দশম অধ্যায়
‘হিস্ট্রি অফ বিজলিমারি রুইন্স’—নামটা দিয়ে গুগল সার্চ করতেই একগোছা রেজাল্ট ভেসে উঠল স্ক্রিনের উপর। তাদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ঈশানী বুঝতে পারলে কোনও লিঙ্কই কাজের নয়। কোনও গণ্ডগ্রামের জঙ্গলের মাঝে কিছু ভাঙাচোরা বাড়িঘর নিয়ে খুব বেশি লোকের আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কয়েকটা লিংকে ঢুকে ঘোরাঘুরি করল ঈশানী। তারপর কী বোর্ডের ফন্টটা বদলে বাংলা করে নিল।
ছোটখাটো দু-একটা ইনফরমেশন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। একটা লিংকে আগ্রহ হতে ক্লিক করল। সেটা খুলে যেতে কোনরকমে চোখ বুলিয়ে পড়তে লাগল। গোটাটা পড়ে অবশ্য খুব একটা ভক্তি হল না। স্থানীয় সংবাদপত্র বলছে ও অঞ্চলে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে। সাদা শাড়ি পরা কিম্ভূত মহিলা দেখা গেছে। মাঝরাতে উল্টোপাল্টা চিৎকার শোনা গেছে এই জাতীয় আরও কিছু হাবিজাবি। খোঁজাখুঁজি করে স্থানীয় এক বাউলের নম্বরও পাওয়া গেল। সে নাকি মাঝেমধ্যেই ওই ক্যাম্পে আসে। নাম—চরণদাস।
একদল লোক বলছে একসময় ওই বাড়িগুলোতে কোথা থেকে নাকি কিছু কাপালিক গোছের লোকজন এসে বসবাস করতে শুরু করে। অতটা রাস্তা উজিয়ে এসে লোকের ঘরবাড়ি থেকে হাঁসমুরগি চুরি করে নিয়ে যেত তারা। স্থানীয় লোকজন মিলে একদিন আক্রমণ করতে তারা নাকি কোথায় পালিয়ে যায়। দাঙ্গার সময়ে বহুলোককে গুমখুন করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ওখানে।
‘হ্যালো মিস প্রামাণিক…’
নিজের কিউবিকলের উল্টোদিক থেকে গোস্বামীর গলা পেয়ে মুখ তুলে তাকায় ঈশানী। ওর শিরদাঁড়াটা সোজা হয়ে যায়। গোস্বামী ওর দিকে এগিয়ে আসেন। চোখের দিক থেকে একবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘ব্যাপার কী? রাতে ঘুম হচ্ছে না?’
ঈশানী মুখে লজ্জার ভাব আনে, ‘আসলে কাজের প্রেশার এত বেড়েছে…ভাবলাম কিছু কাজ না হয় বাড়ি থেকেই করে দিই। তাই রাত জেগে…’
‘ওয়েল, চোখের তলায় কালি না পড়লে এপ্রেজাল, ইনক্রিমেন্ট কোনওটাই হয় না মাই ডিয়ার…’
‘পয়সা দিয়ে কী করব স্যার ঘুম না এলে?’
‘পয়সা ক্যান পে ফর ইয়োর ইএমআই। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি, ইএমআই-এর থেকে বেশি ঘুম আর কিছুই নষ্ট করতে পারে না।’
‘সেই জন্যেই আপনারা এমন ঝাঁ চকচকে অফিস সাজিয়ে রাখেন, না স্যার? যাতে এরকম বড়লোকের অফিস থেকে বেরিয়ে বারো টাকার বাসের টিকিট কাটতে গায়ে লাগে, চিল্ড এসি থেকে বেরিয়ে বর্ষায় ফ্যানের হাওয়া অসহ্য লাগে, আমার ধর্মতলার ফুট থেকে কেনা আড়াইশো টাকার শার্ট পরে আসতে পারি না…আপনারা জানেন ইএমআই-এর খাঁড়াটা ঘাড়ে না পড়লে আমরা বোকা পাঁঠার মতো এখানে ছুটে আসব না। তাই আপনারা সেক্স আর কন্ডোম দুটো একসঙ্গে বিক্রি করেন…’
‘তুমি কি আমাদের বেশ্যা বলতে চাইছ?’ গোস্বামীর মেজাজটা আজ ভালো আছে। মজার ছলেই জিগ্যেস করলেন তিনি।
‘বেশ্যা!’ ঈশানী আঁতকে ওঠে, ‘যার প্রতি অনুভূতি নেই, ক’টা পয়সার জন্য তার সঙ্গে সেক্স করে তাকে খুশি করা অনেক বড় জাতের অভিনয় স্যার। একটা আর্ট। ও আপনারা পারবেন না। আপনারা পয়সার জন্য শুধু চাটতে পারেন। ওইটুকুতে বেশ্যা হওয়া যায় না…’
এগিয়ে এসে ওর পিঠে হাত রাখেন গোস্বামী, ‘লাঞ্চ হতে চলল। ক্যাফেটেরিয়ায় এসো, কেমন?’
মাথার ফেট্টিটা আয়নায় দেখে ভালো করে এঁটে নেয় ঈশানী। তারপর ফোনের স্ক্রিন খোলা রেখেই ফ্লোর ছাড়িয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় চলে আসে।
মিনিটপাঁচেক আগেই লাঞ্চ হয়েছে। এখন সমস্ত জায়গাটা জুড়ে ওর অফিস কলিগরা কেউ বসে কেউ বা দাঁড়িয়ে আবার কেউ কেউ জটলা করে গল্প করছে। এদের কারো সঙ্গেই ঈশানীর তেমন একটা জমে না। তাও একটা পরিচিত টেবিলের ধার খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল ও।
একটু দূরেই বসেছেন গোস্বামী। এই টেবিলে বসে আছে অরুনাভ, হোসেন আর আলিশা। মুখদেখা একটা বন্ধুত্ব আছে ওদের সঙ্গে। তিনজনেই ওকে দেখে একবার হাসল, তারপর আবার ঝুঁকে পড়ল ফোনের স্ক্রিনের উপরে। ঈশানীর খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। তাও ভদ্রতার খাতিরে একটা মেকি আগ্রহ দেখানোর চেষ্টা করল, ‘কী দেখছিস তোরা?’
অরুনাভ ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে আড়মোড়া ভাঙল, ‘কলকাতার লোকজনেরও খেয়েদেয়ে কাজ নেই।’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘খবরটা দেখোনি তুমি?’ হোসেন নিজের ফোনটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। এতক্ষণ তিনজনে মিলে একটা খবর পড়ছিল ওরা। সেটাই আপাতত এগিয়ে দিয়েছে ঈশানীর দিকে। স্ক্রিনটা চোখের সামনে এনে হেডলাইনে চোখ রাখতেই ঈশানীর বুকের মধ্যে দিয়ে একটা গরম স্রোত নেমে গেল। হেডলাইনের সঙ্গে একটা ছবিও আঁকা আছে। ছবিটা ওর চেনা। ভীষণ চেনা।
ছবি থেকে ওর চোখ খবরের দিকে সরে আসে। ধীরে ধীরে পড়তে থাকে—শহর জুড়ে অদ্ভুত পাগলের উপদ্রব। গত দিন দশেক ধরে একদিন পরপর কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় মাঝরাতে ওয়ালকালার বা স্প্রে পেন্ট দিয়ে কারা যেন কার্টুন এঁকে দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় মিটারখানেক বর্গের জায়গা জুড়ে রঙিন কার্টুন। ছবিগুলো যে একজনেরই আঁকা সেটা বোঝা যাচ্ছে ছবির চরিত্রদের দেখে। বিষয়বস্তু আলাদা আলাদা হলেও চরিত্র মাত্র দুটি। একটা অল্পবয়সি মেয়ে, আর একটা অদ্ভুত দেখতে কাকতাড়ুয়া। তারা কোথাও একে অপরের সঙ্গে নাচছে, কোথাও ফাঁকা রাস্তার উপরে শুয়ে রাতের তারা দেখছে, আবার কোথাও একজন অন্যজনের ঘাড়ের উপর উঠে উঁকি দিচ্ছে ঘুমন্ত লোকের বাড়িতে। সব থেকে বেশি হইচই পড়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দেওয়ালে ভোরবেলা এরকম ছবি আঁকা থাকতে দেখে। রাতে যথেষ্ট প্রহরা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আঁকা হল ছবিটা তাই নিয়ে চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। এছাড়াও এখনও অবধি তারা কার্টুন এঁকেছে হাওড়া ব্রিজের থামে, ন্যাশনাল মিউজিয়ামের দরজায়, ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। সব থেকে বড় কথা যে বা যারা এ ছবি আঁকছে তাদের উদ্দেশ্যটা কী?
এই সমস্ত হেরিটেজ জায়গায় রং দিয়ে কার্টুন আঁকা উচিত কিনা সেই নিয়ে সেলেবদের মতামত ছেপেছে ফলাও করে।
অরুনাভ একটু ভেবে বলল, ‘ভিক্টোরিয়ায় ছবি আঁকল আর কেউ দেখতে পেল না?’
হোসেন খবরটা আগেই পড়েছিল, সে বলল, ‘মেন যে গার্ড সে বলছে তাকে নাকি তারই মতো দেখতে একটা লোক দুই থাপ্পড়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিল। তারপর থেকে আর কিছু মনে নেই। আর একজন গার্ড বলেছে সে ওই মেইন গার্ডকে নাকি একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে মেয়ে নিয়ে ফস্টিনস্টি করতে দেখেছে…’
খবরটা পড়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল ঈশানী। নিজের ফোনের স্ক্রিনে আবার মন দিল।
আলিশা বলে মেয়েটা কফিতে চুমুক দিচ্ছিল এতক্ষণ, সে ফোনটা হোসেনের হাতে ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘এতে ক্ষতি কী আছে? ছবিই তো এঁকেছে।’
‘সেটা বড় কথা নয়। ধরতে পারলে পুলিশে বাখান দেবে। তাও এতটা রিস্ক নিয়ে আঁকছে যখন কিছু তো উদ্দেশ্য আছে শালাদের।’ অরুনাভ বলে।
‘সমস্ত জায়গার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, সেখানে যা হোক একটা কিছু আর্ট গুঁজে দিলেই সেটা সুন্দর হয়ে যায় না। সেটা মোড়ের মাথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত হোক আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কাকতাড়ুয়াই হোক…’ হোসেন ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে।
‘আরে রাখ তোর সৌন্দর্য। আমার মনে হয় এরা অ্যানার্কিস্ট। আই মিন ডার্ক নাইটের জোকারের মতো। এইভাবে সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দেওয়াটাই এদের অ্যাজেন্ডা…’
আলিশা কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে শান্ত গলাতেই বলে, ‘আমার কিন্তু মনে হয় এটা এক রকমের আন্দোলন!’
‘কীসের আন্দোলন?’
‘আচ্ছা তুই ছেলেবেলায় কী হতে চাইতিস? আইটি প্রফেশনাল?’
‘উঁহু ট্রাক ড্রাইভার। একটা গেম এনে দিয়েছিল দাদা, তাতে ট্রাক চালাতে হত। সিমুলেশন গেম। সেইটা শালা একেবারে নেশার মতো হয়ে গেছিল। সেই থেকে শখ ছিল বড় হয়ে ট্রাক ড্রাইভার হব…’
‘তারপর হলি না কেন? স্কিল ছিল না?’
‘ছিল কিনা বুঝব কী করে? আমাদের দেশে, আমাদের মতো মিডল ক্লাস বাঙালি ফ্যামিলিতে চাইলেই ওসব হওয়া যায় না।’
আলিশা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কাঁধ ঝাঁকায়, ‘আমি ডান্সার হতে চেয়েছিলাম। এখন কর্পোরেট বসের আঙুলের ইশারায় ল্যাজ নাচাচ্ছি। আমাদের এই সিস্টেমটা না, আমাদের একটা নির্দিষ্ট দিকে বয়ে নিয়ে যায়। তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, তোমাকে ডাক্তার হতে হবে, তোমাকে ব্যবসা করতে হবে, নয় তোমাকে সরকারি চাকরি করতে হবে। তার বাইরে তোমার জীবনে কোনও অ্যাজেন্ডা থাকতে পারে না। তুমি ভালো ছবি আঁকবে কেন? না বায়োলজিতে মাছের পিত্তথলি আঁকতে সুবিধা হবে।
তুমি ভালো গান গাইবে কেন? না পাশের বাড়ির ব্যানার্জিবাবুর মেয়ে কি সুন্দর গান গেয়েছে…এই ঝাঁটের এডুকেশন সিস্টেম তৈরি করেছি আমরা, যার কাজই হচ্ছে একটা মানুষের ভেতরের শিল্পীসত্তাকে গুড়োগুড়ো করে ফেলা। আমরা যতদিন পারি নিজেদের ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়া প্রিয়জনদের মতো নিজেদের স্বপ্নগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখি। তারপর একদিন এইসবের চক্করে আমাদের সত্যিকারের ইচ্ছাগুলো, আমাদের আর্টগুলো মরে যায়। মরে যায়, আর বিচার পায় না…বাড়ির লোক মরার পর বিচার না পেলে লোকে আন্দোলন করে…’
‘কিন্তু এ কেমন আন্দোলন? কী লাভ হবে এসব করে?’
‘আন্দোলন লাভের জন্য হয় না। লাভ একটা মাড়োয়াড়ি কনসেপ্ট। আন্দোলন হয় লোকের অসুবিধা করার জন্য। আগে একটাকা বাসের ভাড়া বাড়লে মেট্রো ভাঙচুর হত। জোর করে জমি অধিগ্রহণ হলে রাস্তা অবরোধ হত, ধর্মঘট হত। জোর করে মানুষের শিল্পীসত্তাকে নষ্ট করে দেওয়ার বিরুদ্ধে এরকম একটা প্রতিবাদ হলে তাতে খারাপ কিছু অন্তত আমি দেখি না…’ কথাটা বলে ঈশানীর দিকে তাকায় আলিশা, ‘তোর কী মনে হয় ঈশানী? তুইও তো কার্টুন আঁকতিস?’
নিজের ফোনেই মন দিয়ে কী যেন দেখছিল ঈশানী। সেদিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলে, ‘চোখগুলো ঠিকঠাক হয়নি। নাকটা আরও লম্বা হত…’
হোসেন ফোন দেখতে দেখতে বলে, ‘সাত রাতে এগারোটা ছবি এঁকেছে। এত পারফেকশন নিয়ে কাজ করবে কী করে?’
‘ক’টা?’ আচমকাই মুখ তুলে প্রশ্ন করে ঈশানী।
‘এগারোটা। এই তো লিস্ট ধরে দিয়েছে। ভিক্টোরিয়া, পার্ক স্ট্রিট, রবীন্দ্রসরোবর মেট্রো…’
মনে মনে কী যেন হিসেব করে ঈশানী। ওর ভুরু দুটো কুঁচকে যায়। মনটা সেদিক থেকে সরিয়ে আবার নিজের ফোনের দিকে নজর দেয় ও। বিজলিমারির ক্যাম্পসাইট সম্পর্কে বেশ কয়েকটা ছোটখাটো খবরের লিঙ্ক খুঁজে পেয়েছে ও। সেগুলো ঘেঁটে দেখতে গিয়েই একটা আর্টিকালের ছবিতে ওর চোখ আটকে যায়।
এক সাংবাদিক বাড়িগুলোর ব্যাপারে খোঁজখবর করতে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এলাকার লোক দাবি করে ওর ভিতরে কিছু পুরোনো কাঠের ভাঙা আসবাব আর রান্নার জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই পড়ে ছিল না। তবে সেগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকজনই কোথাও সরিয়ে ফেলে।
কয়েকটা বাচ্চা ছেলের কাছ থেকে ধ্বংসস্তূপ থেকে নিয়ে আসা কিছু মাটির জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। সেগুলোরও ছবি আছে একটা। সেই ছবিতেই চোখ আটকেছে ঈশানীর।
একটা বাচ্চা ছেলের সামনে রাখা টেবিলে উল্টে রাখা আছে একটা কালচে হাঁড়ি। এই হাঁড়িটা ঈশানী চেনে।
ভিডিওর ডেসক্রিপশন বক্স থেকে সাংবাদিকের নাম্বারটা পাওয়া গেল। টেবিল থেকে উঠে ব্যালকনিতে এসে দ্রুত সেই নম্বরে কল করল ঈশানী। ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যালো…’
‘ইউটিউব থেকে পেলাম আপনার নম্বরটা।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু…’
‘বিজলিমারি ক্যাম্পসাইটের খবরটা আপনি কভার করেছিলেন। গ্রামের লোক ওই বাড়িগুলো থেকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসে। সেগুলো কী ছিল মনে পড়ছে আপনার?’
আর্টিকালটা অন্তত বছর দুয়েক আগের। মনে করতে একটু সময়ে লাগে মানুষটার, ‘তেমন দরকারি কিছু না। কিছু মাটির বাসনকোসন, আর…’
‘কালো হাঁড়ি?’
ভদ্রলোকের গলায় উচ্ছ্বাস খেলে যায়, ‘হ্যাঁ, কালো হাঁড়ি। প্রচুর কালো হাঁড়ি ছিল বাড়িগুলোতে। হাঁড়িগুলো দেখতে একটু অড। মানে সচরাচর ওরকমটা দেখা যায় না। তাছাড়া অতগুলো হাঁড়ি নিয়ে ওই ক’টা লোক ঠিক কী করছিল…’
‘কাকতাড়ুয়া বানাচ্ছিল।’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে ঈশানী।
দুপুরবেলা নিজের অফিসে বসে পা দোলাচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু। বাইরে একদল লোক বসে আছে। গলা তুলে একজন একজন করে ডেকে নিচ্ছে ও। মন দিয়ে তাদের সমস্যা শুনছে। তারপর এটা সেটা বুঝিয়ে দিয়ে কোনরকমে বাইরে বের করে দিচ্ছে। এই এলাকার কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে প্রতি মঙ্গলবার এই ব্যাপারটা চালু করেছে ও। এতে জনসংযোগ বাড়ে। কৃষ্ণেন্দু জানে মানুষের জন্য কী করছি সেটা বড় কথা নয়, কিছু করছি করছি বলে মনে হলেই ওষুধে কাজ দেয়।
‘পরের জন আসুন…’
পর্দা সরিয়ে বুড়োটাকে ঢুকতে দেখেই পিত্তি জ্বলে উঠল ওর। আজ প্রায় দশদিন হল রোজ আসছে লোকটা। রোজ একই দাবি। ওর ছেলের নাকি কি একটা প্রকল্পে টাকা পাওয়ার ছিল, সেটা কিছুতেই অ্যাকাউন্টে ঢুকছে না। কৃষ্ণেন্দু অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ওর হিসসাটুকু বুঝিয়ে না দিলে ওর পক্ষেও সে টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। টাকা তো ও একা খায় না, স্যাংশন করার ক্ষমতাও ওর একার নেই।
মুখটা ব্যাজার করে বোতাম খোলা জামার ফাঁক দিয়ে বুক চুলকে নিল কৃষ্ণেন্দু। তারপর তেমনি তেঁতো গলায় বলল, ‘আপনি আবার চলে এসেছেন দাদু? এভাবে দরজায় দরজায় ঘুরে কি কাজ হবে…’
ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখে বললেন, ‘তোমরা ভোটের আগে দরজায় দরজায় ঘুরলে, কাজ হল তো…’
কৃষ্ণেন্দু ধমক দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় আর একটা লোক ঘরে ঢুকে আসে। তাকে দেখে একটু ঘাবড়ে যায় কৃষ্ণেন্দু। লোকটা উচ্চতায় অন্তত সাড়ে ছ’ফুট। শরীর তো নয়, যেন পেশির প্রদর্শনী। চোখে কালো সানগ্লাস, গলার কাছে একটা ফেট্টি বাঁধা। গায়ের রং সাহেবদের মতো ফর্সা। মাথাজোড়া টাক। দেখলেই ভয় আর ভক্তি দুটোই একসঙ্গে জাগে।
কৃষ্ণেন্দু মুখ থেকে অবাক ভাবটা দ্রুত সরিয়ে ফেলল, ‘এই আপনি কে? ওনার হয়ে গেলে তারপর আপনি আসবেন…’
বৃদ্ধ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই লম্বা লোকটার পাতলা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল, ‘না না আমি ওনার সঙ্গেই এসেছি। মেসোমশাই, আপনি বসুন না…’
মেসোমশাই? এরকম দুবলা ভগ্নপ্রায় বৃদ্ধের বোনপোর এমন হলিউডি হিরোর মতো চেহারা! ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাস হয় না কৃষ্ণেন্দুর। বুড়োটা কি ভাড়া করে গুন্ডাটুন্ডা নিয়ে এসেছে? অবশ্য তাতেও ক্ষতি নেই। এই অফিসে ওকে চমকানোর ধক কোনও বাছাধনের নেই। সে যতই গাঁট্টাগোট্টা লোক হোক।
লোকটার দিকে তাকিয়েই কৃষ্ণেন্দু বলে, ‘দেখুন, ওনাকে তো বলেইছি, ওনার টাকাটা যদি নিতে হয়, আমাদের কথা একটু ভাবতে হবে। আগের আমলে তো কিছুই পেতেন না। আমরা তবু…’
ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ে কৃষ্ণেন্দুর গালে। দামড়া হাতের থাপ্পড় খেয়ে মুখটা প্রায় উল্টোদিকে ঘুরে যায় তার। মুখ দিয়ে গোঁৎ করে একটা শব্দ বেরিয়ে আসে। ঘাড়টা একটু হলে ভেঙে যাচ্ছিল। মুখ থেকে খানিকটা থুতু ছিটকে বেরিয়ে আছে তার। মুহূর্তে চেয়ার থেকে তেড়ে ফুঁড়ে উঠতে যায় কৃষ্ণেন্দু, ‘চুদির ভাই! তুই আমাকে চড়…’
আবার একটা চড় এসে পড়ে ওর গালে। আবার ঘাড় ঘুরে যায় পেছনে। বিষম ব্যথায় পাকস্থলী অবধি গুলিয়ে ওঠে। লাফিয়ে উঠে লোকটার গলা ধরতে চায় কৃষ্ণেন্দু কিন্তু হাত পৌঁছায় না। তার আগেই লোকটা ওর গলা টিপে ধরে।
কোঁকাতে কোঁকাতে বুড়োর দিকে তাকায় কৃষ্ণেন্দু, ‘গুন্ডা নিয়ে এসেছেন না? গুন্ডা নিয়ে এসেছেন? যা করার করে নে শুয়োরের বাচ্চা। ওইদিকে সিসিটিভিতে রেকর্ড হচ্ছে সব…যদি বেঁচে থাকি…’
আবার চড়।
অবশ হয়ে আসে কৃষ্ণেন্দুর গাল। হাঁপাতে হাঁপাতেই সে বলে, ‘তুই জানিস না পার্টিতে আমার কোথায় কোথায় হাত আছে…’
‘তার আগে তোর কোথায় কোথায় হাত দিয়ে চটকে দিই একবার দেখ…’ বলেই কৃষ্ণেন্দুর দুপায়ের ফাঁকটা সজোরে চেপে ধরে লোকটা। চিৎকার করে ওঠে কৃষ্ণেন্দু। ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে কান মাথা দিয়ে ফুটো হয়ে রক্ত বেরোবে এক্ষুনি। যন্ত্রণায় এবার কেঁদে ফেলে সে, ‘ও মেসো, ক্ষমা করে দিন মেসো। আপনার সই আমি করে দিচ্ছি…’
বুড়ো কিছু বলার আগেই লোকটা আবার চড় মারে ওর গালে। কৃষ্ণেন্দু আবার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আরে আবার মারছেন কেন, বললাম তো সই করে দিচ্ছি…’
‘সে তো মেসোমশাইয়ের কাজটা। আমার কাজটা?’
‘আ…আপনার আবার কী কাজ?’
ওকে মাটিতে নামিয়ে রেখে ওর ঘরের চারদিকটা ভালো করে নজর ঘুরিয়ে দেখে নেয় লোকটা। তারপর বলে, ‘এখানে তুই যে কাজটা করিস সেটা আদৌ তোর কাজ না। আই মিন ভগবান তোকে সে কাজের জন্য তৈরি করেনি…’ কথাটা বলে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে লোকটা। নীলচে স্বপ্নালু চোখে তাকায় ওর দিকে, ‘তুই বরঞ্চ যেটা ভালো পারিস সেটাই কর…’
‘কী? আমি…’
কৃষ্ণেন্দুর মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। লোকটার পাথরের মতো মুখে একটা হাসি খেলে গেছে ততক্ষণে। বুড়োর দিকে চেয়ে সে নরম গলায় নির্দেশ দেয়, ‘আপনি চোখ বন্ধ করে নিন মেসোমশাই…’ বলেই কৃষ্ণেন্দুর দিকে পেছন ফিরে একটু ঝুঁকে নিজের প্যান্টের বোতাম খুলে সেটা মাটিতে নামিয়ে ফেলে লোকটা। চড়া এসিতেও কৃষ্ণেন্দু অদ্ভুতরকম ঘামতে থাকে।
দশমিনিট পর আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় লোকটা। ঠাসিয়ে আর একটা চড় মারে কৃষ্ণেন্দুর গালে। ঘরের সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা একবার দেখে। চোখ মারে। তারপর এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
লোকটা বেরিয়ে যেতে দু’সেকেন্ড সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে কৃষ্ণেন্দু। তারপর চাপা চিৎকার করে ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই গর্জন শোনা যায়, ‘চুদির ভাইটাকে বেরতে দিবি না, ফরসা করে, টাকমাথা…’
অভিজিৎ কৃষ্ণেন্দুর অফিসের দরজা সামলায়, ফোনের ওপাশে তারও চিৎকার শোনা যায়, ‘আমাকে ধাক্কা মেরে এক্ষুনি বেরিয়ে গেল স্যার। গায়ে কী জোর!’
কৃষ্ণেন্দুর লাল মুখ হিংস্র নেকড়ের মতো দেখায়, ‘কোয়ি বাত নাহি। সিসিটিভি আছে। যেখানেই থাক হিঁচড়ে টেনে আনব। মাদারচোদকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে…’ কথাটা বলতে বলতেই এগিয়ে গিয়ে বুড়োর কলার খামচে ধরে কৃষ্ণেন্দু, ‘শুয়োরের বাচ্চা, বল কোত্থেকে ভাড়া করে এনেছিলি…’
বুড়ো খাবি খায়, ‘আমি আনিনি স্যার। ও বাইরে বসেছিল। নিজে বলল আমার সঙ্গে আসবে। তারপর থেকে আমি কিছুই…’
ধাক্কা মেরে বুড়োর মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দেয় কৃষ্ণেন্দু, ‘ধরে আনি ওকে, তারপর তোর বিচিও ফাটাব আমি…’
টেবিলে ফিরে যায় ও। পার্টিরই দুটো ছেলে আর অভিজিৎ এতক্ষণে ঘরে ঢুকে ঝুঁকে পড়েছে সিসিটিভি ফিডের উপর। রিওয়াইন্ড করে একটু আগের দৃশ্য চালানো হয়েছে সেখানে।
কৃষ্ণেন্দু আবার চাপা গর্জন করে, ‘শেষে যা, শেষে। একবার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিল শুয়োরের বাচ্চাটা, মুখটা দেখ…’
একটু এগিয়ে ঠিক সেই টাইমস্ট্যাম্পেই স্ক্রিন ফ্রিজ করে অভিজিৎ। লোকটা ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসছে। নিজের মুখটা ভালো করে দেখছে। তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়েই একবার চোখ মেরে দৌড় লাগাচ্ছে। মুখটা দেখতে পেয়েই সে স্তব্ধ হয়ে যায়। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে আছে লোকটার মুখ।
‘এই…এই চুদির ভাইটা…রাস্তাঘাটে যেখানে দেখতে পাবি জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিবি…’ কৃষ্ণেন্দুর গলা হুঙ্কারের মতো শোনায়।
‘এই লোকটা এসেছিল আপনার ঘরে?’ অভিজিৎ মিনমিনে গলায় জিগ্যেস করে।
‘কেন? চিনিস একে?’
‘একটা প্রশ্ন করব স্যার?’
‘কী প্রশ্ন?’
অভিজিৎ ওর দিকে হতবাক মুখ তুলে তাকায়, ‘আপনি কি শুধু দেশি পানু দেখেন?’
‘মানে? কী বলতে চাইছিস কী?’
‘বিদেশি দেখলে আপনিও লোকটাকে চিনতে পারতেন। লম্বা, টাকমাথা, জমকালো ফিগার, নীল চোখ, চওড়া হাসি…’
নিজের ফোনে কী একটা নাম লিখে সার্চ করে দেখায় অভিজিৎ। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে স্থির চোখে চেয়ে থাকে কৃষ্ণেন্দু। শিরদাঁড়া দিয়ে কোথায় যেন ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় তার।
অভিজিৎ জিজ্ঞেস করে, ‘ক্লিপটা কি পুলিশে দেব স্যার?’
‘না…’ থমথমে গলায় বলে কৃষ্ণেন্দু, ‘ডিলিট করে দে…’
সাড়ে দশটার কাছাকাছি বেজেছে। লালবাজারের বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল কয়েকটা খোলা। দোকানগুলোর দিকে দেখতে দেখতেই চারু বলে, ‘আজ এত তাড়াতাড়ি বেরোলি যে, কিছু প্ল্যান আছে নাকি?’
‘আছে তো…’ একটা মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকানের সামনে হুট করেই স্কুটিটা দাঁড় করাতে করাতে বলে ঈশানী।
চারু হেলমেট খুলে অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে, ‘এখানে, এখানে কী হবে?’
‘তুই দাঁড়া এখানে। আমি আসছি…’ কথাটা বলে দোকানের ভিতরে ঢুকে যায় ঈশানী। মিনিটখানেক পরেই একটা মাঝারি সাইজের বাক্স হাতে বেরিয়ে আসে বাইরে।
‘এতে কী আছে?’ চারু অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।
‘খুলে দেখ…’
সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বাক্সটা খুলতে থাকে চারু। এত রাতে চারদিকের রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। মাথার উপর দিয়ে যাওয়া জট পাকানো ইলেক্ট্রিকের তার আর লাইটপোস্টের ছায়া চাঁদের আলো ফুঁড়ে জেগে আছে রাস্তার উপরে। তার সঙ্গে মিশেছে কলকাতার হলদে সোডিয়াম ভেপারের আলো।
বাক্সটা খুলে ফুটপাথেরই একদিকে সরে আসে চারু। একটা দোতারা বের করে এনেছে তার ভিতর থেকে। অবাক হয়ে একবার ঈশানীর দিকে আর একবার দোতারাটার দিকে তাকিয়ে দেখল সে, ‘আ…আমি এটা বাজাই তুই জানলি কেমন করে?’
‘চরণদাস বাউল বলল মাঠের কাকতাড়ুয়াটা নাকি হাঁ করে ওর গান শুনত। তাই থেকেই বুঝলাম…পরশু ফোন করে ওদের বলে রেখেছিলাম। আজ আনিয়ে রেখেছে…’
দোতারার তারগুলোর উপর আদর করে আঙুল বোলাতে থাকে চারু। উজ্জ্বল হাসিতে ভরে ওঠে ওর মুখ, ‘তোকে যে আমি কী বলব মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না…’
‘বলতে হবে না। গেয়ে শোনালেই হবে…’
স্কুটিটা পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করে ওরা। রাস্তার একদিকে বন্ধ চশমার দোকান। বাইরে বিশাল আকারের ফাঁকা ফ্রেমের কাটআউট। সেগুলোর ভিতর দিয়ে কারা যেন চেয়ে থাকে ওদের দিকে। পুরোনো বাড়িঘরের ভিতর বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিল ছাদের ঘর থেকে কে বুঝি ছাদের পাঁচিলে এসে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে রাস্তার দিকে।
ঈশানী চারুর দিকে চেয়ে বলে, ‘তুই শুধু দেখে দেখে দোতারা বাজাতে শিখে নিয়েছিলি?’
‘সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে সব কিছুই ইন্টারেস্টিং লাগে। দিনের পর দিন ও বাজাত আর আমি শুনে যেতাম। শেষে শিখে গেলাম…’
একটা গলির মধ্যে আলোছায়া জায়গা বুঝে সরে আসে ওরা। রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া একটা বেঞ্চ আছে এখানে। পুরোনো চাতালের ভাঙা অংশ সেই বেঞ্চের সঙ্গে জুড়ে আছে। দেখে বোঝা যায় এককালে এখানে পুরোনো কলকাতার রোয়াক ছিল। পাড়ার বয়স্করা সন্ধেবেলা বসে বসে আড্ডা দিত। এখন প্রগতির অত্যাচারে সে রোয়াকের একটা অংশ তাদের নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
বেঞ্চের উপরে বসেই দোতারাটা বাগিয়ে ধরে চারু। ঈশানী পা ছড়িয়ে নিচে চাতালের উপর বসল। যেন এক্ষুনি গানের মজলিশ শুরু হবে। আরাম করে সেটাই দেখতে বসেছে। মুখে টলটলে হাসি খেলা করছে তার। গান শুরু করতে যাচ্ছিল চারু, কিন্তু তার আগেই থেমে যায়।
‘আবার কী হল? শুরু কর…’ ঈশানী ভুরু কুঁচকে বলে।
‘উঁহু, একটা জিনিস মিসিং…’
‘কী জিনিস?’
‘চরণদাস যখন গান গাইত ওর পায়ে একটা ঘুঙুর বাঁধা থাকত। ওটা দিয়ে গানের তাল রাখত। সেটা এখানে নেই…’
‘তাহলে কী হবে?’ ঈশানীকে অস্থির দেখায়।
‘একটা ব্যাবস্থা আছে…’ বেঞ্চ থেকে উঠে ঈশানীর সামনে গিয়ে বসে পড়ে চারু। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে আনে। ঈশানী তাকিয়ে দেখে জিনিসটা নূপুর।
ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গোড়ালির কাছ থেকে লং স্কার্টটা একটু উপরে তুলে পায়ে সেটা পরিয়ে দেয় চারু। ঈশানী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে। চাঁদের আলোয় ছেলেটার অদ্ভুত মায়াবি মুখটা আশ্চর্য নরম দেখায়। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতের রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় তার, ‘আমি গান গাইলে তোকে নাচতে হবে…’
‘তাই? তাহলে দেখবে কে?’
‘আমরা। শুধু এখন নয়, যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন।’ ঈশানীর কপালে আঙুল রাখে ছেলেটা, ‘এখান দিয়ে। আয়…’
চারুর হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। দোতারাটা বাজতে শুরু করেছে। তার তালে তালে নাচতে থাকে ঈশানী। রুনরুন করে ওর পাতলা নূপুরটাও তাল মিলিয়ে বাজতে শুরু করে দোতারার শব্দের সঙ্গে।
নিজের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়ে একমনে বাজিয়ে চলেছে ছেলেটা। দোতারাটা ওর হাতের সঙ্গে মিশে গেছে যেন। ঈশানী ওর পেছনে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে মাথা রাখে ওর কাঁধে।
ছেলেটা এখনও গেয়ে চলেছে। দু’হাতে ছেলেটার কোমর জড়িয়ে ধরে ঈশানী। এতদিন অভ্যাস নেই বলে এইটুকু নেচেই হাঁপিয়ে গেছে ও। দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে থাকে।
বহুদিনের জমা যন্ত্রণা ছেলেটার কাঁধের উপর যেন নেমে যায় সেই নিঃশ্বাস বেয়ে…