কাউণ্ট কোবরা – ৫৬

ছাপ্পান্ন

মন্দিরের পেছনের দেয়ালে সোনার সুতোয় কারুকাজ করা পর্দা এখনও দুলছে। লাফিয়ে মঞ্চ থেকে নামল রানা। ছুটে গিয়ে ভারী কাপড় সরাতেই দেখল, সামনে খোলা দরজা। অন্ধকার দেয়ালের ভাঁজে চোখেই পড়ে না। ওদিক থেকে আসছে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। ক’পা দূরেই প্যাচানো সিঁড়ি। ওপরে পায়ের ধুপ-ধাপ আওয়াজ।

ঘাড় ফিরিয়ে মন্দির দেখল রানা। রফিকের জন্যে বুকটা পুড়ছে ওর। ব্রুনারের সঙ্গীদেরকে ঘিরে ধরেছে রানা এজেন্সির গোয়েন্দারা। পালিয়ে যেতে দেবে না কাউকে। একটা কলামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এডি অ্যামন। তাঁর হাতে সেল ফোন। ব্রুনারের দলের লোকগুলোকে গ্রেফতার করাবার দায়িত্ব এখন তাঁর। এদিকে জসিমের প্রচণ্ড সব লাথি খেয়ে গোঙাতে গোঙাতে মেঝেতে গড়াচ্ছে ব্যানওঅর্ট। নরপিশাচগুলোকে বেঁধে রেখে পুলিশ আসার আগেই প্রাসাদ ছেড়ে সরে যাবে রানা এজেন্সির ছেলেরা। তবে ততক্ষণে ওই নরপশু ডাক্তার হয়তো বেঁচে থাকবে না।

জসিমকে মানা করল না রানা। সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘আমি ব্রুনার আর বুচারের পেছনে গেলাম।’

ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠেছে প্যাচানো সিঁড়ি। একেকবারে তিন ধাপ টপকে উঠতে লাগল রানা। নিজের পদশব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল ওপরে ছুটছে আরও দু’জন লোক। তবে তাদের সঙ্গে কমে আসছে ওর ব্যবধান।

আরও কয়েক ধাপ উঠেই রানা শুনল পিস্তলের গর্জন।

কয়েক মুহূর্ত পর আবারও।

আর বড়জোর একতলা ওপরে আছে লোকগুলো।

দৌড়ের গতি তুলে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল রানা।

.

বলরুমে মাসুদ রানাকে চিনতে পেরেই ক্রিস্টা গুন্থার বুঝে নিয়েছে, এবার হয়তো শেষ হবে চরম অপমান ও কষ্টের দিন। হয়তো দীর্ঘ তিন বছর পর মুক্তি পাবে ব্রুনারের হাত থেকে। তবে যাই ঘটুক, আর কিছুই পরোয়া করে না ও। এভাবে বেঁচে মরে থাকার চেয়ে মরে বাঁচা ঢের ভাল।

গত তিনবছর যে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে, তখন লুকা ব্রুনারের প্রাসাদের দু’চারটে গোপন পথ চিনে নেয়নি, তা তো নয়। এই বাড়িতে গোলকধাঁধার মত অসংখ্য করিডোর থেকে চলে যাওয়া যায় অন্য আরেকটায়। মন্দিরের দিকে ওকে যেতে দিত না ব্রুনার। তবে লোকটা জানে না, বহুদিন আগেই মন্দিরে নামার প্যাচানো সিঁড়িটা সে চিনে নিয়েছে। আর সেজন্যেই মনে হচ্ছে, বিপদে পড়লে ওই পথেই পালাতে চাইবে লুকা ব্রুনার। বাইম মাছের মত পিচ্ছিল জানোয়ারটা সবসময় কোটের আস্তিনে বাড়তি তাস রাখে। চট্‌ করে বুদ্ধির খেলায় তাকে হারিয়ে দেয়া কঠিন।

অবশ্য, এবার বুদ্ধির খেলায় তাকে হারিয়ে দেবে ক্রিস্টা। দেরি না করে ফিরেছে নিজের ঘরে। পার্টির ড্রেস পাল্টে পরে নিয়েছে জিন্সের প্যান্ট ও পুরনো সোয়েটার। জীবনে শেষবারের মত মাথা থেকে খুলেছে নকল চুল। হ্যাণ্ডব্যাগ নিয়ে সোজা এসেছে ধুলো ভরা পুরনো আমলের করিডোরে। এদিকটায় আলো কম। প্যাচানো সিঁড়ির মুখে করিডোরে লোহার বেড়ি দেয়া দরজায় চোখ রাখল ক্রিস্টা। ভাল করেই জানে, আগে হোক বা পরে, ওই দরজা খুলে বেরোবে লুকা ব্রুনার। ক্রিস্টার ডানে আবছা আঁধার করিডোর। ওখান থেকেই আবারও প্যাচানো সিঁড়ি উঠেছে বাড়ির ছাতে। তবে আজ লুকা ব্রুনারকে ওই সিঁড়ি ব্যবহার করতে দেবে না ক্রিস্টা।

পদশব্দ থামল পুরনো দরজার ওপাশে। তালার যন্ত্রাংশ নড়াচড়ার কিট-কিট আওয়াজ। হাতব্যাগ থেকে ব্ল্যাক উইডো পিস্তলটা নিয়ে হ্যামার তুলল ক্রিস্টা।

খুলে গেল দরজা। দু’পা সামনে বেড়ে আবছা আলোয় বুচার আর ব্রুনারের মুখোমুখি হলো ক্রিস্টা।

ওকে দেখে থমকে গেছে ব্রুনার। পাশেই বুচার। ছোট্ট পিস্তলটার ওপর চোখ পড়তেই ডানহাত ওপরে তুলল বিলিয়নেয়ার। নরম সুরে বলল, ‘ক্রিস্টা… এসব কী…’

আগে কারও দিকে পিস্তল তাক করেনি ক্রিস্টা। তবে দ্বিধা এল না ওর মনে। রাবারের হ্যাণ্ডেল সুন্দরভাবে বসে গেছে হাতের তালুতে। ছোট্ট ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল। শব্দের গতির চেয়ে বেশি বলে বদ্ধ জায়গায় বিকট আওয়াজ তুলল হাই-ভেলোসিটি পয়েন্ট টু-টু ম্যাগনাম বুলেট। শব্দটা কানে এতই বেশি লাগল, আরেকটু হলেই হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিত ক্রিস্টা।

বুলেটের আঘাতে অর্ধেক ঘুরে গেছে চিরকালের ধর্ষক বুচার। একহাতে চেপে ধরেছে ঘাড়। টলমল করে পিছিয়ে গেল দু’পা। ঘাড়ের ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে পেছনের দেয়ালে গিয়ে লাগছে রক্তের ধারা। দুলছে বুচার।

এবার তেড়ে আসবে লোকটা, ভাবল ক্রিস্টা। শক্ত করে ধরতে চাইল পিস্তলের হ্যাণ্ডেল। দ্বিতীয় গুলি ছুঁড়বার জন্যে আবারও হ্যামার কক করতে হবে। কিন্তু থরথর করে কাঁপছে ওর হাত।

সরে গিয়ে টলতে টলতে তৃতীয়তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল বুচার। পিস্তলের হ্যামার তুলতে চাইল ক্রিস্টা। পরের ল্যাণ্ডিঙের ওদিকে হারিয়ে গেল ব্রিটিশ সাইকোপ্যাথ। কাঠের মেঝেতে অনিয়মিত পদশব্দ।

সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেছে ব্রুনার। বিস্ফারিত হয়েছে দুই চোখ।

ক্লিক শব্দে ঠিক জায়গায় বসল ব্ল্যাক উইডোর হ্যামার। সরাসরি লুকা ব্রুনারের বুকে তাক হলো পিস্তল

‘ক্রিস্টা,’ ভুরু উঁচু করে অনুরোধের সুরে বলল লোকটা। ‘একবার ভেবে দেখো কী করছ।

‘খেলা খতম, ব্রুনার,’ বলল ক্রিস্টা। ‘যা খুশি করবে তা আর চলবে না।’

অনুনয়ের দৃষ্টিতে ওকে দেখল বিলিয়নেয়ার। কাঁপা গলায় বলল, ‘ক্রিস্টা, নিজের মনের দিকে তাকাও।’ এক পা এগোল সে। ‘তুমি আসলে আমাকে খুন করতে চাও না।’

একটু দেরিতে তার হাতে কালো, বেঁটে অটোমেটিক পিস্তলটা দেখল ক্রিস্টা। এখন আর কিছু করার নেই। আড়ষ্ট হয়েছে লুকা ব্রুনারের চেহারা। কোমরের কাছ থেকে তাক না করেই গুলি ছুঁড়ল সে। তার প্রথম বুলেট ফুটো করল ক্রিস্টার হাতের তালু। লাফিয়ে উঠে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল পয়েন্ট টু-টু পিস্তল। তীব্র ব্যথায় আর্তচিৎকার করে উঠেছে ক্রিস্টা। আবারও গুলি করল লুকা ব্রুনার।

দ্বিতীয় বুলেট বিঁধল ক্রিস্টার কাঁধে। সারা শরীরে শত শত ছোরা গেঁথে যাওয়ার মত তীব্র ব্যথা পাগল করে দিল মেয়েটাকে। কখন যেন পিছিয়ে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকতেই পিছলে বসে পড়ল মেঝেতে।

সামনে বেড়ে ওর মুখোমুখি হলো ব্রুনার। মুখে ফুটল বিজয়ীর হাসি। খুব কাছে পৌঁছে ছোট্ট কোল্টের নল তাক করল রক্ষিতার দু’চোখের মাঝে। হাসি-হাসি সুরে বলল, ‘গুড বাই, ক্রিস্টা!’

কিন্তু তখনই সামনের দিকে হোঁচট খেল বিলিয়নেয়ার।

দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে রানা।

গুলির শব্দে কান ঝনঝন করছে বলে সাইলেন্সড পিস্তলের ‘খুক!’ শব্দটা শুনতে পায়নি ক্রিস্টা। ভাঙাচোরা ভঙ্গিতে ওর কোলে খসে পড়ল রক্তাক্ত লুকা ব্রুনার। একবার খুব জোরে ঝাঁকুনি দিয়েই স্থির হয়ে গেল দেহটা।

কলার ধরে ক্রিস্টার ওপর থেকে ব্রুনারের লাশ সরাল রানা। বসে পড়ল মেয়েটার পাশে। কয়েক মুহূর্তে বুঝে গেল ক্রিস্টার পোশাকের সব রক্ত ব্রুনারের নয়।

মেয়েটার সোয়েটারের কলার ছিঁড়ে ক্ষতটা দেখল রানা। ডানদিকের কলার বোন ও বুকের ওপরের পেশির মাঝে ফুটো তৈরি করেছে বুলেট। ক্ষতটা মন দিয়ে দেখল রানা। রক্তে ভিজে গেল ওর হাত। যে-কোনও সময়ে জ্ঞান হারাবে ক্রিস্টা। ওর পিঠের কাছে পৌঁছে আটকে আছে ছোট ক্যালিবারের বুলেট। ওটা চুরচুর হয়নি দেখে রানা বুঝে গেল, কিছু দিন হাসপাতালে থাকলেই সুস্থ হয়ে উঠবে মেয়েটা।

অবশ্য, হাতের ক্ষতটা খুব বাজে। মাংস চিরে বেরিয়ে এসেছে তালুর সাদা হাড়। অস্বাভাবিকভাবে পেঁচিয়ে আছে আঙুল। হয়তো আর কখনও ঠিক হবে না ওর ডানহাত।

তবুও বলতে হবে কপাল জোরে বেঁচে গেছে মেয়েটা। চিরকাল খুনের নির্দেশ দিয়েছে বলে বাজে শুটার লুকা ব্রুনার। অথবা, সে ছিল স্যাডিস্ট। ভেবেছে কষ্ট দিয়ে মারবে মেয়েটাকে। ঘটনা যা-ই হোক, সে এখন আর দুনিয়াকে কলুষিত করছে না।

‘একটু ধৈর্য ধরো,’ ক্রিস্টাকে বলল রানা। ‘কিছুক্ষণ পর ডাক্তার পৌঁছে যাবে।’

‘অনেক ধন্যবাদ, রানা,’ দুর্বল স্বরে বলল ক্রিস্টা। হাসতে চাইল, তবে তখনই জ্ঞান হারিয়ে টলে পড়ল মেঝেতে।

কয়েক মুহূর্ত মেয়েটাকে দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা।

ভাঙা পুতুলের মত পড়ে আছে লুকা ব্রুনার।

দু’শ’ বছরেরও বেশি অসংখ্য মানুষকে অত্যাচার, নির্যাতন ও খুনের পর চিরকালের জন্যে থেমেছে কাউন্ট কোবরার বংশধারা। আর কখনও ওই পরিবারের কেউ দুর্নীতি করবে না। ব্রুনারের চোখদুটো হলদেটে তেল ভরা পোর্সেলিনের মত। পাতলা ঠোঁটে টিটকারির হাসি।

পলকের জন্যে রানার মনে হলো, লোকটার বুকে আরও দশটা বুলেট গেঁথে দিলে ভাল লাগবে ওর। তবে ছেলেমির সময় নেই, সামনে রয়েছে অনেক কাজ।

কোথায় গেছে মাইক বুচার?

পেছন-দেয়ালে একরাশ রক্ত। মেঝেতে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত ফেলে চলে গেছে লোকটা সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির ধাপে রক্তাক্ত পদচিহ্ন। রেলিঙে রক্তমাখা হাতের ছাপ। সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয়তলায় কোথাও গেছে মাইক বুচার!

হঠাৎ করেই রানার মনে পড়ল খুব জরুরি একটা কথা: তা হলে এমিলি এখন কোথায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *