একচল্লিশ
ভিয়েনার আকাশ থেকে কালো মেঘের ভেলাগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে নিরুদ্দেশে চলেছে শীতল দমকা হাওয়া। একটু আগে একটা স্ট্যাণ্ড থেকে দৈনিক পত্রিকা কিনেছে রানা। দুপুর গড়ালেও খিদে নেই। ব্যাঙ্কগ্যাস অ্যাণ্ড লোয়েলস্ট্রাসের কোণে দাঁড়িয়ে দেখল, আকাশছোঁয়া বার্গথিয়েটারের কাছে সিগনাল সবুজ হতেই ওর দিকে আসছে লুদভিগ কেইলমানের মার্সিডিয। গাড়িটা পাশে থামতেই প্যাসেঞ্জার সিটে উঠল রানা। রওনা হয়ে গেল কেইলম্যান।
‘জিনিসটা বোধহয় তোমার,’ বলে তার কোলে পুলিশ আইডি ফেলল রানা।
‘ওরে, শয়তান! খোদ ইবলিশ!’ বিড়বিড় করল লুদভিগ। ‘সকাল থেকে এটা খুঁজতে খুঁজতে প্রায় পাগল হয়ে গেছি!’
ওগুলো পেয়েছ?’ জানতে চাইল রানা।
মাথা দোলাল লুদভিগ। ‘পেছনের সিটে। সবুজ ব্যাগে।’ ঘুরে ব্যাকসিট থেকে ব্যাগ নিতে গিয়ে পেছনের জানালা দিয়ে কালো তিনটে অডি গাড়ি দেখল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আমাদের পিছু নিয়েছে।
‘তুমি সত্যিই সতর্ক মানুষ,’ বলল লুদভিগ। ‘তবে চিন্তার কিছু নেই। ওরা আমার লোক।’
‘ওরা কতটুকু জানে?’
‘খুব সামান্য।’
ছোট ফ্লাইট ব্যাগটা নিয়ে সিধে হয়ে বসল রানা। কোলে রেখে যিপার খুলে দেখল ভেতরে পাঁচটা বাক্স। প্রতিটা দৈর্ঘ্যে ছয়ইঞ্চি, চওড়ায় চার। ওপরে জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা: সেন্টারফায়ার পিস্তল-কার্ট্রিজ, .৪৫ ক্যালিবার।
একটা বাক্স খুলল রানা। লাল প্লাস্টিকের ট্রে-র বুকে আধইঞ্চি বৃত্তাকার গর্তে বসে আছে দশ সারিতে পঞ্চাশটা বুলেট। পাঁচটা বাক্সে সবমিলিয়ে আড়াই শ’। মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘সব আনট্রেইসেবল?’
‘আমাকে বোকা ভাবো নাকি?’ জানতে চাইল লুদভিগ।
কত খরচ হলো? এখনই শোধ করে দিই?’
‘পয়সা লাগবে না। ট্রেনে করে ঘুরে এসে লাভ হলো?’ ব্যাকপ্যাক থেকে খালি প্যারা-অর্ডন্যান্স পিস্তল বের করল রানা। রিলিফ বাটন টিপতেই কোলে পড়ল ম্যাগাযিন। ‘জরুরি কিছু তথ্য পেয়েছি।’
‘কী তথ্য?’
ম্যাগাযিনে গুলি ভরতে ভরতে ফিয়োনা যার্নের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, সেগুলো জানাতে লাগল রানা।
চুপচাপ ড্রাইভ করতে করতে শুনছে লুদভিগ। কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল, ‘কী কারণে ওই বাড়িতে ঢুকতে চাইল অ্যালেক?’
‘ওই কথায় পরে আসছি,’ বলল রানা, ‘একটা সাইবার ক্যাফেতে চাকরি করে ফিয়োনা। ওর সঙ্গে কথা শেষ করে অন-লাইনে সার্চ দিয়েছি। ক্রস-রেফারেন্সের পর জানলাম অনেক কিছুই। তোমার হয়তো মনে আছে, কোবরা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম?’
মৃদু মাথা দোলাল লুদভিগ।
কোবরা কোনও কোড নয়,’ বলল রানা, ‘অনেকেই তাকে ডাকে কাউণ্ট কোবরা বলে।’
‘ওই নাম আগেও শুনেছি।’
‘লুকা ব্রুনার সম্পর্কে কিছু জানো?’
মাথা নাড়াল লুদভিগ। জানে না।
‘সতেরো শ’ অষ্টাশি সাল থেকে সতেরো শত ছিয়ানব্বুই পর্যন্ত লুকা ব্রুনারের পূর্বপুরুষ ডেরেক ব্রুনার ছিল অস্ট্রিয়ার সিক্রেট পুলিশের চিফ। সার্ভিসের জন্যে সম্রাট জোসেফ দ্বিতীয় তাকে জমি ও পদবী দেন। তখন নাম হলো কাউন্ট ডেরেক ব্রুনার। তার রাজকীয় প্রাসাদ ও এস্টেট ছিল ভিয়েনার খুব কাছেই।’
‘ওই বাড়িতেই লোকটাকে খুন করেছে?’
‘হ্যাঁ। পারিবারিক প্রাসাদ। বর্তমানে ওখানে বাস করে অষ্টম কাউণ্ট কোবরা লুকা ব্রুনার। এসব গেল ইতিহাসের কথা। তবে পদবী আর প্রাসাদই শুধু পেয়েছে সে, তা নয়। অন্যান্য অনেক দায়িত্বই বর্তেছে তার ওপর।
‘বলতে থাকো।’ গাল ফুলিয়ে উইওস্ক্রিনের দিকে ফুঁ দিল লুদভিগ।
‘অ্যালেক আবিষ্কার করেছিল অন্যকিছু, সেটা ইতিহাসের বইয়ে নেই,’ বলল রানা, ‘চিঠিতে যে-কোবরার কথা লেখেন মোযার্ট, সেই লোকই ডেরেক ব্রুনার। প্রফেসর ডিয়ানোর কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ওই লোকই ছিল অর্ডার অভ রা-র প্রধান। সম্রাটের হয়ে নোংরা সব খুনের পেছনে ছিল তার ব্যক্তিগত বাহিনী। খুন হয় একের পর এক প্রতিভাবান ম্যাসন। আর ডেরেকের প্রাসাদ ছিল ওই সংস্থার হেডকোয়ার্টার।’
‘তাতে কী?’
‘এখনও টিকে আছে অর্ডার অভ রা, লুদভিগ। ওদেরকে খুঁজে বের করেছিল অ্যালেক।
রানার দিকে তাকাল ডিটেকটিভ সার্জেণ্ট। ‘তা-ই?’
‘মোযার্টের ব্যাপারে রিসার্চ করতে গিয়ে বেশকিছু জরুরি তথ্য জেনে যায় অ্যালেক,’ বলল রানা। ‘তবে জানত না ওই বাড়িতে কী পাবে। হয়তো ভেবেছিল ইতিহাসের গোপন কোনও অধ্যায় আবিষ্কার করবে। বুঝতে পারেনি ঢুকে পড়েছে কালসাপের আস্তানায়। দুর্ভাগ্য, ঠিক তখনই দেখতে পেয়েছে ওই খুন।’
‘তা হলে বোঝা যাচ্ছে, একই রাতে কেন মরল জোসেফ গ্রাফহসলার,’ বলল লুদভিগ।
‘ওই পার্টিতে ভাড়াটে পিয়ানিস্ট ছিল সে,’ বলল রানা। ‘অতিথি লিস্টে ছিল তার নাম। তবে অ্যালেক ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে গ্রাফহসলারের ঠিকানায় পৌঁছে যায় একদল খুনি। তারা যখন বুঝল, জোসেফ আর অ্যালেক একই লোক নয়, তখন নিশ্চয়ই মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ছেলেটার পেট থেকে সব কথা আদায় করেছে। জোসেফ হয়তো ভেবেছিল সব বলে দিলে প্রাণে বাঁচবে।’
ভুরু কুঁচকে ফেলল লুদভিগ। ‘তার মানে সাক্ষী রাখবে না বলে খুন করা হলো বেচারাকে। তারপর খুনির দল গেল অ্যালেকের খোঁজে।
‘তা মনে হয় না,’ বলল রানা। ‘দলে লোকের অভাব নেই তাদের। একদল খুনি যখন জোসেফকে ধরতে গেছে, ওই একইসময়ে অ্যালেকের পিছু নিয়ে তাকে খুন করতে গেছে আরেকদল।
মাথা নাড়ল লুদভিগ। ‘একমিনিট। ওরা জানবে কী করে যে…
‘কোথায় পাবে অ্যালেককে?’ তিক্ত হাসল রানা। ‘জরুরি সব তথ্য জুগিয়ে দিয়েছে পুলিশের কমপিউটার। সরকারের প্রতিটা বিভাগে লোক আছে ওদের। অ্যালেক বিদেশি লোক। কোনও হোটেল বা বোর্ডিং হাউসে উঠতে হলে ওকে দেখাতে হয়েছে পাসপোর্ট। ওই এলাকায় একই নামে অন্য কোনও অ্যালেক বেকার ছিল বলে মনে করি না। খুব সহজেই ওকে পেয়ে যায়।’
চুপ করে আছে লুদভিগ।
‘সিডি তৈরি করে মাত্র বোনের ঠিকানায় পোস্ট করেছে, এমনসময় ধরা পড়েছে অ্যালেক,’ বলল রানা। ‘এরপর লেকের ধারে নিয়ে বলা হয়েছে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে। কিছুটা যাওয়ার পর গুলি করেছে ওর চারপাশে বরফের মেঝেতে। ওর বাঁচার উপায় ছিল না।’ বাক্স থেকে নিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ম্যাগাযিনে আর একটা বুলেট ঠুসে দিল রানা।
‘তো এবার কী করবে?’ জানতে চাইল লুদভিগ।
ম্যাগাযিনে দ্বিতীয় বুলেট ভরল রানা। ‘এখন জানি বাড়িটা কোথায়। সুতরাং ওখানে গিয়ে চুকিয়ে দেব পাওনা।’
ওই বাড়িটা কোথায়?’
‘যা করার আমাকে করতে দাও,’ বলল রানা, ‘পরে পেপারে দেখে নিয়ো।’
‘আমার সাহায্য তোমার লাগবে।’
তৃতীয় বুলেট ম্যাগাযিনে ভরল রানা। ‘লাগবে না। তোমাকে এসবে জড়াতে চাই না।’
‘তুমি কি পাগল হলে? স্রেফ খুন হয়ে যাবে তো!’ জবাব না দিয়ে চতুর্থ বুলেট ম্যাগাযিনে ভরল রানা। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। ইণ্ডিকেটর দিয়ে ব্যস্ত ইন্টারসেকশনে বাঁক নেয়ার আগে রিয়ার ভিউ মিরর দেখল লুদভিগ। ‘বিশ্বাস করলাম তুমি একাই দশজন!’ বিড়বিড় করল। ‘কিন্তু মরতে লাগে মাত্র একটা বুলেট।
চুপ করে থাকল রানা। বাক্স থেকে নিয়ে ম্যাগাযিনে ভরল পঞ্চম বুলেট।
লুদভিগ বাঁক নেবে, এমনসময় লাল ট্রাফিক সিগনালের তোয়াক্কা না করে ঝড়ের বেগে ওদের ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেল গাঢ় হলুদ রঙের বিশাল এক আর্মার্ড ট্রাক। বাজিয়ে চলেছে বিকট হর্ন। রানার একমুহূর্ত পর ওদিকটা দেখল লুদভিগ। দেরি হলো ব্রেক করতে। ষাট মাইল বেগে মার্সিডিযের পেটে গুঁতো মেরে মুহূর্তে গাড়িটাকে দু’টুকরো করল দানবীয় ট্রাক।