কাউণ্ট কোবরা – ৫৮

আটান্ন

সিঁড়ির ধাপে রক্তের চিহ্ন দেখে ঝড়ের বেগে উঠছে রানা। রেলিঙে রক্তমাখা হাতের ছাপ। বাজেভাবে আহত হয়েছে মাইক বুচার। তবে সে এখনও খুব বিপজ্জনক। বোধহয় চলেছে ছাতের দিকে।

মাত্র কয়েক মুহূর্তে পঞ্চমতলায় উঠল রানা। বুকে বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড। সামনের করিডোর ধরে সোজা এগিয়ে গেছে রক্তের ফোঁটা। দু’পাশের দরজাগুলোর দিকে পিস্তল তাক করে জায়গাটা পেরিয়ে গেল রানা।

করিডোরের শেষে খোলা দরজা। ওদিকে চোখ যেতেই রানা দেখল, শীতল হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে পর্দা। ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দিয়ে ঢুকছে তুষার।

সতর্ক পায়ে ওই ঘরের দিকে চলল রানা। পাঁজরে গুঁতো মারছে হৃৎপিণ্ড। ওই শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল চেনা এক আওয়াজ।

ক্রমেই বাড়ছে ওটা। তীক্ষ্ণ শব্দে চালু হয়েছে শক্তিশালী ইঞ্জিন। একটু দূরের খোলা ছাতে বাড়ছে গর্জন।

হেলিকপ্টার।

ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর দিকে চলল রানা। আর তখনই ওর চোখের সামনে ঝলসে উঠল সাদা একরাশ মেঘ। হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে পিছলে গেল ওয়ালথার পিস্তল। কিছু বুঝবার আগেই খপ্ করে ধরা হয়েছে ওর কলার। পরক্ষণে একটানে তুলে নেয়া হয়েছে ওপরে। চওড়া এক কপালের নিচে ছোট দুটো জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেল রানা। তখনই চোয়ালে লাগল প্রচণ্ড ঘুষি। উড়ে গিয়ে পেছনের এক ডেস্কের ওপর চিত হয়ে পড়ল ও। চারপাশে ছড়িয়ে গেল ফাইল, কাগজ, অ্যাশট্রে ও টেলিফোন।

এত প্রকাণ্ড লোক জীবনে খুব কমই দেখেছে রানা। ডেস্ক ঘুরে ওর দিকেই আসছে লালচে মুখের দৈত্য।

বড় বড় দাঁত বের করে হাসল লোকটা। ‘তুমি মরে গেছ।’ তার ইংরেজি উচ্চারণ খুবই খারাপ। এই মুহূর্তে ডানহাতে আটইঞ্চি নলওয়ালা .৪৪ স্টিল-বডি রুগার রেডহক। একপলক রানাকে দেখে নিয়ে কোমরে অস্ত্র গুঁজল দানব। ‘না, এটা লাগবে না।’ দু’হাত ওপরে তুলল সে।

কাত হয়ে ডেস্ক থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। শুকিয়ে গেছে গলা। ছাতে বাড়ছে হেলিকপ্টারের গর্জন। ঘুষি খেয়ে ঠোঁটের কোনা কেটে গেছে রানার। জিভে পেল রক্তের নোনতা স্বাদ। বনবন করে ঘুরছে মাথা। অথচ, ওর যেতে হবে বুচারের পেছনে। তার আগে কাবু করতে হবে সাদা এই ইয়েতিকে। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করল রানা। পরক্ষণে এক লাফে এগিয়ে ঘুষি বসাল দৈত্যের সোলার প্লেক্সাসে। গায়ের সমস্ত শক্তি খরচ করেছে রানা। মুঠো থেকে কাঁধ পর্যন্ত ঝনঝন করছে হাড়। এটা ওর জীবনের সেরা ঘুষি। ঠিকভাবে লাগলে ঘোড়াও কাত হয়ে মাটিতে পড়বে। ·

অথচ, কিছুই হলো না ভয়ানক দৈত্যের। রানার মাথার দিকে এল জাম্বুরা সাইযের ঘুষি। ঝট্ করে পাশে সরে এবারের মত বেঁচে গেল রানা। দেরি না করে গায়ের জোরে লাথি দিল দৈত্যের তলপেটে। তবে হাত নামিয়ে লাথিটা ঠেকাল লোকটা। তার গলায় জ্যাব করতে চাইল রানা। ওটাও ঠেকিয়ে দিল দানব। রীতিমত ভয় পেয়ে পিছিয়ে এল রানা। বুঝে গেছে, ঘরের ভেতর কমে আসছে নড়াচড়ার জায়গা। খোলা জানালা দিয়ে এল হেলিকপ্টারের গর্জনের ওপর দিয়ে অন্য আওয়াজ। ভীষণ ভয়ে আর্তচিৎকার জুড়েছে ছোট কোনও মেয়ে। ওই শব্দ লক্ষ্য করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। ওদিকে খোলা ছাতে চিমনিগুলোর মাঝে বড় জায়গা নিয়ে হেলিপ্যাড। ত্রিশ গজ দূরে চারদিকে তুষারের কণা ছড়াচ্ছে কালো এক হেলিকপ্টার। জ্বলে উঠেছে শক্তিশালী সাদা বাতি। আগের চেয়ে জোরে ঘুরছে রোটর শক্ত হাতে চেপে ধরে হেলিকপ্টারে এমিলিকে তুলতে চাইছে মাইক বুচার। ছুটে যাওয়ার জন্যে লোকটার গায়ে লাথি মারছে মেয়েটা। ব্যথা পেয়ে দাঁত খিঁচাল ব্রিটিশ কমাণ্ডো। রক্তে কালো হয়ে গেছে তার শার্ট।

ওদিকটা দেখতে গিয়ে দেরি করেছে রানা। ওর পাঁজরে লাগল বুট পরা পায়ের ভারী লাথি। মুহূর্তে বুঝে গেল রানা, ফেটে গেছে ওর পাঁজরের হাড়। মেঝেতে পড়েই নিজেকে গড়িয়ে দিল ও। একহাতে চেপে ধরেছে আহত জায়গাটা ঢুকে পড়ল ডেস্কের মাঝের গভীর জায়গায়। তবে একহাতে ডেস্ক ধরে প্রায় উড়িয়ে ওটাকে আরেক দিকে সরাল দৈত্য। তার হাতে এখন ভারী এক ড্রয়ার। ধুম্ করে ওটা নামল পিচ্চি প্রতিযোগীর মাথার ওপর। চুরমার হয়ে গেল ড্রয়ার। রানার চারপাশে বৃষ্টির মত ঝরঝর করে ঝরল অফিস ইকুইপমেন্টস্। কার্পেটে কী যেন চকচক করতে দেখল রানা। ওটা সরু একটা ছোরার মত। লেটার ওপেনার। খপ্ করে ওটা তুলে নিল ও। আবারও খুব কাছে পৌঁছে গেছে দৈত্য। তবে সে কিছু করার আগেই তার বুটের ওপর প্রাণপণ শক্তিতে চালাল লেটার ওপেনারটা।

শক্ত চামড়ার বুট। লেটার ওপেনারের ডগাও তেমন চোখা নয়। তবে গায়ের জোরে মেরেছে রানা। ভচ্ করে চামড়া ভেদ করে দৈত্যর পায়ে বিধল লেটার ওপেনার। মাংস, হাড় ও সোল পার করে ওটা গেঁথে গেল কাঠের মেঝেতে। দৈত্য আপাতত হয়েছে জাদুঘরের বোর্ডে পিন দিয়ে আটকে রাখা প্রজাপতির মত।

ছোট্ট মাথাটা ঝট করে পেছনে হেলিয়ে বিকট এক রাক্ষুসে আর্তনাদ ছাড়ল দৈত্য। টলমল করে উঠে দাঁড়াল রানা। পরক্ষণে কোমর ঘুরিয়ে মারাত্মক এক লাথি দিল দানবের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায়, দু’পায়ের সংযোগস্থলে। তাতে মিলল ভাল ফলাফল। দু’ভাঁজ হয়ে মেঝেতে বসল দৈত্য। ছোট্ট কানদুটো ধরে ডানহাঁটু তুলেই তার নাকেমুখে কঠিন এক গুঁতো মারল রানা।

ছাতে বুচারের হাত থেকে ছুটে গেছে এমিলি। ঘুরন্ত রোটরের ঝোড়ো হাওয়ায় আকাশে উড়ছে ওর মাথার চুল। বেচারি ছুটে এল জানালার দিকে। তবে জোরে দৌড়াতে গিয়ে তুষারে পিছলে গেল পা। পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়াল আবার। পিছু নিয়েছে বুচার। আবার দৌড়াবার আগেই খপ্ করে ধরে ফেলল এমিলির দীর্ঘ চুল। হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে নিল। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল মেয়েটা।

এদিকে বেমক্কা পিট্টি খেয়ে মোটা হেঁড়ে গলায় ফুঁপিয়ে উঠেছে দৈত্য। সরে যেতে চাইলেও হুঁশ নেই পা গেঁথে আছে মেঝেতে। এই সুযোগে দেয়ালে ঝুলন্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার খুলে নিল রানা। লোহার ভারী সিলিণ্ডারটা সজোরে নামাল দৈত্যের মাথার ওপর। ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ে চিত হলো দৈত্য। মেঝে থেকে খুলে গেছে আহত পা। জেদি বাচ্চার মত প্রাণপণে ছুঁড়ছে হাত-পা। অবশ্য যে-কোনও সময়ে উঠে আবারও ধরতে পারে রানাকে। কোনও ঝুঁকি নিল না রানা, ভারী সিলিণ্ডারের তলিটা প্রচণ্ড বেগে নামাল লোকটার মুখের ওপর। বিশ্রী মড়াৎ আওয়াজে কপালের হাড় ভেঙে ঢুকল দৈত্যের মগজে। মাত্র দু’বার ঝটকা দিল দানব, তারপর স্থির হয়ে গেল মেঝেতে।

লাশের বেল্ট থেকে ৪৪ রুগার নিল রক্তাক্ত, আহত রানা। পরীক্ষা করল অস্ত্রের সিলিণ্ডার। ওটার ভেতর আছে ছয়টা ম্যাগনাম কার্ট্রিজ। দেরি না করে টলতে টলতে ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর দিকে চলল রানা। হেলিকপ্টারের দিকে এমিলিকে টেনে নিয়ে চলেছে বুচার। বেশি ঝামেলা করছে দেখে বেচারিকে গুঁজল বগলের ভাঁজে। প্রাণপণে দুই পা ছুঁড়ছে মেয়েটা।

ছাতে পা রেখে ফাটল ধরা পাঁজরের হাড়ের কথা ভুলে হেলিকপ্টারের দিকে ছুটল রানা। রিভলভারটা বুচারের দিকে তাক করে রোটরের গর্জনের ওপর দিয়ে চিৎকার করল, ‘থামো, বুচার! নইলে গুলি করব!’

ঘুরেই এমিলিকে বর্মের মত করে নিজের সামনে ধরল বুচার। কী যেন ধরেছে বাচ্চা মেয়েটার ঘাড়ে।

ওটা একটা সিরিঞ্জ।

বুড়ো আঙুল রেখেছে প্লাঞ্জারের ওপর। গলা ফাটিয়ে বলল বুচার, ‘তুমি তেড়িবেড়ি করলে খুন হবে মেয়েটা! অস্ত্র নামিয়ে রাখো!’

রিভলভারটা ছাতে ফেলে পা দিয়ে দূরে ঠেলল রানা। ব্যথা সহ্য করেও টিটকারির হাসি হাসল বুচার। এমিলিকে টেনে তুলল হেলিকপ্টারে। এখনও ঘাড়ে ধরে রেখেছে সিরিঞ্জ। অন্যহাতে সিটের ফ্রেমের সঙ্গে হ্যাণ্ডকাফে আটকে দিল এমিলির হ’ত। অসহায় চোখে সব দেখছে রানা। পিছলে এগিয়ে হেলিকপ্টারের কন্ট্রোলের সামনে বসল বুচার। আর্মিতে থাকতে যান্ত্রিক ফড়িং চালাতে শিখেছে। সে দক্ষ পাইলট। তুষারপাতের সময় কোনও পাইলট হেলিকপ্টার আকাশে না তুললেও বুচার চিরকালই ভয়ানক বেপরোয়া।

ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে হেলিকপ্টার। পার্সপেক্স জানালা দিয়ে এমিলির ফ্যাকাসে মুখ দেখল রানা। মুখ বিকৃত করে চিৎকার করছে বেচারি। কিন্তু প্রচণ্ড আওয়াজে ওর কথা শুনতে পাবে না কেউ।

ছুটতে ছুটতে হেলিপ্যাডে পৌঁছুল রানা। আকাশে ভেসে উঠেছে হেলিকপ্টার। চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে তুষারের জোরালো ঝড়। তুষার ও বাতাসে প্রায় বুজে গেল রানার চোখ। আগেই ছাত থেকে তুলে নিয়েছে রুগার রিভলভার তবে হেলিকপ্টারের দিকে গুলি করার সাহস হলো না।

ঘুরে যাচ্ছে যান্ত্রিক ফড়িং। মরিয়া হয়ে চারপাশে তাকাল রানা। ছাতের কিনারায় পাথরের একটা প্যারাপেট আছে। ওটার উচ্চতা বড়জোর চার ফুট। দৌড়ে গিয়ে ওটার ওপর উঠল রানা। ভাল করেই জানে, একবার এত উঁচু ছাত থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। তবুও লম্বা রিভলভারটা বেল্টে গুঁজে সামনে বাড়িয়ে দিল দু’হাত। হেলিকপ্টারের নাক নিচু করে রওনা হলো বুচার। একইসময়ে সামনে ঝাঁপ দিল রানা। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ও ভারশূন্য। বহু নিচে ম্যানশনের লনে জ্বলছে উজ্জ্বল আলো। ড্রাইভওয়ে ধরে একসারিতে এগিয়ে আসছে পুলিশের গাড়ির আলো। ভণ্ডুল হয়ে গেছে ব্রুনারের পার্টি। অতিথিরা এখন পালাতে পারলে বাঁচে।

আকাশ থেকে পড়তে পড়তে হেলিকপ্টারের একদিকের বরফ-ঠাণ্ডা স্কিড বামহাতে জড়িয়ে ধরল রানা। ডানদিকে বাঁক নিল যান্ত্রিক ফড়িং। সরে যাচ্ছে বিশাল প্রাসাদ ছেড়ে। ঝুলতে ঝুলতে চলেছে রানা। ঝোড়ো হাওয়া ছিঁড়ে নিতে চাইল ওর মাথার চুল ও পোশাক। এবার অন্যহাতেও স্কিড ধরল রানা। শূন্যে দুলতে দুলতে হাত ও কোমরের জোরে স্কিডে তুলে নিতে চাইল পা। অনেক নিচে আবছাভাবে দেখল ঘুরে যাচ্ছে সবকিছু।

রানা স্কিড জড়িয়ে ধরতেই ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে ‘কপ্টারের। মাইক বুচারের বুঝতে দেরি হয়নি, এমনটা হয়েছে কী কারণে। ককপিট থেকে দেখল, ঝুলন্ত অবস্থায় বেপরোয়াভাবে পাশের দরজা খুলতে চেষ্টা করছে মাসুদ রানা। ব্যথা ভুলে নিষ্ঠুর হাসল বুচার। আবারও হেলিকপ্টার নিয়ে চলল ম্যানশনের দিকে। ভাল করেই জানে, ঝাঁকি দিয়েও রানাকে ঝরাতে পারবে না। তবে কিছুর সঙ্গে ঘষে ওকে পিষে শেষ করে দেয়া খুব সহজ কাজ।

সামনেই অন্ধকারে বিশাল এক চিমনি। কাত হয়ে ওটার দিকে হেলিকপ্টার সরাল বুচার। রানা দেখল, এখন আর পা স্কিডে তোলার সময় পাবে না, অথচ হুড়মুড় করে ওর দিকেই আসছে ইঁটের তৈরি চিমনি। বাঁচার জন্যে বুকের কাছে দু’পা তুলল ও। সাঁই করে তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল চিমনি। ছাতের ওপর দিয়ে গর্জন ছেড়ে উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার। আবারও ওটা ঘুরিয়ে নিল বুচার। জি-ফোর্স দু’হাত ছুটিয়ে দিতে চাইছে বুঝে প্রাণপণে শক্ত করে স্কিড জড়িয়ে ধরল রানা।

আবারও ছাতে ফিরছে বুচার। রানার পায়ে লেগে উঁচু প্যারাপেট থেকে নিচে খসে পড়ল কিছু আস্ত ইঁট। আবারও কাত হয়ে হেলিকপ্টার ঘোরাল বুচার। দাঁত বের করে হাসছে। এবার দেয়ালে ঘষে মাছির মত চ্যাপ্টা করবে রানাকে। আগ্রহের আতিশয্যে বেশি কাত করে ফেলেছে হেলিকপ্টার। ছাতের কিনারায় খটাং শব্দে লাগল টেইল রোটর। নানাদিকে ছিটকে গেল কমলা ফুলকি। মুচড়ে গেছে ধাতব লেজ। থরথর করে কেঁপে উঠেছে উড়ন্ত হেলিকপ্টার। মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল ওটা। বাড়ি থেকে সরে টলতে টলতে চলল দূরের জঙ্গলের দিকে।

স্কিডে পা তুলল রানা। ডানহাতে হ্যাণ্ডেল ধরে একটানে খুলল দরজা, পরক্ষণে হুড়মুড় করে ঢুকল ককপিটে। অসংখ্য গাছের মগডালের সামান্য ওপর দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে চলেছে হেলিকপ্টার। তুষার ছাওয়া পাইন, নেড়া ওক ও বিচ গাছের ওপর পড়ছে উজ্জ্বল আলো।

বিষ ভরা সিরিঞ্জ হাতে রানার দিকে ঝুঁকল বুচার। তবে ঝট্ করে একদিকে সরে হামলা এড়াল রানা। একইসময়ে ‘কপ্টারের কন্ট্রোলের ওপর চেপে ধরল বুচারের কবজি। দুই সিটের সংকীর্ণ জায়গায় শুরু হলো দু’জনের মরণপণ কুস্তি ও এলোপাতাড়ি কিলঘুষি। ছাঁটা চুল খামচে ধরে বুচারের মুখ ডায়ালের ওপর আছড়াল রানা পর পর তিনবার। রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে বুচারের কপাল।

নিচে নামছে হেলিকপ্টার। বাড়ছে ঘূর্ণন। চোখেমুখে ওর খামচি এড়াতে গিয়ে ঠেলে বুচারকে দরজার ওপর ফেলল রানা। ওর ঘুষি খেয়ে খসে গেল লোকটার সামনের দুটো দাঁত। মাথাটা ধরে আবারও কন্ট্রোলের ওপর ফেলল ওকে রানা। সিটে এলিয়ে পড়ল বুচার। রানা দেখল কাত হয়ে সরাসরি জঙ্গলের দিকে নেমে চলেছে হেলিকপ্টার।

কন্ট্রোলের ওপর ঝুঁকে রানা বুঝল, কিছুই করার নেই। ঘুরতে ঘুরতে আরও দু’শ’ গজ গিয়ে গাছগুলোর ওপর নামল ‘কপ্টার। মুহূর্তে ভাঙল রোটর। ব্লেডগুলো কচাকচ কাটছে নরম ডাল ও পাতা। মড়মড় আওয়াজে মোটা একটা ডাল ভেঙে মাটির দিকে ধসে পড়ল ভারী এয়ারক্র্যাফট। ছাতটা কয়েক ডিগবাজি দেয়ায় পা পিছলে মেঝেতে পড়ল রানা।

মাটির তিরিশ ফুট ওপর থেকে গাছগুলোর নিচের শাখা-প্রশাখার শুরু। সব ভেঙে সরাসরি নিচে পড়ল ওরা। ফাটল ধরা পার্সপেক্স কাঁচের মাঝ দিয়ে ঝোড়ো বেগে তুষারে ছাওয়া জমি উঠে আসতে দেখল রানা। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে। পরক্ষণে বড়সড় এক তুষারের ঢিবির ওপর নাক গুঁজল হেলিকপ্টার। ওপর থেকে নেমে এল কাটা পড়া ডাল-পাতা ও এয়ারক্র্যাফটের নানান টুকরো অংশ। ‘কন্ট্রোল কন্সোলের ওপর পড়ে আছে বুচার। ডায়ালে ফৎ-ফৎ আওয়াজ তুলছে বৈদ্যুতিক ফুলকি।

রানার নাকে এল এভিয়েশন ফিউয়েলের কড়া গন্ধ।

ধড়মড় করে আঁধার, বিধ্বস্ত ককপিটে উঠে দাঁড়াল রানা। সারা শরীরের ব্যথায় ভীষণ অসুস্থ লাগছে।

ছাত এখন মেঝে। ওপরের আসনে সিটবেল্ট থেকে ঝুলছে এমিলি। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে। সিটের হাতলে হ্যাণ্ডকাফে বাঁধা পড়েছে একহাত। চেষ্টা করেও ছোটাতে পারছে না।

ফ‍-ফৎ শব্দ শুনে পেছনে তাকাল রানা। উইণ্ডশিল্ডের ভেতর ‘হুউফ্’ আওয়াজে জ্বলে উঠেছে আগুন। লকলক করে চাটছে কন্ট্রোল ও সিট। একবার এভিয়েশন ফিউয়েল জ্বলে উঠলে বোমার মত বিস্ফোরিত হবে হেলিকপ্টার।

আগুনের আলোয় হ্যাণ্ডকাফের শেকল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল রানা। তাতে কোনও লাভ হলো না। ভয়ে বিস্ফারিত চোখে ওকে দেখছে মেয়েটা। সারা মুখে ছড়িয়ে আছে মাথার চুল। স্টিলের ব্রেসলেট থেকে বেরোল না চিকন হাত।

মেঝেতে আছে বুচার। হ্যাণ্ডকাফের চাবির জন্যে তার রক্তাক্ত টুক্সেডোর পকেট হাতড়াল রানা। কিন্তু কোনও পকেটেই নেই চাবি। অসহ্য হয়ে উঠছে আগুনের তাপ। রানার পিঠ চাটল শিখা। পুড়ছে জ্যাকেট। ঝুঁকে বুচারের প্যান্টের পকেট সার্চ করল রানা। হ্যাণ্ডকাফের চাবি পেল বাম পকেটে। আগুনে পুড়ে মরার ভয় তোয়াক্কা না করে দ্রুত এমিলির হাতের হ্যাণ্ডকাফ আনলক করল রানা। সিটবেল্ট খুলে হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে নামিয়ে নিল নিচে। পত-পত আওয়াজে পুড়ছে ওর জ্যাকেটের আস্তিন। কানে কীসের ঝনঝন আওয়াজ। এমিলির হাত থেকে খুলে নিয়ে বুচারের একহাতে হ্যাণ্ডকাফ আটকে দিল ও। ব্যস, ‘কপ্টারের সিটের সঙ্গে আটকা পড়ল কসাই। মেয়েটাকে নিয়ে ককপিটের দরজার দিকে সরল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে লাথি দিল মুচড়ে যাওয়া ধাতব কপাটের ওপর। বিশ্রী ক্র্যাচ আওয়াজে খুলল ওটা। এমিলিকে কাঁধে নিয়ে বিধ্বস্ত এয়ারক্র্যাফট থেকে নেমে পড়ল রানা। ছুটে পেরোতে চাইল আগুনের তৈরি দেয়াল। পেছনে কমলা শিখা গিলে নিয়েছে ককপিটটাকে।

রানার মনে হলো চিরকাল জ্বলছে বুঝি নরকে, এমনসময় ছিটকে বেরিয়ে এল আগুনের ভেতর থেকে। এমিলিকে কাঁধে রেখে টলতে টলতে পেরোল তুষারের উঁচু এক ঢিবি। ওখানে না থেমে হেঁটে চলল অদ্ভুত এক ঘোরের ভেতর।

দশ গজ যেতে না যেতেই হঠাৎ সাদা উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল জঙ্গল। বিপদটা বুঝে, ধসে পড়া বুড়ো এক ওক গাছের গুঁড়ির আড়ালে তুষারমোড়া জমিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। বুক দিয়ে ঢেকে ফেলেছে মেয়েটাকে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো হেলিকপ্টারের ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। কানে তালা লেগে গেল ওদের।

চারপাশে ছিটে গেল ভাঙা যন্ত্রপাতি ও সাদা আগুনের বিশাল ফুটবল। দিনের মত আলোকিত হলো আঁধার আকাশ। হেলিকপ্টার যেখানে ধসে পড়েছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে ওদিকের প্রতিটি গাছ। ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরছে পোড়া, নষ্ট জিনিসপত্র।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে রানার বুকে নাক গুঁজল এমিলি।

ওই জ্বলন্ত নারকীয় পরিবেশে বেঁচে নেই বুচার, ভাবল রানা। এবার এমিলিকে পৌঁছে দেবে ওর বাবার কাছে।

তারপর যাবে স্লোভেনিয়ায়, যেখানে ছিল লিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *