আটচল্লিশ
পরদিন সকাল।
লুকা ব্রুনারের ম্যানশনের দোতলায় ছোট্ট একটা ঘরে ঘুম ভাঙল এমিলি কেইলম্যানের। বালিশ থেকে মুখ তুলেই টের পেল, বনবন করে ঘুরছে মাথা। আনমনে ভাবল, কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম? চট্ করেই মনে পড়ল সব। আসলে কোনও কিছুই দুঃস্বপ্ন ছিল না। চিৎকার করতে করতে দু’হাতে কিল দিচ্ছিল দরজায়। তবে কিছুক্ষণ পরেই ব্যথা হয়ে গেল হাত। আর তখনই খুলে গেল দরজা।
হাজির হলো সেই শয়তান বুড়োটা। বাজপাখির চোখের মত ঝকঝকে তার চোখ। মুখে অশুভ হাসি। বুড়োর পেছনে ছিল লুকাস। কিন্তু এই বুড়ো তাকে ডাকল অন্য নামে। সবই বুঝে গেল এমিলি। বুকে জমল লোকটার প্রতি চরম ঘৃণা। ভাবল: ইবলিশটার কানের লতি ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে সারা মুখেই যদি ভয়ঙ্কর ঘা হতো, আর সেই লজ্জায় বাকি জীবন কোনও গর্তে লুকিয়ে থাকত, তা হলে বেশ হতো!
এমিলির মনে আছে, কীভাবে পশুর মত ওকে বিছানায় ঠেসে ধরেছিল শয়তানটা। প্রাণপণে লাথি মেরে মুক্ত হতে চাইলেও জানোয়ারটার শক্তির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
তখনই ঘরে ঢুকল আরেকজন। বোধহয় ডাক্তার। অথবা সাদা কোট পরা আস্ত ইবলিশ। লোকটার মুখে নকল হাসি। হাতে চামড়ার ছোট ব্যাগ। ওটা থেকে সিরিঞ্জ বের করল সে। ওদিকে ষাঁড়ের মত লোকটা এমনভাবে চেপে ধরল, কোনভাবেই সরতে পারল না ও। হাসতে হাসতে ওর বাহুতে সুঁই ফুটিয়ে দিল ডাক্তার। তারপর আর কিছুই মনে নেই।
হাতটা চোখের কাছে আনল এমিলি। ব্যথা রয়ে গেছে ইঞ্জেকশন দেয়া জায়গায়। চারপাশে চেয়ে বুঝল, রয়েছে আগের সেই ছোট ঘরেই। আসবাব বলতে প্রায় কিছুই নেই। মেঝেতে উল্টে পড়া খাবারের ট্রে। ওই খাবার চাই না বলে দেয়ার পরেও জোরাজুরি করছিল বলে লোকটার হাত থেকে ট্রে ফেলে দিয়েছিল ও। লোকগুলো খেলনাও এনেছিল। নোংরা, পুরনো কাপড়ের তৈরি পুতুল। ভেবেছিল, ওটা পেলেই বুঝি খুশিতে নাচতে শুরু করবে ও। যে-লোক ওকে ধরে এনে এই ঘরে ভরে দিয়েছে, তার মুখের ওপর পুতুলটা ছুঁড়ে মেরেছিল ও। এখনও ওটা পড়ে আছে দরজার কাছে।
আচ্ছা, কতক্ষণ ধরে ওকে এখানে আটকে রেখেছে?
মনে তো হচ্ছে হাজার হাজার বছর।
খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে দেখতে।
কোথায় এখন বাবা?
গায়ে ঘামের গন্ধ থাকলেও বাবা যে কত ভালমানুষ, পরিষ্কার জানে এমিলি। ঘাড় কাত করে কান পাতল। কে যেন নিচু গলায় কথা বলছে দরজার বাইরে!
ও জানে, বাইরে কেউ না কেউ পাহারা দিচ্ছে। ওই লোক বোধহয় সেই নকল লুকাস। অথবা ওই সুন্দরী মেয়েটা। মাঝে মাঝে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে যায়। এদের ভেতর সবচেয়ে ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ সে। দুঃখ পেয়েছে কোনও কারণে। নইলে চোখে এত কষ্ট কেন? তবে তাকে বিশ্বাস করবে না এমিলি। তার সঙ্গে কথাও বলবে না। ও-ও এই একই দলের।
বিছানায় সোজা হয়ে বসে জানালার দিকে তাকাল এমিলি। ওই জানালা বড়জোর একটা স্কাইলাইট। মাথার অনেক ওপরে ছাতের কাছে। আকাশের ঘন কালো মেঘ ছাড়া ওদিক দিয়ে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই বাড়িটা বোধহয় খুব নির্জন কোনও এলাকায়। চারপাশ খুব নীরব। বাইরে গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ নেই। তবে নিচে হয়তো হাঁটাচলা করছে মানুষ। একবার তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলে হয়তো তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাবে।
বিছানা থেকে নামতেই পা-দুটো খুব ভারী লাগল এমিলির। প্রথমবারের মত টের পেল, পাল্টে দেয়া হয়েছে ওর পোশাক। এখন পরনে ঢলঢলে, বেঢপ, কমলারঙা পায়জামা। ওর নিজের পোশাক নতুন করে ধুয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে একটু দূরের চেয়ারে।
টেনে স্কাইলাইটের নিচে চেয়ার নিল এমিলি। ওটার ওপর রাখা পোশাক ফেলে দিল মেঝেতে। একহাতে হেলান দেয়ার জায়গাটা ধরে এক পা তুলল চেয়ারের সিটে। তিন সেকেণ্ড পর তুলে নিল বামপা। টলমল করছে। একহাতে ধরতে চাইল স্কাইলাইট। তবে জানালা পর্যন্ত পৌঁছুল না আঙুল। শক্ত করে ধরার কিছুই নেই। মেরুদণ্ড টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল ও।
.
এমিলি যে ঘরে বন্দি, সেখান থেকে চার শ’ গজ দূরে মোটা এক গাছের পুরু ডালে বসে ২০x৫০ যেইস বিনকিউলার চোখে ম্যানশনের দিকে চেয়ে আছে মাসুদ রানা। অলস ভঙ্গিতে গাছটাকে দুলিয়ে দিচ্ছে শীতল হাওয়া। গাছ বেয়ে অনেক ওপরে উঠেছে রানা। আশা করছে গুঙিয়ে ওঠা ডাল ওকে নিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে নিচে পড়বে না।
রাজকীয় ম্যানশনটা খুঁজে নিতে কষ্ট হয়নি রানার। ওর ব্যাপারে জরুরি একটা তথ্য জানে না লুকা ব্রুনার। রানা এখন জানে ইতরটা কোন্ বাড়িতে বাস করে। আর ওখানেই আটকে রেখেছে এমিলিকে। পাথুরে কুঠরি থেকে বের করে মিশনের জন্যে দরকারি সব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ওকে। এখন ওর প্রথম কাজ হবে মেয়েটাকে উদ্ধার করে দূরে কোথাও সরিয়ে দেয়া। ওই কাজটা করতে গিয়ে লুকা ব্রুনারের মত দশটা জানোয়ারকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না। ঠিক করেছে মেয়েটার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আবার ফিরবে ব্রুনার, বুচার ও তাদের দলের লোকগুলোকে শায়েস্তা করতে।
অন্তত একটু আগেও এটাই ছিল রানার ভাবনা।
কিন্তু ম্যানশনটা দেখে বুঝে গেছে, চাইলেও ঢুকতে পারবে না ওটার ভেতর। বাড়িটা আসলে দুর্ভেদ্য, ছোটখাট কোনও দুর্গ। এস্টেটের উঁচু প্রাচীর কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ এক শ’ গজ পর পর ওয়াচ টাওয়ার। দেয়ালের মাঝে বিশাল খিলান করা দরজা। মস্ত দুই কপাটের ওপরে একটা করে ব্রোঞ্জের তৈরি বড়সড় ফণা তোলা গোক্ষুর সাপ। লোহার উঁচু গেট সোনালি রঙ করা। বাইরের দিকে চোখা গজাল। এস্টেটের গেটহাউসের সামনে পায়চারি করছে সশস্ত্র কয়েকজন প্রাক্তন মিলিটারি গার্ড। বিশাল বাগান ও নানান ধরনের ফোয়ারার মাঝ দিয়ে চওড়া রাস্তা গেছে সাদা পাথরের তৈরি ম্যানশনের কাছে। পেছনের উঁচু পাহাড়ে সারি সারি পাইন গাছের জঙ্গল।
বাড়ির উঁচু ব্যারোক ফ্যাসাডে ফোকাস করল রানা। ওপরতলায় অন্তত এক ডযন ছোট স্কাইলাইটের মত জানালা।
রানা বুঝে গেল, ম্যানশনে আছে অন্তত এক শ’র বেশি ঘর। এমিলি আছে সেগুলোর যে-কোনও একটায়।
.
চেয়ারের পিঠের ওপরে পা রেখে টলমল করছে এমিলি। সোজা হয়ে ছোট্ট দু’হাতে ধরতে চাইল জানালার খিল। কয়েক মুহূর্ত পর ধরেও ফেলল। ঠেলে ওপরে তুলতে চাইল খিল। তবে ইঞ্চিখানেক ওঠার পর আটকে গেল জংধরা কবজা। আর উঠছে না। একবার জানালা খুলতে পারলে চিৎকার করে সাহায্য চাইবে। আরও জোরে জানালার খিল ঠেলল এমিলি।
আরেকটু খুলল জানালা। ফাঁক দিয়ে হাত বের করতেই ওর আঙুলে লাগল শীতল হাওয়া। আর তখনই শুনতে পেল হেলিকপ্টারের জোরালো আওয়াজ।
.
গাছে বসে চকচকে কালো বেল ৪০৯ হেলিকপ্টারটাকে দেখছে রানা। ওটার গায়ে কিছুই লেখা নেই। কারুকাজ করা ফ্যাসাডের ওদিকে ম্যানশনের ঢেউ-খেলানো ছাতে নামছে যান্ত্রিক ফড়িং। ওটা থেকে কে নামবে বা কে উঠবে, জানার উপায় নেই।
বিনকিউলার দিয়ে ম্যানশনের সামনে একসারি গাড়ি দেখল রানা। ওদিকটা পাহারা দিচ্ছে অন্তত পনেরোজন গার্ড। নিশ্চয়ই সঙ্গে অস্ত্র আছে। ম্যানশনের ভেতরে আর কয়জন আছে, কে জানে! চারপাশের বাগানে চোখ বোলাল রানা। দেয়ালের ওদিকে গাছ ও ঝোপে লুকাতে পারবে যে- কেউ। তবে বাড়ির চারপাশে সিমেন্টের উঠান যেন খাঁ-খাঁ মরুভূমি। গার্ডের চোখ এড়িয়ে ওদিকে যাওয়া অসম্ভব। রাতে লন ও বাগানের ফুলের বেডে ফেলা হবে উজ্জ্বল আলো। কাজেই ওদিকে চোখ থাকবে সিকিউরিটি ক্যামেরার। কয়েক দলে ভাগ হয়ে নিয়মিত পায়চারি করবে গার্ডরা।
চোখ থেকে যেইস বিনকিউলার নামাতেই বহু দূরে ছোট এবং সাদা লাগল বাড়িটাকে। যন্ত্রটা গলায় ঝুলিয়ে কয়েক মিনিট ডালে বসে ভাবল রানা।
আগেও বহুবার ভয়ঙ্কর সব শত্রুর আস্তানায় হানা দিয়েছে। কিন্তু বিশাল ম্যানশনের আর্কিটেকচারাল প্ল্যান হাতে না পেলে ওখানে ঢুকতে যাওয়া হবে স্রেফ আত্মহত্যা করা। নিজে তো মরবেই, ওর জন্যে খুন হবে বাচ্চা মেয়েটাও আপাতত ম্যানশনে হামলার উপায় নেই। তা হলে বাকি রইল করার মত একটাই কাজ: ধরে এনে এডি অ্যামনকে তুলে দিতে হবে লুকা ব্রুনারের হাতে।
কালচে পুরু ডালের গোড়ায় পৌঁছে নিঃশব্দে গাছ বেয়ে নেমে এল রানা। পূর্ণবিশ্রাম পেয়ে তরতাজা হয়ে উঠেছে শরীর। প্যান্টের পায়ায় মুছে নিল হাতদুটো, তারপর রওনা হলো একটু দূরের রাস্তার দিকে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে উত্তরদিক থেকে। একটু পর ধূসর একটা ভ্যানের পাশে পৌঁছে গেল রানা। দরজা খুলে বসে পড়ল ড্রাইভিং সিটে। পাশের সিটে রাখল বিনকিউলার। ইগনিশনে চাবি মুচড়ে দিতেই চাপা গর্জন ছাড়ল ডিয়েল ইঞ্জিন।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহর থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে যেতে পাড়ি দিতে হবে সুদীর্ঘ পথ। তবে ওখানে যাওয়ার আগে একবারের জন্যে থামবে অন্য এক জায়গায়।