কল্যাণ অন্বেষা

কল্যাণ অন্বেষা

সুস্থ মানুষ যেমন পথ্যাপথ্য বিচার করে না, সুস্থ জাতিও তেমনি কথায় কথায় শাস্ত্র আওড়ায় না। প্রাণ-প্রাচুর্যের এমন একটি আনন্দিত প্রেরণা আছে, যে-প্রেরণাবশে মানুষ সহজে ও স্বচ্ছন্দে আনন্দ অন্বেষায় ও কল্যাণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করে। প্রাণের প্রেরণাতেই এ প্রয়াস চলে বলে তা স্বাস্থ্যকর। স্বাস্থ্য শিশুকে চাঞ্চল্য দান করে, আর চাঞ্চল্য বশে সে দুরন্ত হয়। এই দুরন্তপনাকে যে। ভয় করে, সে বস্তুত সুস্থতাকেই ভয় পায়। কেননা তাতে তার কাজ বাড়ে, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আলস্যের স্বস্তি উপভোগে অভ্যস্ত জীবনে একে সে বিপর্যয় বলেই জানে।

অর্জন যে করতে জানে না, বর্জনের শক্তি তার আয়ত্তে থাকে না। আয় না থাকলে মানুষ ব্যয় করতে ভয় পায়। গ্রহণ-বিমুখ মানুষ স্বাভাবিক কারণেই বর্জন-বিমুখ হয়। বৃষ্টি কিংবা বরফের দাক্ষিণ্য না-পেলে স্রোতস্বিনী যেমন বদ্ধ জলাতে জীর্ণতা পায়, তেমনি গ্রহণ-ভীরু মানুষও রক্ষণশীল হয়। শিশু-পাঠ্য কবিতার কলি মনে পড়ছে :

যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে।
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।
যে জাতি জীবনহারা অচল অসার
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।

ঘরোয়া পরিবেশে প্রাপ্ত পুরুষানুক্রমিক বিশ্বাস-সংস্কার ও আচার-আচরণকে যারা জীবনের পরম আশ্রয় বলে মানে, তারা জগতের নিত্য-নব আলো-বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর বলে জানে। তাই নতুনের প্রভাব এড়িয়ে প্রথার-প্রতাপ স্বীকার করে তারা জীবনযাত্রায় স্বস্তি খোঁজে। এমন ব্যক্তি বা সমাজ শামুকের মতো। তার কায়িক বৃদ্ধি আছে, মনের বিকাশ নেই। এমন মানুষ ভোগলিন্দু হয় কিন্তু চরিত্রবান হয় না। তাই ব্যবহারিক জীবনে সে স্বাচ্ছন্দ্যকামী, এবং এ স্বাচ্ছন্দ্যের ঈহা তাকে চুরি, মিথ্যাচার, লাম্পট্য, শোষণ, পীড়ন প্রভৃতি সর্বপ্রকার অপকর্মে প্রবর্তনা দেয়, এবং বস্তুজগতে সে বিদেশী বিজাতির আবিষ্কৃত নতুন সামগ্রী গ্রহণে হয় উৎসুক। তখন হারাম-হালালের, সুন্নত নফলের, মকরুহ্-বেদাঁতের কোনো বাছ-বিচার তার মনে জাগে না। কেবল জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রেই সে শাস্ত্রীয়-প্রত্যয় পরিহার করতে নারাজ। শাস্ত্র হচ্ছে বিশ্বাসের ইমারত। বিশ্বাস মাত্রই আবেগসঞ্জাত। এবং আবেগ যুক্তির বীজও নয়, প্রসূনও নয়। তাই বিশ্বাস বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধের বীজ বুনে। আর জ্ঞান মিলন-ময়দানে আহ্বান জানায়। কেননা, জ্ঞানে কুহেলিকা কিংবা কুয়াশা নেই, জ্ঞান প্রতারিত করে না। অতএব জ্ঞানের ক্ষেত্রেই কেবল মানুষ মিলতে পারে। আর জ্ঞান সব সময়েই বিপন্মুক্ত।

এক হিসেবে বিশ্বাস মাত্রেই অন্ধ। কেননা বিশ্বাসের জন্ম অনুমানে, লালন আবেগে এবং বিস্তার অনুভবে। অন্ধ যখন পথ চলে, তখন সে হাতড়িয়ে চলে এবং অনিশ্চিতে পা বাড়ায়। চক্ষুষ্মনের মতো চলার স্বাচ্ছন্দ্য এবং দেখার আনন্দ সে পায় না। অন্ধ প্রয়োজনের অনুগত। আনন্দ থাকে তার অনায়ত্ত। জ্ঞানই চক্ষু আর বিশ্বাস হচ্ছে অন্ধতা। জ্ঞানকে যে বিশ্বাসের উপরে ঠাই দেয় না, যে বিশ্বাসকে পরিহার করে জ্ঞানকে গ্রহণ করে না, তার জিজ্ঞাসা নেই। সে জগৎ ও জীবনের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত। দেহ- প্রাণ প্রকৃতির দান বটে, কিন্তু চেতনা-সুন্দর জীবন জ্ঞানের প্রসূন। প্রকৃতির দান উদ্ভিদ কেবল অরণ্যই সৃষ্টি করে। মানুষের পরিচর্যায় গড়ে উঠে উদ্যান। তেমনি জ্ঞানের অনুশীলনে পাই সাংস্কৃতিক জীবন–যা সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের আধার। জ্ঞান মানুষকে বোধিসত্তায় উত্তীর্ণ করে। আসলে বোধিসত্ত্ব অর্জনই তো মানুষের লক্ষ্য। আর কে-ই-বা অস্বীকার করবে যে চিত্ত-সম্পদ ও বস্তু-সম্পদ–মানব-সাধ্য এই দুটো ঐশ্বর্যই জ্ঞানেই কেবল লভ্য? . সচেতন কিংবা অবচেতন ভাবে মানুষের যা কাম্য, কবির ভাষায় তা–

চাই স্বাধীনতা চাই পক্ষের বিস্তার
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরাণে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া এ বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয় স্পন্দন।

 শাস্ত্র ও সংস্কারের বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করা কেবল জ্ঞান ও যুক্তির জোরেই সম্ভব। কেননা জ্ঞান এবং যুক্তিই শুধু মানুষকে সুস্থ ও স্বস্থ করতে ও রাখতে পারে। জ্ঞানই চক্ষু এবং যুক্তিই চেতনা, এবং চেতনা-সম্পন্ন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি আত্মসামর্থ্যে পথ চলে, তাই সে চলার স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ দু-ই পায়।

আজ দেখছি শাস্ত্র ও সংস্কারের আনুগত্য এবং অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যাধিক্যের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে প্রতারণার জাল বুনছে। নির্বাচনের সময়ে তাদের দেশ-জাত-ধর্ম-চেতনা এমনি প্রবল ও প্রচণ্ড হয়ে উঠে যে সরল মানুষেরা মনে করে বুঝি আমরা সর্বনাশের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি! এদের দস্তান না ধরলে বুঝি অপমৃত্যু সুনিশ্চিত! তারা কেবল কথার বেড়া দিয়ে শাস্ত্রের ও স্বার্থের, স্বত্বের ও স্বর্গের, সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের এমন অনুপম মায়ালোক নির্মাণ করে যে বিমূঢ় অভিভূত অজ্ঞ মানুষের এই মরীচিৎকার খপ্পর এড়ানোর উপায় থাকে না।

সহজ করে বুঝতে গেলে, গণতান্ত্রিক সরকার হচ্ছে একটি প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপক সমবায় সংস্থা। রাষ্ট্রবাসীর ব্যবহারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য দানই তার মুখ্য কাজ। বস্তু-সম্পদে রয়েছে মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন এবং তজ্জাত সামাজিক অধিকার। আর চিত্ত-সম্পদ চিরকালই ব্যক্তিক। অতএব ব্যবহারিক প্রয়োজনে বৈষয়িক বস্তু-সম্পদের বারোয়ারী প্রয়োগ সুনিয়মিত রাখা ও সুনিয়ন্ত্রিত করাই হচ্ছে সরকার নামের সংস্থার দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই সরকারি সংস্থার দায়িত্ব ও কর্তব্য কতকগুলো বিভাগে বিন্যস্ত; যেমন স্বরাষ্ট্র বিভাগ, অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য বিভাগ, যোগাযোগ বিভাগ, বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, সৈন্য বিভাগ প্রভৃতি।

কোথায় রেলপথ করা দরকার, পাটের বাজার কোথায় সন্ধান করা উচিত, কলেরা-বসন্ত নিরোধের উপায় উদ্ভাবন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কিংবা সেচ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি একান্তই ঐহিক ও ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কিত বিষয়। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের এসব সম্পদ ও সমস্যার সঙ্গে শাস্ত্র ও সংস্কারের কোনই সম্পর্ক নেই। এখানে আদর্শের কোনো প্রয়োজন যদি থাকে, তবে তা বিবেকী আদর্শ। এবং সে-আদর্শ সদিচ্ছার, সর্বজনীন কল্যাণের ও জৈব-স্বাচ্ছন্দ্যের। এ কার্যে যা প্রয়োজনীয় তা আদর্শ নয়, বরং অভিপ্রায় ও উপায়। বারোয়ারী কল্যাণে সদুপায় উদ্ভাবন ও প্রয়োগই কেবল দরকার, আর কিছু নয়।

এ যুগে সে উপায় হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যা, আর অভিপ্রায় হচ্ছে সংহত ভুবনে জাতিপুঞ্জের সমস্বার্থে সহ-অবস্থান ও সহযোগিতার সদিচ্ছা। জাহাজ আরোহীরা যেমন স্ব স্ব জীবনের নিরাপত্তার জন্যেই জাহাজের নিরাপত্তা কামনা করে, তেমনি স্ব-স্বার্থেই মানুষ রচনা করবে মিলন-ময়দান, কামনা করবে সহ-অবস্থান ও সহযোগিতার জন্যে বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তি। এক্ষেত্রে শাস্ত্র, সংস্কার কিংবা তত্ত্বের প্রভাব ও প্রয়োগ অকল্যাণকর। একে তো শাস্ত্র ও সংস্কার রাষ্ট্রিক বিষয়-সংপৃক্ত নয়, দ্বিতীয়ত আজকের দিনে কোনো রাষ্ট্রেই নাগরিকরা অভিন্ন জাত-বর্ণ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব শাস্ত্র, সংস্কার কিংবা তত্ত্বকে এই ব্যবহারিক জীবনের সম্পদ ও সমস্যার সঙ্গে, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঙ্গে সংলগ্ন করা গলগ্রহ করারই নামান্তর।

পদলোভী স্বার্থবাজের ছল-চাতুরী ও বঞ্চনা-প্রতারণা থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার ও রক্ষণের জন্যে আজ বিবেকী মানুষের বড় প্রয়োজন। এমন তীব্রতায় এদেশে ত্রাণকর্তার প্রয়োজন আগে আর কখনো অনুভূত হয়নি। আজ এমন কতকগুলো সংবেদনশীল মানববাদী কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কর্মীর প্রয়োজন, যাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ত্যাগ ও নির্যাতন স্বীকারের অঙ্গীকারে এগিয়ে আসবেন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে বিবেকী আত্মার ভূমিকা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবার জন্যে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তেমন মানববাদী কী এখনো দুর্লভ থাকবেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *