1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৫

পাঁচ

লণ্ডন।

ঐতিহ্যবাহী পাঁচতারা হোটেল দ্য নেড।

বিলাসবহুল ফয়েতে ঢুকে রিসেপশন কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মাসুদ রানা। গম্ভীর কণ্ঠে সুন্দরী রিসেপ- শনিস্টকে বলল, ‘আপনাদের লিউটেন্স সুইটে উঠেছিলেন এমিলিয়া বেকার। তিনি কি এখনও ওখানে আছেন?’

তিন মিনিট পর লিফটে চেপে অষ্টমতলায় উঠল রানা। ধাতব দরজা খুলে যেতেই সামনে পড়ল চওড়া করিডোর। নরম, পুরু কার্পেটে ডুবে গেল ওর জুতোর গোড়ালি। সুইটের দিকে পা বাড়িয়ে ভাবল: কী ধরনের বিপদ যে ওকে ডাকল লিয়া? এতদিন পর কীভাবে শুরু হবে ওদের আলাপ?

লিউটেন্স সুইটের দিকে পা বাড়িয়ে ওটার দরজার সামনে এক লোককে দেখল রানা। ওর মনে হলো না কোনও অতিথির জন্যে অপেক্ষা করছে সে। দরজার দিকে পিঠ রেখে কঠোর চোখে দেখছে ওকে। জবাবে নিজেও তাকে আপাদমস্তক দেখে নিল রানা। লোকটা দানবের মত বিশাল আকৃতির। ওর চেয়ে অন্তত সাতইঞ্চি উঁচু। চওড়ায় দ্বিগুণ। ওজনেও রানার চেয়ে কমপক্ষে দেড় শ’ পাউণ্ড বেশি হবে। পরনে কমদামি কালো পলিয়েস্টার কাপড়ের সুট। ফুলে আছে বুক ও বাইসেপের কাছে। যে-কোনও সময়ে ফোলা পেশির চাপে ফাটবে সস্তা পোশাকের সেলাই। বছরের পর বছর স্টেরয়েড ব্যবহার করেছে বলে ব্রণে ভরা মুখটা হয়েছে চাঁদের জমির মত উঁচু-নিচু। বিশাল কাঁধের ওপর বসানো ছোট্ট ন্যাড়া মাথাটা আচ্ছামত কামানো।

হাঁটার গতি না কমিয়ে সরাসরি দানবের সামনে থামল রানা। ‘এমিলিয়া বেকারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

বুকের ওপর দু’হাত ভাঁজ করে মাঝারি সাইজের গাছ- পাকা বেল আকৃতির মাথাটা নাড়ল লোকটা। মুহূর্তের জন্যে চোখে দেখা দিল তাচ্ছিল্য। পিনপিনে সরু কণ্ঠে বলল, ‘কেউ দেখা করতে পারবে না। তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না এখন।’

‘আমি তার বন্ধু। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে ও।’

প্রায় দু’কানের কাছে থাকা চোখদুটো কঠোর দৃষ্টিতে দেখছে রানাকে। ‘কই, আমাকে তেমন কিছু বলা হয়নি।’

‘তাকে গিয়ে জানান আমি এসেছি,’ বলল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা।’

আবারও মাথা নাড়ল দানব। ‘না, সে উপায় নেই।’

‘আমাকে ভেতরে যেতে দিন,’ সহজ সুরে বলল রানা। ‘যা তো তুই! গেলি! নইলে পেঁদিয়ে তোকে মুতিয়ে ছাড়ব বলে দিচ্ছি!’

দরজায় টোকা দেবে বলে হাত তুলল রানা। কিন্তু খপ্ করে ওর কবজি ধরল দৈত্য।

‘গায়ে হাত দেয়া ঠিক হচ্ছে না,’ নরম কণ্ঠে বলল রানা।

জবাব দেয়ার জন্যে হাঁ করল লোকটা, কিন্তু পরক্ষণে মুচড়ে নিয়ে রিস্ট লক করল রানা। পিঠের ওপরে নিয়ে গেছে হাতটা। আরেকটু চাপ পড়লে মট্ করে ভাঙবে হাড়। ব্যথা এতই বেশি, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল লোকটা। আপাতত কিছু করার নেই তার।

‘আমরা বরং আবারও প্রথম থেকে আলাপ করি,’ বলল রানা। ‘আমি এখানে এসেছি এমিলিয়া বেকারের সঙ্গে দেখা করতে। তোমাকে ব্যথা দিতে চাই না, তবে বাড়াবাড়ি করলে বাধ্য হব। ওই সুইটে ঢুকতে চাই। তুমি কি আমাকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে যাবে?’

‘হ্যাঁ… হ্যাঁ, নেব! হাতটা ছেড়ে দিন!’ ব্যথা আর ভয়ে কাঁপছে দৈত্যের মিহি গলা। নড়ার সাধ্য বা সাহস নেই।

এ পর্যায়ে খুলে গেল সুইটের দরজা। বেরিয়ে এসেছে আরও দুই দৈত্য। তাদের পরনেও সস্তা সুট। তবে প্রথমটার তুলনায় এদুটো কিছুটা ছোট দৈত্য। মনে হয় ছোট প্রদীপের ঘষায় এসেছে।

সতর্ক, কঠোর দৃষ্টিতে তাদেরকে দেখল রানা। ‘আমাকে ভেতরে যেতে দাও, নইলে ভেঙে দেব তোমাদের সঙ্গীর হাতটা।’

দু’বডিগার্ডের পেছনে দেখা দিয়েছে এমিলিয়ার পরিচিত মুখ। ওকে দেখে একপাশে সরে গেল তারা।

এমিলিয়া অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি এঁকে চিনি।’

‘হ্যালো, লিয়া,’ চাপা শ্বাস ফেলল রানা।

ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা। ‘আমার বডিগার্ডদের মারধর করছ কেন?’

মিষ্টি কণ্ঠস্বরটা শুনে মৃদু হাসল রানা। আগের মতই মধু ঝরছে ওই গলা থেকে। কণ্ঠে ওয়েস্-এর হালকা টান। মুচড়ে ধরা হাতটা রানা ছেড়ে দেয়ায় মেঝেতে বসে হাঁফাতে লাগল স্টেরয়েডসেবী দানব।

আঙুল তুলে তাকে দেখাল রানা, ‘তো এরাই তোমার বডিগার্ড? ব্যাপারটা বেশ দুঃখজনক!’

দরজার কাছে নার্ভাস হয়ে পরস্পরকে দেখছে ছোট দুই দানব। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বড় দৈত্য। তার চোখে চোর- চোর ভাব। বগলের কাছটা ডলতে ডলতে মৃদু গুঙিয়ে উঠল।

‘ভেতরে এসো,’ রানাকে আমন্ত্রণ জানাল লিয়া। কাঁধের ধাক্কায় দু’দিকের দুই বডিগার্ডকে ঠেলে সরিয়ে সুইটে ঢুকল রানা। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে লিয়ার লিউটেন্স সুইট। বাতাসে রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলের সুবাস। ওর পেছনে দরজাটা বন্ধ করল লিয়া। করিডোরে রয়ে গেল তিন বডিগার্ড।

অনিশ্চয়তা নিয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে রানা ও লিয়া।

‘কীভাবে যেন পেরিয়ে গেল ছয়টা বছর, তাই না?’ অস্ফুট স্বরে বলল মেয়েটা।

আগের মতই লিয়ার হালকা শরীরটা উইলো গাছের মতই নমনীয়। গায়ের ত্বক পাকা জলপাইয়ের মত। আর ওই সবুজ দুই চোখে খেলছে অদ্ভুত এক কষ্ট। পরনে ফেডেড জিন্স ও নেভি সোয়েটার। মুখে মেকআপ নেই। কোনদিনও ওসব লাগত না ওর। গহনা বলতে কণ্ঠে চিকন একটা চেইন। ওটা থেকে ঝুলছে সোনার লকেট। কাঁধে লুটিয়ে পড়েছে মসৃণ, কুচকুচে কালো এলো কেশ। আগের মতই রানার কল্পনার রাজ্যের রাজকুমারী রয়ে গেছে এই অপ্সরা। অজান্তে ঢোক গিলল রানা।

‘তা হলে সত্যিই এলে, মাসুদ রানা,’ শীতল সুরে বলল এমিলিয়া বেকার। ‘সবসময় ভেবেছি, দেখা হলে কষে একটা চড় দেব তোমার গালে।’

‘আজ কি সেজন্যেই ডেকেছ?’ জানতে চাইল রানা। ‘আমি তো হাজির। চাইলে ইচ্ছেপূরণ করতে পারো।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আসবেই না।’

‘গতরাতে পেয়েছি তোমার মেসেজ। তারপর প্রথম সুযোগে চলে এসেছি।’

‘আমি তো ভয়েস মেইল করেছি কয়েক দিন আগে।’

‘ব্যস্ত ছিলাম, তাই বন্ধ ছিল আমার ফোন,’ বলল রানা। ‘হ্যাঁ, আগের মতই ব্যস্ত,’ মৃদু টিটকারির সুরে বলল লিয়া। ‘কথা না রাখার অভ্যেসটাও তো তোমার ঢের পুরনো।’

নির্বাক রানা বলল না, যে-বৃদ্ধকে পিতার মত ভক্তি করে, তাঁর নির্দেশে গভীর রাতে বিমানে চেপে দেশে ফিরতে হয়েছিল ওকে। এরপর বেশ ক’সপ্তাহ যেখানে ছিল, কারও সঙ্গে যোগাযোগের উপায় ছিল না।

‘গতকাল ভয়েস মেসেজ পেয়ে ভাবলাম, আমার সাহায্য তোমার দরকার,’ বলল রানা, ‘তবে এখন মনে হচ্ছে আমাকে দেখে তুমি অখুশি। সেক্ষেত্রে আমি কি চলে যাব?’

চোখ তুলে ওকে দেখল লিয়া। ‘তোমার সাহায্য আর লাগছে না। খুব ভয় পেয়েছিলাম, নইলে ডাকতাম না। উচিত হয়নি তোমাকে এসবে জড়ানো। সবই এখন চলে এসেছে নিয়ন্ত্রণের ভেতর।’

‘তোমার রিসেপশন পার্টি তো দেখলাম,’ বলল রানা।

‘তুমি তো কাজ ফেলে এসেছ। তাতে হয়তো ক্ষতিও হয়েছে। তাই উপযুক্ত টাকা দাবি করলে তা দিতে আমি বাধ্য।’ সবজেটে সোফার সামনে থেমে হ্যাণ্ডব্যাগটা তুলে নিল লিয়া। বের করল একতোড়া দশ পাউণ্ডের নোট।

‘তোমার কাছে পয়সা চাইনি, লিয়া। জানতে চাইছি আসলে কী হয়েছে।’ কাঁধের ওপর দিয়ে দরজা দেখাল রানা। ‘তুমি কি লণ্ডনে নতুন কোনও সার্কাস পার্টি খুলছ?’

সোফার ওপর হ্যাণ্ডব্যাগ রেখে দিল লিয়া। ‘তুমি আসলে কী বলতে চাও?’

‘তুমি সার্কাস পার্টি খুলতে না চাইলে ওই ক্লাউনগুলো এখানে কেন?’

‘আমার নিরাপত্তার জন্যে।’

‘ভীষণ ভিতু কোনও ছিঁচকে চোরের খপ্পর থেকেও তো ওরা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।’

‘কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব দিতেই হতো। তুমি তো এখানে ছিলে না।’

‘দেরি হলেও বহু দূর থেকে এসেছি জানতে, আসলে কী হয়েছে তোমার।’

ফ্যাকাসে চেহারায় রক্ত ফিরেছে লিয়ার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি দুর্ব্যবহার করতে চাই না। খুব ক্লান্ত লাগছে। ভয়ও পেয়েছি। আমি একটা ড্রিঙ্ক নেব। তুমি কি নেবে?’

সোফায় কালো চামড়ার জ্যাকেট রাখল রানা। ‘হলে মন্দ হয় না।’

ড্রিঙ্ক ক্যাবিনেট খুলে উইস্কির বোতল নিল লিয়া। রানা দেখতে পেল মৃদু কাঁপছে মেয়েটার হাত।

দুটো গ্লাস নিয়ে ডাবল উইস্কি ঢালল লিয়া।

আগে লিয়া ড্রিঙ্ক করত না, ভাবল রানা। তখন ওর বয়স মাত্র আঠারো। এরপর পেরিয়ে গেছে পুরো ছয়টা বছর। লিয়া এখন চব্বিশ বছরের স্বাধীন, স্বাবলম্বী এক ভদ্রমহিলা। সেসময়ের লিয়াকে চিনলেও আজকের মানুষটাকে ও সত্যিই চেনে না।

সোফায় বসে ড্রিঙ্কের গ্লাস বাড়িয়ে দিল লিয়া। ওটা নিল রানা।

নিজের গ্লাসের সোনালি তরলে চুমুক দিল লিয়া। কড়া স্বাদে কুঁচকে গেল ওর গোলাপি গালদুটো। ছোট্ট কফি টেবিলে গ্লাস রেখে তিক্ত স্বরে বলল, ‘আমি বিপদে আছি, রানা। কারা যেন আমার পিছনে লেগেছে।’

‘একটু খুলে বলো,’ বলল রানা।

মুখের ওপর থেকে চুল সরাল লিয়া। ‘আমি লণ্ডনে আছি সাত সপ্তাহ ধরে। রয়েল অপেরায় টস্কা চলছিল। তাই অপেরার কাছাকাছিই ছোট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। তবে শেষ শো হওয়ার পরদিন সকালে ভাবলাম, আমার গ্রামের ম্যানশনের জন্যে টুকটাক কিছু জিনিস কিনব। শপিং শেষে নির্জন রাস্তা ধরে ফিরছি ফ্ল্যাটের দিকে, এমনসময় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, কারা যেন অনুসরণ করছে, চোখ রাখছে আমার ওপর। কেমন যেন খারাপ একটা অনুভূতি হলো মনে।’

‘বলতে থাকো।’

‘ওই লোকগুলো ছিল কালো এক গাড়িতে। ওটার ব্র্যাণ্ড মনে নেই। আমার ঠিক পেছনে ধীরে ধীরে আসছিল। প্রথমে ভাবলাম নিশ্চয়ই ফোটোগ্রাফার বা ভক্ত। তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে বাড়িয়ে দিলাম হাঁটার গতি। আর তখনই হঠাৎ করে গাড়িটা এসে আটকে দিল আমার পথ। পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে পড়ল লোকগুলো।’

‘চেহারার বর্ণনা দিতে পারবে?’

মৃদু মাথা দোলাল লিয়া। ‘ওরা তিনজন। ড্রাইভার সহ। পরনে দামি, কালো সুট। মনে হয়েছিল ব্যবসায়ী। তাদের একজন আমাকে বলল, যাতে গাড়িতে উঠি। তখন ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু খপ্ করে আমার হাত চেপে ধরল লোকটা।’

‘তার হাত থেকে ছুটলে কীভাবে?’

তিক্ত হাসল লিয়া। ‘মণ্টি কার্লো সম্পর্কে সবাই বলে, ওটা পুলিশি রাজ্য। অথচ মহিলাদের জন্যে ওই এলাকা সবসময় নিরাপদ। আসলে যেখানেই যাই না কেন, তা ইউনাইটেড স্টেট্স্ হোক বা অন্য দেশ, আমি সবসময় নিজের সঙ্গে রাখি এক ক্যান মেইস।’

অবাক চোখে লিয়াকে দেখল রানা। ‘মেইস? তোমার কাছে ছিল?’

মাথা দোলাল লিয়া। ‘ব্রিটেনে ওটা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ সেজন্যে সঙ্গে রাখি ছোট এক ক্যান হেয়ারস্প্রে। লোকটা হাত ধরে টান দিতেই ওর চোখে স্প্রে করেছি।’

‘খুবই কাজের জিনিস।’

হেলান দিয়ে সোফায় বসল লিয়া। কালো চুলে ঢেকে গেছে ওর মুখ। একহাতে চুল সরিয়ে বলল, ‘কখনও ভাবিনি ওটা কাজে লাগবে। পরে ভীষণ খারাপ লেগেছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে আর্তনাদ করতে লাগল লোকটা। ডানহাতে কোট থেকে বের করল পিস্তল। তখন তীরবেগে ছুটলাম। পেছনে ধাওয়া করল অন্য দু’জন। অনেক দিন প্র্যাকটিস করেছি বলে খুব জোরে দৌড়াতে পারি। তবে শেষে ধরা পড়ে যেতাম। কিন্তু সেসময়ে হাজির হলো একটা ক্যাব। ওটা থামিয়ে পেছনের সিটে উঠে চিৎকার করে বললাম, ‘জলদি! যত জোরে সম্ভব ড্রাইভ করুন! প্লিয!’

এরপর আর ওই ফ্ল্যাটে যাইনি।’ দুশ্চিন্তা ভরা চোখে রানাকে দেখল লিয়া। ‘এখন আমার কী করা উচিত, রানা?’

‘আমার মনে হয় না করিডোরের ওরা তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারবে।’

‘ওই লোকগুলো আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল, তা-ই না?’

‘তাই মনে হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘তুমি যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছ, অনেকেই তোমাকে টার্গেট করতে পারে। নাম আছে তোমার। টাকারও অভাব নেই। কেউ না কেউ তোমার ক্ষতি করতে চাইছে। …তোমার চেনা কোনও শত্রু আছে?’

ভাবতে গিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল লিয়া। ‘তেমন কারও কথা তো মনে পড়ছে না। আমার সঙ্গে আবার কার শত্রুতা? আমি তো সাধারণ একটা গায়িকা।’

‘নাম করা গায়িকা,’ শুধরে দিল রানা। ‘আগে কখনও মনে হয়েছে পিছু নিচ্ছে কেউ? ফোনে বা ই-মেইলে হুমকি দিয়েছে?’

কাঁধ ঝাঁকাল লিয়া। ‘আমার পিএ অ্যানের মাধ্যমে ভক্তরা যোগাযোগ করে। কেউ কেউ চলার পথে চিনে ফেলে। তখন অটোগ্রাফ আদায় করে। এমনটা মাঝে মাঝেই ঘটে। কিন্তু হুমকি দিয়েছে কেউ, তেমন কখনও হয়নি।’

‘ওই তিন লোকের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ক্যাবে উঠলে তুমি, তারপর কি সরাসরি এখানে এসেছ?’

‘আমি তো বোকা নই, রানা। মনে হয়েছিল ওই ক্যাবের নম্বর দেখে আমাকে খুঁজে বের করবে তারা।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘তার মানে, এই হোটেলের স্টাফরা ছাড়া আর কেউ জানে না তুমি এখানে উঠেছ?’

‘তবে সবই জানিয়ে দিয়েছি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে।’

‘এ ধরনের কেসে বেশিরভাগ সময়ে কোনও কাজে আসে না পুলিশ।’

‘আমার কাছ থেকে স্টেটমেণ্ট নিয়ে বলে দিয়েছে, তারা তদন্ত করে দেখবে।’

‘তোমার কি জানা আছে ওই গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার?’

‘রানা, তখন সবকিছু এত দ্রুত ঘটছিল যে…’

‘তার মানে, তাদেরকে ট্রেস করতে পারবে না পুলিশ। হয়তো ওই গাড়ির লাইসেন্স প্লেট বা গাড়িটা চুরি করা।’ চুপ হয়ে গেল রানা। এবার যা বলবে স্থির করেছে, তা বলতে দ্বিধা এল ওর মনে। তবুও ইতস্তত করে জানতে চাইল, ‘লিয়া, এরপর তো পেরিয়ে গেছে কয়েকটা বছর। তুমি কি…’

‘বলতে চাইছ, ছয় বছর আগে তুমি উধাও হওয়ার পর আমি আজও একা রয়ে গেছি কি না?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘এটা জানা জরুরি।

‘রানা, আমি বোধহয় এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যে প্রস্তুত নই।’

‘প্রয়োজন আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি: বিয়ে করেছিলে?’

‘না।’

‘কাছে আসতে চেয়েছে কেউ?’

‘একজন। ওর নাম ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখে। তবে তাকে বন্ধুর বেশি কিছু হতে দিইনি।’

‘এসব নিয়ে রাগারাগি হয়েছিল?’

‘না। দু’বছর আগেই বলে দিয়েছি, আমরা বড়জোর ভাল বন্ধু হতে পারি। নইলে কিছুই নয়। তুমি আসলে কী জানতে চাইছ, রানা?’

‘কিডন্যাপিং আজকাল মস্তবড় ব্যবসা,’ বলল রানা, ‘সেটা করা হয় টাকার জন্যে, আবার কখনও প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। তোমার কী ধারণা: কেন তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছে ওরা?’

‘আমার জানা নেই। ‘

‘তোমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা কোন অপেশাদার গ্রুপের কাজ বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘তারা ভাল করেই জানে তুমি আসলে কে। এ-ও জানে, কোথায় তোমার ফ্ল্যাট।’ ড্রিঙ্কে হালকা চুমুক দিয়ে কফি টেবিলে গ্লাসটা রাখল রানা। ‘তো এখন প্রথম কথা হচ্ছে: এই বিষয়ে তুমি কী করতে চাও?’

‘লণ্ডন থেকে বিদায় নেব। হোটেলে বসে থেকে নিজেকে বন্দি-বন্দি লাগছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে থাকব ভেনিসে। ওখানে দ্য ম্যাজিক ফুটের পারফর্মেন্স হবে। তবে তার আগে একবার ঘুরে আসব পশ্চিম অক্সফোর্ডশায়ার থেকে। লরেন্স এবং তার টিম আমাকে পাহারা দিয়ে রাখবে।’

‘পশ্চিম অক্সফোর্ডশায়ারে কেন?’

‘কিছু দিন আগে ওখানে একটা ম্যানশন কিনেছি। ওটার নাম হচিন্সটন হল। ভাবছি, ওখানে অপেরা শেখাবার একটা স্কুল খুলব।’

‘এই ব্যাপারে তুমি ছাড়া আর কারা জানে?’

‘আলাপ করেছি আমার পিএস র‍্যাচেল আর ম্যানেজারের সঙ্গে,’ বলল লিয়া। ‘বাড়িটা বিশাল। খালি পড়ে আছে। মন্টি কার্লো থেকে কিছু জিনিস ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখনও সাজিয়ে নেয়া হয়নি বাড়িটা। তবে বাসযোগ্য। কয়েক দিন ওখানে বিশ্রাম নেব। এরই ভেতর স্থির করে নেব কী করা যায়।’

‘এবার আমার কথা মন দিয়ে শোনো, লিয়া,’ কাঁধের ওপর দিয়ে দরজা দেখাল রানা। ‘তোমার প্রথম কাজ হওয়া উচিত, ওই গাধা তিনটেকে বেতন চুকিয়ে দিয়ে বিদায় করা। ওদেরকে দিয়ে কিছুই হবে না। আমি চাইলে যে-কোনও সময়ে এখানে ঢুকতে পারতাম। কোনও ধরনের বাধা দিতে পারত না ওরা।’

মাথা দোলাল লিয়া। ‘ঠিক আছে, ধরে নাও ওদেরকে বিদায় করে দিলাম। তারপর?’

‘তুমি চাইলে নিরাপত্তার দিকটা আমি দেখতে পারি।’

‘মনে মনে সেটাই চেয়েছি,’ লজ্জায় রক্তিম হলো লিয়ার মুখ।

‘আমি বডিগার্ড নই, লিয়া। আমার কাজ একেবারেই আলাদা। তবে বডিগার্ডের দায়িত্ব ভালভাবে পালন করতে পারে এমন দক্ষ অনেককেই চিনি। তারা তোমাকে নিরাপত্তা দেবে।’

দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল মেয়েটার মুখে। ‘তার মানে, একদল লোকের বদলে আরেক দলকে কাজে নেব।’

মৃদু হেসে মাথা নাড়ল রানা। ‘আমি যাদের কথা ভাবছি, ওরা পেশাদার। টেরও পাবে না, ওরা ঘিরে রেখেছে তোমাকে। আমি ওদেরকে ভাল করেই চিনি।’

‘তুমি নিজে দায়িত্বটা নিলে স্বস্তি পেতাম,’ বলল লিয়া।

‘আমাকে কেন? আমি তো কথা দিয়েও তা রাখি না!’

‘এবার আবার আমাকে ডুবিয়ে দেবে না তো, রানা?’ ছলছল করছে লিয়ার চোখ। ‘আমি সত্যিই খুব ভয়ে আছি।’

চাপা শ্বাস ফেলল রানা। ‘ঠিক আছে, এবার ঠকলে আমি ঠকব, তোমাকে ঠকে যেতে হবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *