একটা পাখির ছানা—যার বাপ মরে গেছে, মা মরে গেছে—চারদিককার দুর্বিসহ ভয় দুর্বলতা ও উপায়হীনতা ক্রমে ঘিরে ফেলেছে যাকে—এই মেয়েটির ধড়ের ভিতর যেন সেই আতুর অনাথ ছানার প্রাণ সঞ্চারিত হয়ে উঠেছে; তাকে দেখবার বুঝবার গ্রহণ করবার জন্য কোথা কেউ নেই—কোনওদিনও যেন থাকবে না আর।
পঙ্কজবাবু বললেন—এই আমার ইচ্ছা প্রসাদ—তোমার মার ও
প্রসাদ বললে—হ্যাঁ, চারজন পার্টনার; ওদের ব্যবসার নাম আছে; খাতাপত্রখানা সঙ্গে এনেছিল—আমাকে দেখিয়েছে; যতটা বলে ততটা নয়—তবে আমাদের চেয়ে ঢের বেশি টাকা আছে—কাঁচা টাকা অন্তত।
পঙ্কজবাবু বললেন—তা তো হ’ল—
প্রসাদ বললে—তাইতেই অনেক দূর হল বাবা—
—কিন্তু টাকাই তো সব নয়—ছেলেও খুব সৎ চরিত্রবান ছেলে–সেই জন্যই আমার আগ্রহ খুব বেশি।
চন্দ্রমোহনের জীবনের এ দিকটা প্রসাদ বিশেষ কোনও কথাবার্তা বলতে গেল না, চুপ করে রইল।
পঙ্কজবাবু বললেন—তা’হলে তোমার মত আছে?
প্রসাদ বললে—কিন্তু বিয়ের খরচটা খুব সংক্ষেপে সারাই ভাল—কাঁচা টাকার মাল ওদের না হয় খুব আছে—ওদের মেয়েদের না হয় খুব ঘটা করে বিয়ে দেবে, কিন্তু আমাদের তো আর সেরকম অবস্থা নয়—
পঙ্কজবাবু অত্যন্ত প্রীত হয়ে বললেন—আচ্ছা সে সব বোঝা যাবে বোঝা যাবে —বিজলীর টাকা বন্ধ করবার পর বেশ একটু আয় দেখা দিচ্ছে—কিন্তু ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে না তো? কোনও চিঠিও লেখে না—একেবারে গুম যে!
প্রসাদকে নাক মুখ খিঁচতে দেখে পঙ্কজবাবু তাড়াতাড়ি বললেন—কল্যাণীকেও আর বোর্ডিঙে পাঠাব না—তাতেও খানিকটা লাভ হবে—
পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে বললেন—আমি বলেছি, তোমার মাও বলেছেন— এখন তুমিও কল্যাণীকে বেশ একটু ভালো করে বুঝিয়ে বোলো—আমাদের চেয়ে হয়তো তোমার কথার শক্তি বেশি হবে—তুমি তার দাদা বলে সে হয়তো বেশ—
পঙ্কজবাবু চলে গেলেন।
প্রসাদ কথার লোক মাত্র নয়—কাজকেই সে ঢের ভালো বোঝে
কোর্টের থেকে ফিরে এসে একটু খাওয়া-দাওয়া বিশ্রামের পর প্রসাদ কল্যাণীর ঘরের দিকে গিয়ে বললে—কৈ রে কল্যাণী
কল্যাণী দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার বিছানার ভিতর জড়সড় হয়ে পড়ে ছিল। মেজদার গলা শুনে তার যেন কেমন দিনের আলোর পৃথিবীটাকে মনে পড়ল—আশা ও সাধের সুদূর পৃথিবীটা এক মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘরের কাছে এসে পড়ল যেন—
কল্যাণী ধড়মড় করে উঠে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে বললে—মেজদা! মেজদা—এসো।
—ঘুমিয়েছিলি?
—না
কি করছিলি অন্ধকারের মধ্যে একা বসে বসে
কল্যাণীর চোখে জল এল—
প্রসাদ বললে—এই বিকেল বেলাটা বুঝি এমনি করে মাটি করতে হয়!
প্রসাদ বললে—একদিন তো যাত্রাও দেখলি না? দেখেছিলি?
কল্যাণী ধরা গলায় বললে—না
—কেন না?
কল্যাণী চুপ করে রইল।
প্রসাদ কল্যাণীর ঘাড়ের ওপর হাত দিয়ে বললে—লক্ষ্মীপূজোর সময় আবার হবে— আমার সঙ্গে যাস্—আমি তোকে নিয়ে যাব।
কল্যাণী বললে—আমাকে নিয়ে যেও তুমি
—হ্যাঁ নিশ্চয় নিয়ে যাব
লক্ষ্মী পূজোর সময় হবে?
—লক্ষ্মী পূজোর সময়—শ্যামা পূজোর সময়; এখন দিয়ালিও দেখতে পারবি একটা ট্যাক্সিতে করে—না হয় আমাদের বাড়ির গাড়িটায়ই যাওয়া যাবে বেশ। সমস্ত শহরটা ঘুরে আসা যাবে বোম পটকা আতসবাজী দেখতে দেখতে।
প্রসাদ হেসে উঠল—
কল্যাণী হেসে উঠল—
প্রসাদ বললে—চল, আজ একটু গাড়িতে করে বেড়িয়ে আসি
কল্যাণী আগ্রহের সঙ্গে বললে—কোথায়?
—নদীর পাড় দিয়ে ঘোরা যাবে—বেশ জ্যোৎস্না রাত আছে
কল্যাণী বললে——চল
—সাজগোজ কর
শাড়ী পরে এসে সে বললে—মেজদা, আর কেউ যাবে?
—না।
দু’জনে গেল।
গাড়ি খানিকটা চলল —
জ্যোৎস্না–নদী—মেজদার অনেক দিন পরে এমন স্নেহ-কল্যাণীর মন নানারকম ভরসা ও প্রসন্নতায় ভরে উঠল—
সে বললে—মেজদা—
প্রসাদ চুরুটে একটা টান দিয়ে বললে—কি রে–
—তোমাকে একটা কথা বলব আমি
—বল
—কিছু মনে কোরো না তুমি মেজদা–তোমাকে না বললে কাকে বলব আমি আর? প্রসাদ কল্যাণীর পিঠে হাত বুলুতে বুলুতে সস্নেহে বললে–কি কথা?
চন্দ্রমোহনের কথাটা আগাগোড়া সে বললে প্রসাদকে
প্রসাদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল—
কল্যাণী বললে—এ লোকটাকে তুমি তাড়িয়ে দাও মেজদা—
প্রসাদ চুপ করে তাকিয়ে ছিল দূর দুর্নিরীক্ষ্য শূণ্যের দিকে, কোনোও কথা বললে না।
কল্যাণী বললে—তোমার পায়ে পড়ি মেজদা, আমাদের বাড়ি একে আর ঢুকতে দিও না তুমি—ওর গলার স্বর শুনলেই আমার প্রাণ শুকিয়ে যায়—আমার এত কষ্ট হয় মেজদা
প্রসাদ বললে—কিন্তু শুনেছি লোকটার ঢের টাকা আছে
—অমন টাকার গলায় দড়ি
—সে টাকা তারা সাধু উপায়ে রোজগার করেছে
—তা করুক
প্রসাদ একটু ঘাড় নেড়ে হেসে খুব দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বললে—কিন্তু আমি যদি মেয়ে হতাম, চন্দ্রমোহনকে বিয়ে করতাম।
কল্যাণী অবাক হয়ে বললে—কেন?
—টাকার যে কি সুখ তা তুমি এখনও বোঝ নি কল্যাণী। কলকাতায় চন্দ্রমোহনদের রাজারাজড়াদের মত বাড়ি—সেখানে তার বৌ হয়ে বাড়ির পাটরানী হয়ে থাকা—সবসময় দাসদাসীর সেবা লোকজনের আদর সম্মান, যখন খুসি থিয়েটার বায়োস্কোপ সার্কাস—কত কি আমোদফুর্তি—সে সবের নামও জানি না আমরা। তারপর মধুপুরে বাড়ি—জামতাড়ায় বাড়ি—শিমলতলায় বাড়ি—দেওঘরে বাড়ি—দার্জিলিঙে বাড়ি—ওদিকে দেরাদূনে— আলমোড়ায়—নইনীতালে—এমন সুখ তুমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পার না কল্যাণী।
কল্যাণী হতাশ হয়ে বললে—মেজদা, তুমিও এই কথা বল?
—আমি ঠিকই বলি বোন, সব কথাই তোমাকে বলেছি—
কল্যাণী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে গাড়ির পাদানের দিকে তাকিয়ে রইল—
প্রসাদ বললে—তুমি জান না হয়তো আমাদের জমিদারীর আর কিছু নেই
—কিছু নেই মানে?
—এখন কোর্ট অব ওয়ার্ডসে দিলেই ভালো হয়
প্রসাদের হাত ধরে কল্যাণী বললে—ছি, অমন কথা বোলো না।
ধীরে ধীরে হাত খসিয়ে নিয়ে প্রসাদ বললে—না বলে কি করব? বাবার হাতে আর দু’বছরও যদি থাকে তাহ’লে আমাদের পথে নামতে হবে—
কল্যাণী অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে বললে—সত্যি বলছ তুমি মেজদা?
—দাদার ওপর ঢের নির্ভর করা গেছিল। কিন্তু দাদা দিলেন উল্টে আরো পগার করে সব। সে যাক, যা হয়ে গেছে তা গেছে, কিন্তু হবে তা আরো ভীষণ —
কল্যাণী পীড়িত হয়ে প্রসাদের দিকে তাকাল।
প্রসাদ বললে—দাদা আর ফিরবেন না, সে মন্দ নয়। কিন্তু ফেরেন যদি, দাবি কররে এ বাড়িটা হয়তো তাঁকে ছেড়ে দিতে হতে পারে—তাঁকে আর তাঁর মেমসাহেবকে—আর এড়িগেড়ি ট্যাশগুলোকে—
কল্যাণী বললে—সমস্ত বাড়িটা দিয়ে তিনি কি করবেন?
—মেমসাহেবরা সমস্ত বাড়ি না নিয়ে থাকে না—আমাদের সরে যেতেই হবে—কল্যাণী অত্যন্ত আশ্বাস ও পরিতৃপ্তির সঙ্গে বললে—তখন তোমার কাছে গিয়ে থাকব আমি।
প্রসাদ একটু হেসে বললে—সে ক’দিন আর থাকতে পারবে তুমি? ক’দিন আর সম্মানের সঙ্গে সেরকম থাকতে পারবে তুমি?
কল্যাণী একটু আঘাত পেয়ে বললে—ভাইদের কাছে থাকতে গিয়ে অসম্মান কি করে হয় মেজদা?
প্রসাদ বললে—তা হয়—খুব–হয় […] বিকার হয়—
কল্যাণী বিমূঢ়ের মত প্রসাদের দিকে তাকাল।
প্রসাদ বললে—তোমার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা চেপে যাওয়া উচিত নয় তোমার কাছে আমার। শুনতে খারাপ শুনালেও যা স্বাভাবিক—যেমনটি হয় যা ঘটবে তাইই তোমার জানা উচিত আমারও খুলে বলা উচিত সব—
চুরুটে একটা টান দিয়ে প্রসাদ বললে—জমিদারী বলে আমাদের কারুর কিছুই থাকবে না, কোনও অংশ থাকবে না, সম্পত্তি না কিচ্ছু না—ওকালতি করেই আমাকে খেতে হবে; আমি বিয়েও করব—হয়তো শিগগিরই; জমিদারী তখন ফেঁসে গেছে—তুমি জমিদারের মেয়ে নও কিচ্ছু নও—আমার বৌ তখন তোমার ঘাড়ে হাগবে খুব জোর দিয়ে এই কথাটা বললে প্রসাদ—সেটা তোমার কেমন লাগবে কল্যাণী?
কল্যাণী শিহরিত হয়ে উঠল।
প্রসাদ বললে—কিশোর পুরুষমানুষ আছে—একটা কিছু করেও নিতে পারবে হয়তো— তার জন্য তেমন ভাবনা নেই—কিন্তু তুমি কোথায় দাঁড়াবে?
প্রসাদ বললে—আর কিশোরও যে না বিয়ে করে ছাড়বে তা আমার মনে হয় না। তার ওখানে গিয়ে থাকলে তার বৌও তোমার ঘাড়ে হেগে বেড়াবে—
এর আর কোনও এপিঠ ওপিঠ নেই—
কল্যাণী বললে—গাড়িটাকে ফিরতে বল—
প্রসাদ গাড়োয়ানকে হুকুম দিয়ে কল্যাণীকে বললে—এই বেলা জমিদারের মেয়ে থাকতে থাকতে চন্দ্ৰমোহনকে তুমি বিয়ে করে নাও, না হ’লে পরে দুর্গতির আর শেষ থাকবে না তোমার।
কল্যাণী আঁতকে উঠল—
প্রসাদ বললে—তুমি মনে কর তুমি খুব সুন্দর। কিন্তু নিৰ্জ্জলা সুন্দর মুখ দেখেই মানুষে আজকাল বড় একটা বিয়ে করে না। আমি নিজেও তা করব না। তোমার মতন এরকম সৌন্দর্য—এও অসাধারণ কিছু নয়—তুমি পঙ্কজবাবুর মেয়ে বলেই আজ এ জিনিসের একটা কিছু দাম আছে—চন্দ্ৰমোহনের স্ত্রী হলে এর দাম আরও হাজার গুণ বেড়ে যাবে। না হলে আমার কুচ্ছিৎ মাগ এলেও—সেই যা বলেছি—হৈ হৈ করে তোমার ঘাড়ে ঘাড়ে হাগবে—খুব সেয়ানা জিনিস হবে সেটা তখন, না?