‘কাঁচা আমি’ ও ‘পাকা আমি’

‘কাঁচা আমি’ ও ‘পাকা আমি’

আমরা ‘কথামৃতে’ দেখি, শ্রীরামকৃষ্ণ দুটি কথা খুব ব্যবহার করছেন—‘কাঁচা আমি’ আর ‘পাকা আমি’। শব্দ দুটি ঠাকুরের একেবারে নিজস্ব। তাঁর আগে আর কেউ এই শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন বলে আমরা জানি না। ঠাকুর ব্রাহ্মনেতা কেশব সেনকেও এই ‘কাঁচা আমি—পাকা আমি’র কথা বলেছিলেন। নিজেই বলছেন: কেশবকে বললুম, ‘আমি’ ‘আমার’ এটি অজ্ঞান। ‘আমি কর্তা’ আর আমার এই সব স্ত্রী, পুত্র, বিষয়, মান, সম্ভ্রম, এ ভাব অজ্ঞান না হলে হয় না। তখন কেশব বললে, মহাশয় ‘আমি’ ত্যাগ করলে যে আর কিছুই থাকে না। আমি বল্‌লুম কেশব তোমাকে সব ‘আমি’ ত্যাগ করতে বলছি না, তুমি ‘কাঁচা আমি’ ত্যাগ কর। ‘আমি কর্তা’ ‘আমার স্ত্রী-পুত্র’ ‘আমি গুরু’, এ সব অভিমান, ‘কাঁচা আমি’—এইটি ত্যাগ কর। এইটি ত্যাগ করে ‘পাকা আমি’ হয়ে থাকো। আমি তাঁর দাস, আমি তাঁর ভক্ত, আমি অকর্তা, তিনি কর্তা। (১-৬-২) ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা—এইটা হচ্ছে ‘পাকা আমি’র লক্ষণ। আমারই আরেকটা দিক রয়েছে—সেই ‘আমি’ সবসময় নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে। ভাবছে—আমি তাঁর দাস, আমি তাঁর সন্তান, কিংবা আমিই তিনি। এই হচ্ছে ‘পাকা আমি’। কিন্তু বিদ্যার অভিমান, ধনের অভিমান, গুণের অভিমান, বংশ বা পদগৌরবের অভিমান ‘কাঁচা আমি’। সেটা অহংকার। আমরা আমাদের ‘কাঁচা আমি’কে সব বলে মনে করি। দেহ-মন-বুদ্ধির গণ্ডির মধ্যেই আমাদের সব মনে করি। কিন্তু এর ঊর্ধ্বে যে আরেকটা ‘আমি’ আছে, সেটা ভুলে যাই। সেই ‘আমি’ আছে বলেই এই ‘আমি’ কাজ করছে—এই মন কাজ করছে, দেহ কাজ করছে, বুদ্ধি কাজ করছে। সেই ‘আমি’—পরমাত্মা। আমার প্রকৃত রূপ হচ্ছে সেটা। সেটাই ‘পাকা আমি’। এই ‘পাকা আমি’ই সত্য। ‘কাঁচা আমি’ মিথ্যা। ‘কাঁচা আমি’টা চিরস্থায়ী নয়—ভেঙে যায় একদিন। আজ হোক, কাল হোক কিংবা কয়েক জন্ম পরেই হোক—ভেঙে যায়। যত তাড়াতাড়ি ভাঙে ততই মঙ্গল। কারণ, সেই আমি—ছোট আমি, ক্ষুদ্র আমি। তার জন্যই আমি দুঃখ পাই। উপনিষদে দুটো পাখির উদাহরণ দেওয়া আছে। তারা দেখতে একই রকমের, আবার একই গাছে তারা বসে আছে। এদের একজন চুপ করে বসে আছে, গাছে নানারকম ফল আছে—খাচ্ছে না, চুপ করে বসে আছে; শান্ত, আত্মস্থ। আর অন্য পাখিটি? সে এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফাচ্ছে। অস্থির সে। কখনও মিষ্টি ফল খাচ্ছে—ভাল লাগছে। আবার কখনও তিতো ফল খাচ্ছে, ভাল লাগছে না। কিন্তু তবুও সে ফল খেয়েই চলেছে। কখনও তিতো, কখনও মিষ্টি। এই পাখিটি যেন জীবাত্মা। সংসারে আবদ্ধ হয়ে কত রকমের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সে চলেছে। অন্য পাখিটি পরমাত্মা, সে নির্লিপ্ত, সাক্ষী, উদাসীন। সে সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, সংসারের সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। বস্তুত দুটো পাখিই এক—জীবাত্মা পরমাত্মাই—জীব ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু অজ্ঞতাবশত ব্রহ্ম থেকে অর্থাৎ নিজের স্বরূপ থেকে নিজেকে আলাদা মনে করে। বাসনার দ্বারা তাড়িত হয়ে নিজের উপর জীববুদ্ধি আরোপ করে সংসারে জড়িয়ে পড়েছে। সে যে নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-ব্ৰহ্ম, তা সে জানে না। অর্থাৎ তার ‘পাকা আমি’কে ভুলে গিয়ে ‘কাঁচা আমি’ নিয়ে মেতে আছে। ‘কাঁচা আমি’টা আমার প্রকৃত রূপ নয়। আমার প্রকৃত রূপ ঐ ‘পাকা আমি’। ঠাকুর বলছেন ‘দাস আমি’, ‘বিদ্যার আমি’, ‘ভক্তের আমি’, এরই নাম ‘পাকা আমি’। (১-১৫-২)

আর ‘কাঁচা আমি’ কি? আমি কর্তা, আমি এত বড়লোকের ছেলে, বিদ্বান, আমি ধনবান আমাকে এমন কথা বলে!—এই সব ভাব। (ঐ) নিজেকে প্রাধান্য দেওয়া, নিজেকে একটা কেউকেটা মনে করা—এটাই হচ্ছে ‘কাঁচা আমি’। অর্থাৎ অহংকার। একটা শ্লোকে বলা হচ্ছে: ‘অহংকারস্য দ্বে বৃত্তী অহন্তা মমতা চেতি’—দুটো বৃত্তি বা ক্রিয়া অহংকারের। অহংতা আর মমতা—আমি আর আমার—আমি এটা করেছি, এই জিনিসটা আমার, এই বাড়ি আমার। ‘আমি করেছি’ না বলে ‘আমরা করেছি’ও তো বলা যায়, ‘আমার বাড়ি’ না বলে ‘আমাদের বাড়ি’ বলা যায়—শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু তা আমরা বলতে চাই না। বহুবচন নয়, সবসময় ঐ একবচন—’আমি’ আর ‘আমার’। অহংকারের লক্ষণই হল এই ‘আমি’ আর ‘আমার’। ঠাকুর বলছেন: ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুইটি অজ্ঞান। তুমি’ ও ‘তোমার’ এই দুইটি জ্ঞান। (১-১৮-৩) যে নিরহঙ্কার তারই জ্ঞান হয়। নীচু জায়গায় বৃষ্টির জল দাঁড়ায়, উঁচু জায়গা থেকে গড়িয়ে যায়। (১-১২-৮) জ্ঞান—অর্থাৎ ঈশ্বরলাভ, বা নিজের স্বরূপ উপলব্ধি। যার ‘পাকা আমি’ সে জ্ঞান লাভ করতে পারে। ‘পাকা আমি’ ভগবানের দিকে নিয়ে যায়। আর ‘কাঁচা আমি’ বন্ধনের কারণ হয়। ঈশ্বরকে জানতে দেয় না। আমার স্বরূপটা আমাকে জানতে দেয় না। অর্থাৎ অজ্ঞান করে রাখে আমাকে। ঈশ্বর তো চাইছেনই আমার হৃদয়ে আসতে। কিন্তু আমি যে সেখানে খুব সাজিয়ে-গুজিয়ে মহা-আড়ম্বর করে নিজেকে বসিয়ে রেখেছি। ঈশ্বর এসে দেখেন: তাঁর জন্য কোন আসন তো পাতা নেই, তাঁর জন্য কোন স্থান তো খালি নেই। তিনি ফিরে যান তখন। রবীন্দ্রনাথ তাই বলছেন: ‘দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে।’ আমার এমনই প্রকৃতি যে, আমি দুয়ার বন্ধ রাখবই। কিন্তু প্রভু, তুমি দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যেও না। তুমি কৃপা করে দুয়ার ভেঙে আমার হৃদয়ে এসো। আমার ‘আমি’-কে তুমিই কৃপা করে মুছে দাও।

এই ‘কাঁচা আমি’কে ঠাকুর আবার অন্য জায়গায় বলছেন: ‘বজ্জাত আমি’। হাজার বিচার কর, ‘আমি’ আর যায় না। (১-১২-৯) বলছেন: অশ্বত্থ গাছের ফেঁকড়ি। অশ্বত্থ গাছের ডাল কেটে দেওয়া হল, কিছুদিন পরে দেখা যাবে, আবার সেখান থেকে একটা ফেঁকড়ি বেরিয়েছে। অহংকারও ঠিক তাই। খুব বিচার করে ‘আমি’কে সরিয়ে দিয়েছি, মনে মনে ভাবছি, অহংকার নেই। আবার একটু পরেই দেখা যাবে কোত্থেকে অহংকার এসে গেছে। কতরকম ভাবে এই অহংকার আসে। ভাল দেখতে—তার জন্য অহংকার। বিদ্যা—তার অহংকার, ভাল গান করতে পারি—তার অহংকার। আবার ধর্মের অহংকারও আছে। Holier than thou—আমি অন্যের থেকে ধর্মের দিক দিয়ে এগিয়ে আছি, এও অহংকার। এই অহংকার আরও সূক্ষ্ম, সেইজন্য আরও সাংঘাতিক। অল্ডাস হাক্সলী একেই বলেছেন, Self-righteousness—এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। আমার মতো ন্যায়নিষ্ঠ কেউ নেই, আমি সব বুঝে ফেলেছি, আমিই একমাত্র ন্যায়ের পথে আছি—এ-ধরনের ভাব প্রায়ই আত্মপ্রবঞ্চনা হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি আবার রয়েছে বিনয়ের অভিমান। আসলে বিনয় হচ্ছে ভিতরের জিনিস, স্বতঃস্ফূর্ত। সেটা লোকদেখানো ব্যাপার হলে উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বিনয় খুব ভাল, কিন্তু আমি খুব বিনয়ী, এই ভাবটা মনে এলে সেটা আবার অহংকারে পরিণত হতে পারে, হয়ও। সেইজন্য ঠাকুর বলছেন: অশ্বত্থ গাছের ফেঁকড়ি। রবীন্দ্রনাথের সেই ‘ভক্তিভাজন’ কবিতাটি এখানে স্মরণ করা যায়:

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ একবার আমাকে একটা গুজরাটী কবিতা বলেছিলেন:

হুঁ করুঁ হুঁ করুঁ এ জ অজ্ঞানতা।

শকটনো ভার জেম শ্বান তানে॥

—আমি করি আমি করি, এটা অজ্ঞানতা। গরুরগাড়ির ছায়ায় ছায়ায় একটা কুকুর চলেছে। কুকুর ভাবছে সে-ই গাড়িটা টেনে নিয়ে চলেছে। আসলে কিন্তু গাড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে গরু। তেমনি আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টার পিছনে ঈশ্বরের শক্তি। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া তৃণটিও নড়ে না। অথচ আমরা মনে করি, আমরাই সব করছি। কেনোপনিষদের সেই কাহিনী মনে পড়ছে। দেবতা আর দানবদের যুদ্ধে দেবতাদের জয় হয়েছে। দেবতারা তো খুব খুশি। তাঁদের সকলের মনেই এরজন্য খুব গর্ব।—আমাদের এত শক্তি! এমন সময় হঠাৎ সেখানে নতুন এক মূর্তি আবির্ভূত হলেন। কেউ তাঁকে চিনতে পারছেন না। সবাই ভাবছেন, কে ইনি? ইন্দ্র তখন অগ্নিকে পাঠালেন তাঁর কাছে। অগ্নি তাঁর কাছে যেতেই সেই মূর্তি অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি কে, কি কর? অগ্নি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন: আমি সব পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারি। তিনি বললেন: তাই নাকি? এই খড়টাকে পুড়িয়ে দাও তো দেখি। অগ্নি ভাবলেন: এ আবার একটা পরীক্ষা নাকি। কিন্তু পোড়াতে পারলেন না, যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন, পারলেন না। লজ্জায় মাথা হেঁট করে অগ্নি চলে গেলেন। দেবতারা তখন বায়ুকে পাঠালেন। বায়ুকেও সেই মূর্তি সেই খড়টা দিয়ে বললেন: এটাকে উড়িয়ে দাও তো দেখি। বায়ু প্রাণপণ চেষ্টা করলেন, পারলেন না। মাথা হেঁট করে তিনিও বিদায় নিলেন। এবার কে যাবেন? স্বয়ং ইন্দ্রই গেলেন এবার। দেবরাজ তিনি। তিনি যেতেই সেই মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল, সেই জায়গায় দেখা গেল এক দেবীমূর্তি। ইনি হচ্ছেন উমা হৈমবতী। উমা ইন্দ্রকে বললেন: আগে যাঁকে দেখেছ তিনি ব্রহ্ম। তিনিই সবকিছুর মূল। তোমরা ভাবছ তোমাদের শক্তিতে জিতেছ। তা নয়, তাঁরই শক্তিতে তোমরা জয়লাভ করেছ। আমাদের সব শক্তির উৎস ব্রহ্ম। কিন্তু ‘অহংকারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে’ —অহংকারে বিমূঢ় হয়ে আমরা সেটা ভুলে যাই, নিজেদের কর্তা মনে করি।

শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলছেন: জীবের ‘আমি কর্তা’ এই অভিমান অজ্ঞান থেকে হয়। আবার সেই নিজেকে কর্তা মনে করার মধ্যেও কিরকম ফাঁকি। ভাল কিছু যখন হয়, যেখানে একটুও কৃতিত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা—সেখানে ‘আমি’। খুব উৎসাহভরে সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করি—‘আমি এটা করেছি’। কিন্তু যেখানে খারাপ কিছু, যেখানে ভুল-ভ্রান্তি, অগৌরব—সেখানে অন্য কাউকে দায়ী করি। অন্য কাউকে যদি না পাই, তাহলে ‘ভগবান তুমি’। ঠাকুরের সেই যে ব্রাহ্মণের গল্প আছে: ব্রাহ্মণ ফুলের বাগান করার কৃতিত্ব নিজে নিয়েছিলেন আর গোহত্যার পাপ ইন্দ্রের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।* বাস্তবিক, সমস্ত জীবনটা ধরে আমরা কি করছি? ‘আমি’র প্রতিযোগিতা। নিজেকে জাহির করার প্রচেষ্টা। স্বামীজী বলছেন: ‘বহে মাত্র “আমি” “আমি”—এই ধারা অনুক্ষণ’। সর্বক্ষণ এই ‘আমি’ রয়েছে। আর একটা কবিতায় বলছেন: ‘ধরিয়ে বাসনা বেশ উজালা, গরজি গরজি উঠে তার বারি, “অহমহমিতি”।’ —আমাদের সমস্ত জীবনের পিছনে বাসনার প্রবাহ। সেই বাসনার তরঙ্গ গর্জে গর্জে উঠছে ‘আমি’কে কেন্দ্র করে। ‘আমি’কে আশ্রয় করে সেই বাসনা নিজেকে প্রকাশ করছে। আমি ভাল খাব, আমি ভাল থাকব, আমি ভাল পরব, ইত্যাদি। ‘আমি’ না থাকলে কোন বাসনা নেই, বাসনা না থাকলে জন্মমৃত্যু নেই, অর্থাৎ মুক্তি, অর্থাৎ সব দুঃখের শেষ। সেইজন্য ঠাকুর বলছেন: আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল। (১-৪-৬ ) অথচ এই ‘আমি’ কিছুতেই যেতে চায় না। সবসময় আগে ‘আমি’ এসে যায়। নিজের কথা বলতে খুব ভাল লাগে। আত্মপ্রশংসা করে যাচ্ছি, আত্মপ্রচার করছি। হয়তো অপরের বিরক্তি হচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারি না। নিজের অজ্ঞাতসারে নিজের কথা বলে যাচ্ছি। এটাই তো মায়া! ঠাকুরও সেই কথাই বলছেন: জীবের অহংকারই মায়া। (ঐ) বলছেন: জীব তো সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। কিন্তু এই মায়া বা অহংকারে তাদের সব নানা উপাধি হয়ে প’ড়েছে,⋯এক একটি উপাধি হয়, আর জীবের স্বভাব বদলে যায়। (ঐ) উদাহরণ দিয়ে বলছেন: একজন যদি কালাপেড়ে ধুতি পরে, অমনি সে নিধুবাবুর টপ্পা গাইতে থাকবে। আবার কেউ যদি বুটজুতো পরে তাহলে সে শিস্‌ দিতে আরম্ভ করে, আর সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় সাহেবদের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। বলছেন: টাকাও একটি বিলক্ষণ উপাধি। টাকা হ’লেই মানুষ আর এক রকম হ’য়ে যায়, সে মানুষ থাকে না। একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতী সেই গর্ত ডিঙ্গিয়ে গিছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ ক’রে হাতীকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড় সাধ্য যে আমায় ডিঙ্গিয়ে যাস্! টাকার এত অহংকার। (ঐ) ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বরে এক ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। সে বেশ বিনয়ী ছিল, ঠাকুরকে সম্মান করত। কিছুদিন পরে ঠাকুর কোন্নগরে গেছেন, সঙ্গে হৃদয়। গঙ্গার ঘাটে ঐ ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা। ঠাকুরকে দেখেই ব্রাহ্মণ বলছে: কি ঠাকুর! বলি—আছ কেমন? তার কথার স্বর শুনেই ঠাকুর বলছেন: বুঝলি হৃদে, লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এরকম কথা! অর্থাৎ টাকা হওয়াতে কথা বলার ধরনটাই পালটে গেছে। আগের সেই বিনয়ী ভাবটা আর নেই। অহংকারের জন্য এরকম হয়ে থাকে। একটি মজার গল্প আছে। একজন বাজারে মাছ কিনতে গেছে। তার আঙুলে অনেকগুলো আংটি। সে আঙুলগুলো প্রসারিত করে জিজ্ঞাসা করছে: এই মাছটার কী দর?—যাতে সবাই তার আংটি দেখতে পায়। মেছুনীরও আবার হাতে কিছু অলংকার রয়েছে, সে সেগুলি দেখিয়ে মাছের দাম বলছে। সবসময় অহংকারের এইরকম নানা খেলা চলছে। অহংকার বা ‘কাঁচা আমি’ যে কতভাবে আমাদের জড়িয়ে রাখে আর প্রবঞ্চনা করে, তার ইয়ত্তা নেই। তাই একমাত্র উপায় হচ্ছে তাঁর শরণাগত হওয়া, শরণাগত হয়ে তাঁকে বলা: আমি কিছু নই, কিছু জানি না। একই মানুষ, কত সুন্দর সরল ছিল —জীবনে কোন সাফল্য এল তার, বদলে গেল। তাকে মনে হচ্ছে, এ যেন আর আগের লোক নয়, ঠিক যেন চেনা যাচ্ছে না। অহংকারের জন্য এরকম হয়। আবার ব্যতিক্রমও আছে। বহু কৃতিত্বের অধিকারী, অথচ নিরহংকার। এরকম যে হয়, সেই মহৎ।

আমরা একটা কথা বলি যে, আজকাল মানুষ বড় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে—‘ego-centric’। কিন্তু এ নতুন কিছু নয়। চিরকাল মানুষ এই ‘আমি’কে কেন্দ্র করে চলেছে। সেই ‘আমি’তে যদি একটু আঘাত পড়ে, অমনি আমি ফুঁসে উঠি—প্রত্যাঘাত করি। আমার অজান্তেই হয়তো করি। কতদিনের বন্ধুত্ব হয়তো ভেঙে গেল—‘আমি’তে আঘাত লেগেছে বলে। একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। দুই বন্ধু যাচ্ছিলেন তীর্থদর্শনে—মানস-সরোবরে। অনেকদিনের বন্ধু তাঁরা। ওঁদের সঙ্গে আমাদের এক সাধুও গেছিলেন। তাঁর কাছেই গল্পটা শুনেছি। এক চটিতে তাঁরা সবাই রাত কাটিয়েছেন, পরদিন সকালে যাত্রা করবার জন্য সবাই প্রস্তুত হচ্ছেন, বিছানা বাঁধবার সময় এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে বলেছেন: তুই আমার দড়ি নিয়েছিস কেন? অন্য বন্ধু বলছেন: তোর দড়ি নিলাম কোথায়? এটা তো আমার দড়ি। প্রথম বন্ধু বলছেন: তোর দড়ি হল কি করে? ওটা তো আমার দড়ি। বন্ধুতে বন্ধুতে এরকম কথা হতেই পারে, কিন্তু সেই বন্ধু হঠাৎ বলে বসলেন—তাহলে আমি চুরি করেছি বলতে চাস্? ব্যস্‌, এই নিয়ে এমন বিবাদ যে, কথা বন্ধ। একজন ফিরেই আসবেন ঠিক করেছেন। আর সেই স্বামীজী বিপন্ন। তিনি দুজনকে কত বোঝান, কিন্তু আর বাক্যালাপ নেই দুজনের। দেখা গেল একজন বন্ধু এমন মনঃকষ্টে আছেন যে, খাবার তৈরি হয়েছে, তিনি খাবেন না, দূরে এক জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসে আছেন। এই স্বামীজী খুঁজতে খুঁজতে তাঁর কাছে গিয়ে বলছেন: চলুন, খেয়ে নেবেন চলুন, আর দেরি করলে পথে খুব অসুবিধে হবে আমাদের। সেই বন্ধুর সেদিকে মন নেই! বলছেন: শেষকালে আমি চোর হয়ে গেলাম! —এরকম হয়। সামান্য একটু কথা, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ভেঙে গেল—‘আমি’তে লেগেছে বলে। এ কেন হয় বলা যায় না। সেইজন্যই ঠাকুর বলছেন যে, এই অহংকারই মায়া। ‘মায়া’র কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এই ‘আমি’ বোধ কেন সবসময় মাথা তুলে দাঁড়ায়—এও বোঝা যায় না।

ঠাকুর বলছেন: এই মায়া বা অহং যেন মেঘের স্বরূপ। সামান্য মেঘের জন্য সূর্যকে দেখা যায় না—মেঘ স’রে গেলেই সূর্যকে দেখা যায়। (ঐ) আমার মধ্যে সচ্চিদানন্দরূপ সূর্য রয়েছেন, ঈশ্বর রয়েছেন সর্বদা। কিন্তু আমার অহংবুদ্ধির জন্য তিনি যেন ঢাকা পড়ে রয়েছেন—মেঘ যেমন সূর্যকে ঢেকে রাখে। মেঘ সরে গেলেই সূর্য দেখা যায়। তেমনি, যদি গুরুর কৃপায় একবার অহং বুদ্ধি যায় তা’হলে ঈশ্বর দর্শন হয়। (ঐ) শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদে বলছে-

সর্বাজীবে সর্বসংস্থে বৃহন্তে

অস্মিন্‌ হংসো ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রে।

পৃথগাত্মানং প্রেরিতারঞ্চ মত্বা

জুষ্টস্ততস্তেনামৃতত্বমেতি॥

ব্রহ্মচক্রে মানুষ কেন এত কষ্ট পায়? — ব্রহ্ম বা আত্মা থেকে পৃথক মনে করে বলে। পৃথক মনে করে এই ‘অহং’-এর জন্য। আমি স্বয়ং ব্রহ্ম, আমি স্বয়ং ঈশ্বর। অথচ আমি সেটা বুঝতে পারি না। আমি অসীম, অনন্ত। অথচ মায়ার জন্য নিজেকে মনে করছি সসীম, সান্ত। মনোবিজ্ঞানীরা একটা কথা বলেন: alienation— স্বরূপ থেকে সরে যাওয়া। এও ঠিক তাই। আমরা যেন কক্ষচ্যুত নক্ষত্র এক একটা, নিজেদের জায়গা থেকে সরে গেছি, পূর্ব-পরিচয় হারিয়ে ফেলেছি আমরা, নিজেদের কাছেই নিজেরা যেন অপরিচিত। আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-পূর্ণ। অথচ বদ্ধ মনে করছি নিজেকে, এই মায়ার জন্য, ‘কাঁচা আমি’র জন্য। ঠাকুর বলছেন: জীব ও আত্মার প্রভেদ হয়েছে, এই আমি মাঝখানে আছে বলে। উদাহরণ দিয়ে বলছেন: জলের উপর যদি একটা লাঠি ফেলে দেওয়া যায়, তাহলে দুটো ভাগ দেখায়। বস্তুতঃ, এক জল; লাঠিটার দরুন দুটো দেখাচ্ছে। অহং-ই এই লাঠি। লাঠি তুলে লও, সেই এক জলই থাকবে। (ঐ) ‘আমি’ বোধ দূর হলেই দেখা যাবে জীব আর আত্মাতে আর কোন প্রভেদ নেই। বেদান্তসারে বলছে: …জীব কাকে বলে? অয়ং কর্তৃত্ব-ভোক্তৃত্ব-সুখিত্ব-দুঃখিত্ব-আদি-অভিমানিত্বেন ইহলোক-পরলোকগামী ব্যবহারিকো জীব ইতি উচ্যতে—‘আমি করছি’, ‘আমি ভোগ করছি’, ‘আমি সুখী’ কিংবা ‘আমি দুঃখী’ ইত্যাদি অভিমান যার আছে, সেই জীব। এই ‘আমি’ বোধ বা অভিমান আছে বলেই তার এই জন্ম হয়েছে, এরজন্যই তাকে পুনর্জন্মও গ্রহণ করতে হবে। ‘আমি’ বোধ থাকলেই, আমি জীব। ‘আমি’ বোধ যদি দূর হয়ে যায় তাহলে আমি আর জীব নই—আমি তখন ‘শিব’ হয়ে গেছি। কুলার্ণবতন্ত্রে একটা শ্লোক আছে, তাতে বলা হচ্ছে:

দ্বে পদে বন্ধমোক্ষায় মমেতি নির্মমেতি চ।

মমেতি বধ্যতে জন্তুর্ন মমেতি বিমুচ্যতে॥

—দুটো জিনিস আছে, তাদের একটাতে বন্ধন, আর একটাতে মুক্তি হয়। মমত্ববুদ্ধি থাকলে, ‘আমি আমার’ বোধ থাকলে, সেটা বন্ধনের কারণ হয়। আর মমত্ববুদ্ধি যদি না থাকে, তাহলে সেটা মুক্তির কারণ হয়। ঠাকুর সেইজন্য বারবার বলছেন: ‘আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল’। কিন্তু ‘আমি’ দূর করবার কি উপায়? উপায় হচ্ছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছে, আর একটা কাঁটা দিয়ে সেই কাঁটাটা তুলে ফেললাম। এও ঠিক তাই। এখন আমার মধ্যে যে-আমি আছে সেই-আমি—‘কাঁচা আমি’, ‘বজ্জাত আমি’, ‘ছোট আমি’। আমি ‘বড় আমি’র আশ্রয় নেব। ঠাকুর বলছেন: ‘আমি’ তো কিছুতেই যাবে না, তবে থাক্‌ শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।(১-৪-৬) আমি এখন মনে করছি ‘আমি বিদ্বান’, ‘আমি বুদ্ধিমান’, ‘আমি পণ্ডিত’। সেই জায়গায় আমি মনে করব ‘আমি ঈশ্বরের সন্তান’, ‘ঈশ্বরের দাস’, কিংবা ‘আমি স্বয়ং ঈশ্বর’। এরূপ ‘আমিতে’ দোষ নাই; মিষ্ট খেলে অম্বল হয়, কিন্তু মিছরি মিষ্টির মধ্যে নয়।⋯ ‘দাস আমি’ কি ‘ভক্তের আমি’ কি ‘বালকের আমি’ এরা যেন ‘আমি’র রেখা মাত্র। (ঐ) এতে দোষ নাই, বরং এতে ঈশ্বর লাভ হয়। (১-৪-৭) এখন প্রশ্ন হল: যার ‘দাস আমি’ তার কাম-ক্রোধাদি কিরূপ? (ঐ) ঠাকুর বলছেন: ঠিক ভাব যদি হয়, তা হলে কাম-ক্রোধের কেবল আকার মাত্র থাকে। যদি ঈশ্বর লাভের পর ‘দাস আমি’ বা ‘ভক্তের আমি’ থাকে, সে ব্যক্তি কারো অনিষ্ট করতে পারে না। (ঐ) উদাহরণ দিয়ে বলছেন: পরশমণি ছোঁয়ার পর লোহার তরোয়াল সোনা হয়ে যায়। সোনার তরোয়াল দিয়ে কাউকে মারা যায় না। ‘আমি দাস, তুমি প্রভু’, ‘আমি ভক্ত, তুমি ভগবান’ এই অভিমান ভক্তের থাকে। ঈশ্বর লাভের পরও থাকে, সব ‘আমি’ যায় না। আবার এই অভিমান অভ্যাস করতে করতে ঈশ্বর লাভ হয়। (ঐ) এটাই হচ্ছে বড় কথা। ঈশ্বরলাভের পরও ‘আমি’ থাকে অর্থাৎ ‘পাকা আমি’ থাকে। কিন্তু যারা ঈশ্বরলাভ করেনি, সাধারণ লোক, তাদেরও ঐ ‘পাকা আমি’ অভ্যাস করতে হয়। সেটাই সাধনা। মনে মনে সবসময় বলতে হয়, ‘আমি দাস, তুমি প্রভু’, ‘তুমি মা, আমি তোমার সন্তান’। এইরকম অভ্যাস করতে করতেই ঈশ্বরলাভ হয়। এরই নাম ভক্তিযোগ। (ঐ) আর জ্ঞানপথে বলতে হয়: আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। আমি সাক্ষী, উদাসীন, নিষ্ক্রিয়, দ্রষ্টা। জ্ঞানপথ অপেক্ষাকৃত কঠিন। একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে। ভক্তিপথেই হোক আর জ্ঞানপথেই হোক—‘আমি অকর্তা’ এই বোধ কিন্তু দুটোতেই আসছে। ভক্তিপথে ভক্ত বলে—আমি কিছু করছি না, সব তুমি করছ। আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী। আর জ্ঞানপথে গেলে ভাবতে হয়: আমি নিষ্ক্রিয় আত্মা, আমি কিছু করি না।* সেটাই হল ‘পাকা আমি’র লক্ষণ। ঠাকুর বলছেন: আমি করছি এইটির নাম অজ্ঞান। হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর আমি অকর্তা; তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; এইটির নাম জ্ঞান। (১-১০-৭) যদি ঈশ্বরের কৃপায় ‘আমি অকর্তা’ এই বোধ হয়ে গেল, তা হলে সে ব্যক্তি তো জীবন্মুক্ত হয়ে গেল। তার আর ভয় নাই। (১-৪-৬) ভক্তের ভাব হচ্ছে: ‘যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি’। তুমি আমাকে দিয়ে যেমন করাচ্ছ, আমি তেমনই করছি। আমি কিছু না—তুমিই সব। তোমাকে বাদ দিয়ে আমার কোন অস্তিত্ব নেই। একটা গান আছে:

সকলি তোমার ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।

তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি ॥

লোকে বলুক, কিন্তু আমি যেন কখনও না বলি। কবীর বলছেন:

প্রভু ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম তেরা।

তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান মেরা॥

—আমি তোমার গোলাম, চাকর। তুমি আমার প্রভু, আমার কর্তা। এই হল ‘আমি’ মুছে ফেলার পথ। ভক্ত কখনও বলে না যে, ‘আমি করছি’। যে ঠিক ভক্ত, সে বলে—হে ঈশ্বর! তুমিই কর্তা, তুমিই সব করছো, আমি কেবল যন্ত্র, আমাকে যেমন করাও তেমনি করি। আর এ সব তোমার ধন, তোমার ঐশ্বর্য তোমার জগৎ। তোমারই গৃহ পরিজন, আমার কিছু নয়। আমি দাস। তোমার যেমন হুকুম, সেইরূপ সেবা করবার আমার অধিকার। (১-১৮-৩) ভক্ত বলে: ‘যৎ কৃতং যৎ করিষ্যামি তৎ সর্বং ন ময়া কৃতম্‌’—আমি যা করেছি বা যা কিছু করব, সেসব আসলে আমি করিনি। ‘ত্বয়া কৃতন্তু’—তুমিই করেছ প্রভু। আর ফল কে ভোগ করবে? ‘ফলভুক্‌ ত্বমেব’—তুমিই ফলভোগ করবে। আমি নই, আমার নয়—তুমি সব করছ, সব কিছু তোমার! রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করছেন: প্রভু, আমার অহংকার তুমি মুছে ফেল, আমি যেন নিজেকে কখনও প্রচার না করি! বলছেন:

আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।

সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥

… … …

আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,

তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।

‘আমি’ থাকলে তিনি আসবেন না। একজন মুসলমান সাধক-কবি বলছেন: ভরী সরায় রহীম লখি, আপ পথিক ফিরি জায়। ‘ভরী সরায়’—সরাইখানা লোকে ভর্তি। সেইসময় রহীম এলেন সেখানে। রহীম অর্থাৎ ঈশ্বর। আরবীভাষায় ঈশ্বরের নাম রহীম। ঈশ্বর এসে সরাইখানা ভর্তি দেখলেন। তখন তিনি হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। এখানে সরাইখানা মানে আমাদের হৃদয়। ভগবান আমাদের হৃদয়ে আসতে চেষ্টা করছেন। আসতে গিয়ে দেখছেন, আমরা ইতিমধ্যে নিজেদেরই সেখানে বসিয়ে রেখেছি। তাই তাঁকে ফিরে যেতে হয়। ব্রাদার লরেন্স ‘Practice of the Presence of God’ বইতে বলছেন ঐ একই কথা: ‘We must devote ourselves to Him in good earnest, casting everything else out of our hearts; He wishes to be alone therein….’ আমাদের অন্তরটাকে একেবারে ফাঁকা করতে হবে। তবেই তিনি আসবেন। ভগবান একা থাকতে ভালবাসেন। আমাদের অন্তরে শুধু তিনিই থাকবেন। সেখানে আর কারও উপস্থিতি যেন তিনি সহ্য করতে পারেন না। ঠাকুর বলছেন: সুতোয় একটুও আঁশ বেরিয়ে থাকলে যেমন সেই সুতো ছুঁচের ভিতর দিয়ে যেতে চায় না, তেমনি অহংকারের লেশমাত্র থাকলেও ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। যীশুখ্রীষ্টও বলছেন ঠিক সেই কথা ‘If any man will come after me, let him first deny himself.’—কেউ যদি আমার কাছে আসতে চায়, তবে আগে তাকে নিজেকে মুছে ফেলতে হবে, অহংকার দূর করতে হবে। রজনীকান্ত বলছেন: ‘কবে তোমাতে হয়ে যাব, আমার আমি হারা।’ কবে আমি তোমাতে আত্মসমর্পণ করতে পারব। তুলসীদাস বলছেন: ‘কেবল তন্ময় ভই কছু ন জানে হম কো হৈ’—আমি তন্ময় হয়ে আছি, তোমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছি। তুমি ছাড়া আর কিছু আমি জানি না—নিজেকেও জানি না। সব দেশে, সব যুগে, সব ধর্মেরই এই এক কথা—নিজের ‘ক্ষুদ্র আমি’কে ভুলতে হবে।

স্বামীজী একবার একটা চিঠিতে বলছেন: পরিকল্পনা করে আমি কাজ করব? না, তা আমি করব না। বলছেন:১০ ‘I am Mother’s child. She works, She plays. Why should I plan? What should I plan? Things came and went, just as She liked, without my planning.’—আমার ইচ্ছায় কিছু হয় না; যা-কিছু হয়েছে, সবই মায়ের ইচ্ছায়। আমি মায়ের সন্তান, মায়ের উপর নির্ভর করে আছি। মা-ই তাঁর কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। তাই কর্মের পরিকল্পনা আমি করতে চাই না। কেন পরিকল্পনা করতে যাব? কী পরিকল্পনাই বা করব? স্বামীজী প্রথমবার বিদেশ থেকে ফিরে যখন শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করতে গেছেন, মা বলছেন:১১ বাবা, তুমি যা করেছ, এমন আর কেউ করেনি। স্বামীজী বলছেন: কী ছাইপাঁশ বলছ, এসব আমি করেছি, না তুমি করেছ? তুমি ইচ্ছামাত্র আমার মতো লাখো বিবেকানন্দ করতে পার তা কি আমি জানি না? এই হচ্ছে ঠিক ঠিক অহংশূন্যতা। ঠাকুর ‘আমি-আমার’ এই কথা দুটি মোটে পছন্দ করতেন না। বলতেন: ‘আমাদের’ বলাই ভাল, ‘আমি-আমার’ বলা ভাল না। নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে, ‘আমার কথা’ ‘আমার এই মত’—এসব না বলে বলতেন: এখানকার কথা, এখানকার এই মত। অন্য কেউও যদি তাঁর সামনে বলে ফেলত, ‘আমি এটা করব’, খুব বিরক্ত হতেন। একবার কালনায় গেছেন ভগবানদাস বাবাজীকে দেখতে। ভগবানদাস বাবাজী তখনকার দিনের উঁচুদরের একজন সাধক—বাংলার বৈষ্ণবসমাজের শিরোমণি ছিলেন তিনি। ঠাকুরের একটা শখ ছিল—যখনই তিনি শুনতেন কোথাও একজন বড় সাধু আছেন বা ভক্ত আছেন, তাঁকে দেখতে যেতেন। তাই কালনায় গেছেন ভগবানদাস বাবাজীকে দেখতে, সঙ্গে আছেন হৃদয়। বাবাজীর আশ্রমে গিয়ে ঠাকুর নিজের কোন পরিচয় দেননি। হৃদয়ই সামনে এগিয়ে গেছেন—উনি তাঁর পেছনে আছেন। আশ্রমে গিয়ে প্রথমেই তাঁরা দেখলেন: একজন বৈষ্ণব সাধু কি অন্যায় করেছেন, বাবাজী তাঁকে বকছেন আর বলছেন যে, তাঁর কণ্ঠী (মালা) কেড়ে নিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দেবেন। হৃদয় আর ঠাকুর গিয়ে একপাশে বসলেন। হৃদয়ই বাবাজীর সাথে কথা বলছেন, ঠাকুর চুপ করে আছেন। হৃদয় জিজ্ঞেস করলেন: আপনি তো সিদ্ধ হয়েছেন, আপনি এখনও তাহলে মালা রেখেছেন কেন? বাবাজী বললেন: নিজের প্রয়োজন না থাকলেও লোকশিক্ষার জন্য মালা রেখেছি। বাবাজী ঐ যে একজন সাধুকে তাড়িয়ে দেবেন বলছিলেন সেটাই ঠাকুর মোটে পছন্দ করেননি। তারপর যেই তিনি বলেছেন, ‘লোকশিক্ষার জন্য মালা রেখেছি’, ঠাকুর আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি। খুব রেগে গেছেন। উঠে দাঁড়িয়ে ভগবানদাস বাবাজীকে লক্ষ্য করে বলছেন: কি? তোমার এখনও এত অহংকার? তুমি লোকশিক্ষা দেবে? তুমি তাড়াবে? তুমি ত্যাগ ও গ্রহণ করবে? তুমি লোকশিক্ষা দেবার কে? যাঁর জগৎ তিনি না শিখালে তুমি শেখাবে?—বলতে বলতে একেবারে সমাধিস্থ! আর আশ্চর্যের ব্যাপার ভগবানদাস বাবাজী কোন প্রতিবাদ করলেন না তাঁর কথার, বিরক্ত হলেন না—ঠাকুরের কথা মেনে নিলেন। অথচ তখনও পর্যন্ত তিনি জানেন না, ঠাকুর কে! স্বামী সারদানন্দ লিখছেন: ‘চিরকাল শ্রীশ্রীজগন্মাতার উপর সকল বিষয়ে বালকের ন্যায় সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া আসায় ঠাকুরের নির্ভরশীলতা এত সহজ, স্বাভাবিক ও মজ্জাগত হইয়া গিয়াছিল যে, নিজে অহংকারের প্রেরণায় কোনও কাজ করা দূরে থাকুক, অপর কেহ ঐরূপ করিতেছে করিব বলিতেছে দেখিলে বা শুনিলে তাঁহার মনে একটা বিষম যন্ত্রণা উপস্থিত হইত। সেইজন্যেই তিনি ঈশ্বরের দাসভাবে অতি বিরল সময়ে “আমি” কথাটির প্রয়োগ করা ছাড়া অপর কোনও ভাবে আমাদের ন্যায় ঐ শব্দের উচ্চারণ করিতে পারিতেন না। অল্প সময়ের জন্যও যে ঠাকুরকে দেখিয়াছে সেও তাঁহার ঐরূপ স্বভাব দেখিয়া বিস্মিত ও মুগ্ধ হইয়াছে, অথবা অন্য কেহ কোনও কর্ম “আমি করিব” বলায় তাঁহার বিষম বিরক্তি প্রকাশ দেখিয়া অবাক হইয়া ভাবিয়াছে—ঐ লোকটা কি এমন কুকাজ করিয়াছে যাহাতে তিনি এতটা বিরক্ত হইতেছেন!’১২

শুধু ধর্ম নয়, যে কোন ভাল কাজ করতে গেলে নিজেকে ভুলতে হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে মেতে আছে। আমরা বলি আত্মহারা হয়ে গেছে। কথাটা খুব ভেবে বলি না। আত্মহারা হয়ে গেছে অর্থাৎ নিজেকে ভুলে গেছে। নিজেকে ভুলে যায় বলেই সে কত কিছু আবিষ্কার করে। মানুষ নিজেকে নিয়ে থাকতে পারে না। যতই সে নিজেকে ভুলতে পারে, নিজেকে অন্যের মধ্যে বিস্তারিত করে দিতে পারে, আত্মহারা হতে পারে, ততই সে শান্তি পায়। আর যত দুঃখ সে পায় তার মূলে এই ‘আমি’। যতক্ষণ ‘আমি’ থাকে, তাকে এই সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হয়। (১-১২-৮) মুক্তি হয় না। জন্মমৃত্যুর চক্রে বারবার ঘুরপাক খেতে হয়। যখন মানুষ তার এই ‘আমি’কে সম্পূর্ণভাবে ভুলে যেতে পারে, তখনই তার সব দুঃখের শেষ হয়। ঠাকুর উপমা দিচ্ছেন বাছুরের। বলছেন: ‘আমি’ ‘আমি’ করলে যে কত দুর্গতি হয়, বাছুরের অবস্থা ভাবলে বুঝতে পারবে। বাছুর ‘হাম্ মা’, ‘হাম্ মা’ (আমি আমি) করে। তার দুর্গতি দেখ। হয়ত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাঙ্গ্‌ল টানতে হচ্ছে; রোদ নাই, বৃষ্টি নাই। হয়ত কষাই কেটে ফেললে। মাংসগুলো লোকে খাবে। ছালটা চামড়া হবে। সেই চামড়ায় জুতো এই সব তৈয়ার হবে। লোকে তার উপর পা দিয়ে চলে যাবে। তাতেও দুর্গতির শেষ হয় না। চামড়ায় ঢাক তৈয়ার হয়। আর ঢাকের কাঠি দিয়ে অনবরত চামড়ার উপর আঘাত করে। অবশেষে কিনা নাড়ীভুড়িগুলো নিয়ে তাঁত তৈয়ার করে; যখন ধুনুরীর তাঁত তৈয়ার হয় তখন ধোনবার সময় ‘তুঁহুঁ তুঁহুঁ’ বলে। (অর্থাৎ ‘তুমি তুমি’ বলে) আর ‘হাম্ মা, হাম্ মা’ বলে না। তুঁহুঁ তুঁহুঁ বলে, তবেই নিস্তার, তবেই তার মুক্তি। (১-১০-৫) ‘আমি আমি’ অনেক করে দেখা গেল যে, শুধু দুঃখ আর দুঃখ। শেষকালে পুরোপুরি ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ—তোমার হাতে সব ছেড়ে দিলাম, তুমি যা কর। এই বোধ যখন আসে তখনই আমরা শান্তি পাই। ঠাকুর বলছেন: জীবও যখন বলে, ‘হে ঈশ্বর, আমি কর্তা নই, তুমিই কর্তা—আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী’, জীবের সংসার-যন্ত্রণা শেষ হয়। তখনই জীবের মুক্তি হয়, আর এ কর্মক্ষেত্রে আসতে হয় না। (ঐ) তাই জীবনের সব কাজে, সব আচরণে এটা অভ্যাস করতে হয়, কায়মনোবাক্যে অভ্যাস করতে হয় যে, আমি কিছু না—ঈশ্বর, তিনিই সব। ‘আমি’র জায়গায় ‘তুমি’। নাহং—তুঁহুঁ।

আকর-তালিকা

 । শ্রীমাধুৰ্য-কাদম্বিনী, ৮মী বৃষ্টিঃ

 । গীতা, ৩/২৭

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ১/৬

 । বেদান্তসার, ৭৩

 । কুলার্ণবতন্ত্র, ১/১১১

 । গর্গসংহিতা, অশ্বমেধ খণ্ড, ৫০/৩৬

 । মুকুন্দমালা স্তোত্র, ১৬

 । The Practice of the Presence of God, Brother Lawrence, Allahabad Saint Paul Society, 1981, p. 64

 । Meister Eckhart, A Modern Translation by Raymond Bernard Blakney, 1941, p. 6

১০। C. W., Vol. VIII, 1977, p. 517

১১। শ্রীশ্রীসারদা দেবী, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, ১৩৮৮, পৃঃ ২২৮

১২। লীলাপ্রসঙ্গ, ২য় ভাগ, গুরুভাব—উত্তরার্ধ, ১৩৮৬, পৃঃ ১৩৯-৪৩

* ‘সংসার করতে দোষ কি?’ দ্রষ্টব্য।

* সোহহং দাসোহহমিতি বা বুদ্ধির্যস্য দৃঢ়াহমলা।

কর্মভির্ন স বধ্যেত অকর্তৃত্বাচ্চ দেববৎ॥

—যার ‘আমি ব্ৰহ্ম’ (অর্থাৎ জ্ঞানপথ) বা ‘আমি তাঁর দাস’ (অর্থাৎ ভক্তিপথ) এই বুদ্ধি দৃঢ় হয়েছে, কর্ম তাকে আবদ্ধ করতে পারে না। কারণ সে মনে করে যে, সে অকর্তা। (ভক্তিচন্দ্রিকা, ১/২/৫ সম্পাদনা: গোপীনাথ কবিরাজ, ১৯২৪)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *