কহলীল জিবরানের প্রেমের চিঠি

কহলীল জিবরানের প্রেমের চিঠি [দ্য লাভ লেটারস অব কহলীল জিবরান] 

নিউ ইয়র্ক ২ জানুয়ারি ১৯১৪ 

[প্রিয় মিস জিয়াদাহ][১]

নীরবে কয়েকটি মাস কেটে গেছে—না পেয়েছি তোমার চিঠি, না আমার চিঠির উত্তর এবং এ সময়ে আমি অনেক কিছু চিন্তা করেছি। কিন্তু আমার কখনও মনে হয়নি তুমি অসৎ। কিন্তু এখন তুমি সেই অসততা অনুভব করছ তোমার আত্মায়। এটাই শুধুমাত্র সঠিক এবং যথাযথ যে আমার উচিত তোমাকে বিশ্বাস করা, কারণ তুমি যা বলো তাই আমি বিশ্বাস করি এবং তাতে আমার আস্থা আছে। অবশ্যই তুমি গর্ব করে বলতে পারো ‘আমি অসৎ’ এবং তোমার গর্বকে তুমি ন্যায্য বলতে পারো কারণ অসততাও একটি শক্তি যা ক্ষমতা এবং প্রভাবকে দিক থেকে ভালোত্বের প্রতিপক্ষ। যাহোক তোমার অনুমতি প্রার্থনা করে বলছি, তুমি কতটুকু অসৎ তা আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়। আমি যতটুকু অসৎ তুমি তার অর্ধেকও নয়। আমি হলাম আতঙ্কের মতো অসৎ যা কিনা দোজখের ক্যারাভানে বসবাস করে। মে, আমি ব্লাক স্পিরিটের মতো অসৎ, যে দোজখের দরজা পাহারা দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তুমি তা বিশ্বাস করবে। 

কিন্তু এখনও আমি বুঝতে পারছি না কেন তুমি আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ‘অসৎ’ শব্দটি ব্যবহার করেছ। তুমি কী দয়া করে এর একটা ব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে চাঙা করবে? দয়া করে তুমি যে চিঠিগুলি লেখ আমি তার প্রত্যেকটির জবাব দিয়েছি এবং আমি নিয়মিত গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি তোমার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যা তুমি দয়া করে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলেছ : সেখানে কী আমার কোনো ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে? তোমার মানসপটে কোনো পাপকে প্রশ্রয় না দিয়ে তোমার যথাযথ শাস্তির ক্ষমতাকে আমায় হাতে-কলমে দেখিয়ে দিতে পারো? তোমার সারল্য প্রশংসিত হয়েছে এবং আমি তোমার হাইসোসট্যাসিস[২] এ বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে ভারতীয় ঈশ্বর কালীর তরবারি এবং ডায়না’র তীরগুলির স[ম্মিলনই হল গ্রিকদের ঈশ্বর উপাসনার আদর্শ। 

এখন আমরা প্রত্যেকেই বুঝে গেছি অন্যের আত্মার ভেতরে কী অসততা আছে এবং এর প্রবণতা হচ্ছে মানুষকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া। এসো আমরা আবার সেই সংলাপগুলি শুরু করি, যা আমরা দু বছর আগে শুরু করেছিলাম। 

তোমার সবকিছু কেমন আছে এবং তোমার স্বাস্থ্য? তুমি কেমন আছ? কেমন উপভোগ করছ তোমার শারীরিক বলিষ্ঠতা, লেবাননে ওরা যেমন বলেছে। গত গ্রীষ্মে কী তোমার একটা হাত গ্রন্থিচ্যুত হয়েছে অথবা তোমার মা কী ঘোড়ায় চড়া থেকে তোমাকে বিরত রেখেছে যেন সুস্থ হাতদুটি নিয়ে তুমি মিশরে ফিরতে পারো? আর এদিকে আমার স্বাস্থ্য বলতে গেলে ইতস্তত ভ্রমণরত মাতালের মতো। আমি গত গ্রীষ্ম কাটিয়েছি পাহাড়ের উচ্চতা ও সমুদ্রতীরের মাঝখানে, একবার এদিকে একবার ওদিকে এবং কাজ করতে করতে ও আমার স্বপ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নিউ ইয়র্কে ফিরেছি রোগা ও বিবর্ণ হয়ে। ঐসব অদ্ভুত স্বপ্ন আমাকে তুলে নিয়ে গেছে পাহাড়ের খুবই উঁচুতে, তারপর আবার নামিয়ে নিয়ে এনেছে উপত্যকার গভীরতায়। 

আমি খুবই খুশি হয়েছি যে তুমি আরবের শ্রেষ্ঠ সাময়িক পত্রিকা আল ফওনুন [৩] উৎকৃষ্ট বলে বিচেনা করেছ। এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী হিসেবে তিনি বেশ মিষ্টি প্রকৃতির যুবক, তাঁর চিন্তাভাবনা স্পষ্ট এবং ‘আলিফ’ ছদ্মনামে প্রকাশিত তাঁর কিছু মৌলিক কবিতা ও উপভোগ্য রচনার জন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার। এই যুবকের কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তিনি শুধু ইউরোপীয়দের সব রচনাই পড়েননি, তা যথাযথভাবে আত্মস্থ করেছেন; যেমন আমাদের বন্ধু আমিন রিহানির[৪] একটা নতুন ও দীর্ঘ উপন্যাস তিনি ধারাবাহিকভাবে ছাপতে শুরু করেন। অবশ্য উপন্যাসের অধিকাংশ অধ্যায়ই তিনি আমাকে পড়িয়েছেন এবং আমি দেখলাম সবগুলি অধ্যায়ই চমৎকার। আল-ফওনুনের সম্পাদককে জানিয়েছি যে তোমার উপর আমি একটা রচনা লিখব এবং তিনি আনন্দের সঙ্গে তা পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। 

খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে, আমি কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারি না, কিন্তু আমি গান ভালোবাসি, যেমন ভালোবাসি জীবনকে এবং আমি বিশেষভাবে সংগীতের আদর্শ ও গঠন সম্পর্কে এবং আমার জ্ঞানকে আরও গভীরতর করার জন্য এর ইতিহাস, উদ্ভব এবং এর উন্নতির বিষয়ে জানতে আগ্রহী এবং আমি যদি টিকে থাকি তাহলে এসব বিষয় নিয়ে আরবি ও ফারসি গানের মিশ্রণ সম্পর্কে একটি দীর্ঘ রচনা লিখব। তবে এসব গানের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশীয় গানও আমি একই রকম ভালোবাসি। এক সপ্তাহ ধরে একবার কী দুবার অপেরা দেখতে যাওয়া ছাড়া বাকি সময়টা শুনেছি ইউরোপীয় সংগীত, বিশেষ করে যা সিম্ফনি, সোনাটা ও কানতাতাস নামে পরিচিত—কারণ অপেরা তার সারল্য হারিয়েছে, যা আমার প্রকৃতির সঙ্গে মেলে এবং যা আমার পছন্দ ও অপছন্দের সঙ্গে একসুরে বাঁধা এবং এখন আমাকে বলতে দাও আমি কতখানি ঈর্ষান্বিত হয়েছি ‘আউদ’ (প্রাচ্যদেশীয় বীণাজাতীয় যন্ত্র)-এর প্রতি যা তুমি খুব কাছে থেকে ধরে রেখেছ এবং আমি প্রার্থনা করি আমার প্রশংসার শব্দগুলিসহ তুমি আমার নাম উচ্চারণ করতে থাক, যখন তুমি ‘নাহাত্তয়ান্দ’[৫] -এর সুর বাজাও তোমার ‘আউদ’-এর তারে। ওটা একটা সুর যা আমি ভালোবাসি এবং এই সুর ও নবী মহম্মদ[৬] সম্পর্কে কারলিলি’র ব্যাখ্যাকৃত মতামত একই বলে আমি মনে করি। 

যথেষ্ট দয়াপরবশ হয়ে একটু কী আমার কথা ভাববে, যখন তুমি স্ফিংসের রাজকীয় পরিবেশের মুখোমুখি দাঁড়াও। আমি যখন মিশর সফর করেছিলাম তখন সপ্তাহে দুবার সেখানে যেতাম এবং সোনালি বালির ওপর বসে দীর্ঘক্ষণ আমার চোখকে স্থির করে রাখতাম পিরামিড ও স্ফিংস-এর ওপর। সে সময় আমি আঠারো বছরের যুবক। শিল্পের এরকম প্রকাশের মুখোমুখি আমার হৃদয় তখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠত, যেমন ঝড়ের মুখোমুখি শিউরে উঠে নলখাগড়া। স্ফিংস আমার দিকে তাকিয়ে হাসত আর আমার হৃদয় ভরে উঠত মধুর দুঃখবোধ ও আকস্মিক তীক্ষ্ণ বেদনার আনন্দে। 

তোমার মতো আমিও ড. সুমাইয়েল’[৭]-এর একজন গুণগ্রাহী। লেবানন যে অল্প কয়েকজন লেখকের জন্ম দিয়েছে তিনিও তাদের মধ্যে একজন, যিনি নিকটপ্রাচ্যে নতুন রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটাতে পারেন এবং আমি মনে করি মিশর ও সিরিয়ার ‘ন্যায়নিষ্ঠ ও সুফিদের প্রভাবকে পালটা আক্রমণ করতে প্রাচ্যদেশে তাঁর মতো একজন মানুষের ভীষণ প্রয়োজন। 

তুমি কী খায়রুল্লাহ ইফেন্দি খায়রুল্লাহর ফরাসি গ্রন্থটি পড়েছ?’ আমি বইটি দেখিনি কিন্তু আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, এই গ্রন্থে তোমার ও আমার ওপর আলাদা অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। সুতরাং তুমি দুই কপি পেলে আমাকে এক কপি পাঠিও। ঈশ্বর তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। এখন মধ্যরাত, সুতরাং শুভরাত্রি এবং ঈশ্বর আমার জন্য তোমাকে রক্ষা করুন। 

একান্তভাবে তোমার, 
জিবরান কহলীল জিবরান 

***

[১. জিবরান এবং মে লেখালেখির মাধ্যমে অন্তরঙ্গ হওয়ার আগে জিবরান সনাতন আরবি প্রথা অনুযায়ী তাকে যে-ভাষায় সম্বোধন করতেন তা মূলত অনুবাদযোগ্য নয়। যেমন তিনি মে-কে সম্বোধন করতেন ‘হাদরাত আল-আদিবাহ আল ফাদিলা’ (আক্ষরিক অর্থ : স্বতন্ত্র ও শুদ্ধ লেখক)। সে কারণে এ রকম সম্বোধনের স্থানে ‘প্রিয় মিস জিয়াদাহ্’ বন্ধনীর ভেতরে ব্যবহার করা হয়েছে।

২. জিবরান এই ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক শব্দটি শ্লেষ হিসেবে ব্যবহার করেছেন যার অর্থ ‘ঐশ্বরিক ক্ষিপ্রতা’ অথবা মে-এর বিশেষ ঐশ্বরিক আইন। 

৩. আল ফাওনুন আরব-পৃথিবীর একটি সাময়িকপত্র, ১৯৩১ সালে নাসিব আরিদা (১৮৮৭-১৯৪৬) কর্তৃক নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া তিনি নিউইয়র্কে ‘আল রাবিতা আল কালামিয়া’-এরও প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রচনার মধ্যে বিনাইটেড স্পিরিট নামে একটি কবিতা সংগ্রহ ও উপন্যাস দিক আল-জিন আল-হোসী অন্যতম।

৪. আমিন [আল] রিহিনী (১৮৭৬-১৯৪০), একজন লেবানীয় লেখক। জন্মেছেন উত্তর-লেবাননের ফ্রেইকিতে। পরবর্তীকালে তিনি দেশত্যাগ করে নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি আরবি ও ইংরেজি দুভাষাতেই লিখতেন। তাঁর বিখ্যাত রচনা হচ্ছে মূলক আল আরব ও কালব আল লুবনান। তিনি ছিলেন জিবরান ও মে জিয়াদাহ’র বন্ধু। 

৫. আরবি সুর। 

৬. থমাস কারলিলি (১৭৯৫-১৮৮১) ছিলেন দার্শনিক ও ঐতিহাসিক এবং তিনি কেমব্রিজে ছাত্রজীবনে কখনই আরবি অধ্যায়ন করেননি, কিন্তু তার অন হিরোজ, হিরো ওরশিপ অ্যান্ড দ্য হিরোইক ইন হিস্ট্রি গ্রন্থে নবী মহম্মদের (স.) বীরত্ববাদের ভূয়সী প্রসংসা করেছেন। 

৭. ড. শিবলি সুমাইয়েল (১৮৬০-১৯১৭), একজন লেবানীয় ডাক্তার এবং লেখক। চিকিৎসা সংক্রান্ত পুরোনো গ্রন্থের বিবরণ ও ব্যাখ্যা সম্বলিত তাঁর কিছু রচনা আছে। তিনি মে-এর বন্ধু এবং তাঁর লেখার ভক্ত ছিলেন।

৮. খায়রুল্লাহ ইফেন্দি খায়রুল্লাহ (১৮২২-১৯৩০) একজন লেবানীয় লেখক যিনি প্যারিসে বসবাস করতেন এবং ফরাসি সংবাদপত্র লে টেম্পস-এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখার পরিচালক ছিলেন। তিনি ফরাসি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, নাম সিরিয়া। ]

.

নিউ ইয়র্ক ২৪ জানুয়ারি ১৯১৯ 

প্রিয় মিস জিয়াদাহ, 

তোমার সুন্দর ও চমৎকার মানসিকতা নিয়ে তুমি শান্তিতে থাকো। আজ আমি আল-মাকতাতাফ[১] এর সংখ্যাগুলো পেয়েছি, যা তুমি দয়া করে আমাকে পাঠিয়েছ এবং আমি তোমার রচনা বিশাল আনন্দ ও সীমাহীন প্রশংসার সঙ্গে একটার পর একটা পড়েছি। আমি দেখতে পেলাম তোমার রচনা সেইসব প্রবণতা ও অনুরাগের তত্ত্বাবধায়ক, যা দীর্ঘকাল ধরে আমার চিন্তাকে ঘিরে রেখেছে এবং অনুসরণ করছে আমার স্বপ্নগুলোকে। যাহোক, অন্য তত্ত্ব ও আদর্শও সেখানে রয়েছে যা তোমার মুখোমুখি আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। যদি আমি এখন কায়রোতে থাকতাম তাহলে তোমার কাছে তোমাকে দেখার ও বিস্তারিত আলোচনা করার অনুমতি চেয়ে প্রার্থনা করতাম। বিষয়গুলি যেমন ‘স্থানের মানসিকতা’, ‘মন ও হৃদয়’ এবং হেনরি বার্গসনের[২] বিভিন্ন বিষয়ে। কিন্তু কায়রো হচ্ছে সেই দূরবর্তী প্রাচ্য এবং নিউইয়র্ক হচ্ছে কায়রোর কাছে আর এক দূরবর্তী পাশ্চাত্য, সুতরাং আমার আশা ও ইচ্ছা অনুযায়ী আলোচনার কোনো পথ নেই। 

তোমার রচনা তোমাকে উৎকৃষ্ট প্রতিভাবান হিসেবে তুলে ধরেছে। এমনকি তোমার রচনা সুখপাঠ্য এবং বিষয়-নির্বাচন ও তা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে রয়েছে শুদ্ধতার ছাপ। এছাড়া এই রচনাগুলিতে পরিষ্কারভাবে তোমার ব্যক্তিগত ও গোপন অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে, আর সে-কারণেই তোমার গবেষণা আরবিভাষার উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সম্পদ। আমি মনে করি অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত বিশ্বাস সবধরনের জ্ঞান এবং রচনার চেয়ে উৎকৃষ্টতর। 

যাহোক, আমার একটা প্রশ্ন আছে, আশাকরি তুমি তা জিজ্ঞাসা করার অনুমতি দেবে। প্রশ্নটি হল : সম্ভবত সেরকম দিন কি আসতে পারে না যখন তোমার এই বিখ্যাত মেধা উৎসর্গীত হবে তোমার অন্তরাত্মার গোপনীয়তাকে ব্যাখ্যা করতে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাগুলি এবং আত্মার পবিত্র রহস্যসমূহ। এগুলি সৃষ্টিশীলতার ভান নয়, বরং সেইসব অধ্যয়নের চেয়ে অধিক স্থায়ী বা কিনা সৃষ্টিশীল। তুমি কী দেখোনি, গদ্য বা কবিতার ওপর থিসিস রচনার চেয়ে গদ্য বা কবিতা লেখা অনেক উত্তম। উদাহরণ হিসেবে বলি, তোমার একজন ভক্ত হিসেবে মিশরীয় চিত্রকলার ইতিহাস এবং যুগ থেকে যুগে ও সাম্রাজ্য থেকে সাম্রাজ্যে এর উন্নয়ন সম্পর্কে তোমার লেখা পড়ার চেয়ে আমি বরং স্ফিংসের হাসির ওপর লেখা তোমার একটি কবিতা পড়ব। কারণ স্ফিংসের হাসির ওপর লেখা কবিতাতে তুমি আমাকে যা উপহার দেবে তার কিছুটা ব্যক্তিগত, অথচ মিশরীয় চিত্রকলার ইতিহাসের ওপর লেখা থিসিসের মাধ্যমে তুমি আমাকে পরিচালিত করবে সর্বজনীনতার দিকে এবং তা পুরোপুরিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক। 

যাহোক, মিশরীয় চিত্রকলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত ও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলি প্রদর্শন করা তোমার ক্ষমতা অনুযায়ী অসাধ্য নয়, তা সত্ত্বেও আমি অনুভব করি যে চিত্রকলা হচ্ছে একধরনের অভিব্যক্তি যা একজনের আত্মার ভেতরে ভাসে, চলাফেরা করে এবং হয়ে ওঠে। চিত্রকলা তোমার বিরল মেধার কাছে গবেষণার চেয়ে অধিক শোভন ও আনন্দদায়ক—যার অভিব্যক্তি সমাজের নির্যাসে ভাসে, চলাফেরা করে এবং হয়ে ওঠে।

আমি যা বলেছি তা কিছুই নয়, তবে চিত্রকলার নামে একটা আবেদন মাত্র। আমি তোমার কাছে আবেদন করি, কারণ আমি তোমার সেইসব মোহময় জগৎকে আক্রমণ করতে চাই যেখানে তুমি খুঁজে পাবে সাফো, এলিজাবেথ ব্রাউনিং[৩], অলিভ স্কেইনার[৪] এবং তোমার অন্যান্য ভগিনীদের—পৃথিবী ও স্বর্গের মাঝখানে হাতির দাঁত ও সোনার তৈরি মই রয়েছে যাদের। 

দয়া করে নিশ্চিত করো যে, তুমি আমার প্রশংসা গ্রহণ করেছ এবং দয়া করে আমার গভীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করো। ঈশ্বর তোমাকে আমার জন্য রক্ষা করুন। 

একান্তই তোমার 

জিবরান কহলীল জিবরান 

***

১. আল-মুকতাতাফ একটি বিখ্যাত আরবি সাময়িকপত্র। ফারিস নাইমার, শাহীন মাকারিয়াস এবং লেবানীয় লেখক ও বিজ্ঞানী ড. ইয়াকুব সাররউফ (১৮৫৩-১৯২৭) কর্তৃক পত্রিকাটি ১৮৭৬ সালে প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পত্রিকা আরবের পাঠকের কাছে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের পরিচিত করে তোলে। এই সাময়িকপত্র ১৮৮৫ সালে কায়রোতে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৫২ সালে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

২. হেনরি বার্গসন (১৯৫৯-১৯৪১) একজন ফরাসি দার্শনিক। ১৯২৭ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান—যিনি বিপক্ষীয় বস্তুবাদী দলকে আক্রমণ করতে আধ্যাত্মবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

৩. এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং (১৮০৬-১৮৬১) একজন কবি। রবার্ট ব্রাউনিং তার কবিতা পড়ে, দেখা না-হওয়ার আগেই তার প্রেমে পড়েন এবং অবশেষে তাদের বিয়ে হয়। 

৪. অলিভ স্কেইনার (১৮৫৫-১৯২০) ছিলেন বৃটেনের একজন নারীবাদী লেখক। রাজনীতি ও নারীমুক্তির ওপর তাঁর রচনা আছে। তিনি তাঁর লেখায় ‘রালফ আইরন’ এই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। 

.

নিউ ইয়র্ক ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ 

প্রিয় মিস মে, 

তোমার চিঠি আমাকে হাজার বসন্ত ও হাজার শরতের স্মৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেল এবং আমি দেখতে ফেলাম নিজেকে আর একবার সেইসব প্রেতাত্মার মুখোমুখি যারা অদৃশ্য এবং দ্রুত নীরবতার ভেতরে আত্মগোপন করে—যেমন আগ্নেয়গিরির লাভা নির্গত হয়েছে ইউরোপে[১]—কী দীর্ঘ আর গভীর এই নীরবতা 

আমার প্রিয় বন্ধু, তুমি জানো যে, আমাদের অধিক বিঘ্নিত কথোপকথনের ভেতরে আমি সান্ত্বনা, সঙ্গ এবং স্বস্তি খুঁজতে অভ্যস্ত এবং তুমি জানো আমি প্রায়ই নিজেকে বলি : ‘সেখানে, সেই দূরবর্তী প্রাচ্যে একজন তরুণী, যে অন্য তরুণীদের মতো নয়, যে মন্দিরে প্রবেশ করেছে তার জন্মেরও আগে, দাঁড়িয়ে আছে পবিত্রতার পবিত্রতমতার ভেতরে এবং জানতে এসেছে উচ্চতম ও মহত্ত্বম শ্রেণীর গোপনতা, সূর্যোদয়ের দানব যাকে পাহারা দেয়। সে আমার দেশ ও মানুষকে তার দেশ ও মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তুমি কী জানো আমি আমার কল্পনার কর্ণকুহরে ফিসফিস করে এই কথা বলতে অভ্যস্ত-আমি তোমার চিঠি পেয়েছিলাম। যদি তুমি তা জানো তাহলে কখনই তুমি চিঠি লেখা বন্ধ করবে না। অন্যদিকে, তুমি হয়তো জানো না, সে-কারণেই চিঠি লেখা বন্ধ করেছ। একটা সিদ্ধান্ত সর্বাংশেই বিচক্ষণতা ও উত্তম রায়বিহীন হতে পারে না। 

স্বর্গ জানে স্ফিংসের ওপর লেখার বিষয়ে আমি কোনো ঝামেলা করিনি। আল ফওনুন-এর মালিকের কী অবিশ্রান্ত চাপ—ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন। কবির কাছ থেকে লেখা আদায় করা আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ; বিশেষ করে সেইসব ছোট ছোট দল, যারা এর প্রেরণার অনুসন্ধান করছে জীবন যা পরামর্শ দেয় তার কাছ থেকে এবং তুমিও সেই দলের। তারপরও আমি জানি চিত্রকলা চাহিদা তৈরি করে, যদিও চাহিদা চিত্রকলা তৈরি করতে পারে না এবং সেখানে কিছু বিষয়-সংক্রান্ত পরামর্শের ভান থাকে, শিল্পীর বিষয় হিসেবে যা স্বকীয় উৎকর্ষতা হ্রাস করে। আর তুমি লিখেছিলে ‘এ মুহূর্তে স্ফিংসের ওপর কোনো রচনা লেখার উৎসাহ বোধ করছি না।’ আমি উল্লসিত হয়েছি : বাহ! মে বেশ প্রকৃত শিল্পীর মেজাজ রপ্ত করেছে। মূলকথা হল আমি তোমাকে উৎসাহিত করব স্ফিংসের হাসির ওপর একটা কবিতা লিখতে, তারপর মে-এর হাসির ওপর আমি একটি কবিতা লিখব এবং তার হাসির ছবি যদি পাই তবে আজই লিখব। কিন্তু অবশ্যই আমি মে-এর হাসি দেখতে মিশর সফর করব। একজন নারীর হাসি সম্পর্কে একজন কবি কী বলতে পারে? মোনালিসার বিষয় সম্পর্কে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কোনো শেষ কথা কী ছিল না? তা সত্ত্বেও লেবানীয় তরুণীর হাসিতে একটা গোপনীয়তা আছে, যা অন্য কেউই নয় শুধুমাত্র একজন লেবানীয়ই তা উপলব্ধি ও বর্ণনা করতে সক্ষম অথবা এটা একজন নারী— হোক সে লেবানীয় বা ইতালীয়, যে ওষ্ঠের দ্বারা তৈরি সেই সুকুমার প্রেতের পেছনে অনন্তকালের গোপনীয়তাকে লুকানোর জন্য হাসছে। 

দ্য ম্যাডম্যান[২]—দ্য ম্যাডম্যান সম্পর্কে আমার কী বলার আছে? তুমি বলো যে, ওখানে একটা নিষ্ঠুরতার উপাদান আছে, এমনকি একটা অন্ধকার ক্যারাভানের উপাদান। কিন্তু আগে আমি কখনই এ-ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হইনি, যদিও আমি আমেরিকা ও ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত সেইসব সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রচুর পড়েছি, সেখানে এই ক্ষুদ্র বইটি সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। অদ্ভুত বিষয় হল পাশ্চাত্যের অধিকাংশ লেখকই যে অংশদুটোর প্রশংসা করেছে তা হচ্ছে ‘মাই ফ্রেন্ড’ এবং ‘দ্য স্লিপ- ওয়াকারস’। কিন্তু তুমি আমার বন্ধু, তুমি এই লেখায় নিষ্ঠুরতা দেখতে পেয়েছে? কী লাভ যখন একজন মানুষ সারা পৃথিবীর অনুমোদন পায় এবং মে-এর অনুমোদন হারায়? পাশ্চাত্যবাসীরা ম্যাডম্যান ও তার স্বপ্নের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই আনন্দিত। কারণ তারা নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে বিরক্ত। আর এই বিরক্তির জন্য অচেনা ও অদ্ভুত বিষয়ের প্রতি তাদের দুর্বলতা, বিশেষভাবে যদি তা হয় প্রাচ্যদেশীয় পোশাকে সজ্জিত। কিন্তু ঐসব নীতিকথামূলক গল্প ও গদ্যকবিতাগুলি আল ফওনুন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তারা এমন একজন লেখককে দিয়ে তা অনুবাদ করিয়েছিলেন ইংরেজিভাষায় সূক্ষ্ম জ্ঞানের চেয়ে আমার প্রতি যার ভালোবাসা প্রবল। 

ম্যাডম্যান সম্পর্কে তোমার মন্তব্যের ভেতরে ব্যবহৃত ‘বিরক্তি’ শব্দটি আমি লাল কালি দিয়ে বৃত্তাবদ্ধ করেছি, কারণ তুমি যদি আমার ‘দ্য স্লিপ ওয়াকারস’ গল্পটি এবং ‘ইয়েসটারডে’ ও ‘টুমোরো -এর মা এবং মেয়ের বক্তব্যে আরোপিত গুণ বা ধর্ম সম্পর্কে মনোযোগী হতে তাহলে ‘বিরক্তি’ শব্দের পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করতে—নয় কি? আমার আত্মার ক্যারাভান (একসঙ্গে গমনকারী মরুযাত্রী দল) সম্পর্কে কী বলব আমি? ঐ ক্যারাভান তোমাকে আতঙ্কিত করে, সুতরাং সেখানে তোমাকে আমি নিতে চাই না, বিশেষ করে যখন আমি ভ্রমণরত মানুষের মতো সারিবদ্ধ ফুলের বাগান এবং অতিরিক্ত বেড়ে ওঠা বনভূমিতে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়েছি। আমি আমার আত্মার ক্যারাভানে তখনই ফিরে যাই, যখন আমার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেবার মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাই না এবং যাদেরকে আমি ভালোবাসি তাদের কেউ কেউ এই ক্যারাভানে প্রবেশ করলে কিছুই খুঁজে পাবে না, শুধু দেখতে পাবে একজন মানুষ হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে প্রার্থনা করছে। দ্য ম্যাডম্যান-এর তিনটি ইলাসট্রেশন (চিত্র বা নকশা) তোমার অনুমোদন পাওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। এটা নির্দেশ করে যে, তোমার দুই চোখের মাঝখানে একটা তৃতীয় 

(অলৌকিক দৃষ্টিসম্পন্ন) চোখ আছে। আমি সবসময়ই জানি তোমার কানের পেছনেও একটা কান আছে, যা নীরবতার মতো সেইসব চমৎকার শব্দ শুনতে পায়, যেসব শব্দ ঠোঁট বা জিভ তৈরি করে না, কিন্তু তা সেই অজানা ও দূরবর্তী পৃথিবীর যা নির্গত হয় পেছনের জিভ বা ঠোঁট থেকে—আনন্দ, বেদনা ও আকাঙ্ক্ষার মধুর নিঃসঙ্গতার শব্দ। যখন আমি ঘোষণা করি; যারা আমাদের বোঝে এবং কিছু আয়ত্ত্ব করে আমাদের কাছ থেকে, যা তুমি জিজ্ঞাসা করো, আমি কাউকে পছন্দ করি কী না, যে আমাকে বোঝে? না না, আমি চাই না কোনো মানুষ আমাকে বুঝুক, যদি তার বোঝাবুঝি সেইভাবে উত্তরাধিকার দান করে আমার আধ্যাত্মিক দাসত্বকে। অনেক মানুষই রয়েছে যারা কল্পনা করে যে তারা আমাদের বোঝে, কারণ একজীবনে যে অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে তারা তার সঙ্গে আমাদের বাইরের আচরণে সাদৃশ্য খুঁজে পায়। 

এটাই যথেষ্ট নয় (তাদের জন্য) দাবি করার জন্য যে আমাদের গোপনীয়তা তারা জানে—যে গোপনীয়তা রয়েছে আমাদের ভেতরে এবং আমরা নিজেরাই তা জানি না—কিন্তু তারা অবশ্যই আমাদেরকে সংখ্যায় চিহ্নিত করে, লেবেল এঁটে দেয় এবং বিভিন্ন স্তরে আমাদেরকে তুলে রাখে, যা গঠন করে তাদর চিন্তা ও ধারণা, যেমন একজন কেমিস্ট ওষুধ ও পাউডারভর্তি বোতলগুলি নিয়ে যা করে। একজন লেখক দাবি করে যে, তোমার কিছু কিছু লেখায় আমাকে অনুকরণের ছাপ রয়েছে—সে কী সেইসব লেখকদের একজন নয় যারা দাবি করে আমাদের গোপনীয়তা জানে এবং বোঝে? যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে তাকে বোঝানো অসম্ভব যে, স্বাধীনতা হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যেখানে সব আত্মাই সামনের দিকে এগোয় এবং ওক ও উইলো একে অন্যের ছায়ায় বাড়ে না। 

চিঠির শুরুতে যা বলতে চেয়েছিলাম, সে-সম্পর্কে একটা শব্দও না বলে এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, আমাদের একজন কী এই মৃদু ধোঁয়াশাকে ধাতু, পাথর বা কাঠের মূর্তি অথবা কোনো ভাস্কর্যের আদলে রূপান্তরিত করতে সক্ষম? কিন্তু লেবানীয় তরুণীটি যে কিনা যাবতীয় শব্দের উৎসের বাইরের শব্দও শুনতে পায়, বোধশক্তি দ্বারা উভয় আদলই সেই ধোঁয়াশার ভেতরেও সে উপলব্ধি করবে। 

তোমার চমৎকার এবং মহৎ ও পবিত্র হৃদয় নিয়ে তুমি শান্তিতে থাকো। ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। 

একান্তই তোমার 

জিবরান কহলীল জিবরান 

***

১. তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। 

২. দ্য ম্যাডম্যান (১৯১৮) হচ্ছে কহলীল জিবরানের ইংরেজিতে লেখা প্ৰথম গ্ৰন্থ। 

.

নিউ ইয়র্ক ১০ মে ১৯১৯ 

প্রিয় মিস মে, 

দ্য প্রসেশনস*-এর প্রথম যে-কপিটি আমি পেয়েছি তা চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত করলাম। এখানে তুমি দেখতে পাবে একটা স্বপ্ন, যার আদর্শ ছিল অর্ধেক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এবং অর্ধেক সুস্পষ্ট। এর কিছু যদি তোমার পছন্দ হয় তাহলে তোমার অনুমোদন রূপ নেবে লাবণ্যময় বাস্তবতায়; আর যদি অনুমোদন না পায়, তাহলে ধোঁয়াশার ভেতরে তার সমগ্রতা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। 

তোমার সত্তাকে হাজার শুভেচ্ছা ও অভিবাদন এবং ঈশ্বর তোমাকে পাহারা দিন ও রক্ষা করুন। 

একান্তই তোমার 

জিবরান কহলীল জিবরান 

***

* আল মাওয়াকিব (দ্য প্রসেশনস) হচ্ছে জীবরানের একটি কবিতা। এই কবিতায় তিনি মিত্রাক্ষার ব্যবহার করেছেন, ছন্দের নিয়ম মেনেছেন। প্রতীকী চিত্রকলার সাহায্যে এই কবিতাকে তিনি সজ্জিত করেন, যেখানে দার্শনিক ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত এই কবিতার ওপর মে জিয়াদাহ মিশরীয় পত্রিকা আল-হিলাল-এ সমালোচনা লেখেন (সংখ্যা ২৭, পৃষ্ঠা ৮৪৭-৪৯)। 

.

নিউ ইয়র্ক ১১ জুন ১৯১৯ 

প্রিয় মিস মে, 

দীর্ঘ ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে তোমার তিনটা চিঠি এবং আল-মাহরসাহ[১] পত্রিকায় প্রকাশিত তোমার চমৎকার লেখাটি পেলাম। আমার কাজের লোকের কাছে জানলাম এই চিঠিগুলি (যা আমার কাছে সম্পদের সম্পদ-কোষাধ্যক্ষের কোষাগার) একসঙ্গে এসেছে চারদিন আগে। এতে মনে হয়, মিশরীয় পোস্টঅফিস সম্প্রতি চিঠি বিলি করা বন্ধ করেছে,বাইরে থেকে আসা চিঠিগুলো বিলি না করে ফেলে রাখছে তারা। 

টেবিলে আমার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকা অন্যান্য চিঠিগুলোর দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সারাদিন কাটালাম তোমার কথা শুনে, যে উচ্চারণ মধুরতা এবং কঠোর তিরস্কারের ভেতরে পর্যায়ক্রমিকভাবে আবর্তিত হয়। ‘কঠোর তিরস্কার’ এজন্যে বলছি যে তোমার দ্বিতীয় চিঠিতে কিছু পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করেছি যেখানে আমার অনুমোদন ছিল আমার সুখী হৃদয়কে বিষণ্ণ করে তোলার। কিন্তু কীভাবে আমি নিজেকে অন্য দিক থেকে আসা মেঘমুক্ত ও তারাচ্ছন্ন আকাশের আপাতদৃশ্যমান মেঘের ওপর বসবাস করতে দিই এবং কীভাবে আমার চোখকে ফুল ফুটে থাকা গাছের ওপর থেকে সরিয়ে তারই শাখার ক্ষুদ্রতম ছায়ার দিকে তাকাতে দিতে পারি এবং আমি কীভাবে মহামূল্যবান পাথরে ভর্তি সুগন্ধি হাতের কোমল চুরিকাঘাতকে প্রতিবাদ করতে পারি?

আমাদের কথোপকথন— পাঁচ বছরের নীরবতা থেকে যাকে আমরা মুক্তি দিয়েছি তা কখনই দোষারোপ বা পাল্টা অভিযোগে পর্যবসিত হতে পারে না। সে কারণে তুমি যা বলো তাই আমি মেনে নিই এই বিশ্বাসে—যে সাত হাজার মাইল দূরত্ব আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে তাতে আর নতুন করে এক ইঞ্চি দূরত্বও যোগ হবে না। যদিও ঐ দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। কোন্ সেই ঈশ্বর ঝোঁকের বশে আমাদের ভেতরে সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সঞ্চার করেছেন, সেই সুন্দরের জন্য আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা তার উৎসই বা কী এবং যার জন্য আমরা তৃষ্ণার্ত তা হচ্ছে অন্তহীনতা। বন্ধু, আজকাল ব্যথা, বিভ্রান্তি, কাঠিন্য এবং বাধার যথেষ্ট সুন্দর পন্থা রয়েছে আমার মত হচ্ছে, একটি ধারণা একটি চূড়ান্ত অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে এবং উপাদানিকতা হচ্ছে একটি গ্রন্থের একটি শব্দ অথবা বাক্যবন্ধ অথবা একটি চিঠিতে একটা পর্যবেক্ষণকে তৈরি করার কার্যকারিতা যা অতিক্রমযোগ্য নয়। সুতরাং এসো আমাদের পার্থক্যগুলো একপাশে সরিয়ে রাখি—যার অধিকাংশই হচ্ছে মৌখিক—এসো আমরা সেগুলি একটি মজবুত সোনার বাক্সের মধ্যে জমা রাখি এবং তা ছুড়ে ফেলি হাসির সমুদ্রে। 

মে, কী মিষ্টি এক আনন্দদায়ক তোমার চিঠিগুলো। ওরা অমৃতের নদীর মতো পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসে এবং গান গাইতে গাইতে চলে যায় আমার স্বপ্নের উপত্যাকার ভেতর দিয়ে। অবশ্য তারা অফিসের বীণার মতো, যা সেইসব বিষয়কে আকর্ষণ করে যেগুলি দূরের এবং অগ্রবর্তী বিষয়, যেগুলি কাছের এবং এর মোহিত করা প্রতিধ্বনি পাথরকে উজ্জ্বল বাতিতে পরিণত করে, আর বৃক্ষশাখা নাড়ায় ডালপালা। যেদিন তোমার একটা চিঠি আসে সেদিন পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করার আনন্দ অনুভব করি, সুতরাং সেখানে একদিন একবারে তিনখানা চিঠি—কী বলব তোমাকে বলো। অবশ্য এরকম দিনে সুউচ্চ মিনারের শহর ইরাম[২]-এর রাস্তায় যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে ও আনন্দে ভেসে বেড়ানোর পথকে আমি পরিত্যাগ করি। 

কীভাবে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিই এবং কীভাবে আমাদের কথোপকথন চালাই, যখন আমার হৃদয়জুড়ে আছে এমন কিছু যা কালিতে লেখা সম্ভব নয়, যদিও আমাদের কথোপকথন অবশ্যই চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু তুমি কী বুঝতে পারো কী কী না-বলার রয়ে গেছে? 

তুমি প্রথম চিঠিতে বলেছ যে, আমি যদি আমেরিকায় থাকতাম তাহলে তোমার স্টুডিওতে যেতাম। 

আমার স্টুডিও হচ্ছে আমার মন্দির বন্ধু, ওটা আমার জাদুঘর, আমার স্বর্গ এবং আমার নরক। এটা একটা অরণ্য যেখানে জীবন জীবনকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকে এবং আমার সঙ্গে এক মরুভূমি এর অস্পষ্টতার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে, কোনোকিছুই দেখছে না, কিন্তু দেখছে বালির সমুদ্র এবং একটি ইথারের (আলোকতরঙ্গ প্রেরণের কল্পিত মাধ্যম) সমুদ্র। প্রিয় বন্ধু, আমার এমন একটা ঘর যার দেয়াল এবং ছাদ নেই। এই স্টুডিওতে অনেক কিছুই রেখেছি যা আমি সযত্নে লালন করি। আমি (নির্দিষ্টভাবে) ভালোবাসি প্রাচীন বস্তুসমূহ। এই স্টুডিওর এক কোনায় অতীত যুগের সামান্য কিছু বিরল ও মূল্যবান জিনিসের সংগ্রহ রয়েছে, যেমন মিশর, গ্রিস এবং রোমের কিছু মূর্তি এবং কিছু শ্লেটপাথর রয়েছে। এছাড়া আরও রয়েছে ফিনিসীয় গ্লাস, পার্সিয়ান মৃৎশিল্প, প্রাচীন কিছু গ্রন্থ, ফরাসি এবং ইতালীয় কিছু পেন্টিং এবং কিছু বাদ্যযন্ত্র—যা তাদের নীরবতার ভেতরেও কথা বলে। কিন্তু আমাকে অবশ্যই একটা কালোপাথরের ক্যালডীয় মূর্তি সংগ্রহ করতে হবে। ক্যালডীয়দের সবকিছুর জন্যই আমার বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে-তাদের পুরাণ কাহিনী, কবিতা, তাদের প্রার্থনা, তাদের জ্যামিতি, এমনকি সময়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব যা তারা চিত্রকলা ও হস্তশিল্পের পেছনে ফেলে এসেছে। এইসব নিশ্চল দূরত্ব ও রহস্যময় স্মৃতি আমার ভেতরে আমাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চলে যাওয়া দিনগুলোর কাছে এবং অনুমতি দিচ্ছে ভবিষ্যতের জানালার ভেতর দিয়ে অতীতকে দেখতে। আমি প্রাচীন জিনিস ভালোবাসি এবং তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে, কারণ তারা হচ্ছে মানুষের চিন্তার ফল (অথবা ফসল), যারা হাজার পদাঘাতের শোভাযাত্রায় কুচকাওয়াজ করছে অন্ধকারের বাইরে এবং আলোর ভেতরে—সেই অন্তহীন ভাবনা, যা কিনা ছায়াপথ ধরে উদিত হওয়ার জন্য আমাকে ডুবিয়ে দেয় সমুদ্রের গভীর তলদেশে। 

যেমন তোমার বক্তব্য, ‘কত সুখী তুমি, যে নিজের শিল্পের ভেতরে পরিতৃপ্তি খুঁজে পাও’–একথা আমাকে দীর্ঘ সময় ভাবিয়েছে। না মে, আমি সুখীও নই, তৃপ্তিও খুঁজে পাই না। আমার ভেতরে কিছু আছে যা কখনই তৃপ্ত হতে পারে না, কিন্তু লালসার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। কিছু একটা আছে যা কখনই সুখী হতে পারে না, কিন্তু তা কৃপণতাও নয়। আমার গভীরে রয়েছে ক্রমাগত ধুক্‌ধুকানি ও এক অবিরাম যন্ত্রণা এবং কোনোটাই আমার পরিবর্তন করার কোনো ইচ্ছে নেই—এরকম দুরবস্থায় থাকা কোনো মানুষ সুখ কী তা জানে না এবং স্বীকৃতি দিতে পারে না পরিতৃপ্তিকে, কিন্তু সে কোনো অভিযোগ করে না, কারণ অভিযোগের ভেতরে একধরনের আয়েশ আছে এবং তা সীমা অতিক্রম করে থাকে। 

তুমি কী তোমার এই বিশাল মেধা নিয়ে সুখী এবং পরিতৃপ্ত? আমাকে বলো মে, তুমি কী সুখী এবং তৃপ্ত? আমি প্রায় তোমার ফিফিসানি শুনতে পাচ্ছি : ‘না সুখীও নই, পরিতৃপ্ত নই।’ পরিতৃপ্তি হচ্ছে সন্তুষ্টি, আর সন্তুষ্টি হচ্ছে সীমাবদ্ধ অথচ তুমি সীমাবদ্ধ নও। সুখী হওয়ার জন্য এরকম সীমাবদ্ধতা আসে যখন কেউ একজন জীবনের মদ্য পান করে মাতাল, কিন্তু যার কাপ সাত হাজার লীগ গভীর এবং হাজার লীগ প্রশস্ত, সে কখনও জানে না সুখ কী, যদি না জীবন তার কাপে অন্তহীনতা হয়ে ঝরে পড়ে। এটা কী তোমার নিজস্ব কাপ নয় মে, হাজারে একটি এবং এক লীগ গভীর? 

আমার মনের অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে কী বলব? দু’এক বছর আগেও আমার জীবন সুখ ও শান্তিহীন ছিল না—কিন্তু আজ প্রশান্তি রূপান্তরিত হয়েছ গোলমালে এবং সুখ রূপান্তরিত হয়েছে বিবাদে। লোকজন আমার দিন ও রাত্রিকে গোগ্রাসে গিলে ফেলছে এবং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও নম্রতা দিয়ে প্লাবিত করছে আমার স্বপ্নকে। অধিকাংশ সময়ই আমি এই শহর থেকে পালিয়ে গেছি, যা আমাকে নিয়ে গেছে দূরের গন্তব্যে অর্থাৎ আমি আমার আত্মাকে চড়িয়ে দিতে পারি জনগণের কাঁধে এবং আমার আত্মার উপর প্রেতাত্মাকে। আমেরিকানরা হচ্ছে পরাক্রমশালী, তারা ক্লান্তিহীন, অনড়, নীরবচ্ছিন্ন, নিদ্রাহীন, এবং স্বপ্নহীন। যদি তারা কাউকে ঘৃণা করে তবে তাকে খুন করে উদাসীনভাবে, আর যদি কাউকে ভালোবাসে তাহলে দয়া করে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তাই নিউইয়র্কে কাউকে বসবাস করতে হলে তার উচিত একটা ধারালো তরবারি সঙ্গে রাখা কিন্তু মধুভর্তি তরবারির কোষে রাখা তরবারি তাকেই শাস্তি দেয় যে সময়কে খুন করতে পছন্দ করে এবং সে-ই মধু থেকে তুষ্ঠি লাভ করে যে ক্ষুধার্ত। 

সেই দিন আসবে যখন আমি পূবের দিকে পালাব। মাতৃভূমির জন্য আমার আকাঙ্ক্ষা আমাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে এবং এটা হয়েছিল আমার চারপাশের খাঁচার জন্য নয়, সেই বাধাগুলি যা আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি। কিন্তু কোন্ মানুষটি পাথর নির্মিত সেই বাড়ি পরিত্যাগ করতে সক্ষম, যেখানে সে জীবন কাটিয়েছে, নিজেকে টুকরো টুকরো করে ভেঙেচুরে, এমনকি ঐ বাড়িটাই ছিল তার কারাগার, কারণ একদিনের জন্যও ঐ বাড়ি পরিত্যাগ করতে সে না ছিল সক্ষম না ছিল ইচ্ছুক। 

প্রিয় বন্ধু, নিজের কথা তোমাকে শুনিয়ে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা করো এবং বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ না করে অর্জনের জন্য আমাদের সংগ্রাম করা উচিত। দ্য প্রোসেশনস সম্পর্কে তোমার অনুমোদন কবিতাটিকে আমার কাছে আরও প্রিয়তর করে তুলেছে। তুমি ঘোষণা করেছ যে, পদ্যটি তোমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি তোমার কাছে এতই কৃতজ্ঞ যে, বিনয়ের সঙ্গে মাথা নত করছি। যাহোক আমি বিশ্বাস করতে চাই যে তোমার কবিতা মনে রাখার ক্ষমতা প্রশংসাযোগ্য যা কিনা আমার কাছে অধিক আনন্দদায়ক ও মহৎ- দ্য প্রোসেশনস-এ আমি যা লিখেছি তার চেয়ে অথবা এখন যা লিখছি। যেমন বইয়ের ড্রইংগুলি সম্পর্কে তুমি বলেছ : ‘তুমি শিল্পী, বিশ্বাস স্থাপন করার শক্তির সাহায্যে এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছ, যে ক্ষমতা অন্তরীক্ষের ঈশ্বর তোমাকে দিয়েছেন এবং আমরা, মানে দর্শকরা যখন এরকম বিষয়ের মুখোমুখি হই এবং বুঝতে না-পারার কারণে কিছুই পাই না—পরিণতিতে আমরা হই দুর্দশাগ্রস্ত।’ 

এ-ধরনের কথা আমি মেনে নিতে পারি না এবং আমি এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছি (আমি প্রায়ই এমন বিদ্রোহী হয়েছি)। তুমি আমাদের একজন মে, তুমি শিল্পের পুত্রকন্যাদের ভেতরে আছ, যেমন গোলাপ পাতার কুয়াশার ভেতরে থাকে গোলাপ। দ্য ম্যাডম্যানের ছবিগুলো সম্পর্কে আল-মাহরউসাহ পত্রিকায় প্রকাশিত রচনায় তোমার গভীর শৈল্পিক ধারণার প্রমাণ মেলে, যা তোমার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে এবং তোমার সমালোচনার ক্ষমতা তোমাকে সেইসব পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিয়েছে যা খুব কম লোকই পারে। 

এটা কোনো অতিকথন নয় যে : ‘তুমিই প্রথম প্রাচ্যদেশীয় বালিকা, প্লেয়াডেস[৩] যেখানে বসবাস করে এরকম একটা বনের ভেতর দিয়ে হাঁটো, দৃঢ়পায়ে মাথা উঁচু করে এবং হাসি দেখে মনে হয় এটা যেন সেই বালিকার পিতার বাড়ি।’ আমাকে বলো কীভাবে সবকিছু তুমি জেনে এসেছ, কোথা থেকে আহরণ করেছ ধনাগার যা তোমার ভেতরে লুকানো আছে এবং লেবাননে আসার আগে তোমার আত্মা কোন্ যুগে বসবাস করেছে। প্রতিভার ভেতরে থাকে একটা রহস্য যা কিনা জীবনের রহস্যের চেয়েও অধিকতর গভীর। 

পাশ্চাত্যের লোকেরা আমার সম্পর্কে যা বলে তা শুনতে তুমি পছন্দ করবে। তোমার দেশপ্রেম ও তোমার আগ্রহের জন্য তোমাকে সহস্র ধন্যবাদ। ওরা বলে আমার বিষয়বস্তু বিশাল, কিন্তু ওরা যা বলে তা অতিরঞ্জন এবং তাদের মতামত ব্যাখ্যা করতে তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তারা আমাকে খরগোশ ভাবার চেয়ে উট ভাবতে পছন্দ করে এবং ঈশ্বর জানেন প্রিয় বন্ধু, আমার হৃদয়ে বেদনা সঞ্চারিত না হলে এ-ধরনের উচ্চপ্রশংসা আমি কখনই পড়ি না। অনুমোদন হচ্ছে একধরনের দায়িত্ব যা চালাকি করে অন্যেরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় আমাদের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হতে। যাহোক আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, যদিও ভারী বোঝার কারণে আমাদের পিঠটা বাঁকা হয়ে আছে এবং দুর্বলতা থেকেই আমাদেরকে তুলে আনতে হবে শক্তি। 

আমি তোমাকে আলাদা মোড়কে কিছু সাময়িকপত্র এবং সংবাদপত্রের কিছু কাটিং পাঠাচ্ছি এবং তুমি দেখতে পাবে তাদের আত্মার প্রেতাত্মাকে নিয়ে তারা বিরক্ত হয়ে গেছে এবং এসব নিয়ে তারা খুবই ক্লান্ত, সুতরাং তারা এখন অদ্ভুত এবং অপরিচিতের পেছনে লেগে থাকে, বিশেষ করে প্রাচ্যদেশীয় বিষয় সম্পর্কে। এথেন্সের মানুষও তাদের স্বর্ণযুগের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যাবার পর এরকম ছিল। 

প্রায় এক মাসেরও বেশি হল দ্য ম্যাডম্যান সম্পর্কে কিছু কাটিং-এর সংগ্রহ পাঠিয়েছি জনাব এমিল জেদানকে[৪] –সেও তোমার একজন বন্ধু। 

আমি প্রশংসা করি এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই তুমি সমস্যাগুলি অতিক্রম করতে পেরেছ। আমি বিক্ষোভের খবরগুলি পড়তাম এবং অস্থিরতা আমাকে সতর্ক করে তুলত, এই দুই অবস্থার যে-কোনো একটির ভেতরে আমি নিজেকে শোনাতাম শেক্সপিয়রের শব্দগুলি : 

আমাদের লোককে ভয় পেয়ো না 
ওদের ভেতরে রয়েছে সেরকম পবিত্ৰতা, যা 
একজন রাজাকে আড়াল করার কাজ সম্পাদন করে।
সেই পবিত্রতা রাজদ্রোহ করতে পারে, কিন্তু তা 
উঁকি দিয়ে দেখবে নিজের ইচ্ছাশক্তির ভেতরের মৃদু ভণিতা। [৫]

মে, তুমি তাদের ভেতর আছ যারা সুরক্ষিত এবং তোমার আত্মার ভেতরে থাকে একজন দেবদূত যাকে সবগুলি দানব থেকে রক্ষা করেন ঈশ্বর। 

তুমি আরও জানতে চেয়েছ পৃথিবীর এই অংশে তোমার কোনো বন্ধু আছে কী না? 

জীবনের বহনকৃত শ্বাসরুদ্ধকর মাধুর্য এবং ঐশ্বরিক তিক্ততা নিয়েও পৃথিবীর এ অংশে তোমার একজন বন্ধু রয়েছে, যে তোমার মঙ্গল চায় এবং সে লক্ষ্য রাখবে যেন তোমার কোনো অনিষ্ট না হয়। কাছে থাকে যে তার চেয়ে দূরের বন্ধু কখনও কখনও হয় অধিক কাছের। পাহাড়ে বসবাসের চেয়ে উপত্যকা দিয়ে যেতে যেতে দূরের পাহাড় কী সম্ভ্রমোদ্দীপক ও অধিক স্পষ্ট নয়? 

স্টুডিওর ওপরে রাত্রি তার দানবকে তুলে দিয়েছে এবং আমি দেখতে পাচ্ছি না আমার হাত কী লিখছে। তোমাকে সহস্র শুভেচ্ছা ও অভিবাদন এবং আমার ঈশ্বর সবসময় তোমাকে পাহারা দিন এবং রক্ষা করন। 

তোমার অকৃত্রিম বন্ধু 

জিবরান কহলীল জিবরান 

***

১. আল মাহরউসাহ মিশরের একটি সংবাদপত্র,, ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৮ সালে মে-এর বাবা ইলিয়াস জিয়াদাহ-এর সম্পাদকমণ্ডলীর একজন ছিলেন। অরপর তিনি এই পত্রিকার মালিক হন এবং মে হন এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। ১৯২০ সালে পিতার মৃত্যুর পর মে এই সংবাদপত্রের মালিক ও প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। 

২. ‘ইরাম—সুউচ্চ স্তম্ভের শহর।’ কোরানে এর উল্লেখ আছে। এটা ছিল একটি দেশ, যেখানে আদ’ গোষ্ঠী বসবাস করত এবং এই শহর তৈরি হয়েছিল অনেকগুলি স্তম্ভের ওপর। জিবরান এই নামটা ধার করেছেন একটা সুফি নাটকের জন্য এবং তা লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১১ সালে। 

৩. গ্রিক পুরাণের এটলাসের সাত কন্যা প্রাচীনকালে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। কখনও কখনও প্লেয়াডেস নামেও ডাকা হত। তাদেরকে বলা হত, সাহিত্য, চিত্রকলা ও বিজ্ঞানের তত্ত্বাবধায়ক। 

৪. এমিলি জেদান ১৯১৪ সালে সাময়িকপত্র আল-হিলাল-এর প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা তার বাবা জর্জ জেদান। 

৫. হ্যামলেট, ৭ম অঙ্ক, দৃশ্য-৫, লাইন ১২৩-১২৬। 

.

নিউ ইয়র্ক ১১ জুন ১৯১৯ 

এনভেলপে ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ ছিল ১১.৬.১৯। ভেতরে পাওয়া গেছে দ্য ম্যাডম্যান সম্পর্কে আমেরিকান সমালোচকদের রিভিউ-এর কতগুলি কাটিং। নিচের কাটিংটির ওপরে জিবরান অযত্নের সঙ্গে নিম্নলিখিত লাইনগুলি লিখেছেন। 

দ্য ম্যাডম্যান ফরাসি, ইতালি ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন অংশ। ফরাসি অনুবাদটি খুব তাড়াতাড়িই প্রকাশিত হবে এবং আমি যথাসময়ে তোমাকে এক কপি পাঠাব। 

দ্য ম্যাডম্যান। রচনা কহলীর জিবরান। নফ। মূল্য : ১.২৫ ডলার। 

রোডিন এই আরবীয় কবি সম্পর্কে যে খুব বেশি আশা করেছেন তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ঐসব কবিতা ও নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী যা জিবরান আমাদেরকে ইংরেজিতে উপহার দিয়েছেন, সেখানে তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন সেইসব, যা রোডিন করেছিলেন মার্বেল ও দিয়ে। কবি এবং ভাস্কর উভয়েই একটি কল্পনাকে তুলে ধরেছেন যা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছায় এবং ইঙ্গিত দেয় শক্তির—এটা একটা ইচ্ছা যা মানুষের বিভিন্ন বিষয়কে করে তোলে : সর্বজনীন গুণসম্পন্ন। একটি রসালো বক্রাঘাত এবং সত্যের জন্য ভালোবাসা যা স্বতঃসিদ্ধ উক্তিতে কখনও ভীত নয়। রোডিন জিবরানকে তুলনা করেছেন উইলিয়াম ব্লেকের সঙ্গে। কিন্তু দ্য ম্যাডম্যানে সংগৃহীত নীতিগর্ভ রূপক কাহিনীগুলি জরাথুস্ট্রের ছদ্মবেশ ধারণ করা ও না করা এবং রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘায়িত ছন্দের অধিক ইঙ্গিতবহ। ইংরেজি ভাষা কখনই এই প্রকৃতির কাজের জন্য যথাযথ মাধ্যম নয়। এই রচনা অধিক ‘সমালোচনাপ্রবণ, অর্থ ধরে রাখার ক্ষেত্রে অধিক প্রতিরোধ্য, বলতে গেলে প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্য মোটামুটিভাবে বৃত্তাবদ্ধ এবং তরবারি আবৃত করা মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে। যদি আমরা ফরাসি অনুবাদকের অনূদিত এই কবিতার দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টা বেশ মজার হবে : 

সেখানে কী আছে যা একজন পাগল মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে পারে কিন্তু তার নিজের রক্ত! আমি ছিলাম বোবা এবং আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোমার আহত মুখমণ্ডল সম্পর্কে। তোমার দিন-রাত্রির ভেতরে আমি বন্দি ছিলাম এবং আমি দীর্ঘ দিন ও দীর্ঘ রাত্রির দরজার ভেতরে চিৎকার করেছিলাম। 

এবং এখন আমি যাই, যেমন অন্যেরা ক্রুশবিদ্ধ হয়ে ইতিমধ্যেই গেছে এবং আমি ভাবি আমরা আর ক্রুশবিদ্ধ হতে ক্লান্ত হই না। সেজন্য অবশ্যই ক্রুশবিদ্ধ হতে হবে আমাদের দলে দলে, মানুষের বৃহত্তর পৃথিবী ও বৃহত্তর স্বর্গের মাঝখানে।

.

নিউ ইয়র্ক ২৫ জুলাই ১৯১৯ 

প্রিয় মিস মে, 

গত চিঠিতে তোমাকে আমি লিখেছিলাম, তোমাকে চিরদিন আমার মনে থাকবে। অনেক দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি তোমার কথা ভেবে, তোমার সঙ্গে কথা বলে, তোমার গোপনীয়তাগুলি আবিষ্কার করার ও তোমার রহস্যগুলির জট খোলার চেষ্টা করে। তারপরও বিষয়টি আমার কাছে এখনও পর্যন্ত বিস্ময়কর। মে, আমার অধ্যয়নের ভেতরে তোমার মানসিক উপস্থিতিটা আমি অনুভব করতে চাই এবং আমি তা লক্ষ্য করি আমার গতিবিধির মধ্যে, কথাবার্তায় এবং নিজের সঙ্গে বাদানুবাদ করার সময় উচ্চৈঃস্বরে মতামত ব্যক্ত করি। আমাকে এভাবে কথা বলতে দেখে সাধারণভাবেই তুমি বিস্মিত হবে। আমার কাছেও অদ্ভুত মনে হয় যে, আমারও উচিত এই তাড়না অনুভব করা এবং তোমাকে তা লিখে জানানো প্রয়োজন। আমার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল এই প্রয়োজনের পেছনের গোপনীয়তা—এই জরুরি প্রয়োজন। 

একবার তুমি বলেছিলে, ‘মন এবং চিন্তার পারস্পরিক ক্রিয়ার (খেলার) ভেতরে সব সময়ই একটা দ্বন্দ্ব আছে—যা কিনা থাকে ইন্দ্রিয়ের সচেতনতার ওপরে এবং তারা কেউই কখনও পুরোপুরিভাবে মন ও চিন্তা থেকে মুছে ফেলতে পারে না সেই পারস্পরিক ক্রিয়া এবং দ্বন্দ্ব—যাদের মাতৃভূমি একই।’ এই চমৎকার রচনাংশ এটা মৌলিক সত্যকে তুলে ধরে। কোনো কোনো সময় একধরনের মানসিক একাত্মতার ভেতর দিয়ে তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, কিন্তু এখন আমার কাছে তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আমি একটা ‘বন্ধন’ প্রতিষ্ঠা করেছি—বিমূর্ত, কমনীয়, দৃঢ়, অদ্ভূত এবং প্রকৃতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অন্যসব বন্ধনের মতো নয়। এটা এমন একধরনের বন্ধন, পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গে যার তুলনা হতে পারে না। এটা হল সেই বন্ধন যা সাধারণ বন্ধন থেকেও অধিক দৃঢ়, কঠোর এবং স্থায়ী। 

একটি মাত্র সুতাও নয় যা থেকে এই বন্ধন তৈরি হয়। এটা হল দিন ও রাত্রি দিয়ে বোনা, যা সময় পরিমাপ করে এবং দূরত্বে বৈচিত্র্য আনে, যা কবর থেকে আলাদা করে দোলনাকে। সেই সুর সুতার একখানিও নয় যা বোনা হয়েছিল অতীতের লাভ এবং ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা—এই বন্ধন টিকে আছে দুটি মানুষের ভেতরে, যারা একত্রিত হয়েছিল না বর্তমানের দ্বারা না ভবিষ্যতের দ্বারা এবং তারা ভবিষ্যতের দ্বারা আর মিলিত নাও হতে পারে। 

একরম একটা বন্ধন মে, এরকম একটা ব্যক্তিগত আবেগ ও এরকম একটা গোপন বোঝাপড়ার ভেতরে বসবাস করে যে-স্বপ্নগুলো তা যে-কোনোকিছুর চেয়ে অধিক উদ্ভট এবং অধিক গভীর, যার তরঙ্গোচ্ছ্বাস মানুষের বুকের ভেতরে—স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন, স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন। 

মে, এরকম একটা বোঝাপড়া হচ্ছে গভীর ও নীরব সংগীত, যা রাত্রির স্তব্ধতায় শোনা যায়। সেই সংগীত আমাদেরকে নিয়ে যায় দিন ও রাত্রির কল্পলোকের ওপরে, সময়ের ওপরে, অনন্তকালের ওপরে। 

মে, এরকম একটা আবেগ, যা আকস্মিক তীক্ষ্ণ বেদনাকে সম্পৃক্ত করে, যা কখনও অদৃশ্য যদি হবে না, কিন্তু যা আমাদের কাছে প্রিয় এবং আমরা যা বিনিময় করতে পারব না, সুযোগ থাকত যে-কোনো পরিমাণ খ্যাতি ও আনন্দের—হোক তা জানা অথবা কল্পিত। উপরোক্ত আলোচনা হল তোমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের একটি উদ্যোগ, যা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, একমাত্র সে ছাড়া, যে তোমার ভেতরে সবকিছু ভাগাভাগি করে। তারপরও আমি একটা গোপনীয়তার তল স্পর্শ করেছি যার ভেতরে তুমি যথেষ্ট নও। তারপর আমি হলাম তাদের ভেতরে একজন, যার জীবন হল তার উপহার এবং তার অনুমতি আছে সাদা সিংহাসনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর, কিন্তু আমি সেই তল স্পর্শ করেছি যা আমার কাছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ—তারপর, তারপর চিঠিটাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা যাক। 

করজোড়ে প্রার্থনা করছি আমাকে চিঠি লিখো এবং সকাতরে বলছি, লিখবে কিন্তু সেইসব মুক্ত, বিচ্ছিন্ন, গতিসম্পন্ন অনুভূতি যা মানবতারও ওপরে বসবাস করে। মানবতা সম্পর্কে তুমি ও আমি একটা ভাগাভাগির কথা জানি—একটা বৈষয়িক লাভ যা মানুষকে একত্রিত করে এবং ঘটনা হল সেটাই আবার তাদেরকে আলাদা করে দেয়। 

মে, আমরা কিছুক্ষণের জন্যও নিজেদের বহুলব্যবহৃত পথ থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিতে পারি না এবং মে, কল্পলোকে প্রবেশের ধারণা করার মতো থামারও সময় নেই আমাদের, যেখানে সে থামে দিন ও রাত্রির ওপরে, সময়ের ওপরে, অনন্তকালের ওপরে। ঈশ্বর তোমাকে সব সময় রক্ষা করুন। 

তোমার প্রকৃত বন্ধু
জিবরান কহলীল জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ২৬ জুলাই ১৯১৯ 

এনভেলপে ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ ছিল ২৬.৭.১৯। এনভেলপের ভেতরে নিম্নলিখিত সংবাদপত্রের কাটিংটিতে ছিল জিবরানের প্রথম ছবির বই ‘টুয়েন্টি ড্রইংস’-এর এ্যলিস রাফেলের ভূমিকার অংশবিশেষ। সেইসঙ্গে জিবরানের আরবি হস্তাক্ষরে লেখা নিম্নলিখিত নোট। 

এই বইটি শরতের প্রথম দিকেই প্রকাশিত হবে এবং প্রথম যে-কপিটি আমি পাব সেটাই তোমাকে পাঠাব। 

বিশটি ড্রইং,
কহলীল জীবরান 
এ্যালিস র‍্যাফেল এর ভূমিকা সম্বলিত।
মূল্য : ৩.০০ ডলার 

কহলীল জিবরানের প্রথম ইংরেজি গ্রন্থ দ্য ম্যাডম্যান একই সঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকাতে প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর কবিতা আরবি জানা লাখ লাখ পাঠকের কাছে পরিচিত ছিল। তাঁর চিত্রকলা তাঁর কবিতার মতোই গুণসম্পন্ন। তাঁর বন্ধু অগাস্টি রোডিন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন : ‘আমি জিবরান ছাড়া অন্য কাউকে চিনি না, যার কবিতা এবং ড্রইং একই সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কিত, যা তাকে নতুন ব্লেকে পরিণত করেছে। এই ছবিগুলি অনন্ত ও শ্বাশ্বত সত্যসমূহের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মনুষ্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। আরও রয়েছে সৃষ্টির চেতনা, আকার পরিবর্তন, মানবতার দুর্দশার ব্যাখ্যা, সেন্টরের (অর্ধাংশ মানবদেহ এবং অর্ধাংশ অশ্বদেহধারী কল্পিত জীব) আনন্দদায়ক কমনীয় ছবি— যা শুধু জিবরানই আঁকতে পারে—তাদের লৌকিক উপাখ্যানের যুদ্ধগুলিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মানুষের নিষ্ঠুর প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম। কুড়িটি ড্রইং-এর মধ্যে একটি সম্পূর্ণ রঙিন, বাকিগুলি পেন্সিলের কাজ। এই ছবির বইটি এসময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সেরা কাজের একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংগ্রহ, যিনি নিকট প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদকে নিয়ে এসেছেন আমেরিকায় এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পাশ্চাত্যের শিল্পীদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে নতুন ও পুরোনো পৃথিবীর মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করার। 

.

নিউ ইয়র্ক ৯ নভেম্বর ১৯১৯ 

প্রিয় মিস মে, 

তুমি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়েছে এবং তা হওয়ার যথেষ্ট অধিকার তোমার আছে। আমার দিক থেকে আমার কিছুই করার নেই তোমার ইচ্ছার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া। আমার ভুল-ভ্রান্তি কী তুমি ক্ষমা করবে না? ওজন ও পরিমাপের পৃথিবী থেকে আমি যতদূর সম্ভব নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। তুমি কী সোনালি অর্থ ভাণ্ডারে সেইসব জমা রাখবে না, যা স্বর্গীয় ধনভাণ্ডারে জমা রাখার উপযুক্ত নয়। 

যে উপস্থিত আছে তার চেয়ে অনুপস্থিত কেউ সরাসরি জ্ঞান অর্জন করতে পারে না এবং সেরকম বিবেচনা করাও একটা অপরাধ। জ্ঞান ও সচেতনতা ছাড়া কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় না। আমি চাই না তাদের হাতে গরম সিসা অথবা ফুটন্ত পানি ঢেলে দিতে, যারা পুরোপুরি জ্ঞানী। আমি জানি অপরাধের জন্য অপরাধের একটা নিজস্ব শাস্তি বরাদ্দ থাকে এবং দুঃখজনক হচ্ছে যে, অধিকাংশ মানুষের জীবনই তার জন্য নির্ধারিত কাজের ভেতরে স্বাভাবিক। 

আমি আলোকপ্রবাহী কিন্তু অস্বচ্ছ উপাদানের মুখোমুখি স্বস্তি ও সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছি যা সমস্ত দূরত্ব এবং বাধা-বিঘ্নকে অদৃশ্য করে দিয়েছে এবং এই একাকী সান্ত্বনা ও স্বস্তি আর কিছুই নয়, সেই উপাদান যা আবেদন করছে কিন্তু অন্যের সাহায্য নিচ্ছে না। তোমার জন্য যে প্রায়ই অন্তর্গত অর্থের জগতে বসবাস করে এবং জানে সেই আলোকপ্রবাহী কিন্তু অস্বচ্ছ উপাদান আমাদের ভেতরে একা, আমরা যা সব করি তা থেকে, এমনকি মৌখিক ও আপাত ব্যাখ্যার অধিক বাকপটুতা এবং মহত্তম শৈলীর আকাঙ্ক্ষা থেকে তা দূরবর্তী। এমনকি আমাদের ভেতরে ওটা ছিল কাব্যিকতার স্বগোত্রীয়—এটা নিজে গীতিকবিতা তৈরি করতে পারে না, পারে না নিজের রহস্যগুলির ওপর রঙ চড়াতে। প্রতিটি মানুষ কৃত্রিম হতে সক্ষম যখন তার পছন্দ ও অপছন্দের প্রশ্ন দেখা দেয় এবং সক্ষম উদ্দেশ্য ও চিন্তার বিনিময় নিয়ে ভোজবাজি দেখাতে, কিন্তু পৃথিবীর কোনো মানুষই নিঃসঙ্গতার ক্ষেত্রে কৃত্রিম হতে সক্ষম নয় অথবা সক্ষম নয় ভোজবাজি দেখানোর ক্ষেত্রে কিংবা ক্ষুধা ও তৃষ্ণার সময়। এমন একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, স্বপ্নকে পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ক্ষমতা যার আছে অথবা একটি প্রতিমূর্তিকে অন্যকিছুতে রূপান্তরিত করতে পারে কিংবা তার গোপনীয়তাকে স্থানান্তরিত করতে পারে এক জায়গা থেকে অন্যত্র—যা আমাদের ভেতরে ক্ষণস্থায়ী এবং দুর্বল, তা কী আমাদের ভেতরের কাঠিন্য ও পরাক্রমশীলতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়? অর্জিত আত্মা পৃথিবীর বন্ধনের মতো পরিবর্তনের ফলশ্রুতি এবং আত্মার সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে তা রূপান্তরিত হয় যা কিনা স্বর্গের। সেই নীল শিখা, যা অপরিবর্তনীয়ভাবে উত্তাপ বিকিরণের মাধ্যমে রূপান্তরিত করে কিন্তু রূপান্তরিত হয় না এবং নির্দেশ দেয়, কিন্তু নির্দেশিত হয় না। 

তুমি কী সত্যি সত্যি ভাব—তুমি সবচেয়ে উঁচু মনের মানুষ-এই ‘মৃদু শ্লেষোক্তি’ একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, বেদনা যাকে তুলে ধরেছে, যাকে রোপণ করেছে একাকিত্ব এবং ফসল তুলেছে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার সাহায্যে। তুমি কী মনে করো ‘দার্শনিক রসিকতা’ হচ্ছে ভালোবাসার সত্য এবং তা বিচ্ছিন্নতা ও সম্পূর্ণতার ইচ্ছার সহগামী হতে পারে? না বন্ধু আমার, তুমি কী নিশ্চিতভাবে এরকম সন্দেহ ও বিশ্বাসের অনুভূতিগুলোর ওপরে অবস্থান করছ? অবিশ্বাস হল প্রচুর ভীতিপূর্ণ এবং তা নেতিবাচক, যখন অবিশ্বাস ঐগুলি স্বীকার করে, যা তাদের আস্থা হারিয়েছে। কিন্তু তুমি ভয়হীন ও ইতিবাচক এবং নিজের রয়েছে পর্যাপ্ত আস্থা। সুতরাং কেন তুমি ঐসব বিশ্বাস করো যে, ভাগ্য তোমার হাতের তালুতে স্থান করে নিয়েছে? কেন তুমি তোমার দৃষ্টিকে অন্তর্গত সৌন্দর্যের দিকে ফেরাও না, যা কিনা সত্য এবং সেইসব বহির্দৃশ্য থেকে যা আবির্ভূত হয়। 

আমি গ্রীষ্মের দিনগুলো কাটিয়েছি অরণ্য ও সমুদ্রের মাঝখানে স্বপ্নের মতো একটা নির্জন বড়িতে। অতীতে যখনই আমি আমার আত্মাকে (নিজস্বতা) হারিয়েছি তখনই তা আবিষ্কারের জন্য এসেছি সমুদ্রের কাছে এবং বৃক্ষসমূহের ছায়ায় আমি আমাতে ফিরে এসেছি। এদেশের অরণ্য পৃথিবীর প্রতিটি অরণ্য থেকে আলাদা—তারা সবুজ, গভীর ও অতিবাড়ন্ত যা ফিরে যাচ্ছে স্মরণাতীত কালে, একেবারে শুরুতে : ‘সৃষ্টির শুরুতে ছিল শব্দ এবং শব্দ ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে এবং শব্দই ছিল ঈশ্বর।’ আমার সমুদ্র হচ্ছে তোমার সমুদ্র, সেই গতিসম্পন্ন শব্দ, যা তুমি মিশরের সমুদ্র-উপকূল জুড়ে শোনো, তা আমরা দুজনেই শুনি এই (এদেশীয়) সমুদ্র-উপকূলে এবং বিরতি, যা তোমার হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে জীবনকে দিয়ে এবং যা ত্রাসোদ্দীপক ও ভয়াবহ। আমি প্রাচ্য সমুদ্রের গান শুনেছি এবং পাশ্চাত্যে ও উভয় স্থানে এটা ছিল সবসময়ই অনন্তের আদি অন্তহীনতা, আত্মাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে অথবা নামিয়ে আনছে মাটিতে, কোনো সময়ে তা আনন্দে পরিপূর্ণ, কখনও বা দুঃখে। আমি আলেকজান্দ্রিয়ার বালির ওপর বসে সেই গান শুনেছিলাম—সত্যিই। 

১৯০৩ সালের গ্রীষ্মে আলেকজান্দ্রিয়ার বালির ওপর এবং তারপর শুনেছিলাম বিভিন্ন যুগের ভাষা প্রাচীন সভ্যতার সমুদ্র থেকে, যেমন আমি গতকাল তা শুনেছিলাম আধুনিক সভ্যতার সমুদ্র থেকে। আমি প্রথম আট বছর আগে এই শব্দ শুনি। আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম, আমার জীবন হয়ে পড়েছিল বিশৃঙ্খল এবং এক সেতুবন্ধ প্রশ্নসহ আমি আমার ধৈর্য ও আমার মায়ের সহিষ্ণুতা সেই বিশৃঙ্খলার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। আজও আমি সেই একই ভাষা শুনতে পাই এবং একই রকম সবগুলি প্রশ্নকে জিজ্ঞাসা করি—শুধুমাত্র এখন এটা হচ্ছে আমার ‘সর্বজনীন জননী’ যে অবশ্যই আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়, এমনকি শব্দের চেয়ে অনেক বেশি কিছু বুঝতে আমাকে সাহায্য করেছে এবং যখন আমি তাদেরকে অন্যের কাছে ব্যাখ্যা করতে শুরু করি, তখন তা আমার ঠোঁটে নীরবতায় পরিণত হয়। আমি সমুদ্রের পাড়ে বসি, কল্পনা করি সবচেয়ে দূরতম দিগন্ত এবং জিজ্ঞাসা করি এক হাজার একটা প্রশ্ন—এখনও একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছি। আমি অনুভব করি আমার বয়স আশি হয়ে গেছে যেমন হয়েছিল যখন আমার বয়স আট বছর। তোমার আয়ত্ত্বের ভেতরে কেউ কী আছে যে জবাব দিতে পারে? অনন্তকালের ভেতরে সময়ের প্রবেশপথ এক মিনিটের জন্যও খোলা থাকে না, সুতরাং আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি কী রহস্য এবং গোপনীয়তা তাদের পেছনে রয়েছে। আমাদের মুখের ওপর থেকে মৃত্যু সাদা মুখাবরণ তুলে নেওয়ার আগে তুমি কী জীবনের সেইসব শক্তিশালী গোপন নীতিমালার একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারো না? তুমি বলতে পারো যে আমি নিরুদ্বিগ্নতার সুবিধার প্রশংসা করি, কিন্তু তা শুধুমাত্র তখনই, যখন সবকিছুই আমি অনুবাদ করি ব্যক্তিগত ভাষায়। 

শক্তিশালী প্রচেষ্টা হচ্ছে স্রেফ একটা মই, যা আমাদের নেতৃত্ব দেয় শীর্ষে আরোহণ করতে। অবশ্যই উড়ে গিয়ে আমি আমার শীর্ষে পৌঁছাব, কিন্তু জীবন আমার শাখাকে (বাহু) শেখায়নি আঘাত করতে এবং অনেক উঁচুতে ভেসে থাকতে—সুতরাং আমার কী করার আছে? আমি প্রকৃতই সত্যকে অগ্রাধিকার দিই, যে সত্য লুকানো এবং যে সত্য স্পষ্ট, যেমন আমি অগ্রাধিকার দিই উপলব্ধিকে, যা নীরব, সম্পূর্ণ এবং তৃপ্তিদায়ক—যা বিশ্লেষণ ও সত্যতা প্রমাণের জন্য কাউকে সঙ্গে নিতে চায়। কিন্তু আমি দেখেছি যে উচ্চপ্রশংসিত নীরবতা সবসময় শুরু হয় উচ্চপ্রশংসিত শব্দের সঙ্গে। 

আমি সবধরনের সুবিধার (নিরুদ্বিগ্নতার জন্য) প্রশংসা করি, পছন্দ করি বিশৃঙ্খলা ছাড়া জীবনের সবকিছুই, তবে এ ধরনের সুবিধা যদি বিশৃঙ্খলাকে আচ্ছন্ন করতে আসে তখন আমি আমার চোখ বন্ধ করে নিজের সঙ্গে কথা বলি : ‘এটা আমার জন্য পারাপারের স্থান অতিরিক্ত হিসেবে বহন করতে পারে, যেমন শতশত মানুষকে ইতিমধ্যেই আমি বহন করতে শুরু করেছি’। কিন্তু বিশৃঙ্খলাও তেমন কিছু নয় যা ঘৃণা-সহকারে পরিহার করা যায়। একটা সময় পর্যন্ত সে শুধুই তোমাকে সঙ্গ দেয়, যখন আমি ওগুলি সম্পর্কে পরিশ্রান্ত। এটাই পরিণত হয় রুটিতে যা আমি খাই, পরিণত হয় পানিতে যা আমি পান করি; পরিণত হয় বিছানায়, আমি যেখানে শয়ন করেছি এবং পরিণত হয় পোশাক- পরিচ্ছদে যা আমি পরেছিলাম, তা খুঁজেছি নিজের ভেতরে; এমনকি তার নাম ঘোষণা করতে অক্ষম। আমি প্রবলভাবে এর প্রতিটি ছায়া থেকে পালানোর চেষ্টা করছি। 

দ্য প্রসেশনস[১] সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত তোমার লেখাটি হচ্ছে আরবিভাষায় নতুন ধরনের প্রথম রচনা। এটা হচ্ছে সেই বিষয়ের ওপর প্রথম গবেষণা, লেখার সময় যা লেখকের মনের ভেতরে ছিল। 

মিশর ও সিরিয়ার লেখকেরা তোমার কাছ থেকে ভালোভাবে শিখতে পারে, শুধুমাত্র কাগজে বাঁধানো বই ছাড়াও কীভাবে আবিষ্কার করতে হয় নির্যাসকে এবং উদ্ভাবন করতে হয় কবির মানসিক গঠন ও কবির বাইরেরটা উদ্ভাবনের মুখোমুখি কীভাবে তা গঠিত হয়। তোমার মনোবিশ্লেষণিক রচনার জন্য আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত নয়। কারণ যা নিয়ে লেখা হয়েছে আমি সে-বিষয় সম্পর্কে সচেতন। যদি আমাদের জাতির পক্ষ থেকে জনসমক্ষে আমি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারতাম—তোমার লেখা সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লেখা আমার জন্য খুবই জরুরি। কখনও কখনও প্রাচ্যের লোকেরা তা খারাপ রুচির বলে মনে করবে। কিন্তু সেইদিন আসবে, যেদিন আমি বলব মে, তার মেধা সম্পর্কে আমি কী ভাবি এবং যা আমি বলি তার সম্পর্কে এবং তা হবে প্রচণ্ড। এটা হবে উঁচুস্তরবিশিষ্ট এবং দীর্ঘ ও সুন্দর, কারণ এটা সত্য। 

‘বিদ্রোহী ও বিদ্রোহের শব্দমুক্ত’ এই শিরোনামে আমার একখণ্ড ড্রইং-এর বই এই শরতে প্রকাশিত হবে, ছাপাখানায় ঘর্মঘট না হলে তিন সপ্তাহ আগেই বইটি প্রকাশিত হত। আগামী বছর দুটো বই প্রকাশিত হবে। একখানা হচ্ছে, আল-মুসতাওহীদ[একাকী মানুষ], এটার অন্য নামও আমি দিতে পারি এবং যার বিষয়বস্তু হচ্ছে কবিতা ও নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী; আর দ্বিতীয় বইটি হচ্ছে প্রতীকসমৃদ্ধ ড্রইং, শিরোনাম নাহওয়া আল্লাহ [ঈশ্বরের প্রতি]। 

চিঠির একপর্যায় শেষ করছি, সেইসঙ্গে আরেক পর্যায় শুরু করছি। যেমন প্রফেট—হাজার বছর আগে যা লেখার কথা চিন্তা করেছিলাম, কিন্তু গত বছর শেষ হওয়ার আগে এত বছরেও কাগজের ওপরে তা এক অধ্যায়ও লিখতে পারি নি—এই প্রফেট সম্পর্কে আমি তোমাকে কী বলতে পারি? ওটা হচ্ছে আমার পুনর্জন্ম এবং আমার প্রথম ব্যাপ্তিস্ত প্রাপ্তি, এখন আমার ভেতরে একটাই চিন্তা যা আমাকে সূর্যের আলোর নিচে গুণসম্পন্ন করে তুলবে। এই প্রফেট ইতিমধ্যে লেখা হয়ে গিয়েছিল, আমি লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করার আগেই; যেমন সে আমাকে তৈরি করেছিল, আমি তাকে তৈরি করার আগেই এবং তার উৎসর্গ, ইচ্ছা এবং চড়াই-উত্রাই আমার সামনে আবির্ভূত হওয়ার আগেই নীরবে আমাকে স্থাপন করেছিল সাত হাজার লিগ[২] গভীরতা অনুসরণ করতে। দয়া করে আমার সঙ্গদানকারী ও সাহায্যকারীকে জিজ্ঞাসা করো, সেই আলোকপ্রবাহী অস্বচ্ছ উপাদান নবী সম্পর্কে কি গল্প বলেছে। যেমন, আলোকপ্রবাহী অস্বচ্ছ উপাদান রাত্রির নীরবতার ভেতরে প্রশ্ন করে যখন আত্মা তার হাতকড়া এবং পোশাক থেকে মুক্ত হয় এবং তোমার কাছে প্রকাশিত হয় নবী এবং তার অগ্রবর্তী নবীদের রহস্য। 

প্রিয় বন্ধু, আমি বিশ্বাস করি যে, এই আলোকপ্রবাহী অস্বচ্ছ উপাদানের ভেতরে যথেষ্ট প্রস্তাব রয়েছে একটা পরামাণুর জন্য একটা পাহাড়কে সরাতে এবং আরও বিশ্বাস করি—যদিও আমি জানি যে আমরা এই উপাদানকে তারের মাধ্যমে বর্ধিত করতে পারি দুই দেশের মধ্যে অর্থাৎ যার মাধ্যমে আমরা জানব, যা জানতে ও অর্জন করতে ইচ্ছা হয় এবং যার জন্য আমরা প্রবল আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা অনুভব করি। 

আলোকপ্রবাহী অস্বচ্ছ উপাদান সম্পর্কে আমার অনেক কিছু বলার আছে এবং অন্যসব উপাদান সম্পর্কেও। কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে আমার নীরব থাকা উচিত। আমি নীরব থাকব যতক্ষণ না ধোঁয়াশা মিলিয়ে যায়, সময়ের দরজা বিস্তৃতভাবে খোলে এবং সর্বময় ক্ষমতার দেবদূত আমাকে বলে, ‘নীরবতায় যে সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সে-সম্পর্কে বলো এবং বসে থাকো বিশৃঙ্খলার দীর্ঘ ছায়ার ভেতরে।’ 

সময়ের দরজা কখন খুলবে? তুমি কী জানো, তুমি জানো কখন সময়ের দরজা খুলবে এবং ধোঁয়াশা মিলিয়ে যাবে? 

মে, সবসময় ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। 

একান্ত অনুগত 

জিবরান কহলীল জিবরান 

***

১. এটাই দ্য ফোররানার-এ পরিণত হয়েছিল এবং প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। 

২. পানির গভীরতা পরিমাপের একক। 

.

নিউ ইয়র্ক ১৫ নভেম্বর ১৯১৯ 

নিচের আমন্ত্রণপত্রটি একটা এনভেলপের মধ্যে পাওয়া গেছে। ডাকঘরের মোহরের ছাপের তারিখ হচ্ছে ১৫.১১.১৯। নিমন্ত্রণপত্রের ওপর জিবরান আরবিতে নিম্নলিখিত কথাগুলো লিখেছিলেন। 

এটা একটা শৈল্পিক সম্ভাষণের নিমন্ত্রণপত্র, তুমি কী দয়া করে উপস্থিত হয়ে আমাদেরকে সম্মানিত করবে? 

নিমন্ত্রণপত্রের নমুনা, ইংরেজিতে হুবহু ছাপা হল। 

.

নিউ ইয়র্ক ৩০ নভেম্বর ১৯১৯ 

দু’সপ্তাহ পর মে আরও একটা নিমন্ত্রণপত্র পান। নিউ ইয়র্কের ম্যাকডোয়েল ক্লাব-এর এই নিমন্ত্রণপত্রটি পাঠানোর সময় জিবরান নিমন্ত্রণপত্রের মার্জিনের খালি জায়গায় নিম্নলিখিত বাক্যগুলি লেখেন। নিমন্ত্রণপত্রটি হুবহু ছাপা হল। 

আমার উচ্চারণকে সংগীতে রূপান্তরিত করতে তুমি কী এখানে ছিলে? যদিও আমি জানব যে অচেনাদের ভেতরেও একজন বন্ধু আমার পাঠ শুনছে এবং হাসছে স্নেহপূর্ণ মধুর হাসি। 

নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যাকডোয়েল ক্লাব 
১০৮ পশ্চিম ৫৫ তম স্ট্রিট 
সম্মিলিত চিত্রকলার একটি ক্লাব 
বুলেটিন, নভেম্বর ও ডিসেম্বর ১৯১৯ 

ম্যাকডোয়েল ক্লাবের উদ্দেশ্য : 

১. স্থাপত্য কলা, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, নাটক, সাহিত্য ও সংগীতের শৈল্পিক আদর্শ আলোচনা ও হাতে কলমে দেখান এবং এ সম্পর্কিত জ্ঞান বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করার পাশাপাশি, বিশেষ করে এসব শিল্পের অন্তর্গত উদ্দেশ্য উদাহরণ সহকারে ব্যাখ্যা করা এবং যেসব শিল্পকলা স্বীকৃতি দাবি করে, শিল্পকলার পারস্পরিক সহানুভূতিশীল বোঝাবুঝিকে ত্বরান্বিত করে, উপহার দেয় তাদের প্রভাবের প্রশস্ততা এবং এডওয়ার্ড ম্যাকডোয়েলের জীবনের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেয় সেইসব শিল্পকলাকে তুলে ধরা। 

২. এই উদ্দেশ্যের উন্নতি বিধানে ক্লাবের জন্য একটা বাড়ি তত্ত্বাবধান করা। 

মঙ্গলবার রাত্রি, দুই ডিসেম্বর 
রাত সাড়ে আটটা
সাহিত্য সমিতি ঘোষণা করছে
রচনা পাঠ 
কহলীল জিবরানের
নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী 
ও 
উইটার বাইনারস-এর স্তুতিগান 
রচনাপাঠ করবেন লেখক 
সদস্য ও তার অতিথিদের জন্য বিনামূল্যে 

.

নিউ ইয়র্ক ২৮ জানুয়ারি ১৯২০ 

প্রিয় মিস মে, 

তুমি আমার আক্ষেপের যথাযথ অর্থ জানতে চাও এবং চাও ক্ষমাশীলতার জন্য আমার কৈফিয়তের পেছনের অন্তর্গত গোপনীয়তাও। এখানে যথাযথ ও সাধারণ অর্থ হচ্ছে আমার অনুশোচনার পেছনে কী ছিল এবং কী আছে, এমনকি আমার মনস্তাত্ত্বিক বিষয় এবং তার অর্থ ও রহস্যের পেছনে কী আছে, সবকিছুই। 

গীতিকবিতা বলে যে চিঠির উল্লেখ তুমি করেছ আমি তার জন্য অনুশোচনা করিনি। এ সম্পর্কে লেখা—না ক্ষুদ্রতম না বৃহত্তম—কোনোরকম চিঠির জন্যই আমি আক্ষেপ করিনি, কখনও করব না। 

আমি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হইনি, তাই নিজেকে পুনরুদ্ধার করার কোনো কারণই দেখি না। তাই কীভাবে সে-সম্পর্কে আক্ষেপ করতে পারি যা আমার ভেতরে ক্রমাগত টিকে থাকছে। আমি তাদের একজন নই, যারা বিনিদ্রতার ভেতরে পরিত্যক্ত হয়, যা তারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে পারে তাদের স্বপ্নের ভেতরে, কারণ আমার স্বপ্ন হচ্ছে আমার বিনিদ্রতা যা আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে এবং আমার জীবন এক পা এগিয়ে যাওয়া ও দু’পা পিছিয়ে আসার ভেতরে বিচ্ছিন্ন হয়নি। 

আমার একমাত্র পাপ হচ্ছে আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ, অথবা আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করতে পারি, যে পরিবর্তন ও পরিমাপের পৃথিবী থেকে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। তুমি কায়রো ত্যাগ করার আগে যে সেখানে গিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার বালির জন্য, আমি অসতর্কতার কারণে তার হাতে কিছু ফুটন্ত পানি ঢেলে দেওয়ায় আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। তোমার বিবৃতি পড়ার পর মনে পড়ল মূল চিঠিটা পোস্ট করার আগে কিছু একটা লক্ষ্য করা উচিত ছিল। আমি ভেবেছিলাম অথবা কল্পনা করেছিলাম যে আমার চিঠি তোমাকে বিরক্ত করেছিল, কারণ আমি চিঠিতে সেইসব নির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করেছিলাম যা অন্যেরা পড়তে পারে। যে আমাদের ভেতরে আছে সে কখনও বিরক্ত ও বিষাদগ্রস্ত হবে না জ্ঞানের ক্ষেত্রে, যা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার, যা হাতে পৌঁছেছে, চোখে দেখা গেছে কিন্তু সেসব তথ্য জানার অধিকার তার নেই। এটা হল একটা বিষয় যা আমি খুবই দেরি করে জানিয়েছি এবং এখন আক্ষেপ করছি। এটাই একমাত্র জিনিস যা আমি তোমাকে ‘বিস্মৃতির ধনাগারে’ জমা রাখতে বলেছি। সেন্সরশিপ পদ্ধতির উদ্ধৃতি দিয়েই বলি—এর টিকে থাকার সবগুলি কারণসহ এবং এর সমস্ত প্রতিধ্বনি—পরিবর্তন ও পরিমাপের পৃথিবীর মতোই। আমি এটা করেছিলাম, কারণ সেন্সরশিপ ছিল পৃথিবী থেকে সরিয়ে আনা অনেক দূরবর্তী একটি বিষয়, যা আমার চিন্তাকে অধিকার করেছে সেই সময়ে, যখন স্বর্গ থেকে অপসারিত হয়েছে নরক। 

গতবছর সেন্সর সম্পর্কে সামান্য কিছু শিখলাম, যা আমার কাছে বয়ে নিয়ে এল সমাধির ভেতরে প্যাচর হাস্যধ্বনি। সেন্সর অফিসের কিছু যুবক কর্মচারী প্রাচ্য থেকে আসা আমার সমস্ত চিঠি খুলেছে, সেখানে তারা মন্তব্য যোগ করেছে এবং সেগুলির বিষয় হচ্ছে- শুভেচ্ছা, অভিবাদন, রাজনীতির ওপর ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, সভ্যতা এবং সাহিত্য। 

এমনকি সেন্সর বিভাগের অদ্ভুত এক লোক দামাস্কাসে আমাকে লেখা একটা চিঠিতে কিছু খালি জায়গা খুঁজে পায় যেখানে আসলে ঠিকানা লেখার কথা, সে-জায়গাটুকু একটা স্তুতিমূলক কবিতা দিয়ে অলংকৃত ছিল—যদি সেই কবিতার কথা তোমাকে বলি তাহলে তুমি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হবে, কিন্তু অন্য একটা চিঠিতে ছিল একটা তথাকথিত লিরিক কবিতা, আমার লেখা এবং আমি আমাকে লিখেছি আমার ভেতরে—এটা হল, আমি যেমন ছিলাম এবং যেমন থাকব। এই চিঠিটা হচ্ছে—যেমন এটা ছিল গতকাল অথবা এটা হবে আগামীকাল। সুতরাং তোমার কোনো আস্থা নেই আমার ওপর। তুমি কী ক্ষতের ভেতরে তোমার আঙুল প্রবেশ করাতে চাও? 

নৈরাশ্যবাদ সম্পর্কে আমার অপছন্দের বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করার অনুমতি দাও, হোক তা তীক্ষ্ণ অথবা তীর্যক। আমি রসিকতা অপছন্দ করি, হোক তা দার্শনিক অথবা দর্শনের বাইরের বিষয় এবং এইসব লোকদের মধ্যে যারা আধ্যাত্মিক বোঝাবুঝি অর্জন করেছে এবং আমি আরও অপছন্দ করি সমস্ত বিষয়-সম্পর্কিত ভান ও ভণ্ডামি, এমনকি বেশি পরিমাণ উচ্চপ্রশংসা। এই অপছন্দের কারণগুলি বসবাস করে সভ্যতার যান্ত্রিক প্রকাশের ভেতরে, যা আমি আমার চারপাশে প্রতিমুহূর্তে দেখি এবং সমাজের প্রভাবে তা চলে চাকার ওপর, কারণ এর কোনো পাখা নেই। 

আমার মনে হয় তীক্ষ্ণ নৈরাশ্যবাদ সম্পর্কে আমার প্রতি তোমার দোষারোপ মূলত ম্যাডম্যানের এক জায়গায় আমি যা বলেছিলাম, তাই। যদি আমার ধারণা সত্যি হয় তাহলে আমি অবশ্যই সে সম্পর্কে সমস্ত অভিযোগ মেনে নেব, কারণ ম্যাডম্যান পুরোটা আমি নই—চিন্তা এবং উৎস—কোনো কারণ ছাড়াই আমি চেষ্টা করেছি আমার নিজের চিন্তা ও প্রবণতার সম্পূর্ণ ছবি তুলে ধরতে, যদিও ম্যাডম্যান চরিত্রে আমি যে ভঙ্গি উপযুক্ত হবে বলে পছন্দ করেছি, এটা সেই ভঙ্গি নয়, যে ভঙ্গিতে লিখব বলে আমার বন্ধুকে বলেছিলাম, যে বন্ধুকে আমি ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। যাহোক, আমি যা লিখেছি তার মাধ্যমে আমার বাস্তবতা তুমি ব্যাখ্যা করতে পারো। ম্যাডম্যানের পরিবর্তে দ্য প্রোসেশনস-এর সেই অরণ্যের যুবকটির সঙ্গে আমাকে শনাক্ত করতে কে তোমাকে বাধা দিয়েছে? মে, আমার আত্মা হচ্ছে অরণ্যের সেই যুবকের মতোই অধিক স্বগোত্রীয় এবং তার বাঁশির সুর হচ্ছে ম্যাডম্যান ও তার কান্নার এবং অচিরেই তুমি অনুধাবন করবে ম্যাডম্যান কিছুই ছিল না, কিন্তু একটা দীর্ঘ শিকলের সংযোগ, যা বিভিন্ন ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে। আমি কখনও অস্বীকার করিনি যে ম্যাডম্যানে একটা বিশৃঙ্খল যোগাযোগ আছে, যা লোহা দিয়ে তৈরি, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, পুরো শিকলটাই নিকৃষ্টমানের খাদ্যশস্যের মতো লোহা দিয়ে তৈরি হতে যাচ্ছে। মে, প্রতিটি আত্মার নিজস্ব ঋতু আছে, আত্মার শীত বসন্তের মতো নয়, এমনকি গ্রীষ্মকালও নয় শরতের মতো। আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম জেনে যে, লেভি১ পরিবারের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক রয়েছে। আমি প্রকৃতই আনন্দিত এবং এই বিশাল আনন্দের কারণ হচ্ছে আমি একজন যাজকের কন্যার সন্তান। যদিও আমার মাতামহ ধর্মতত্ত্বীয় গোপনতা সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন কিন্তু তারপরও তিনি চার্চসংগীত ও অন্যান্য সংগীত খুব ভালোবাসতেন এবং সে-কারণেই তার যাজক হওয়াকে আমি ক্ষমা করেছি। আমার মা ছিলেন তার খুব আদরের সন্তান এবং মাও তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। অদ্ভুত বিষয় হল, মার উচিত ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং নিজেকে প্রস্তুত করা, যখন জীবনের মুখ্য সময়ে উত্তর লেবাননের সেন্ট সাইমন নারীমঠে সন্ন্যাসিনী হয়ে প্রবেশ করেন। আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাগুলির শতকরা নব্বই ভাগ জন্মগতভাবে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া (এর অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, আমি তার মধুরতা, কোমলতা ও মহানুভবতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারি, অথবা তার সমকক্ষ), যদিও সন্ন্যাসীদের (ভিক্ষু) প্রতি আমার একধরনের বিদ্বেষ রয়েছে। আমি নানদের ভালোবাসি এবং অন্তর থেকে তাদের শুভাশীষ জানাই। তাদের জন্য আমার ভালোবাসার কারণ হল : সেইসব অতীন্দ্রিয় ভক্তি ও শ্রদ্ধা থেকে উদ্ভূত বৈশিষ্ট্য-পরিপূর্ণ স্বপ্ন যা ছড়িয়ে পড়েছিল আমার মায়ের যৌবনের কল্পনায়। একবার আমি নিম্নলিখিত শব্দগুলি উচ্চারণ করে যখন তাকে স্মরণ করেছিলাম তখন আমার বয়স কুড়ি বছর : 

‘এটা আমার ও যে কোনো মানুষের জন্য ভালো হত 
যদি আমি নারী মঠে প্রবেশ করতাম।’ 
‘তুমি যেহেতু নারীমঠে প্রবেশ করেছিলে 
সেহেতু আমার পৃথিবীতে আসা উচিত হয়নি,’ আমি বলেছিলাম। 
‘প্রিয় পুত্র, তোমার জন্ম আগে থেকেই 
নির্ধারিত হয়েছিল’, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন। 
‘হ্যাঁ, কিন্তু পৃথিবীতে আসার বহু আগেই, মা হিসেবে 
আমি তোমাকে পছন্দ করেছিলাম’, আমি বললাম। 
‘তোমার জন্ম না হলে তুমি স্বর্গে থাকতে 
দেবদূত হয়ে।’ 
‘কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি দেবদূত’। আমি উত্তর দিই। 
তিনি হাসেন এবং বলেন, ‘তোমার পাখা কই?’ 
আমি তার হাত ধরে আমার কাঁধে রেখে 
বলেছিলাম, ‘এখানে। 
তিনি বলেছিলেন, ‘গুগুলি ভাঙা।’ 

এই কথোপকথনের নয়মাস পর আমার মা ঐ নীল দিগন্তের ওপর অদৃশ্য হয়ে যান, কিন্তু তার সেইকথা : ‘ওগুলি ভাঙা’ আমার ভেতরে প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করেছিল এবং এই শব্দগুলির ভেতর থেকেই আমি দ্য ব্রোকেন উইংস[২] (ভাঙা ডানা) এর কাহিনী বুনতে শুরু করেছিলাম। 

না, মে, আমি কখনই আমার মায়ের জাগতিক আত্মসংযমের অংশীদার হতে পারিনি। আমার কাছে আত্মিকভাবে এখনও তিনি একজন মা। আমি তার নৈকট্য ও প্রভাব অনুভব করি এবং প্রয়োজনের সময় তার কাছ থেকে সাহায্য পাই, যা তার বেঁচে থাকা অবস্থার চাইতেও বেশি এবং যে-পদ্ধতিতে এটা সম্ভব হয় তা সম্পূর্ণ অদ্বিতীয়। যাহোক এই অনুভূতি, আমার অন্যান্য আত্মিক মা ও বোনের সঙ্গে যে বন্ধন তাতে বাধা সৃষ্টি করে না। আমার নিজের মা ও অন্যান্য মা সম্পর্কে অনুভূতির ভেতরে কোনো পার্থক্য নেই, শুধুমাত্র স্বচ্ছ স্মৃতি ও অস্পষ্ট স্মৃতির পার্থক্য ছাড়া। 

আমি আমার মা সম্পর্কে তোমাকে খুব কমই বলেছি … এবং নিয়তি যদি কখনও আমাদের সাক্ষাৎ ঘটায় তাহলে তার সম্পর্কে তোমাকে অনেক কিছু বলব এবং আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, তুমি তাঁকে ভালোবাসতে শুরু করবে— তুমি তাঁকে ভালোবাসবে, কারণ তিনি তোমাকে ভালোবাসেন—উপরে উঠে যাওয়া অন্য পৃথিবীর আত্মা এই পৃথিবীর যে-কোনো সুন্দর আত্মাকে ভালোবাসে। মে, তুমি একটা সুন্দর আত্মা, সুতরাং বিস্মিত হয়ো না যখন আমি বলি, ‘তিনি (মা) তোমাকে ভালোবাসেন।’ আলফওনুন পত্রিকায় প্রকাশিত ড্রইঙে তার মুখখানা ছিল বিশাল আবেগে পরিপূর্ণ এবং আমার ‘টুয়েন্টি ড্রইংস’[৩]-এর প্রথম পাতার একটি হচ্ছে তার মুখ। আমি একে বলি অনন্তযাত্রা, কারণ এতে তার পৃথিবীর জীবনের শেষমুহূর্ত এবং অন্য জীবন শুরুর প্রথম মুহূর্ত ফুটে উঠেছে। 

যেমন আমার পিতার পরিবারের তিন অথবা চার পুরোহিতের জন্য আমি গর্ব করতে পারি, যেমন তুমি গর্ব করো জিয়াদাহ পরিবারের পুরোহিত ও যাজকদের নিয়ে। তোমার পরিবারের পুরোহিতদের বিশাল প্রভাব রয়েছে যাকে আমি একটা বিশাল সুবিধা বলব। আমার পরিবারের বৃক্ষটি এরকম প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপাদন করতে পারেনি। যাহোক আমাদের একজন পুরোহিত আছে, যে প্রকৃতই অর্ধ-পুরোহিত। তোমার ওখানে এরকম কেউ আছে? এই খুরুশকাফ[৪] অথবা জিবরানীয় পাদরি ঈশ্বরের কাছে সকাতরে প্রার্থনা করে তাকে মাদার চার্চের অন্তরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, আলিঙ্গন করতে খ্রিস্টের দ্বাদশ শিষ্যের কালের চার্চকে, ঠিক যেন সে উড়নচণ্ডী ছেলেকে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে এনেছে। যেমন, তুমি জানো মাদার চার্চের অন্তর আর আমাদের পিতা আব্রাহামের হৃদয় একই—একদিকে পাপীদের আয়েশের জন্য অন্যদিকে মৃতদের বিশ্রামের জন্য। কিন্তু ক্রিশ্চানেরা একটা বিষয় থেকে মুক্ত হতে পারে না যখন নিজেকে দেখে অন্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বরত অবস্থায়, কিন্তু স্বৰ্গকে আমি ধন্যবাদ জানাই—স্বর্গে কখনও পাপীরা যাবে না, মৃতদের মধ্যেও আমাকে গোনা হবে না। এসব কিছু ছাড়াও আমি আব্রাহমের জন্য একধরনের সহানুভূতি অনুভব করি এবং বিশেষভাবে তার হৃদয়ের প্রতি। এটাও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, উত্তর লেবাননের অর্ধেক মানুষ হল পুরোহিত ও যাজক আর বাকি অর্ধেক হচ্ছে সেইসব যাজকদের বংশধর। তোমার জন্মস্থান ঘাজির[৫] -এর লোকেরা? আমার ধারণা এগুলির মতো কোনোকিছু একটা। যেমন, আমার জন্মস্থান—বিসাররি, সেখানে কতজন পুরোহিত ও যাজক রয়েছে তা বের করা গেলে একটা কাজ হতে পারে। হ্যাঁ, এসো এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল ৬ সম্পর্কে আলাচনা করা যাক। এটার জন্য আমি কোনোভাবেই ভীত নই। যুদ্ধের (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে) আবির্ভাবের আগেই দ্রুত বইটি বেরিয়েছে। বই প্রকাশের দিনই আল-ফওনুন পত্রিকার নামে এক কপি পাঠিয়েছি এবং আজ পর্যন্ত তার কোনো স্বীকৃতির রসিদ পাইনি এবং বিষয়টা আমাকে আহত করেছে এবং এখনও পর্যন্ত তা আমি ভুলিনি। এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল[৬]-এর লেখাগুলো আমার আগের কাজগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিভিন্ন সময়ে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। ওগুলি হচ্ছে আমার আঙুরক্ষেতের অপক্ব আঙুর—আমি ওগুলি লিখেছিলাম নিম্ফ অব দ্য ভ্যালি[৭] এর বহু আগে। সত্যি বলতে কি প্রায় ষোলো বছর আগে আল মুহাজের[৮] পত্রিকায় সবগুলি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। নাসিব আরিদা এগুলি সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এমনকি বারো বছর আগে প্যারিসে লেখা দুটো প্রবন্ধও এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন। শৈশব ও বয়ঃসন্ধির মাঝখানের সময়কালে আমি প্রচুর গদ্য ও পদ্য লিখেছিলাম। কিন্তু ওগুলি প্রকাশের অপরাধ আমি কখনই স্বীকার করব না। আমি এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল-এর একটা কপি পাঠাচ্ছি এই আশায় যে, তুমি লক্ষ্য করতে পারবে এই কাজের ফর্মের চেয়ে উদ্যোগটাই প্রশংসার। 

আমি চার্লস গুয়েরিনকে[৯] (তার কাজ) ভালোবাসি, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুভব করি, তিনি যে স্কুলের (চিন্তার স্কুল) ছাত্র এবং যে বৃক্ষের শাখা ছিলেন তা কখনই উচ্চতর বনভূমির অংশ নয়। উনিশ শতকের শেষাশেষি এবং বিশ শতকের শুরুতে ফরাসি কবিতা চিত্রকলার চেয়েও অধিক জ্বলজ্বলে ছিল। আমি বিশ্বাস করি ভাস্কর রোডিন[১০], চিত্রকর ক্যারিয়ার[১১] এবং সংগীতজ্ঞ দেবুসি[১২] সমস্ত নতুন ভিত্তিকে ভেঙে ফেলে প্রকৃত অর্থে মহৎদের ভেতরে স্থান করে নিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত গুয়েরিন ও তার সমকালীনরা তাদের জন্য নির্ধারিত যুদ্ধপূর্ব মানসিক অবস্থা অনুসরণ করছে। জীবনের সৌন্দর্য সম্পর্কিত সচেতনতা সত্ত্বেও যন্ত্রণা ও উল্লাস, জীবনের গোপনীয়তা ও রহস্য—সবকিছুই প্রতিনিধিত্ব করে নতুন সূর্যাস্তের চেয়েও নবযুগের সূচনাকারীর উজ্জ্বলতাকে। আমি আরও বিশ্বাস করি আরব- বিশ্বের সমকালীন কবি ও লেখকরাও ক্ষুদ্র পর্যায়ে হলেও একই ধারণা, একই অবস্থা এবং একই নবযুগের প্রতিনিধিত্ব করে। 

আরব-বিশ্ব সম্পর্কে আসলে তোমাকে একটা কথা আমার জিজ্ঞাসা করা উচিত : তুমি মিশরের কবি ও লেখকদের অনুসরণের জন্য কেন নতুন পথ দেখাও না? তুমি একাই এ কাজ করতে সক্ষম, সুতরাং কী তোমাকে থামিয়ে রেখেছে? মে, তুমি হলে নতুন প্রভাতের কন্যাদের একজন, সুতরাং কেন তুমি তাদের জাগাও না যারা এখনও ঘুমুচ্ছে। একজন মেধাবী নারী সবসময়ই হাজারজন মেধাবী পুরুষের সমান। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তুমি হলে প্রকৃতই তাদের একজন, যাদের দ্বিধান্বিত আত্মা নিষ্ক্রিয়তার শক্তির দাসত্বে বাঁধা পড়ে আছে, তুমি তাদের মাঝে ভালোই জীবন চালাতে পার এবং পাহাড়ের শীর্ষে উঠতে প্রস্তাব ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়ে তুমি পরিপূর্ণ করতে পারো তাদের। এটাই করো এবং জ্ঞানের ভেতরে নিরাপদ হও এবং সে-ই নিরাপদ হতে পারে যে তার বাড়ি আলোকিত করতে বাতিতে তেল ঢালে এবং তোমার ও আমার বাড়ি কী একটা আরব- বিশ্ব নয়? 

তুমি তোমার প্রত্যাখ্যান ব্যাখ্যা করেছ এভাবে যে, শৈল্পিক ভোজসভায় যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তোমার এই প্রত্যাখ্যান আমাকে বিস্মিত করেছে—সত্যি বলতে কী এই প্রত্যাখ্যানে আমি খুবই আশ্চর্য ও বিস্মিত হয়েছি। তুমি কী স্মরণ করতে পারো না ছবির প্রদর্শনীতে আমরা একসঙ্গেই ছিলাম? তুমি কী ভুলে গেছ কীভাবে আমরা এক ছবি থেকে আরেক ছবির দিকে এগিয়ে গেছি? তুমি কী ভুলে গেছ কিভাবে আমরা বিশাল হলঘরে পায়চারি করেছিলাম খুঁজতে খুঁজতে, সমালোচনা করতে করতে এবং রঙ ও রেখার পেছনের উদ্দেশ্য, প্রতীক, অর্থ এবং উদ্দেশ্যর পেছনে কী থাকে তা আবিষ্কার করতে করতে? কীভাবে তুমি এসব ভুলে গেলে? স্পষ্টত আলোকপ্রবাহী কিন্তু অস্বচ্ছ উপাদান আমাদের ভেতরে কোনো জ্ঞান ছাড়াই ক্রিয়া করে, এমনকি চলাফেরাও। এটা পাল তুলে আকাশ পেরিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, যখন ব্যক্তিগত ছোট্ট ঘরে বসে আমরা সান্ধ্য খবরের কাগজ পড়ছি, এটা কখনও দূরের বন্ধুকে পরিদর্শন করে যখন কাছের বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি, এটা চলাফেরা করে, দূরত্ব, জাদুকরি বনভূমি ও মঠের ভেতর দিয়ে, যখন আমরা একজন মহিলাকে চা পরিবেশন করি, যিনি তার মেয়ের বিয়ে সম্পর্ক আমাদেরকে বিস্তারিত বলেছেন। 

আমাদের ভেতরে আলোকপ্রবাহী কিন্তু অস্বচ্ছ উপাদানগুলি রহস্যময় মে এবং এর কর্মকাণ্ডের বিচিত্রতাও আমাদের অজানা। আমরা স্বীকার করি আর না করি এটা থাকে আমাদের আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য, গন্তব্য ও নৈপুণ্যের ভেতরে; এটা হল আমাদের আত্মা, যার বসবাস আমাদের ঐশ্বরিক অবস্থানের ভেতরে। আমি বিশ্বাস করি তুমি যদি তোমার স্মৃতিকে মৃদু নাড়া দাও তাহলেই তুমি আমাদের প্রদর্শনী পরিদর্শনের কথা স্মরণ করতে পারবে—সুতরাং কেন একটু চেষ্টা করবে না? 

আমার চিঠি দৈর্ঘ্যে বেড়ে গেছে—যখন কোনোকিছুতে একজন আনন্দ খুঁজে পায় অন্যজন উদ্যোগ নেয় সেই আনন্দকে দীর্ঘায়িত করতে। আমি তোমার সঙ্গে এই সংলাপ শুরু করেছি মধ্যরাতেরও আগে, এখন নিজেকে খুঁজে পেলাম যখন মধ্যরাত ও সকালের মাঝখানে কিছু সময় বাকি আছে, কিন্তু যতদূর মনে আছে সে-বিষয়ে একটা শব্দও বলিনি, চিঠি শুরু করার সময় আমি যা বলতে চেয়েছিলাম। 

আমার ভেতরের সহজাত বাস্তবতা হচ্ছে পরিপূর্ণ নির্যাস গ্রহণ, যে স্বপ্ন বিনিদ্ৰতায় আবৃত এবং তা কিছুই নয়, কিন্তু নীরবতা। 

তোমাকে আমার এক হাজার একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার বাসনা ছিল। কিন্তু মোরগ ডাকতে শুরু করেছে এবং আমি একটা প্রশ্নও করিনি। উদাহরণ হিসেবে চেয়েছিলাম যে, বন্ধুত্বের ধ্বনি হিসেবে কী ‘স্যার’ শব্দের কোনো অস্তিত্ব আছে? আমি আমার অভিধানে বহু খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু দেখলাম না, যা আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে, আমি ভেবেছিলাম আমার অভিধানের কপিটি আদর্শ কপি—কিন্তু বোধ হয় আমি ভুল করেছি। এটা খুবই সামান্য প্রশ্ন। অন্য ঘটনা ও অন্য রাত্রির জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমি এড়িয়ে যাব—কারণ আমার সন্ধ্যা এখন বুড়ো হয়ে গেছে এবং বুড়ো রাত্রির ছায়ায় আমি তোমাকে লিখতে চাই না। 

নতুন বছরে তোমার করতল নক্ষত্রপুঞ্জে পূর্ণ হয়ে থাকুক আশা করছি। মে, ঈশ্বর তোমাকে পাহারা দিন এবং রক্ষা করুন। 

একান্তই তোমার 

জিবরান কহলীল জিবরান 

পুনশ্চ : চিঠি শেষ করার পর আমার জানালা খুলে দেখি পুরো শহরটা সাদা হয়ে আছে, আসলে চারদিকে বরফ পড়েছে। এটা একটা ত্রাসোদ্দীপক দৃশ্য এবং অসম্ভব খাঁটি, যা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় উত্তর লেবাননে আমার শৈশবের দিনগুলিতে, যখন আমি বরফকে বিভিন্ন আকার ও চেহারা দিতে ভালোবাসতাম, যা সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গলে যায়। 

আমি এইসব বরফের ঝর্নাকে ভালোবাসি যেমন ভালোবাসি, ঝড়। আমি এখন বাইরে যাব প্রতিটি মিনিট হাঁটব সাদা ঝড়ের সঙ্গে। কিন্তু আমি একা হাঁটব না। 

জিবরান 

***

১. লেভি হচ্ছে যাকোবের তৃতীয় পুত্র। তিনি ইহুদি আইনদাতা ও ধর্মযাজক ছিলেন। 

২. ‘দ্য ব্রোকেন উইংস’ হচ্ছে জিবরানের একটি আরবি নভলেট, ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয়। 

৩. ‘টুনেয়ন্টি ড্রইংস’ হচ্ছে এ্যালিস র‍্যাফেল-এর ভূমিকা-সম্বলিত জীবরানের একটা ড্রইং-এর বই। ১৯১৯ সালে নিউইয়র্কে প্রকাশিত হয়। 

৪. ‘খুরুশকাফ’ হচ্ছে দুটি আরবি শব্দ খুরি (যাজক) ও উসকাফ (বিশপ)-এর সম্মিলনে তৈরি সংযুক্ত শব্দ। 

৫. ঘাজির, কিসারওয়ানে অবস্থিত একটি লেবানীয় গ্রাম। জিয়াদাহ পরিবারের বাড়ি যে-শহরে, এই গ্রাম তার খুবই কাছে। এখানে মে, প্রায়ই গ্রীষ্ম যাপন করতেন। 

৬. ‘এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল’ জিবরানের প্রবন্ধ ও গদ্য কবিতার সংগ্রহ। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়।

৭. জিবরানের ‘নিম্ফ অব দ্য ভ্যালি’ প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। এই গ্রন্থে জিবরান অতিমাত্রিক গোঁড়ামিকে আক্রমণ করেছন। 

৮. ‘আল মুজাহের’ (আভিবাসী) একটি আরবি সংবাদপত্র, মাইকেল রুস্তম কর্তৃক ১৮৯৫ সালে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৯. চালর্স গুয়েরিন (১৮৭৩-১৯০৭) একজন ফরাসি কবি। তিনি প্রচুর আবেগপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কবিতা লিখেছেন। 

১০. অগাস্টি রোডিন (১৮৪০-১৯১৭) একজন ফরাসি ভাস্কর। জিবরানের স্টাইলের ওপর তার সুশোভন প্রভাব ছিল এবং রোডিনই প্রথম ব্যক্তি যিনি জিবরানের কাজকে উউলিয়াম ব্লেকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। 

১১. ইউজিন ক্যারিয়ার (১৯৪৬-১৯০৬) একজন ফরাসি চিত্রকর। ধোঁয়াশাপূর্ণ পটভূমির জন্য তার ছবি সেকালে বিখ্যাত ছিল। 

১২. ক্লদ দেবুসি (১৮৬২-১৯১৮) প্রতিনিধিত্বশীল ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট সংগীত সৃষ্টিকারী। তিনি তাঁর সময়ে খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। 

.

নিউ ইয়র্ক ৩ নভেম্বর ১৯২০ 

প্রিয় বন্ধু মে, 

আমার সাম্প্রতিক নীরবতা কোনোকিছুই নয়, কিন্তু একজন দ্বিধান্বিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষের নীরবতা—সে কারণে আমি প্রায়ই বসেছি আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার উপত্যকার মাঝখানে, তোমাকে বলতে এবং পুনরায় আবেদন জানাতে—কিন্তু দেখছি কিছুই বলার নেই। আমি বলার কিছুই দেখি না মে, কারণ আমি অনুভব করি বলার মতো কিছুই তুমি ফেলে যাওনি এবং তোমাকে বলতে চাই সেইসব অদৃশ্য হাতের অদৃশ্য সুতোর বয়ন ছিন্ন করতে, যা চিন্তা থেকে চিন্তায় এবং আত্মা থেকে আত্মায় বন্ধন সৃষ্টি করে। একবার একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও এই ঘরে বসে দীর্ঘসময় ধরে তোমার মুখ স্মরণ করেছিলাম। অন্যদিকে, তুমিও মাথা নাড়িয়ে হাসতে শুরু করলে এমন হাসি, যা দ্বন্দ্ব এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার ভেতরে দৃষ্টিগোচর (প্রকাশিত) হয়; যার কারণে আমি অস্থির। এখন কী বলব তোমাকে, যখন তোমার চিঠি আমার সামনে খোলা? এই উঁচুমানের চিঠি আমার দ্বন্দ্বকে অস্বস্তিত্বে পরিণত করেছে। আমি অস্বস্তিতে ভুগছি আমার নীরবতাকে নিয়ে, আহত হওয়া নিয়ে। আমি অস্বস্তিতে ভুগছি আমার ভেতরের গর্ব নিয়ে, যা আমাকে মুখে আঙুল দিয়ে নীরব থাকতে বলেছে। গতকালই আমি বিবেচনা করেছি যে, তুমিই হলে সেই ‘অপরাধী’ কিন্তু আজ তোমার দয়া ও মহানুভবতা আমাকে দুই দেবদূতের মতো আলিঙ্গন করে—নিজেকে তখন আমার অপরাধী মনে হয়। 

কিন্তু বন্ধু, আমার কথা শোনো, আমার নীরবতা ও আমার আহত অনুভূতির কারণগুলি তোমাকে জানাব। আমি দুই ধরনের জীবনযাপন করি। একধরনের জীবন কাটাই কাজের মাঝে, খোঁজাখুঁজির মাঝে, লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ও তাদের অন্তর্গত জগতে হানা দিয়ে এবং মানুষের মনের গভীরে বসবাসরত গুপ্তরহস্য অনুসন্ধান করে। অন্যধরনের জীবন কাটাই দূরে কোথাও গিয়ে—শান্ত, ত্রাসোদ্দীপক, জীবনীশক্তিতে ভরপুর কিন্তু তা সময় অথবা স্থানের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়। গতবছর যখনই দূরে কোথাও গেছি, আমি দেখতে পেয়েছি আমার পাশে অন্য একটি আত্মাকে—প্রতি মূহূর্তের চিন্তা বিনিময় করেছি এবং ভাগাভাগি করেছি গভীরতম আবেগ। এটা আমি শুরুতে আরোপ করেছিলাম মৌলিকতাকে বিশুদ্ধ ও সাধারণ করতে, কিন্তু খুব দ্রুত না হলেও দুইমাস পার হয়েছিল, তারপর আমি অনুধাবন করতে শুরু করেছিলাম গোপন দূরত্বের অস্তিত্ব, যে মৌলিকতাগুলি স্বাভাবিক পরিকল্পনার চেয়ে অধিক সুশোভন। একইভাবে অদ্ভুত ঘটনা হল—এই ভ্রমণ থেকে প্রায়ই আমি এমন একধরনের অনুভূতি নিয়ে ফিরি, যার হাতে কুয়াশার মতো স্পর্শ লেগে থাকে এবং আমার মুখের ওপর দিয়ে চলে যায় এবং কখনও কখনও আমি মৃদু ও চমৎকার শব্দ শুনি, ক্ষুদ্র নবজাত শিশুর নিশ্বাস প্রতিধ্বনিত হয় আমার কানে। 

কেউ কেউ বলে আমি একজন কল্পনাবিলাসী। কিন্তু আমি জানি না, এই শব্দ বলে তারা কী বোঝাতে চায়? যাহোক আমি জানি আমি ততটা কল্পনাবিলাসী নই, যতটা নিজের ভেতরে আচ্ছন্ন। এমনকি আমি যদি তাই হই তাহলে আমার আত্মা তা বিশ্বাস করবে না। মে, এই আত্মা জীবনে এমন কিছুই দেখে না, যা তার নিজের নয় এবং বিশ্বাস করবে না কী অভিজ্ঞতা সে নিজে নিজে অর্জন করেছে এবং যখন সে কোনোকিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সেই কোনোকিছুই তার নিজস্ব বৃক্ষের শাখায় পরিণত হয়। গত বছর আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং এটা একটা অভিজ্ঞতা বটে—যা স্বপ্ন দেখেছিলাম তা নয়। বেশ কয়েকবার এমন অভিজ্ঞতা অতিক্রম করেছি এবং চেতনা ও মন উভয় সম্পর্কেই অৰ্জন করেছি প্রাথমিক জ্ঞান। এ অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা গোপন হিসেবে পুষে রাখার। কিন্তু আমি তা করিনি। আমি আমার একজন (নারী) বন্ধুর সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছি। আমি তার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছি, কারণ আমি অনুভব করেছি যে, এসময়ে এটা করা জরুরি। তুমি কী জানো আমার বন্ধু আমাকে কী বলেছে? তাৎক্ষণিকভাবে সে বলে এটা কিছুই নয়, কিন্তু একটা গীতিকবিতা। যদি কোনো মা তার শিশুকে বহন করে বলে যে তার কাঁধে একটা কাঠের পুতুল ছিল এবং তা সে বহন করছিল একটা সস্তা জিনিসের জন্য, তাহলে তার (আমার বন্ধুর) কী উত্তর হতে পারে এবং কী সে অনুভব করতে পারে? 

কয়েক মাস কেটে গেছে এবং ‘গীতিকবিতা’ শব্দটি আমার হৃদয়ে আমোচনীয়ভাবে খোদিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বন্ধু তাতে সন্তুষ্ট হয়নি এবং এতই অসন্তুষ্ট হয়েছে যে, সে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, ক্রুদ্ধ তিরস্কারের সঙ্গে যার পিঠ খামচে ধরা ছাড়া আমি একটি শব্দও বলতে পারছি না; তার মুখোশ ঢাকা অজ্ঞাত বিষয় আমি নাও দেখে থাকতে পারি এবং সবসময়ই আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাত সে নখ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। তারপর হতাশায় নিজেকে পরিপূর্ণ করে তুলি। আমার সমস্ত উপাদানগুলি হতাশার চেয়েও অধিক যন্ত্রণাদায়ক, ‘তুমি ব্যর্থ হয়েছ’ কারও সম্পর্কে এ ঘোষণা দেওয়ার চেয়েও কঠিন 1 মে, নৈরাশ্য হচ্ছে কারও হৃদয়ের স্রোতের নিম্নতম ভাটার অবস্থাটি। মে, নৈরাশ্য হচ্ছে একটা শব্দহীন অনুভূতি। সে-কারণে আমি ঐসব মাসগুলিতে প্রায়ই তোমার মুখোমুখি বসি এবং কিছু না বলে তোমার মুখ মনে করার চেষ্টা করি। আর এরকম অবস্থায় থেকে আমি তোমাকে লিখিনি যখন সত্যিই আমার লেখা উচিত ছিল এবং সে-কারণে নিজেকে বলতে অভ্যস্ত হয়েছি : ‘এখানে আত্মার পালন করার মতো কোনো ভূমিকা নেই।’ কিন্তু প্রত্যেক শীতেরই হৃদয়ে রয়েছে বসন্তের ধুকধুকানি এবং প্রতিটি রাতের ছদ্মবেশের পেছনে রয়েছে একটা হাস্যরত সকাল, সুতরাং আমার নৈরাশ্য একটা আশায় রূপান্তরিত হয়। কী ঐশ্বরিক সময় ছিল সেটা, যখন আমি আমার ড্রইং ‘অনন্তযাত্রা’ সৃষ্টি করি। ধ্যানের ভেতরে এক নারীর গলায় অন্য নারীর ঠোঁটের স্পর্শ কেমন ত্রাসোদ্দীপক ও মধুর। আমাদের ভেতরের অস্তিত্ব থেকে প্রবহমান আলো কী দ্যুতিময়—সত্যিই মে, কী দ্যুতিময় সেই আলো। 

সেই পুরুষ সম্পর্কে আমার কী বলার আছে, সে দুজন নারীর ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে—একজন নারী সেই পুরুষটির স্বপ্নের বাইরে বিনিদ্রতাকে বয়ন করে চলেছে, অন্যজন তার বিনিদ্রতা থেকে তৈরি করছে তার স্বপ্ন। সেই হৃদয় সম্পর্কে আমি কী বলতে পারি, যাকে ঈশ্বর দুটি বাতির ভেতরে স্থাপন করেছেন? এরকম পুরুষ সম্পর্কে আমি কী বলতে পারি? আমি কি বলব সে বিষাদগ্রস্ত? আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি সেই স্বার্থপরতা, যা এই বিষাদগ্রস্ততার অংশ নয়। আমি কী তাকে সুখী বলব? আমি জানি না, তবে এটা জানি মে, সেই স্বার্থপরতা তার সুখের অংশও নয়। আমি কী বলব সে এই পৃথিবীতে একজন আগন্তুক? আমি জানি না, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কী কখনও চাও সে তোমার কাছে আগন্তুক হয়ে থাকে? যদি সে সত্যিই পৃথিবীতে একেবারেই সঙ্গীহীন এক একাকী মানুষ হয় তাহলে কে তার ভাষার একটি শব্দও বুঝতে পারবে—যা তার আত্মার ভাষা? আমি জানি না, কিন্তু জানতে চাই তুমি কী কখনও তার সঙ্গে সেই ভাষায় কথা বলতে অস্বীকার করবে—যে বিষয়ে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞান কারও নেই। তুমি কী পৃথিবীতে একজন আগন্তুক নও? তুমি কী তোমার পরিবেশ অর্থাৎ তোমার উদ্দেশ্য, আকাঙ্ক্ষা, চুক্তি ও প্রবণতার কাছে আগন্তুক নও? বলো মে, বলো, পৃথিবীতে কী এমন লোক অনেক আছে যারা তোমার আত্মার ভাষা বুঝতে পারে? কত সময় আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে, তুমি কী এমন কাউকে অতিক্রম করে এসেছ যে তোমার নীরবতার ভেতরে তোমার কথা শুনতে পেয়েছে অথবা তোমাকে বুঝতে পারে তোমার দৃঢ়তার ভেতরে কিংবা যে তোমার জীবনের পবিত্রতার পবিত্রতম সঙ্গ দেয়, যখন তুমি তার মুখোমুখি একটা বাড়িতে বসো, যে-বাড়িটা অন্যান্য বাড়িগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। 

ঈশ্বর তোমাকে ও আমাকে সেইসব লোকের তালিকাভুক্ত করেছেন, যাদেরকে তিনি বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রেমিক এমনকি প্রশংসা করার মানুষ দিয়ে সাহায্য করেছেন এবং আমাকে বলো সেইসব অকৃত্রিম ও অতি উৎসাহী বন্ধুদের ভেতরে কী একজনও আছে, যার কাছে দুজনের কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারি, ‘একদিনের জন্য তুমি আমার খিটখিটে মেজাজটাকে বহন করবে?’ তাদের ভেতরে কী একজনও আছে যে জানে আমাদের গানের পেছনেও একটা গান আছে, অন্য কোনো শব্দ যাকে থামাতে পারে না এবং তার কোনো হৃদয়তন্ত্রী নেই যেখানে সুর বাঁধা যায়। তাদের ভেতরে এমন কেউ কী আছে, যে সবসময় জানতে আসবে আমাদের দুঃখের আনন্দ এবং আনন্দের দুঃখগুলি? 

তুমি আমাকে বলো : ‘তুমি একজন চিত্রকর ও কবি এবং কবি ও চিত্রকর হয়েই তোমার সুখী থাকা উচিত।’ কিন্তু মে, আমি কবিও নই, চিত্রকরও নই। আমি আমার দিন ও রাত্রিগুলো কাটাই ছবি এঁকে এবং লিখে, কিন্তু ‘সেই আমি’ (সেটা আমার আত্মা) আমার দিন ও রাত্রির ভেতরে বসবাস করে না। মে, আমি হলাম একটা অস্পষ্টতা, আমি হলাম ধোঁয়াশা যা বস্তুকে ছদ্মবেশ পরায়, কিন্তু কখনও তাদেরকে একত্রিত করে না। আমি হলাম সেই ধোঁয়াশা যা বৃষ্টির পানিতে অপরিবর্তিত থাকে। আমি ধোঁয়াশা, আর এই ধোঁয়াশাই আমার একাকিত্ব এবং হয়ে ওঠা অস্তিত্ব এবং আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা এর মধ্যেই বসবাস করে। যাহোক, আমার দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই ধোঁয়াশাই আমার বাস্তবতা, অন্য ধোঁয়াশার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তা আকাশ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়, অপেক্ষা করে এই শব্দগুলো শোনার জন্য, ‘তুমি একা নও, আমরা দুজন আছি, আমি জানি তুমি কে?’ 

বলো, বলো প্রিয় বন্ধু আমার, পৃথিবীতে এমন কী কেউ আছে যে, স্বেচ্ছায় আমাকে বলবে : ‘আমি হলাম অন্য ধোঁয়াশা, হে ধোঁয়াশা, চলো আমরা পাহাড় ও উপত্যকাকে ছদ্মবেশ পরাই, চলো আমরা বৃক্ষের ভেতর ও ওপর দিয়ে ভ্রমণ করি, চলো ঢেকে ফেলি উঁচু পাহাড়কে, চলো দুজনে মিলে সব সৃষ্টির হৃদয় ও রোমকূপে প্রবেশ করি এবং ইতস্তত ঘুরে বেড়াই সেইসব দূরবর্তী জায়গায়, যেগুলি দুর্ভেদ্য এবং অনাবিষ্কৃত?’ বলো মে, তোমার গণ্ডির ভেতরে এমন একজনও কী আছে যে আমাকে এ ব্যাপারে একটিমাত্র শব্দ বলতে সক্ষম হবে অথবা স্বেচ্ছায় বলবে। এসব কিছুর পর তুমি আশা করছ আমি হাসব এবং ক্ষমা করব। 

আজ সকালে আমি অনেক হেসেছি। নিজের আত্মার গভীরে এখনও হাসছি। আমি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে হাসছি এবং আমি দীর্ঘ সময় ধরে হাসতে থাকব। আমি হাসছি, যেন হাসা ছাড়া কিছু না-করার জন্যই আমি সৃষ্টি হয়েছি। কিন্তু ক্ষমাশীলতা হচ্ছে একটি ভয়ানক শব্দ, যা বিধ্বস্ত করে, ক্ষত সৃষ্টি করে, শক্তি প্রয়োগ করে অস্বস্তিতে মাথা নোয়াতে এবং সেই পবিত্র উদ্যোগের মুখোমুখি আতঙ্কিত হয় এবং নারীর ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই আমি হলাম একমাত্র অপরাধী। নীরবতা ও নৈরাশ্যের ভেতরে থাকতে আমি পুনরায় ব্যার্থ হয়েছি- সুতরাং আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করার জন্য আমি প্রার্থনা করি, যেসব ভুল এতদিন আমি করেছি। 

এটা অধিক শোভন হবে ‘বাহিথাতু আল-বাদাইয়া’[১] সম্পর্কে প্রারম্ভিক মন্তব্য করা, কিন্তু ব্যক্তিগত ঘটনা আমাদেরকে খুবই আন্দোলিত করেছে এবং ব্যক্তিগত ঘটনার শক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও উপলব্ধি থেকে আমাদেরকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে আসে। আমি ‘বাহিথাতু আল-বাদাইয়া’র মতো কোনো আরবি গ্রন্থ পড়িনি। এরকম রেখা ও রং দিয়ে আঁকা দুটো প্রোট্রেট আমি জীবনে দেখিনি। আরও দেখিনি একের ভেতরে দুই প্রোট্রেট: একজন মহিলা লেখক ও সংস্কারকের পোট্রেট এবং একজন নারীর পোট্রেট যে নারী লেখক ও সংস্কারকের চেয়েও মহৎ। আমি জীবনে কখনও এত ভালোভাবে এক আয়নায় দুই নারীর মুখ প্রতিফলিত হতে দেখিনি—এক নারীর মুখ অর্ধেক পৃথিবীর ছায়ার কারণে অজ্ঞাত এবং অন্য নারীর মুখ সূর্যের রশ্মিতে মোহগ্রস্ত। আমি বলি : ‘একজন নারীর মুখ অর্ধেকটা পৃথিবীর ছায়ায় আবৃত’, কারণ দীর্ঘ সময়ের পর আমি অনুভব করেছি এবং এখনও অনুভব করি—’বাহিথাতু আল বাদইয়া’ তার শারীরিক পরিবেশ মৃত্যু পর্যন্ত কখনই অতিক্রম করতে পারেনি অথবা পারেনি জাতীয় ও সামাজিক প্রভাব থেকে নিজে মুক্ত হতে। অন্য লেবানীয় মুখটি হচ্ছে সূর্যরশ্মির দ্বারা মোহগ্রস্ত—আমি বিশ্বাস করি—সে- ই প্রাচ্যদেশীয় প্রথম নারী যে স্বর্গীয় মন্দিরে আরোহণ করে, যেখানে সমস্ত মানসিক অনুভূতি তাদের অস্তিত্বও আন্দোলিত করে এবং হয়ে ওঠে, যেভাবে প্রথা ও চুক্তির ধুলো এবং উপলব্ধির শক্তি থেকে বেরিয়ে আসে তারা। সৃষ্টির সম্মিলন এবং দৃশ্য ও অদৃশ্য এবং জানা-অজানা যেগুলির অস্তিত্ব আছে—সবকিছুই উপলব্ধি করতে হলে এটাই হচ্ছে প্রাচ্যদেশীয় নারীর প্রথম মুখ এবং অবশেষে সময় যখন লেখকের রচনা ও কবির কবিত্ব নিক্ষেপ করে বিস্মৃতির নরকে, যেখানে ‘বাহিথাতু আল বাদাইয়া’র গ্রন্থ গবেষক, চিন্তাবিদ ও বিনিদ্র মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর একটা আকর্ষণ মাত্র। মে, তুমি হচ্ছ একটা কান্নার শব্দ, যে বন্যতার ভেতরে বসবাস করে, তুমি হলে একটা ঐশ্বরিক কণ্ঠস্বর এবং তা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে উন্মুক্ত ঐশ্বরিক এলাকায় সময়ের প্রান্তসীমা পর্যন্ত।

এখন আমার অবশ্যই উচিত তোমার মিষ্টি প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া, যা তুমি জানতে চেয়েছ। তোমার প্রথম প্রশ্ন, ‘আমি কেমন আমি’? ‘আমার কেমনত্ব’ সম্পর্কে ভাবার প্রচুর সময় আমাকে দেওয়া হয়নি। আমার মনে হয়, আমি ভালো, তা সত্ত্বেও বিভিন্ন আকৃতির চাকা বিবিধ বিহ্বলতার প্যাচানো স্ক্রুর আদলে আমার প্রাত্যহিক জীবন কী মধুর।

‘আমি কী লিখছি?’ আমি লিখছি এক অথবা দুই লাইন ‘দিন ও রাত্রি নামার মাঝখানে’। ‘দিন ও রাত্রি নামার মাঝখানে’ বলেছি এ কারণে, আমি দিনের আলো কাটাই আমার বিশাল তেলরঙের ছবির ওপর কাজ করে, শীতের আগে যা আমাকে শেষ করতেই হবে। চুক্তির কারণেই ছবিটা শেষ করার তাগাদা রয়েছে অথচ প্যারিস এবং প্রাচ্যে আমার শীত কাটানোর কথা ছিল। ‘আমি কী অনেক কাজ করি?’ আমি সবসময়ই কাজ করি। এমনকি যখন আমি জেগে থাকি তখনও। কাজের ক্ষেত্রে আমি কঠিন পাথরের মতো, কিন্তু আমার প্রকৃত কাজ ছবি আঁকা বা লেখা নয়। মে, আমার ভেতরে অন্য একটা সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি রয়েছে—শব্দ দিয়ে যার করার কিছু নেই, রেখা দিয়েও নয়, রং দিয়েও নয়। যে কাজ করার জন্য আমি জন্মেছি, ব্রাশ আর কলমের সেখানে করার কিছু নেই। 

‘আজ আমি কোন্ রঙের স্যুট পরেছি জানো? আমার অভ্যাস একই সময়ে দুটো স্যুট পরা—একটা হচ্ছে কাপড় যা সুতোয় বোনা এবং দর্জি দিয়ে তৈরি হয়েছে; অন্যটি তৈরি মাংস, হাড় এবং রক্ত দ্বারা। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি একটা ঢিলেঢালা জামা পরেছি, এটা বেশ দীর্ঘ এবং কালি ও রঙে আচ্ছন্ন—এটা দেখে দরবেশের আলখাল্লা মনে হওয়াও বিচিত্র নয়। পাশের ঘরে গিয়ে আমি নিজেই আমার পোশাক খুলেছি, তখন শুধুই রক্ত, মাংস ও হাড়ের জামা—এরকম সময় প্রায়ই আমি চাই যেন কেউ আমাকে না দেখে, বিশেষ করে যখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি। 

‘আজ সকাল থেকে ক’টা সিগারেট খেয়েছি?’ কী মধুর প্রশ্ন এবং কী কঠিন এর উত্তর দেওয়া। মে, আজ হচ্ছে সেইদিন, যে দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিগারেট খাওয়া যায় এবং সকাল থেকে অন্তত কুড়িটা সিগারেট জ্বালিয়েছি। আমার মত হল ধূমপান অসংযত প্রয়োজনের চেয়ে অধিক আনন্দদায়ক। আবার কখনও একটা সিগারেট না জ্বালিয়েও আমি দিন কাটাতে পারি। 

আমার বাড়ি, এখন পর্যন্ত যার দেয়াল এবং ছাদ তৈরি হয়নি—যা আমাদেরকে বন্দি করতে চায়—অথচ বালির সমুদ্র আর স্বর্গীয় সমুদ্র প্রাচীনকালে যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে—গভীর, তীরহীন এবং ঢেউয়ে পরিপূর্ণ। ঐ সমুদ্রে আমি যে জাহাজে ভ্রমণ করি তাতে পাল তুললেও জাহাজ ধীরগতিতে চলে। কেউ কী আছে, যে সক্ষম অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে একটা আলাদা পাল দেবে। আমি বিস্মিত হই, কে সক্ষম এবং কে স্বেচ্ছাকৃতভাবে পারে। 

টুয়ার্ডস গড বইটি ফর্মের দিক দিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন এবং এই বইয়ের সেরা ড্রইং গুলো আঁকা হয়েছে মধ্যদিনের বাতাসে এবং এর ভাবমূর্তি আঁকা হয়েছে চাঁদের মুখাবয়বকে। অন্যদিকে ‘আল-মুসতাত্তহিদ’ তিন সপ্তাহ আগে দ্য ফোররানার[২] নামে প্রকাশিত হয়েছে। এর একটা কপি তোমাকে পাঠিয়েছি। একই খামের ভেতরে আল আওয়াসিফ’ (দ্য টেম্পেস্ট)[৩]-এর একটা কপি এবং আমার আঙুরক্ষেতের অপক্ব আঙুর এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল-এর তৃতীয় কপিটি তোমাকে পাঠিয়েছি। আমি আমার প্রকাশকের গ্রীষ্মকালীন তালিকা পাঠাতে পারিনি, কারণ পুরো গ্রীষ্মকালই অন্য একটা কাজে আমাকে বাইরে থাকতে হয়েছিল। ড্রইং, মৃৎশিল্প, গ্লাস, পুরোনো বই, বাদ্যযন্ত্র এবং মিশরীয়, গ্রিক ও গথিক মূর্তিগুলি চিরন্তন গুপ্ত বিষয় এবং অমরত্বকে প্রকাশ করে আর এসব শব্দ গৃহীত হয়েছে ‘ঈশ্বরের গ্রন্থ’ থেকে। আমি প্রায়ই এসবের মুখোমুখি বসেছি এবং চিন্তা করেছি এদের দ্বারা আমার ভেতরে সৃষ্টি দীর্ঘায়িত হয়, মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়েছে যতক্ষণ না আমার চোখের সামনে তারা অদৃশ্য হয়ে যায় প্রাচীন ভূতদের দ্বারা পুনস্থাপিত হয়ে—যারা তাদেরকে অদৃশ্য জগৎ থেকে দৃশ্যমান জগতে ফিরিয়ে এনেছে। যদিও আমার কালো পাথরের একটা ক্যালডীয় মূর্তি নেই। গত বসন্তে এক ইংরেজ বন্ধু (বৃটিশ যুদ্ধাভিযানে কাজ করে) আমাকে লিখেছিল এবং বলেছিল : ‘যদি খুঁজে পাই তাহলে ওটা তোমার।’ 

আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি এবং একটাও বাদ পড়েনি। চিঠির প্রথম পাতা শুরু করার সময় আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, সে-সম্পর্কে মাত্র একটা শব্দ বলে এখন চিঠির এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। আমার ভেতরের ধোঁয়াশা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায়নি এবং নীরবতা—সেই উড্ডয়ন ও কাঁপুনির নীরবতা, কখনও বক্তব্যে পরিণত হবে না। তুমি কী তোমার হাত দিয়ে এই ধোঁয়াশা অনুভব করবে না? তুমি কী চোখ বন্ধ করে নীরবতার এসব উচ্চারণ শুনবে না? তুমি পুনরায় পার হবে না উপত্যকা, যেখানে একাকিত্ব পাখির মতো শূন্যে ভেসে থাকে, ভেড়ার মতো ধীরগামী, স্রোতের মতো প্রবহমান এবং ওকগাছের মতো দণ্ডায়মান। মে, তুমি কী আর একবার এই পথ দিয়ে যাবে না? ঈশ্বর তোমাকে পাহারা দিন এবং রক্ষা করুন। 

জিবরান 

***

১. বাহিথাতু আল-বাদাইয়া (দ্য ডেজার্ট রিসার্চার) হচ্ছে মিশরীয় মহিলা লেখক মালাক এইচ নাসিব (১৮৮৬-১৯১৮)-এর ছদ্মনাম। তার ওপর লিখতে গিয়ে মে তাঁর গ্রন্থে এই নাম ব্যবহার করেছেন। গ্রন্থটি প্রকাশ করে দার-আল-হিলাল। প্রকাশকাল ১৯২০। 

২. দ্য ফোররানার হচ্ছে জিবরানের ইংরেজিতে লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়। প্ৰথম গ্ৰন্থ দ্য ম্যাডম্যান-এর মতো একটা তুলির স্পর্শ এবং চিত্র দ্বারা গভীর সুফিতত্ত্ব প্রবণতা এই গ্রন্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 

৩. আল-তাওয়াসিফ (দ্য টেম্পেস্ট) হচ্ছে জিবরানের প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং গদ্যকবিতার সংগ্রহ। আরবিতে লেখা। এই লেখাগুলো ১৯১২-১৯১৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন আরবি সংবাদপত্র ও বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। 

.

বস্টন ১১ জানুয়ারি ১৯২১ 

মে, 

আমরা একটা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছেছি এবং আমাদের নিচে বিস্তৃত সমতল ভূমি, বন ও উপত্যকা, সুতরাং চলো আমরা এখানে বসে অল্পকিছু কথা বলি। আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, কারণ দূরে আরও উঁচু পাহাড়ের চূড়া দেখতে পাচ্ছি—সূর্যাস্তের আগে অবশ্যই আমাদের সেখানে পৌঁছাতে হবে, কিন্তু তুমি খুশি না-হওয়া পর্যন্ত এ-জায়গা আমরা ত্যাগ করব না, এমনকি এক পা-ও এগুব না আমরা যতক্ষণ না তোমার মনে শান্তি আসে। 

আমরা একটা ভয়ানক বাধা অতিক্রম করেছি, তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্বন্দ্ব ছাড়া অবশ্যই নয় এবং আমি স্বীকার করছি যে, আমি অতিরিক্ত চাপের কারণে অনড় অবস্থা গ্রহণ করেছি, কিন্তু আমার অনড় অবস্থা ছিল পূর্ব-পরিজ্ঞেয় (আগাম জানা যায় এরকম), যার ফলাফল হচ্ছে তথাকথিত ইচ্ছাশক্তির চেয়ে অধিক শক্তিশালী কিছু একটা। আমি আরও স্বীকার করছি যে, কোনো কোনো বিষয়ে আমি স্বাধীনতা ছাড়াই হস্তক্ষেপ করেছি—সেখানে কী জীবনের বৃত্ত নেই যা স্বাধীনতার ওপরে নিয়ে পৌঁছায়? আমরা যদি নিজের ভেতরে ফিরে না আসি তাহলে স্বাধীনতা পাথরে পরিণত হবে। তোমার বর্তমান অভিজ্ঞতা যে- কোনোভাবেই হোক তা অতীতের অভিজ্ঞতাগুলির মতোই, আমি সেগুলির বর্ণনা দেব না—কিন্তু তার সবগুলিই অদ্ভুত ও নতুন এবং হঠাৎ হঠাৎ তারা আসে। আমি কায়রোতে ছিলাম এবং তোমাকে বলেছিলাম শুধু মুখের কথা—তাতে দেখা যায় এক স্বার্থপর যবনিকার পদচিহ্ন ছাড়া এক স্বতন্ত্র রীতি এবং আমাদের মাঝখানে ভুল-বোঝাবুঝির কোনো শব্দ উত্থিত হয়নি। আসলে সে-সময় আমি কায়রোতে ছিলাম না, চিঠি ছাড়া তোমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না এবং এসব বিষয় নিয়ে চিঠি লেখা—একটা সহজ ও সাধারণ বিষয়কে আসলে জটিল করে তোলে এবং সবচেয়ে ঔপাদানিক বিষয়গুলির ওপর আনুষ্ঠানিকতার বিশাল ছদ্মবেশ ছুঁড়ে দেয়। সে-কারণে প্রায়ই আমরা যখন একটা সাধারণ চিন্তাকে ব্যাখ্যা করতে চাই, তখন যে শব্দ আমাদের কাছাকাছি আমরা তা-ই ব্যবহার করি অর্থাৎ শব্দ আমাদের কলম ও কাগজের ওপর যা ঢেলে দিতে অভ্যস্ত তার ফলাফল হচ্ছে সাধারণভাবে একটা ‘গদ্যকবিতা’ অথবা ‘চিন্তাশীল প্রবন্ধ’। এর কারণ হচ্ছে, আমরা যে ভাষায় অনুভব করি এবং চিন্তা করি, যা আমাদের লেখার ভাষায় চেয়ে অধিক সৎ এবং আন্তরিক। অবশ্যই আমরা কবিতা পছন্দ করি, হতে পারে তা গদ্যে অথবা পদ্যে এবং উভয়ই প্রতিফলিত হয় এ-ধরনের প্রবন্ধ ও আমরা পছন্দ করি। চিঠি লেখা হল মৃত্যুঞ্জয়ী আবেগের মতো একটি বিষয়। এমনকি আমার সেই স্কুলের দিনগুলোতে যতদূর সম্ভব বহুশ্রুত উক্তিগুলি এড়িয়ে যেতাম, কারণ আমি অনুভব করতাম এবং এখনও অনুভব করি যে, ওগুলি চিন্তা এবং উপলব্ধি দুটোই—যা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু এটা আমার কাছে এখন আবির্ভূত হয়, যা থেকে আমি পালাতে পারি না এবং যা আমি ঘৃণা করি—আমার কাছে মনে হয় আমি গত দেড়বছর ধরে আমাকে খুঁজেছি সেখানে, যেসব স্মৃতির ভেতর দিয়ে পনেরো বছর পথ চলেছি এবং আমার কাছে প্রমাণিত হয়েছে, আমার চিঠিই হচ্ছে সমস্ত ভুল-বোঝাবুঝির ফলাফল। 

আমি আবার বলছি, আমি কায়রোতে ছিলাম—আমাদের উচিত কিছুক্ষণের জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করা—যেমন আমরা সমুদ্রের ওপরে ছিলাম অথবা নক্ষত্রের ওপরে কিংবা ফুল ফুটে থাকা আপেলগাছের ওপরে। কী অদ্ভুত এবং অনন্য আমাদের অভিজ্ঞতা—সেগুলি বেশি অদ্ভুতের চেয়ে জ্ঞানী নয় অথবা সমুদ্র, নক্ষত্র এবং ফুল ফুটে থাকা আপেলগাছের চেয়ে অদ্বিতীয়। অদ্ভুত এ কারণে যে, আমাদের উচিত পৃথিবী ও মহাশূন্যের বিস্ময়কর ঘটনাগুলি মেনে নেওয়া, কিন্তু- একই সঙ্গে অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাসের ব্যাপারে যত্নবান নয়—যা আমাদের আত্মায় নির্মিত হয়। 

মে, আমি এরকম ভাবতে ভালোবাসি যে, আমাদের কিছু অভিজ্ঞতাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুজনে সম্মিলিতভাবে একই সঙ্গে ভাগাভাগি করছি, ততক্ষণ ব্যাপারটা ঘটবে না। আমার এ-ধরনের চিন্তার প্রবণতা সম্ভবত এর প্রধান কারণ এবং আমার কিছু চিঠি তোমাকে এরকম চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছে যে, ‘আমাদের এখানে থামা উচিত’। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমরা ‘সেখানে থামিনি’। মে, জীবন একজায়গায় থামে না এবং এর সমস্ত সৌন্দর্যসহ ঐশ্বরিক মিছিল কিছু করতে না-পারলেও কুচকাওয়াজ করে সামনে এগোয় এবং তোমার ও আমার জন্য অর্থাৎ আমাদের জন্য কে জীবনকে পবিত্র করে তুলবে এবং কোটি সঠিক তার প্রতি যত্নবান হবে, আশীর্বাদ করবে এবং আমাদের সমস্ত অস্তিত্বসহ জীবনের কাছে তা হবে মধুর ও সৎ। জীবন স্থায়ী ও মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার পর কে ক্ষুধা, কে তৃষ্ণা তা আমরা বলতে চাই না অথবা আমরা এমন একটা কিছু করি যা থেকে ভীতির জন্ম হয় অথবা ‘আত্মাকে সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা ও তিক্ততায় পূর্ণ করে তোলে’। আমরা না সক্ষম, না আমাদের ইচ্ছা হয় হাতের উল্টোপিঠটা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে যা আগুনে পরিশোধিত হয়েছে এবং যখন আমরা কোনোকিছুকে ভালোবাসি মে, আমরা ভালোবাসার দিকে তাকাই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে, কোনো প্রান্তসীমা স্পর্শ করার জন্য নয় এবং মহত্তম শ্রেণীর মুখোমুখি আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও বশ্যতা স্বীকার করি। কারণ আমরা বশ্যতা স্বীকার করি মানোন্নয়নের জন্য এবং গভীর শ্রদ্ধা করি ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য। যদি আমরা কোনোকিছুর জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করি তাহলে আমরা ধরে নিই অপেক্ষার একটা পুরস্কার বা স্বীকৃতি আছে। আমরা এটাও জানি গোপনীয়তা বা অজ্ঞতার বিষয় হচ্ছে সেইগুলি যা আমাদের অপেক্ষা ও প্রবণতার যথাযথ এবং অধিক মনোযোগ দাবি করে। সত্যের ভেতরে আমরা দুজন—তুমি আর আমি সূর্যের আলোয় দাঁড়াতে পারি না : ‘যতটা ভালোভাবে পারি নিজেকে আমরা যন্ত্রণাবিদ্ধ করব।’ কিন্তু সেটা ছাড়া আমরা কেউই কিছু করতে পারি না, যা আমাদেরকে ঈশ্বরের শহরে নিয়ে যায়, যদিও ওটা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না, যা আমাদেরকে বৃহত্তর আত্মার কাছে নিয়ে যায় এবং আমাদের কাছে ক্ষমতা ও রহস্য প্রকাশ করে এবং আমাদের আত্মার ভেতরে আমরা বিস্মিত হই। যদিও আমরা আত্মার সাধারণ প্রকাশের ভেতরে বুদ্ধিবৃত্তিক সুখ খুঁজতে সক্ষম, একটা সাধারণ ফুলের জন্যও আমরা বসন্তের সমস্ত মহিমা এবং সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াই, স্তন্যপানরত নবজাতকের চোখে আমরা খুঁজি মানবতার সমস্ত আশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। যদিও আমরা কাছের জিনিসগুলি ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক অর্থাৎ সামনে কী আছে তার কাছে পৌঁছাতে চাই। আমাদের জীবন ও পরিস্থিতির মুখোমুখি একথা বলে আমরা না দাঁড়াতে সক্ষম না অবনত হতে এবং তা হল : ‘আমাদেরকে তাই দাও যা আমরা চাই, অথবা কিছুই দিও না—যা আমরা চাই অথবা একেবারেই চাই না।’ না মে, আমরা এসব করি না, কারণ আমরা উপলব্ধি করি কোটি যথাযথ ও আশীবার্দ বর্ষণ করে এবং যা জীবনে স্থায়ী তা কখনই আমাদের ইচ্ছাকে অনুসরণ করে না, কিন্তু তার ইচ্ছা অনুযায়ী আমাদেরকে পরিচালিত করে। কোন্ উদ্দেশ্যে আমরা, সাত হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে আমাদের আত্মার গোপনীয়তাগুলিকে দৃষ্টিগোচর করতে পারি যা আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। উল্লাসকে টিকিয়ে রাখো গোপনীয়তা প্রকাশের জন্য। কোন্ উদ্দেশে আমরা মন্দিরের দরজার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি, সেখানে দাঁড়ানোর মহিমা ছাড়া। একটা পাখির কী উদ্দেশ্য থাকে যখন সে গান গাইতে গাইতে উচ্চকিত হয় অথবা ক্রুদ্ধ হয় যখন সে পুড়ে যায়? নিঃসঙ্গ আত্মার জন্য শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ প্রকাশই সুশোভন 

তোমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা সত্যি মধুর এবং তার নির্যাস কী কমনীয়। মে, শোনো তোমাকে একটা গল্প বলি এবং তুমি আমার খরচে কিছুক্ষণের জন্য হাসতে পারো। নাসিব আরিদা এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল-এর প্রবন্ধগুলি সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন একখণ্ডে প্রকাশের জন্য। এটা ছিল যুদ্ধের আগের সময়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিভিন্ন লেখার সমাবেশসহ আমার জন্মদিন শিরোনামের দুর্বল লেখাটিও সংযুক্ত করার—এমনকি আমার জন্মদিনের তারিখটা পর্যন্ত। উল্লেখ্য, সে সময় আমি নিউ ইয়র্কে ছিলাম না। তিনি আমার জন্মতারিখ খুঁজতে শুরু করেন এবং তিনি হচ্ছেন একজন ক্লান্তিহীন গবেষক এবং শেষপর্যন্ত কাছাকাছি সময়টা আবিষ্কার করেন এবং ইংরেজি ৬ জানুয়ারি আরবিতে অনুবাদ করেন, ‘৬ই কানুন আল-আওয়াল’।[১] এ পদ্ধতিতে তিনি আমার জীবনের আয়ুকে এক বছর কমিয়ে আনেন এবং প্রকৃত জন্মতারিখটা এক মাস পিছিয়ে যায়। ‘এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল’ প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি প্রতিবছর দুটো জন্মদিন উপভোগ করেছি। প্রথমটি অনুবাদের ত্রুটির কারণে যা ছিল মূলত অনুমান এবং আমি তা জানতাম না। যে বছর অপহৃত হয়েছি—ঈশ্বর জানেন এবং তুমি জানো এর জন্য আমাকে প্রচুর মাশুল দিতে হয়েছে, অনেক হৃদস্পন্দন ব্যয় করতে হয়েছে, সইতে হয়েছে সত্তর টন ওজনের নীরব যন্ত্রণা এবং অজানা জিনিসের জন্য অপেক্ষা—সুতরাং কীভাবে আমি এই ক্ষুদ্র ত্রুটিকে একটি গ্রন্থে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারি? 

মে, আমি এই উপত্যকা থেকে বেশ দূরে ছিলাম। আমি এই শহরে, মানে বস্টনে দশদিন আগে এসেছি কিছু ছবি আঁকার জন্য। কিন্তু পোস্টঅফিস আমাকে কোনো পার্সেল পাঠায়নি, চিঠি পাঠিয়েছে নিউ ইয়র্কের ঠিকানায়। তোমার চিঠি ছাড়া আর বড়জোর দশদিন বাঁচতে পারতাম। এই চিঠিটা আমার জীবনের হাজার হাজার গিঁটগুলোকে একত্রিত করেছে এবং ফুলবন ও বেষ্টিত ফলবাগানে উন্মোচিত করেছে অপেক্ষার মরুভূমি –’অপেক্ষা হচ্ছে সময়ের ধাতব প্লেটের ওপর আঁকা অমোচনীয় ছবি। মে এবং আমি ক্রমাগত অপেক্ষার সম্রাজ্যে বসবাস করি’। কখনও কখনও আমার কাছে মনে হয়, আমি সেইগুলোর আশায় জীবন কাটিয়েছি যা এখনও আমি পাই নি—তারা কেমন যারা অন্ধ ও প্রতিবন্ধীর মতো জেরুজালেমের বেথেসদার জলমগ্ন এলাকায় শায়িত : ‘একজন দেবদূত নির্দিষ্ট ঋতুতে জলমগ্ন এলাকার (ডোবায়) তলদেশে গিয়েছিল, তোলপাড় করেছিল জল এবং জল তোলপাড় করার পর প্রথম সেই জলে যে ঝাঁপ দেয় তার সমস্ত ব্যাধি দূর হয়’।[২] যাহোক এখন আমার নিজস্ব দেবতা ডোবার জলের তলদেশ তোলপাড় করছে এবং আমি দেখছি কেউ একজন আমাকে সেই জলের ভেতরে ফেলে দিয়েছে। আমি সেই মন্ত্রমুগ্ধকর ও ত্রাসোদ্দীপক স্থানে চলাফেরা করি, আমার দু-চোখ আলোতে ভরে যায় এবং আমার পা দৃঢ় সিদ্ধান্তে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মানুষের চেয়েও অধিক স্পষ্ট ও বাস্তব একটা ছায়ার পাশাপাশি আমি হাঁটি। আমি যে হাতখানা ধরে হাঁটি তা যেমন কোমল তেমনি দৃঢ়; এই হাতখানা এমন যার ইচ্ছাশক্তি খুব প্রবল এবং হাতের আঙুলগুলো কোমল হলেও তা ওজন তুলতে ও শিকল ভাঙতে সক্ষম এবং তখন আমার মাথাটা ঘোরাই হাসতে থাকা একজোড়া আকর্ষণীয় চোখ ও ঠোঁটের দিকে, যা তার মধুরতার ঘ্রাণে ভরপুর। 

একবার তোমাকে বলেছিলাম যে, আমার জীবনযাপন মূলত দুই ধারায় বিভক্ত, যার একটা কাটাই কাজ করে ও লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আর অন্য জীবন কাটাই ধোঁয়াশার ভেতরে। কিন্তু সেটা ছিল গতকাল, এখন এই মুহূর্তের জন্য আমার জীবন একীভূত হয়েছে এবং এখন আমি সেই ধোঁয়াশার ভেতরে কাজ করি, লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, এমনকি ঘুমাই, স্বপ্ন দেখি এবং জেগেও উঠি ধোঁয়াশার ভেতরে। যদিও এটা একটা পরমানন্দ যা পাখার ঝাপটায় পরিবেষ্টিত—এরকম পরমানন্দের অবস্থায় একাকিত্ব আর একাকিত্ব নয় এবং অজানার জন্য অপেক্ষার যন্ত্রণা আমার জন্য জানা যে-কোনোকিছুর চেয়ে মনোমুগ্ধকর। মে, এটা একটা ঐশ্বরিক মোহগ্রস্ত অবস্থা—এই মোহগ্রস্ত অবস্থা যা গোপনীয়তাকে কাছে নিয়ে আসে, উন্মোচন করে যা কিনা অজ্ঞাত এবং উদ্ভাসিত করে সবকিছু। আমি অনুভব করি যে, আধ্যাত্মিক মোহগ্রস্ততা ছাড়া যে জীবন, তা দানাছাড়া গমের মতো এবং আমি হলফ করে বলছি, আমরা যা বলি, করি অথবা চিন্তা করি তা সবই মূল্যহীন, যখন আমরা এক মিনিটের ধোঁয়াশার সঙ্গে তা তুলে ধরি। তুমি চাও আমার বুকের ধাতব প্লেটে ‘গীতিকবিতা’ শব্দটি খোদাই করতে। আমার বিরুদ্ধে তুমি এটা ব্যবহার করতে চাও; সুতরাং তুমি এই দুর্বল ফর্মের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারো, যে ফর্মের আমিই বহনকারী। একে খোদিত হতে দাও, খোদিত হতে দাও—খোদিত হতে দাও এবং চলো আমরা ইথারে ভাসমান সব গীতিকবিতাগুলিকে সংস্কার করার জন্য ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাদেরকে আদেশ দিই ভূমির ওপর নিজেদেরকে মেলে ধরতে, খাল খনন করতে, রাস্তা নির্মাণ করতে—প্রাসাদ, টাওয়ার ও মন্দির উত্থিত হতে এবং বন্যতাকে বাগান ও আঙুরক্ষেতে পরিণত করতে, কারণ পরাক্রমশীল মানুষেরা এখানে বসবাস করতে আসে এবং তারা এটা তাদের বাড়ি হিসেবে পছন্দ করেছে। মে, তুমি হলে এক পরাক্রমশীল বিজয়ীর জাতি এবং একই সঙ্গে তুমি সাত বছরের একটি বালিকা সূর্যালোকে হাসছ, ধাওয়া করছ প্রজাপতির পেছনে, জড়ো করছ গোলাপ-পাপড়ি এবং লাফিয়ে পড়ছ স্রোতে। এরকম একটা মিষ্টি মেয়ের পেছনে ‘ছোটার চেয়ে মধুর বিষয় আমার জীবনে আর কিছুই নেই, কারণ আমি তাকে অদ্ভুত ও বিস্মিত হওয়ার মতো গল্প শোনাতে পারি যতক্ষণ-না তার চোখের পাতা সুখনিদ্রা স্পর্শ করে এবং শান্ত ও স্বর্গীয় রীতিতে সে ঘুমের মধ্যে ডুবে যায়। 

জিবরান 

***

১. কানুন আল-আওয়াল (প্রকৃত অর্থে ‘প্রথম কানুন’) হল আরবিতে ডিসেম্বর মাস এবং জানুয়ারি হচ্ছে আরবিতে কানুন আল-থানি (প্রকৃত অর্থে ‘দ্বিতীয় কানুন’।) 

২. সেন্ট জন-এর নতুন বাইবেল। চতুর্থ খণ্ড 

.

নিউ ইয়র্ক ৬ এপ্রিল ১৯২১ 

১…….. ছদ্মবেশ ধারণের উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে এটা একজন নারীর জন্য সুবিবেচনাপ্রসূত এবং লোকজনের দৃষ্টিশক্তি থেকে তা তাকে এবং তার হৃদয়কে গোপন করে। আত্মা এবং মন হিসেবে ঈশ্বর তোমাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। তোমার মুখের আলো এবং হৃদয়ের আগুন আমাদের খুববেশি প্রয়োজন। সুতরাং কেন তুমি একই সঙ্গে দুটোই আমাদেরকে দাও না? 

আমরা সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষ করেছি— বাবা, ভাই, সঙ্গী এবং তোমার বন্ধু—সেইসঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা—প্রত্যেকেই তোমার হৃদয় এবং আত্মাকে কবিতা ও মুওয়াসা[২]-এর ফর্মে গদ্যে ও পদ্যে রূপান্তরিত করতে চায় এবং দাঁড়াতে চায় যেমন যাজিকারা দাঁড়ায় পরিবর্তনের মুখোমুখি—অন্তত দুই মাসে একবার এবং সেই মন্ত্রমুগ্ধ জগৎ সম্পর্কে বলে—চিন্তা, বিজ্ঞান, গবেষণা এবং যুক্তির জগতের পেছনে যার বসবাস। 

এক টুকরো বিশুদ্ধ সংবাদ : আমি একটা প্রথমশ্রেণীর (উন্নত ও মানসম্পন্ন অর্থে) দূরবীন পেয়েছি এবং আমি প্রতি সন্ধ্যায় দুএক ঘণ্টা নক্ষত্র থেকে অনন্ত পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে কাটাই—দূরত্ব, গোপনীয়তা ও বিশাল সমগ্রের আতঙ্ক যে-যন্ত্রের খুব কাছাকাছি। এখন মধ্যরাত এবং কালপুরুষ এখন স্বর্গীয় গোলকে পৌঁছেছে এবং ম্যারি[৩], তুমি জানো নীহারিকা কালপুরুষের কক্ষপথের কাছাকাছি এবং মহাশূন্যের বাইরে তা সবচেয়ে সুন্দর জাঁকজমক প্রদর্শনী। সুতরাং হে আমার সঙ্গী, চলো আমরা এখন জেগে উঠি এবং একজন দেবদূতের চোখে রাতের আকাশ, বিস্ময়, সমবেদনা এবং জ্ঞানের সৌন্দর্য কেমন, সে-সম্পর্কে ধারণা করার জন্য ছাদে যাই। হে প্রিয় নারী, আমি বলছি এই হল সেই মানুষের জীবন, যা মরুভূমির মতো পড়ে থাকবে বালিশূন্য, যতক্ষণ-না ঈশ্বর তাকে আমার ছোট্ট রাজকুমারীর মতো কন্যাসন্তান দিয়ে পুরস্কৃত করেন। আরও বলি : হে প্রিয়তমা, যার কন্যাসন্তান নেই তার একটি কন্যাসন্তান দত্তক নেওয়া উচিত। কারণ সময়ের গোপন অর্থ যুবতী মেয়ের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে। আমি আমার কন্যাকে রাজকুমারী বলে ডাকি, কারণ তার চলাফেলা, ভাবভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, হাসি, কৌতুকপ্রিয়তা, অকপটতা সবকিছুই রাজকীয় চরিত্রের নির্দেশ করে। তদুপরি সে হচ্ছে স্বৈরাচারী এবং শক্ত করে ধরে রেখেছে নিজস্ব ধারণাগুলি, কোনোকিছু ছাড়া তাদের পরিবর্তন ও সংশোধন সম্ভব নয়, কিন্তু তার স্বৈরতন্ত্র এবং সুনির্দিষ্ট রায় খুবই মধুর। 

এটা খুবই ছোট্ট চিঠি—কিন্তু এটাই প্রথম, যা আমি পাঁচ সপ্তাহ ধরে লিখেছি। তুমি কী চিঠিটা পড়ে দেখবে কী কী লেখা হয়নি? আমি জেগে উঠে (সকাল) আবার লিখব। বসন্ত আমাকে বিছানার চাদরের তলা থেকে টেনে বের করবে এবং নেতৃত্ব দেবে পশুচারণ ভূমির দিকে যেতে যেখানে জীবন তার সন্তানদের নতুন হৃদয় দান করে এবং ফিসফিসানি ও নিশ্বাস বদলে ফ্যালে তাদের গান ও ঈশ্বরের প্রশংসার ভেতরে। 

মে, প্রিয় বন্ধু আমার, আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ো না—আমার প্রতি অখুশি না-হওয়ার জন্য আমি প্রার্থনা করি। আমাকে অল্প আশীর্বাদ করো, যেমন আমি সবসময় করে থাকি। 

জিবরান 

***

১. এই চিঠির প্রথম দুই পাতা হারিয়ে গেছে। 

২. আরবি কবিতার একটা ফর্ম বা রীতি। 

৩. ম্যারি হচ্ছে মে’র প্রকৃত নাম, কিন্তু পরবর্তী নামটি অধিক কাব্যিক বলে, তিনি তা পছন্দ করতেন। 

.

নিউ ইয়র্ক, শনিবার সন্ধ্যা ২১ মে ১৯২১ 

প্রিয় বন্ধু মে, 

‘গভীর ভালোবাসাসহ—এবং গভীর ভালোবাসাসহ’—এটা হচ্ছে সত্যের একটা সাধারণ বিবৃতি যা সম্প্রতি আমার কাছে স্বচ্ছ হয়েছে, খুলে দিয়েছে আমার আত্মার দরজা- জানালাগুলি। একবার আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার দৃষ্টিশক্তির ভেতরে কী ঘটেছিল, আমি স্বপ্নেও যার অস্তিত্ব দেখিনি এই পৃথিবীতে। 

‘গভীর ভালোবাসাসহ—এবং গভীর ভালোবাসাসহ’-এবং ‘গভীর’ ও ‘ভালোবাসা’ থেকে আমি আনন্দে প্রার্থনা করতে, শান্তির জন্য প্রতীক্ষা করতে এবং অপমান থেকে অব্যাহতি পেতে শিখেছি। আমি উপলব্ধি করেছি যে ‘অধিক’ স্বপ্ন দিয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ তার নিঃসঙ্গতা পরিপূর্ণ করতে সক্ষম এবং আরও সক্ষম ক্লান্তি দূর করে ভালোবাসার মধুরতার সেই নিঃসঙ্গতাকে পূর্ণ করে দিতে। আমি আরও উপলব্ধি করেছি যে, একাকী মানুষ হচ্ছে একজন আগন্তুক এবং সে বাবা, ভাই, বন্ধু হতে সক্ষম, এমনকি এসব ছাড়া সে শিশু হয়েও জীবন উপভোগ করতে পারে। ‘গভীর ভালোবাসাসহ’-এর মধ্যে ‘গভীর’ এবং ‘ভালোবাসা’ হচ্ছে পাখাগুলি যা বিস্তৃত হয় এবং হাতগুলি, যা আশীর্বাদ করে। 

মাসখানেক আগে আমার শরীর ভালোই ছিল, কিন্তু এখন আমি অসুস্থ এবং এই দুর্বল শরীর এখনও পর্যন্ত কোনো নির্দেশ শুনছে না—সে ভারসাম্য ও ছন্দ হারিয়েছে। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমার সমস্যাটা কী? ডাক্তার বলেছেন : অতিরিক্ত পরিশ্রম ও পরিচর্যার অভাবে চরম স্নায়বিক অবসন্নতা দেখা দিয়েছে। ফলে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক। নাড়ির স্পন্দন প্রতি মিনিটে ১১৫, যা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে ৮০। 

মে, গত দুইবছরে আমি আমার শরীরকে দিয়ে অতিরিক্ত বোঝা বহন করিয়েছি। যতক্ষণ দিনের আলো থাকে ততক্ষণ অভ্যস্ত আমি ছবি-আঁকায় ব্যস্ত থাকতে, তারপর সকাল পর্যন্ত লেখা। তারপর বক্তৃতা দেওয়া, সবরকমের লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা—আর এই শেষের কাজটি হল আকাশের নিচের সবচেয়ে কঠিন বিষয়। খাবার টেবিলে নিজেকে ব্যস্ত রাখি সেইসব কথাবার্তায় এবং তাদের সঙ্গে, যারা কথা বলতে পছন্দ করে কফি পরিবেশনের সময় না-হওয়া পর্যন্ত। প্রায়ই আমি বাড়ি ফিরি মধ্যরাতের পর। আমার কী উচিত ঠাণ্ডা পানি ও কড়া কফিতে স্নান করা এবং বাকি রাত লিখে অথবা ছবি এঁকে কাটানো—যদিও আমি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলাম। আমি হলাম আমার উত্তর লেবানীয় সঙ্গীর মতো, অসুস্থতা দ্রুত আমাকে তার আয়ত্তে নিতে পারবে না। অসুস্থতা শারীরিকভাবে বিশাল ও শক্তিশালী—সেখানে আমি সম্পূর্ণ বিপরীত। বলিষ্ঠ মানুষের শারীরিক সদ্‌গুণের একটিও অর্জন করতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার পছন্দ করা উচিত যা আমি করতে পারি, যখন তোমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো বিকল্প আমার আর কিছু নেই, যে-প্রশ্নগুলির বিষয় মধুর অর্থাৎ ‘হিত সাধনের সংকল্প এবং উৎকণ্ঠা’ 

সেই দীর্ঘ চিঠিটা কই, যা রুলটানী চারকোনা কাগজের ওপর পেন্সিল দিয়ে লেখা হয়েছিল, ক্রসওয়ার্ডের (শব্দ সাজানোর বাধা বিশেষ) ফর্মে এবং সাজানো হয়েছিল একটা সুন্দর বাগান। সেই বাগানের দীর্ঘ রেখার ওপর দিয়ে নদী ও নৌকা* দেখা যাচ্ছে। মে, আমার সেই চিঠি কই? কেন তুমি ওটা আমার কাছে পাঠাওনি? আমি চিঠিটা পেতে ভীষণ আগ্রহী, আমি এর সবটুকু চাই, এমনকি এর ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র অংশটুকুও। তুমি কি জানো ঐ চিঠিটা সম্পর্কে বর্ণনা শোনার পর আমি ওটা পেতে কত বেশি আগ্রহী-ঐ চিঠি হল একটা ঐশ্বরিক ঘ্রাণ, যা একটা নতুন দিনে সুপ্রভাতের বার্তা বয়ে আনে। তুমি তার কতটুকু জানো—’পাগলামিসহ’ শব্দটা ব্যবহারের সময় আমার চেতনা পুরোপুরি ছিল। চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলার জন্য তোমাকে সকাতর অনুরোধ করে গতরাতে আমি একটা তারবার্তা পাঠিয়েছি। 

মে, তুমি কী তোমার বোধশক্তি দ্বারা আমার মধ্যে কোনো ভালোত্ব দেখতে পাও? কিংবা ভালোত্ব তোমার খুব প্রয়োজন? তোমার কথা কথার মধুরতায় আহত, সুতরাং আমার উত্তর কী হওয়া উচিত? তোমার প্রয়োজন, এরকম কিছু যদি আমার ভেতরে থেকে থাকে, হে বন্ধু আমার—তাহলে সেগুলি সম্পূর্ণভাবে তোমার। ভালোত্বের নিজের কোনো গুণ নেই, এর বিপরীত অবস্থা হচ্ছে অজ্ঞতা। যেখানে ‘ভালোবাসা গভীর’ সেখানে কী অজ্ঞতা বসবাস করতে পারে? 

ভালোত্ব যদি ভালোবাসায় গঠিত হয়, তাহলে সুন্দর কী? মহত্ত্বের উপস্থিতিতে ত্রাসের অনুভূতি এবং দূরত্ব ও অদৃশ্যের জন্য অপেক্ষা কী? আর এ সবই যদি ভালোত্ব হয় তাহলে আমি তাদের একজন, যাদের ভেতরে ভালোত্বের ছিটেফোঁটা আছে। কিন্তু অন্যকিছুর মধ্যে যদি ভালোত্ব থাকে, তাহলে আমি জানি না–কে আমি, কী আমি? মে, আমি অনুভব করি যে, উৎকৃষ্ট নারী অবশ্যই একজন পুরুষের আত্মায় ভালোত্বের অস্তিত্ব দাবি করবে যদি সে অনভিজ্ঞও হয়। 

এখন আমি কতখানি মিশরীয় হতে চাই জানো? কতখানি আমি আমার দেশের হতে চাই, যাদের ভালোবাসি তাদের নৈকট্য চাই। মে, তুমি কী জানো, প্রতিদিন আমি নিজেকে কল্পনা করি কোনো প্রাচ্যদেশীয় শহরতলির বাড়িতে এবং আমি কল্পনা করি আমার বন্ধু আমার সামনে বসে আছে এবং উচ্চৈঃস্বরে তাঁর সাম্প্রতিক অপ্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ছে এবং তার লেখাটা একটা শ্রেষ্ঠ জিনিস এ-বিষয়ে একমত হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা দীর্ঘ সময় লেখাটা নিয়ে আলোচনা করে কাটিয়েছি। আমি আরও কল্পনা করি এবং ফলশ্রুতি হিসেবে বালিশের তলা থেকে আমার উচিত কিছু কাগজ বের করা এবং কয়েক ছত্র পড়া, যা আমি গতরাতে লিখেছিলাম এবং তা আমার বন্ধুর অনুমোদন পাবে, যদিও সে নিজেকেই বলবে, ‘যখন সে অসুস্থ থাকে তখন তার লেখা উচিত নয়। এসময় লিখলে লেখার গঠনপদ্ধতি দুর্বল ও দ্বিধান্বিত হয়। সুতরাং পুরোপুরি সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত তার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা চরিতার্থ করা উচিত নয়।’ আমার বন্ধু এটা নিজেকে শোনাবে এবং নিজের ভেতরে তার সেই উচ্চারণ আমার শোনা উচিত, সম্মত হওয়া উচিত যে সত্য সে বলে তার সঙ্গে এবং তারপর আমি উচ্চৈঃস্বরে বলব, ‘আমাকে একটা সুযোগ দাও, অনুমতি দাও এক বা দুসপ্তাহের এবং আমি তোমাকে খুবই চমৎকার রচনাংশ পড়াব।’ প্রতিবাদে তুমি বলবে, ‘এক অথবা দুবছরের জন্য লেখা, ছবি আঁকা এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেকে তোমার বিরত থাকা উচিত এবং তুমি যদি তা না করো তাহলে আমি খুবই অখুশি হব।’ আমার বন্ধু ‘অখুশি’ শব্দটি উচ্চারণ করে পুরোপুরি ‘স্বৈরতন্ত্রের’ সুরে এবং আমাকে সে দেবতাসুলভ হাসি উপহার দেয়। সুতরাং কিছুক্ষণের জন্য তার অসন্তোষের ধাঁধায় পড়ে যাই এবং তারপর তার হাসি ও অসন্তোষের সঙ্গে আমিও নিজেকে উল্লসিত অবস্থায় দেখতে পাই, এমনকি উল্লসিত হই আমার নিজস্ব ধাঁধার সঙ্গে। 

এসো লেখা সম্পর্কে কথা বলা যাক। তুমি কি জানো, কী পরিমাণ আনন্দ, গর্ব ও সুখ অনুভব করেছি গত মাসগুলিতে প্রকাশিত তোমার প্রবন্ধ এবং ছোটগল্পগুলি পড়ে। আমি তোমার এমন কোনো রচনা পড়িনি, যা পড়ে আমার হৃদয় আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠেনি এবং দ্বিতীয়বার না-পড়েও সেইসব সাধারণ জীবনের চিত্র খুঁজে পাই, যা কখনও কখনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বহন করেছে এবং আমি চিহ্নিত করি ধারণা ও গঠনপদ্ধতি, অন্য কেউ যা দু’লাইনের মাঝখানে পড়ে না অথবা দেখতে পায় না, যেগুলি আমি ছাড়া আর কারও জন্য লেখা হয়নি। মে, তুমি হচ্ছ জীবনের ধনভাণ্ডারসমূহের ধনভাণ্ডারমে, তুমি তার চেয়েও অধিক—তুমি তুমিই। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই, তুমি যে জাতির মানুষ, আমিও সেই একই জাতির এবং যে-সময়ে তুমি বেঁচে আছ, সেই সময়ে আমিও। মাঝেমধ্যে আমি কল্পনা করি, তুমি গত শতাব্দীতে বসবাস করেছ অথবা তারও আগের শতাব্দীতে—আমি আমার হাত তুলি এবং বাতাসকে তাড়াই, যেভাবে কেউ ব্রাশ দিয়ে ধোঁয়ার মেঘ পরিষ্কার করে তার মুখের ওপর থেকে। 

আমি দুই অথবা তিন সপ্তাহের জন্য গ্রামে যাব একটা ছোট্ট বাড়িতে বসবাস করতে। বাড়িটি সমুদ্র ও বনের মাঝখানে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। কী চমৎকার সেই বন এবং কত ফুল সেই বনে, কত পাখি এবং কত বসন্ত। কয়েক বছর আগে আমি এই বনে একাকী বিস্মিত হতাম এবং প্রায়ই যেতাম সমুদ্রতীরে এবং বিষাদগ্রস্ত মনে বসতাম পাথরের ওপর, কখনও ঢেউয়ের ওপর, তবে তা এমন একজন মানুষের মতো যে পৃথিবী এবং এর প্রেতাত্মা থেকে পালাতে চায়। 

কিন্তু এই গ্রীষ্মে আমি বনের ভেতরে ইতস্তত ভ্রমণ করব, সমুদ্রের পাশে বসব এবং আমার আত্মার ভেতরে কিছু একটা খুঁজব, যা আমাকে একাকিত্ব ভুলতে সাহায্য করবে এবং আমার হৃদয়ে কিছু একটা হবে যা দুঃখবোধ থেকে আমার মনোযোগ ভিন্নমুখী করে তুলবে। 

মে, আমাকে বলো এই গ্রীষ্মে তুমি কী করবে? তুমি কী আলেকজান্দ্রিয়ার রামলেহ অথবা লেবাননে যাচ্ছ? তুমি একা যাচ্ছ লেবাননে? হায়, আমি কখন লেবাননে ফিরব! তুমি আমাকে বলতে পারো কখন লেবাননে ফিরব? তুমি আমাকে বলতে পারো কখন আমি এদেশ ও সেই সোনার শিকল থেকে মুক্ত হতে পারব, যেখানে আমার ইচ্ছগুলো শৃঙ্খলিত। 

মে, তোমার কী মনে আছে, তুমি বুয়েনস এয়ারস-এর এক সাংবাদিকের কথা বলেছিলে, যে একবার চিঠি লিখে তোমার লেখা ও ছবি চেয়েছিল। আমি অনেক সময় সেই সাংবাদিকের অনুরোধের কথা ভেবেছি, একজন খবরের কাগজের লোকের অনুরোধ। প্রত্যেকবারই পরিতাপের সঙ্গে নিজেকে বলেছি, ‘আমি সংবাদিক নই, আমি সাংবাদিক নই। সাংবাদিকের মতো একই রকম অনুরোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি আমি একটা সাময়িকপত্রের মালিক হতাম অথবা সম্পাদক। ভয় এবং অস্বস্তি এড়িয়ে মুক্তমনে তার কাছে একটা ছবি আমার চাওয়া উচিত।’ সবকিছুই আমি বলেছি আমার হৃদয় থেকে। মে, যারা আমার হৃদয় নিয়েছে, তারাই মনোযোগ দিয়েছে আমার কথায়। এখন মধ্যরাত। আমার ঠোঁটে উচ্চারিত শব্দ যতক্ষণ-না কাগজে লিখব, ততক্ষণ তা কখনও ফিসফিস করে, কখনও উচ্চৈঃস্বরে কোলাহল করবে। আমি সেই শব্দ লিখি যা আমি নীরবতার ভেতরে উচ্চারণ করতে চাই। আর নীরবতা সবকিছুই ধারণ করে, যা আমরা ভালোবেসে উদ্দীপনা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বলি। আর নীরবতা—মে, আমাদের প্রার্থনাকে সেখানে নিয়ে চলো যেখানে আমরা তা নিয়ে যেতে চাই অথবা ঈশ্বরের উদ্দেশে তুলে ধরি। 

আমি এখন বিছানায় যাচ্ছি এবং আজ রাতে দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমুব। আমি স্বপ্নের ভেতরে তোমাকে বলব যা আমি কাগজে লিখতে পারি না। শুভরাত্রি মে। ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। 

জিবরান 

***

* আমি আমার মনের চোখে নদী এবং নৌকা দেখতে পারি, কারণ মিশর সফরের পর থেকেই আমি তা স্মরণ করছি। [জিবরানের নিজস্ব ফুটনোট] 

.

নিউ ইয়র্ক, সোমবার সকাল ৩০ মে ১৯২১ 

মে, ম্যারি, বন্ধু আমার, 

আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার পর জেগেছি। এই স্বপ্নে আমি শুনলাম তুমি কথা বলছ আমার সঙ্গে, কিন্তু তা তীব্র ও কঠোর সুরে। যাহোক আমি এখনও পর্যন্ত সেজন্য বিব্রত। স্বপ্নে আমি আরও দেখলাম তোমার কপালে একটা ছোট্ট ক্ষত এবং ঝলসানো সেই ক্ষত থেকে চর্বিসহ রক্ত ঝরছে। আমার সেই সমস্যা নেই, যা চিন্তার অধিক মনোযোগ ও প্রত্যাশা দাবি করে আমাদের যে স্বপ্ন আছে তার চেয়ে এবং আমি হলাম এমন একটা মানুষ যে স্বপ্ন দেখে প্রচুর। এটার চেয়ে স্বচ্ছ কোনোকিছু এর আগে দেখেছি কী না আমি তা স্মরণ করতে পারি না। জানি না এই সকালে কেন আমি দ্বিধান্বিত, উত্তেজিত এবং চিন্তিত। তোমার কথার কঠিন ও তীব্র সুর কিসের গুরুত্ব বহন করে? তোমার কপালের ক্ষতের অর্থ কী? কেউ কী আছে যে আমাকে বলতে পারে আমার বিষাদগ্রস্ততা ও অস্পষ্টতার ভেতরে কী আছে? 

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রার্থনা করে আজ আমি সারাদিন কাটাব। আমি আমার হৃদয়ের নীরবতার ভেতরে তোমার জন্য প্রার্থনা করব এবং প্রার্থনা করব আমাদের জন্য। ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন এবং রক্ষা করুন। 

জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ৯ মে ১৯২২ 

আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বন্ধু, [১] 

ম্যাডাম (ইংরেজিতে ভদ্রমহিলাদের সম্বোধনসূচক শব্দ), তুমি জানতে চেয়েছে প্রায়শই আমি চিন্তায়, হৃদয়ে এবং আত্মায় একা থাকি কী না। কীভাবে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিই? আমার একাকিত্ব বিশালও নয়, আবার অন্যদের চেয়ে গভীরও নয়। প্রত্যেকেই তারা নিজের ভেতরে একা। আমাদের প্রত্যেকই হচ্ছে এক একটা হেঁয়ালি। আমরা প্রত্যেকেই হাজার ছদ্মবেশের ছদ্মবেশী এবং সেখানে একজন একাকী মানুষ ও অন্যদের ভেতরে পার্থক্য কী, একমাত্র একাকিত্বের বাক্যাবলি ছাড়া, যা সে বলে এবং অন্যজন তা নিজের কাছে রেখে দেয়। কথোপকথনের ভেতরে কিছু আয়েশ হতে পারে, তেমনি নীরবতার ভেতরে প্রকাশিত হয় কিছু গুণ। 

ম্যাডাম, আমি জানি না প্রায়শই আমি বিষাদে ভরা এই একাকিত্বের ভেতরে থাকি কী না, কিন্তু এরকম সময়ে ভাবনার অভিব্যক্তির খেয়ালের প্রকাশ ঘটে অথবা আমি যাকে ‘আমি’ বলি তার ব্যক্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। তারপরও আমি জানি না,তবে যদি একাকিত্ব দুর্বলতার প্রতীক হয়, তাহলে আমি অবশ্যই দুৰ্বলতম মানুষ। 

আমার প্রবন্ধ ‘মাইসেলফ ইজ ল্যাডেন উইথ ওন ফুটস’[২] একজন কবির তীব্র শোকের মুহূর্তের দীর্ঘশ্বাস মাত্র ছিল না, এটা ছিল একটা সাধারণ, প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত অনুভূতির প্রতিধ্বনি, যার অনেক অভিজ্ঞতা আছে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তুমি, প্রিয়তমা তুমি জানো, কখনও কখনও এটা একটা গুণ যা কিনা গর্ব অথবা আত্মাভিমান, কিন্তু তা সত্ত্বেও যা প্রাকৃতিক। 

তুমি ভালোভাবেই উল্লেখ করেছ : ‘কোলাহলের ভেতরে একাকিত্বের যন্ত্রণা এবং কষ্টভোগ বেশ তীব্রতর।’ এটা একটা অপরিহার্য সত্য। কীভাবে একজন মানুষ তার সঙ্গী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পায়, তাদের সঙ্গে কথা বলে, ধারণা বিনিময় করে, ভাগাভাগি করে চিন্তা-ভাবনা ও গতি-প্রকৃতি এবং এই সবকিছুই করে সে অনুগতভাবে ও সর্বান্তঃকরণে, যদিও দৃশ্যমান জগতের অর্জিত আত্মার সীমা পেরিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়, তার অন্য আত্মার মতো গোপন আত্মা, যে একাকী নীরবতার মৌলিক জগতের ভেতরে কথা বলে। 

আমিসহ অধিকাংশ মানুষই ধোঁয়া এবং ছাই ভালোবাসে কিন্তু তারা আগুন সম্পর্কে ভীত, কারণ আগুন চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এবং পুড়িয়ে দেয় হাতের আঙুল। অধিকাংশ মানুষ এবং আমি আনুষ্ঠানিক রীতিতে একে অন্যের সঙ্গে আদানপ্রদান করছি ভাসা-ভাসা পর্যায় পর্যন্ত। ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে এর নির্যাস, কারণ উপলব্ধির শক্তি থেকে তা কখনই আসে না। গোপনীয়তা অন্যের কাছে উন্মোচিত করে হৃদয়ের ভেতরে ক্রন্দন করা মানুষের পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ নয়। ম্যাডাম, এই হল একাকিত্ব এবং এই হচ্ছে বিষাদগ্রস্ততা।

আমি ইচ্ছে করেই নিজের সম্পর্কে ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছি, যা আমি গ্রীষ্মের শেষাশেষি তোমাকে বলেছিলাম, ছয় সপ্তাহ ধরে তোমাকে লেখার জন্য লোক ভাড়া করার চেষ্টা করেছি, কারণ আমার ডানহাতের স্নায়ু লেখার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে, কিন্তু কখনই আমার মনে হয়নি যে, ‘চেষ্টা’ শব্দটি আমার বন্ধুর হাতে শল্যচিকিৎসার একটা ছুরিতে পরিণত হয়েছে। আমি এরকম বিভ্রান্তির ভেতরে বসবাস করি, যে পাখাবিশিষ্ট আত্মা কখনও শব্দের খাঁচায় বন্দি হতে পারে না এবং সেই ধোঁয়াশা কখনও পাথরে রূপান্তরিত হয় না। আমি এরকম স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি ও দেখে থাকি এবং আমার ভাবাচ্ছন্নতার ভেতরে আমি আয়েশ খুঁজে পাই। কিন্তু সকাল যখন সেই স্বপ্নটা ভেঙে দেয়, তখন আমি জেগে উঠি, নিজেকে দেখতে পাই একটা ছাইয়ের স্তূপের ওপর বসে আছি, আমার হাতে একটা ভাঙা নলখাগড়া এবং মাথায় কাঁটার মুকুট … না, এটা এমন কিছু নয়, কারণ আমিই দোষী। আমাকে অবশ্যই এই দোষ মেনে নিতে হবে, মে। 

 আমি আশা করি তোমার ইউরোপ-ভ্রমণের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এখানে শিল্পকলা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন দেখে তুমি মুগ্ধ ও উল্লসিত হবে—বিশেষ করে ফ্রান্স এবং ইটালিতে। সেখানে জাদুঘর এবং বিভিন্ন অ্যাকাডেমি আছে, আরও আছে প্রাচীন গথিক রীতির গির্জা—রয়েছে রেনেসাঁর দুই শতাব্দীর স্মৃতিচিহ্ন—চৌদ্দশো ও পনেরোশো শতাব্দী এবং সে-সময়ের শ্রেষ্ঠ যা-কিছু আমাদের ভেতরে যারা পরিত্যাগ করেছে তারা পৃথিবীর বিজিত এবং বিস্মৃত জাতি। ম্যাডাম, ইউরোপ হচ্ছে চোরদের আখড়া—বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৃত সমঝদার লোকেরা অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন এবং সেভাবেই তা কিনে থাকে। 

পরবর্তী শরতে প্রাচ্যে ফেরার প্রবল ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কিছু চিন্তাভাবনার পর উপলব্ধি করলাম যে অচেনা মানুষের ভেতরে নিজেও অচেনার ভার বহন করা সহজ, অন্তত আমার নিজের ভেতরে নিজে অচেনা হওয়ার চেয়ে, বেরিয়ে আসার সহজ পথটা গ্রহণ করতে যে অভ্যস্ত—এমনকি সেখানে ভারসাম্যহীনতা ও অস্পষ্টতার ভেতরে রয়েছে অনুসরণের রীতি। 

দয়া করে আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করো এবং মে, ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। 

তোমার একান্ত বাধ্যগত, 

জিবরান কহলীল জিবরান 

***

১. সম্বোধনের একটি আরবি প্রথা। পুরো চিঠিটাই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিক এবং শ্লেষপূর্ণ। 

২. প্রবন্ধটি ‘নাফছি মুহামালাতুন বি আথমারিহা’ শিরোনামে আরবিতে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে প্রবন্ধটি ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ‘আল-বাদাইওয়াল তাবাইফ’ (রেয়ার এন্ড বিউটিফল সেইংস) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

.

নিউ ইয়র্ক ৫ অক্টেবার ১৯২৩ 

না,[১] মে, আমাদের সেইসব সাক্ষাতের ভেতরে কোনো উদ্বেগের অস্তিত্ব থাকে না, যখন ধোঁয়াশা আমাদেরকে ঢেকে দেয়, কিন্তু সাক্ষাতের ভেতরে আমরা কথা বলি। যখন দূরে কোনো চারণভূমিতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় তখন আমি সবসময় দেখি তুমি একটা মিষ্টি এবং দয়ালু নারী, যে সবকিছু সম্পর্কে সজাগ এবং সবকিছু জানে, তার ধারণা ঈশ্বরের আলোয় জীবন আলোকিত হয় এবং সে তার মানসিক শক্তির আলো দিয়ে পরিপূর্ণ করে জীবন। আর যখন লেখার কালির কলঙ্কিত কালিমার ভেতরে সাক্ষাত হয় এবং কাগজ সাক্ষী থাকে তখন আমি তোমাকে ও আমাকে দেখি দ্বন্দ্বযুদ্ধে রত অত্যন্ত বদরাগী দুই প্রতিপক্ষ—বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্বযুদ্ধ ছাড়া এ আর কিছুই নয় এবং এই যুদ্ধের পরিমাপ ও ফলাফল সীমাবদ্ধ। 

মে, ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করুন, তুমি আমার হৃদয়ের প্রশান্তি হরণ করেছ, এমনকি ক্ষিপ্রতা ও অনমনীয়তা এবং বিশ্বাসসহ। সবচেয়ে অদ্ভুত হল, ওগুলি আমাদের আছে, যা দ্বন্দ্ব ও বিরক্তি সৃষ্টিতে সক্ষম। 

পরস্পরের কাছে নতুন করে পুনর্বার প্রমাণ করার কিছু নেই, আমাদের অবশ্যই একটা বোঝাবুঝিতে আসতে হবে, কিন্তু আমরা কখনই একটা বোঝাবুঝিতে আসাতে পারব না, যদি আমরা শিশুসুলভ অকপটতার সঙ্গে কথা না বলি। দক্ষতা, অকপটতা, সুশোভিতকরণ ও প্রতিষ্ঠানের দাবিসহ অলঙ্কারশাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা দুজনেই পথভ্রষ্ট। তুমি ও আমি একটা উপলব্ধিতে পৌঁছেছি যে, বন্ধুত্ব এবং হৃদয়ের বাগ্মিতার সম্মিলিত প্রকাশ সহজে সম্ভব হয় না। মে, হৃদয়টা সাধারণ এবং হৃদয়ের গুপ্ত বিষয়ের প্রকাশ হচ্ছে মৌলিক বিষয়, যেখানে বাগ্মিতা হচ্ছে সামাজিক বাহন। সুতরাং আমাদের উচিত অলঙ্কারসমৃদ্ধ কথার চেয়ে সাধারণ কথা বলা এবং তুমি কী তাতে রাজি আছ? ‘তুমি আমার ভেতরে বসবাস করো এবং আমি তোমার ভেতরে। তুমি এটা জানো এবং আমিও এটা জানি।’ আমরা এতদিন যত কথা বলেছি, তার চেয়ে এই অল্পকটি শব্দ কী উত্তম নয়? গতবছর এরকম কথা উচ্চারণ করতে কে আমাদের বাধা দিয়েছিল? হতবুদ্ধি, গর্ব, সামাজিক রীতি অথবা কী? শুরু থেকেই আমরা জেনেছি এই মৌলিক সত্য, সুতরাং ধর্মপ্রাণ চরিত্র ও উৎসর্গীত বিশ্বাসীদের খোলাখুলি কথাবার্তা কেন তুলে ধরি নি? আমরা কী তা করেছিলাম? আমরা আমাদের সন্দেহ, যন্ত্রণা, দুঃখ, ঘৃণামিশ্রিত ভয় ও হয়রানি থেকে বিরত থেকেছি—হয়রানি যা কিনা তিক্ততার ভেতরে হৃদয়ের মধুতে রূপান্তরিত হয় এবং ধুলোর ভেতরে হয় হৃদয়ের রুটি (খাবার/জীবিকা)। ঈশ্বর তোমাকে ও আমাকে ক্ষমা করুন।

আমাদের অবশ্যই একটা বোঝাবুঝিতে আসতে হবে, কিন্তু কীভাবে আমরা তা অর্জন করব, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা পরস্পরের স্পষ্টভাষণে পুরোপুরি বিশ্বাস করছি। ম্যারি, স্বৰ্গ ও মর্ত্য এবং তাদের ভেতরে কী থাকে সে-সম্পর্কে তোমাকে আমি আগেই বলেছি। আমি তাদের ভেতরে একজন নই যে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র পাঠানোর জন্য শুধুমাত্র গীতিকবিতা লেখে। এমনকি আমি তাদেরও একজন নই, যে সকালবেলা এমনভাবে কথা বলে যেন ফল দিয়ে জাহাজ বোঝাই করেছে এবং সন্ধ্যায় সে ভুলে যায় ফল এমনকি তার ওজন পর্যন্ত। আমি নই তাদেরও একজন, যারা আগুনে আঙুল পরিশুদ্ধ না করে পবিত্রতাকে স্পর্শ করে। তাদেরও একজন আমি নই, যাদের অনুভূতি বা চেতনা দিনরাত্রির শূন্যতাকে পরিপূর্ণ করে তোলে প্রেমের অভিনয় দিয়ে। আমি তাদের মতো নই, যারা তাদের আত্মার গোপনীয়তাকে খর্ব করে এবং তাদের হৃদয়ের যা-কিছু অজ্ঞাত শুধুমাত্র তা-ই যে-কোনো প্রবহমান বাতাসে তারা জনসমক্ষে প্রচার করে থাকে। এটা সত্য যে, আমি খুবই পরিশ্রমী মানুষ এবং বিশাল, মহৎ খাঁটি এবং সুন্দরের জন্য আমার রয়েছে আকুল আকাঙ্ক্ষা, যেমন অন্যেরা বিশালত্ব, মহত্ত্ব, পরিশুদ্ধতা ও সৌন্দর্যের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। কিন্তু তারপরও আমি মানুষের ভেতরে অচেনা, পুরোপুরিভাবে আমার নিজের কাছেও ঠিক অন্যদের মতো, পুরোপুরি অচেনা হওয়া সত্ত্বেও উভয়লিঙ্গের অন্তত সাত হাজার বন্ধু যাদের রয়েছে। অন্য কোনো মানুষের মতো যৌন- কসরৎ চরিতার্থ করার ঝোঁক আমার নেই, অনেকেই যাকে সুমধুর বিশেষণে ভূষিত করেছে এমনকি নেশা-ধরানো শব্দসম্বলিত নাম পর্যন্ত দিয়েছে। মে, আমাদের মতো প্রতিবেশী সঙ্গীদের কাছে আমি হলাম ঈশ্বর, জীবন এবং মানবতা প্রেমিক, এমনকি আজকের দিন পর্যন্ত ভাগ্য আমাকে দিয়ে এমন কিছু করায় নি, যা আমার প্রতিবেশী সঙ্গীদের জন্য লজ্জার বিষয় হবে। 

যখন প্রথম চিঠিটা লিখেছিলাম, তখন ওটা ছিল আমার আস্থার প্রমাণ যে, তোমার ভেতরে আমি আছি। কিন্তু তুমি যখন উত্তর পাঠিয়েছিলে তা ছিল তোমার সন্দেহের জলজ্যান্ত প্রমাণ। নিজেকে বাধ্য করলাম তোমাকে চিঠি লিখতে, তুমি দিলে সতর্কীকরণ উত্তর। আমি তোমাকে একটা অদ্ভুত সত্যকথা বলেছিলাম এবং উত্তরে তুমি অমায়িকভাবে বলেছিলে, ‘খুব ভালো লিখেছ। চালাক ছেলে, কী অপূর্ব তোমার গীতিকবিতাগুলি।’ আমি সবকিছুই জানি, অবশ্য সমাজের বিশেষ স্তরে প্রচলিত অন্তরঙ্গ আদব-কায়দা আমি পর্যবেক্ষণ করিনি। হয়তো কখনও তা পর্যবেক্ষণ করবও না। আমি আরও জানি যে, তোমার সতর্কীকরণের কারণ ছিল, কী ঘটতে পারে সেই ভয়ের জন্য এবং আমার মর্মবেদনার কারণ হচ্ছে, কী অবস্থা হতে পারে আগেই তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হই না। আমি কী মে ছাড়া অন্য কারো কাছে চিঠি লিখেছিলাম, অবশ্য আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল কী ঘটবে? আমি কি মে ছাড়া অন্য কারো কাছে সত্য প্রকাশ করতে পারি? অদ্ভুত এই যে, এর জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। কোনো দুঃখ করিনি আমি, কিন্তু নিজের ভেতরেই আমাকে দৃঢ় হতে হয়েছে সত্যের প্রতি এবং তোমার প্রতি আন্তরিক হওয়ার জন্য আমি উৎসুক, যে-কারণে বারবার তোমাকে লিখেছিলাম এবং প্রতিবারই তোমার উত্তরে আন্তরিকতার ছাপ লক্ষ্য করেছি, কিন্তু আমি জানতাম চিঠির উত্তর মে নয় অন্য কেউ দিত। ঐ আন্তরিক উত্তর আসত মে-এর সেক্রেটারির কাছ থেকে, যে একজন বুদ্ধিমতী যুবতী এবং সে মিশরের কায়রোতে বসবাস করে। আমি কেঁদে ফেলি এবং ফিসফিস করে বলি, ‘আমি যার ভেতরে বসবাস করি এবং যে আমার ভেতরে বসবাস করে’–এ উত্তর তার কাছ থেকে আসেনি। এ উত্তর এসেছে সেই নারীর কাছ থেকে, যে সতর্ক ও দুঃখবাদী এবং সে দেওয়া-নেওয়ায় বিশ্বাসী, যেন আমি অভিযুক্ত এবং সে অভিযোগকারী। আমি তোমার ওপর রাগ করেছি? মোটেই নয়। আমি রাগ করেছি তোমার সেক্রেটারির ওপর। আমি কী তোমার ওপর যুক্তিযুক্ত বা অযৌক্তিকভাবে কোনো রায় কখনও চাপিয়ে দিয়েছি? 

কখনও নয়—আমি তোমার সম্পর্কে কখনও কোনো রায় দিইনি। আমার হৃদয় কখনও তোমাকে আদালতে বিচারাধীন করার অনুমতি দেবে না। আমরা কী ভাগাভাগি করি মে? চলো আমরা আদালতে থেকে বেরিয়ে যাই। কিন্তু তোমার সেক্রেটারি সম্পর্কে আমার একটা মতামত আছে, যখন তুমি আর আমি কথা বলতে বসি তখন সে আসে এবং নিজেই আমাদের মুখোমুখি বসে অর্থাৎ যেন সে একটা রাজনৈতিক সম্মেলনের প্রতিটি মুহূর্তকে নথিবদ্ধ করছে। প্রিয় বন্ধু, তোমার কাছে জানতে চাই আমাদের দুজনের কী সত্যিই সেক্রেটারি দরকার? যদি দরকারই হয় তাহলে আমি আমার সেক্রেটারিকে ডাকতে পারি। তুমি কী চাও আমার সেক্রেটারি তোমার তত্ত্বাবধায়ক হোক? দ্যাখো মে, এখানে দুই পাহাড়ের শিশুরা সূর্যশ্মিতে আরোহণ করছে এবং সেখানে চারজন লোক, একজন নারী এবং তার সেক্রেটারি ও একজন পুরুষ ও তার সেক্রেটারি। এখানে দুজন শিশু হাত ধরে হাঁটছে ঈশ্বরের ইচ্ছায় এবং ঈশ্বর-নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে এবং সেখানে চারজন লোক একটা অফিসে বসে কথার মারপ্যাচে নিজেদের ভেতরে বাদানুবাদ করছে। বারবার উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে, আবার বসছে এবং অন্যের বিশ্বাসকে বাতিল করতে প্রত্যেকেই যা বিশ্বাস করে তা সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। এখানে দুটি শিশু, ওখানে চারটি শিশু, সুতরাং কেন তুমি যেতে ইচ্ছুক। বলো আমাকে কোন্ পথে? 

আমার মনে হয় তুমি জানো এইসব অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব নিয়ে আমি কী পরিমাণ ক্লান্ত এবং তুমিই শুধুমাত্র জানো সাধারণত্ব আমার কতখানি প্রয়োজন। আমি চাই তুমি জানো যে, পরিপূর্ণতার (বিশুদ্ধতার) জন্য আমি কী পরিমাণ অপেক্ষা করি। কলঙ্কহীন সাদা বিশুদ্ধতা, ঝড়ের ভেতরে বিশুদ্ধতা, ক্রুশের ওপরের বিশুদ্ধতা—এমনকি সেই বিশুদ্ধতা যা অশ্রু গোপন করে না এবং সেই বিশুদ্ধতা যা হাসে, কিন্তু যে হাসে তার দ্বারা সেই হাসি বিব্রত হয় না। আমার মনে হয় তুমি এটা জানো—তুমি এ সবই জানো। 

‘আজ সন্ধায় আমি কী করতে পছন্দ করব?’ 

এখন সন্ধ্যা নয়, এখন দুটো বাজে। এত আগেই তুমি কোথায় যেতে চাও? এখানে এই নীরবতার ভেতরে থাকাই উত্তম। আমাদের অপেক্ষাকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি, যতক্ষণ-না অপেক্ষা আমাদেরকে ঈশ্বরের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমরা মানবতাকে ভালোবাসতে পারি যতক্ষণ-না মানবতা আমাদের কাছে তার হৃদয় উন্মোচন করে। 

ঘুম তোমার চোখদুটোকে চুম্বন করছে। তোমার চোখের পাতায় চুম্বনরত ঘুমকে অবহেলা কোরো না, আমি ঘুমকে তোমার চোখের পাতা চুম্বন করতে দেখছি, আমি চুম্বন করতে দেখছি এরকমভাবে—এইভাবে। সুতরাং এখানে এই ঘাড়ের ওপর তোমার মাথা রাখো এবং ঘুমাও, ঘুমাও আমার ছোট্ট প্রেয়সী, ঘুমাও যেন তুমি তোমার মাতৃভূমিতে নিজের বাড়িতে শুয়ে আছ। 

অন্যদিকে আমি জেগে থাকব। নিজেই নিজেকে জাগিয়ে রাখব। আমাকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। সকাল পর্যন্ত সজাগ থাকার জন্যই আমার জন্ম হয়েছিল। ঈশ্বর তোমাকে পাহারা দিন। সজাগ থাকার জন্য ঈশ্বর আমাকে আশীর্বাদ করুন এবং সবসময় তোমাকে রক্ষা করুন। 

জিবরান 

***

১. এই চিঠিতে কোনো সম্বোধন করা হয়নি। 

.

বস্টন ৩ নভেম্বর ১৯২৩ 

নিম্নলিখিত তথ্যসহ মাইকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্যের ছবি সম্বলিত এই পোস্টকার্ডটি খামে ভরে পাঠানো হয়েছিল। খামের ওপর ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ ছিল ৩.১১.১৯২৩। কার্ডটিতে নিম্নলিখিত লাইনগুলো লেখা ছিল। 

দ্যাখো ম্যারি, মাইকেলেঞ্জেলো কত মহৎ। এই মানুষটি মার্বেলপাথর খোদাই করে সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাবান দানবের তত্ত্বাবধায়ক, যা চূড়ান্ত উৎকর্ষের ক্ষেত্রে মধুর এবং কোমল। মাইকেলেঞ্জেলোর জীবনের উদাহরণ হচ্ছে কোমলতার প্রকৃত শক্তি এবং সেই নমনীয়তাই হচ্ছে প্রকৃত রূপান্তরের উত্তরপুরুষগণ। সুন্দর মুখের[১] প্রতি শুভরাত্রি। 

জিবরান 

***

১. এ ধরনের অদ্ভূত বাক্যাংশ সাধারণত আরবিতে প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে আদর করে বলা হয়ে থাকে, বাংলায় এর কোনো সমার্থক শব্দ নেই। 

.

বস্টন ৮ নভেম্বর ১৯২৩ 

নিম্নলিখিত তথ্যসহ দুটি পোস্টকার্ড একটা খামের ভেতরে পাঠানো হয়েছিল। খামের ওপর ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ হচ্ছে ৮.১১.২৩। 

তোমার জীবনে এমন কোনোকিছু কী দেখেছ যা এই দুটি মুখের চেয়ে অধিক সুন্দর। আমি বিশ্বাস করি তারাই হচ্ছে গ্রিকশিল্পের উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি। যখনই আমি বস্টন শহরে যাই তখনই ঐ শহরের জাদুঘরে গিয়ে সরাসরি ‘গ্রিসীয় কক্ষে’ প্রবেশ করি এবং ঘন্টা খানেক বসে বসে দুটো মুখ পরখ করি। তারপর ডানে-বামে কোনোদিকে না-তাকিয়ে মুহূর্তের ভেতরে জাদুঘর পরিত্যাগ করি। এর অর্থ এই নয় যে, অন্য সৌন্দর্য দেখে আমি ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে অসন্তুষ্ট হয়েছি। 

মধুর ও সুন্দর মুখের প্রতি সুপ্রভাত। 

জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ১-৩ ডিসেম্বর ১৯২৩ 

মে, তোমার চিঠি কী মিষ্টি, আমার হৃদয়ে মধুবর্ষণ করে। পাঁচদিন আগে আমি গ্রামে গিয়েছিলাম এবং সেখানে পাঁচদিন কাটিয়েছি আমার প্রিয় ঋতু শরৎকে বিদায় জানাতে। মাত্র দুঘণ্টা আগে ফিরেছি। আমি ফিরেছি ঠাণ্ডায় জমে এবং মনে হয় আমি শেষ হয়ে গিয়েছি। কারণ আমি এমন একটা ভ্রমণ করেছি যা পরিবর্তনযোগ্য, যা নাজারেত থেকে বিসাররি যতদূর তার চেয়েও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে—কিন্তু আমি ফিরেই একগাদা চিঠির স্তূপের ওপর তোমার চিঠিটা দেখতে পেলাম এবং সত্যি বলতে কি, যখন আমার ছোট্ট প্রিয়তমার কাছ থেকে চিঠি পাই তখন অন্য চিঠিগুলো আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি বসে চিঠিটা পড়ি এবং তা থেকে উষ্ণতা পাই। তারপর আমি আমার পোশাক বদলাই এবং দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ি। আবার তৃতীয়বার পড়ি এবং সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে বারবার চিঠিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি। ম্যারি, আমি অন্য কোনো পানীয়ের সঙ্গে ঐশ্বরিক মদ মেশাই না। 

এখন তুমি আমার সঙ্গে ম্যারি, আমার সঙ্গে তুমি এখানে, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি এবং শব্দ দূরত্বের চেয়ে অধিক উত্তম। তোমার বিশাল হৃদয়ের সঙ্গে আমি যে-ভাষায় কথা বলি, এটা তার চেয়েও মহৎ এবং আমি জানি তুমি আমার কথা শুনতে পাও। আমি জানি আমরা একে অন্যকে স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে বুঝতে পরি এবং আরও জানি অতীতের যে- কোনো সময়ের চেয়ে আজ রাতে আমরা ঈশ্বরের শক্তির খুব বেশি কাছাকাছি। আমি ঈশ্বরের প্রশংসা করি এবং তাকে ধন্যবাদ দিই বিচ্ছিন্ন আমাকে এই মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং আমি হলাম আমার পিতামাতার বাড়িতে পর্যটক। এই মুহূর্তে, একটা চমৎকার চিন্তা, একটা খুবই চমৎকার চিন্তা আমাকে নাড়া দিয়েছে। মনোযোগ দিয়ে শোনো আমার ছোট্ট প্রিয়তমা, যদি আমরা কোনোদিন ঝগড়া করি (অর্থাৎ যদি ঝগড়া উপেক্ষায় যোগ্য না হয়) তাহলে অবশ্যই আমাদের আলাদা পথ বেছে নেওয়া উচিত নয়, প্রতিটা যুদ্ধের পর অতীতে যেমন হয়েছে। পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের অবশ্যই এক ছাদের নিচে থাকা উচিত, যতক্ষণ আমরা ঝগড়া করে বিরক্ত না হই এবং হাসতে শুরু করি অথবা ঝগড়া নিজেই বিরক্ত হয়ে আমাদেরকে মাথা ঝাঁকিয়ে বিদায় জানায়। 

আমার এই ধারণা সম্পর্কে তুমি কী ভাবো? 

এসো, যতখুশি ঝগড়া করা যাক অথবা ঝগড়া আমাদেরকে নিজে যতটুকু অনুমতি দেয় ঈহদিন থেকে আসা তোমার জন্য এবং বিসাররি থেকে আসা আমার জন্য এবং আমাদের ঝগড়াটা খুবই সনাতন। যাহোক আগামি দিনগুলিতে কী ঘটে সেটাই হল বড় কথা। আমাদের অবশ্যই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে হবে যতক্ষণ-না মেঘপুঞ্জ ঐ মুখকে অতিক্রম করে এবং তোমার অথবা আমার সেক্রেটারি যদি ভেতরে আসে—আমরা ভদ্রভাবে তাদেরকে বাইরের পথ দেখিয়ে দেব, কিন্তু তা শুধুমাত্র চলে যাওয়ার জন্য নয়, বিশেষ কাজে দ্রুত বাইরে পাঠানোর জন্য। 

সব মানুষের ভেতরে একমাত্র তুমি আমার আত্মার সবচেয়ে কাছে, এমনকি হৃদয়েরও এবং আত্মা ও হৃদয় কখনও ঝগড়া করে না। শুধু আমাদের চিন্তা ঝগড়া করে এবং চিন্তা হচ্ছে অর্জিত, এটা পরিবেশ থেকে আহরণ করা, যা আমরা দেখি আমাদের সামনে, যা থেকে প্রতিটি দিন আমাদের নিয়ে আসে, কিন্তু হৃদয় এবং আত্মা আমাদের ভেতরে একটা শ্রেষ্ঠ নির্যাস তৈরি করেছে আমাদের চিন্তারও আগে। চিন্তার কাজ হচ্ছে সংগঠিত করা এবং সাজিয়ে রাখা, এটা একটা ভালো কাজ এবং আমাদের সমাজজীবনের জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু হৃদয় এবং আত্মার জীবনে তার কোনো স্থান নেই। ‘তারপরও যদি আমরা ঝগড়া করি তবু কখনই আমরা অন্য পথ বেছে নেব না।’ সমস্ত ঝগড়ার কারণ থাকা সত্ত্বেও চিন্তা এসব বলতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা সম্পর্কে একটি শব্দও বলতে পারে না, শাব্দিক অর্থে আত্মার পরিমাপ করতেও সক্ষম নয়, যুক্তির মাপকাঠিতেও পারে না হৃদয়য়ের ওজন নিতে। 

আমি আমার ছোট্ট প্রিয়তমাকে ভালোবাসি, কিন্তু জানি না কেন আমি তাকে ভালোবাসি। আমি আমার মনের কাছে তা জানতেও চাই না, আমি তাকে ভালোবাসি তা-ই যথেষ্ট। এটাই যথেষ্ট যে আমি আমার আত্মা ও হৃদয়ের ভেতরে তাকে ভালোবাসি। এটাই যথেষ্ট আমার জন্য, তার কাঁধের ওপর মাথাকে বিশ্রাম দেওয়া, যখন আমি বিষাদগ্রস্ত, কিংবা নির্জনতায় একা অথবা যখন আমি সুখী, আবেগাপ্লুত এবং বিস্ময়ে অভিভূত। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট, পাহাড়ের চূড়ায় তার পাশেপাশে হাঁটা এবং তারপর তাকে বলা, ‘তুমি আমার সঙ্গী, তুমি আমার সঙ্গী।’ 

মে, তারা আসলে বলে, আমি মানুষকে ভালোবাসি এবং সবাইকে ভালোবাসার কারণে কেউ কেউ আমাকে নিন্দাও করে। হ্যাঁ, আমি সব মানুষকে ভালোবাসি। কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব ও অগ্রাধিকার ছাড়াই আমি মানুষকে পুরোপুরি ভালোবাসি, আমি তাদেরকে ভালোবাসি একটা একক হিসেবে। আমি তাদেরকে ভালোবাসি কারণ তারা ঈশ্বরের আত্মা। কিন্তু প্রত্যেক হৃদয়েরই একটা বিশেষ বিশেষ কেবলা[১] আছে, প্রত্যেক আত্মারই একটা বিশেষ দিক রয়েছে একাকিত্বের সময় যা আবর্তিত হয়। প্রত্যেক আত্মারই রয়েছে সন্ন্যাস গ্রহণের আশ্রম, যার ভেতরে সে নিজেই অবসর নেয় আয়েশ ও সান্ত্বনা পেতে। প্রত্যেক হৃদয়েরই অন্য হৃদয়ের জন্য মন কেমন করে এবং এই আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে সে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনের আশীর্বাদ এবং শান্তি উপভোগ করতে অথবা জীবনের যন্ত্রণা ও কষ্ট ভুলে যেতে। 

এখন আমি অনুভব করতে পেরেছি মে, আমি সেই দিক খুঁজে পেয়েছি যার প্রতি আমার হৃদয় ধাবিত হচ্ছে। আমার এই উপলব্ধি একটা ঘটনা যা সাধারণ, স্বচ্ছ এবং সুন্দর। এ কারণেই সেন্ট থমাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলাম, কারণ সে সন্দেহ ও তদন্তের মনোভাব নিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল। আমি সেন্ট থমাস ও তার সন্দেহজনক আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব। আমাদের স্বর্গীয় নির্জনতার ভেতরে ঈশ্বর প্রদত্ত বিশ্বাস উপভোগের জন্য সে আমাদেরকে পরিত্যাগ করতে পারবে। 

এখন প্রায় শেষরাত এবং আমার ইচ্ছামতো অনেক কথাই বলেছি। সম্ভবত সকাল না- হওয়া পর্যন্ত নৈঃশব্দের ভেতরে কথা বলা উত্তম এবং ভোরবেলায় আমাদের অনেক কাজের মুখোমুখি আমার ছোট্ট প্রিয়তমা আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। তারপর যখন দিন ও তার দিনের সমস্যা শেষ তখন আমরা ফিরে আসব আগুনের পাশে বসে কথা বলতে। এখন তোমার কপালটা আরও কাছে আনো, ঠিক এরকম—এবং ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ ও রক্ষা করুন। 

জিবরান 

***

[১. মুসলমানরা যেদিকে মুখ করে নামাজ পড়ে (মক্কার দিকে) অর্থাৎ পশ্চিমদিক।]

.

নিউ ইয়র্ক, রবিবার রাত দশটা ২ ডিসেম্বর ১৯২৩ 

অস্থিরভাবে[১] একটা ব্যস্ততম দিন কেটেছে আমাদের। সকাল নটা থেকে এ পর্যন্ত আমরা পরিচিতদেরকে বলেছি বিদায় এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছি নতুনদেরকে। কিন্তু সবকিছুর ভেতরেও আমি মিনিটে মিনিটে আমার সঙ্গীর দিকে একঝলক তাকিয়েছি আর বলেছি : ‘আমি ঈশ্বরের প্রশংসা করি এবং ধন্যবাদ দিই তাকে, তার জন্যেই আমরা আবার কুঞ্জবনে মিলিত হয়েছি এবং পরস্পর পরস্পরের পকেটে বই অথবা স্কেচপ্যাডের পরিবর্তে এক টুকরো রুটি মাত্র। আমি ঈশ্বরের প্রশংসা করি এবং ধন্যবাদ দিই, তার জন্যই আর একবার আমরা ফিরতে পেরেছি আমাদের শান্ত উপত্যকায় চরতে থাকা পশুর পাল এবং উড়তে থাকা পাখির ঝাঁকের কাছে। আমি ঈশ্বরের প্রশংসা করি এবং তাকে ধন্যবাদ দিই কারণ মিষ্টি মিরিয়াম[২] নৈঃশব্দের ভেতর আমার কথা শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে আমার মোহ, যেমন আমি বুঝতে পারি তার সহানুভূতি। 

আমি ঈশ্বরের প্রশংসা করি এবং ধন্যবাদ জানাই দিন এবং তার স্থিতিকালের জন্য, কারণ তা হল দিনের আয়তন। মে, আমার জিভে কথা বলেছে, মে আমাকে ধরতে দিয়েছে তার হাত, আমি তা ধরতে দিয়েছি অন্যদের। সারাদিন ধরে তার চোখে আমি সবকিছু দেখেছি, প্রত্যেকের চেহারায় উপলব্ধি করেছি দয়া এবং তার কান দিয়ে সবকিছু শুনেছি—শুনেছি তার স্বরের মিষ্টতা। 

তুমি আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নাও এবং যখন তুমি তা করো তখন আমার পুরো অস্তিত্ব পরিপূর্ণ সহানুভূতির সঙ্গে মাতৃত্বে রূপান্তরিত হয়। আমার শরীর খুব ভালো আছে। যে অসুস্থতা সম্পর্কে আগে বলেছিলাম সেই অসুখ আমাকে পরিত্যাগ করে গেছে এবং কপালের দুপাশে ডোরাকাটা দাগ রেখে যাওয়া সত্ত্বেও আমাকে ও তোমার আত্মাকে রেখে গেছে শক্তিশালী করে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কোনো সাহায্য ছাড়াই নিজেকে সুস্থ করে তুলতে পারি। আমি ছিলাম বাস্তববাদী এবং চূড়ান্ত, কিন্তু ডাক্তারেরা যে বিবেচনা ও সন্দেহের উপত্যকায় হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নদ্রষ্টা সে-ব্যাপারে আমিও একমত। তারা প্রতিক্রিয়া অধ্যয়ন করতে অধিক আগ্রহী এবং তা তারা ওষুধ দিয়ে করার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু কারণের দিকে তারা বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয় না—যেমন ‘বাড়ির মালিকই ভালো জানে বাড়িতে কী আছে।’ আমি সমুদ্র ও অরণ্যে গিয়েছিলাম এবং কোনো রকম বাধা-বিঘ্ন ছাড়া দীর্ঘ ছয়মাস কাটিয়েছি এবং ফলশ্রুতিতে ‘কারণ’ ও ‘প্রতিক্রিয়া’ সবই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আধুনিক ওষুধপত্রের ওপর আমরা একটা বই লিখলে কেমন হয়? তুমি কী আমার সঙ্গে এই বইয়ের যৌথ লেখক হতে চাও? 

এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অবশ্যই আমাদের আলোচনা করতে হবে। অবশ্যই তোমার মনে আছে, কয়েক সপ্তাহ আগে তুমি আমার কাছে একটা গোপনীয়তাকে উন্মোচন করেছ এবং তোমার আরও মনে আছে তোমার ‘অবস্থা’ আমি মেনে না-নেওয়া পর্যন্ত তুমি তা উন্মোচিত করো নাই। কী অদ্ভুত তারা কারা, তা জানার আগেই আমি ‘অবস্থাটা’ মেনে নিয়েছি? এই অবস্থাগুলি কী? প্রিয়তমা, দয়া করে আমাকে বলবে তারা কারা? আমি প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত। ‘তোমার গোপন চিন্তাকে’ উন্মোচন করার আগে দীর্ঘদিন ইতস্তত করেছ, সুতরাং তুমি অবস্থাটা উন্মোচন করতে নিঃসন্দেহে চিন্তিত হয়ে পড়েছ। দয়া করে আমাকে বলবে তুমি কী চাও? তোমার আকাঙ্ক্ষার নিশ্চয়তা ও শর্ত কী কী? অবস্থা, অবস্থাই এবং যারা পরাজিত তাদেরকে অবশ্যই গ্রহণ ও সম্মান করা উচিত 1 কিন্তু তোমার অবস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর কী ঘটেছে তা আমি তোমার কাছে লুকাব না, আমি তদন্ত করব তোমার গালের সেই টোল অথবা কৃত্রিম টোল যা আমার চিবুককে পরিহাস করেছে। তুমি কী মনে করো আমি আমার চিবুকের ওপর নির্ভর করে সবকিছুর প্রতি সদয় হব, যা বাকি অংশকে পরিহাস করবে? কখনই না। 

আমি ঐ দুষ্ট টোলকে ঢেকে দেব যা এর পরিপার্শ্বকে সম্মান করে না। ‘এই টোল-এর অনমনীয়তা ও আক্রোশের ভেতরে বিশিষ্ট। আমি একে ঘন ও লম্বা দাড়ির ভেতরে কবর দেব।’ এটা আমি ঢেকে ফেলব চুলের সেই অংশ দিয়ে যা ধূসর হয়ে গেছে এবং চুলের যে-অংশ কালো আছে তা দিয়ে একটা কফিন তৈরি করার অঙ্গীকার করছি। যদিও আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিশোধ কার্যকর করব বেহায়া টোলের ওপর, যা কাউকে অনুগত করার ব্যাপারে অসচেতন, যার ক্রুদ্ধতা সমস্ত অস্তিত্বের ক্রুদ্ধতাকে স্পর্শ করে এবং যার হাসি তাদের প্রত্যেককে হাসায়। 

আগামীকাল আবার আমাদের আলোচনা শুরু করব, কিন্তু এখন চলো ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের তারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। বলো, আমার ছোট্ট প্রিয়তমা, মানুষের হৃদয়ের চেয়ে রাত্রি কী অধিক গভীর ও বিস্ময়কর? মানুষের হৃদয়ের ভেতরে যা চলাচল করে, ছায়াপথগুলি কী তার চেয়েও অধিক ত্রাসোদ্দীপক এবং চমৎকার? সেখানে রাত্রি ও অগণিত তারার ভেতরে ঈশ্বরের হাতে কেঁপে কেঁপে জ্বলতে থাকা শুভ্র শিখার চেয়ে কী অধিক পবিত্র কিছু আছে? 

[কোনো স্বাক্ষর নেই]

***

১. এই চিঠিতে কোনো সম্বোধন করা হয়নি। 

২. জিবরানের দেওয়া মে-এর আরও একটি নাম। 

.

নিউ ইয়র্ক ৩ ডিসেম্বরের মধ্যরাত ১৯২৩ 

দ্য প্রফেট সম্পর্কে তোমার মন্তব্যের উত্তরে আমি কী করতে পারি? এই গ্রন্থটি হচ্ছে শুধুই একটা ক্ষুদ্র অংশ, যা আমি দেখেছি ও প্রতিদিন যা দেখি এবং বহু জিনিসের একটা ক্ষুদ্র অংশ, মানুষের শান্ত হৃদয় ও আত্মার ভেতরে যে নিজের ব্যাখ্যার জন্য উদগ্রীব। নিজে নিজে সবকিছু অর্জনের ক্ষমতাসহ এই পৃথিবীর মুখের ওপর কেউ নেই—একক পরিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সে অন্য মানুষের সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ আমাদের ভেতরে সেখানে একজনও নেই, লোকে অমনোযোগী হয়ে যা বলে তার চেয়ে অধিক লিপিবদ্ধ করতে যে সক্ষম। 

মে, দ্য প্রফেট হচ্ছে একটা পৃথিবীর প্রথম চিঠি … অতীতে আমার ধারণা ছিল এই পৃথিবীটা আমার এবং সেটা আমার ভেতরে এবং সেটা আমার নিজের কাছ থেকেই পাওয়া। সে-কারণে আমি সেই পৃথিবীর প্রথম চিঠিটা সম্পর্কে রায় দিতে অক্ষম, আর অক্ষমতার কারণ হচ্ছে আমার অসুস্থতা, তবে বাস্তবিক অর্থে এর কারণ হচ্ছে আমার আত্মার যন্ত্রণা ও কষ্টভোগ। তারপর ঈশ্বর ইচ্ছা করেন আমার চোখ খুলে যাক, তাই আমি আলো দেখতে পাই এবং ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার কানও খুলে যায়, ফলে আমি শুনতে পাই এই চিঠি সম্পর্কে অন্যদের রায় এবং ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার ঠোঁট খোলা উচিত এবং সেইসঙ্গে উচিত চিঠিটা পুনরায় পড়া। আমি উল্লাসের সঙ্গে চিঠিটা পুনরায় পড়ি। কারণ প্রথমবারের মতো আমি উপলব্ধি করেছি যে, অন্য মানুষই সবকিছু এবং আমি আছি আমার পৃথক আত্মার সঙ্গে এবং এটা কিছুই নয়। স্বাধীনতা, আয়েশ ও প্রশান্তি কী তা তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। এই উপলব্ধি তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না, নিজেকে তার সীমাবদ্ধ আত্মার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত দেখতে চায়। 

এবং তুমি, মে, আমার বাড়ন্ত ছোট্ট প্রিয়তমা, তুমি আমাকে এখন সাহায্য করবে পৃথিবীর দ্বিতীয় চিঠিটা তোমাকে শোনাতে, সে সম্পর্কে রায় দিতে এবং তুমি সবসময় আমার সঙ্গে থাকবে। 

তোমার কপালটা আরও আছে আনো মিরিয়াম, আরও কাছে আনো, ঐ কপালের জন্য আমাদের হৃদয়ে একটা সাদা গোলাপ আছে, যা আমি তোমার কপালে স্থাপন করতে চাই। যখন এরকম দৃশ্যের মুখোমুখি আমি মৃদু কেঁপে উঠি, তখন মনে হয় ভালোবাসা কত মধুর। 

ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন এবং আমার ছোট্ট প্রিয়তমাকে রক্ষা করুন। ঈশ্বর তোমার আত্মা দেবদূতের গানে পূর্ণ করে তুলুন। 

জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ৩১ ডিসেম্বর ১৯২৩ 

নিউ হ্যাম্পশায়ারের মাউন্ট লাফেইতি’র ছবি সম্বলিত পোস্টকার্ড যে খামে পাঠানো হয়েছিল তাতে ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ হচ্ছে ৩১.১২.২৩। পোস্টকার্ডে নিম্নলিখিত কথাগুলো লেখা ছিল। 

গত গ্রীষ্মে এই উপত্যকা আমাকে উত্তর লেবাননের উপত্যকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। 

উপত্যকায় জীবন কাটানোর চেয়ে অধিক আনন্দদায়ক জীবন আমার জানা নেই। আমি শীতকালে উপত্যকা খুব ভালোবাসি ম্যারি, যখন চিরসবুজ সাইপ্রেস গাছ পুড়ে যাওয়ার সৌরভে ঘর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন আমরা আগুনের পাশে বসি এবং বাইরে তখন বরফ পড়ছে, বাতাস বরফকে আঘাত করছে, বাইরে বরফের বাতি ঝুলছে জানালার শার্শির কাঁচে—দূর থেকে ভেসে আসছে নদীর শব্দ এবং সাদা ঝড়ের শব্দ তার সঙ্গে একত্রিত হয়ে ঢুকে পড়ছে আমাদের কানে। 

কিন্তু আমার ছোট্ট প্রিয়তমা যদি আমার কাছে না থাকে তাহলে কোথাও কোনো উপত্যকা নেই, বরফ নেই, সাইপ্রেস গাছ পুড়ে যাওয়ার কোনো সৌরভ নেই, নেই বরফের স্বচ্ছ বাতি, নদীর গান, নেই ত্রাসোদ্দীপক ঝড়…. যদি আমার ছোট প্রিয়তমা এই সবকিছু থেকে দূরে থাকে তাহলে সবকিছুই অদৃশ্য হয়ে যাক। 

সেই প্রিয় সুন্দর মুখের প্রতি শুভরাত্রি। 

জিবরান 

পুনশ্চ : অতীতে আমি নিউজপেপার কাটিং এজেন্সি থেকে খবরের কাগজের কাটিং নিতাম। গত বছর থেকে আমি তা বন্ধ করেছি। খবরের কাগজের ওপর আমি খুবই বিরক্ত ছিলাম তখন। একঘেয়েমিজনিত ক্লান্তির ভেতরে একধরনের আধ্যাত্মিক তন্দ্রালুতা থাকে, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করো, আমি আবার এগুলো পাওয়ার চেষ্টা করব। 

.

বস্টন ১৭ জানুয়ারি ১৯২৪ 

পোস্টকার্ডে লেখা এই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল খামে। ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ হচ্ছে ১৭.১.১৪। পোস্টকার্ডে নিম্নলিখিত কথাগুলো লেখা ছিল। 

আমার জীবনের সুপ্রভাতে আমি প্রায়ই বলতাম সাভানিজ[১] হচ্ছে ডেলাক্রোইক্স[২] ও ক্যারিয়ারের পর সবচেয়ে বড় ফরাসি চিত্রকর, কিন্তু আজ আমার জীবনের এই অপরাহে এসে আবার বলছি সাভানিজই উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় চিত্রকর। কারণ সমস্ত চিত্রশিল্পীর ভেতরে তার হৃদয়, চিন্তা, কর্ম ও সংকল্প ছিল খুবই সাধারণ। 

যখন আমি যুবক ছিলাম তখন প্রায়ই বস্টনের পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম এবং ভীতি নিয়ে এইসব ছবির মুখোমুখি দাঁড়াতাম। আজ আমি আরও একবার এই লাইব্রেরি পরিদর্শনে এসেছি। আমি আমার প্রিয় মিরিয়ামকে আমার পাশে নিয়ে একই ছবির সামনে দাঁড়িয়েছি এবং এই ছবিগুলির যে সৌন্দর্য দেখলাম তা আগের বছরগুলিতে দেখি নি। অবশ্য তখন আমার মিরিয়াম আমার সঙ্গে ছিল না, সে-কারণে আমি কিছু দেখি নি। আলো ছাড়া চোখ কেবলি মুখের দুটি গর্ত মাত্র—এর বেশিকিছু না, কমও কিছু না। তুমি কী তোমার মিষ্টি কপালটা আরও কাছে আনবে? এরকম—ঠিক এরকম। ঐ মিষ্টি কপালের ওপর ঈশ্বরের আলো বর্ষিত হোক—আমেন। 

জিবরান 

***

১. পারভিস দ্য সাভানিজ (১৮২৪-১৮৯৮) হলেন একজন ফরাসি প্রতীকীবাদী চিত্রকর, যার ড্রইং বিখ্যাত হয়েছিল রঙের সাধারণত্ব ও বিষয়ের সমন্বয়ের কারণে। 

২. ইউজেন ডেলাক্রোইক্স (১৭৯৮-১৮৬৩) হলেন একজন ফরাসি চিত্রকর। তাঁকে ‘রোমান্টিক স্কুল অব আর্ট’-এর নেতা হিসেবে তখন বিবেচনা করা হত। 

.

নিউ ইয়র্ক ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৪ 

আজ আমরা একটা শক্তিশালী বরফঝড়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ম্যারি, তুমি জানো আমি সব ধরনের ঝড় কী পরিমাণ ভালোবাসি, বিশেষ করে বরফঝড়। আমি বরফ ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি এর সাদা রঙ, ভালোবাসি বরফের ঝরে পড়ার সঙ্গে এর গভীর নীরবতাও। আমি আমার হৃদয়ের গভীর দূরত্বের অপরিচিত উপত্যকায় ঝরে-পড়া বরফ ভালোবাসি, সেখানে সূর্যের আলোয় বরফের টুকরো কেঁপে কেঁপে জ্বলছে, ঝিকমিক করছে এবং নীরবে প্রবাহিত হচ্ছে, যেভাবে ফিসফিস করে তারা গানের মতো। আমি ভালোবাসি বরফ এবং আগুন, উভয়ই এক উৎস থেকে আসে, কিন্তু তাদের জন্য আমার ভালোবাসা শুধুমাত্র বিশাল ভালোবাসার জন্য প্রস্তুতি মাত্র—যা অধিক বিস্তৃত এবং মহিমান্বিত। 

এই শব্দগুলি পড়তে কী ভালোলাগে : 

মে, আমরা আজ তোমার জন্মদিন উদযাপন করব 
এবং তোমার ভেতরে উদ্‌যাপন করব জীবন। 

এই আরবি কবিতাগুলির ভেতরে কী পার্থক্য, যা সম্প্রতি এক আমেরিকান আমাকে পাঠিয়েছেন : 

তোমার সম্মান এবং পুরস্কার 
তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করবে। 

আমার এসব উদ্বেগ সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয় শেষমুহূর্ত আসার আগেই। 

এসো আবার আমরা তোমার জন্মদিনের বিষয়ে ফিরে যাই। আমার জানতে খুব ইচ্ছা হয় আমার ছোট্ট প্রিয়তমা বছরের কোনদিনে জন্মেছিল।[১]

আমি তা জানতে চাই। আমি জন্মদিন এবং এর উদযাপন ভালোবাসি। তুমি আমাকে বলবে, ‘প্রতিদিন আমার জন্মদিন, জিবরান,’ এবং আমি উত্তর দেব, ‘হ্যাঁ এবং আমি প্রতিটি দিন তোমার জন্মদিন উদ্‌যাপন করব, কিন্তু সেখানে প্রতিবছর একটা বিশেষ জন্মদিন থাকতেই হবে।’ 

প্রকৃতপক্ষে আমার মুখে দাড়ি থাকা উচিত নয়—তোমায় একথায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি খুবই খুশি এবং আমি ভাবি যে, আমার দাড়ির এই আত্মসমর্পণ বা হার মানা হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুরুত্বের একটি অবস্থা মাত্র। এই দাড়ি আমার অধিকাংশ চিন্তাকে দখল করে রেখেছে—এটাই আমার অপ্রয়োজনীয় কঠোর পরিশ্রমের কারণ। কিন্তু এখন আমার দাড়ি হচ্ছে আমার দায়িত্ব অথবা আমার আত্মার চেয়ে দায়িত্বশীল অন্য কেউ—আমার হাত এবং রেজারের স্পর্শে আমি ওকে অব্যাহতি দেব। কে এই দাড়ির দায়িত্ব নেবার কথা উত্থাপন করেছে? ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করুন যারা এই দাড়ির মালিক বলে দাবি করে। যাহোক তোমার তীক্ষ্ণ উপলব্ধি, প্রশ্নের লতাগুল্ম ছাঁটাইয়ের প্রযুক্তিগত দিকের ওপর বিস্তারিত কাজের কষ্ট লাঘব করে দেয় … 

… আমার ছোট্ট প্রিয়তমা, দ্যাখো রসিকতা কীভাবে পবিত্রের পবিত্রতার প্রতি আমাদেরকে নেতৃত্ব দেয়। আরবি শব্দ রাফিকা [সঙ্গী] আমার হৃদয়ের ভেতরে পাখা ঝাপটায় সুতরাং আমি উঠে দাঁড়িয়ে মনের ভেতরে পায়চারি করি যেন আমি সঙ্গীকে খুঁজছি। কখনও কখনও কিছু নির্দিষ্ট শব্দ আমাদের ওপর কী অদ্ভুত ক্রিয়া করে—এবং সূর্যাস্তের সময় চার্চের ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে কী সাদৃশ্য সেই শব্দের ধ্বনির। এটাই সেই অদৃশ্য অন্তরাত্মার রূপান্তর সাধন, কেবলমাত্র নীরবতার উচ্চারণ থেকে, শুধুই আরাধনার কর্মকাণ্ড থেকে।

তুমি আমাকে বলেছ যে তুমি ভালোবাসাকে ভয় পাও[২], কেন আমার ছোট্ট প্রিয়তমা, তুমি কী সূর্যের আলোকে ভয় পাও? তুমি কী সমুদ্রের ভাটার টান এবং প্রবাহকে ভয় পাও? তুমি কী ভয় পাও দিনের উষালগ্নকে? তুমি কী বসন্তের আবির্ভাবকে ভয় পাও? আমি বিস্মিত হই কেন তুমি ভালোবাসাকে ভয় পাও? 

আমি জানি যে নিকৃষ্ট মানের ভালোবাসা তোমাকে সুখী করতে পারে না, যেমন আমি জানি আমাকে পারে না। তুমি এবং আমি আত্মার ভেতরে কৃপণ হয়ে কখনই তৃপ্ত নই। আমাদের একটা বিশাল চুক্তি প্রয়োজন। আমরা সবকিছু চাই। আমরা আরও চাই উৎকর্ষ। আমি বলি কী ম্যারি, সময়ের যে দৈর্ঘ্য তা পরিপূর্ণ হয়ে আছে, সেজন্যই আমাদের ইচ্ছা ঈশ্বরের অনেক ছায়ার একটি ছায়ার ভেতরে ছিল। আমরা নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের অথবা আমাদের অনেক রাত্রির একটিমাত্র আলোকরশ্মি অর্জন করব। 

শোনো ম্যারি, ভালোবাসাকে ভয় পেয়ো না। ভালোবাসাকে ভয় পেয়ো না হে আমার হৃদয়ের বন্ধু। এর কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করতেই হবে; তা সত্ত্বেও যন্ত্রণা, আকাঙ্ক্ষা, জটিলতা ও বিভ্রান্তির পথ ধরে এটা কী বয়ে আনতে পারে? শোনো ম্যারি, আমি আজ বাসনার কারাগারে বন্দি, বাসনা বা আকাঙ্ক্ষা যা-ই বলো না কেন, এর জন্ম হয়েছিল যখন আমি জন্মেছিলাম। আজ আমার পায়ে একটা পুরোনো ধারণার শিকলের বেড়ি, যেমন বছরের ঋতুগুলো পুরোনো হয়ে যায়। আমার বন্দিত্ব কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে তুমি কী বহন করতে পারবে? সুতরাং অবশেষে আমরা সূর্যের আলো থেকেই উদ্ভূত হই। তুমি কী আমার পাশে ততক্ষণ দাঁড়াবে, যতক্ষণ-না পায়ের বেড়ি ধ্বংস হচ্ছে এবং আমরা স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারছি কোনো বাধা ছাড়াই পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত। 

এখন কাছে এসো, তোমার কপালটা আমার আরও কাছে আনো—এভাবে, হ্যাঁ ঠিক এভাবে এবং আমার হৃদয়ের প্রিয়তমা সঙ্গীকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করুন এবং রক্ষা করুন। 

জিবরান 

***

১. এই চিঠিটা লেখা হয়েছিল মে-এর জন্মদিনের পনেরো দিন পর (১১ ফেব্রুয়ারি) 

২. মে জিয়াদাহ-এর লেখা চিঠি (১৫ জানুয়ারি ১৯২৪) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। 

.

নিউ ইয়র্ক ২ নভেম্বর ১৯২৪ 

তুমি তোমার নীরবতার কারণ জানো, কিন্তু আমি জানি না। এই উপলব্ধির জন্য এটা প্রকৃতপক্ষেই অন্যায় এবং এটাই দ্বন্দ্বের উৎস হবে যা আমার দিন ও রাত্রিকে ঘিরে রাখে। কর্মকাণ্ড এবং শব্দাবলি সবকিছুর পরিমাপ করা হয় এর অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্যের সাহায্যে, কিন্তু আমার সংকল্প হচ্ছে ঈশ্বরের হাতের রেখায়। আমার ছোট প্রিয়তমা আমাকে বলো গত বছর কী কী তোমার হয়েছিল? আমাকে তা বলো এবং ঈশ্বর তোমাকে আমার পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করুন। 

ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন এবং তার আলোয় তোমায় হৃদয় পরিপূর্ণ করে তুলুন। 

জিবরান 

নিউ ইয়র্ক ৯ ডিসেম্বর ১৯২৪ 

কী মিষ্টি আমার ছোট্ট প্রিয়তমা যে প্রতিদিন প্রার্থনার ভেতরে আমাকে স্মরণ করে। কত মিষ্টি সে, কত বিশাল তার হৃদয় এবং কত চমৎকার তার আত্মা। কিন্তু আমার ছোট্ট প্রিয়তমার নীরবতা কী অদ্ভুত। কী অদ্ভুত তার নীরবতা। এই নীরবতা অনন্তকালের মতো দীর্ঘ, ঈশ্বরের স্বপ্নের মতো গভীর। তোমার কী স্মরণ আছে, যখন তোমার লেখার সময় এসেছিল, তখন তুমি লেখ নি। তুমি কী ভুলে গেছ রাত্রি পৃথিবীকে আলিঙ্গন করার আগে ঐক্য ও শান্তিকে আলিঙ্গন করার একটা চুক্তি ছিল আমাদের। 

তুমি আমার স্বাস্থ্য ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছ। যেমন তোমার প্রশ্ন, আমি কেমন আছি। আমি ঠিক তোমার মতো ভালো আছি। আর চিন্তার কথা বলছ—ওরা এখনও পর্যন্ত ধোঁয়াশার ভেতরে ঢাকা পড়ে আছে—একইভাবে, তবে আমরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি—তুমি এবং আমি—সেই হাজার বছর ধরে। 

মিরিয়াম, জীবন একটা চমৎকার সংগীত, এই জীবনে আমাদের কেউ কেউ শুধু একটা শব্দ-সংকেত দিতে পারে, আর অন্যেরা পারে একটা সুর-মাধুর্য সৃষ্টি করতে। মিরিয়াম, তোমার মনে হয় আমি ধ্বনি সৃষ্টি করতে পারি না, না পারি সংকেত দিতে, না করতে পারি সুরসৃষ্টি। আমার মনে হয় আমি এখনও ধোঁয়াশার ভেতরে আছি, যা একসঙ্গে আমাদেরকে হাজার বছর পেছনে নিয়ে গেছে। এসব কিছু সত্ত্বেও আমি ছবি এঁকে অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছি এবং একটা ক্ষুদ্র নোটবই পকেটে নিয়ে মাঝেমধ্যেই পালিয়ে যাচ্ছি কোলাহল ছেড়ে দূরের কোনো গ্রামে। ঐ নোটবইয়ের কিছু অংশ কোনো একদিন তোমাকে পাঠাব 1 

আমি আমার সম্পর্কে সবকিছু জানি, সুতরাং যা প্রয়োজনীয় চল সেগুলি ফেরত নেওয়া যাক, ফেরত নেওয়া যাক আমাদের প্রিয় মানুষকে। তুমি কেমন আছ এবং তোমার চোখ? তুমি কী কায়রোতে বসবাস করে সুখী যেমন আমি নিউ ইয়র্কে? মধ্যরাতের পর তুমি কী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে স্থিরদৃষ্টিতে চারপাশ এবং আকাশে নক্ষত্র দ্যাখো? তারপর কী তুমি ঘুমুতে যাও এবং তুমি কী সেইসব হাসিকে লুকিয়ে ফ্যালো যা তোমার চোখের ভেতরে বিলীন হয়ে যায়? আমি তোমার সম্পর্কে ভাবি প্রতিদিন, প্রতিরাত। আমি সবসময় তোমার কথা ভাবি এবং প্রতিটি চিন্তার ভেতরে কিছু নির্দিষ্ট আনন্দ ও যন্ত্রণা আছে। কী অদ্ভুত মিরিয়াম, আমি যখনই তোমার কথা ভাবি, তখনই আমি গোপনে নিজেকে ফিসফিস করে বলি, ‘এসো, তোমার যন্ত্রণা এখানে ঢেলে দাও, এখানে আমার বুকের ওপর।’ সময়মতো আমি তোমার নাম ধরে ডাকি, তবে তা অন্যদের কাছে অচেনা মনে হলেও আমার কাছে তা প্রিয় পিতা ও করুণাময়ী মাতার মতোই শোনায়। 

আমি তোমার ডানহাতের তালুতে চুমু খাই এবং তারপর বামহাতে। ঈশ্বরকে মিনতি করছি তোমাকে রক্ষা করতে, তোমার হৃদয় পূর্ণ করতে তার আলোতে এবং তিনি তার সব পছন্দের মানুষের মতো তোমারও তত্ত্বাবধান করুন। 

জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ১২ জানুয়ারি ১৯২৫ 

ম্যারি, 

এই মাসের ছয় তারিখে প্রতিটি মিনিট এবং প্রতিটি সেকেন্ড আমি তোমার কথা ভেবেছিলাম এবং মে ও জিবরানের ভাষায় যা বলা হয়েছিল তা আমি ভাষান্তর করেছিলাম। এই ভাষা পৃথিবীর অন্য কোনো বাসিন্দা বুঝতে পারে না একমাত্র মে এবং জিবরান ছাড়া …এবং অবশ্যই তুমি জানো বছরের প্রতিটি দিনই তোমার অথবা আমার জন্মদিন। 

পৃথিবীর অন্যান্য সব মানুষের ভেতরে মার্কিনীরা জন্মদিন উদযাপন করতে, জন্মদিনের উপহার দিতে ও নিতে বেশি ভালোবাসে। এরকম ঘটনা আমি অবশ্য এড়াতে পেরেছি, তারা আমার প্রতি দয়া করেছে। এ মাসের ছয় তারিখে অসম্ভব দয়া দেখিয়ে বিব্রত করেছে এবং পরিপূর্ণ করেছে গভীর কৃতজ্ঞতায়। কিন্তু ঈশ্বর জানেন এত দূরে থাকার পরও তোমার যে-কথা আমি শুনেছি তা অধিকতর প্রিয় এবং আমার জন্য অন্যেরা যা করতে পারে, তার চেয়ে মূল্যবান। ঈশ্বর তা জানেন এবং তোমার হৃদয়ও তা জানে।

জন্মদিন উদ্‌যাপনের পর আমরা একসঙ্গে বসেছিলাম, তুমি এবং আমি অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে এবং দীর্ঘ সময় কথা বলেছি পরস্পর এবং সেইসব কথা বলা হয়েছে যা দীর্ঘ অপেক্ষা ছাড়া হয় না এবং যা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তারপর আমরা দূরের নক্ষত্রের দিক স্থিরদৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়েছিলাম। আমরা তারপর আমাদের কথার সারসংক্ষেপ করলাম উষালগ্ন পর্যন্ত এবং তোমার হাত ছিল আমার ধুকধুক করতে থাকা হৃদয়ের ওপর, যতক্ষণ-না সকালটা ভেস্তে যায়। 

ঈশ্বর তোমাকে লক্ষ্য করুন এবং রক্ষা করুন, মিরিয়াম এবং মে, তিনি তোমার আলো দিয়ে তোমাকে স্নান করিয়ে দিন। ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন, যে তোমাকে ভালোবাসে তার জন্য। 

জিবরান 

চিঠির শেষে জিবরান আগুনের শিখার নিচে হাত সম্বলিত এই স্কেচটি এঁকেছিলেন, যা মে-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রতীকে পরিণত হয়। 

.

নিউ ইয়র্ক ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ 

দ্য ভিঞ্চির ছবি সম্বলিত পোস্টকার্ডে লেখা এই চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল খামে। খামের ওপর ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ হচ্ছে ৬.২.২৫। 

ম্যারি, 

আমি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্ম কখনও উপভোগ করিনি, নিজের ভেতরে গভীর অভিজ্ঞতার অনুভব অর্জন ছাড়া এবং তা হল তার মুগ্ধ করার ক্ষমতা। এগুলি তার আত্মার অংশ—আমাকেও প্রভাবিত করেছে। 

এই অবিশ্বাস্য মানুষটির শিল্পকর্মের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে যখন আমার বয়স ছয় বছর। এটা এমন একটা মুহূর্ত ছিল যা আমি জীবনে ভুলব না এবং সারাজীবন এটা আমার ভেতরে সক্রিয় থাকবে, সমুদ্রে কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া জাহাজের কম্পাসের কাঁটার মতো। আমার কাগজপত্রের ভেতরে আজ কার্ডটা খুঁজে পেয়েছি এবং এটা তোমাকে পাঠিয়ে দিই সেইসব বিষয় উদ্‌ঘাটন করতে, যার ভেতরে আমার যৌবনের বছরগুলোর বিষণ্ণ উপত্যকায় একাকিত্ব ও অপরিচিতের জন্য প্রতীক্ষা করে কেটেছে। ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। 

জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ২৩ মার্চ ১৯২৫ 

ম্যারি, 

সেই ছোট্ট ফাইলটাই তোমার দুশ্চিন্তা ও বিরক্তির কারণ হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করো। আমি ভেবেছিলাম এটা সবচেয়ে ভালো ও সহজ পথে পাঠিয়েছি। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে উল্টো। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করো প্রিয় বন্ধু এবং আমার পক্ষ থেকে স্বর্গ তোমাকে পুরস্কৃত করবে। 

তো, তুমি তোমার চুল কেটেছ। সেই দুর্বিনীত অথচ চমৎকার কালো ঢেউগুলি তুমি কেটে ফেলেছ? আমি তোমাকে কী বলব? কী বলব আমি তোমাকে, যখন কাঁচি সমস্ত অভিযোগ আগেই প্রতিহত করেছে। 

এটা কোনো বিষয় নয়। এটা কোনো বিষয়ই নয়। সেজন্যই ইতালীয় হেয়ার ড্রেসারের দেওয়া পরামর্শের ব্যাপারে আমি দ্বিমত পোষণ করতে পারি না। ঈশ্বর সব ইতালীয়দের পিতার আত্মাকে ক্ষমা প্রদর্শন করুন। 

সেই প্রচণ্ড ক্ষতির কথা আমাকে জানিয়েও সে তৃপ্ত হয়নি। আমার বন্ধুর ইচ্ছা আমার ক্ষততে আরও একটু অপমান যোগ করে বলা যে, ‘একজন কবি এবং চিত্রশিল্পী যে মার্জিত সুন্দর চুল দেখে মুগ্ধ, সে সুন্দর চুল ছাড়া অন্যকিছুর অস্তিত্ব মেনে চলতে পারে না।’ 

হে শাসনকর্তা, আমার ঈশ্বর, ক্ষমা করো ম্যারি যা উচ্চারণ করেছে তার প্রতিটি শব্দ, ক্ষমা করো তাকে এবং তার ভুলগুলি ধৌত করো তোমার ঐশ্বরিক আলোর মহিমায়। তাকে উদ্ঘাটন করো, তার স্বপ্নের ভেতরে, তার জাগরণের ভেতরে, তোমার দাস জিবরানের ক্যাথলিকবাদ উচ্চারণ যে-কোনোভাবেই হোক সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। হে ঈশ্বর, তোমার একজন দেবদূত পাঠিয়ে তাকে জানাও যে, তোমার এই দাস অনেকগুলি জানালাসহ একটা সন্ন্যাসীর আশ্রমে বসবাস করে, যে জানালার ভেতর দিয়ে সে তোমার সৌন্দর্য এবং সব জিনিস ও স্থানের উৎকর্ষতার প্রকাশ পর্যবেক্ষণ করে এবং সে কালো চুলের প্রশংসাগীতি গায়, যতটা তার পক্ষে সম্ভব এবং সে বিস্মিত হয় অতি কালো চোখের ওপর নীল চোখের কর্মকাণ্ড দেখে। আমি তোমার কাছে মিনতি করি, আমার শাসনকর্তা এবং আমার ঈশ্বর, ম্যারিকে বিশেষভাবে উপদেশ দাও কবি ও চিত্রশিল্পীদেরকে লজ্জা না দিতে, বিশেষ করে তোমার দাস জিবরানকে …আমেন। 

এই দীর্ঘ প্রার্থনার পর তুমি কীভাবে আমার সঙ্গে প্রাকৃতিক দাড়ির ত্রুটি নিয়ে আলোচনার আশা করতে পারো? অবশ্যই না। যাহোক, আমি একজন ইতালীয় হেয়ার ড্রেসার খুঁজব এবং তাকে জিজ্ঞাসা করব প্রাকৃতিক দাড়িকে সাধারণ গোলাকার দাড়িতে রূপান্তরিত করতে সে সক্ষম কী না—গোলাকার মানে ঠিক জ্যামিতিক কম্পাসের মতো, যেন আমি একজন শল্যচিকিৎসা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ—তবে আমার অপারেশন-ভীতি নেই।

এবার তোমার চোখের আলোচনায় ফিরে আসা যাক। তোমার চোখদুটো কেমন আছে ম্যারি? তুমি জানো, তুমি তোমার অন্তঃস্থল থেকেই জানো তোমার চোখের সুস্থতার ব্যাপারে আমি খুবই উদগ্রীব। যখন এটা তোমার চোখের বিষয় তখন কেন তুমি বলো যে, অবগুণ্ঠনের পেছনে যা লুকানো আছে তা তুমি দেখতে পাও—কীভাবে দ্যাখো? তুমি তো জানো মানুষের হৃদয় হচ্ছে দূরত্ব ও পরিমাণের আইন দ্বারা শাসিত এবং আমাদের হৃদয়ের সেই শক্তিশালী ও সবচেয়ে গভীর অনুভূতি হচ্ছে সেটাই, যার কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি এবং এই আত্মসমর্পণের ভেতরে আমরা অনুভব করি আনন্দ, আয়েশ ও শান্ত অবস্থা, যদিও আমরা এর প্রকৃতি ব্যাখ্যা অথবা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম নই। এটাই যথেষ্ট যে, এই অনুভূতি হচ্ছে গভীর, শক্তিশালী এবং ঐশ্বরিক। সুতরাং তুমি কেন প্রশ্ন করো এবং সন্দেহ করো? আমরা দুজনের কেউ কী বলতে পারি : ‘আমার হৃদয়ের দৃশ্যমানতার ভেতরে প্রজ্জ্বলিত একটি সাদা অগ্নিশিখা এবং এর এটা-ওটা কারণ রয়েছে অথবা এই এর অর্থ এবং এসব হল এর প্রতিক্রিয়া।’ 

আমি তোমার চোখকে জিজ্ঞাসা করেছি ম্যারি, কারণ আমি তোমার চোখের বিষয়টি নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকি, কারণ আমি ঐ চোখের আলো ভালোবাসি, তাদের দূরত্বের স্থিরদৃষ্টি ভালোবাসি এবং ভালোবাসি তাদের স্বপ্নময় দৃষ্টির নৃত্যরত প্রতিমূর্তি। 

আমার উদ্বেগ তোমার চোখের জন্য। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমি তোমার কপাল ও আঙুল সম্পর্কে কম উদ্বিগ্ন। 

ম্যারি এবং মে, ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন এবং তিনি আশীর্বাদ করুন তোমার চোখদুটিকে, সেইসঙ্গে তোমার কপাল ও আঙুলকে এবং ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন আমার জন্য। 

জিবরান 

.

বস্টন ২৮ মার্চ ১৯২৫ 

মানতেগনা’র[১] ছবি সম্বলিত পোস্টকার্ডে নিচের বাক্যগুলো লেখা ছিল। পোস্টকার্ডটি যে- খামে পাঠানো হয়েছিল তাতে ডাকঘরের মোহরের ছাপে তারিখ হচ্ছে ২৮. ৩. ২৫। 

***

১. ইতালিয় চিত্রকর আন্দ্রেয়া মানতেগনা (১৪৩১-১৫০৬) ছিলেন চিত্রকলার ক্ষেত্রে ইতালিয় রেনেসাঁর পথপ্ৰদৰ্শক। 

.

ম্যারি,

মানতেগনা’র জন্য আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে এবং আমার মতামত হচ্ছে তার প্রত্যেকটি ছবিই এক-একটি গীতিকবিতা। তবে অবশ্যই তোমাকে ফ্লোরেন্স ও ভেনিস পরিদর্শন করতে হবে এই লোকটির শিল্পকর্ম দেখতে এবং তা প্রয়োজন কেবলি নিজের জন্য। অদ্ভুত এবং খামখেয়ালিপনা কাজে, কম করে হলেও প্রচুর অনুপ্রেরণা থাকে, যেমন থাকে অস্বাভাবিকত্ব। 

সুন্দর মুখের প্রতি ধন্যবাদ। 

জিবরান 

***

নিউ ইয়র্ক ৩০ মার্চ ১৯২৫ 

ম্যারি, 

হ্যাঁ, আমার চার সপ্তাহের নীরবতার কারণ ছিল ‘স্প্যানিশ ফিভার’–খুব বেশিও নয়, আবার কমও নয়। 

আমি দেখেছি এটা খুবই কঠিন—ভয়ানকভাবে কঠিন। যে কোনো অসুখের সংবাদই তোমাকে স্পর্শ করে। যখন আমি অসুস্থ হই তখন আমার একটাই ইচ্ছা হয়, অন্যলোককে দেখে তখন ভালো লাগে না, এমনকি যাদের ভালোবাসি এবং আমাকে যারা ভালোবাসে তাদেরও নয়। আমার মত হচ্ছে যে কোনো অসুস্থতায় সুস্থতার জন্য প্রয়োজন নির্জনতা। 

যাহোক, আমি সুস্থ, সম্ভবত অল্প সুস্থতার চেয়েও ভালো এবং আমি গোপনীয়তার সঙ্গে আমার গোপন অনুভূতিকে গোপন করে বলতে পারি, আমার শরীর হল একটা প্রকাণ্ড প্রাণী, যে কোনো যুদ্ধ করার জন্য সে প্রস্তুত। এটা বিসাররি থেকে আসা সেই মানুষটি যে কঠোরতা সইতে পারে এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে এরকম বর্ণনা দেয়।[১]

আল-সাইহ[২]-এর বিশেষ সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই দেরিতে পৌঁছেছে। আজ সকালে আমি মালিক/প্রকাশকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। তিনি আমাকে জানালেন, এখনও পর্যন্ত তার কাগজের কপি তিনি নিয়মিত পাঠাচ্ছেন, হোক তা বিশেষ সংখ্যা অথবা সাধারণ সংখ্যা। 

মিষ্টি মিরিয়াম, এটা তোমার সম্পর্কে একটা বিশাল অত্যুক্তি এবং তা হল, ‘আল-সাইহ’ -এর সম্পাদক তার কাগজের বিশেষ সংখ্যায় লেখা না দেওয়ার জন্য তোমার প্রতি বিরক্ত। তুমি কী করে ভাবলে যে, নিউ ইয়র্কে আমার চারপাশে যারা আছে তারা তোমার প্রতি বিরক্ত হতে পারে? আমি হাজারবার তোমাকে বলেছি, ‘শিল্পীরা প্রকৃত অর্থে কোনো উৎপাদন-কারখানা নয়, অর্থাৎ আমরা কোনো মেশিন নই, তুমি যার একপ্রান্তে কালি ও কাগজ দিয়ে আহার জোগালে এবং আশা করলে অন্য প্রান্ত কবিতা ও প্রবন্ধ উৎপাদন করবে। আমরা লিখি যখন আমাদের লেখার ইচ্ছা হয়, তুমি যখন চাইবে তখনই লেখা হবে না। সুতরাং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আমাদের একা থাকতে দিন, কারণ আমরা একই পৃথিবীর অধিবাসী—অবশ্য তুমি অন্য বিশ্বের, তুমি আমাদের একজন নও এবং আমরা তোমার দয়া পাইনি।’ আমার এই কঠোর বাচনভঙ্গি সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? কিন্তু সত্যিই বলছি—কোনো রসিকতা নয়। তুমি কী লক্ষ্য করোনি অধিকাংশ সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের মালিকরা ভাবে, লেখক হচ্ছে গ্রামোফোনের মতো, কারণ তারা ধ্বনিসংক্রান্ত ধারণার ভেতরে জন্মেছে? 

এখানে এই নিউ ইয়র্কে আমরা হচ্ছি বসন্তের শুরু, এখানকার বাতাসে একটা উপলব্ধি ও জাদুমন্ত্রের মুগ্ধতা রয়েছে, যা আত্মা, যৌবন ও উষালগ্নের আলোতে পরিপূর্ণ—গ্রাম এলাকায় স্বল্পকালীন ভ্রমণ খুবই পছন্দের, এ্যাসতারতে ও এ্যাডোনিস-এর যাজক ও যাজিকাদের আফকা* গুহা পরিদর্শনের মতো। 

কয়েকদিনের মধ্যে যিশু মৃত অবস্থা থেকে জেগে উঠবেন মাটির নিচে সমাহিতদের জীবন দান করতে, আপেল ও কাঠবাদাম গাছে ফুল ফুটবে এবং সুমধুর গান ফিরে আসবে আমার নদী ও তার স্রোতধারায়। 

এপ্রিলের সবগুলি দিনে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে এবং এপ্রিলের পরও তুমি আমার সঙ্গে থাকবে—প্রতিদিন, প্রতিরাত।

প্রিয় মিরিয়াম, ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। 

জিবরান 

***

১. মূল আরবি শব্দ ‘বাহমউত্তিয়া’ হিব্রু ‘বি হেমথ’ থেকে গৃহীত হয়েছে। প্রকাণ্ড প্ৰাণী। 

২. ‘আল-সাইহ’ হচ্ছে আমেরিকায় আরব অভিবাসীদের খবরের কাগজ। কবি আবদেল মাসিহ হাদ্দাদ কর্তৃক নিউইয়র্কে প্রকাশিত হয়। এই কাগজের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। 

* ‘আফকা’ হচ্ছে উত্তর লেবাননের একটি গ্রাম, ধ্বংসস্তূপের জন্য খ্যাত—বিশেষ করে এ্যাসতারেত ও এ্যাডোনিসের মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ। এখানে একটা গুহাও আছে এবং এই গুহা হচ্ছে ইব্রাহিম নদীর উৎসস্থল। 

.

নিউইয়র্ক (?) মে, ১৯২৭ [১]

লোকটা সম্পর্কে তুমি কী বলবে? যখন সকালে সে ঘুম ভেঙেই তার বিছানার পাশে সেই বন্ধুর চিঠি দেখতে পায় যাকে সে ভালোবাসে। সে আনন্দে চিৎকার করে কেঁদে ফেলে : ‘সুপ্রভাত, স্বাগতম।’ তারপর অধৈর্য হয়ে এমনভাবে সে চিঠিটা খোলে যেন একজন পিপাসার্ত মানুষ একটা পানির বোতল খুঁজে পেয়েছে। তারপর সে দেখতে পায় বেশি নয়, কমও নয়, সাত্তকি বে-এর লেখা একটা কবিতা মাত্র।[২] 

এটা তেমন কিছু নয়, আমি হালিম ইফেন্দি দামুস৩ -এর একটা দীর্ঘ, বিস্তৃত এবং উপভোগ্য কবিতা খুঁজে বের করব এবং সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করার পর তোমাকে পাঠিয়ে দেব। 

সাত্তকি’র কবিতাটা যদি এপ্রিলের ১ তারিখে এসে পৌছত তা হলে এই রসিকতার প্রশংসা করা যেত এবং ভেবে নিজেকে বলা যেত, ‘কী ভয়ংকর মেয়ে সে এবং আন্তর্জাতিক ডাক সার্ভিস সম্পর্কে সে কত ভালো জানে।’ কিন্তু কবিতাটা এসেছে মে-এর প্রথম দিনে। মে ফুলের মাস, সুতরাং উত্তেজনায় ঠোঁট কামড়ানো ছাড়া আমার কী করার ছিল। আমি রাগে ফেটে পড়তে পারতাম, চিৎকার করে ভয় দেখাতে পারতাম এবং প্রচণ্ড শব্দে ভরে তুলতে পারতাম আমার বাড়িটাকে। 

যদিও আমি ঠিক করেছি শব্দের ভেতরে স্বাধীনতা অধ্যয়ন করব, ‘একটা চোখের জন্য চোখ এবং একটা দাঁতের জন্য দাঁত’ এবং আমি তোমাকে সবকিছুই পাঠাব, যা আরবি কবিতার রাজকবিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

এখন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, ‘তোমাকে ক্ষমা না করে এই বাকি দিনটা কী করে কাটাই?’ তোমার রাজকবির কবিতা আমার মুখ ধুলোয় ভর্তি করে দিয়েছে এবং বিশ কাপ কফি এবং বিশটি সিগারেট দিয়ে তা আমাকে ধুয়ে ফেলতেই হবে। শুধু তা-ই নয়, সেইসঙ্গে অবশ্যই আমাকে পড়তে হবে কিটস[৪], শেলি[৫], ব্লেক[৬] এবং মজনুন লাইলার[৭] কবিতা। 

সবকিছু সত্ত্বেও তোমার হাতের তালুটা দেখাও … এরকম করে… যেভাবে অন্য মানুষেরা দেখায়। 

জিবরান 

***

১. এই চিঠির খামের ওপর ডাকঘরের মোহরের ছাপ অস্পষ্ট। 

২. আহমেদ সাকি (১৮৬৯-১৯৩২) ছিলেন মিশরের রাজকবি এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে প্রধান আরবি কবিদের একজন। ‘বেক’ অথবা ‘বে’ ছিল একটা সম্মানজনক উপাধি। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মিশরে এরকম উপাধির প্রচলন ছিল। 

৩. হালিম দামুস একজন লেবানীয় কবি। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। 

৪. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১) একজন কবি। জিবরান তাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার শিরোনাম ‘বিহুরফ মিন নার’ (উইথ লেটারস অব ফায়ার/আগুনের চিঠিগুলির সঙ্গে)

৫. পি. বি. শেলি (১৭৯২-১৮২২) একজন কবি। ম্যারি হ্যাসকেলকে লেখা জিবরানের চিঠিতে বারবার তার উল্লেখ আছে। 

৬. উইলিয়াম ব্লেক (১৭৫৭-১৮২২) কবি ও চিত্রশিল্পী—জিবরানের সাহিত্য এবং ছবিতে যার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এমনকি তিনি ব্লেকের একটা গ্রন্থের শিরোনামও ধার করেছেন এবং তা হচ্ছে—এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল। 

৭. মাজনুন লাইলা হলেন সতেরো শতকের একজন আধা-পৌরাণিক কবি, যার প্রকৃত নাম কাইস ইবনে আল মুলাওয়াহ। 

.

নিউ ইয়র্ক ১০ ডিসেম্বর ১৯২৯ 

প্রিয় বন্ধু ম্যারি, 

আজ জানলাম যে তোমার পিতা সোনালি দিগন্তের ওপরে চলে গেছেন এবং পৌঁছে গেছেন সেই লক্ষ্যে, যা আমরা সবাই তৈরি করি আমাদের তীর্থযাত্রার সময়। কী বলি তোমাকে? ম্যারি, তুমি খুবই মহান তোমার চিন্তায় এবং শব্দ-নির্বাচনের ক্ষেত্রে। তুমি শুনতে চাও সান্ত্বনাদায়ক স্বতঃসিদ্ধ উক্তি। কিন্তু আমার হৃদয়ে প্রবল ইচ্ছা তোমার মুখোমুখি দাঁড়ানোর এবং নীরবতার ভেতরে তোমার হাত ধরার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করা, যা তোমার আত্মাকে পরিপূর্ণ করেছে, কেননা সে তোমার খুব কাছে এবং একজন অচেনা, কিন্তু তোমার অনুভব ভাগাভাগি করতে সে সক্ষম। 

ঈশ্বর ম্যারি এবং মে-কে আশীর্বাদ করুন এবং প্রতিদিন ও প্রতিরাত তিনি তোমাকে রক্ষা করুন এবং তোমাকে তত্ত্বাবধান করুন তোমার বন্ধুর জন্য। 

জিবরান 

.

নিউ ইয়র্ক ১৭ ডিসেম্বর ১৯৩০ 

মে জিয়াদাহকে নিউ ইয়র্ক থেকে পাঠানো টেলিগ্রামে যে তথ্য রয়েছে তার মর্মার্থ হল : 

শেষপর্যন্ত তোমার দয়ার্দ্র ও মিষ্টি চিঠিটা পেয়েছি, কিন্তু অসুস্থ হাত নিয়ে লিখতে পারি না—এই তথ্য পরিবেশন করছি ভালোবাসার সঙ্গে। শুভ খ্রিস্টমাস ও নতুন বছরের শুভেচ্ছা। 

জিবরান 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *