একান্ন
একই দিন।
বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা নেমেছে।
কাউন্ট কোবরার বিশাল ম্যানশনের সামনের জানালা দিয়ে বেরোচ্ছে ঝলমলে আলো। ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল রশ্মিতে দিন হয়ে উঠেছে ফ্যাসাড ও বাড়ির চারপাশের তুষারে ছাওয়া বিশাল এলাকা। বিরতিহীনভাবে ম্যানশনে উপস্থিত হচ্ছেন বিখ্যাত, কুখ্যাত, সম্মানিত ও ক্ষমতাশালী সব অতিথিরা একের পর এক। সাদা আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে ফেরারি, পোর্শে, মার্সিডিয, বেন্টলি, রোল্স রয়েস ইত্যাদি নাম করা দামি গাড়ি। প্রতিটার দরজা খুলে স্বাগত জানাচ্ছে ইউনিফর্ম পরা একাধিক ডোরম্যান। যদিও পথ হারাবার উপায় নেই, তবুও ক’জন গার্ড পথ দেখিয়ে অতিথিদেরকে পৌঁছে দিচ্ছে ম্যানশনের ভেতর। মনিব নেমে যাওয়ার পর প্রকাণ্ড বাড়ির একপাশে পার্কিং লটে যার যার গাড়ি রাখছে শোফাররা।
ম্যানশনের মার্বেল পাথরের বিশাল এন্ট্রান্স হলে জড় হচ্ছেন অতিথিরা। রুপালি ট্রেতে সবুজ বোতল ও লম্বা গ্লাস রেখে নানাদিকে ছুটছে সাদা টুক্সেডো পরা ওয়েইটাররা। অতিথির ইশারায় তাঁদের হাতে দক্ষতার সঙ্গে তুলে দিচ্ছে শ্যাম্পেন ভরা গ্লাস। ককটেইল বা ড্রাই মার্টিনি সার্ভ হচ্ছে বার থেকে। দীর্ঘ টেবিলে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রাজকীয় সব লোভনীয় খাবার। নাও যার যত খুশি!
সন্ধ্যাকালীন অত্যন্ত দামি পোশাক অতিথিদের পরনে, মহিলাদের গলা ও হাতে ঝিকমিক করছে দুর্মূল্য পাথর বসানো সব অলঙ্কার। চারপাশে মৃদু হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে ‘পুপ!’ শব্দে খোলা হচ্ছে ওয়াইন বা শ্যাম্পেনের কর্ক। উঁচু ছাতে বাড়ি খেয়ে ফিরছে বিটোফেনের সিম্ফনি। খুলে গেছে দেখার মত সুন্দর বলরুমের ডাবল ডোর। যে-কোনও সময়ে বেজে উঠবে স্ট্রিং কোয়ার্টেট, শুরু হবে ওয়ালয়ের প্রথম সেট। ডাক পড়বে প্রথম দফার নাচে। এরই ভেতর ড্যান্স ফ্লোরে জুটে গেছে অভিজাত পরিবারের কয়েকজোড়া যুবক- যুবতী।
ম্যানশন থেকে বহু দূরে মেইন গেটের বাইরে তুষারে ছাওয়া পথে পায়চারি করছে একজন গার্ড। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা দূর করতে হাত ঘষছে বা পা ঠুকছে। রেডিয়ো হ্যাণ্ডসেট কান থেকে নামিয়ে দেখল, বরফ-ঢাকা পথে আসছে আরেকটা গাড়ির আলো। এবারেরটা কালো রঙের জাগুয়ার। বিশাল গেটের সামনে থামল ওটা। ড্রাইভারের জানালার পাশে ঝুঁকল গার্ড। নিঃশব্দে যান্ত্রিকভাবে নেমে গেল কাঁচ। গাড়ির ভেতরে উঁকি দিল গার্ড। পেছনে দু’জন লোক। পরনে চমৎকার সুট। তার ওপর চাপিয়ে নিয়েছেন ওভারকোট। আজ যাঁরা অতিথি হয়েছেন, তাঁদের বেশিরভাগের চেয়ে বয়স কম এঁদের। বড়জোর ত্রিশ। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটের লোকটা মনে হয় দু’জনের কারও বডিগার্ড। পাথরের মূর্তির মত সরাসরি সামনে চেয়ে আছে ড্রাইভার।
‘নিমন্ত্রণপত্র, প্লিয?’ কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইল গার্ড। অপেক্ষা করছে, এবার পরীক্ষার জন্য তার হাতে দেয়া হবে কার্ডগুলো।
অতিথিদের হাত ঢুকে গেল কোটের পকেটে। বেরিয়েও এল ইনভিটেশন কার্ড। ওগুলো সংগ্রহ করে গাড়ি থেকে সরে গেটহাউসের দিকে চলল গার্ড। ওখানে আলো আছে। তবে দশ সেকেণ্ড দেখেই মাথা নাড়ল সে। বড় কোনও গোলমাল আছে ইনভিটেশন কার্ডে।
এগুলো নকল জিনিস!
ঝট্ করে জাগুয়ার গাড়ির দিকে ফিরল গার্ড।
আর তখনই চিরকালের জন্যে বুজে গেল তার চোখ।
শিথিল দেহটা তুষারে পড়ার আগেই ধরে ফেলল রানা। গেটহাউসের আরেকদিক থেকে এল বিস্মিত চিৎকার। দ্বিতীয় গার্ড রেডিয়ো হাতে তোলার আগেই খুলে গেছে জাগুয়ারের পেছন-দরজা। নেমে পড়েছে এক অতিথি। তার হাতে সাইলেন্সার ফিট করা লুগার পিস্তল। মগজে বুলেট নিয়ে গেটহাউসের দরজার পেছনে ধপ করে পড়ল দ্বিতীয় গার্ড।
জাগুয়ারের পেছনের ওই অনাহূত অতিথির নাম রামিন রেযা। অল্প কিছু দিন আগে যোগ দিয়েছে রানা এজেন্সিতে। নিজে ট্রেইনিং দিয়েছে ওকে রানা’। এবং সে কারণে ভাল করেই জানে, নিজের কাজে সামান্যতম গাফিলতি নেই ছেলেটার। ভবিষ্যতে যে-কোনও সময়ে কাজে লাগবে বলে গত ছয়মাসে শিখে নিয়েছে জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষা। আপাতত জার্মান ভাষাটা কাজে লাগবে, কারণ ওকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গেটহাউসে। কেউ এলে ম্যানশনে ঢুকতে দেবে। ওর কাজে সাহায্য করবে ফরাসি পেঁচা ব্রিয়া ফুলজেন্স। ওর এই নামটা হয়েছে বড় চশমার কারণে। প্রফেসর প্রফেসর চেহারা দেখে কারও সাধ্য নেই বোঝে, সে আসলে কে। ওর টার্গেট যখন বোঝে সে খুন হচ্ছে, ততক্ষণে বড় বেশি দেরি হয়ে যায়।
গেটহাউসের ভেতর দুই মৃত গার্ডকে শুইয়ে দিল রামিন রেযা আর ব্রিয়া ফুলজেন্স। সন্তুষ্টি নিয়ে মাথা দোলাল রানা। ওভারকোট ও টুক্সেডো জ্যাকেট খুলল রামিন ও ফুলজেন্স। শীতে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে পরল দুই গার্ডের ইউনিফর্ম।
আবারও গিয়ে জাগুয়ার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠল রানা। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে গম্ভীর চেহারায় বসে আছে রানার জান-ই-দোস্ত ভিটো রেমারিক। রানা প্রস্তাব দিতেই খুশি মনে রাজি হয়েছে এই মিশনে যোগ দিতে। বলেছে, ‘বহুদিন হোটেল চালিয়ে খিল ধরে গেছে হাত-পায়ে। তুমি ডাকলে নরকে যেতেও কোনও আপত্তি নেই আমার।’
এডি অ্যামনের কোয়ার্টার থেকে খুব তাড়াহুড়োয় এই তিনজনকে ফোন দিয়েছিল রানা। বলে দিয়েছে, যেন দেরি না করে চলে আসে ভিয়েনায়। রেমারিককে দারুণ মানিয়ে গেছে টুক্সেডোতে। চুল এখন জেল-এর কল্যাণে চকচকে কালো। পার্টিতে মুখে থাকবে আন্তরিক হাসি। চট্ করে মিশে যেতে পারবে অতিথিদের মাঝে। আর একবার কাজে নামলে ওর তুলনা শুধু ও-ই।
গেটহাউস থেকে বাটন টিপে দেয়ায় যান্ত্রিক খের-খের শব্দে খুলে গেল উঁচু গেট। দূরে ম্যানশনের চারপাশে উজ্জ্বল আলো। গেট পেরিয়ে মৃদু আওয়াজে ড্রাইভওয়ে ধরে ওদিকে চলল জাগুয়ার। কাছে পৌঁছে যেতেই ম্যানশনটাকে দেখাল উঁচু পাহাড়ের মত। জোরালো আলোয় ঝলমল করছে বিশাল ফ্যাসাড। নানাদিকে আইভি লতার সবুজ কারুকাজ। গাড়ি রাখার আগেই সরু একটা কেস খুলে ভেতর থেকে চশমা নিল রানা। টিন্টেড কাঁচে কোনও পাওয়ার নেই। নাকে চশমা বসিয়ে শেষবারের মত চেক করল এয়ারপিস। গাড়ি থেকে নেমে ভ্যালের হাতে গছিয়ে দিল জাগুয়ারের চাবি। নেমেছে রেমারিকও। নিঃশব্দে অনুসরণ করল রানাকে। এন্ট্রান্সে ওদেরকে স্বাগত জানাল কয়েকজন ডোরম্যান। দীর্ঘ কালো কোট খুলতে রানা ও রেমারিককে সাহায্য করল তাদের একজন। ভেতরে জমে উঠেছে পার্টি। রিসেপশন হলে ঢুকে আলাদা দুই দিকে চলল দুই বন্ধু। পরস্পরের দিকে না চেয়ে মিশে গেল অতিথিদের মাঝে।
ম্যানশনের প্রথমতলা উষ্ণ। বাতাসে মিউযিক ও শ দুয়েক মানুষের কলগুঞ্জন। একজন ওয়েটার ট্রে ভরা গ্লাস সহ পাশ দিয়ে যাচ্ছে দেখে, তার কাছ থেকে শ্যাম্পেনের একটা গ্লাস নিল রানা। হিমশীতল সোনালি তরলে চুমুক দিতেই জিভে জড়িয়ে গেল ঝাঁঝালো মিষ্টি স্বাদ। বিশাল এন্ট্রান্স হলের কোণে পৌঁছে দেয়াল-ঘেঁষা কারুকাজ করা বড় এক আয়নায় নিজেকে দেখল রানা। কালো টুক্সেডোয় মন্দ লাগছে না ওকে দেখতে। আইব্রাউ পেন্সিল দিয়ে বদলে নিয়েছে ভুরু। মুখ ও হাতে সাদা মেকআপ। চট্ করে লুকা ব্রুনার বা মাইক বুচারও বুঝবে না, ও আসলে ইউরোপিয়ান নয়। রানা প্রথম সুযোগে ঢুকবে ম্যানশনের আরও গভীরে। খুঁজে বের করবে সেই পৈশাচিক মন্দির।
একটা সাইড টেবিল থেকে চকলেট বিস্কুট নিল রানা। ওটা খাওয়া শেষ করে অভিজাত ভঙ্গিতে ন্যাপকিন দিয়ে মুছল ঠোঁট। তারই ফাঁকে নিচু গলায় বলেছে, ‘চেক।’
পরক্ষণে ওর কানে এল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা রেমারিকের কণ্ঠস্বর: ‘সব ঠিক।’
অলস চোখে চারপাশে তাকাল রানা। এই হলওয়ে এতই বড়, ভেতরে পুরে দেয়া যাবে মাঝারি সাইযের আস্ত এক জেট বিমান। ওপর থেকে হলওয়ের মাঝে নেমেছে লাল কার্পেট মোড়া চওড়া সিঁড়ি। বহু ওপরে গম্বুজের মত ছাত। নানাদিকে স্যাটিন কাপড়ের পর্দা। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে দুর্দান্ত সব দামি চিত্রকর্ম। সেগুলোর ভেতর একটাকে লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির অরিজিনাল তৈলচিত্র বলেই মনে হলো ওর।
রাজকীয়ভাবে দু’ভাগ হয়ে দোতলার দিকে উঠেছে চওড়া সিঁড়ি। সোনালি সিল্কের দড়ি দিয়ে কর্ডন করা হয়েছে ওপরের ল্যাণ্ডিং। সিঁড়ির পায়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই গার্ড। প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না আগ্নেয়াস্ত্র আর রেডিয়ো আছে তাদের কাছে। সরে গিয়ে হলরুমে ঢুকল রানা। মৃদু আওয়াজে বাজছে স্ট্রিং কোয়ার্টেট। আশপাশে কোথাও নেই রেমারিক।
ঘুরে-ফিরে অতিথিদেরকে দেখছে রানা। এরা সবাই বিত্তশালী ও উঁচু সমাজের মানুষ। তাদের স্ত্রীরা পার্টিতে এসেছে স্বামীর ওপর চোখ রাখতে। এই বুঝি তাদের সংসার ভাঙল সুন্দরী কোনও বাজে মেয়েলোক!
উল্টোও হতে পারে।
হোঁতকা, বুড়ো কোনও খচ্চর ব্যবসায়ী হয়তো কঠিন দৃষ্টি রেখেছে তরুণী স্ত্রীর ওপর। বলা তো যায় না, কোনও যুবক হয়তো শুয়ে পড়বে তার স্ত্রীকে নিয়ে খালি কোনও বেডরুমে!
এই পার্টির বেশিরভাগ অতিথিই জানে না, বাড়ির নিচে মন্দিরে একজন মানুষকে খুন করা হবে বলে আজ আয়োজন করা হয়েছে এই অনুষ্ঠানের! ফুর্তি করে বাড়ি ফিরবে তারা। বুঝবেও না গোপনে ঘটে গেছে কী ভয়ানক নির্মম হত্যাকাণ্ড।
ট্রে হাতে এক ওয়েটার যাচ্ছে দেখে আরেক গ্লাস শ্যাম্পেন নিল রানা। তখনই দেখল এদিকে আসছে লুকা ব্রুনার! মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, ওর চোখে তাকাল ভাইপার। ধীর ভঙ্গিতে ফিরে দাঁড়াল বিসিআই এজেন্ট। বুকে ছলকে উঠেছে উষ্ণ রক্ত। লোকটা আরও কাছে আসতেই ড্রিঙ্কে চুমুক দিল রানা। ভাবছে: এই পার্টিতে এসে নিজেকে দিগম্বর লাগছে কেন!
অবশ্য দু’ফুট দূর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল বিলিয়নেয়ার। চাপা শ্বাস ফেলল রানা। ভিড়ের ভেতর গিয়ে ঢুকেছে হারামি বুড়ো।
স্বস্তির শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই রানা টের পেল, কেউ একজন চেয়ে আছে ওর দিকে।
ঘুরে তাকাল ও। ড্যান্স ফ্লোরে ড্রিঙ্ক হাতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। রানার চোখে চোখ পড়তেই সামান্য কুঁচকে গেল তার দুই ভুরু। কী যেন ভাবছে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।
হীরা বসানো ক্লিপ দিয়ে সোনালি চুলগুলো মেয়েটার মাথার ওপরে স্তূপ করা। পিঠ-খোলা বল গাউনে দুর্দান্ত সুন্দরী লাগছে তাকে। তবে রানা বুঝে গেল, কড়া মেকআপ নিয়েছে ওই মেয়ে। মাথার সোনালি চকচকে চুলগুলো নকল।
ঘুরে ভিড়ে হারিয়ে গেল ক্রিস্টা গুন্থার।
সত্যি কি মেয়েটার চোখে চিনে ফেলার দৃষ্টি ছিল, ভাবল রানা। ক্রিস্টাকে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারবে না। তবে আপাতত এ বিষয়ে ওর কিছুই করার নেই।
ডাবল-ডোরের কাছ থেকে হলওয়ের দিকে তাকাল রানা। সিঁড়ির সামনে থেকে সরে গেছে দুই গার্ড। চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা।
এখন বাজে রাত আটটা বায়ান্ন।
মুখের কাছে হাতের তালু গোল করে মৃদু কাশি দিল রানা। বলরুম থেকে রওনা হলো সিঁড়ির দিকে। আরেকবার কেশে নিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘ডাইভার্শন।’
দুই সেকেণ্ড পর বলরুম থেকে এল জোরালো ঝনঝন আওয়াজ। এইমাত্র ল্যাং খেয়ে ট্রে ভরা গ্লাস নিয়ে মেঝেতে পড়েছে এক ওয়েটার। ওখানে দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে কালো চুলের এক যুবক অতিথি। ঝাড়ু আর পেপার টাওয়েল হাতে ওদিকে ছুটে গেল দুই ওয়েটার। এই দুর্ঘটনা নিয়ে নিচু গলায় কথা বলছে অতিথিরা। ব্যস্ত হয়ে কাজে নামল তিন ওয়েটার। বেশিক্ষণ লাগল না ভাঙা কাঁচ ও শ্যাম্পেন মেঝে থেকে সরিয়ে নিতে। ওই কয়েক মুহূর্তই দরকার ছিল রানার, রেমারিকের কথা ভাবতে ভাবতে হালকা পায়ে উঠে গেছে সিঁড়ির প্রথম ল্যাণ্ডিঙে। চট্ করে কাঁধের ওপর দিয়ে দেখে নিয়েছে নিচে।
কেউ চেয়ে নেই।
দড়ির কর্ডন টপকে টুক্সেডোর পকেটে চশমা রেখে হনহন করে উঠে গেল রানা দোতলায়।
বাড়ির বাইরে কাজে নামার জন্যে তৈরি থাকবে রানা এজেন্সির জসিম হায়দার, রফিক, আহসান, সালাম, মোমিন ও মোকাই তালুকদার। রানার জানা নেই কতজন গার্ডকে কাবু করতে পেরেছে ওরা। আপাতত মনে হচ্ছে কোথাও কোনও গোলমাল নেই।
‘মন্দিরের ব্যাপারে কিছু জানলে?’ দোতলায় থেমে নিচু গলায় জানতে চাইল রানা।
ওদিক থেকে সাড়া নেই
একটু পরেই রানার কানে মৃদু খড়মড় আওয়াজ তুলল এয়ারপিস। তারপর শুনল: ‘বাইরে থেকে ঢোকার উপায় নেই।’
গলাটা চিনল রানা। মুকুল ইঞ্জিনিয়ার। পরিবারের বড় ছেলে। চারটে ছোট ভাই-বোনের খাওয়া ও লেখাপড়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বাংলাদেশ নেভির চাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছে রানা এজেন্সিতে। দক্ষ সৈনিক।
বাইরে থেকে ওরা মন্দিরে ঢুকতে পারবে না, আগেই আন্দাজ করেছিল রানা। ঘুরে দেখতে লাগল করিডোরগুলো। খুঁজে বের করতে হবে অ্যালেকের ভিডিয়োতে দেখা সেই করিডোরটা। এক করিডোরে ঢুকে ওর মনে হলো, জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে। থামল গিয়ে একটা অ্যালকোভের সামনে। ওটার ওপরের দিক ওর মাথার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি উঁচু। মার্বেলের পেডেস্টালে দাঁড়িয়ে আছে মিশরীয় আর্টিফ্যাক্ট। ফেরাউনের মুখে কালো ও সোনালি মুখোশ। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার সময় নিজের অগোচরে ক্যামেরায় ওই দৃশ্য তুলেছিল অ্যালেক।
না, ঠিক দিকেই চলেছে রানা।
কিন্তু দোতলায় গোলকধাঁধার মতই জটিল সব করিডোর। বামে একটা দরজা পেরোবার পর সামনে পড়ল আরেকটা দীর্ঘ করিডোর। দু’পাশের দেয়ালে ঝুলছে নানান অ্যান্টিক ও সোনালি ফ্রেমে বাঁধাই করা পেইন্টিং। আরেকবার হাতঘড়ি দেখল রানা। খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়।
শীতল একটা চিন্তা এসে খামচে ধরল ওর হৃৎপিণ্ড।
যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে?
করিডোরের সামনের একটা দরজা খুলতে চাইল রানা।
ওটা লক করা।
করিডোর ধরে আরও এগিয়ে পরের দরজার সোনালি হ্যাণ্ডেল মুচড়ে বুঝল, ওটা খোলা। মৃদু ক্যাচ আওয়াজে ফাঁক হলো দরজা। ভেতরে পা রাখল রানা। সামান্য ফাঁক করে রাখল কপাট। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিয়ে পা বাড়াল সামনে। কিন্তু তখনই কোমরে গুঁতো দিল ভারী কী যেন। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে জিনিসটা কী তা বুঝতে চাইল রানা।
বিলিয়ার্ড টেবিল। ওটার কোনা ঘুরে এগোতেই দেখল, সামনের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দিয়ে এসে মেঝেতে পড়েছে চাঁদের রূপালি আলো। পাথরের ছোট এক ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল রানা। ঘর্মাক্ত মুখে লাগল বরফের মত ঠাণ্ডা হাওয়া। নিচে তুষারে ঢাকা জমিন। আশপাশে কোথাও নেই ওর দলের কেউ। আবার এ-ও ঠিক, চট্ করে ওদেরকে দেখে ফেলার কথাও নয়। প্রত্যেকে হাইলি ট্ৰেইণ্ড। ক্ষমতা অর্জন করেছে প্রায় অদৃশ্য হওয়ার।
পকেট থেকে মিনি ম্যাগলাইট নিয়ে দু’বার বাতি জ্বেলে নিভিয়ে দিল রানা। ওই সিগনাল দেখে লন পেরিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে এল কালো পাঁচ-ছয়টা ছায়া। থামল দোতলার ব্যালকনির নিচে। লনে কোনও গার্ড নেই যে ওদেরকে চমকে দেবে। রানা ভাল করেই জানে, ওর দলের ছেলেদেরকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল গার্ডরা।
ব্যালকনির রেলিং টপকে মেঝেতে পড়ল রাবার মোড়া বাঁকা আংটা। ওটার পেছনে বাঁধা কালো দড়িটা তুলে রেলিঙে বেঁধে দিল রানা। দু’বার ঝাঁকুনি দিতেই টানটান হলো দড়ি। নিচতলা থেকে উঠছে কেউ।
কিন্তু হঠাৎ করে রানার পেছনে আলোয় ভরে গেল ঘরটা। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। কর্কশ স্বরে জানতে চাইল লোকটা, ‘কী হচ্ছে এখানে?’