1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪

চার

উত্তর আয়ারল্যাণ্ড।

বেশ কয়েক বছর আগের কথা।

আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা। তবে একটু আগে থেমে গেছে অঝোর বৃষ্টি। সরু গলি ধরে পানির অগভীর সব ডোবা এড়িয়ে হেঁটে চলেছে মাসুদ রানা। দু’দিকের দেয়ালে নানান রঙে লেখা রয়েছে জঘন্য সব গালি। যেহেতু এসব তাঁকেই প্রদান করা হয়েছে, তাই নিজ চোখে দেখলে রাস্তাতেই হাঁটু গেড়ে কাঁদতে বসতেন পোপ। একটু দূরেই ঝিরঝিরে হাওয়ায় ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে দুলছে ছোট্ট বার-এর মস্ত সাইনবোর্ড। কয়েক পা হেঁটে পাথরের এন্ট্রান্স পেরিয়ে জংধরা স্টেয়ারওয়েতে উঠল রানা। ডাবল ডোর ঠেলে বার-এ ঢুকতেই শুনতে পেল মিষ্টি আওয়াজে বাজছে পিয়ানো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল রানা। আজ খদ্দের নেই বললেই চলে। বার কাউন্টারের সামনে পৌঁছে বসে পড়ল ও একটা টুলে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কর্কশ একটা কাপড় দিয়ে পাইন্ট গ্লাস ঘষছে মাঝবয়সী বারম্যান।

‘কী খবর, জিম?’ নিচু গলায় জানতে চাইল রানা।

ঘন দাড়ির ভেতর দেখা দিল কয়েকটা খয়ে যাওয়া দাঁত। ‘কোথাও কোনও সমস্যা নেই। আজও কি একই ব্র্যাণ্ড?’

‘তোমার আপত্তি না থাকলে।’

পেছনের তাক থেকে শিভাস রিগালের সবুজ বোতল নিল জিম ব্র্যাণ্ডন। গ্লাস নিয়ে ওটাতে ঢালল ডাবল স্কচ উইস্কি। গ্লাসটা কাউন্টারে রানার সামনে রেখে বলল, ‘আজকেই বোধহয় শেষ হবে এই বোতলটা।’

জবাবে কিছু বলল না রানা।

নতুন সুর বাজাচ্ছে পিয়ানোবাদক। এই পিয়ানো একটু বেসুরো। টিউন করা জরুরি। অবশ্য দক্ষ বাদকের কল্যাণে ঢাকা পড়ছে বেশিরভাগ ত্রুটি।

‘এই ছেলেটা ভাল বাজায়, তাই না?’ বলল জিম ব্র্যাণ্ডন। ‘তোমার মতই আর্মিতে আছে।’

ঘুরে আর্মির ইউনিফর্ম পরা পিয়ানিস্টের দিকে তাকাল রানা। ‘তাই তো দেখছি।’

‘আর্মিতে না গেলে পিয়ানিস্টের চাকরি অফার করতাম। এখানে লাইভ অনুষ্ঠান হলে জমে উঠত আমার ব্যবসা।’

ওই যুবক সৈনিককে চেনে রানা। নাম অ্যালেক বেকার। আগামী কয়েক দিন পর কঠিন একটা কমাণ্ডো ট্রেইনিঙে যোগ দেবে ওরা। বাংলাদেশ থেকে রানাকে পাঠানো হয়েছে এই জন্যই।

পিয়ানোর গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বেকারের বাজনা শুনছে সোনালি চুলের এক মেয়ে। একটু পর পর প্রশংসার চোখে দেখছে সুদর্শন যুবককে। জেরি লি লিউসের ভঙ্গিতে ঝড়ের বেগে রিড টিপছে বেকার। অন্তিম ঝঙ্কার তুলে একটু পর শেষ হলো বাজনা।

‘তোমার তুলনা হয় না,’ শ্বাস আটকে বলল স্বর্ণকেশী মেয়েটা। ‘তার চেয়েও বড় কথা, তুমি একজন সৈনিক। আমি কি ভুল বললাম?’

মৃদু হাসল বেকার। ‘আমি দুর্ধর্ষ এসএএস ফোর্সে আছি।’

‘যাহ্, সত্যিই?’ আহ্লাদী সুরে জানতে চাইল মেয়েটা। ‘হ্যাঁ,’ চোখ টিপল বেকার। ‘কিন্তু আজও বড় একাকী।’ খিলখিল করে হেসে উঠে অ্যালেক বেকারের পিঠে সেঁটে গেল মেয়েটা। ডানহাতে নতুন সুর তুলল সৈনিক, বামহাতে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েটার সরু কোমর। যুবতীকে টেনে নিল নিজের দিকে। ‘পিয়ানোবাদকের টুলে সবসময় দু’জন বসার জায়গা থাকে। বসে পড়ো। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কীভাবে ডুয়েট বাজাতে হয়।’

বেকারের গা ঘেঁষে বসল মেয়েটা। উষ্ণ ঊরুর ঘষা লাগছে যুবকের ঊরুতে।

‘তোমার নামটা কী?’ প্রশ্ন করল বেকার।

‘বাৰ্থা।’

মেয়েটাকে পটাতে চাইছে যুবক। মৃদু হেসে নিজের ড্রিঙ্কের দিকে ফিরল রানা। চোখাচোখি হতেই চোখ টিপল বারম্যান। ‘মনে হয় এ ব্যাটা বহু ঘাটের পানি খাওয়া কুমির!’

খুলে গেল বার-এর দরজা, ভেতরে ঢুকল চারজন যুবক। সামনে বেড়ে ঘরের মাঝের টেবিলটা দখল করল তারা। এদের বয়স বড়জোর পঁচিশ। শক্তপোক্ত শরীর। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। বার কাউন্টারে এসে চারজনের জন্যে চার পাইণ্ট লাগার বিয়ার নিল তাদের একজন। রানা সৌজন্যের খাতিরে মৃদু মাথা দুলিয়েছে, সেটা দেখেও দেখল না সে।

চার বন্ধুর ভেতর রয়েছে ঝগড়াটে চেহারার মোটা এক যুবক। সিটে ঘুরে পিয়ানোর দিকে তাকাল সে। কর্কশ স্বরে বলে উঠল, ‘বার্থা! এদিকে এসো!’ চোখ সরু করে অ্যালেক বেকারকে দেখছে সে।

পিয়ানোর টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। চেহারায় উৎকণ্ঠা। নিচু গলায় বেকারকে বলল, ‘এবার আসি।’

জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল সৈনিক। হতাশা নিয়ে বাজাতে শুরু করেছে সুরকার ফ্রেডেরিক শোপ্যানের একটা সুর। চার যুবকের সঙ্গে টেবিলে যোগ দিল বার্থা।

‘ওই হারামজাদার সঙ্গে তোমার কী?’ কড়া গলায় জানতে চাইল মোটা যুবক। চোখে আগুন। ‘ভুললে কী করে যে আমি তোমার কেউ হই?’

‘এমনিই একটু আলাপ করছিলাম,’ নরম সুরে বলল বার্থা। ‘ওর সঙ্গে কোনও ঝামেলায় যেয়ো না, চার্লি।’

পিয়ানোর পাশ থেকে পাইন্ট গ্লাস নিল অ্যালেক বেকার। এক চুমুকে শেষ করল সোনালি বিয়ার। চট্ করে দেখল হাতঘড়ি। টুল থেকে নেমে পাশ কাটাল চার যুবকের টেবিল। তার দিকে প্রশংসার চোখে চেয়ে আছে বার্থা।

পরস্পরের দিকে তাকাল চার যুবক।

দরজা পেরিয়ে গলিতে পা রেখেছে অ্যালেক বেকার। ভুরু কুঁচকে থুতনি দিয়ে ওদিকটা দেখাল মোটা চার্লি। বার্থাকে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, ‘অপেক্ষা করো।’ বিয়ার শেষ করেই চেয়ার ছাড়ল সে। একই কাজ করেছে তার তিন বন্ধু। বেরোবার দরজার দিকে চলল তারা।

পেছন থেকে কাতর সুরে ডাকল বার্থা, ‘চার্লি…

‘আর একটা কথাও না!’ মেয়েটার দিকে তর্জনী তাক করল মোটকু। হুমকির সুরে বলল, ‘এসব হচ্ছে শুধু তোমার কারণে! আগেও বলেছি যার-তার সঙ্গে ঘেষ্টাতে যাবে না!’

চার যুবকের মতলব খারাপ। বার ছেড়ে বেরিয়ে গেল তারা।

সবই বুঝেছে রানা। গ্লাস খালি করে টুল থেকে নেমে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল সরু গলিতে। এরই ভেতর অ্যালেক বেকারকে ঘিরে ধরেছে চার যুবক। তাদের দু’জন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলেছে একদিকের দেয়ালে। অন্য দু’জনের হাতে বেরিয়ে এসেছে সুইচ গিয়ার ছোরা। মোটকু চার্লির কঠিন এক ঘুষি পেটে নিয়ে দু’ভাঁজ হলো অ্যালেক। তবে সোজা হয়েই কপাল দিয়ে গুঁতো মেরে বসল চার্লির নাকে। কাতরে উঠে পিছিয়ে গেল মোটকু। ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। ফাটা নাক থেকে দরদর করে ঝরছে রক্ত। অন্য তিন যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ল অ্যালেকের ওপর। দু’জন মিলে ছোরা চেপে ধরল বেকারের গলায়। তৃতীয়জন পিছিয়ে এসে লাথি দিচ্ছে তার পেটে। বামদিকের বদমাশ একটানে বের করে নিল অ্যালেকের মানিব্যাগটা।

তিন যুবকের খেয়াল নেই পেছনে পৌঁছে গেছে আরেকজন। নিজের ভাঙা নাক নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত চার্লি। সুতরাং অন্য তিনজনের দিকে মনোযোগ দিল রানা। খপ্ করে মুঠিতে ধরল ডানদিকের ছোরাওয়ালার চুল, মাথাটা পেছনে টেনে এনেই কষে লাথি দিল ওরা কাফ মাসলে। ধড়াস্ করে মাটিতে পড়ল ছোকরা। ছটফট করছে পায়ের পেশি ফেটে যাওয়ার যন্ত্রণায়। অনায়াসেই তাকে খুন করতে পারে রানা। তবে তা না করে ওর পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ মাড়িয়ে সামনে এগোল। তীব্র ব্যথায় মাটিতে গড়াতে গড়াতে বুকফাটা, করুণ আর্তনাদ ছাড়ল যুবক। তার দুই বন্ধু বুঝে গেল, পড়ে গেছে তারা কঠিন পাত্রের হাতে। তবু একজন ছুরিটা বাগিয়ে ধরে চোখ-মুখ পাকিয়ে রানাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করল, ‘আয়! সামনে আয়!’

কিন্তু তার পরেও রানা এগোয় দেখে ঝট্ করে পিছন ফিরে প্রাণপণে ছুটল উল্টো দিকে। শেষজন সাহস হারিয়ে মানিব্যাগ ফেলে ঝেড়ে দৌড় দিল ছুরিওয়ালার পিছু পিছু।

এদিকে দু’হাত ওপরে তুলে লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হয়েছে মোটা চার্লি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার সারা মুখ। রানা বুঝে গেল কী পদের যোদ্ধা সে। স্রেফ গায়ের জোরে জিতে গেছে এতদিন। খেপা বলদের মত মাথা নিচু করে রানার দিকে তেড়ে এল চার্লি। মুহূর্তে রানা বুঝল, এর ঘুষি হবে ধীর গতির, ফলে সহজেই ব্লক করতে পারবে। তারপর তার গায়ের কাছে ঘেঁষে গেলেই মারতে পারবে ইচ্ছেমত।

রানার ধারণাই ঠিক। তবে ওর একমাত্র চিন্তা হয়ে উঠল, যেন অতিরিক্ত জোরে মেরে খুন করে না ফেলে গাধাটাকে।

ডানহাত ঘুরিয়ে ঘুষি মারল চার্লি। তবে তার হাত ব্লক করে কবজিটা মুচড়ে ভাঙল রানা। প্রায় একইসময়ে ওর জ্যাব ফাটিয়ে দিল মোটকুর দু’ঠোঁট। ভীষণ ব্যথা পেয়ে তিন পা পিছিয়ে হুড়মুড় করে একপাশের গার্বেজ বিনের ওপর পড়ল সে। কাছেই দুই হাতে ক্ষতিগ্রস্ত অণ্ডকোষ চেপে ধরে মাটিতে গড়াচ্ছে তার বন্ধু।

পেটে লাথি খেয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অ্যালেক বেকারের। ‘চলো, এবার যাওয়া যাক,’ কাঁধ ধরে তাকে সোজা হতে সাহায্য করল রানা। পায়ের নিচে শক্ত কী যেন ঠেকতেই ওদিকে তাকাল। ওটা চার্লির সামনের একটা দাঁত।

‘ঠিক সময়ে পৌছে গেছ, নইলে আমার হাতে স্রেফ খুন হয়ে যেত এরা সবক’টা,’ ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নেয়ার ফাঁকে বলল অ্যালেক বেকার। পরক্ষণে কুঁচকে গেল দুই ভুরু। চিনে ফেলেছে, এই যুবক অন্য দেশের হলেও আর্মির অফিসার। সোজা হয়ে খটাস্ করে স্যালিউট ঠুকল সে। ‘ইয়েস… স্যর!’

‘তুমি যে দারুণ লড়ছিলে তা তো দেখতেই পেলাম! এসএএস ফোর্স, না?’ অ্যালেকের ভেজা ওয়ালেট থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে কাগজপত্র। ওগুলো তুলল রানা। ড্রাইভিং লাইসেন্স, টাকা, একটা ছবি…

মানিব্যাগে কাগজপত্র ভরে ওটা অ্যালেকের হাতে দিতে গিয়েও থমকে গেল রানা। আবারও ওয়ালেটের ভাঁজ খুলে দেখল ছবিটা। এবার দিয়েছে পুরো মনোযোগ।

ছবিতে অ্যালেক রেকার আর এক তরুণী মেয়ে। পার্টিতে তোলা ছবি। মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরেছে যুবক। চেহারায় কেমন যেন বোকা-বোকা ভাব।

অ্যালেক বেকারের ছবির দিকে চেয়ে নেই রানা।

মেয়েটার পরনে পান্না-সবুজ ইভনিং ড্রেস। ওটা একদম ওর চোখের মণির মত একই রঙের। ফর্সা খোলা কাঁধে এলিয়ে পড়েছে কালো চুলের একরাশ মেঘ।

কয়েক মুহূর্ত ওই ছবি থেকে চোখ সরাতে পারল না রানা। তারপর অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ছবিটা মানিব রেখে অ্যালেক বেকারের দিকে বাড়িয়ে দিল। আড়ষ্ট বলল, ‘আমার এমন একজন গার্লফ্রেণ্ড থাকলে বার্থার মত সস্তা মেয়ের সঙ্গে মিশতে যেতাম না।’

ওয়ালেট নিয়ে পকেটে রাখল অ্যালেক বেকার। ওপরের ঠোঁট থেকে রক্ত মুছে বলল, ‘পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, স্যর। তবে ওই মেয়ে আমার গার্লফ্রেণ্ড নয়। ও আমার ছোটবোন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *