পঁচিশ
র্যাভেনা শহরের প্রান্তে রানা ও লিয়ার হোটেল।
সকালে ঘুম ভাঙতেই লিয়া দেখল, কার সঙ্গে যেন নিচু গলায় ফোনে কথা বলছে রানা। ওর জানা নেই, এটা সপ্তম কল। স্থানীয় ফোন ডিরেক্টরিতে প্রফেসর ডিয়ানোর নাম ও ফোন নম্বর নেই। তাই এক এক করে ডিয়ানোদেরকে কল করছে রানা। তালিকার মাঝে পৌঁছে ভাবল, এভাবে সময় নষ্ট না করে সোজা যাবে প্রফেসর যে মিউযিক ইন্সটিটিউটে চাকরি করেন, সেখানে।
হোটেলে নাস্তা সেরে সিট্রোন গাড়িতে চেপে র্যাভেনা শহরের মাঝে পৌঁছল ওরা। পার্কিং লটে গাড়ি রেখে কোবল পাথরে বাঁধাই করা গলি ধরে হেঁটে চলল। শহরে এখন চলছে অফ সিযন। ঝিমিয়ে আছে চারপাশ।
সেইণ্ট ভিটালের চার্চ পাশ কাটিয়ে পৌঁছুল ইসটিটিউটো মনটেভারডির কাছে। সরু ওই দালানের সামনে সাদা পাথরের একের পর এক কলাম আর বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি। কাঁচের দরজা পেরোলেই রিসেপশন ফয়ে। মার্বেলের মেঝেতে ওদের পদশব্দ ছাতে গিয়ে বাড়ি খেয়ে তৈরি করছে প্রতিধ্বনি। ওপরতলায় চেলো বাজাচ্ছে কেউ। আরেক ঘর থেকে আসছে পিয়ানোর সঙ্গে কোন মহিলার তারস্বরে সরগম। নানান বাদ্যযন্ত্রের শব্দে পাথরের তৈরি পুরনো বাড়িটা হয়ে উঠেছে মাছের বাজারের মতই সরগরম।
ডেস্কের সামনে গিয়ে থামল রানা ও লিয়া।
কালো পোশাকে পাথুরে চেহারার এক মহিলা বসে আছে রিসেপশন ডেস্ক সামনে নিয়ে। ভুরু কুঁচকে ওদেরকে দেখল সে। ভারী গলায় জানতে চাইল, ‘কী সাহায্য করতে পারি?’
‘আমরা প্রফেসর ডিয়ানোকে খুঁজছি,’ ইতালিয়ান ভাষায় বলল রানা।
তাতে মাথা নাড়ল মহিলা। ‘প্রফেসোরে ডিয়ানো আর শিক্ষকতা করেন না। ক’বছর আগেই অবসর নিয়েছেন।’
‘তাঁর ফোন নম্বর পেতে পারি?’ জানতে চাইল রানা। আগেই জানে, মানা করে দেয়া হবে ওকে।
‘না, আমরা কারও ফোন নম্বর দিই না।’
‘আপনার কথা বুঝেছি, তবে বিষয়টা খুব জরুরি। আর আমরা এসেছি বহু দূর থেকে।’
ভীষণ গম্ভীর হয়ে বুকে দু’হাত ভাঁজ করল মহিলা। ‘দুঃখিত। আমি কোনও সাহায্য করতে পারছি না।’
মানিব্যাগের দিকে হাত বাড়াল রানা। দ্বিতীয় চেষ্টার সময় দুর্গম পথ প্রায়ই সুগম করে দেয় এর ভেতরের জিনিস। তবে ডাইনীর মত এই ভয়ঙ্কর মহিলা টাকায় পটবে কি না, তা নিয়ে মনে গভীর সন্দেহ আছে রানার। ওর পাশ থেকে মৃদুকণ্ঠে ইংরেজিতে বলে উঠল লিয়া, ‘ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দাও।’
কঠিন চেহারায় ওদেরকে দেখছে মহিলা।
তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিল লিয়া। নিখুঁত ইতালিয়ান ভাষায় বলল, ‘সিনোরা, আপনার ডিরেক্টরকে একটু ইন্টারকম করুন।’
এ কথা শুনে চমকে গেল মহিলা। ‘তা কেন করব?’
আবারও হাসল লিয়া। ‘তাঁকে বলবেন, জরুরি একটা কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এমিলিয়া বেকার।’
এমিলিয়া বেকার নামটা জাদুর মত কাজ করল মহিলার পাষাণ হৃদয়ে।
তামাক চিবানো খয়েরি দাঁতের বিশাল এক হাসি দিল মহিলা। বিখ্যাত সোপরানোকে চিনতে পারেনি বলে পাঁচবার ক্ষমা চাইল। পথ দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে নিয়ে উঠে এল দোতলায়।
বিরক্ত চোখে লিয়াকে দেখছে রানা।
‘কী হলো?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল লিয়া।
‘তোমাকে না বলেছি কাউকে পরিচয় জানাবে না।’
‘এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল?’
‘অন্য পথ খুঁজে নিতাম।’
‘পিস্তল ধরতে মহিলার মাথায়?’
‘বুদ্ধিটা খারাপ দাওনি,’ বিড়বিড় করল রানা।
কালো এক দরজার সামনে থেমে তিনটে টোকা দিল রিসেপশনিস্ট, তারপর কপাট ফাঁক করে ভেতরে ভরে দিল মাথা। ঝড়ের বেগে কী যেন বলল ইতালিয়ান ভাষায়। দুই একটা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বুঝল না রানা। ঘর থেকে এল গম্ভীর কণ্ঠস্বর: ‘লা বেকার? কুই?’
পাঁচ সেকেণ্ড পর রিসেপশনিস্টকে ডজ দিয়ে ১৯৮২-র ওয়ার্ল্ড-কাপ হিরো পাওলো রসির মত অফিস থেকে ছিটকে বেরোলেন বেঁটে এক ঝাড়ুর কাঠি। পরনে ১২ গেজ দোনলা বন্দুকের নলের মত সরু প্যান্ট আর কাকের পালকের মত কালো কোট। লিয়ার হাত ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকাতে লাগলেন তিনি। তারই ফাঁকে বললেন, এক্ষুণি কফি-কেক-বিস্কুট আনো। চোখ সরাতে পারছেন না লিয়ার ওপর থেকে। নাক কুঁচকে ভয়ানক বিদঘুটে হাসি দিলেন। ‘আমি লুই ইভানি। এটা যে কতবড় সম্মান, মেইস্ত্রা, কিছুতেই বুঝিয়ে বলতে পারব না। বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি?’
অফিসে নিয়ে রানা ও লিয়াকে বসালেন ঝাড়ুর কাঠি। লিয়া জানাল, জরুরি কাজে দেখা করতে চায় প্রফেসর ডিয়ানোর সঙ্গে। তাঁর টেলিফোন নম্বরটা দিলেই চলবে।
অনিশ্চিত হয়ে গেলেন ইভানি। দাঁতের ফাঁক দিয়ে শ্বাস ফেলছেন।
‘উনি মারা যাননি তো?’ জানতে চাইল লিয়া।
‘না, না, মরেননি!’ বললেন ডিরেক্টর। ‘মরবেন কেন? নিজের গ্রামের বাড়িতেই আছেন। এখান থেকে মাইল দশেক দূরে। খুশি মনেই আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেব। তবে একটু সাবধান হতে হবে।’ কী যেন ভাবলেন ডিরেক্টর। ‘লিয়োনার্দো ডিয়ানো মানুষ হিসেবে খুবই ভাল। তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন সেরা মোযার্টিয়ান স্কলার। কিন্তু বয়স হয়েছে তো, তাই… ইয়ে… একটু যেন পাগলামিতে পেয়ে বসেছে তাঁকে।’
‘কী ধরনের পাগলামি?’ জানতে চাইল রানা।
কাঁধ ঝাঁকালেন ডিরেক্টর। ‘মাথায় একবার কিছু ঢুকলে সেটা আর মগজ থেকে বেরোতে চায় না। তাই ক্রমেই হয়ে উঠলেন খ্যাপাটে। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বিরোধ হতো। একসময়ে হয়ে গেলেন ইসটিটিউটো-র জন্যে বড় ধরনের বোঝা। তাঁকে নিয়ে হাসিতামাশা করত সবাই। একবার চেতিয়ে দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আবোলতাবোল বকতেন।’ দুঃখের হাসি দিলেন ডিরেক্টর। তাই নিজে যখন অবসরে যেতে চাইলেন, আমরা এককথায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।’
‘কী বিষয়ে বলতেন তিনি?’ জানতে চাইল রানা। মাথা নাড়লেন ইভানি। ‘কথা বললেই বুঝবেন।’