বায়ান্ন
ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকল রানা।
দু’হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে একজন। চোখে কঠোর দৃষ্টি। টেকো মাথায় পিছলে যাচ্ছে পেছনের করিডোরের আলো। লোকটার দুই কানের ওপরে দু’গোছা চুল। তার পেছনে এসে থামল দ্বিতীয় গার্ড। আকারে সে প্রথমজনের প্রায় দ্বিগুণ। ভুরু কুঁচকে দেখছে রানাকে।
‘মাফ করবেন,’ জার্মান ভাষায় বলল রানা, ‘বাথরুম খুঁজছিলাম।’
‘এটা ম্যানশনের মালিকের ব্যক্তিগত কামরা,’ বলল টেকো গার্ড। ‘আপনি এখানে কী করছেন?’ রানার কাঁধের ওপর দিয়ে খোলা ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দেখল সে। কঠোর সুরে জানতে চাইল, ‘আপনিই খুলেছেন ওই জানালা?’ মনে সন্দেহ আসতেই সরু হয়েছে তার দুই চোখ।
ব্যালকনির হ্যাণ্ডরেইলে ঘষা খাচ্ছে কালো দড়ি। রানার দিকে এক পা এগোল লোকটা। একহাত রেখেছে কোমরে ঝুলন্ত রেডিয়োর ওপর।
‘অতিরিক্ত ওয়াইন খেয়ে কেমন যেন লাগছে,’ বিব্রত হাসল রানা।
‘নিচতলায় বাথরুম আছে,’ কড়া সুরে বলল দ্বিতীয় গার্ড। ‘পথ হারিয়ে উঠে এসেছি,’ বলল রানা। ‘বিরাট প্রাসাদ।’ ওর কথায় সন্তুষ্ট নয় দ্বিতীয় গার্ড, মাথা নাড়ছে। ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর দিকে এগোল তার সঙ্গী টেকো।
চট্ করে ব্যালকনির দিকে চেয়ে রানা পরিষ্কার দেখল, শ্বেত পাথরের মেঝেতে ফুটে আছে কালো রাবার মোড়া আংটা। যে-কোনও সময়ে ওটা দেখবে গার্ডরা।
রানা যা ভেবেছে, তাই হলো। আংটার ওপর চোখ পড়তেই কোমর থেকে হ্যাঁচকা টানে রেডিয়ো নিল টেকো। অস্ত্র বের করতে জ্যাকেটে হাত ভরেছে লম্বা গার্ড।
বিলিয়ার্ড টেবিল থেকে মাত্র এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে রানা। আরেক পা এগোতেই হাতে পেল দীর্ঘ, মসৃণ, পোক্ত কিউ। ঝট করে কাঠের লাঠিটা তুলেই খটাস্ আওয়াজে টেকো গার্ডের মাথার চাঁদিতে নামাল রানা। ‘ওঁউক্স!’ বলেই হাত থেকে রেডিয়ো ফেলে মেঝেতে শুয়ে পড়ল টেকো।
ওদিকে জ্যাকেটের পকেট থেকে পিস্তল বের করে ফেলেছে বেঁটে গার্ড। টার্গেট যদি বা ফস্কে যায়, গুলির আওয়াজে ছুটে আসবে ম্যানশনের সব প্রহরী। লম্বা গার্ডের গতি খুবই দ্রুত হলেও সে রানার মত বিদ্যুৎ-গতি নয়। ভাঙা বিলিয়ার্ড কিউ-এর চোখা দিকটা ঘ্যাঁচ করে লোকটার ডানচোখে গেঁথে দিল রানা। মগজ ফুটো হওয়ায় মুহূর্তে মরেছে সাদা শিম্পাঞ্জি। দড়াম করে মেঝেতে পড়ল লাশ।
এদিকে আচমকা মেঝে ছেড়ে উঠেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রানার দিকে তেড়ে এল টেকো। ঝট্ করে একপাশে সরল রানা। ওর মাথার আধইঞ্চি দূর দিয়ে গেল জোরালো ঘুষি। ঠিক জায়গায় লাগাতে পারেনি বলে সামান্য ঘুরে গেছে টাক- মাথা। এই সুযোগে তার বুকের কাছে পৌঁছে গেল রানা। ডানহাতের মাংসল, শক্ত কিনারা দিয়ে চুরমার করে দিল টেকোর কণ্ঠা। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা। গলা থেকে বিশ্রী ঘড়ঘড় শব্দ হওয়ার আগেই বুট দিয়ে মাড়িয়ে তার ঘাড় ভাঙল রানা। ঘুরে দেখল, ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর ওদিকে ব্যালকনির রেলিং টপকে মেঝেতে নেমেছে কালো পোশাক পরা কেউ।
ছেলেটা জসিম হায়দার।
‘ভাল লাগছে, ঠিক সময়ে পৌঁছে,’ তাকে বলল রানা।
ঘরে ঢুকল জসিম। কালো উলের হ্যাট খুলে রানার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। পরক্ষণে ওর চোখে পড়ল মেঝেতে পড়ে থাকা দুই লাশের ওপর। ‘মাসুদ ভাই, খেলা তো দেখি শেষই করে দিয়েছেন!’
‘আসল খেলা শুরুই হয়নি এখনও। এসো, ধরো এই বাঁটকুর পা দুটো।’
কাবার্ডের দিকে এক-এক করে লাশদুটো টেনে নিল ওরা। মৃতদেহ লুকানোর পর রক্তে ভেজা কার্পেটের ওপর বিছিয়ে রাখল শুকনো ম্যাট্রেস। ততক্ষণে দড়ি তুলে ব্যাল থেকে ঘরে ঢুকেছে দলের বাকি পাঁচজন—রানা এতে রফিক, মোমিন, সালাম, মোকাই তালুকদার ও মুকুল ইঞ্জিনিয়ার। ওদের দলের অন্য ছয়জন এখন তিনটে দলে ভাগ হয়ে কাবু করছে নিচের গার্ডদেরকে।
দেরি না করে জসিম, রফিক, মোমিন, সালাম, মোকাই ও মুকুল ইঞ্জিনিয়ার চেক করে নিল ওদের সাইলেন্সার লাগানো সাবমেশিন গান কারবাইন।
‘এই যে আপনার প্রিয় অস্ত্র, মাসুদ ভাই,’ একটা ওয়ালথার পি. পি. রানার হাতে গুঁজে দিল জসিম। ‘তবে সাইলেন্সারটা নতুন।’
‘হাতে সময় নেই।’ বেল্টে ওয়ালথার গুঁজল রানা। একবার উঁকি দিয়ে দেখল, বাইরের করিডোরে কেউ নেই। ঘর ছেড়ে একে একে বেরোল ওরা। মেঝের পুরু কার্পেটের জন্যে কোনও আওয়াজ তুলবে না কমব্যাট বুট। অস্ত্র বাগিয়ে রানার পিছু নিল ওরা। এখন কেউ দেখলে ভুলেও ভাববে না, পথ হারিয়ে এদিকে এসেছে ওরা প্রস্রাব করতে।
এবার যা করার করতে হবে খুব দ্রুত। নিচতলা থেকে যোগাযোগ করছে না ভিটো রেমারিক। তবে নিশ্চয়ই এরই ভেতর মন্দিরের দিকে রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে লুকা ব্রুনারের দলের পিশাচরা।
দলের সামনে সামনে হাঁটছে রানা। মনে করতে চাইছে অ্যালেকের ভিডিয়ো ক্লিপের দৃশ্য। আরেকটা বাঁক নিল ওরা। সামনে একটা দরজা। এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে রানাকে। থমকে দেয়ালের তৈলচিত্র দেখল। অ্যালেকের ভিডিয়োতে ওটা দেখেছে। আঠারো শতকের দৃশ্য। বিশাল এক হলরুমে মিটিঙে বসেছে একদল লোক। এদিকে-ওদিকে ম্যাসোনিক সিম্বল। উঁচু কলাম। এর মানে কী, বুঝতে দেরি হলো না রানার। আবারও এগোল। ওর বুকে জ্বলছে শীতল ক্রোধের আগুন। ওরা পৌছে গেছে মন্দিরের খুব কাছে। ওখানেই জড় হবে লুকা ব্রুনার ও তার দলের নরপশুরা।
করিডোরের সামনে হঠাৎ করেই খুলে গেল একটা দরজা। একদিকের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করল রানা, জসিম, মোমিন, সালাম, মোকাই ও মুকুল ইঞ্জিনিয়ার। ওই দরজা পেরিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এল এক যুবক আর এক যুবতী। খিলখিল করে হাসছে মেয়েটা। হাতে হাত রেখে ক’পা যাওয়ার পর হঠাৎ সঙ্গীর হাত ছুটিয়ে দেয়ালের আয়নায় নিজেকে দেখল মেয়েটা। পরীক্ষা করছে মেকআপ আর চুল ঠিক আছে কি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাতাল কণ্ঠে বলল, ‘চেহারার যা হাল, সবই বুঝবে আমার মিস্টার বুড়োহাবড়া!’
‘কেউ কিচ্ছু বুঝবে না, ডার্লিং,’ টাই সিধে করছে যুবক। ‘চলো, চট্ করে পার্টিতে ফিরে যাই।’
আয়না দেখে পোশাক ঠিকঠাক করে নিচ্ছে মেয়েটা। সঙ্গীর তাড়া খেয়ে আধ পা এগোল। একটু সরলে আয়নায় পরিষ্কার দেখবে পেছনের করিডোরে রানাদেরকে।
টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রানা।
আয়নার দিকে চেয়ে দুষ্ট হাসল মেয়েটা। ঠোঁট বিকৃত করে পরক্ষণে পিছু নিল প্রেমিকের। কয়েক মুহূর্ত পর হাতে হাত রেখে হাসতে হাসতে করিডোরের আরেক বাঁকে হারিয়ে গেল তারা।
জসিমের দিকে তাকাল রানা।
জবাবে বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলল জসিম। ‘এত বেইমান হয় কেন সাদা মেয়েগুলো!’
‘আর সাদা ছেলেগুলো?’ চোখ নাচাল ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালাম।
‘ওটা ওর দোষ, কিন্তু ওই মেয়েটা তো বুড়ো স্বামীর পয়সার লোভে… ‘
‘চুপ,’ চাপা স্বরে বলল রানা। ইয়ারপিসে শুনতে পেয়েছে রেমারিকের কণ্ঠস্বর।
‘ওরা নেমে যাচ্ছে মন্দিরে।’
হাতঘড়ি দেখল রানা।
রাত এখন নয়টা চোদ্দ।