‘কস্মৈ হবিঘা বিধেম’?

‘কস্মৈ হবিষা বিধেম’?

আলোচনাটা রেলগাড়ি হইতে আধ্যাত্মিকতায় গড়াইয়া পড়িল।

শুভেন বলিল, ও জিনিসটা আমাদের দেশের নদীনালাগুলোকে শৃঙ্খলিত করে, ম্যালেরিয়ায় দেশটাকে জর্জরিত করে দিয়েছে, এখন সেদিক থেকে ফুরসুত পেয়ে ধর্ম নিয়ে পড়েছে।

তারাপদ মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, ধর্ম নিয়ে?

শুভেন উত্তর করিল, ধর্ম নিয়ে। না বিশ্বাস হয়, আজ একবার হাওড়া স্টেশনটা ঘুরে এস। পুজোর ছুটি আরম্ভ হয়ে গেল তো? সমস্ত কলকাতার লোককে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত; স্পেশাল ট্রেন, টিপ্লিকেট, বিজ্ঞাপনের চটকটাও লক্ষ্য করো—চ’লে এস সব— অভাবনীয় কন্‌সেশন—ভুবনবিখ্যাত তাজ দেখবে চল, শারদ-জ্যোৎস্নাস্নাত তুষারস্বপ্ন দেওয়ান-ই-খাস, জব্বলপুরের মর্মরশৈল, অজন্তা, ইলোরা। পুজো রইল শিকেয় তোলা, রেলের ডাকের কাছে মায়ের ডাক? বাড়ির পুজো তো উঠেই গেছে বলা চলে, আসর রেখেছে বারোয়ারি। মা এখন সর্বজনের ঘর থেকে মানে মানে বেরিয়ে এসে, সৰ্বজনীন নামে কোন রকমে টিকে আছেন; তবে লৌহদানবের সঙ্গে কম্পিটিশনে এটুকুও বজায় থাকবে কি না বলা যায় না; আরও গোটাকতক স্পেশাল, ডুপ্লিকেট, ভাড়া সম্বন্ধে আরও একটু কনসেশন,—দেখবে, সর্বজনীন বারোয়ারিতলাগুলোও ফাঁকা মাঠ হয়ে গেছে।

তারাপদ বলিল, তোমার যে পুজোর ওপর অর্থাৎ বাড়িতে প্রতিমার সামনে ব’সে পুজোর ওপর এ রকম গভীর আস্থা, এটা আমার জানা ছিল না।

শুভেন উত্তর করিল, পুজোর ছুটির ওপর ষোল আনা আস্থা থাকবে আর পুজোটির ওপর থাকবে না, এর আমি মানে বুঝি না। আসল কথা, পুজোর আবেষ্টনীর মধ্যে থেকে আমরা স’রে যাই ব’লেই পুজোর ওপর আস্থা ক’মে আসছে। সেই কথাই আমি বলছিলাম। এই স’রে যাওয়ার সুবিধে ক’রে দিয়েই রেলগাড়ি আমাদের সর্বনাশ সাধন করছে।

তারাপদ বলিল, শুভেনের নিজের মতেই লৌহদানবে যখন পেরে ওঠা যাবে না, তখন তার কথা থাক। বাকি থাকে পুজো, প্রার্থনা—এই সব। এ সম্বন্ধে কি আমরা সকলেই শুভেনের সঙ্গে একমত?

শৈলেন বলিল, তোমার মতটা কি শুনি আগে?

আমার মত, আমরা বিংশ শতাব্দীর লোক।

শুভেন টিপ্পনী করিল, বিশ্বমানবতার স্বপ্নবিলাসী! রাধানাথ?

রাধানাথ ডান হাতের আস্তিন গুটাইয়া উপর-হাতে বাঁধা গোটাকতক মাদুলি মেলিয়া ধরিল, তাহার পর আস্তিনটা আবার যথাপূর্ব নামাইয়া দিয়া টীকাস্বরূপ বলিল, এগুলোকে পুজোও বলতে পার, প্রার্থনাও বলতে পার। অবশ্য সবাই ফলপ্রদা নয়; রূপোরটি— মা শীতলা বাঁচিয়েছিলেন, বাঁচানোয় যে কৃতিত্বও ছিল, তা মুখের দাগগুলো দেখেই বুঝতে পারবে, যমরাজ এই গরিবের প্রাণটুকুর জন্যে কি খোঁড়াখুঁড়িটা লাগিয়েছিলেন। তামারটি— ওলাইচণ্ডী, শাশুড়ির সুপারিশ। কিছু ফল এখনও পাই নি; সম্প্রতি একটা শর্ত পেশ করেছি, যদি আবার এই শীতকালটায় বাতে উপদ্রব না করে তো ষোড়শোপচারে পুজো দিয়ে মাদুলিটা সোনার ক’রে দেবো, দেখি কি হয়! তবে খতিয়ে দেখেছি, মোটের ওপর শতকরা পঞ্চাশটা প্রার্থনা পূর্ণ হয়। জীবনভোর প্রার্থনা ক’রেই কেটে গেল ব’লে কোন্ অলক্ষ্য শক্তির দ্বারা সেগুলো পূর্ণ হয়, সে তত্ত্বের কথাটা অবশ্য ভেবে দেখবার সময় পাই নি। আর একটা মজা দেখি, এটা বোধ হয় মাত্র আমারই জীবনের একটা বিশেষত্ব দেখেছি, সেই শক্তি প্রার্থনাগুলি অল্টার নেট্‌লি মঞ্জুর করেন, একটি তথাস্তু, পরেরটি নৈবচ। অবশ্য ভুল হয়ে যায় তবুও যতটা পারি প্রার্থনাগুলিকে রেগুলেট ক’রে চলবার চেষ্টা করি। যেমন ধর, পূর্ণ হবার পালা জেনে এই সেদিন প্রার্থনা করেছিলাম, মা, অন্তত পাঁচটা টাকাও মাইনে বাড়িয়ে দাও। জানই তো, গত মাস থেকে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশে উঠেছি। এর পরেরটি মঞ্জুর হবে না, দেবী বোধ হয় বেশি আশকারা দিতে চান না; তাই প্রার্থনা করেছি, মা, যেন শত পুত্র লাভ করি। বেশ পৌরাণিক গোছের প্রার্থনা, কিন্তু ও ধৃতরাষ্ট্রেরই পোষায়, পঁয়ত্রিশ টাকায় তো অতবড় হেঁপা সামলানো যায় না। এ প্রার্থনা মঞ্জুরও হবে না। বেশ নিশ্চিন্দি আছি। এর পরের প্রার্থনা করব, গিন্নীর বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসবার মন হোক, গেছেও অনেক দিন। তার পরের প্রার্থনাটা হবে (শুভেনের পানে চাহিয়া) শুভেনের রেল-দানবকে বিনষ্ট করবার জন্যে।

শুভেন রাগতভাবে চাহিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিল।

তারপর বলিল, বাকি রইলে শৈলেন তুমি। এ সম্বন্ধে তোমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথাটা জানতে পারলে মন্দ হ’ত না।

শৈলেন বলিল, আমায় আপাতত দিন-কতকের জন্যে রেহাই দিলে পারতে, কেন না আমি এখন ওই দুটোর মধ্যে দোল খাচ্ছি, কোন একটা মীমাংসায় পৌঁছতে পারি নি।

শুভেন বলিল, তবুও বল না শুনি। আরে, সন্দেহ-দোলায় তো আমরা সকলেই দুলছি। মানুষ মাত্রেরই দোলায় আগমন ঘোড়ায় যাত্রা, ছত্রভঙ্গ ক’রে।

শৈলেন বলিল, আমি তোমার দেবতাও মানি, আবার দেবতা মেনেও তারাপদর বিশ্বমানবতা মানতে বাধা দেখি না; কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্টভাবে মানতে হচ্ছে ব্যক্তি-মানবকে অর্থাৎ রাম-শ্যাম-যদুকে, যে দেবতা আর বিশ্বমানব দুইকেই আড়াল ক’রে নিজেকে প্রকট ক’রে দাঁড়িয়েছে। দেবতাও আছেন, বিশ্বমানবও নিতান্ত কবি-কল্পনা নয়; কিন্তু পুজো করতে হ’লে আর সবকে ছেড়ে এই ব্যক্তি-মানবকেই আগে করব। কেননা দেখা গেছে, তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে দেবতার ভোগ থেকেও কেটে দেওয়ার তার ক্ষমতা আছে; অথচ দেবতার ক্ষমতা নেই যে তার কাছে মাথা তোলেন। তোমরা চাইছ নিশ্চয়, কিন্তু অকস্মাৎ সেদিন শিলা-দেবতার পুজো করতে গিয়ে এই মানব-দেবতার পুজো ক’রে ফেলে একটু প্রত্যক্ষ ফল পেয়েছিলাম, সেই থেকে আমার ভক্তিটা একটু যেন এই দিকে ঢলেছে। আমরা পুজো করি বিজেতার (বা বিজেত্রীর)। ধর, ছিন্নমস্তক এবং শূলবিদ্ধ না হয়ে মহিষাসুরই যদি মার বাহুটাতে শিঙ বিঁধে তাঁকে কাবু করতে পারত, পুজোটা কাকে দিতে আজ—তা ভয়েই হোক বা ভক্তিতেই হোক? মহিষাসুর বেশে দেবতার কাছে হেরেছিল যে দানব, সে এখন মানববেশে দেবতাকে দাবিয়ে রেখেছে, নানারূপে পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করে। পুজোয় আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু পুজোটা দোব আমি কাকে, তাই নিয়ে আমি একটা সমস্যায় পড়েছি, একটু পরিবর্তন ক’রে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, কস্মৈ হবিষা বিধেম—দেবায় দানবায় বা? হবিঃ আমি কাকে দোব? দেবতাকে না দানবকে?

রাধানাথ বলিল, শৈলেনের কথাটা নেহাত ফেলবার নয়; পুজো যদি লেগে যায় তো প্রত্যক্ষ ফল দিতে মানুষের মত কেউ নয়, তবে মানুষের হাঁ-টা বেশি বড়, অল্পে মন পাওয়া যায় না। পাশের বাড়িতেই শুনলাম, সুবিনয়ের ঠকুমা সওয়া পাঁচ আনা মানত ক’রে নাতিটিকে মা-কালীর মধ্যস্থতায় ম্যাট্রিক পাস করিয়ে দিয়েছেন, এদিকে ডালিতে সওগাতে আমার প্রায় টাকা দশেক বেরিয়ে গেল, ভাইটিকে নিতে পারবেন কি না—সে উত্তরটি বড়বাবুর কাছে এখন পর্যন্ত পাওয়া গেল না। বোঝ কাণ্ডটা, দশ টাকা আর কোথায় সওয়া পাঁচ আনা, তফাতটা দেখ একবার।

শৈলেন মুখ হইতে সিগারেটটি সরাইয়া ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, আমি যাঁর কথা বলছি, তিনি ঠাকুরের চেয়ে পৌনে আটআনার বেশি পুজোতেই তৃপ্ত হলেন, অবশ্য চাকরি দেন নি, কেননা তাঁর হতে চাকরি ছিল না, তবে যা কিছু হাতে ছিল তার মুখ্যাংশ যে আমায় দিয়েছিলেন, এ কথা স্বীকার না করলে অধর্ম হবে।

তারাপদ কাঁকালে একটা বালিশ টানিয়া লইয়া অর্ধশয়ান হইয়া বলিল, তবে একটু সবিস্তারে বল। এত অল্পেই যিনি কল্পবৃক্ষের কাজ করেন, তাঁর কাহিনী দিয়েই আজ সন্ধ্যাটুকু পবিত্র করে নেওয়া যাক।

শৈলেন বলিতে লাগিল, আমি এবার দিল্লি থেকে ফেরবার পথে বৃন্দাবন হয়ে আসি। পৌঁছুলাম সন্ধ্যার সময়। পরের দিন সকালে একটা ট্যাক্সি এনগেজ ক’রে বড় বড় দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেললাম। রাত দশটায় আমার গাড়ি। ভাবলাম, বিকেলটা তা হলে হেঁটেই দেখে আসি। একটু গলিঘুঁজির ভেতর পর্যন্ত গিয়ে না দেখলে শুধু সাজানো জায়গাগুলো দেখেই কোন একটা স্থান সম্বন্ধে ঠিক মত ধারণা হয় না, যেমন শুধু পোশাকী বেশে এবং পোশাকী কথায় কোন লোকের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। গলি-ঘুঁজি ঘোরা ট্যাক্সি কিংবা টাঙ্গার দ্বারা সম্ভব নয়। রোদটা একটু ভাল ভাবে পড়তেই বেরিয়ে পড়লাম এবং এ গলি সে গলি ঘুরতে ঘুরতে সন্ধের সময় একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম; তিনটে গলি সেখানে মিশেছে, একপাশে খানিকটা খোলা জায়গা, তার পেছনে একটা মাঝারি গোছের মন্দির।

আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, খোলা জায়গাটাতে একটা পাথরের বেঞ্চের মত ছিল, গিয়ে তার ওপর ব’সে পড়লাম। দৃশ্যের মধ্যে কোন বিচিত্রতা নেই। মন্দিরে কিছু লোক যাওয়া-আসা করছে; সামনে একটি টিউব-ওয়েল; মেয়েরা ঘড়া নিয়ে আসছে, জল ভ’রে মাথায় তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

তারাপদ বলিল, আশ্চর্য! তবুও তুমি বিচিত্রতার অভাব পেলে? জলভরণ আয়ী ব্রজনারী—

শৈলেন তারাপদর পানে একটু মৃদু হাসিয়া চাহিল, বলিল, একটা টিপ্পনী যে হবে এ জায়গাটিতে, তা আমি জানতাম; কিন্তু বৈচিত্র্য কই বল? তুমি যে অর্থে বৈচিত্রের কথা বলছ, সে তো দূরের কথা, ওরা যে ব্রজনারী তাই গিয়েছিলাম ভুলে, কেননা টিটেগড় কিংবা নৈহাটির কুলি লাইনের চেয়ে স্থানটা বিশেষ আলাদা ছিল না। ব্রজনারীর সার্থকতা যমুনায়, শ্যামতৃণাস্তীর্ণ পুলিন, তার ওপর লুটিয়ে পড়ছে কালো জলের ঢেউ। তমালশাখায় শিখীর দল, তারা মুরলীর তানে পেখম ধ’রে কেকাধ্বনিতে কালিন্দীর তীর উচ্চকিত ক’রে তুলছে। আসছে ব্রজাঙ্গনার দল, হাস্যেলাস্যে, কৈশোর-যৌবনের শত ভঙ্গিমায় চঞ্চল লহরী তুলে, জলের স্রোতে একটি লীলাচপল রূপের স্রোত মিশতে আসছে। যাদের বঙ্গনারী বলে আমরা জানি, তাদের উদ্দেশ্য তো জল ভরা থাকত না, তাদের উদ্দেশ্য থাকত শুধু যমুনা—প্রেমের তীর্থ যমুনা, কালো জলে, তীরের শ্যামলিমায়, আকাশপ্লাবী সুরের মূর্ছনায় ঢলঢল। জল ভরার জন্য আসা নয়, জল ভরাটা ছিল মাত্র সাধন; আসা হিসাবের সংসার পেছন ফেলে বেহিসাবের নমক্রীড়ায়, কার কলসী গেল ভেসে, কার গেল জলের পূর্ণতায় অতল জলে তলিয়ে, তার হিসেবে রাখা হত না। তার জায়গায় সঙ্কীর্ণ গলির প্রান্তে পায়োনিয়ার ফাউন্ড্রি কিংবা আর্থার ডেভিসন কোম্পানীর নলকূপ। মিউনিসিপ্যালিটি লেজারের আয়ব্যয় কড়াকান্তিতে পর্যন্ত ক’ষে নিয়ে আড়াই ফিট একটি পাকা চত্বর গড়িয়ে দিয়েছে। সেইটুকুতে কলসী আগে বসাবার অধিকার নিয়ে তোমার জলভরণ আয়ীদের মধ্যে থেকে যে সুললিত ব্রজবুলীর বুকনি মাঝে মাঝে নির্গত হচ্ছে, তাতে—রক্ষে যে মন্দিরের দেবতা পাষাণরূপেই রয়েছেন—নবরূপে থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে পাষাণ মেরে যেতে হ’ত।

শুভেন হাসিয়া বলিল, শৈলেনকে চটিয়েছে তারাপদ।

তারাপদ বলিল, মাফ চাইছি শৈলেন। অত অল্প একটু উসকে দিতেই যে তোমার মধ্যেকার কবিটি এমন উগ্র হয়ে বেরিয়ে পড়বেন, এমন আশঙ্কা করি নি। গল্প বল।

শৈলেন বলিয়া চলিল, আমি অলসভাবে এইসব কথা ভাবছিলাম, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এই বিরোধ। সেটা ছিল যুবদেবতার যৌবন অর্থাৎ আতিশয্যের কাল; এটা হচ্ছে যেন বার্ধক্য, এখন জল পরিবেশন করতেও যেন হিসেবে খতিয়ে তার হাত কেঁপে উঠেছে; নলকূপের সঙ্কীর্ণ জলধারা আর তাই নিয়ে এই কলহ দেখে-শুনে আমার এই কথা মনে হচ্ছিল। সন্ধ্যা গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের কলের লোক ক’মে এল এবং মন্দিরে দু- একটি করে পূজকের সংখ্যা বেড়ে উঠতে লাগল। তারপর হঠাৎ একসময় কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠল। দেখলাম আরতি শুরু হয়েছে। উঠে গিয়ে একপাশটিতে দাঁড়ালাম।

হিন্দু হ’লেও স্বীকার করবে, হিন্দুদের পূজা-অনুষ্ঠান জাতিগত সৌন্দর্যজ্ঞানের একটা চমৎকার নিদর্শন, তার মধ্যেও আরতি জিনিসটি সৌন্দর্যের একেবারে চরমোৎকর্ষ, সময় হিসেবে, আবার চারুশিল্প হিসেবেও, যদি পুজোর একটা অঙ্গকে চারুশিল্প বলতে আপত্তি না কর।

আরতি শেষ হ’লে পেছনকার লোকেরা এক-একটা প্রণাম ক’রে ধীরে ধীরে চ’লে গেল। খালি পেয়ে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। মথুরা-বৃন্দাবনের অধিকাংশ মূর্তির মত এও দেখলাম রাধাশ্যামের যুগল মূর্তি। আগন্তুকদের যারা বাকি রইল, তারা স্বভাবতই একটু বেশি ধর্মপ্রবণ বুঝতেই পার, না হ’লে বাইরের দিকে দাঁড়িয়েই এক-একটা প্রণাম ঠুকে খ’সে পড়তে পারত। তারা প্রায় সবাই স্ফুট বা অস্ফুট স্বরে দু-একটা ক’রে স্তব আওড়ালে, তারপর সাড়ম্বরে আবার প্রণাম করে প্রায় সকলেই একটি ক’রে পয়সা বেদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দু-একজন ক’রে চ’লে যেতে লাগল।

আমি একটু ফাঁপরে পড়লাম। একটিও স্তব জানা নেই, অথচ এসে দাঁড়িয়েছি একেবারে মূর্তির সামনে। এতক্ষণ মনের মধ্যে যে অপরিসীম একটি তৃপ্তি অনুভব করছিলাম, যা সত্যিকার পুজো, সেটা কোথায় গেল, আর সন্ধান পেলাম না। দেবতা কি ভাবছেন বলা যায় না, তবে দেখলাম, কয়েকজন মানুষ যেন আমায় দেখে একটা দুর্বোধ্য সমস্যায় প’ড়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, ভাবটা যেন—এ আবার কি জীব, মন্দিরে আসে, অথচ স্তব জানে না! এই সমস্যাপীড়িতদের মধ্যে একজন মন্দিরের পুরোহিত, পাণ্ডা বা অন্য সহকারী। সে লোকটা মূর্তি থেকে একটু দূরে দুই হাঁটুতে ভর করে কোমর মুড়ে দাঁড়িয়েছিল। লোকটাকে আমার মোটেই ভাল লাগছিল না, কেমন একটা হিসাবকুটিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মূর্তির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে, যেন অব্যর্থ দৃষ্টিতে প্রণামী পয়সাগুলোর হিসেব কষে যাচ্ছে, বোধ হয় পরে ভাগাভাগিতে ইতরবিশেষ না হয় সেই জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে আবার আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল,—যদি ঠিক বুঝে থাকি তো তাতে শ্লোক না জানার জন্যে কৌতূহল ছিল শ্লোক না জেনে মন্দিরে এতদূর এগিয়ে আসার জন্যে বিদ্বেষ ছিল এবং সেই শ্লোক না জানার অপরাধটার জন্যে ভাল রকম প্রণামী দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করছি, কি না করছি, সেই নিয়ে একটু লুব্ধ উদ্বেগ ছিল। আর সবাই যারা আমার অজ্ঞতায় কৌতূহল অনুভব করছিল, তাদের অগ্রাহ্য করলাম, কিন্তু এর দৃষ্টির সামনে আমি কোনমতেই নিজের অন্তরে শুদ্ধিটাকে ধ’রে রাখতে পারলাম না। একটু পরে যেন ধ্যান করছি এই ভাবে, অর্ধস্তিমিত নেত্রে আস্তে আস্তে শুরু করে বেশ দ্রুতভাবেই ঠোঁট নাড়তে লেগে গেলাম। তোমরা শুনে নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হ’লে না, দেবতাও নিশ্চয় সেদিন ওই মেকী ঠোঁট-নাড়ায় সন্তুষ্ট হন নি; কিন্তু তখন ভাবগ্রাহী দেবতা তো আমার কাছে সত্য নয়, সত্য ছিল দুটি সন্ধানী দৃষ্টির বিষাক্ত তীক্ষ্ণ চাহনি। তাকেই নরম করবার জন্যে আমার সমস্ত সত্তা উঠে পড়ে লেগেছিল, কথাটা তোমার প্রিয় সাইকলজি-সম্মত তারাপদ। হাসছ বটে, কিন্তু নিতান্ত হেসে উড়িয়ে দেবার মত নয়।

তারাপদ বলিল, হেসে ওড়াবার জন্যে হাসছি না, তোমার তৎকালিক অবস্থাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, স্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছি, দুটো উগ্র চোখের সামনে পরিত্রাহি ঠোঁট নেড়ে যাচ্ছ, তাই—

শৈলেন বলিল, তোমার কল্পনা আছে, কিন্তু সহানুভূতি নেই, নইলে আমার অবস্থাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে চোখ দুটো অশ্রুতে ভেসে যাওয়ার কথা। যাক, অনভ্যাসের দরুন ঠোঁট যখন প্রায় আড়ষ্ট হয়ে এসেছে, একবার আড়চোখে চেয়ে দেখলাম। দেখি, কোন ভাবান্তর নেই, কিংবা যদি ভাবান্তর ছিলই তো বরং আরো উগ্রতার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে আমার স্ফূরিত অধরোষ্ঠের সব ফাঁকই যখন ধ’রে ফেলেছে। সেই দৃষ্টির মধ্যে ছিল একটা হিংস্র উল্লাস—যেন একটা আশা, এইবার দুর্বলতাকে কেন্দ্র ক’রে মোটারকম ঘুষ আদায় করতে পারবে। পাণ্ডাজাতীয় লোকদের মধ্যে তুমি এই জিনিসটা আকছারই দেখতে পাবে। পাণ্ডা হচ্ছে ধর্মের খেয়ার আমাদের পারানি, কিন্তু ধর্মসম্বন্ধীয় আমাদের কোন ত্রুটি- বিচ্যুতি বা দুর্বলতায় ওরা মোটেই দুঃখিত নয়, কেননা এই ত্রুটি-বিচ্যুতিই ওদের উপজীবিকা। কথাটা বড় অদ্ভুত নয়? কিন্তু বড় সত্য। তুমি যত পাপ করবে, তত বড় তোমার প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা, তত বড় মোটা কাঞ্চনমূল্য পুরুতঠাকুর বা পাণ্ডার ট্যাকে গিয়ে উঠবে, তার দুঃখ করবার ফুরসত কোথায় বল?

অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। বলবে বোধ হয়, মন্দির ত্যাগ করে আসছিলাম না কেন? তার দুটো কারণ ছিল, প্রথমত তো চ’লে আসতে পা উঠছিল না, যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল; আর দ্বিতীয়ত-পা যদি কোন রকমে উঠতও, চলে আসতে সাহস হচ্ছিল না। না হবার কারণ, পেটে যেমন একটাও শ্লোক ছিল না, পকেটে তেমনই একটাও পয়সা ছিল না যে প্রণামী দিয়ে স’রে পড়ি। স্তব আর পয়সা দুদিক দিয়েই ফাঁকি দিয়ে এদের সামনে দিয়ে চ’লে আসবার যে দারুণ লজ্জা আর অস্বস্তি, তার আমি সম্মুখীন হয়ে উঠতে পারছিলাম না। আমি একটা ফাঁকতালের অপেক্ষা করছিলাম। অন্যান্য কৌতূহলীরা একে একে যাচ্ছে, পাণ্ডাঠাকুরের একটু সুমতি হ’লেই স’রে পড়ব। ততক্ষণ ঠোঁট যেমন নড়ছে নড়ুক।

হাসিও পায়; এসেছি দেব-মন্দিরে, কিন্তু আমার দ্রুত পরিবর্তনটা লক্ষ্য কর। দেবতাকে তো আর সেখানে থাকতে দেয় নি ওরা। তা হ’লে নিশ্চয় করুণাপরবশ হয়ে তিনি আমায় বাঁচাতেন।

ঠিক কথা, পকেটে পয়সা ছিল না বটে, একটা আধুলি ছিল। কিন্তু গোটা একটা আধুলি তো প্রণামী দেওয়া যায় না, বিশেষ ক’রে প্রণামী যখন ঠাকুরকেই দেওয়া হচ্ছে না, ভাঙাবারও কোন অন্য উপায় নেই। ঠোঁট নাড়ার নেপথ্যে, কি যে করব মনে মনে ভাবছি, হঠাৎ স্মরণ হ’ল, ব্যাগে একটা অচল পয়সা আছে; অচল মানে সেটা মোগল আমলের কিংবা ওই রকম কোন সময়ের পয়সা। এবারে দিল্লিতে সংগ্রহ করি। ছাপ-টাপগুলো বেশ আছে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

চামড়ার ব্যাগ মন্দিরে বের করা যাবে না, আস্তে আস্তে পকেটে হাত পুরে দিলাম, সন্তর্পণে বোতাম টিপে পকেটের ভেতরেই ব্যাগটা খুললাম। উদ্বেগে হাতটা কাঁপছিল, কম্পিত আঙুলেই মুদ্রা দুটোকে অনুভব ক’রে একটা ধরলাম। বের করতে গিয়ে একবার প’ড়ে গিয়ে ব্যাগের কোণে স’রে গেল। সিগারেটের পাইপ, ডাক-টিকিট প্রভৃতির মাঝ থেকে আবার তাকে উদ্ধার ক’রে মুঠোয় নিয়ে বের করলাম এবং মূর্তির পায়ের কাছে ফুলের গাদার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। কাজটা একা আমার হাতই সারলে, কেন না আমার দৃষ্টি এদিকে বরাবরই পাণ্ডাঠাকুরের দিকে ছিল; স্তব জানি আর নাই জানি, এদিকে আমার ভক্তি যে মূল্য হিসেবে আর সবার সঙ্গেই সমান, সেদিকে যে আমি দেব-মূর্তিকে ফাঁকি দিচ্ছি না, সেটা জানার বিশেষ সতর্কতা ছিল। তারপর প্রণাম ক’রে বেরিয়ে এলাম।

.

কথাটা শুনতে কেমন কেমন লাগে বটে, কিন্তু মন্দির থেকে বেরুতেই বাইরের হাওয়া লেগে কপালটা যেন জুড়িয়ে গেল।

বাইরে একটু রক, তাই থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। কয়েকজন স্ত্রীলোককে উঠতে দেখে আমি এক পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে রুক্ষ গলাটাকে সাধ্যমত মোলায়েম করে কে একজন ডাকলে, বাবুজী!

ফিরে দেখি সেই পাণ্ডা। অথচ পয়সা চালাবার অপরাধে মন দুর্বল হয়েই ছিল, বুকটা যেন ধড়াস করে উঠল। যথাসাধ্য মনের ভাবটা সামলে নিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে উত্তর করলাম, কেয়া মহারাজ? সঙ্গে সঙ্গে তার মহারাজত্বটাকে আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে যুক্তকর মাথায় ঠেকিয়ে বললাম, দণ্ডবৎ হই। বিদেশ-বিভূঁই, একা মানুষ বুঝতেই তো পারছো অবস্থাটা।

পাণ্ডাজী বললেন, আপকো জরা ভিতর আনে পড়েগা, বড়া পাণ্ডাজীকা ঘরমে।

আত্মারাম খাঁচা ছাড়বার উপক্রম করছে। বললাম, যেতাম, বড় মহারাজের সঙ্গ লাভ—সে তো মহাভাগ্য, পরম কাম্য জিনিস; কিন্তু আমায় এক্ষুনি বাসায় ফিরতে হবে।

পাণ্ডাজী একটু গূঢ় মৃদু হাস্যের সঙ্গে ডাইনে ও বাঁয়ে মাথা নাড়লেন, শেষে বললেন, রাধাস্বামী নারাজ হোয়গা বাবুজী, ছোড় নেহি সকতে।

সর্বনাশ! আবার রাধাস্বামীকেও জড়িয়েছে। ছাড়বে তো নাই, তবু একবার শেষ চেষ্টা করা। বললাম, না ছাড় মহারাজ, যেতেই হবে; কিন্তু ছেড়ে দিলেই ভাল করতে। বাসায় একগুষ্টি মেয়েছেলে, চারজন অসুখে পড়েছে, নেহাত রাধারমণকে না দেখলে প্রাণ আইঢাই করে, সেইজন্যে কোন রকমে একবার আসা।

ভেতর থেকে একজন গলা বাড়িয়ে হাঁক দিলে, লে আয়া বাবুকো মথরা-পরসাদ?

তাঁর চেহারা নজরে পড়ল না, কিন্তু আওয়াজ শুনে যা ধারণা হ’ল, তাতে আমি একেবারেই হাল ছেড়ে দিলাম। অবসন্ন কণ্ঠে বললাম, চল তা হ’লে!

দু পা এগিয়ে মনে হ’ল, অদৃষ্টে যা আছে সে তো ফলবেই, তবু আগে থেকে সাফাই গেয়ে রাখা ভাল। বললাম, পাণ্ডাজী মহারাজ, ওই প্রণামীটা যা দিয়েছি নেহাত নিরুপায় হয়েই, না হ’লে ও কি আর জেনেশুনে কেউ রাধাস্বামীর শ্রীপাদপদ্মে দিতে পারে? ওঁর কাছে তো সবাই সমান, মোগল রাজাই বল আর ইংরেজ বল আর গর্ভমেন্টই বল। শুভেন, তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, যেন ভয়ানক উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছ!

শুভেন বলিল, তোমায় ফাঁসিতে ঝোলাতে নিয়ে যাচ্ছে, উৎকণ্ঠিত হব না? বন্ধুবিচ্ছেদের কষ্ট।

শৈলেন বলিল, কষ্টের বদলে এবার হিংসে হবে। বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে ফাঁসির বদলে যদি গলায় পুষ্পমাল্য তুলে দেয় তো—

তিনজনেই একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, মানে?

শৈলেন বলিতে লাগিল, দেবতার বেদী থেকে একটু দূরে একপাশে একটা ছোট ঘর। মূর্তির সামনে আসতেই বড় পাণ্ডাজী সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, ‘আইয়ে বাবুজী’ ব’লে দু হাত বাড়িয়ে আমায় আমন্ত্রণ করলেন এবং দু-একবার এদিক ওদিক চেয়ে আমি কিছু ভাববার বোঝবার পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের হাত থেকে মালাটি নিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, বৈঠিয়ে।

মেঝেতে নয়, একটি নির্দিষ্ট আসনে বসলাম। তিনিও আমার সামনে বসলেন। ভুঁড়িটি পায়ের অনেকখানি ঢেকে ফেলেছে, মুখে প্রসন্ন হাসি, পায়ের তেলোয় হাত বুলাতে বুলোতে দুলে দুলে বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে বললেন, ভক্তি তো আজকাল বড় দেখা যায় না বাবুজী, তাই খাঁটি ভক্ত দেখলেই বড় আনন্দ হয়। অরে, চন্নামৃৎ দেও বাবুজীকে মথরা, আওর ভোগকা পরসাদি; উঠো, লে আও।

মথুরাপ্রসাদ একটু বিমূঢ়ভাবে বড় পাণ্ডাজীর মুখের দিকে চেয়ে রইল—যেন কিছু বলতে চায়, অথচ আমার সামনে বলা সমীচীন হবে কি না বুঝে উঠতে পারছে না। বড় মহারাজ হেসে বললেন, আরে, রাতহিকা পরসাদিসে লে আও দো-চার পেঁড়ে, দো পত্তি তুলসী ডাল দেও।

বুঝলাম, সন্ধ্যের প্রসাদ ইতিমধ্যে কাবার করেছে এরা। রাত্রের ভোগের জন্যে রাখা মিষ্টি থেকে কিছু বের ক’রে, দুটো তুলসীপাতা ফেলে দিয়ে আমায় খুশি করতে চায়। ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলাম; আপত্তিও করলাম মৃদু গোছের। জোর আপত্তি করবার শক্তি ছিল না বা ক্রমেই লোপ পাচ্ছিল, সব দেখেশুনে আমি ক্রমেই অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম।

বড় মহারাজ বিস্মিত হয়ে বললেন, আরে, দোষ কি আছে? ভগবান তো ভক্তের মুখ থেকেই আহার লেন। আগে ভক্ত তব্ ভগবান, আগে সুদামা তব্ কিষুণজী, আগে তুলসী তর্—আরে, তু খড়া কেঁও রহে মথরা, যাও। ভক্তি বোলো আর বিশোয়াস বোলো বাবুজী—এক খালি বাঙ্গালিয়নমে হ্যায়, ব্যস্। আমি তো দূর থেকে ব’সে দেখছিলাম বাবুজী, কেতো লোক আসছে, কেতো যাচ্ছে, লেকিন চেহরে পর ভক্তি কাঁহা?

বিমূঢ় হয়ে গেছি; এর পরিণাম কোথায়? ঠাট্টা করছে নাকি?

মথুরাপ্রসাদ প্যাড়া আর চিনি ভরা একটি মাঝারি গোছের সরা সামনে বসিয়ে কুষি ক’রে হাতে চরণামৃত দিলে, তারপর সামনে মেঝের ওপর বসে চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে হাত নেড়ে বললে, ঐ তো মুগ্ধ বনে ওহি দেখ রহা থা, আঁখ আঁধা মুনে হুয়ে ক্যা ধ্যানকা ভার! মানো কে শিবজী রাধাশ্যামকা ধ্যান কর রহে হ্যাঁয়—ব্যস্–সিফ ওঁঠ (ঠোট) জরা জরা হিপ রহা হ্যাঁয়। কহা তো—মুগ্ধ বনে ওহি দেখ রহা থা।

মন্দিরে তখন লোক যাওয়া-আসা করছে, কেউ দিচ্ছে একটি পয়সা, কেউ দিচ্ছে না; প্রণামী দেওয়ার মত হাত চললেই দুজনের নজর কথাবার্তার মধ্যেও সেই দিকে গিয়ে পড়ছে। আমি এই বিশিষ্ট রকম আপ্যায়নে লজ্জিত যে না হয়ে উঠেছিলাম এমন নয়; কিন্তু জানই তো, সব বিশিষ্টতা অর্জনের মধ্যে একটা মাদকতা আছে। আমি চারিদিকের অনাদৃতদের মধ্যে এই আদর-অভ্যর্থনায় অসন্তুষ্ট হচ্ছিলাম না, যদিও এত বড় অন্যায় ব্যাপারটা দেবমন্দিরেই হচ্ছিল। আমি শুধু আশ্চর্য হচ্ছিলাম, কি এমন ব্যাপার ঘটেছে, যার জন্য এই একটু আগে যার বা যাদের দৃষ্টি আমায় স্ফুর বিদ্বেষে বিঁধছিল, তাদের কাছে আমি এত বড় ভক্ত হয়ে গেলাম যে, আমার সুস্পষ্ট প্রবঞ্চনাকে ওরা শিবের ধ্যানের সঙ্গে তুলনা করতেও পেছপা হল না। বাঙালি বলে? বৃন্দাবনে বাঙালি তো কম নয়, এবং আমার সামনেই আরও দু-একজনকে প্রণাম করে যেতে দেখলাম। তবে?

আরও খানিকটা সময় গেল। সময়টুকু পাণ্ডাজী ভক্তিত্ব সম্বন্ধে গভীর উপদেশ দিয়ে ভরিয়ে দিলেন—দেবতার ওপর ভক্তি এবং দেবসেবকের ওপর, কারণ ওঁর থিয়োরি অনুযায়ী আগে দাস, তবে দেবতা, সামনের খুরিতে তার নজিরও উপস্থিত। আমিও বিধিমত নীচুর দিক থেকে আরম্ভ করলাম এবং শেষ পর্যন্ত দেবসেবককে ভক্তিরসে এতটা দ্রব করে ফেললাম যে, তিনি আমার ঘাড়ে আর একটি প্যাড়ার খুরি না চাপিয়ে ছাড়লেন না। সঙ্গে সঙ্গে কিছু নির্মাল্য, এবং উপঢৌকন হিসাবে একটি রাধাকৃষ্ণের পিতলের ছাপ পর্যন্ত। বলাবাহুল্য বাসার ঠিকানা আর দেশের বাড়ির ঠিকানা না নিয়ে ছাড়লেন না, অবশ্য যে বাসার ঠিকানা আর দেশের বাড়ির ঠিকানা তিনি পেলেন তা বৃন্দাবন চষে ফেললেও খুঁজে পেতেন না, কেন না গলির নাম আর বাড়ির নম্বর দুটোই দিল্লি থেকে ধার করা; আর দেশের ঠিকানা ধরে গেলে তাঁকে ভবানীপুরে আমার কাছে না পৌঁছে বরিশালে সুলোচন দত্ত চৌধুরীর কাছে পৌঁছতে হত। লোকটা নেহাত কাল্পনিক চরিত্র নয়, আমার কিছু টাকা মেরে এখন দেশে গিয়ে দোকান ফেঁদেছে। ঘাড়ে গোটা দুয়েক পাণ্ডা চাপলে আমার আনন্দ হবার কথা।

শৈলেন বালিশে হেলান দিয়ে নূতন একটা সিগারেট ধরাইবার আয়োজন করিতে লাগিল। তিনজন উৎসুক ভাবে খানিকটা অপেক্ষা করিল, তাহার পর তারাপদ বলিল, কি হে, তোমার কাহিনী শেষ হয়ে গেল নাকি? অন্যদের তুলনায় কেন যে হঠাৎ অত খাতির, সে কথা বললে না তো?

শৈলেন বলিল, সে তো আগেই বলেছি, ধরতে পারলে না বুঝি? অন্যদের পুজোর সঙ্গে আমার পুজোর পৌনে আট আনা পার্থক্য ছিল। সেটা টের পেলাম বাসার কাছে এসে টাংগা থেকে নেমে। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ব্যাগ থেকে আধুলিটা বের ক’রে টাংগাওয়ালার হাতে দিয়ে বললাম, তিন আনা পয়সা ফেরত দে।

টাংগাওয়ালা ঝুঁকে হাতের তেলোর উপর মুদ্রাটা দেখলে, তারপর বিস্ময় এবং বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, বাবুজী, তরি করতে হ্যাঁয়?

বললাম, সে কি, ঠাট্টা করব কেন রে?

সে বললে, দেখিয়ে তো কেয়া দিয়া!

মথুরা-বৃন্দাবনের টাংগাওয়ালা, ওর মুহূর্তের মধ্যে একটা আধুলি বদলে ফেলে হাঙ্গামা বাধানো কিছুই নয়, গোড়া থেকেই কড়া ভাব দেখিয়ে শুরু করতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কি মনে করে থেমে গেলাম; পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালাতেই দেখি—সত্যিই আধুলি নয়, একটা পয়সা।

শুভেন কপালে চোখ তুলে বলে উঠল, বারে! ওইটুকুর মধ্যেই ব্যাটা আধুলিটা বদলে পয়সায়—

শৈলেন ঠোটের কোণে সিগারেটটা চাপিয়া বলিল, এবং আমার সেই মোগল আমলের পয়সাটাই। মন্দিরের যত ভেল্কি সেই আধুলিটা করিয়েছে, আমার অজ্ঞাতে আমার হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে।

কিন্তু সে কথা থাক; কথা হচ্ছে, সেদিন দেব-মন্দিরে মানবই আমার দেবতাকে আড়াল ক’রে দাঁড়িয়ে ছিল দানববেশে, তার বিভীষিকা, তার কদর্যতা দিয়ে। দেবতাকে টেনে নামিয়ে সামান্য একটা রূপোর টুকরো তাঁর বেদীতে বসিয়েছিল, দেবতা প্রতিরোধ করতে পারেন নি। ব্যাপারটা বোধ হয় সামান্য; কিন্তু মনে রাখতে হবে, তারকেশ্বরে, গয়ায় যে কাণ্ড হয়ে গেল, এ তারই সগোত্র। কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, সেই দানব যদি অন্যদের চেয়ে পৌনে আট আনা বেশি দক্ষিণাতেই সন্তুষ্ট হয়ে দেবতার হাতের একটি মালা, এমন কি দেবতার ভোগের সামগ্রী পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দিতে পারে তো আমি তাকে ঠেলে আর কার পুজো করব, কে আমার পুজোর যোগ্য অধিকারী? তোমরা দেবতার কথা, পুজোর কথা তুলেছিলে; কিন্তু ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র—সর্বত্রই দেবতাকে পেছনে ফেলে এই দানবই বিজয়ী বীরের মত এগিয়ে দাঁড়াচ্ছে, পুজো করলে প্রত্যক্ষ ফল হাতে তুলে দিচ্ছে, তাই আমি এ প্রশ্নের উত্তর চাই। সম্ভবামি যুগে যুগে, কিন্তু আর কবে? শুষ্ক সান্ত্বনার কথাটি আঁকড়ে আর কত দিন লোকে বিশ্বাসের বাতিটুকু জ্বেলে রাখবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *