ছয়
বার্ন শহরের কালচে আকাশ থেকে ঝরঝর ঝরছে পেঁজা তুলার মত সাদা তুষার। আজকের দিনটা যেন কাটতেই চাইছে না। এবার একটা কিছু ঘটুক, কামনা করছে অস্থির বিক্ষোভকারীরা। রাস্তায় রাখা স্টোভের গনগনে আগুনের ধারে বসে তাদের দিকে চেয়ে আছে ডিলান অ্যাকোলা।
সকালে চেঁচামেচি-হৈ-চৈ হলেও এখন কেমন যেন দমে গেছে বিক্ষোভকারীরা। সবাই ক্লান্ত ও শীতার্ত। রাস্তার নানান জায়গায় সমবেত হয়ে আলাপ করছে নিজেদের ভেতর। অনেকের হাতে হার্বাল সিগারেট, কালো চায়ের কাপ বা ডিক্যাফ কফির ফ্লাস্ক। এরই ভেতর হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে অনেকে। তারপরও রয়ে গেছে চার শ’র বেশি বিক্ষোভকারী।
সকালে হোটেলের নিজস্ব এলাকায় ঢুকতে চেয়েছে তারা। কিন্তু বড়লোকদের কনফারেন্সে সিকিউরিটি সিস্টেম বড়ই কঠোর। উঁচু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যানার দুলিয়ে আদতে কোনও লাভই হয়নি। এরপর সে সুযোগও আর থাকল না। তাদেরকে দূরে সরিয়ে নিজেদের ভ্যান ও মোটর সাইকেল রাস্তায় রেখে ব্যারিকেড তৈরি করল এক শ’র বেশি পুলিশ। তারাও স্বস্তিতে নেই। ভাল করেই জানে, জনবলের দিক থেকে তারা নগণ্য।
সফেদ তুষারে ছাওয়া লনের কয়েক শ’ গজ দূরে বিশাল হোটেল। কনফারেন্স বিল্ডিঙের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একই মডেলের তেরোটা কালো লিমাযিন। মিনিট খানেক আগে অ্যাকোলার প্রেমিকা অ্যানা দেখেছে, হোটেলের সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একদল ড্রাইভার। দেরি না করে নিজেদের গাড়ির ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলেছে তুষার। ওটা দেখেই অ্যানা বুঝেছে, এবার কিছু না কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
‘ওই যে, ওরা আসছে!’ চিৎকার করে উঠল কেউ।
নিজেদের ব্যানার অস্ত্রের মত করে তুলে হোটেলের দিকে তাক করল বিক্ষোভকারীরা। এসব ব্যানারে একই কথা লেখা: বন্ধ করো প্রাকৃতিক দুর্যোগ! বিপর্যস্ত ইউরোপকে উদ্ধার করবে এডি অ্যামন!
অ্যানার বিনকিউলার চোখে তুলে কনফারেন্স বিল্ডিঙের দিকে তাকাল ডিলান অ্যাকোলা। খুলে গেছে নিচতলার চওড়া গেট। তুষারপাতের ভেতর বেরিয়ে এল ব্যবসায়ীদের ছোট দলটি। তাদের ভেতর সবচেয়ে তরুণ বিলিয়নেয়ারের বয়স হবে অন্তত পঞ্চাশ। প্রত্যেকের পরনে দামি সুট। বয়স্কদের মাথায় হ্যাট। গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর জন্য হোটেলের পথে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে লবণ। এখন আর তুষারে পা পিছলে পড়বে না কেউ। বিলিয়নেয়ারদের মাথার ওপর ছাতি ধরে পাশে পাশে হাঁটছে হোটেলের স্টাফরা। এদিকে সাদা হোণ্ডা প্যান ইউরোপিয়ান মোটর সাইকেলে চেপে বসেছে একদল পুলিশ। তাদের পাশেই সাদা পোশাকে রেডিয়োতে কথা বলছে সিকিউরিটির একদল লোক।
একইসময়ে তেরোটা লিমাযিনের পেছন-দরজা খুলে দিল ড্রাইভাররা। যন্ত্রের মত যার-যার গাড়িতে উঠল তেরোজন বিলিয়নেয়ার। ধুপ্ শব্দে বন্ধ হলো পেছনের দরজা। চেহারায় শ্রদ্ধা-ভক্তি ফুটিয়ে তুলে তুষারপাতের ভেতর গাড়ির পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল হোটেলের স্টাফরা। কয়েক মুহূর্ত পর রওনা হলো কালো গাড়ির কনভয়। প্রাইভেট রোড ধরে নিঃশব্দে এগোচ্ছে হোটেলের উঁচু গেট লক্ষ্য করে। বিশাল গেটের ওদিকে অপেক্ষা করছে শত শত বিক্ষোভকারী। লিমাযিনের কনভয়ের সামনে সামনে চলেছে পুলিশের মোটর সাইকেল বহর। লিমাযিনগুলোর পেছনে সিকিউরিটির চারটে গাড়ি।
প্রথম লিমাযিনের পেছন-সিটে বসে আছেন ষাট বছর বয়সী এক ভদ্রলোক। পরনে অভিজাত পোশাক। তাঁর নাম লুকা ব্রুনার। তিনিই এই বিলিয়নেয়ার কমিটির প্রেসিডেন্ট এ মুহূর্তে কোলে দু’হাত রেখে শান্ত চেহারায় উত্তেজিত সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ দেখছেন।
লুকা ব্রুনারের সিটের উল্টো দিকে বসেছে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট। বয়স বড়জোর তিরিশ। আগে ছিল আর্মিতে। চুলে ক্রু-কাট ছাঁট। পেশিবহুল দেহ। চোখে বিরক্তি ও রাগ নিয়ে দুলন্ত ব্যানার দেখছে সে। গ্লাভ্স্ পরা হাত তুলে বিক্ষোভকারীদের দেখাল। ‘সবই গাধার বাচ্চা! দেখুন, স্যর, বাঁদরের মত কেমন লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে! কিন্তু এসব করে ওদের লাভ কী?’
‘গণতন্ত্র বা সাম্যবাদ ওদেরকে দিয়েছে স্বাধীনতার মিথ্যা স্বপ্ন,’ নরম সুরে বললেন লুকা ব্রুনার। চেয়ে আছেন বিক্ষোভকারীদের দিকে।
লিমাযিনের কনভয় পৌঁছে যেতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল হোটেলের চওড়া গেট। এবার সুযোগ এসেছে ভেবে কালো গাড়িগুলোকে ঘিরে ফেলতে চাইল বিক্ষোভকারীরা। শুরু হয়েছে হৈ-চৈ আর চিৎকার। এদিক-ওদিক দুলছে ব্যানার। সকালে আরও অনেক মানুষ ছিল, খেয়াল করলেন লুকা ব্রুনার। বছর দুয়েক আগেও তাঁরা এসব মিটিং ডাকলে বড়জোর হাজির হতো আট-দশজন হিপ্পি। অনায়াসেই তাদেরকে লাঠিপেটা করে বিদায় করত পুলিশ। তবে আজকাল বদলে গেছে পরিস্থিতি।
সামনের লিমাযিন ঘিরে ধরল একদল বিক্ষোভকারী তাদের ওপর চড়াও হলো পুলিশবাহিনী। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে তুলছে নিজেদের ভ্যানে। প্রতিবাদের মাত্রা বাড়ছে ক্রমেই। একজন তরুণের হাতের ব্যানারে লেখা: বন্ধ করো প্রাকৃতিক দুর্যোগ! বিপর্যস্ত ইউরোপকে উদ্ধার করবে এডি অ্যামন!
গাড়ির পথ রুদ্ধ হতেই তরুণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজন পুলিশ অফিসার। ঠাস্ করে গাড়ির উইণ্ডশিল্ডে লাগল ব্যানারের দণ্ড। রঙিন কিছু অক্ষর দেখা গেল কাঁচের ওদিকে।
এডি অ্যামন নামটা ইদানীং বেশি বেশি শুনছেন লুকা ব্রুনার। ওই লোকই খেপিয়ে তুলছে এইসব বেয়াড়া তরুণদেরকে। প্রকৃতি-বান্ধব সব স্টান্ট ব্যবহার করে মাত্র কয়েক বছরে শূন্য থেকে বিপুল জনপ্রিয়তা কামিয়ে নিয়েছে এই ইউরোপলিটিশিয়ান। এখন আর সামান্য হিপ্পির গোষ্ঠী নয় তার দল। আজকাল এডি অ্যামনের জন্য প্রাণ দিতে রাজি হবে এমন মানুষের অভাব নেই। বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা ঝুঁকে পড়েছে তার প্রতি। আর সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থার দিকে এগোচ্ছে ক্রমেই।
ব্যাগ থেকে একবাক্স ডিম নিল ডিলান অ্যাকোলা। সে চিরকালের নিরামিষভোজী বলে কোনও ডিম কখনও ভাঙে না। তবে এই ডিমগুলো পচে গেছে বেশ কয়েক মাস আগে। আর তাই আজ কিনে এনেছে দোকান থেকে। প্রথম লিমাযিন এগিয়ে আসতেই হাসতে হাসতে ডিমের বাক্স হাতে উঠে দাঁড়াল সে। জ্বলজ্বল করছে দামি গাড়ির হেডলাইট। লিমাযিনের পেছনের দরজা লক্ষ্য করে ছুঁড়বে বলে বাক্স থেকে একটা ডিম নিল সে। তখনই ক্যান থেকে একগাদা রঙ স্প্রে করল কেউ কালো গাড়ির জানালা বরাবর।
গাড়ির জানালায় অ্যাকোলা ডিম ছুঁড়বার আগেই সরসর করে নেমে গেল জানালার কালচে কাঁচ। বরফের মূর্তি হলো ডিলান অ্যাকোলা। এ মুহূর্তে শুনছে না শত শত মানুষের হৈ- চৈ। লিমাযিনের পেছন সিটে বসে সরীসৃপের মত শীতল চোখে তাকে দেখছেন বয়স্ক এক লোক। এমনই তাঁর শিরার ভেতর রক্ত যেন জমাট বেঁধে গেল অ্যাকোলার। হাত তুলে থমকে গিয়ে টের পেল, অবশ হয়েছে ওর বাহু। হাতের ভেতর কী যেন মুড়মুড় করে ভাঙল। পিঠ বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল ভীষণ ঠাণ্ডা ভয়ের একটা স্রোত। আবারও উঠে আটকে গেল জানালার কাঁচ। নিঃশব্দে এগোল লিমাযিন।
নিজের হাতের দিকে তাকাল ডিলান অ্যাকোলা। আঙুল বেয়ে নামছে পচা ডিমের দুর্গন্ধময় কুসুম। একে একে তাকে পাশ কাটিয়ে গেল গাড়িগুলো। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল অ্যাকোলা। তারপর আবারও শুনল বহু মানুষের প্রতিবাদের চিৎকার। তখনই মুঠো করে ওর মাথার চুল ধরল এক পুলিশ অফিসার, হ্যাঁচকা টানে ফেলে দিল রাস্তায়। বুক ও পিঠে লাগছে একের পর এক লাথি।
ওদিকে হেলান দিয়ে পেছন-সিটে বসলেন লুকা ব্রুনার। দু’পাশে মোটর সাইকেলে চেপে এগিয়ে চলেছে পুলিশের আউট রাইডার। বেজে উঠল মিস্টার ব্রুনারের ফোন। ধীরে- সুস্থে ওটা তুলে নিয়ে কানে ঠেকালেন তিনি।
‘হোটেলে যাওয়ার আগেই চলে গেছে ওই মেয়েটা,’ ওদিক থেকে জানাল এক লোক। কণ্ঠে চাপা ভীতি। ‘আমরা পৌছুতে আধঘণ্টা দেরি করে ফেলেছি, স্যর।’ তুষারে ছাওয়া টিলার দিকে চেয়ে চুপচাপ তার কথা শুনছেন বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রুনার। ‘তবে একটা ঠিকানা পেয়েছি, স্যর। আবারও খুঁজে নেব মেয়েটাকে।’
‘ঠিকানাটা বলো।’
নোটপ্যাড নিয়ে ঠিকানা লিখলেন ব্রুনার। কাজটা শেষ হলে কোনও কথা না বলে ফোন রেখে দিলেন। কন্সোলের নির্দিষ্ট বাটনে চাপ দিতেই চালু হলো ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টিভি। ডিভিডি অন করে পর্দায় চোখ রাখলেন তিনি।
লণ্ডনের নাম করা এক টেলিভিশন স্টুডিয়োতে বড় একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে মেয়েটি। সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে জমজমাট ইন্টারভিউ। মেয়েটির মুখের প্রতিটা অভিব্যক্তি খেয়াল করছেন লুকা ব্রুনার। চকচক করছে ওর কাঁচ বসানো কাশ্মীরী ড্রেস। গলা ও কানে ঝিলিক দিচ্ছে দামি মুক্তো। দারুণ মানিয়ে গেছে মেয়েটার কুচকুচে কালো চুলের সঙ্গে।
‘দারুণ সুন্দরী, তাই না, স্যর?’ লুকা ব্রুনারের উদ্দেশে বলল তাঁর সহকারী।
স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন বিলিয়নেয়ার, ‘সত্যিই, অপূর্ব রূপসী।’ তিনি ভিডিয়ো স্টপ করতেই কালো হলো স্ক্রিন। সহকারীকে একবার দেখে নিয়ে পাশে রাখা নোটপ্যাডে চোখ বোলালেন। ওপরের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ওটা ধরিয়ে দিলেন সহকারী যুবকের হাতে। নিচু গলায় বললেন, ‘উপযুক্ত ব্যবস্থা নাও, মাইক।’