কাঁকড়া-বিছা
তোমরা হয় ত কাঁকড়া-বিছা দেখিয়াছ। ইহাকে কেহ কেহ বিচ্ছুও বলে। এখানে কাঁকড়া বিছার একটা ছবি দিলাম। কি বিশ্রী প্রাণী! দেখিলেই ভয় করে। তার পরে যদি কাছে আসিয়া গায়ে হুল ফুটাইয়া দেয়, তাহা হইলে সর্ব্বনাশ! ইহাদের হুলে ভয়ানক বিষ। কিন্তু ইহারা মাকড়সাদের দলেরই প্রাণী।
বাংলাদেশের সকল জায়গায় কাঁকড়া-বিছা দেখা যায় না। শুক্নো জায়গাতেই ইহারা বাস করে, তাই বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় ইহাদের উৎপাত বেশি। কখনো কখনো খড়ের ঘরের ছাদে কাঁকড়া-বিছা দেখা যায়। কিন্তু বনে জঙ্গলে এবং ছোট ঝোপের তলাতেই ইহারা বেশি থাকে এবং বর্ষাকালে ঘরে-দুয়ারে আসিয়া উৎপাত করে।
কাঁকড়া-বিছার গায়ের রঙ্ প্রায় কালো। বাদামী রঙের বিছাও দেখা যায়। ইহারা আকারে কখনো কখনো আট-দশ ইঞ্চি পর্য্যন্তও লম্বা হয়। পতঙ্গদের মত ইহাদের শরীর কতকগুলি আংটির মত অংশ দিয়া প্রস্তুত। মাকড়সাদের দেহে যেমন মাথা ও লেজ ছাড়া আর কিছুই নাই, ইহাদের দেহ ঠিক্ সেই রকম নয়। ইহাদের দেহের পিছনকার অংশে লেজ ও পেট থাকে। মাথায় কাঁকড়ার দাড়ার মত এক জোড়া দাড়া থাকে। বেড়াইবার সময়ে ইহারা ঐ দাড়া উঁচু করিয়া এবং নখ ফাঁক করিয়া ছুটিয়া চলে। পথের মাঝে ফড়িং, গোবরে পোকা বা অন্য ছোট পোকামাকড় পাইলে বিছারা নখের ফাঁকে শিকারদের চাপিয়া ধরে এবং লেজ বাঁকাইয়া শিকারের গায়ে লেজের হুল ফুটাইয়া দেয়।
কাঁকড়া-বিছার হুলই ভয়ানক অস্ত্র। তেঁতুলের বিচির মত ছয়টি গাঁইট লইয়াই ইহাদের লেজ। লেজের শেষ গাঁইটে ধারালো হুল লাগানো থাকে এবং সেখানেই থলির মত একটি কোষে ভয়ানক বিষ জমা থাকে। বিছারা হুলের ঠোকা দিয়া শিকারের গায়ে ছিদ্র করে এবং তাহাতে বিষ ঢালিয়া দেয়। তোমরা যদি মরা কাঁকড়া-বিছা পরীক্ষা করিবার সুবিধা পাও, তবে তাহার লেজের হুলটা ভালো করিয়া দেখিয়ো। হুলটাকে ঠিক্ লোহার বড়শির মত শক্ত ও উপরদিকে বাঁকানো দেখা যায়। তাই বিছারা হুল ফুটাইবার সময়ে লেজটাকে উঁচু করিয়া উঠায় এবং লেজ দিয়া শিকারের গায়ে জোরে ছোবল মারে এবং সঙ্গে সঙ্গে গায়ে বিষ ঢালিয়া দেয়। কাজেই দেখা যাইতেছে, ইহাদের লেজই সর্ব্বস্ব। মুখে দাঁত আছে বটে, কিন্তু তাহাতে বিষ নাই।
মাকড়সাদের মতই কাঁকড়া-বিছাদের মাথার উপরে দুইটা বড় চোখ এবং কয়েকটি ছোট চোখ আছে। কিন্তু এগুলি পতঙ্গদের চোখের মত ছোট চোখের সমষ্টি নয়। কাঁকড়া-বিছাদের দৃষ্টিশক্তি খুব প্রবল বলিয়া বোধ হয় না।
দাড়া দিয়া বিছারা কখনই চলার কাজ করে না। চলিয়া বেড়াইবার জন্য মাথার অংশ হইতে ইহাদের চারি জোড়া পা আছে। এই সকল পা জোরে চালাইয়া ইহারা এমন ছুট্ দেয় যে, ইহাদিগকে চলিবার সময়ে দেখাই যায় না। ইহাদের সর্ব্বাঙ্গে মাকড়সার মত লোম আছে। কিন্তু লোমগুলি মোটা এবং গায়ে ফাঁক-ফাঁক করিয়া বসানো থাকে।
পতঙ্গদের মাথায় যে শুঁয়ো থাকে, কাঁকড়া-বিছাদের তাহা নাই। শুঁয়োর জায়গায় সরু দাঁত বসানো থাকে। ইহা দিয়াই তাহারা গোবরে-পোকা বা ফড়িং ইত্যাদির শরীর ছিঁড়িয়া ভিতরের সারবস্তু শুষিয়া খায়।
মাকড়সাদের মধ্যে যাহারা পুরুষ হইয়া জন্মে, স্ত্রীদের হাতে তাহাদিগকে অনেক কষ্ট ভোগ করিতে হয়। শেষে রাক্ষসী স্ত্রীরা নিজের স্বামীদিগকে খাইয়া ফেলে। কাঁকড়া-বিছাদের মধ্যেও সেই রকম মারামারি ঝগড়াঝাঁটি দেখা যায়। স্ত্রী-বিছারা কিছুদিন পুরুষদের সঙ্গে শান্তিতে বাস করে। কিন্তু শেষে তাহারা এমন চটিয়া যায় যে, পুরুষদের অনিষ্ট করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়ে। স্ত্রীর মেজাজ বুঝিয়া পুরুষেরা যদি এই সময়ে পলাইয়া যায়, তবেই তাহার রক্ষা পায়। নচেৎ স্ত্রী-বিছারা পুরুষদের ধরিয়া খাইয়া ফেলে।
কাঁকড়া-বিছারা ডিম প্রসব করে না। ইহাদের ডিম পেটের ভিতরেই শেষ পর্য্যন্ত থাকে এবং সেখানেই ফুটিলে বাচ্চা বাহির হয়। পতঙ্গদের বাচ্চা ডিম হইতে বাহির হইয়া যেমন নিজেরাই দেখিয়া শুনিয়া খাওয়া-দাওয়া করে, বিছার বাচ্চারা তাহা পারে না। বাচ্চা-অবস্থায় ইহারা বড়ই নিঃসহায় থাকে এবং মায়ের কাঁধে-পিঠে চাপিয়া বেড়ায়। সদ্য বাচ্চা হওয়ার পরে, যদি তোমরা কোনো বিছা পরীক্ষা কর, তবে দেখিবে, তাহার পিঠ অনেক ছোট বাচ্চাতে ভরিয়া আছে।
বিছারা প্রায় দুই সপ্তাহ ঐ-রকমে বাচ্চা পিঠে করিয়া তাহাদিগকে খাবার দেয়। ইহার পরেই বাচ্চারা সাবালক হইয়া পড়ে এবং ছোট লেজগুলিকে পিঠের উপরে উঁচু করিয়া মায়ের কোল হইতে দূরে দূরে ছিট্কাইয়া পড়ে।