একাদশ অধ্যায়
ঘরের দরজাটা খুলতেই একরাশ মন খারাপ চেপে ধরল গার্গীকে। এই ঘরটায় আগে বহুবার এসেছে ওরা। নতুন কিছু নয়। আজ শুধু ওর সঙ্গে ওর দুই বান্ধবি নেই। তার বদলে তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে। সেই চাবি দিয়ে খুলেছে দরজাটা।
ঘরের একদিকে জানলা লাগোয়া অভিরূপার একটা ফুট দুয়েকের পোর্ট্রেট। তার এক পাশে একটা গিটার। অন্যদিকে ছোট বেড সাইড টেবিলের উপর কয়েকটা ম্যাগাজিন রাখা। সেগুলো চাপা দেওয়া আছে কলিন হুভারের বই দিয়ে। বইটা শেষ করে যেতে পারেনি অভিরূপা। সে চলে যাওয়ার পর একটা সপ্তা কেটে গেছে প্রায়। প্রাথমিক শোকটা কাটিয়ে উঠলেও গার্গী আর তন্ময়ের মধ্যে কী যেন একটা হারিয়ে গেছে।
ঘরের ভেতর ঢুকে জানলার দিকে এগিয়ে আসে গার্গী। অন্যবার ঘরে ঢুকলে ওই বিছানাতেই হয় শুয়ে থাকত অভি, নইলে স্নান করার পর খাটের একপাশে চুল বিছিয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ত। এই বিছানায় বসে কতবার প্র্যাকটিক্যালের লেখা কমপ্লিট করেছে তিনজনে, কতবার ব্রেকআপের পর মদ খেয়ে বমি করেছে মেঝেতে, এখনো যেন মেয়েটার গলার স্বর ঘরের ভেতর শুনতে পাওয়া যায়।
তন্ময় ওর পাশের চেয়ারটাতেই বসে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘বাড়ির অবস্থা তো একেবারেই ভালো নেই বুঝতেই পারছিস। আমারও আর এখানে থাকতে ভালো লাগে না। বোনটাকে নিজের হাতে করে মানুষ করেছিলাম…’
‘তো? চলে যাবে? আমার কী হবে ভাবলে না?’ গার্গী জানলার দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলে। সকালের রোদ এসে পড়ে ওর মুখে। চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে।
‘আমি থাকতেই বা কী লাভ হচ্ছে তোর?’
‘রাতারাতি কিছু ঠিক হবে না তন্ময়। একটা মানুষ চলে গেছে। এই সময়টা…’ এগিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে গার্গী, ‘এই সময়টা আমার পাশে আর কাউকে পাচ্ছি না…’
‘ঈশানী?’ তন্ময় হাত দিয়ে ওর চোখের কোণ থেকে জলটা মুছে দেয়, ‘ঈশানী এল না?’
‘ওর তো অফিস আছে। তাছাড়া আগের মতো আমার সঙ্গে মেশে না আর…’
‘সে কি, তোর সঙ্গে মেশে না কেন?’
একটু দূরে সরে গিয়ে আবার জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় গার্গী, ‘জানি না। কিছু একটা হয়েছে ওর। নিজের খেয়ালে থাকে, সবকিছু থেকে একটু আলাদা হয়ে গেছে…’
‘ক’দিন যেতে দে, ঠিক হয়ে যাবে…’
গার্গী একটা নরম হাসি হেসে দুদিকে মাথা নাড়ায়, ‘নাগো, আর কিছু ঠিক হবে না। আমাদের তিনজনের মধ্যে অভিই একটু আঠার মতো কাজ করত। আমার আর রুনুর মধ্যে মাঝেমধ্যেই ঝামেলা হত। ওই দায়িত্ব নিয়ে মাঝখান থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করত। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো?’
‘কী?’
‘আমরা তলে তলে ওকে হিংসা করতাম। বড়লোকের মেয়ে, জীবনে যা চেয়েছে হাতের সামনে পেয়েছে। এমনকী স্বাধীনতাও। আমাদের দুজনেরই একটা কমন এনিমি ছিল ও। ফলে আমি আর ঈশানী ঝামেলা করলে সেই আগুনে একটু ঘি দিয়ে মিটমাট করে নিতাম নিজেদের মধ্যে…’
দেওয়ালে ঝুলন্ত অভিরূপার ছবিটার দিকে তাকায় তন্ময়, ‘কী জানি, আমার তো মনে হয় একইরকম দুঃখ মানুষকে মিলিয়ে দেয়। একই কারণে যারা কাঁদছে তারা একে অপরের সঙ্গে থাকলে বুক হালকা হয়…’
গার্গী মাথা নাড়ে, ‘সে অন্য কষ্টের বেলা। মানুষের মরে যাওয়ার কষ্টের সঙ্গে অন্য কষ্টের তফাত আছে। অন্যগুলোতে আমরা মলম লাগাই—এ বছর ফেল করেছি তো পরের বছর পড়াশোনা করে পাশ করে যাব, এ বছর প্রেমে ল্যাং খেয়েছি, আবার একটা স্যাঠাভাঙা প্রেম হবে। কিন্তু মৃত্যু জিনিসটা…’ গার্গীর গলার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসে, ‘একমাত্র ভুলে যাওয়া, ইগনোর করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। সে অন্যের হোক বা নিজের…’
তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘আমার বাবা মা-ও মানিয়ে নেবে, বল? একদিন না একদিন?’
গার্গী হাসে, ‘তোমার নিলাদ্রির কথা মনে আছে? সেই কলেজে প্রেম করতাম যার সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ, তারও কেউ মারা গেছিল নাকি?’
‘উঁহু, লং ডিস্ট্যান্স ছিল। খুব একটা কথাবার্তা কিছু হত না। রাতে আমি কলেজ থেকে আর ও অফিস থেকে ফিরে একটু গল্পগুজব করতাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়তাম। লোককে দেখে মাথা গরম হয়ে যেত। শালাদের কাজ নেই নাকি? সারাদিন ফোন করে গুজগুজ, ভিডিও কল, সেলফি তুলে পাঠানো, কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি সময় করে জানানো। ন্যাকাচোদা মনে হত। একটা মানুষের সঙ্গে কত কথা থাকতে পারে? আরে দু’বছর ধরে প্রেম করছি, সারাদিন কথা বলে যেতে হবে কেন? তখন ঈশানী একটা কথা বলেছিল, জানো?’
‘কী?’
‘বলেছিল এই সারাদিনের কথা বলাটা আসলে ইনভেস্টমেন্ট…’
‘ইনভেস্টমেন্ট বলতে?’
‘মানে ধরো, তুমি রোজ যার সঙ্গে রাতে এক ঘণ্টা কথা বলো সে তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে শুধু ওই এক ঘণ্টাটাকেই ভুলতে হবে। তুমি রোজ যার সঙ্গে জুড়ে থাকো, যার গামছা, সাবান তেলে তোমার আঙুলের গন্ধ লেগে থাকে, তাকে ছেড়ে যাওয়াটা আরও কঠিন…সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করতে গেলে কোথাও না কোথাও জুড়ে থাকতে হয়…’
‘মনের বাঁধনটা কিছু নয়?’
সামনে ঝুঁকে একগাল হেসে তন্ময়ের দিকে তাকায় গার্গী, ‘শুধু মনের বাঁধন নিয়ে কি জীবন চলে আমাদের? আমি অভিকে দু’সপ্তাহ আগে যতটা ভালোবাসতাম এখনও ততটা বাসি। বেঁচে থাকলে ও বাসত আমি জানি। তাতে খুশি থাকছি কি?’
বড় করে একটা শ্বাস নেয় গার্গী, ‘বাদ দাও এসব। দেবু যোগাযোগ করেছিল তোমাদের সঙ্গে?’
‘ওর সঙ্গে তো ব্রেক আপ হয়ে গেছিল ছ’মাস আগে। তবে যোগাযোগ রেখেছিল মনে হয়। মাঝখানে একদিন এসেছিল। আমি বললাম ঘরে ঢুকে দেখো যদি কোনও জিনিসপাতি নিয়ে যাওয়ার হয়, নিয়ে যাও…’ দু’দিকে মাথা দোলায় তন্ময়, ‘ছেলেটা খারাপ ছিল না, জানিস?’
উপর নিচে মাথা নাড়ায় গার্গী, ‘আমাদের তিনজনের মধ্যে ওরই বয়ফ্রেন্ডটা পাগলের মতো ভালোবাসত। কিন্তু মাঝে কী যে হল, কীসের ভূত চাপল মাথায়। অকারণেই ব্রেক আপ করল ছেলেটার সঙ্গে। আসলে ও চিরকালই ওইরকম। একবার কিছু মাথায় ঢুকল তো করতে পারে না এমন কাজ নেই। ভালোবাসাটাও, না ভালোবাসাটাও…’ কথাটা বলতে বলতেই অন্য একটা ভাবনা এসে ঘিরে ধরল গার্গীকে, প্রসঙ্গটা পাল্টে নিল সে, ‘ওর কললিস্টটা পাওনি তোমরা?’
‘পেয়েছি। আমি একবার চোখ বুলিয়ে দেখেছি, চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু তো পাইনি তার মধ্যে…’
‘আমাকে একবার দাও তো…’
ভিতরের ঘর থেকে প্রিন্ট করা কললিস্টটা এনে গার্গীর হাতে দিল তন্ময়, ‘সেরকম অচেনা নাম্বার কিছু নেই। ওই একবার দু’বার কল এসেছে ব্যাস। তুই দেখ কিছু পাস কিনা…’
কললিস্টের পাতা উল্টাতে থাকে গার্গী। বেশ কয়েকটা নাম্বার থেকে বারবার ফোন এসেছে। তার মধ্যে ওর নিজেরটাই এসেছে ঘুরেফিরে। ঈশানীরও থাকার কথা ছিল অথচ নেই। শেষ ক’মাসে কি ভালোমতো কথা হয়নি ওদের দুজনের?
অন্য নাম্বারগুলো চেনা নয়। হয়তো নামগুলো দেখলে চিনতে পারত। ফোন নম্বরগুলোর পাশে ডিউরেশন লেখা আছে। তার মধ্যে একটু বড়সড়গুলো খতিয়ে দেখতে থাকল গার্গী।
হঠাৎ একটা নম্বার দেখে গার্গীর চোখ আটকে গেল। পাতাটা সামনে তুলে ধরে বলল, ‘এই ব্যাপারটা খেয়াল করেছ তুমি?’
‘কী?’
‘এই নম্বারটা থেকে বেশ কয়েকটা কল এসেছে। কিন্তু কলটা এসেছে অদ্ভুত সময়ে…’
‘অদ্ভুত সময়ে বলতে?’
ডিটেইলগুলো মেলাতে মেলাতে গার্গী বলল, ‘সব ক’টা কলই এসেছে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। মিনিটকুড়ি কথা হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে।’
‘তাতে অদ্ভুতের কী আছে?’
নিজের মনেই বিড়বিড় করে গার্গী, ‘সেরকম কিছু না। কিন্তু ওই সময়ে আমি টিউশনি পড়িয়ে ফিরতাম। তোমাদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়েই যেতাম বলে মাঝে একবার দুবার ফোন করেছিলাম নিচে নেমে দেখা করার জন্য। কিন্তু ও কিছুতেই দেখা করত না। এমনকী ফোনটাও যেন রাখতে পারলে বেঁচে যেত…’
‘কেন? কী এমন করত তখন?’
‘বলত ওর নাকি কীসব অনলাইন ক্লাস আছে। কিছুতেই মিস করা যাবে না…’
তন্ময় একটু ভেবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘কল করে অনলাইন ক্লাস, তাও আবার কুড়ি মিনিটের! অদ্ভুত তো! নম্বরটা কার দেখ তো…’
এক সেকেন্ড ঠোঁটে আঙুল রেখে ভাবে গার্গী। তারপর নিজের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ট্রু-কলারে নাম্বারটা সার্চ করে। সঙ্গে সঙ্গে নাম্বারের মালিকের নাম ফুটে ওঠে—অভিষেক চৌধুরী।
তন্ময় ঝুঁকে পড়ে স্ক্রিনের উপর, ‘এই ছেলেটা আবার কে?’
‘ঈশানীর বয়ফ্রেন্ড।’ থমথমে গলায় কথা বলে গার্গী। পরক্ষনেই মুখ তুলে বলে, ‘অভির ফোনটা আছে না তোমার কাছে?’
‘হ্যাঁ, ওতে কিছু পায়নি পুলিশ তাই ফেরত দিয়ে দিয়েছে…’ দ্রুত ভিতরের ঘর থেকে অভিরূপার ফোনটা এনে গার্গীর হাতে দেয় ও, ‘লকটা খোলাই আছে। দেখ কিছু পাওয়া যায় কিনা…’
কন্ট্যাক্টে গিয়ে নম্বরটা সার্চ করে গার্গী। কিছুই পাওয়া যায় না সেখানে। নম্বরটা ওর ফোনে সেভ করা নেই। হোয়াটস্যাপে গিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না নম্বরটা।
নিজের চুল খামচে ধরে গার্গী। বিড়বিড় করে বলে, ‘অভি আমাদের লুকিয়ে অভিষেকের সঙ্গে কথা বলল, কিন্তু একবারও হোয়াটস্যাপে পিং করল না?’
তন্ময় অনেকক্ষণ ধরেই সমস্ত ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। সে একটু সন্দেহের গলাতেই বলল, ‘আচ্ছা, এই যে ঈশানীর এক্স বয়ফ্রেন্ড, অভি তাকে চিনত?’
‘চিনত বলতে এক দুবার দেখা হয়েছিল। ফোন নাম্বার নিয়েছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু দুদিন অন্তর তাকে ফোন করে এতক্ষণ কথা বলবে, তার উপর আবার আমাদেরকে মিথ্যে বলবে…এর কী কারণ থাকতে পারে?’
‘আমি একবার ফোন করব ছেলেটাকে?’
গার্গী ঠোঁট কামড়ায়, ‘না, তোমাকে করতে হবে না। আমিই করছি…’
নিজের ফোন থেকে নম্বরটা ডায়াল করে গার্গী। কয়েকবার রিং হতে ওপাশ থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা যায়, ‘বল। তুই এতদিন পরে?’
‘অভিরূপার খবরটা পেয়েছিস তুই?’
‘হ্যাঁ। এমন সময়ে জানতে পেরেছি যে একটু সমবেদনা ফেদনা জানানোর উপায় ছিল না। কী কেলো কেস মাইরি। এই জন্য বলি বেশি মাল ফাল খেয়ে…যাক গে, আমাকে ফোন করছিস কেন?’
গার্গী দ্রুত প্রসঙ্গে আসে, ‘তোর অভিরূপার সঙ্গে কথা হত?’
ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো গলা শোনা যায়, ‘সেসব আমি তোকে বলতে যাব কেন? তুই ওর ভাতার নাকি?’
গার্গীর দাঁতে দাঁত ঘষে যায়, ‘মেয়েটা মারা গেছে অভিষেক! কললিস্টে দেখা যাচ্ছে তোকে প্রায়ই রাত্রিবেলা ও অন্তত মিনিট কুড়ির জন্য ফোন করত। কী চলছিল তোদের মধ্যে?’
‘দেওয়া নেওয়া চলছিল। হয়েছে? তোর তাতে এত ছেঁড়াটা যাচ্ছে কেন?’
গার্গীর হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় তন্ময়। কঠিন গলায় বলে, ‘দেখ, তুই যেই হোস ভাই। এই কললিস্ট পুলিশই আমাদের দিয়েছে। যদি আমাদের কাছে সত্যি কথা বলিস আমরা থানা-পুলিশ করব না। কিন্তু যদি…’
এইবার বোধহয় ছেলেটা একটু ঘাবড়ে যায়। পুলিশের নামটা বলতেই গলার স্বর নরম হয়ে আসে। মিনমিন করে বলে, ‘আরে, তোমরা এত রাগ করছ কেন বলো তো? ও ফোন করত আমাকে। মাঝে মাঝে খবর নিত। আর তাছাড়া…’
‘তাছাড়া কী?’
‘কিছুদিন হল ওর মনটা ভালো যাচ্ছিল না।’
‘কী নিয়ে ভালো যাচ্ছিল না? আর সব থেকে বড় কথা ভালো না গেলে সেটা বলার মতো লোকজন ছিল। খামোখা তোকে কল করতে যাবে কেন?’
দেওয়ালে রংটা করে পেছনদিকে সরে আসে ঈশানী। একবার ভালো করে চেয়ে দেখে উপরে। শিয়ালদা চত্বর গভীর রাতে খানিকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের ব্রিজের উপরে বসে থাকা দুটো ছেলে মেয়েকে খেয়াল করেনি কেউ। ব্রিজের উপরে বসেই আজ বিশাল কাটআউটে ছবি এঁকেছে ঈশানী। তারপর সেটা শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে ব্রিজ থেকে। আপাতত রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা যেকোনও বাস বা গাড়ি থেকে ব্রিজের মাঝ বরাবর ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যাবে সেটাকে। সমস্ত কাজটা শেষ করে নিচের রাস্তায় দাঁড় করানো স্কুটিটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ঈশানী অবাক চোখে চেয়ে থাকে ঝুলন্ত ছবিটার দিকে।
সেই মেয়েটা আর কাকতাড়ুয়া আজ একে অপরের দিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে মুখোমুখি। ভাবখানা যেন এই বুঝি চুমু খেতে যাবে ওরা। কিন্তু কাকতাড়ুয়া বেচারার ঠোঁট বলে কিছু নেই বলে মুখটা ব্যাজার হয়ে রয়েছে তার। পেছনের আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। সেই চাঁদের দুটো চোখ আর একটা মুখ। সঙ্গে খুদে খুদে দুটো হাতও আছে। সে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে যেন দুজনে এই মুহূর্তে যে চুমুটা খেতে চলেছে সেটা চোখে দেখতে চাইছে না সে…
চারুর দিকে হাত দুটো এগিয়ে দেয় ঈশানী। ওর দুটো হাতেই রং লেগে আছে। তাই একটা দিয়ে আরেকটা ধুতে গেলে চারিদিকে রং লেগে যাবে।
বোতল থেকে রিমুভার মেশানো জলটা বের করে কচলে কচলে ওর হাতটা ধুইয়ে দিতে থাকে চারু। সেটা হয়ে গেলে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে দেয় ভালো করে।
ঈশানী একবার গাল টিপে দেয় ওর, আজ ছবিটা অন্যদিনের থেকে বেশ বড় হয়েছে। শরীরের পরিশ্রমটা কম যায়নি। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে, ‘কেমন হয়েছে বল?’
চারুর মুখে একটা করুণ ভাব ফুটে ওঠে, ‘ধুর, ভালো না। কাকতাড়ুয়ার একটা ঠোঁট থাকা উচিত ছিল।’
‘তাতে কী লাভ?’ ঈশানী হাসে, ‘আমার ঠোঁট আছে, তাও চুমু খেতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে যায়…’
‘তাহলে কাকতাড়ুয়া ভালোবাসলে সেটা প্রকাশ করবে কী করে?’
‘কাকতাড়ুয়া ভালোবাসা লুকিয়েই রাখতে পারে না। যাই করে, তাতেই প্রকাশ হয়ে যায়…’ কথাটা বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চারুর মুখ মুছিয়ে দেয় ঈশানী, ‘তুই এত ঘামছিস কেন বল তো?’
‘আমার শরীরটা কলকাতার উপযুক্ত নয়। হুট করে এসে পড়েছি। অস্বস্তি হওয়াই স্বাভাবিক…’
‘আচ্ছা, কাল থেকে তোকে ভারতীয় করে দেব। আর কষ্ট হবে না। ঠিকাছে?’
চারু হালকা হেসে মাথা দোলায়, ‘দরকার নেই। আমায় যেভাবে দেখতে চাইবি আমি তাই। আসলে তো আমি কালো হাঁড়ি বই কিছু নই…’
দুজনে একসঙ্গে রাস্তার উপরে হাঁটতে শুরু করে। যতক্ষণ না আঁকাটা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ একটা চাপা টেনশন চলে ঈশানীর মনে। কেউ ধরে ফেললেই সব শেষ। চারু অবশ্য স্কুটি নিয়ে রেডি হয়েই থাকে। এই ক’দিনে স্কুটি চালানোর বিদ্যেটা ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে সে। ঈশানী লক্ষ করেছে চারু যেকোনও কিছু খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলতে পারে।
শরীরটা আরও ক্লান্ত লাগে ঈশানীর। চারুর হাতটা চেপে ধরে রাস্তার উপর ভীষণ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে ও, মাথাটা রাখে ওর বাহুর উপর।
‘বল না বাবা, ঠিক হয়েছে আঁকাটা?’
পেছন ফিরে আর একবার ব্রিজ থেকে ঝুলন্ত ছবিটা দেখে নেয় চারু, তারপর ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘উম, কিউট হয়েছে ভীষণ!’
খুশি হয়ে হাত থেকে মুখ তুলে চারুর চোখের দিকে তাকায় ঈশানী, ‘তোকেও ভীষণ কিউট লাগছে আজ…’
চারু মুখ বাঁকায়, ‘ধুর, আমার রূপের কমপ্লিমেন্ট দিলে আমার ভালো বা খারাপ কোনটাই লাগে না…’
‘সেভাবে দেখতে গেলে এই পৃথিবীর কোনও মানুষকেই তার রূপের কমপ্লিমেন্ট দেওয়া যায় না। রূপের পেছনে আমাদের নিজেদের অবদান সামান্যই…’
‘তাহলে আমাকে কীসের কমপ্লিমেন্ট দেওয়া যায়?’
একটুক্ষণ কী ভেবে নেয় ঈশানী, তারপর তেমনই উদাস গলায় বলে, ‘আমি যতক্ষণ আঁকি ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তোর এই পাহারা দেওয়াটার…’
‘তখন আমার করারও কিছু থাকে না। দাঁড়িয়ে না থেকে যাব কোথায়?’
ঈশানী দাঁড়িয়ে পড়ে ওর গালে একটা হাত রাখে, ‘জানিস, এই পৃথিবীতে যেসব মানুষ গান গায়, ছবি আঁকে, নাচে, কবিতা লেখে, তাদের উপর একটা অভিশাপ কাজ করে। তারা ওই সময়টুকুনির জন্য নিজের সব কিছু ভুলে যায়। এটাও ভুলে যায় যে কেউ তাদের জন্যও অপেক্ষা করছে, তাদের পথ চেয়ে বসে আছে। তারপর যখন গান, আঁকা কিংবা নাচটা শেষ হয়ে যায় তখন আচমকাই তাদের ভিতর একটা ছটফটানি শুরু হয়। ভয় হয় তাদের। এই যে এতক্ষণ ভুলে ছিল, তাই অভিমান করে সবাই চলে যায়নি তো? ফিরে তাকালে হাসি মুখে কাউকে দেখতে পাবে তো?’
‘তারপর?’
‘আমি রোজ আঁকা শেষ করার পর ভীষণ ভয় নিয়ে পেছন ফিরে তোর দিকে তাকাই। আমার খুব ভয় করে। আমি যখন আঁকছিলাম তখন তুই কি ডেকেছিলি আমাকে? তোর কোনও বিপদ হয়েছিল তখন? আমি সাড়া দিইনি বলে না জানিয়েই কোথাও চলে গেছিস…ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে পেছন ফিরে আমি দেখতে পাই…’
‘কী দেখতে পাস?’
‘যে তুই রোজ একইরকমভাবে মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস…’ হাত বাড়িয়ে ওর দুটো গাল টিপে দেয় ঈশানী, ‘এটা আমার খুব কিউট লাগে। তোর এই অকারণে থেকে যাওয়াটা…’
চারুর মুখে হুট করেই একটা বদল আসে, ‘তোর কেন মনে হয় আমি অকারণে পাশে আছি? হয়তো আমার কোনও উদ্দেশ্য আছে?’
‘জানি…’ শান্ত গলাতেই বলতে থাকে ঈশানী, ‘তোর উদ্দেশ্য কোথাও না থাকতে চাওয়া। শুধু এটা ভাবিস না যে…’
‘কী?’
কথাটা বলার আগে হাসে ঈশানী, মুখ নামিয়ে নেয়, ‘আমাকে দিয়ে এর আগে এ কথাটা কেউ বলাতে পারেনি। কিন্তু…’ ওকে দুহাত দিয়ে কাছে টেনে নেয় সে, ‘এটা বুঝিস না যে তোকে ছাড়া আমার চলবে না?’
চারু একটু সরে আসে, ‘কেন? না চলার কী আছে? আমি যেতে যেতে তুই নিজেই সব শিখে যাবি।’
‘আমার বাবাও এরকম একটা কথা বলেছিল। তারপর দুম করে একদিন চলে গেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম গাঁড় ফেটে যাবে। তারপর দেখলাম নাহ…আমি জানি আমি পারব।’ কথাটা বলে আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না ঈশানী, ‘চল, আর একটু হাঁটি। আজ বেশ হাওয়া দিচ্ছে…’
ওর হাতটা ধরে ফেলে চারু, তারপর বলে, ‘তোর ভয় করে না?’
‘কীসের ভয়?’
চারু একটু অবাক গলায় বলে, ‘আমরা তেমন কিছু পাপ না করে থাকলেও শহরের কয়েকটা পুলিশ অন্তত আমাদের খুঁজছে। কাগজে লেখালিখি হচ্ছে। স্কুটিটা যদি কেউ দেখতে পেয়ে যায়, তারপর সন্দেহ করে গাড়ির নাম্বার দেখে আমাদের বের করে, বাড়িতে একবার ঢুকলেই কিন্তু বুঝতে পারবে…’
ঈশানী নরম হাসি হাসে, ‘তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই কাকতাড়ুয়া। ভয় দেখানো তোর কাজ, ভয় পাওয়া না। আচ্ছা একটা গান শোনা আমাকে, ভয় কেটে যাবে…’
এতক্ষণে সত্যিকারের খুশি হয় চারু। একগাল হেসে বলে, ‘এই তোকে বলা হয়নি। আমি নিজে নিজে একটা গান শিখেছি। চরণদাসের শুধু দেহতত্ত্ব আর দেহতত্ত্ব। আমি একটা অন্য গান শিখেছি…’
‘আমাকে শোনানোর জন্য গান শিখেছিস তুই?’
ভেংচি কাটে চারু, ‘নাহ, রাতে অন্য মেয়ের স্কুটি চেপে ঘুরি তো, তাকে শোনাব বলেই শিখেছি…’
পিঠ থেকে দোতারাটা সামনে এনে তার তারের উপরে হাত রাখতে যাচ্ছিল চারু। ঈশানী হাত বাড়িয়ে ওকে বাঁধা দেয়, ‘না, দোতারাটা বাজাতে হবে না। ওটা তুই পাশে রাখ। খালি গলায় গা…’
একটু রুষ্ট হয় চারু, ‘কেন? দোতারা বাজালে কী সমস্যা? তোর ভালো লাগে না শুনতে?’
‘লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু বাজাতে হবে না…’
‘কেন?’
‘আঃ, বড্ড প্রশ্ন তোর! দেব এক্ষুনি হাঁড়ি ফাটিয়ে। যা বলছি সেটা কর না…’
ভাবাচ্যাকা খেয়ে দোতারাটা সরিয়ে রাখে চারু। রাস্তার একদিকের দেওয়ালে পিঠ রেখে অন্ধকারে মিশেই গলা খাঁকারি দেয় একবার। তারপর খালি গলাতেই গাইতে থাকে। ফাঁকা রাস্তার উপরে ভেসে যায় ওর গানের সুর। মৃদু ঝোড়ো হাওয়া কলকাতার পুরোনো গলির ফাঁকে ফাঁকে বয়ে নিয়ে যায় সেই গান। সেখান থেকে বুঝি আরও দূরে।
আচমকাই এগিয়ে এসে ওর বুকের উপর মাথা রাখে ঈশানী। দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে, ফিসফিসে স্বরে বলে, ‘বোকা, দোতারা বাজালে বুকে মাথা রাখা যায় না…’
গান গাইতে গাইতেই চারুর মুখে হাসি ফোটে। ঈশানীর মাথার উপরে একটা হাত রাখে ও। গলার স্বর আরও নরম হয়ে আসে। ঘুমপাড়ানি গানের সুরের মতো শোনায়।
কতক্ষণ কেটেছে কেউ জানে না। সময়ের হিসেব ভুলে গেছে ওরা। এর মধ্যে চারু একটা গান শেষ করে অন্য গান শুরু করেছে। দূর থেকে একটা পুলিশের গাড়ির আলো রাস্তার উপরে পড়তে ঈশানীকে নিয়েই আরও একটু অন্ধকারে সরে আসে চারু। ঈশানী আচমকা ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে। তারপর আবার শান্ত হয়ে যায়।
‘এই তুই গান শুনছিস না?’ ঈশানীর ঘুম জড়ানো মুখের একটা গালে হাত রেখে জিগ্যেস করে চারু।
লজ্জিত হয় ঈশানী, ‘আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…’
মাথাটা আবার নিজের বুকে টেনে নেয় চারু, ‘একদিন দুদিন একটু বিশ্রাম দে। রোজ রোজ রাত জেগে এসব না করলেও হবে। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসছে তোর…’
সজোরে দুপাশে মাথা নাড়ে ঈশানী, ‘না, ক্লান্ত নয়…’
‘তাহলে?’
‘ক্লান্ত তো আমি অনেক মাস ধরে চারু। আজ আসলে একটুও ভয় করছিল না তাই। নিশ্চিন্ত লাগছিল ভীষণ। চল, বাড়ি ফিরতে হবে…’
অন্ধকার থেকে সরে দুজনে হেঁটে কিছু দূর এগিয়ে আসে। স্কুটিটা এখনও রাস্তার একপাশেই দাঁড় করানো আছে। রঙের ক্যান আর ব্রাশগুলো যত্ন করে স্কুটির ভিতরে ঢুকিয়ে নেয় ঈশানী। দুজন মিলে বোতল থেকে জল খায়।
আজ রাতে শেষবারের মতো দেখে নেয় একটু আগের আঁকাটাকে। কে জানে হয়তো কাল সকাল হওয়া মাত্র পুরসভার লোক এসে গাড়িচাপা কুকুরের বডির মতো সরিয়ে ফেলবে আঁকাটা।
এতক্ষণে রংটা শুকিয়েছে। চাঁদের আলোয় আর একটু বেশি ঝলমল করছে সেটা। দুজনে কিছুক্ষণ তৃপ্তির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেটার দিকে। ঈশানী চারুর হাতটা ধরে বলে, ‘আমার সব স্বপ্নগুলো তোর কবে হয়ে গেল বল তো?’
‘তোর দুঃখগুলো আমাকে বলতে ইচ্ছা করেছিল যবে। যবে আমি ছাড়া আর কাউকে বলতে পারিসনি…’
‘আমি দুঃখ দিয়ে কত কিছু কিনে নিলাম বল? স্বপ্ন, বেঁচে থাকা, আর সব ভয় হারিয়ে গেল আমার…’
হঠাৎ করে ওর দিকে সরে আসে ঈশানী, ‘একদম ভয় করছে না কেন বল তো?’
‘আমারও করছে না। আমি…’
ঘাড় ধরে ওর মুখটা নিজের মুখের কাছে আনে ঈশানী। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘এখন?’
‘এবারে একটু করছে। কিন্তু ঠিক ততটা নয়।’
আরেকটু কাছে নিয়ে আসে, ‘বেশ, এবার বল, এখন করছে?’
বিড়বিড় করে চারু, ‘আমি না কোনওদিন কাউকে চুমু খাইনি।’
‘আমিও। ঠোঁটে চুমু আমার আজ অবধি নিজে থেকে কাউকে খাওয়া হয়নি…’
‘কেন?’
‘আমার খালি মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে। বেশিক্ষণ ওভাবে থাকলে আমি দম আটকে মরে যাব…’
চারু হতাশ হয় কিনা বোঝা যায় না, ‘ওঃ, তাহলে তো…’
মুখটা সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল চারু। হঠাৎ করেই ঈশানী দুহাতে ওর মাথাটা টেনে নেয়। সজোরে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় ওর ঠোঁটে। চারু থতমত খেয়ে কোনরকমে বলে, ‘এই যে বললি দম আটকে মরার ভয় করে…’
‘এই যে বললাম আমার আর কিছুর ভয় করছে না। দম আটকে মরারও না…’
ওদের নিজেদের আঁকা শরীরদুটো নিজেদের শরীরের ছায়াতে ঢেকে যায়। কেবল দুটো কপালের মাঝখান দিয়ে ঈশানীর আঁকা চোখ, হাত আর লজ্জিত মুখওয়ালা চাঁদটাকে দেখা যায়।
সে চাঁদের আলো এতক্ষণ এসে পড়েছিল ফাঁকা রাস্তায়। দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে আছে ছবির চাঁদটা। আর আকাশের চাঁদটাকে ঢেকে দেয় ছেঁড়া মেঘের দল…