চোদ্দ
ভয়ানক দৃশ্যটা দেখার অনেকক্ষণ পর অবশেষে শান্ত হয়েছে লিয়া। যদিও সেজন্যে ওকে দিতে হয়েছে কড়া ঘুমের ওষুধ। এখন হোটেল কক্ষে অকাতরে ঘুমাচ্ছে বেচারি। বালিশে বিছিয়ে আছে মেঘের মত একরাশ কালো চুল। ধীরে ধীরে উঠছে-নামছে বুক ও পেট।
লিয়ার গা কম্বল দিয়ে ঢেকে বিছানার ধারে বসে থাকল রানা, চিন্তিত। বহুক্ষণ পর আবারও গিয়ে বসল ল্যাপটপের সামনে। প্রথম থেকে দেখল গোটা ভিডিয়ো ক্লিপ।
পরের দু’বার দেখার সময় নানান জায়গায় থেমে বুঝে নিল জরুরি কিছু দিক। পরিষ্কার টের পেল, বন্দি খুন হলে কী সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়েছে অ্যালেক। সেজন্যেই খুব কেঁপেছে ছবি। আগের চেয়েও বেশি হাঁফিয়ে উঠেছে বেচারা। তারপর ছুটে পালিয়ে গেছে মন্দির ছেড়ে।
আবারও ভিডিয়ো স্থির করে দেখল রানা। ক্যামেরা দেখাচ্ছে পাথুরে দেয়াল। ওটা কোনও স্টেয়ারকেস। গোটা ভিডিয়ো ক্লিপ অদ্ভুত লাগছে ওর। জায়গায় জায়গায় থামিয়ে খেয়াল করছে নানান কিছু। অ্যালেক ছুট দিতেই পেছনে পড়ল রুক্ষ পাথুরে দেয়াল। ডোরওয়ে পেরোলে শুরু হলো বিলাসবহুল, অভিজাত বাড়ির দামি কাঠের চকচকে প্যানেলিং করা করিডোর। ছাতের আলোয় ঝিকঝিক করছে একটা পেইণ্টিং। ভিডিয়ো পয করে কাছ থেকে চিত্রটা দেখল রানা।
পেইন্টিংটা কোনও সমাবেশের। লোকগুলো বসেছে এক বিশাল হলঘরে। এই ঘর সেই ঘরের মতই, যেখানে খুন হয়েছে বন্দি। মেঝেতে একই টাইল্স্। লোকগুলোর মাথায় পরচুলা। পরনে আঠারো শত শতাব্দীর পোশাক—ব্রোকেড জ্যাকেট ও সিল্কের মোজা। দেয়ালে দেয়ালে অচেনা সিম্বল তবে বোঝা গেল না ওগুলো কীসের।
ভিডিয়ো ক্লিপ আবারও দেখতে লাগল রানা। শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে অ্যালেক। টলতে টলতে ছুটে চলেছে করিডোর ধরে। কেউ পিছু নিয়েছে কি না বুঝতে একবার ঘুরে তাকাল।
ভিডিয়োতে দেয়ালের একটা অ্যালকোভ দেখল রানা। ওখানে অস্বাভাবিক কিছু। ওটা মিশরীয় বলেই মনে হলো। কোনও ফারাওয়ের মূর্তির মুখে মৃত্যু-মুখোশ।
এরপর হঠাৎ করেই শেষ হলো ভিডিয়ো ক্লিপ। ক্যামেরা অফ করেছে অ্যালেক।
কালো স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইল রানা। যা দেখেছে, তার অর্থ আসলে কী, বুঝতে চাইছে। ফাইলের প্রপার্টিতে ক্লিক দিল। ভিডিয়ো ক্লিপটা তৈরি হয়েছে অ্যালেকের মৃত্যুর রাতেই নয়টা সাতাশ মিনিটে।
ভিডিয়োটা রহস্যজনক। পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, সুন্দরী এক মহিলাকে পটিয়ে নিয়ে তার সঙ্গে পার্টি ত্যাগ করেছিল মাতাল অ্যালেক। এরপর বরফে ছাওয়া লেকে স্কেট করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় ওর। অথচ এ ভিডিয়ো অনুযায়ী মৃত্যুর আগে পৈশাচিকভাবে একজন লোককে খুন হতে দেখেছে অ্যালেক। তা হলে কি এতবড় পশু হয়ে গিয়েছিল, পাশবিক হত্যাকাণ্ড দেখার পরেও লেকের তীরে গেছে মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে? এসব একেবারেই মিলছে না অ্যালেকের স্বভাবের সঙ্গে!
মনে মনে হিসাব কষছে রানা।
সুসংগঠিত কোনও দলের হাতে অসহায় এক লোককে খুন হতে দেখেছে অ্যালেক। তারা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, ধনী ও বিপজ্জনক। হাতে প্রমাণ এলেও পুলিশের কাছে না গিয়ে ভিডিয়ো গোপন করেছে অ্যালেক। প্রথম সুযোগে সিডি পাঠিয়ে দিয়েছে বোনের কাছে। এরপর মৃত্যু হয়েছে ওর বরফের মেঝে ভেঙে লেকে পড়ে। খুব তাড়াহুড়োয় শেষ করা হয়েছে তদন্ত। অথচ, এমন হওয়ার কথা নয়। আর তারপর লিয়া যখন টিভিতে দর্শকদের জানাল, অ্যালেকের সংগ্রহ করা ডেটা ওর কাছে আছে, তখন থেকেই কারা যেন চাইছে ওকে কিডন্যাপ করতে।
ঘুমন্ত লিয়ার মুখ থেকে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিতে মন চাইল রানার। চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরোল ওর বুক চিরে। অ্যালেকের মৃত্যুর ধকল মাত্র সামলে নিয়েছে, এমনসময় আবার ওই একই বিষয়ে জড়িয়ে গেছে লিয়া। আরও খারাপ দিক হচ্ছে বেচারি এখন জানে, দুর্ঘটনা ছিল না সেটা, খুন হয়েছে ওর ভাই। মাতাল হয়ে ফুর্তি করতে গিয়ে নয়, তার মৃত্যু হয়েছে ভীষণ আতঙ্কের ভেতর। কেউ বা কোনও দল ঠাণ্ডা মাথায় শেষ করে দিয়েছে তাকে।
কিন্তু কাজটা কাদের? – আনমনে ভাবল রানা।
ঘরের কোণে গিয়ে বসল আর্মচেয়ারে। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে দেহ! গত দেড় সপ্তাহে প্রতিদিন ঘুমাতে পেরেছে বড়জোর এক বা দুই ঘণ্টা।
চোখ বুজে বসে থাকল রানা। মাথায় এল পুরনো সব স্মৃতি। কানে যেন শুনতে পেল অ্যালেকের ভরাট হাসির আওয়াজ। তখনই মনে পড়ল বিশেষ একটি দিনের কথা। সেদিন অ্যালেক না বাঁচালে নিশ্চিতভাবেই মারা পড়ত ও।
.
আগে ইউরোপে এমন শীত দেখেনি রানা। ও ছিল ওয়েস্- এর সীমান্তে। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়েছিল বিশ্বের সেরা কমাণ্ডো ট্রেইনিঙে। প্রতিযোগিতা করতে হবে বেশকিছু দেশের সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের সঙ্গে। তাদের ভেতর ছিল ২২ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস ফোর্সের যোদ্ধারাও। ওরাই ব্রিটিশ আর্মির সেরা ও অভিজাত ফাইটিং ফোর্স।
রানা আজও ভাবে, ওই ট্রেইনিঙে কেন গিয়েছিল অ্যালেক? কৌতুক করে বলত, আমি এসেছি ট্রেইনিঙের নামে গরুর কাবাব আর ভেড়ার মাংসের চপ খেতে, নইলে নরকের মত এই সিকেনার ওয়ান এলাকায় আসি?
প্রথম ভোরে হেরিফোর্ড ত্যাগ করে ওদের কনভয় গিয়ে ঢুকল মধ্য ওয়েল্স-এর ক্যাব্রিয়ান পর্বতমালার ভেতর। ঝরঝর করে পড়ছে তুষার। সারাদিন কীসের মাঝ দিয়ে যেতে হবে বুঝতে পেরে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল প্রায় সবার। তবে তাদের মধ্যে একমাত্র মানুষ অ্যালেক, যে কি না হাসিমুখে মস্করা করছিল। রাইফেল হাতে দোদুল্যমান, চলন্ত বেডফোর্ড ট্রাকের কোণে বসে ভাবছিল রানা, আগামী কয়েক সপ্তাহ প্রচণ্ড দৈহিক ও মানসিক চাপ যাবে ওর ওপর দিয়ে। এই যে দল বেঁধে চলেছে, কয়েক দিনের ভেতরেই ঝরে যাবে এদের বেশিরভাগ অফিসার ও সৈনিক। যারা রয়ে যাবে, তাদেরকে দেয়া হবে চোদ্দ সপ্তাহের কঠোরতম ট্রেইনিং। তার ভেতর থাকবে অ্যাডভান্সড্ ওয়েপন অ্যাণ্ড সার্ভাইভাল ইন্সট্রাকশন, প্যারাশুট কোর্স, ল্যাংগুয়েজ ইনিশিয়েটিভ টেস্টিং, জাঙ্গল-ওঅরফেয়ার ট্রেইনিং, সমস্ত ওজন বহন করে একহাজার গজ সাঁতার প্রশিক্ষণ ও ইন্টারোগেশন-রেফিস্ট্যান্স এক্সারসাইয। এসব করতে গিয়ে যে-কোনও সময়ে প্ৰাণ যাবে যে-কারও। ট্রেইনিঙের এক পর্যায়ে টিকে থাকবে মাত্র কয়েকজন। তারা পাবে অত্যন্ত সম্মানসূচক কোভেটেড উইংড ড্যাগার ব্যাজ। ব্রিটিশ ফোর্স থেকে যারা এসেছে, তারা চাইলে যোগ দিতে পারবে কিংবদন্তির রেজিমেন্ট ২২ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস ফোর্সে। কোনও কোনও বছর গোটা ব্রিটেন থেকে একজন অফিসার বা সৈনিকও পাশ করে না এই ট্রেইনিঙে। এবার অবশ্য সব শেষে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে রেজিমেন্ট ২২ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস ফোর্সের হবে একটি প্রতিযোগিতা। প্রথম তিনজনকে দেয়া হবে বিশেষ সম্মাননা।
সিকেনার ওয়ানের ট্রেইনিং ছিল ভীষণ কঠিন। বরফের মত ঠাণ্ডা ভোরে আবারও মন শক্ত করত একদল ক্লান্ত মানুষ সেদিনের নির্যাতনের জন্যে। প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ত পরিশ্রমের মাত্রা। প্রতি রাতে টুপটাপ করে তুষার ঝরত ক্যাম্পের ক্যানভাসের ওপর, আর গোল হয়ে নীরবে বসে থাকত ওরা। রাতে দারুণ খাবার দেবে, শীঘ্রি সে-আশা বিদায় নিল অ্যালেকের মন থেকে। হতাশ হয়ে পড়ল ও। ট্রেইনিংটা মন ভেঙে দেয়ার মতই।
গোটা সপ্তাহ ধরে ওদের ওপর দিয়ে চলল স্টিম রোলার। এমন কী রানাও তৈরি ছিল না এত সব সহ্য করতে। ওই এলাকায় বছরের সবচেয়ে খারাপ পরিবেশ হয় এ সময়ে। দেহে নানান ব্যথা ও ক্ষত নিয়ে এক শ’ আটত্রিশজনের ভেতর টিকে থাকল শেষপর্যন্ত বারোজন। শোঁ-শোঁ আওয়াজ তোলা তুষার ঝড়ের ভেতর দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা মার্চ করল ওরা। ওই কোর্সের জন্যে ভলান্টিয়ার হয়েছিল এক এসএএস মেজর, বয়স তেত্রিশ। গন্তব্যে পৌঁছুবার পর জানা গেল হারিয়ে গেছে সে। পরে তুষারের মাঠে পাওয়া গেল তার লাশ।
কীভাবে যেন যন্ত্রণা বা কষ্ট সহ্য করার শক্তি বেড়ে গেল রানার। বুঝে গেল আরও দুর্ভোগ সহ্য করেও টিকে থাকতে পারবে ও। মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নেয়ার জন্যে চুলো জ্বেলে গলিয়ে নিত তুষার। সেসময়ে ব্যাকপ্যাক থেকে নিয়ে কামড় দিত পাথরের মত শক্ত মার্স বারে। ওটার চিনি দিত একরাশ শক্তি। আবারও হেঁটে চলত রানা। বারবার মনে হতো, বাদ দিই এবার, আর তো পারি না। কিন্তু চিন্তাটা মনে এলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সবুজের বুকে লাল এক জ্বলজ্বলে সূর্য। বিড়বিড় করে বলত, ‘না, তোকে পারতে হবে। প্রথম হতেই হবে তোকে। তুই হারবি না! তোকে প্রমাণ করতেই হবে, তুই বাংলাদেশের সুযোগ্য সন্তানদের একজন!’
এই ট্রেইনিং দুর্ধর্ষ যোদ্ধার মন ভেঙে দেয়ার জন্যে তৈরি। এরপরেও কেউ পাশ করলে, সে হবে সবচেয়ে কঠোরভাবে প্রশিক্ষিত কমাণ্ডো। বিশ্বে রয়েছে সে ধরনের মাত্র কয়েক শ’জন যোদ্ধা। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল একেকটা করে পরীক্ষা।
আরও কঠিন হলো প্রশিক্ষণ। রাতে অতি ক্লান্তিতে ভেঙে আসত সবার শরীর। ক্যাম্পে ফিরে মোজায় জলপাইয়ের তেল মাখত ওরা, যাতে পরদিন পায়ের ফোস্কা নরম থাকে। প্রশিক্ষণের সময় অদ্ভুত ঘোরের ভেতর দিয়ে পেরোত প্রতিটা দিন। আগের চেয়ে দীর্ঘ যাত্রায় হেঁটে যেত ওরা। ক্রমেই বাড়ত প্যাকের ওজন। মন শক্ত করে এক পা এক পা করে গন্তব্যের দিকে এগোত ওরা। দূরে কোনও জায়গা টার্গেট করত রানা, তারপর ওখানে পৌঁছুলে খুঁজে নিত পরের টার্গেট। তাতে যেন বাড়ত দৈহিক যন্ত্রণা।
তৃতীয় সপ্তাহের চতুর্থ দিন টিকল ওরা মাত্র আটজন। পেন ওয়াই ফ্যান পর্বতের চূড়ার কাছে উঁচু এক জমিতে পৌঁছুল রানা। ঘুরে দেখল, দূরে সাদা তুষারের চাদরের বুক চিরে জঙ্গল ভেদ করে আসছে সবুজ ফোঁটার মত কিছু বিন্দু। ওর তিরিশ গজ পেছনে অ্যালেক।
বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করল রানা। তবে পৌঁছুতে বহুক্ষণ নিল অ্যালেক। রানা বুঝল, শরীরের শেষ শক্তি খরচ করে এ পর্যন্ত এসেছে বেচারা। একেক পা এগোতে গিয়ে টলমল করছে ভরপেট মহুয়া ফুল খাওয়া মাতাল ভালুকের মত। তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। হাঁটু গেড়ে বসল তুষারের ভেতর। রাইফেল ধরে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘এগোও! আমি শেষ! যদি বাঁচি, ক্যাম্পে দেখা হবে!’
চিন্তায় পড়ে বন্ধুকে দেখল রানা। ‘চলো, আমি তোমাকে ধরে নিয়ে এগোই। আর মাত্র কয়েক মাইল।’
‘উপায় নেই, রানা। আর এক পা-ও হাঁটতে পারব না।’
‘তো বিশ্রাম নাও। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। পরে একসঙ্গে যাব,’ জানাল রানা।
চোখ থেকে তুষারকণা সরিয়ে ওকে দেখল অ্যালেক। বিশ্রীভাবে কেশে উঠল। ‘না। তুমি এগোও। আমাকে ডুবিয়ে দিয়ো না। গর্ব করে লিয়াকে বলে ফেলেছি, তুমি এই ট্রেইনিঙে ফার্স্ট হবে।’
দু’পায়ের তালু ছিলে গেছে রানার। ভারী ব্যাকপ্যাকের ওজনে স্ট্র্যাপের রুক্ষ ফিতা চেপে বসেছে পিঠে। মেরুদণ্ড বেয়ে দরদর করে নামছে উষ্ণ রক্ত। হতাশ রানা বুঝল, অ্যালেকের ওজন বয়ে এগোতে পারবে না। নিজের ওজন বহন করাই প্রায় অসম্ভব। বড় মুখ করে ওর ব্যাপারে লিয়াকে বহু কিছু বলে ফেলেছে অ্যালেক। এখন যদি রানা হেরে যায়, মাথা হেঁট হবে বন্ধুর। নিজেও ছোট হবে রানা। মনের চোখে দেখল লিয়ার মিষ্টি মুখ। শুকনো গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, পাহাড়ে ইন্সট্রাক্টর আছেন। তিনি তোমাকে ফেরত নিয়ে যাবেন ক্যাম্পে’
হাত নাড়ল অ্যালেক। ‘রওনা হও। আমি ঠিক আছি। যেতে দেরি হলে বাদ পড়বে ট্রেইনিং থেকে। আমাকে ডুবিয়ে দিয়ো না, রানা!’
অপরাধবোধ ও সারা শরীরের ব্যথা নিয়ে আবারও রওনা হলো রানা। সামনে থেকে হাওয়ায় ভর দিয়ে হু-হু করে এল তুষারকণা। প্রায় খাড়া পাথুরে ঢাল বেয়ে নামার সময় পিছলে গেল বুট। কুয়াশাচ্ছন্ন পাথরের বড় এক স্তূপের কাছে নড়াচড়া দেখল রানা। পাইন গাছের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল হুড পরা এক ছায়ামূর্তি।
ওই অফিসারের চেহারা মনে পড়ল রানার। এ-ও একজন মেজর। এসেছে রয়েল ফিউসিলিয়ার গ্রুপ থেকে। আজ ক্যাম্পে তাকে দেখেনি রানা। প্রথম থেকেই দলের অন্যদের থেকে দূরে সরে থাকে সে। তার ধূসর চোখে ওর প্রতি অবজ্ঞা আর ঘৃণা দেখেছে রানা।
‘ভাবিনি বাঙালি একজন এতদূর আসতে পারবে,’ বলল মেজর।
‘তা হলে ভুল ভেবেছিলে।’
তিক্ত হাসল লোকটা। ‘তোমার কাছে লাইটার হবে?’
‘সিগারেট ধরাবার সময় কোথায়? ‘ রানা কথাটা বলতেই হঠাৎ ওর বুকে জোরে একটা ধাক্কা দিল আর্মি অফিসার। তাল সামলাতে না পেরে ঢালু পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নেমে চলল রানা। পতনের গতি আরও বাড়ল পঞ্চাশ পাউণ্ড ওজনের প্যাকের জন্যে। ঢালু জমি খামচে ধরতে গিয়ে রাইফেল হারাল রানা। পাহাড়ের পায়ে হুড়মুড় করে নামতেই ওর পা ফাটিয়ে দিল বরফের পাতলা চাদর। পরক্ষণে কাদা ভরা এক ডোবার ভেতর ঊরু পর্যন্ত গেঁথে গেল রানা।
ওপর থেকে দেখছে ব্রিটিশ মেজর। একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের পথে রওনা হয়ে গেল লোকটা।
আঠালো কাদার ডোবা। তলিয়ে যাচ্ছে রানা। পিঠ থেকে নামাতে চাইল ভারী ব্যাকপ্যাক। তবে স্ট্র্যাপদুটো চেপে বসেছে কাঁধে। ভারী ওজনের কারণে দ্রুত ডুবছে রানা। বরফে জমাট বাঁধা কয়েকটা নলখাগড়া দেখে আঁকড়ে ধরল। পা তুলবে কাদা থেকে। কিন্তু বরফ আর কাদা থেকে বগবগ আওয়াজ তুলে উঠে এল নলখাগড়া। আরও ছয়ইঞ্চি নেমে গেল রানা। কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল শীতল, নরম কাদায়। ইঞ্চি-ইঞ্চি করে তলিয়ে যাচ্ছে। ডুবে গেল কোমরের বেল্ট। চমকে গেল রানা… চোরাবালি নাকি! উঠে এসে পাঁজরের নিচের হাড় স্পর্শ করল কাদা। চোরাবালিতে পড়লে কী করতে হয় জানে রানা। কিন্তু কোনও কৌশলে কাজ হলো না পিঠের ভারী ওজনের কারণে।
তীরে পৌঁছুবার চেষ্টা করতে গিয়ে আরও দুর্বল হলো রানা। আশপাশে কেউ থাকলে সাহায্য পাবে, ভাবল ও। তবে ওর চিৎকার চাপা পড়ল জোরালো হু-হু হাওয়ার গর্জনের নিচে। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিল রানা। কাদা উঠে আসছে আরও।
যা ভেবেছে তার চেয়ে অনেক গভীর এ ডোবা। দ্রুত ডুবছে রানা। একটু পরেই জীবন্ত কবর হয়ে যাবে কাদার ভেতর। এরই মধ্যে ভীষণ শীতে অবশ হয়েছে দুই পা। ঊরু পর্যন্ত সাড়া নেই। ডোবা থেকে না উঠতে পারলে এখুনি শুরু হবে হাইপোথারমিয়া। এমন সময় বুটের আগায় কিছুটা শক্ত মাটি টের পেল ও। তীরের দিকে এগোতে চাইল রানা। কিন্তু লাভ হলো না, নরম কাদা আরও আঁকড়ে ধরল ওর সর্বাঙ্গ, নড়তে দেবে না। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে শক্তি। বুক ছাড়াল নরম কাদা। বরফ-ঠাণ্ডা পরিবেশে কঠিন হয়ে উঠল শ্বাস নেয়া।
রানা বুঝল, বাঁচার উপায় নেই। আজ কাদা ভরা ডোবার ভেতর মৃত্যু হবে ওর। আবারও লাথি মেরে তীরের দিকে যেতে চাইল। কিন্তু শক্তি নেই শরীরে। একইঞ্চিও এগোতে পারল না।
‘রানা!’
বহু দূর থেকে যেন উচ্চারিত হলো ওর নাম। মুখ তুলে পাহাড়ের দিকে তাকাল রানা। তুষারপাতের মাঝে ঢালু জমি বেয়ে নেমে আসছে আর্মির পোশাক পরা একটা ছায়ামূর্তি। তার দিকে চেয়ে রইল রানা। প্রায় পিছলে নেমে এসে একটু পর ডোবার ধারে পৌঁছুল লোকটা।
রানার প্রিয় বন্ধু অ্যালেক বেকার।
‘এটা শক্ত করে ধরো,’ রাইফেলের বাঁট এগিয়ে দিল সে। খপ্ করে ওটা ধরল রানা। বাঁটের ওয়েবিং স্লিং জড়িয়ে নিল অ্যালেক নিজের কোমরে। শক্ত পাথরে পা বাধিয়ে রানাকে টেনে তুলতে চাইল ও। প্রচণ্ড শক্তি খাটাতে গিয়ে গলা চিরে বেরোচ্ছে চাপা গর্জন। দু’হাতে রাইফেলের নল ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। টান খেয়ে একইঞ্চি-দুইইঞ্চি করে উঠতে লাগল রানা। কাদা থেকে এল চোঁ-চোঁ আওয়াজ। লাথি মেরে এগোতে গিয়ে পায়ের নিচে পেয়ে গেল ও কিনারার অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটি।
একমিনিটের ভেতর ডোবা থেকে উঠে এল রানা। ওকে শক্ত জমিতে টেনে এনে হাঁফাতে লাগল অ্যালেক। ডোবার তীরে শুয়ে থাকল রানা। শ্বাস নিতে গিয়ে মনে হচ্ছে যে- কোনও সময়ে ফেটে যাবে বুকটা।
মিনিট পাঁচেক পর কাদা ভরা রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল অ্যালেক। হাসছে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে। ‘উঠে পড়ো, ব্রাদার! তুমি না বলে ফার্স্ট হবে? জলদি!’
সেই সন্ধ্যায় ক্যাম্পে পৌঁছল মাত্র ছয়জন। অন্যরা হতক্লান্ত শরীরে চলে গেছে হেরিফোর্ডের রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে। দু’এক দিন বিশ্রাম নিয়ে যে-যার মত ফিরবে পুরনো ইউনিটে।
ট্রেইনিং শেষে প্রায় খালি ট্রাকে চেপে ফেরার সময় ওদের সঙ্গে সেই মেজরকে দেখেছিল রানা। ওকে দেখেই চোখ নিচু করে নিল লোকটা। পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে ওর নামটা জেনে নিয়েছিল রানা—মাইক বুচার। সত্যিকারের কসাই লোকটা। এত করেও রানাকে হারিয়ে প্রথম হতে পারেনি ও প্রতিযোগিতায়। ঘটনার কোনও সাক্ষী ছিল না, তাই টু শব্দটি করেনি রানা; কিচ্ছু বলেনি কাউকে। কিন্তু ঘটনাটা মনে রেখেছে।
ডোবা থেকে উদ্ধার পাওয়ার পরদিন ভোর থেকে শুরু হওয়ার কথা ইনিশিয়াল সিলেকশনের জন্যে এনডিয়োরেন্স মার্চ। কোথা থেকে যেন আধবোতল উইস্কি জোগাড় করল অ্যালেক। ডরমিটরিতে ক্যানভাস বাঙ্কে বসে দুই বন্ধু সাবড়ে দিল ওটা। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল রানা, ‘তোমার জন্যে আর মাত্র একটা দিন।’
‘আমার জন্যে আর একটা দিনও নয়,’ মগের দিকে চেয়ে বলল অ্যালেক। ফ্যাকাসে মুখ। চোখে তীব্র বেদনার ছাপ। ‘ওই ব্যাজ চাই না আমি। মরে গিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী?’
‘মাত্র একটা দিন, অ্যালেক, তারপর পাবে দুনিয়া-সেরা আর্মি ব্যাজ,’ বলল রানা।
তিক্ত হাসল ওর বন্ধু। ‘আমার আর সাধ্যই নেই, রানা। আমি তোমার মত কঠিন ইস্পাত দিয়ে তৈরি নই। আসলে সৈনিকই নই। মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ এক ছোকরা। জেদ করে বাবাকে দেখাতে চেয়েছি, আমিও কিছু করতে পারি—মিউযিক নিয়ে কাজ না করলেও চলবে। তবে এখন বুঝে গেছি, প্রথম সুযোগেই আর্মি ছেড়ে বাড়ি ফিরব।’
‘তারপর কী করবে?’ জানতে চাইল রানা।
‘মিউয়িক নিয়েই কাজ করব,’ কাঁধ ঝাঁকাল অ্যালেক। ‘ওটা আমাদের রক্তে আছে। লিয়া বহু ওপরে উঠবে, আমি ওর মত অত মেধাবী নই, তবে না খেয়েও মরব না।’
মন খারাপ হওয়ায় চুপ করে থাকল রানা।
‘ডিগ্রি নিয়েছি পিয়ানিস্ট হিসেবে,’ বলল অ্যালেক, ‘হয়তো শিক্ষকতা করব কোনও স্কুলে। তারপর সুযোগ পেলে ওয়েস্-এর ভাল একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতব। হয়তো দশটা কি বারোটা ছেলেমেয়ে হবে।’
‘তুমিও বললে আর আমিও বিশ্বাস করলাম,’ সারা দেহের ব্যথায় বাঙ্কে শুয়ে পড়ল রানা।
‘আমি অতটা বখাটে নই,’ বলল অ্যালেক। ‘তোমার আর লিয়ার ছেলেমেয়েগুলোকেও মানুষ করে দেব, যাও।’ রানার চোখে তাকাল সে। ‘লিয়া কিন্তু তোমার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস, রানা। ওর মনটা ভেঙে দিয়ো না। যতবার দেখা হয়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমার কথাই খালি তোলে। ওকে কোনদিন কষ্ট দিয়ো না।’
প্রিয় বন্ধুর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরোল রানার বুক চিরে। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ছয় বছর। ও দেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, তা ভালভাবেই বুঝেছিল অ্যালেক। আর সেজন্যেই চায়নি কপাল পুড়ুক আদরের বোনটির। গায়েব করে দিয়েছে ওর ই-মেইলে লেখা চিঠি। হয়তো সেটাই ভাল হয়েছে লিয়া বা ওর জন্যে। বিয়ের বাঁধনে জড়ালে দেশের স্বার্থে ভয়ঙ্কর সব বিপদে ঝাঁপ দিতে গিয়ে হয়তো দ্বিধা আসত ওর মনে।
মুখ তুলে তাকাল রানা। ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন দেখছে বলে কুঁচকে যাচ্ছে লিয়ার ধনুকের মত ভুরু। আরও কিছুক্ষণ অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা দেখল রানা। বুকে উঁকি দিল উদ্ভট, অযৌক্তিক চিন্তা: লিয়ার সঙ্গে বিয়ে হলে কেমন হতো ওর জীবনটা?
মনের গভীর থেকে কোনও সদুত্তর পেল না রানা।