ছাব্বিশ
অস্ট্রিয়া।
মাঝ-সকাল।
লোকটা দৈত্যের মত, দৈর্ঘ্যে অন্তত সাড়ে ছয় ফুট। ওজন দু’শ’ আশি পাউণ্ড। অর্থাৎ একশ’ সাতাশ কেজি। মনে হয় সবটুকুই পেশি, একফোঁটা চর্বি নেই শরীরে। দানবটা উলঙ্গ দেহে স্প্রিংবোর্ডে উঠতেই ওজন নিতে গিয়ে বেঁকে গেল ওটা। ক’বার দোল দেয়ার পর সারা শরীরের পেশি শক্ত করল সে, তারপর নিখুঁত ডাইভ দিয়ে পড়ল সুইমিং পুলে।
পানি না ছিটিয়ে বা বাড়তি শব্দ না করেই ছুরির মত গেঁথে গেল সে পানির ভিতর। কয়েক মুহূর্ত পর ভেসে উঠে শুরু করল সাঁতার। ত্রিশবার ফ্রি স্টাইলে এদিক-ওদিক করে উঠে এল সুইমিং পুল থেকে। যে চেয়ারে পোশাক, ওখানে গিয়ে দাঁড়াল। একটানা পনেরো শ’ মিটার সাঁতরেও হাঁফাচ্ছে না একটুও। ইনডোর পুলের জানালা দিয়ে দেখল তুষারে ছাওয়া এস্টেট। বহু দূরে উঁচু দেয়ালের কাছে গিয়ে থেমেছে পাইন গাছের অরণ্য।
ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে দেখল নিজের সুঠাম দেহ। হাতে ও পাঁজরে কয়েকটা গুলি ও ছোরার পুরনো চিহ্ন। প্রতিটা ক্ষত তৈরির সময় ও তারিখ মনে আছে তার। একেক ক্ষতের আছে একেক কাহিনী। অবশ্য ওগুলো যারা তৈরি করেছে, পরের তিন মিনিটে তারা ত্যাগ করেছে এই পৃথিবী।
লোকটার বয়স ত্রিশ। জন্মেছে লণ্ডনে। আগে ছিল ব্রিটিশ আর্মির মেজর। নাম’ মাইক বুচার। কখনও মাতাল হলে গর্ব করে বলে তার আর্মি জীবনের ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। কমাণ্ডো ট্রেইনিঙে পদক পেয়েছে, সেটা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে ডানহাতে উল্কি এঁকে নিয়েছে। কেউ ওটা দেখলে ভয়ঙ্কর হাসি ফোটে বুচারের মুখে।
আর্মিতে অধীনস্থদের সঙ্গে মারপিটে জড়িয়ে যাওয়ায় কঠোর ভাষায় বকা দেন এক ব্রিগেডিয়ার। সেজন্যে তাকে বেধড়ক পেটায় সে। ফলে আর্মি থেকে বের করে দেয়া হয় বুচারকে। এর আগে সাইকোলজিকাল ইভ্যালুয়েশনে জানা গেছে, অত্যন্ত বিপজ্জনক সাইকোপ্যাথ সে। আর্মি থেকে কোর্ট-মার্শাল হওয়ায় কোথাও সিকিউরিটির ভাল কোন চাকরি পায়নি। বাধ্য হয়ে করছিল সাধারণ সব কাজ।
লণ্ডনে একরাতে বারে এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আবারও দেখা হলো তার। সেই লোক চাকরি দিতে চাইল আফ্রিকায় প্যারামিলিটারি অপারেশনে। তাতে হাতে আসবে প্রচুর টাকা। তা ছাড়া, শত্রুর কেউ খুন হলে থাকছে বোনাস। ওঅরলর্ডের চাকরিটা নিতে দেরি করেনি মাইক বুচার। তিন দিন পর যোগ দিল লড়াইয়ে। এরপর আর কখনও পা রাখেনি ব্রিটেনে।
কঙ্গো, রুয়াণ্ডা, লাইবেরিয়ায় ছিল ভাড়াটে খুনি হিসেবে। যোগ দিয়েছে সরকার বিরোধী দলে। পুড়িয়ে দিয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, মহল্লার পর মহল্লা বা গ্রাম। গোটা পরিবারকে খুন করেছে উপদলীয় সংঘাতে। টাকার বিনিময়ে হেন কাজ নেই, যা করেনি।
কঙ্গোতে ছিঁড়ল কানের লতি। গুলিটা এসেছিল একটা একে-৪৭ রাইফেল থেকে। ওটার মালিক ছিল এগারো বছরের কৃষ্ণাঙ্গিনী বাচ্চা এক মেয়ে। রাইফেলের ম্যাগাযিনে শেষ গুলি ছিল ওটা। মেয়েটা যখন দেখল কান চেপে ধরে চিৎকার করে গালি দিচ্ছে বুচার, ভীষণ ভয়ে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল।
কিন্তু ধাওয়া করে ওকে ধরল বুচার। ঝোপে টেনে নিয়ে মেয়েটার বুকে রাখল ডানহাঁটু। বামহাতে বাচ্চাটার দু’হাত চেপে ধরল মাথার পেছনে। অন্যহাতে বের করল বেয়োনেট। এরপর ধীরে ধীরে ছোরা গাঁথল, ওর রুগ্ন বুকে। অন্তত পাঁচ মিনিট ধরে হত্যাকাণ্ডটা ঘটায় সে।
ওই কথা ভাবলে আজও পুলকিত হয়ে ওঠে বুচার। ঠিক করেছে, আবার সুযোগ পেলে সেইভাবে খুন করবে কাউকে 1
অবশ্য এরপর মৃত্যু-ঝুঁকি কমাতে আফ্রিকায় চোৱাই অস্ত্রের ব্যবসা ধরল সে। কিছু দিনের ভেতর বুঝল, যুদ্ধে না গিয়েও মেলে চোরাই সোনা, হীরা ও নগদ টাকা। ভাল রোজগার হচ্ছিল মাইক বুচারের। কিন্তু কেপ টাউনে পরিচয় হলো অস্ট্রিয়ান এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। ওই লোক চাইল, সে যেন কাজ করে তার হয়ে। বদলে বুচার পাবে মোটা অঙ্কের বেতন। অঙ্কটা এতই মোটা যে না-বলতে পারেনি ও।
গত ক’বছর এমন সুযোগের কথাই ভেবেছে বুচার। ঊনত্রিশ বছর বয়সে যোগ দিল ব্রুনারের পার্সোনাল সেক্রেটারি ও জেনারেল এইড হিসেবে। গত একবছর বিলিয়নেয়ারের চাকরি করে বুঝেছে, তার মনিব সাধারণ কোন ব্যবসায়ী নয়। চোরাই অস্ত্রের ব্যবসায় যা পেত তার চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি বেতন পাচ্ছে সে। কাজেই জানতেও চায়নি, লুকা ব্রুনারের পারিবারিক ব্যবসা কী ধরনের। চাকরিতে যোগ দেয়ার পর জেনেছে, সামান্যতম বেইমানি করলে কাউকে মাফ করে না বিলিয়নেয়ার। ছোটখাটো মানুষটাকে দেখলে মনে হবে কারও সাতেপাঁচে নেই, বড়জোর বয়স্ক এক স্কুল-মাস্টার… ছাত্র পেটায়। তবে বুচার জানে, জীবনে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক যেসব লোক দেখেছে, তাদের চেয়েও নির্মম, নিষ্ঠুর ও ঠাণ্ডা মাথার খুনি এই লুকা ব্রুনার।
মনের আয়নায় বুড়ো ব্যবসায়ীর কুঁচকে যাওয়া ধূসর মুখ দেখল বুচার। আনমনে ভাবল, একদিন খুন করব শুয়োরের বাচ্চাটাকে। আর সেদিন… মনের সুখে যা-খুশি-তাই করব হারামজাদার সুন্দরী রক্ষিতাটার সঙ্গে।
সাদা শার্ট ও ধূসর প্যান্ট পরে গায়ে ব্লেযার চাপিয়ে নিল বুচার। নিজের অফিসে ফিরে ডেস্কে পেল ফ্যাক্স মেশিনের একটা পাতা। ওটা এসেছে লণ্ডন থেকে।
মন দিয়ে কাগজটা পড়ল সে। বুঝে গেল, গোটা ব্যাপারটা ক্রমেই হয়ে উঠছে জটিল।
.
রক্ষণশীলভাবে সাজানো ব্রেকফাস্ট রুমে ক্রিস্টা গুন্থারের সঙ্গে নাস্তায় বসেছে বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রুনার। নীরবে খাচ্ছে সে। জানালার দিকে পিঠ। বাইরে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা লেকের ওদিকে তুষারে ছাওয়া সাদা পাহাড়। গত তিনবছর ধরে রোজ একই নাস্তা খেয়ে চলেছে সে। দুটো ডিম পোচ, পাউরুটির দুই স্লাইস টোস্ট ও প্লেটের পাশে এক গ্লাস কমলার জুস। গত তিনবছরে একবারও লোকটাকে মাখন নিতে দেখেনি ক্রিস্টা। পিঁপড়ার গতি তুলে খাবার শেষ করে খুনিটা।
একটা ফোল্ডার হাতে ঘরে ঢুকল মাইক বুচার।
একইসময়ে থেমে গেল ব্রুনারের হাতের কাঁটাচামচ ও চোয়াল। ন্যাপকিন দিয়ে মুছল দু’ঠোঁট। কঠোর দৃষ্টিতে দেখছে সহকারীকে। ক’মুহূর্ত পর বরফের মত শীতল কণ্ঠে বলল, ‘আগেও বলেছি নাস্তার সময় আসবে না।’ নাক কুঁচকে গেল। ‘ছিহ্, বুচার, আবারও চিউইং গাম চিবুতে শুরু করেছ?’
মনে মনে হাসল মাইক বুচার। মুখ থেকে আঠার মত জিনিসটা বের করে ফেলল ওয়েইস্ট পেপার বাস্কেটে। সুযোগ পেলে বুড়ো ব্যবসায়ীকে বিরক্ত করে বিকৃত আনন্দ পায় সে। ‘সরি, স্যর। মনে হলো, এটা দেখতে চাইবেন। একটু আগে এসেছে।’ ফাইল খুলে কাগজটা লুকা ব্রুনারের হাতে দিল সে।
কোটের পকেট থেকে দামি একটা বাইফোকাল চশমা নিয়ে নাকের ডগায় বসাল বিলিয়নেয়ার। কাগজটা লণ্ডন টাইমসের গত সন্ধ্যার সংস্করণের কপি। এমিলিয়া বেকারের চকচকে ছবি। ওকে ঘিরে রেখেছে একদল ভক্ত। অক্সফোর্ডের দৃশ্যপট দেখে ব্রুনার বুঝল, কোথা থেকে তোলা হয়েছে ছবি। মেয়েটার পেছনে শেলডোনিয়ান থিয়েটার। গায়িকার বামে সুঠামদেহী এক যুবক। তাকে আগে কখনও দেখেনি ব্রুনার। পরস্পরের হাত ধরে আছে এমিলিয়া বেকার ও যুবক। হেডলাইনে লেখা: ‘ইনিই কি জনপ্রিয় গায়িকা এমিলিয়ার নতুন প্রেম?’
কাগজটা রেখে চশমার ওপর দিয়ে বুচারের দিকে তাকাল ব্রুনার। ‘এই লোকই আমাদের দক্ষ কয়েকজনকে খুন করেছে? …কী দিয়ে যেন….’
‘ভারী ফ্রাইং প্যান, স্যর,’ বলল বুচার।
ছবির যুবকের দিকে তাকাল ক্রিস্টা। ওর মনে হলো, ওই লোক দুর্দান্ত সুপুরুষ। এবং অ্যাথলেটিক।
কাছ থেকে ক্রিস্টাকে দেখছে বুচার। মনে মনে বলল, বুড়ো হাবড়াটাকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে তুই হয়তো পালিয়ে যাবি ওই শালার সঙ্গে! খুক-খুক করে গলা পরিষ্কার করল সে। ‘আমি জানি ওই লোক কে, স্যর।’
‘পেশাদার বডিগার্ড?’ জানতে চাইল ব্রুনার।
‘তার চেয়েও বিপজ্জনক। আমি আরও খোঁজ নেব। তাতে লাগবে দু’চার দিন। তবে ভুল না হলে আমি যার কথা ভাবছি এ সেই একই লোক।’
হাতের ইশারায় তাকে বিদায় জানিয়ে ডিমের দিকে মন দিল লুকা ব্রুনার। তবে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে পোচ ডিম। বিরক্ত হয়ে সামনের দিকে প্লেট ঠেলে উঠে পড়ল সে।
.
নাস্তার পর নিজের ঘরের দিকে চলেছে ক্রিস্টা গুন্থার। একটা বাঁক নিতেই করিডোরে দেখল মাইক বুচারকে। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর রুমের দরজার পাশে। বামহাত কপাটের ওপর।
দরজার কাছে পৌঁছে শীতল স্বরে বলল ক্রিস্টা, ‘তুমি কি ভাবছ ঘরে আমাকে ঢুকতে দেবে না?’
আন্তরিক হাসল বুচার। সুন্দরী মেয়েটার পা থেকে মাথা তক দেখে নিল। তাকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুলতে চাইল ক্রিস্টা। তবে খপ্ করে ওর কবজি ধরল শক্তিশালী দানব।
একটানে ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে।
‘আমার গা থেকে হাত সরাও,’ সতর্ক করে দেয়ার সুরে বলল ক্রিস্টা।
পাত্তা না দিয়ে ক্রিস্টাকে কাছে টানল বুচার। ব্লাউজের ওপর দিয়ে বামহাতে ধরল ওর বুক। ‘দারুণ জিনিস তো!’
ছিটকে পিছিয়ে তার গালে কষে একটা চড় দিল ক্রিস্টা। কর্কশ ত্বকে লেগে জ্বলছে হাতের নরম তালু।
হাসি বিস্তৃত হলো বুচারের। নিচু গলায় বলল, ‘মন দিয়ে তোমাকে দেখছিলাম। তাই জেনে গেছি, ওই লোকের কাছ থেকে কী চাও তুমি।’
‘কিছুই চাই না। তুমি ভুল ভাবছ।’
মেয়েরা পতিতা হলে জীবন আর গুছিয়ে নিতে পারে না কোনদিনই। তুমি আসলে ওই বুড়ো ভাম অকর্মা শালার নরম রাবারের বদলে শক্ত কিছু খুঁজছ।
‘একদম বাজে কথা বলবে না!’
‘আমারই তো ভাল একটা আছে।’
‘বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু ব্রুনারকে জানিয়ে দেব।’ এককান থেকে অন্যকানে গেল বুচারের হাসি। ‘সেদিন দূরে নয়, আমার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্ষমা চাইবি, হারামি কুত্তী মাগী!’