কল্পনার কাশ্মীর
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সের শিক্ষার্থী আমি। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরি ফিরি। আপেল-আঙ্গুর-কমলা লেবু খাই শাকসবজির মতো প্রতিদিন! পথেঘাটে ১০-২০ টাকায় কিনতে পাওয়া যায় ওগুলো। কেতাবে আছে বেহেশত এতই সুন্দর যে, ‘কোনো চোখ কখনও দেখেনি। কোনো কান কখনও শোনেনি। কোনো মন কখনও চিন্তাও করেনি। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়েছি, কাশ্মীর হলো পৃথিবীর বেহেশত। প্রকৃত বেহেশতের রূপ ভাবনাতীত! সেখানেই আমার বসবাস। কতই না নয়নাভিরাম, বর্ণনাতীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকি। ক্লাস-পড়াশোনার পাশাপাশি ঘুরে বেড়াই গ্রাম-শহরের অলিগলি।
দিন দিন বাড়ে বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যাই, থাকি-খাই; জানতে চাই কেমন তাদের জীবন? ভূ-স্বর্গের মানুষ বলে কথা! ক্রমে আমি হয়ে উঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য লোকের কাছে পরিচিত, প্রিয়। কাশ্মীরি রূপসী ললনারা নেকাবের আড়াল থেকে আমাকে দেখে, তাতে আমার মধ্যে শিহরণ বয়। আমার নাম জানে সবাই। সভা-সেমিনারে আমি কথা বলি। তাই সবাই আমাকে দেখলে চেনে, সম্মান করে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে। হঠাৎ ছেদ পড়ে সেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। এক রাতে সশস্ত্র জঙ্গিরা আমাকে হোস্টেল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
দূরে অজ্ঞাত স্থানে আমাকে চোখ বেঁধে আটকে রাখে। জানতে চায়, কে তুই? আমি বলি আমার নাম। বাবার নাম। জাতীয়তা। কেন কাশ্মীরে এসেছি, কবে এসেছি, কবে ফিরবো- সবকিছুই বলি। ওরা জানতে চায়, আমি মুসলমান কিনা। আমি বলি হা। ওদের সন্দেহ হয়। আমার কাপড় খোলা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়। আমার ধর্মীয় জ্ঞানের পরীক্ষা নেয়া হয়। তাতে আমি উত্তীর্ণ হই। এরপর আমাকে আটকে রাখা হয় তিন দিন। রেখে দেওয়া হয় চোখ বেঁধে। কিছু খাবারও দেওয়া হয়। আমি অবশ্য সাহস হারাইনি। নিশ্চিন্তে ছিলাম এই ভেবে যে, যা হবার হবে। আল্লাহ ভরসা! তিন দিন পর সশস্ত্র এক যুবক এসে বলে, তোকে মেরে ফেলে আমাদের কোনো লাভ নেই।
তোকে ভারতীয় চর সন্দেহে আমরা ধরেছিলাম। তুই বেঁচে গেছিস। কিন্তু, এখন তোকে ছেড়ে দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন। ভারতীয় বাহিনী তোকে ধরবে। আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইবে। এটা আমাদের জন্য অসুবিধা। যাই হোক, তোকে মারব না, ছেড়ে দেবো। আমাকে চোখ বেঁধে কিছু দূর নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। আমি ফিরে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিরে এসে জানলাম, আমাকে নিয়ে তোলপাড়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছে, কাশ্মীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে বিদেশি (বাংলাদেশি) ছাত্র
নিখোঁজ। ভারতীয় সেনাবাহিনী, জেঅ্যান্ডকে পুলিশ, গণমাধ্যম তন্ন তন্ন করে সন্ধান করছে আমার। বাংলাদেশেও তোলপাড়। বাংলাদেশি হাইকমিশন উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত সরকারের কাছে। ফিরে আসার পর সবাই আমার কাছে জানতে চায় কী খবর? কোথায় ছিলাম। আমি তো হতবাক! গণমাধ্যমে ফলোআপ এলো। আমার সাক্ষাৎকার নিতে হুমড়ি খাচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সামলে উঠতে পারছেন না। আমি মিডিয়ার সামনে যাচ্ছি না। এভাবে কাটলো এক দিন।
পরের দিন আমাকে যেতে হলো পুলিশের সামনে। তারা জানতে চাইল সবকিছু। আমি জানাব কিনা তা নিয়ে দ্বিধান্বিত। যারা আমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারল তাদের তো ক্ষমতা কম নয়। তারা তো আমাকে মুক্তিও দিলো। তাহলে তাদের খবর পুলিশকে দেওয়া উচিত কিনা? পুলিশ তো আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। উদ্ধারও করতে পারেনি। এখন পুলিশকে তথ্য দেওয়ার পর যদি তারা আবার আমাকে নিয়ে যায়। পুলিশ কি আমাকে বাঁচাতে পারবে? এসব প্রশ্ন আমার মনে।
অবশেষে ওসব প্রশ্ন লুকিয়ে যথাসম্ভব জবাব দিলাম। আমি তো বিদেশি। কারও পক্ষেও নই, বিপক্ষেও নই। তেমনভাবেই বললাম। ফিরে এলাম। কিন্তু, তারপর থেকে মনের মধ্যে শুরু হলো খচখচানি। মনে হলো, আমার কোনো নিরাপত্তা নেই। যেখানে যাই, মানুষ আমাকে দেখে। ওখানে আমার শিক্ষাকাল ছিল দুই বছর। তখনও বাকি প্রায় ছয় মাস। ওই ছয় মাস এভাবেই কাটল। কোনো রকমে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরলাম।’
উপরের সব কথা কাল্পনিক। এমন কল্পনা করেছিলাম কাশ্মীরে পৌছার আগে। এই কল্পনার পেছনে কাজ করেছে কাশ্মীর সম্পর্কে আমার পূর্বধারণা। আর সেই ধারণা আমার মধ্যে নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থার মাধ্যমে। আমার বিশ্বাস, সিংহভাগ বাংলাদেশি মানুষের মনে কাশ্মীর এভাবেই আঁকা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী কাশ্মীর যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলেন, সাবধানে থেকো। তুমি তো সাংবাদিক। সবকিছুতে তোমার একটা অনুসন্ধানী মন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেই অনুসন্ধানী মনটা একটু দমিয়ে রেখো। বিপদ আসতে তো আর সময় লাগে না।’ সাংবাদিক লায়েকুজ্জামানকে যখন কাশ্মীরে যাওয়ার খবর জানালাম, তিনি বললেন, “দেখো তুমি আবার জঙ্গি-টঙ্গি হয়ে যেও না।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আমার ফেসবুক বন্ধু। একবার আমার এক স্ট্যাটাসে তিনি মন্তব্য করলেন, এত জায়গা থাকতে কাশ্মীরে গিয়েছেন; জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কিনা তাইবা কে জানে?’ এই মন্তব্যগুলো উল্লেখ করে বোঝাতে চেয়েছি, কাশ্মীরকে আমরা কিভাবে দেখি’। এ গ্রন্থখানি কাশ্মীরের এমন অস্বাভাবিক ও অপূর্ণ কাল্পনিক চিত্রের বিপরীতে একটি পরিপূর্ণ ও প্রত্যক্ষদর্শী চিত্র হাজির করবে বলে আমার বিশ্বাস। কাশ্মীরের কথা; কাশ্মীরিদের কথা বলার দায়িত্ব আমি কেন কাঁধে তুলে নিলাম- এ প্রশ্ন প্রত্যাশিত। জবাবে বলছি, এর কারণ হলো দুটো। প্রথমত, দুই বছরে
কাশ্মীরের মানুষগুলোর উচ্ছ্বসিত ভালবাসা আমাকে দায়বদ্ধ করেছে এ কাজে। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষার জ্ঞানভাণ্ডারে কাশ্মীরের অনুপস্থিতি আমাকে করেছে ব্যথিত ও অঙ্গীকারবদ্ধ। একটু খতিয়ে দেখা যাক, বাংলাদেশের সাহিত্যে কাশ্মীরের কথা কতটুকু আছে, কিভাবে আছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলাকা’য় বলেছেন কাশ্মীরের ঝিলাম নদীর দুর্দম গতীময়তার কথা। ১৯১৫ সালে তিনি গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কিছু সাহিত্যে, উপন্যাসেও কাশ্মীরকে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার আগে অবশ্য রাজনৈতিকভাবে কাশ্মীরের সমস্যা আমাদের নিজেদের সমস্যা বলেই মনে করা হতো। জনমতও ছিল তেমনই। কিন্তু, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জনমানসে যৌক্তিক কারণেই ক্রমান্বয়ে কাশ্মীর অনুপস্থিত হয়ে পড়ে।
কাশ্মীর কালক্রমে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাও হয় রাজনৈতিক বয়ানের বাইরে সামাজিক প্রেক্ষিতকে এড়িয়েই। সেখানে যৎসামান্য আছে, তাও উদার বা সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে কাশ্মীরকে তুলে ধরতে পারেনি। খবরের কাগজের পাতায় মাঝে মধ্যেই ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আলোচনায় কাশ্মীর হাজির হয়। তাতেও সমস্যার ভিত্তিমূলে না গিয়ে কেবল দুই পক্ষের অবস্থানই তুলে ধরা হয়। তবে, ভ্রমণকাহিনী বা ভ্রমণণাপন্যাস হিসেবে বুলবুল সরওয়ারের ঝিলাম নদীর দেশ শূন্যতা পূরণকারী। কাশ্মীরের কণ্ঠস্বরকে বাংলায় বলতে গেলে এককভাবেই তুলে ধরেছেন বুলবুল তার ঝিলামে। ১৯৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত ঝিলাম ইতোমধ্যে ৫১তম মুদ্রণ শেষ করেছে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে।
সাহিত্যকর্ম হিসেবে ‘ঝিলাম নদীর দেশ’কে পূর্ণ সফল বলতে দ্বিধা নেই। ইতিহাসের কোলে আশ্রয় নিয়ে লেখক সেখানে মানুষের প্রেম ও জীবনকে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন অপূর্ব প্রকৃতির ক্যানভাস। ভাষার মুন্সিয়ানায় সেই কাহিনী কখনো মধুর আবার কখনো বেদনাবিধুর হয়ে শিহরণ জাগাতে সক্ষম যেকোনও পাঠকের হৃদয়ে। উপন্যাস হিসেবে ঝিলাম তাই সার্থক। শুধু ঝিলাম নয়, কাশ্মীর ভ্রমণে তারই আরেক সংযোজন ‘ঝিলামে যখন ছিলাম’ (২০১৩)। সেখানে অবশ্য নিজের পারিবারিক ভ্রমণের গল্পকেই সর্বজনীন করে তুলেছেন তিনি।
তবে, দুই ক্ষেত্রেই, কাশ্মীরের মোগল আমল, তাদের শিল্প-সাহিত্য, জৌলুস আর হেরেমের অভ্যন্তরীণ বেদনাবিধুর রোমান্টিকতাকে উপস্থাপন করেছেন লেখক। হয়তো মোগলদের প্রতি তার ব্যক্তিগত দায়বোধ, বা বিনয় এর পেছনে কাজ করেছে। কিন্তু, কাশ্মীরের বর্তমান সাহিত্যে মোগল জৌলুস তো এক ঐতিহাসিক প্রতারণার ভিত্তি হিসেবেই পরিচিত। সম্রাট আকবরের কাশ্মীর দখলের ইতিহাস প্রকারান্তরে দিল্লি ও কাশ্মীরের আজকের সম্পর্কেরই রূপক উপস্থাপন। এ কারণেই, গবেষকের দায়বোধ থেকে বুলবুল সরওয়ারকে মূল্যায়ন করলে বলতে হয়, উপমার প্রয়োগ আর ইতিহাসের সরলীকরণের মাধ্যমে মূলত তিনি জটিল রাজনৈতিক সমীকরণকে এড়িয়ে গেছেন। পাঠকের মন ও দৃষ্টিকোণকে কাশ্মীরিদের জীবনের
বহুমুখী প্রেক্ষিত থেকে সরিয়ে ভাবাবেগের দিকে ধাবিত করেছেন। অবশ্য, ইতিহাস বলার দায় ঔপন্যাসিকের থাকে না। সত্যকথনের দায়িত্ব থেকে তিনি মুক্তি পেতেই পারেন। একজন মুসলিম হিসেবে ইতিহাসের সোনালী স্মৃতি, স্বজাতির কান্নার নোনাজল আমার মনকেও নোনতা করে তোলে। কিন্তু, সেই অবরুদ্ধ আবেগ আর কান্নার নোনা স্বাদের উর্ধ্বে উঠেই আমি এখানে তুলে ধরতে চেয়েছি সকল ধর্মীয় জাতিসত্তার সর্বজনীন প্রেক্ষিত। কেননা, বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনালোকের মিশ্রণ কবি বা শিল্পীর কারুকাজ বটে, তবে সেটি গবেষকের জন্য অপরাধ।
সাহিত্যের বিচারে এটি আসলে কী, তা বলার সাধ্য আমার নেই। কেউ হয়তো একে ভ্রমণ কাহিনী বলতে পারেন। কেউ বলবেন গবেষণা কর্ম। এটা গবেষণা কর্ম বটে, কিন্তু তা কেবল বর্ণনাধর্মী (Descriptive)। অনেকের কাছে বর্ণনাগুলো জার্নালিস্টিক মনে হতে পারে। তবে, তথ্য সংগ্রহে সম্ভাব্য সকল মতের মানুষের প্রতিনিধিত্ব (Quota Sampling) রাখার চেষ্টা করেছি। কোনো গভীর বিশ্লেষণ এখানে হাজির করিনি। সবকিছু ছাড়িয়ে এই বর্ণনায় কিছুটা এথনোগ্রাফিক উপকরণ এসেছে।
আমি মিশেছি কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে। গ্রামে-শহরে ঘুরেছি অনুসন্ধানী মন নিয়ে। আর যেখানেই যে বই-পুস্তক-লেখনী পেয়েছি কাশ্মীর বিষয়ে তা পড়ার চেষ্টা করেছি গভীর আগ্রহে। কাশ্মীরকে নিয়ে লেখা গ্রন্থের সংখ্যা অগণিত। তার খুব সামান্যই আমি পড়তে পেরেছি। যা পড়েছি তার কিঞ্চিত প্রভাব হলেও এই লেখায় পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে লেখায় প্রাথমিক উৎস থেকে বিষয়গুলো মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ মেলেনি। সেকেন্ডারি উৎস থেকে তথ্য নিয়েছি। তবে, মানুষের সঙ্গে কথা বলা, নিজের চোখে দেখা স্মৃতিগুলোই এই গ্রন্থের মূল সংযোজন। কোনো সমাজের প্রাণপ্রকৃতি জানতে সমাজবিজ্ঞানীরা অনেক উপায় অবলম্বন হয়তো করেন। আমার কাছে জন্ম, মৃত্যু আর বিয়েশাদি এই তিন হলো মূল সূত্র। বিশ্বাস করি, এগুলো দেখেই একটি সমাজের মর্মমূল উপলব্ধি করা যায়। আমিও চেষ্টা করেছি তাই।
এর মাধ্যমেই বুঝতে চেষ্টা করেছি কিভাবে কাশ্মীরিরা প্রকাশ ঘটায় তাদের ভালবাসার। কেমনইবা তাদের ঘৃণাগুলোর বহিঃপ্রকাশ। ভালবাসা আর ঘৃণা- এই তো মানুষের জীবন; শান্তি আর সংঘাত এছাড়া সমাজ বলতে আর কীইবা বাকি থাকে? রাজনীতি তো এ দুয়েরই স্ফুরণ। সুতরাং, এই বিষয়গুলোতে আমার জ্ঞান আর উপলব্ধি নিয়েই এই গ্রন্থ। স্পষ্টতই, কাশ্মীরের প্রকৃতিকে ছাপিয়ে জীবন ও প্রাণ এই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য হয়েছে। কেননা, আমার কাছে প্রকৃতির চেয়ে মানুষই বেশি মূল্যবান মনে হয়েছে। মানুষকে কেন্দ্র করেই তো স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন অপরূপ প্রকৃতি। মোগল কিংবা ব্রিটিশ, অথবা আধুনিক ভারত বনাম পাকিস্তান, কেউই প্রকৃতির প্রাণকেন্দ্রাসীন ওই মানুষগুলোর দিকে খুব একটা নজর দিতে সক্ষম হয়নি। মোগলাই প্রেম, সৃজনশীলতা আর আভিজাত্য কাশ্মীরকে যোগ করেছে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার সঙ্গে।
কিন্তু, তারা কি পেরেছিল কাশ্মীরিদের স্বকীয়তার মর্যাতা দিতে? পারস্য থেকে আসা মোগলরা সুচারুরূপে মিশে গিয়েছিল ভারতের মাটি ও মানুষের সঙ্গে। কিন্তু, কাশ্মীরিদের সঙ্গে সেই সখ্য তারা গড়তে পারেনি। বরং, কাশ্মীরে মোগলরা (১৫৮৬/৮৯-১৭৫১) দখলদারের ভূমিকায়ই অবতীর্ণ ছিল। আফগান পাঠানদের (১৭৫১ – ১৮১৯) নিষ্ঠুর নিষ্পেশন এখনও কাশ্মীরের রূপকথায় পাওয়া যায়। ইতিহাসে তো বটেই। শিখদের সামন্তবাদও (১৮১৯ – ১৯৪৬) মানবতাবাদের বাস্তবতা থেকে ছিল বিস্মৃত।
ব্রিটিশরা তো অর্থের লোভে বিক্রিই করেছিল (১৯৪৬) কাশ্মীরের জমিন। সঙ্গে গোলাম বানিয়ে দিয়েছিল জনগণকেও। উপনিবেশিকতার পরের গল্প আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের। সেও আস্থা রেখেছে বলপ্রয়োগে আর দখলে। সীমান্ত, কাঁটাতার, টেরিটোরিই দুটি জমজ রাষ্ট্রের কাছে মুখ্য হয়ে রয়েছে প্রায় পৌনে শতাব্দীকাল ধরে। মানুষের কথা সেখানে কতটুকুইবা শোনা হয়েছে? যতসামান্যই। মোদ্দাকথা, সিংহভাগ সাহিত্য আর ইতিহাসে কাশ্মীরিদের স্থান হয়েছে ‘অপূর্ব ফ্রেমের মধ্যে এক বিশ্রী ছবি’ (An ugly picture in a magnificent frame) হিসেবে। সেই সীমাবদ্ধতা থেকেই আমার দায় কাশ্মীরিদের কাছে। ফ্রেম আর ছবির সামঞ্জস্যই এখানে আমার উপজীব্য। মানুষ আর প্রকৃতির মেলবন্ধনই এখানে আমার লক্ষ্য।
নোট/সূত্র
১. বুলবুল সরওয়ার; ঝিলাম নদীর দেশ (২০১৫); ৫১তম সংস্করণ; ঢাকা: অ্যাডর্ন
২. বুলবুল সরওয়ার; ঝিলামে যখন ছিলাম (২০১৬); ঢাকা: ঐতিহ্য
৩. Mridu Rai; Hindu Rulers Muslim Subjects: Islam, Rights, and the History of Kashmir (2014); New Delhi: Permanent Black. P3.