পঞ্চান্ন
নীরবে অপেক্ষা করছে রানা ও তার দলের সবাই। মন্দির পরিষ্কার করছে তিনজন লোক। মেঝেতে পেতে দেয়া হয়েছে সাদা-কালো রঙের প্লাস্টিক শিট। লোকগুলোর কাজ শেষ হলে অনুষ্ঠানের জন্যে তৈরি হবে মন্দির।
ওপরের গ্যালারি থেকে সরে গেল রানারা। জানে, হাতে একদম সময় নেই!
.
মাত্র দশ মিনিটে তকতকে পরিষ্কার হয়েছে মন্দির। দেয়ালে গেঁথে দেয়া মোমদানীতে জ্বলছে সোনালি মোমবাতি। ঘরে গরম মোম গলে অদ্ভুত গন্ধ তৈরি হয়েছে। হলদে আলো পড়েছে মঞ্চের ওপর তিনটে উঁচু কলামের কাছে পাথুরে দেয়ালে। ওখানে প্রাচীন সিম্বল। একদিকের দেয়ালে জটিল নক্সা। তারই ওপর দিকে সোনার অক্ষরে লেখা: দি অর্ডার অভ রা। মোমবাতির আলোয় আরও ওপরে ঝিকমিক করছে সোনার তৈরি সেই রামছাগলের মাথা। গম্বুজ আকৃতির পাথরের ছাতে ভীতিকর অদ্ভুত ছায়া ফেলেছে দীর্ঘ দুই শিং।
আরও কয়েক মিনিট পর ধনুকের মত বাঁকা খিলানযুক্ত দরজা দিয়ে একসারিতে ভেতরে ঢুকল ক’জন লোক। হাঁটছে নীরবে। নিচু করে রেখেছে মাথা। যেন ধর্মীয় কোনও পবিত্র কাজ করছে। কিংবা এখানে এসেছে কারও শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে। কয়েকটা কলামের মাঝে বাঁকা চাঁদের আকৃতি তৈরি করে দাঁড়াল তারা। সরাসরি চেয়ে আছে উঁচু মঞ্চের দিকে। আগেই তৈরি বলির বেদি। মাঝখানে উঁচু মোটা কাঠের গুঁড়ি থেকে ঝুলছে পুরু শেকল।
সবার শেষে মন্দিরে পা রাখল লুকা ব্রুনার ও মাইক বুচার। দলের পেছনে সামান্য সরে দাঁড়াল তারা। কথা বলছে না কেউ। আবার হাতঘড়ি দেখল কাউণ্ট কোবরা। সময় হয়েছে অনুষ্ঠান শুরু করার।
গভীর ছায়ায় ধীরে ধীরে খুলে গেল ভারী লোহার চওড়া দরজা। মোমবাতির কাঁপা আলোয় দেখা দিল তিনজন লোক। মাঝের জনের চেহারা সবাই চেনে। কুঁচকে গেছে এডি অ্যামনের শার্ট। ডানচোখের ওপর ভুরুতে ছোট কাটা চিহ্ন। শক্ত হাতে তাঁর হাত ধরে এগিয়ে এল মুখোশধারী, শক্তিশালী দুই লোক। রাজনীতিকের মুখ চামড়ার ফিতা দিয়ে বাঁধা। কথা বলতে পারবেন না তিনি। চারপাশ দেখছেন ভীত দৃষ্টিতে। তারপর তাঁর চোখ স্থির হলো কালো সুট পরা লোকগুলোর ওপর। বুঝে গেলেন, জন্মের শত্রুর মৃত্যু দেখতে এসেছে এরা!
মঞ্চে উঠে কাঠের গুঁড়ির সামনে থামল তিনজনের দলটি। এডি অ্যামন ছুটে যেতে চাইলেও তাঁর হাতদুটো পেছনে নিয়ে শেকলে বেঁধে দিল জল্লাদদু’জন। রাজনীতিকের কোমরে আটকে দেয়া হলো সরু তিনটে শেকল। অ্যামনের দু’হাঁটু থরথর করে কাঁপছে। চাইলেও শেকলের জন্যে বসে পড়তে পারলেন না। বেদির, পেছনে গুঁড়ির দু’দিকে ছায়ায় গিয়ে থামল মুখোশধারী দুই মৃত্যুদূত।
দুর্বল শরীর মুচড়ে শেকল ছিঁড়তে চাইছেন এডি অ্যামন। শেকলের মৃদু ঝনঝন ছাড়া মন্দিরে আর কোনও আওয়াজ নেই। সবার চোখ এখন রাজনীতিকের ওপর স্থির।
নিষ্ঠুর হাসি মাইক বুচারের মুখে। এই মুহূর্তগুলো সবসময় ভাল লাগে তার। এডি অ্যামনের কেমন লাগছে, বা কেন তাঁকে মরতে হবে, এসব নিয়ে ভাবছে না সাইকোপ্যাথ। আসল কথা হচ্ছে, কতটা কষ্ট দিয়ে কাউকে খুন করা গেল। আনমনে ভাবল বুচার, কপাল ভাল হলে একদিন হয়তো কোনও মেয়েকে এভাবে খুন করবে এরা। তাতে ওর লাগবে দারুণ মজা। আর বুড়ো খচ্চর খুনের কাজটা ওকে দিলে তো কথাই নেই!
আবারও ক্র্যাচ শব্দে খুলে গেল লোহার দরজা। এবার মন্দিরে ঢুকে মঞ্চে উঠল জল্লাদ। হুডিওয়ালা কালো আলখেল্লা নেমেছে গোড়ালিতে। আততায়ীর হাতে টকটকে লাল স্যাটিন দিয়ে মোড়া দীর্ঘ কিছু। কাপড়টা সরাতেই আগুনের আলোয় ঝিক করে উঠল আনুষ্ঠানিক ধারালো ছোরাটা। বন্দির সামনে গিয়ে দাঁড়াল আততায়ী
প্রথমবারের মত মুখ খুলল ব্রুনার। মন্দিরের ভেতর গমগম করে উঠল তার কণ্ঠ: ‘এডি অ্যামন, মৃত্যুর আগে তোমার কিছু বলার আছে?’ জল্লাদের দিকে চেয়ে ইশারা করল সে। রাজনীতিকের মুখ থেকে চামড়ার ফিতা সরাল জল্লাদ। গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এডি অ্যামন। মাথা নেমে গেছে বুকের কাছে, শ্বাস নিচ্ছেন অনিয়মিতভাবে। মুখ তুলে লালচে চোখে ব্রুনারের দিকে তাকালেন। তাঁর মুখ ভরা থুতু থোক্ করে ছিটকে সাদা-কালো মেঝেতে গিয়ে পড়ল। অতদূর পৌঁছল না, তবে বোঝা গেল ওটা ছোঁড়া হয়েছে বিলিয়নেয়ারের মুখের উদ্দেশেই।
নিচু গলায় নরম সুরে আততায়ীকে বলল লুকা ব্রুনার, ‘ওর হৃৎপিণ্ডটা উপড়ে বের করে নাও।’
দ্বিধাহীনভাবে ছোরা তুলল খুনি। হলদেটে আগুনে ঝিক ঝিক করছে ক্ষুরধার ফলা।
সম্মোহিত দৃষ্টিতে এডি অ্যামন ও জল্লাদকে দেখছে সবাই। হাসিটা আরও চওড়া হলো বুচারের। চিকন একটা হাসি ফুটল ব্রুনারের সরু ঠোঁটে।
ছোরাটা দ্রুত নামতেই ঝাপসা দেখাল ওটার ফলা। ছোরার তীক্ষ্ণ ডগা দেখে আঁৎকে উঠলেন এডি অ্যামন।
তবে তাঁর মাথার ওপরে কাঠের গায়ে ঘ্যাঁচ করে বিধল ছোরা। আততায়ী ওটার হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দিতেই থরথর করে কাঁপতে লাগল অস্ত্রটা।
এক পা এগোল লুকা ব্রুনার। কুঁচকে গেছে দুই ভুরু। কিছু বলতে মুখ হাঁ করল। বুঝে গেছে, বড়সড় কোনও ঝামেলা সৃষ্টি হতে চলেছে।
বন্দির সামনে থেকে সরে গেল আততায়ী। আলখেল্লার ভেতর থেকে বের করল সাইলেন্সার লাগানো একটা ৩৮ ক্যালিবারের ওয়ালথার। অস্ত্রটা সরাসরি তাক হলো দর্শকদের দিকে।
দেরি না করে নিজের অস্ত্র বের করতে হোলস্টারে। দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মাইক বুচার। কিন্তু ভোঁতা আওয়াজ তুলে তার পায়ের কাছে মেঝেতে এসে লাগল একরাশ গুলি। ভয়ে হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল সাইকোপ্যাথের।
ছায়া থেকে আলোয় বেরিয়ে এল মুখোশ পরা দুই গার্ড। মোমবাতির আলোয় ঝিকিয়ে উঠল তাদের হাতের পেটমোটা কালো অটোমেটিক ওয়েপন। মিনিট দশেক আগে মন্দিরের দুই গার্ডকে কাবু করে তাদের জায়গা নিয়েছে জসিম আর মোমিন। পাথুরে কলামের ওদিক থেকে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল আরও দু’জন। সালাম ও মোকাই তালুকদার। গুঁড়ির সামনে থেমে শেকল থেকে এডি অ্যামনকে ছুটিয়ে নিল মুকুল ইঞ্জিনিয়ার।
মাথার হুড খুলে গা থেকে জল্লাদের আলখেল্লা খসিয়ে মাটিতে ফেলল রানা। ওর পায়ের কাছে পড়েছে পোশাকটা। লাথি মেরে ওটা সরিয়ে দিল একপাশে।
আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে লুকা ব্রুনারের সঙ্গীরা। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে তাদের নেতার দিকে। আশা করছে, এর কোনও ব্যাখ্যা দেবে কাউন্ট কোবরা। কিন্তু ব্যাখ্যা কী দেবে, বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেছে ব্রুনারের। শীতল চোখে তাকে দেখল রানা। মনে মনে বলল, ‘বুঝতে দেরি করে ফেলেছ!’
ঠিকভাবেই কাজ হয়েছে রানার প্ল্যানে।
মন্দিরের পেছন-ঘরে ঝামেলা হয়নি দুই গার্ড ও জল্লাদকে কাবু করতে। ওই ঘরে এখন পড়ে আছে তিনটে লাশ। লুকা ব্রুনার ও তার স্যাঙাত্রা পৌছুবার আগেই আলখেল্লা পরে মন্দির দখল করেছে ওরা।
জ্বলন্ত ঘৃণা নিয়ে রানাকে দেখছে মাইক বুচার। হাতে অস্ত্র না থাকলেও লুকা ব্রুনারের দলে সে-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক। হ্যামার তুলে সেফটি ক্যাচ অফ করে তার বুকে ওয়ালথার তাক করল রানা, সতর্ক। ওর আঙুল এখন ট্রিগার গার্ডের ভেতর। ট্রিগারে সামান্য চাপ পড়লেই খটাস্ করে হ্যামার নামবে গুলির পেছনে। প্রাইমার জ্বলে উঠলেই ব্যারেল দিয়ে বেরিয়ে আসবে .৩৮ হলো-পয়েন্ট বুলেট। এক সেকেণ্ডের এক শ’ভাগ সময়ও লাগবে না সেটা বুচারের বুকে ঢুকতে। দেহের ভেতর অন্তত বিশটা টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সীসার স্প্লিন্টার। বড় একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে বেরোবে পিঠ ফুঁড়ে।
ট্রিগারে চেপে বসল রানার আঙুল। ও দেখছে বুচারের চোখ। একটা বুলেট প্রাপ্য তার অ্যালেকের জন্যে। দ্বিতীয়টা লিয়ার জন্যে। এরপর প্রথম ম্যাগাযিন খালি করবে লুকা ব্রুনারের বুকে। মন্দিরের মেঝেতে রক্তের সাগরে পড়ে থাকবে দুই জানোয়ার। শীতল রাগে মৃদু কাঁপছে রানা। জ্বলছে চোখের কোণ। মনে পড়ছে লিয়ার হাসিমুখ। কী যেন বলছিল ওকে। রানার গলার ভেতর তৈরি হলো মস্তবড় একটা দীর্ঘশ্বাস।
‘রানা!’ বামদিক থেকে এল কণ্ঠস্বর 1
বুচারের ওপর থেকে পিস্তলের নল না সরিয়ে ওদিকে তাকাল রানা।
ক্লান্ত চোখে ওকে দেখছেন রাজনীতিক এডি অ্যামন। নরম সুরে বললেন, ‘কাজটা করবে না, প্লিয! ‘
‘এ ছাড়া উপায় নেই,’ ট্রিগারে চাপ বাড়াল রানা। এবার পৃথিবী ছাড়বে ব্রিটিশ জানোয়ার।
‘আমার সঙ্গে কিন্তু অন্য চুক্তি করেছেন আপনি,’ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এডি অ্যামন, ‘আমরা তো খুনি নই, তাই না?’
মাত্র একবার ট্রিগার টিপে দিলেই…
মনে আগুন জ্বলছে রানার। তবে মস্তিষ্ক বলছে: কাজটা এখন না করাই ভাল।
‘এদেরকে গ্রেফতার করা হবে,’ বললেন এডি অ্যামন, ‘বাকি জীবন আর জেল থেকে বেরোতে পারবে না। আপনি কিন্তু এ কথা বলেই আমাকে রাজি করিয়েছেন। কারও মগজে বুলেট গেঁথে দেয়া কোনও সুবিচার হতে পারে না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ধীরে ধীরে তর্জনী বের করল ট্রিগার গার্ডের ভেতর থেকে। সেফটি ক্যাচ অন করে নামিয়ে নিল পিস্তল।
বাঁদরের মত ভেঙচি কেটে হাসল বুচার। অবিশ্বাস নিয়ে রানাকে দেখছে লুকা ব্রুনার। অর্ধেক হাঁ তার মুখ। কিন্তু কিছু বলার সাহস নেই।
বরফের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে তার সঙ্গীরা। ছায়া থেকে বেরিয়ে এল রানার দলের সবাই। কাঁধে কারবাইন।
বুড়ো লোকগুলোর মুখ ফ্যাকাসে। অস্ত্রগুলো দেখছে বড় বড় চোখে। সবার কপালে চিকন ঘাম।
হঠাৎই টলে উঠল ডাক্তার ব্যানওঅর্ট। ব্যথায় বিকৃত হলো মুখ। খামচে ধরল বামবুক। লোকটা ধুপ্ করে পড়ল মেঝেতে। ছটফট করছে কাটা মুরগির মত।
হার্ট অ্যাটাক!
রফিক আহসান প্রশিক্ষিত মেডিক। কারবাইন কাঁধে ঝুলিয়ে অস্ট্রিয়ান ডাক্তারের পাশে গিয়ে বসল। আর তখনই ঝটকা দিয়ে ডানহাত ওপরে তুলল ব্যানওঅর্ট। চিত হয়ে পড়ার সময় রফিকের মুখে অবিশ্বাস দেখল রানা। দু’ফাঁক হয়ে গেছে ওর প্রিয় শিষ্যের গলা! ব্যানওঅর্টের হাতের মুঠোয় সরু স্টিলেটো!
নানান চিৎকারে ভরে উঠল মন্দির। জসিম ও সালাম যে- কোনও সময়ে ঝাঁঝরা করবে ব্যানওঅর্টের বুক। তবে গলা চড়িয়ে নিষেধ করলেন এডি অ্যামন, ‘দয়া করে গুলি করবেন না কেউ!’
চোখের কোণে রানা দেখল, ঘরের পেছনে ছায়ায় নড়ছে ভারী একটা পর্দা। রফিকের দিক থেকে দৃষ্টি সরাল ও।
এখন আর মন্দিরে নেই ব্রুনার বা বুচার!