ্যাকশনের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা…’

‘কিন্তু এতে লাভ কী হচ্ছে এদের?’

হাত ওলটান অনির্বাণ, ‘আপাতভাবে খুব ইনোসেন্ট একটা মজা, বা হুজুগও বলতে পারেন। কিন্তু এদের একটা নেতা গোছের আছে। আমার যতদূর মনে হয় তার কিছু অ্যাজেন্ডা আছে…’ কেটে কেটে সময়ে নিয়ে বলতে থাকেন অনির্বাণ, ‘ব্যাপারটা শুরু হয় সপ্তাখানেক আগে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দেওয়ালে কারা যেন ঘটা করে বিশাল কয়েকটা কার্টুন এঁকে রেখে যায়। তারপর কলকাতার আরও কয়েকটা নাম করা জায়গায়। সেই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। আমার মনে হয় বাজনার নেপথ্যের এই মূল গায়েন বাকিদের মতো এতটা ইনোসেন্ট নয়…তার খোঁজেই…’

এতক্ষণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সরকার। মাথা চুলকে বললেন, ‘তুমি কি এই নিয়ে ফিচারটা লিখবে ভাবছ?’

‘আমি লিখব ভাবছি না, লিখছি। আপনি ছাপবেন কিনা সেটা ভেবে দেখুন…’

‘তুমি খেপেছ নাকি?’ ধমকে ওঠেন সরকার, ‘এটা রবিবার লোকে লুচি কষা মাংস খেতে খেতে পড়বে?’

জিভ দিয়ে চুকচুক করে একটা আওয়াজ করেন অনির্বাণ, ‘বাঙালি লুচির সঙ্গে মাংস নয়, আলুর দমটা প্রেফার করে। কষা মাংসটা গরম ভাতের সঙ্গে, তাও আবার কলাপাতার থালায়। এই জন্যেই বলি আপনারা বাঙালির পালস বোঝেন না…যার সঙ্গে ক্রিকেট, রাজনীতি আর সেলেবদের কেচ্ছা জড়িয়ে নেই তার কোনও কিছুতেই পাত্তা দেবেন না…’

‘তা বলে রাস্তাঘাটে লোকে কাকতাড়ুয়া আঁকছে, তারপর সেলফি তুলে পোস্ট করছে, এটা খবর? এটা ছাপিয়ে আমরা আরও এনকারেজ করব? এরপর লোকে রেল স্টেশনে বিকিনি পরে ভোজপুরি গানে নাচলেও সেটাও এনকারেজ করতে হবে…’

হাত তুলে টেবিলের উপরে আবার চাপড় মারতে যাচ্ছিলেন সরকার। তার আগেই অনির্বাণের বাজখাঁই গলায় টেবিল কেঁপে ওঠে, ‘আপনার লজ্জা করে না স্যার এই কথাটা বলতে?’ টেবিল থেকে উঠে পড়ে অনির্বাণ, ‘লজ্জা করে না? আচ্ছা রেলস্টেশনে নাচবে না। কোথায় নাচবে? আপনার বাড়ির ছাদে? কোথায় নেচে দুটো পয়সা রোজগারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন আপনারা? যে পয়সা দিয়ে আজকের ভাতটা খেয়ে সে কাল আবার নাচতে যাবে?

 ‘ধরুন আমি শুধু ছবি আঁকতে পারি। আমি কোথায় ছবি আঁকলে ফ্ল্যাটভাড়াটুকু জোগাড় করতে পারব? কোথায় অভিনয় করলে মায়ের রোজের ওষুধটুকু কিনতে পারব?…নেই। কোথাও নেই। আমি আমার প্যাশন ফলো করলে শাস্তি হিসেবে আমার না খেয়ে মরার সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন আপনারা। আর কারা দেয় সেই শাস্তিটা জানেন? কোনও মন্ত্রী নয়, আমলা নয়, ভারতমাতা নয়, সংবিধান নয়—যারা এই দেশটা চালায়—কর্পোরেট পুঁজিপতিরা। তারা গান গাওয়া, ছবি আঁকা, অভিনয় জানা লোক নিয়ে কী করবে? তাদের ইয়েসম্যান দরকার, আঙুলের তলায় ট্যালট্যালে হতে পারা গাধার বাচ্চা দরকার…’

অনির্বাণের মুখ লাল হয়ে এসেছে, শব্দগুলো গনগনে আগুনের মতো বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে, ‘শুধু ভিক্টরিয়াটা সম্পদ? হাওড়া ব্রিজটা সম্পদ? আর এই যে এতগুলো শিল্পীকে, তাদের সম্ভবনাকে রোজ জেনে বুঝে খুন করছেন আপনারা, তারা সম্পদ নয়? মিস্টার সরকার, যে সমাজ ঘুমিয়ে থাকে তাকে ঠেলা দিয়ে জাগানো যায়। কিন্তু যে সমাজ টাকার গন্ধ আর কর্পোরেটের খুড়োর কল দেখে ঘুমানোর ভান করছে, তাকে জাগাতে গেলে তার মোক্ষম জায়গাটা টিপে ধরতে হয়…’

আবার এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে পড়ে অনির্বাণ, ‘আপনার কী মনে হয়? লোকে বিকিনি দেখার জন্য ট্রেনে নাচ দেখে? আরে নেটে সার্চ করলে কয়েক লাখ বিকিনি আর কয়েক হাজার পানু সাইট আসে। যে মিউজিশিয়ান হতে চাওয়া ছেলেটা আটঘণ্টা অফিস করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে, সে একজন আর্টিস্টকে এই নরখাদক সিস্টেমটার মুখে ছরছর করে মুতে দিতে দেখতে চায়…’

ঘরের উত্তাপ বেড়ে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকেন সরকার। নখ খোঁটেন। অকারণেই একবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন খোঁজেন, তারপর ঠান্ডা গলায় বলেন, ‘আহা, তুমি এত চটছ কেন? বসো, জল খাও…’

আর একটা ক্যান্ডি তুলে মুখে পোরেন অনির্বাণ, শান্ত গলায় বলেন, ‘আমার কাছে জনবার্তার কন্ট্র্যাক্ট আছে, আপনি না চাইলে…’

‘আমি চাই না কখন বললাম?’ হাত নাড়ান সরকার, ‘কিন্তু এগুলো সবই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তুমি আলাদা করে কী লিখতে পারবে? আই মিন, এইসব সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে মরাল পুলিশিং করা তো নিউজ পেপারের কাজ নয়।’

‘আমি একটা ইন্টারভিউ করতে চাই।’

‘কার?’

‘এই মেইন আর্টগুলো যে বা যারা করছে তার। যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করতে হবে।’

পরের কথাটা বলতে একটু সময় লাগল সরকারের, ‘আচ্ছা, ধরেও নিলাম তুমি তাদের খুঁজে বের করলে। তারা ইন্টারভিউ দিতে চাইবে কেন? মানে ধরো, ওরা যে কাজটা করছে সেটা তো লিগ্যাল নয়। পুলিশ ধরলে…’

মুখ তোলেন অনির্বাণ, ‘দেশের যেখানেই যান বেশিরভাগ স্থাপত্যের গায়ে আপনি ঝুনু আই লাভ ইউ বা রাহুল লাভস প্রিয়া দেখতে পাবেন। আইপিসির চারশো পঁচিশ বলছে সরকারি সম্পত্তি কিংবা হিস্টরিকাল হেরিটেজের কোনরকম ক্ষতি করলে তার বদলে পাঁচমাস জেল হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে আদৌও সম্পত্তির কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। দেওয়ালে করা রং সামান্য ধুলেই উঠে যাবে। পুলিশ বড়জোর একটু চমক ধমক দিতে পারবে, ফারদার আঁকাটা বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু যেহেতু ওরা কোনও ক্রাইম করেনি, তাই ওরা চাইলে ওদের আইডেন্টিটি রিভিল করতে আমি বাধ্য থাকব না…’

‘বেশ, তাহলে তো অসুবিধার কিছু নেই। কিন্তু এদের খুঁজে বের করবে কী করে?’

এইবার ফাইল খুলে কয়েকটা ছবি বের করে সামনে রাখেন অনির্বাণ। কী যেন খুঁজতে খুঁজতে বলেন, ‘খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগবে, তবে তাদের সম্ভব্য ঠিকানাটা কী সেটা মনে হয় আন্দাজ করতে পেরেছি।’

‘কী করে?’

কয়েকটা ফটোগ্রাফ রানা সরকারের সামনে ফেলে দেয় অনির্বাণ, তারপর বলে, ‘আপনি খেয়াল করলে দেখবেন স্যার মূল কার্টুনগুলো যারা এঁকেছে তাদের আঁকাগুলো প্রায় গোটা কলকাতা জুড়ে ছড়ানো, এবং বলাই বাহুল্য কোনও পার্টিকুলার অর্ডারে নয়। খাপছাড়াভাবে। মঙ্গলবার ঢাকুরিয়া হলে বুধবার বরানগর। সেটা অবশ্য ইচ্ছা করেই করা। যাতে এইসবের উৎসস্থল খুঁজে বের করা না যায়। কিন্তু আর্টিস্টের ট্রেডমার্ক তার আর্টে থেকে যায়। সেটা চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। ছবিগুলোর দিকে ভালো করে তাকালেই শিল্পীকে পড়ে ফেলা যায়…’

‘মানে?’

‘ভালো করে দেখুন। এখানে যে মেল ফিগারটা, আই মিন কাকতাড়ুয়া আঁকা হয়েছে সেগুলো ক্লিয়ার লাইন ড্রয়িং। সব ছবিতে তার চোখ, মুখ, নাক, গলার একটা সিঙ্ক্রোনিসিটি আছে। কিন্তু মহিলা চরিত্রটার এক একটা ছবিতে এক একরকম প্রোপরশন। মানুষ যাকে চোখের সামনে দেখে তাকে নিয়ে কনফিউজড থাকে না। কিন্তু যাকে কেবল আয়নায় বা ছবিতে দেখতে পায় তার আকার আকৃতি নিয়ে সঠিক ধারণা করতে পারে না। ফলে সেটা ছবিতে ছবিতে বদলে যায়। এবার দেখুন, প্রায় সব ছবিতে কাকতাড়ুয়া আর মেয়েটার মধ্যে মেয়েটা দর্শকদের থেকে একটু হলেও কাছে আছে। অর্থাৎ শিল্পীর চোখে সে পারস্পেক্টিভ ক্যারেক্টার…’

‘মানে বলতে চাইছ, যে ছবিটা আঁকছে সে মেয়ে? কিন্তু এমনও তো হতে পারে আসল ছবিটা অন্য কেউ ছোট করে কাগজে এঁকে দিচ্ছে। সেটা দেখে দেখে এ আঁকছে…’

‘উঁহু, সেটা আমার মনে হয় না।’

‘কী করে?’

‘দেখুন, শিল্পী দু’ধরনের হয়, এক কপি শিল্পী আর দুই ওরিজিনাল শিল্পী। আমাদের এখানে যারা কার্টুন এঁকেছে তাদের সবার ধরন খুব কাছাকাছি। এর কারণ আমরা ছোট থেকে মোট তিনটে কার্টুন পড়ে বড় হয়েছি। টিনটিন, এস্টেরিক্স আর নারায়ণ দেবনাথের বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা কয়েকটা চরিত্র। এরা সবাই পরিষ্কার লাইন টেনে চরিত্র আঁকতেন। ভিসুয়ালি খুব কমপ্লেক্স ছিল না। ফলে আমরা কার্টুন বানাতে গেলে এদের প্রভাব ছাড়িয়ে বাইরে বেরোনো মুশকিল। কিন্তু এই আর্টিস্টের আঁকার ধরন খেয়াল করলে বুঝবেন এর নিজস্ব ঘরানা আছে। এ সহজ কার্টুনই আঁকছে, কিন্তু লাইনগুলো ততটা ক্লিয়ার নয়। যেন বাস্তব থেকেই নেওয়া, সহজ ঢঙেই মুড়ে দেওয়া, কিন্তু সহজ কথা বলার তাগিদ নেই…এই শিল্পীর যা মুড তাতে এর পক্ষে কপি করা সম্ভব নয়…’

‘বেশ, কিন্তু আমরা কলকাতা জুড়ে কার্টুনিস্ট মেয়ে খুঁজে বের করব নাকি? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে তো।’

হেসে দুদিকে মাথা নাড়েন অনির্বাণ, ‘মনে হয় না তার দরকার হবে স্যার…’ কথাটা বলে একটা বিশেষ ছবি টেবিলের উপরে ফেলে দেন অনির্বাণ, ‘ঠিক এতদূর এসেই আমি আটকে ছিলাম। কিছুতেই নিজেদের খুঁজে বের করার কোনও উপায় রাখছে না এরা। স্কেয়ারক্রো চ্যালেঞ্জের হ্যাশট্যাগে ক্লিক করলে শুধু হাজার হাজার রিলস আসছিল। বিরক্ত হয়ে সেগুলোই একটার পর একটা চালিয়ে রেখেছিলাম। তার মধ্যে একটা বিশেষ রিলসে আমার চোখ আটকে গেল এবং সেখান থেকেই সূত্রটা খুঁজে পেলাম। সেখান থেকে নেওয়া এই ছবিটা…’

টেবিলের উপরে রাখা ছবিটা তুলে একবার দেখলেন সরকার। একটা বছর কুড়ির মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ইট দিয়ে আঁকা ছবির পাশে। সম্ভবত একটা পাঁচিলের গায়ে আঁকা ছবিটা। স্কুটি চালাচ্ছে একটা মেয়ে আর তার পেছনে হাত পা তুলে বসে আছে একটা কাকতাড়ুয়া। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ভিয়ের মতো আঙুল তুলে হেসে সেলফি তুলছে সেটার সঙ্গে।

‘সাধারণ ভাঙা ইট দিয়ে আঁকা এরকম আরও অনেক ছবি আছে। কিন্তু এই ছবিটা তার মধ্যে আলাদা। মূল ছবিগুলো যে বা যারা এঁকেছে তাদের ঘরানার সঙ্গে এই ছবিটার অদ্ভুত মিল…আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন…’

ছবিটা খতিয়ে দেখলেন সরকার, অনির্বাণ বলতে থাকেন, ‘এই রিলসটার ক্ষেত্রে ছবিটা যে তুলেছে সে কার্টুনটা আঁকেনি। আমার যতদূর মনে হচ্ছে স্যার এই ছবিটাও ওরিজিনাল আর্টিস্টরাই এঁকেছে। তবে একটু অখ্যাত জায়গায় আর সাধারণ ইটের টুকরো দিয়ে আঁকা বলে সবাই চিনতে পারেনি…’

‘বেশ, ধরে নিলাম এটাও ওদেরই আঁকা। তা হলেও তো আমাদের লাভ কিছু হচ্ছে না।’

অনির্বাণ কথাটায় পাত্তা দেন না, বলে যেতে থাকেন, ‘যে প্রোফাইল থেকে ছবিটা আপলোড হয়েছে তাকে যোগাযোগ করলাম আমি। জিগ্যেস করলাম এই ছবিটা সে নিজেই এঁকেছে কিনা। মেয়েটা জানালো ওটা ওর নিজের আঁকা নয়। উত্তর কলকাতার একটা স্কুলের পাঁচিলে নাকি এই ছবিটা আঁকা ছিল। ছবিটা দেখে ওদের চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় আসে, তখনই রিলস বানিয়ে ফেলে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকেই বানিয়েছে…’

‘এখান থেকে কী লাভ হল তোমার?’

দুটো হাত মাথার উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙেন অনির্বাণ, ‘টিনটিনের মোট তেইশটা বই রঙিন। শুধু প্রথম বইটা সাদা-কালো। তাছাড়া সেখানে টিনটিনের চরিত্রটা তেমন একটা প্রতিষ্ঠিত নয়। তার কারণ জানেন?’

‘কারণ ওটা প্রথম আঁকা হয়েছিল। তখনও আরজে টিনটিনকে নিয়ে অতটা শিওর ছিলেন না…’

‘বিঙ্গো!’ হেসে ওঠেন অনির্বাণ, ‘আমার মনে হয় এই ছবিটা ওদের প্ল্যানের অংশ ছিল না। বরঞ্চ হুট করে একদিন খেয়ালের বশে এই ছবিটা আঁকার পর থেকেই ওরা পরপর আঁকা শুরু করে।’

একটু ভাবলেন সরকার, ‘বৃত্তটা ছোট হল বটে। কিন্তু উত্তর কলকাতাও তো ছোট জায়গা নয়। খোঁজ শুরু করতে গেলে…’

ছবিটা আবার তুলে ধরেন অনির্বাণ, ‘যে দেওয়ালটা দেখছেন সেটা একটা মেয়েদের স্কুল। আমরা জানি আর্টিস্ট মেয়ে, এবং সম্ভবত সে খুব ভালো কার্টুন আঁকতে পারে বলে পরিচিত…’

ক্যাফের দরজা দিয়ে ঢুকতেই অভিষেককে দেখতে পায় গার্গী। এগিয়ে এসে ওর সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে সে। পিঠের ব্যাগটা খুলে নিচে নামিয়ে রাখে।

সামনে রাখা সোনালি মদের গ্লাসে চুমুক দেয় অভিষেক। মুখ তুলে ঠোঁট চেটে বলে, ‘আছিস কেমন তুই?’

‘তোর সঙ্গে ফালতু গেঁজানোর ইচ্ছা সময় কিচ্ছু নেই আমার। কী বলবি বল…’

‘তুই যে রেকর্ড করছিস না কী করে বুঝব?’

‘বুঝবি না, চাইলে তোকে এক্ষুনি পুলিশে দিতে পারি। শুধু আমরা চাই না অকারণে তোর হ্যারাসমেন্ট হোক…’

অভিষেক চারদিকটা একবার দেখে নেয়, ‘দেখ, সত্যি বলছি এই কেসে আমি কোনও হারামিপনা করিনি। কিন্তু বুঝিসই তো আমার কারবার অত সিধা না। একবার পেছনে পুলিশ লাগলে কোথায় না কোথায় ফেঁসে যাব…’

‘ইউ হ্যাভ মাই ওয়ার্ড, এবার বল, অভিরূপার সঙ্গে প্রেম চলছিল তোর?’

আবার ধীরে সুস্থে সোনালি তরলে একটা বড় চুমুক মারে অভিষেক, ‘ঠিক প্রেম নয়। কাইন্ড অফ একটা ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি। ওই মাঝে মধ্যে ওর বাড়ি গিয়ে…’

‘কবে থেকে?’

‘ঈশানীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে থাকতেই অভিরূপার প্রতি আমার একটা ইন্টারেস্ট ছিল। ঈশানীর একটা আলগা রূপ আর বিশাল দেমাগ ছাড়া আর কিছুই নেই শালা। অভিরূপার পয়সাকড়ি আছে। মেয়েটার মাথাটা খেতে পারলে ওকে টিপে ভালোই রস আসবে। অনেকদিন আগেই একবার ঠারেঠুরে বলেছিলাম ওকে। তখন ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল। হেব্বি খেপে গিয়েছিল। শুধু জুতোতে বাকি রেখেছিল আমাকে…’

‘আশ্চর্য! তুই ওকে এসব বলেছিলি আমাদের কোনওদিন জানায়নি…তারপর?’

‘তো আমাদের সম্পর্কটা কেটে যাওয়ার মাসখানেক পরে হঠাৎ করে একদিন আমাকে ফোন করে ছোটখাটো কিছু দরকারে। কিন্তু আমি শালা বুঝতে পেরেছিলাম, ওসব দরকার ফরকার বাজে কথা। সদ্য ব্রেক আপ হয়েছে, এক্সকে ভোলার জন্য ও একটু নোংরা হতে চাইছে। আর আমার শালা নোংরা করাই কাজ।

‘তারপর?’

‘তখন থেকেই ওর সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা হত। তো করতে করতেই প্রথমে সেক্স চ্যাট। তারপর একদিন দেখা করে…তারপর থেকে ওটাই কন্টিনিউ হতে থাকে। দুসপ্তাহে একবার না হলেও দেখা করতাম আমরা। আমার শালা একটা ফিলিংস গোছের আসছিল, সেটা ওকে বলেওছিলাম। কিন্তু ও শালা কিছুতেই ভালোবাসবে না আমাকে। খাওয়াখায়িই হবে, ব্যাস। মাঝে মাঝে অবশ্য নানারকম দরকারের কথা বলত…’

‘কীরকম দরকার?’

অভিষেক একটু সময় নিয়ে বলে, ‘নানারকম। সেগুলো সবই একটু ঘাপলা টাইপের। যেমন ধর অমুক লোকটা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, অমুক ড্রাগটা কোন ডিলারের কাছে পাওয়া যায়, মাঝে মাঝে আবার অনেকের ফেসবুক হ্যাক করে দিতেও বলত। দু-একজনকে ফোন করে চমকেওছি ওর কথায়…’

‘তুই করতিস সব?’

অভিষেকের মুখটা বিরক্ত দেখায়, ‘শালা, নিজের ইচ্ছায় কে করে এইসব? আমি তো একটা বড় মালফাল কামিয়ে এসব থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টাই করছিলাম। ও প্রথমে এইসব কাজের জন্যও টাকা অফার করেছিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না, এসব কাজে শালা পুলিশের ঝামেলা আছে। তখন ও শালা সিডিউস করা শুরু করল। আমিও রক্ত মাংসের মানুষ…’

‘মানে তুই বলছিস তোর সঙ্গে একটা ফিজিকাল ইন্টিমেসি করে তোকে দিয়ে ও এমন কিছু কাজ করিয়ে নিত যেটা ওর পক্ষে ততটা সম্ভব ছিল না…’

গার্গীর নিজেরও বিশ্বাস হয় না কথাগুলো। এসব নোংরামো করার মতো মেয়ে অভি ছিল না। এতটা ডেস্প্যারেট ও হল কীসে?

অবশ্য চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার মতো মানুষ অভিষেকও না। কিন্তু ওর মুখ দেখে এখন মিথ্যে বলছে বলেও মনে হচ্ছে না।

গার্গী অন্য প্রসঙ্গে আসে, ‘তুই বললি অভি মারা যাওয়ার তিনদিন পরে তুই জানতে পেরেছিলি। এতই যখন ভালোবাসা জন্মেছিল তখন এই তিনদিন একটাও মেসেজ করলি না কেন?’

অভিষেক গ্লাসে একটা চুমুক দিতে যাচ্ছিল, অবাক হয়ে মুখ তোলে, ‘তোকে কে বলল করিনি?’

‘করেছিলি?’

‘যেদিন মারা যায় তার পরদিন সকালেও করেছি…’

গার্গী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘মিথ্যেবাদী! ওর ফোন আছে আমাদের কাছে। তোর একটাও মেসেজ নেই সেখানে। মরার আগে নাহয় ও তোর মেসেজ ডিলিট করে গেছে। পরে কি ওর ভূত এসে করেছে?’

গার্গীর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করেই পকেট থেকে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে অভিষেক। তারপর একটা চ্যাট বক্স বের করে ওর সামনে ফেলে দিয়ে বলে, ‘এই দেখ…’

চ্যাট থ্রেডটা ভালো করে দেখে গার্গী। এবং দেখতেই একটা খটকা লাগে। অভি বলে সেভ করা নম্বরটার হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইলে ডিসপ্লে পিকচারটা ফুটে আছে। সেটার দিকে ভালো করে তাকায় গার্গী। বিড়বিড় করে বলে, ‘এটা অভিরূপার হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি নয়…’

‘এখানেই তো কথা হত…’

দ্রুত প্রোফাইলটা চেক করে গার্গী। এটা অন্য নাম্বার। ও মুখ তুলে বলে, ‘এটা অভিরূপার নাম্বার কবে থেকে?’

‘তা বলতে পারব না। প্রোফাইলটা ক্রিয়েট করেছে মাস পাঁচেক আগে। মানে ওর ব্রেকআপ হওয়ার মাসখানেক পর থেকে। আগে এখানেই ফোন করতাম বেশিরভাগ, অন্য নম্বরটায় বেশি কল করতে ও বারণ করেছিল। এখন এটায় কল করলে সুইচড অফ বলে…’

গার্গীর মাথার ভিতরটা গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে বলে, ‘কিন্তু ওর ফোনে দুটো সিম ছিল বলে তো মনে পড়ছে না। তাছাড়া ও যদি তোর সঙ্গে প্রেম করার জন্য অন্য নম্বর নিয়েও থাকে তাহলে সেটা আমাদের থেকে লুকানোর কী আছে? আমরা তো ওর ফোন খুলে চ্যাট দেখতে চাইতাম না।’

‘আমি কিছু জানি না ভাই। তোদের এই ভুলভাল চক্করের মাঝে আমার গাঁড়টি এবার মারা যাবে…’

‘আচ্ছা ও তোকে দিয়ে যে কাজগুলো করাত সেগুলো তোর চ্যাটবক্স ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে?’

‘যাওয়ার তো কথা, ও আমাকে সব ডিলিট করতে বলত। কিন্তু আমি করিনি।’

‘গোটা চ্যাটটা ফরওয়ার্ড কর আমাকে উইথ মিডিয়া…’

আরও কিছুক্ষণ মদ খেয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যায় অভিষেক। গার্গী মন দিয়ে দেখতে থাকে চ্যাটটা। দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে যায় ওর। বেশ কিছু মানুষের ব্যাপারে খোঁজখবর করেছে অভিরূপা। সহজে সুইসাইডের উপায় জানতে চেয়েছে কখনও, দু-একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকও করতে চেয়েছে। আশ্চর্য! এসব করে লাভ কী হত ওর?

ভালো করে চ্যাটটা পড়তে থাকে গার্গী। হঠাৎই কয়েকটা মেসেজ আর ছবিতে ওর চোখ আটকে যায়। কী আশ্চর্য! অভি হঠাৎ এর ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে কেন?

গার্গীর মন বলে উত্তরের ভীষণ কাছে এসে পড়েছে ও…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *