কল্পনা
চিরযৌবনবাবুর আসল নাম অনেকেই জানেন না, আমাদেরও জানিবার প্রয়োজন নাই। ‘চিরযৌবন’ তাঁহার সাহিত্যিক ছদ্মনাম। এই নামে তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে কীর্তি অর্জন করিয়াছেন।
চিরযৌবনবাবুর বয়স এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। পঁচিশ বছর পূর্বে যে নবীন বিদ্রোহীর দল বাঙলা সাহিত্যে নূতনত্বের বন্যা বহাইয়া দিয়াছিলেন, ইনি তাঁহাদেরই একজন। তারপর বন্যার তোড়ে অনেকেই ভাসিয়া গিয়াছেন; মুষ্টিমেয় যে কয়জন স্বকীয়তায় বলে টিকিয়া আছেন, চিরযৌবনবাবু তাঁহাদের অগ্রণী। এখনও তাঁহার লেখায় দুর্দম যৌবনের তেজ ও বিদ্রোহিতা বিচ্ছুরিত হয়। তিনি নামেও যেমন, অন্তরেও তেমনি—চিরযৌবন।
চিরযৌবনবাবু বিপত্নীক। জীবনের মাত্র দুই-তিনটা বছর তাঁহার স্ত্রীসংসর্গ ঘটিয়াছিল, অন্যথা প্রায় সারা জীবনই একাকী কাটিয়াছে। একাকিত্বে তিনি অভ্যস্ত। কলিকাতার একটি মধ্যমশ্রেণীর দেশী হোটেলের ত্রিতলের ছাদে একটিমাত্র ঘর, সেই ঘরটিতেই তিনি থাকেন। ঘরটির আসবাবপত্রে দেয়ালের ছবিতে শৌখিনতার ছাপ আছে, যদিও তাহা দুর্মূল্য শৌখিনতা নয়। সাহিত্যজীবী মানুষ অনাড়ম্বরভাবে যতখানি শৌখিনতা করিতে পারে, ততখানিই। হোটেলের ম্যানেজার তাঁহাকে স্থায়ী বাসিন্দারূপে পাইয়া গৌরব অনুভব করেন এবং ভৃত্যেরা তাঁহার আজ্ঞা পালনের জন্য ছুটাছুটি করে। চিরযৌবনবাবু সুখে আছেন।
কখনও গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সমকালীন সাহিত্যবন্ধুদের সমাগম হয়। খোলা ছাদের উপর মাদুর পড়ে, চা ও সিগারেটের ধোঁয়ায় বাতাস সুরভিত হয়। চিরযৌবনবাবু হয়তো নিজের সদ্য-রচিত গল্প পাঠ করেন। তারপর আবার একাকী। কল্পনার সমুদ্রে যৌবনের স্বপ্নভরা সোনার তরী ভাসিয়া চলে।
সেদিন সন্ধ্যার সময় চিরযৌবনবাবু বেড়াইতে বাহির হইতেছিলেন। ফাল্গুন মাস, কিন্তু এখনও সন্ধ্যার পর একটু ঠাণ্ডা পড়ে। পাটভাঙ্গা সিল্কের পাঞ্জাবির উপর আলোয়ানটা কাঁধে ফেলিয়া তিনি আয়নার দিকে চাহিলেন। ছিমছাম গৌরবর্ণ চেহারা, মুখের চামড়া এখনও কুঞ্চিত হয় নাই, মাথার চুল বারা আনা কাঁচা আছে। তিনি বুরুশ দিয়া চুলগুলিকে আরও চিক্কণ করিয়া তুলিলেন, সরু গোঁফের উপর একবার আঙুল বুলাইলেন। তারপর দ্বারে তালা লাগাইয়া বাহির হইলেন।
সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে তাঁহার কণ্ঠে গানের কলি গুঞ্জরিত হইতে লাগিল—বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল-শাখাতে দিস্নে আজি দোল—
হোটেলের সদর একটি অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তার উপর; সেখান হইতে কুড়ি পঁচিশ কদম দূরে বড় রাস্তার মোড়। চিরযৌবনবাবু হোটেল হইতে বাহির হইয়া বড় রাস্তার দিকে চলিলেন। মাইলখানেক দূরে একটি পার্ক আছে। সেখানে বেঞ্চির উপর বসিয়া একটি সিগারেট সেবন করিবেন, তারপর আবার বাসায় ফিরিবেন।
তখনো রাস্তায় আলো জ্বলে নাই। দিনের আলো মৌমাছি-ছোঁয়া লজ্জাবতী লতার মতো মুদিয়া আসিতেছে। চিরযৌবনবাবু মোড় ঘুরিতে গিয়া হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িলেন। ঠিক মোড়ের উপর ল্যাম্পপোস্টের নীচে একটি যুবতী দাঁড়াইয়া আছে।
যুবতী চিরযৌবনবাবু অনেক দেখিয়াছেন, আজকাল রাস্তাঘাটে যুবতী দেখার কোনও অসুবিধা। নাই। কিন্তু তিনি দাঁড়াইয়া পড়িলেন এবং নির্নিমেষ নেত্রে যুবতীর পানে চাহিয়া রহিলেন।
যুবতীর চেহারা ভাল। রঙ ফরসা, চোখ ও নাক যেমন ধারালো, গাল ও ঠোঁট তেমনি নরম। গড়ন মোটাও নয়, রোগাও নয়, শাঁসে-জলে। ঘাড়ের উপর খোঁপাটি এমনভাবে বাঁধা যেন খুলিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে। পরনে ফিকা নীল রঙের জর্জেট। বুকে কার দুই বাহুর মধ্যে বালিশের মতো একটি ক্ষুদ্র পুঁটুলি ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং প্রচ্ছন্ন উদ্বেগভরা চোখে এদিকে-ওদিক চাহিতেছে।
দুই মিনিট নিষ্পলক চাহিয়া থাকিবার পর চিরযৌবনবাবু সচেতন হইলেন। মেয়েটিও একবার তাঁহার দিকে ভ্রূ তুলিয়া চাহিয়া অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া লইল। আর দাঁড়াইয়া থাকা যায় না, অসভ্যতা হয়। চিরযৌবনবাবু মেয়েটিকে পাশ কাটাইয়া একদিকে চলিতে আরম্ভ করিলেন।
কয়েক পা চলিবার পর কিন্তু তাঁহাকে থামিতে হইল। পিছন হইতে কেহ যেন রাশ টানিয়া ধরিয়াছে। রাস্তায় বেশী লোক ছিল না। চিরযৌবনবাবু কিছুক্ষণ নতচক্ষে দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর ফিরিয়া চলিলেন।
মেয়েটি তখনও দাঁড়াইয়া আছে। তাহার দিকে যতই তিনি অগ্রসর হইলেন ততই তাঁহার গতি শিথিল হইতে লাগিল; তারপর অজ্ঞাতসারেই তিনি দাঁড়াইয়া পড়িলেন।
যুবতী আবার ভ্রূ বাঁকাইয়া তাঁহার পানে চাহিল; তাহার চোখে অস্বাচ্ছন্দ্য ভরা। চিরযৌবনবাবু হঠাৎ চমকিয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু তাঁহার দৃষ্টি যুবতীর উপর আবদ্ধ হইয়া রহিল।
মোড় ঘুরিয়া তিনি হোটেলের দিকে চলিলেন। যাইতে যাইতে একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন! যুবতী তাঁহারপানে চাহিয়া ছিল, চোখাচোখি হইতেই চোখ ফিরাইয়া লইল।
হোটেলের দ্বারের কাছে আসিয়া চিরযৌবনবাবুর ঘাড় আবার যুবতীর দিকে ফিরিল। সে এইদিকেই তাকাইয়া আছে। চিরযৌবনবাবুর বুকের ভিতরটা একবার প্রবলভাবে হাঁচোড়-পাঁচোড় করিয়া উঠিল, তিনি হোটেলে প্রবেশ করিলেন।
নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া তিনি দ্বার ভেজাইয়া দিলেন। আলো জ্বালিলেন না, আলোয়ান আলনায় রাখিয়া আরাম-চেয়ারে অর্ধশয়ান হইলেন। আজ মনের এই বিহ্বলতার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। সিগারেট ধরাইয়া তিনি আত্মবিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হইলেন।
যুবতীটি সুন্দরী বটে। কিন্তু চিরযৌবনবাবু লুচ্চা-লম্পট নয়, তবে তাহাকে দেখিয়া তিনি এমন আত্মবিস্মৃত হইলেন কেন? হয়তো যুবতীর দেহে রূপ ছাড়াও প্রবল জৈব আকর্ষণ আছে। কিংবা চিরযৌবনবাবুরই দেহে-মনে অনাস্বাদিত যৌবনের রস দীর্ঘকাল ধরিয়া বিন্দু বিন্দু সঞ্চিত হইতেছিল, আজ বসন্ত সমাগমে সহসা উছলিয়া উঠিয়াছে।
যুবতীর বাহুবন্ধনের মধ্যে বালিশের মতো জিনিসটা বোধ হয় একটি শিশু। —কার শিশু?
চিরযৌবনবাবুর মন স্বভাবতই কল্পনা-প্রবণ। তাঁহার চিন্তা বাতাসের মুখে সাবান-বুদ্বুদের মতো ভাসিয়া চলিল।… খুট্ খুট্—খুট্ খুট্। দ্বারে কে টোকা দিতেছে।
চিরযৌবনবাবু উঠিয়া দ্বার খুলে সেই যুবতী দাঁড়াইয়া আছে, বাহুবেষ্টনের মধ্যে কাপড় ঢাকা বালিশের মতো পুঁটুলিটি। ভীরু কণ্ঠে বলিল—‘আপনি কি চিরযৌবন—বাবু?’
চিরযৌবন একটু হাসিয়া বলিলেন—‘হ্যাঁ।’
‘ভেতরে আসতে পারি?’ মেয়েটির গলা কাঁপিয়া গেল।
‘আসুন’
মেয়েটি সঙ্কোচভরে ঘরে প্রবেশ, চিরযৌবনবাবু একটি চেয়ার তাহার দিকে আগাইয়া দিলেন।
সে চেয়ারে বসিল না, ঘরের একপাশে একটি চৌকি ছিল, তাহার উপড় আসনপিঁড়ি হইয়া বসিল, পুঁটুলিটিকে কোলে শোয়াইয়া দিয়া মুখ তুলিল।
চিরযৌবনবাবু বলিলেন—‘আপনাকে চিনি না। কিন্তু আজ বোধ হয় মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।’
মেয়েটি ঘাড় কাত করিয়া বলিল—‘হ্যাঁ, আপনাকে কিন্তু আমি দেখেই চিনতে পেরেছি। আপনার লেখা আমার খুব ভাল লাগে।’
চিরযৌবনবাবু একটু সলজ্জভাবে অভিনয় করিলেন, বলিলেন—‘তৃপ্তি পেলাম। আপনি কি—?’
‘আমাকে আপনি বলবেন না, তুমি বলুন।’
‘তা আচ্ছা। বয়সে আমি যখন বড়—’
‘এমন কী বড়? আমার বয়স তেইশ।’
চিরযৌবনবাবু নিজের বয়স বলিলেন না, প্রশ্ন করিলেন—‘তোমার নাম কি?’
‘কল্পনা।’
চিরযৌবনবাবু স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন, তাঁহার গল্প-উপন্যাসে কল্পনা নামে কোনও চরিত্র আছে কিনা। না, নাই, নূতন নাম।
‘তুমি মোড়ে দাঁড়িয়ে কারুর জন্যে অপেক্ষা করছিলে বুঝি?’
কল্পনা মুখ নত করিল, তাহার কপাল ও গাল দুটি ধীরে ধীরে রক্তিমাভ হইয়া উঠিল। চিরযৌবনবাবু বুকের কাছে সূচীবিদ্ধবৎ একটু জ্বালা অনুভব করিলেন।
‘স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করছিলে?’
কল্পনা চকিতে চোখ তুলিয়া আবার নত করিল।
‘আমার বিয়ে হয়নি।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর চিরযৌবনবাবু লক্ষ্য করিলেন, কল্পনার কোলে বস্তুপিণ্ডটি অল্প অল্প নড়িতেছে, একটি শীর্ণ কাকুতি শোনা গেল।
‘বাচ্ছাটির বয়স কত?’
‘দশ দিন।’
‘দশ দিন! —এ—কার বাচ্ছা?’
কল্পনা বিদ্রোহভরা সুরে বলিল—‘আমার।’
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। শিশু পুনশ্চ আকুতি জানাইল। চিরযৌবনবাবু বলিলেন—‘ওর বোধহয় ক্ষিদে পেয়েছে।’
কল্পনা বলিল—‘হ্যাঁ, ক্ষিদে পেলে উসখুস করে।’
‘তা—ওকে কিছু খেতে দেওয়া দরকার। কি দেবে? আমার ঘরে টিনের দূধ আছে।’
‘এখনও টিনের দুখ খেতে শেখেনি।’
কল্পনা চিরযৌবনবাবুর দিকে পিছন ফিরিয়া বসিল। তিনি ক্ষণেক বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া তাড়াতাড়ি চোখ ফিরাইয়া লইলেন।
দশ মিনিট পরে কল্পনা আবার সামনে ফিরিয়া বসিল। পূর্ণোদর শিশু আর কোনও গণ্ডগোল করিল না।
চিরযৌবনবাবু একটু কাশিয়া বলিলেন—‘তুমি কেন আমার কাছে এসেছ বললে না তো। কিছু চাই কি?’
কল্পনা ব্যগ্র চক্ষে চাহিয়া বলিল—‘চাই। আজ রাত্রির জন্যে আমাদের আশ্রয় দিতে হবে।’
‘তা—তোমার কি আর কোথাও যাবার নেই?’
‘না। শুনবেন আমার ইতিহাস? নতুন কিছু নয়, কিন্তু শুনলে আপনি বুঝবেন। আমি জানি যৌবনের স্বধর্মকে আর যে যাই বলুক, আপনি কখনও অপরাধ বলে মনে করবেন না।’
চিরযৌবনবাবু দৃঢ়স্বরে বলিলেন—‘না, যৌবনের স্বধর্মকে আমি অপরাধ বলে মনে করি না। বরং যারা যৌবনকে জোর করে পীড়ন করতে চায়, অপরাধী তারাই।’
কল্পনা প্রদীপ্ত চক্ষে বলিল—‘তাই তো আপনার লেখা এত ভালবাসি—আপনি চিরযৌবন। এখন আমার ইতিহাস বলি। এই কলকাতা শহরেরই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘরের মেয়ে আমি। ঘরে সৎমা আছেন। বিয়ে দেবার পয়সা বাবার নেই, তাই লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন।
‘একজনকে ভালবেসেছিলাম। ভালবাসা বলতে ঠিক কি বোঝায় তা হয়তো মনস্তত্ত্ববিদেরা জানেন। তার কতখানি দৈহিক আকর্ষণ, কতখানি মানসিক, তা বিচার করার মতো বুদ্ধি আমার নেই। বোধ হয় ডি এল রায়ের কথাই ঠিক—যখন থাকে না future-এর চিন্তা থাকে না ক’ shame, তারেই বলে প্রেম। আমারও সাময়িকভাবে সেই অবস্থা হয়েছিল। বিয়ে হবার উপায় ছিল না, জাতের তফাত। লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখা হত। একবার স্বামী-স্ত্রী সেজে একরাত্রি একটা হোটেলে ছিলাম। তারপর—
‘সৎমা জানতে পারলেন, বাবার কানে উঠল। আমার তখন future-এর চিন্তা ফিরে এসেছে, প্রেমাস্পদকে বললাম—আমাকে বাঁচাও। উত্তরে প্রেমাস্পদ তার বিয়ের নিমন্ত্রণ-পত্র আমার হাতে দিল। তাকে দোষ দিই না। কারণ বিয়ের কথা তার সঙ্গে কোনও দিন হয়নি।
‘তারপর যথাসময়ে বাবা আমাকে মেটার্নিটি হোমে ভর্তি করে দিয়ে বলে গেলেন—আর বাড়িতে ফিরে যেও না।
‘তারপর আজ দশ দিন পরে মাতৃত্বের নিদর্শন নিয়ে মাতৃসদন থেকে বেরিয়েছি।’
কল্পনা চুপ করিল। চিরযৌবনবাবু সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিলেন। পাঁচ মিনিট পরে সিগারেটের টোটা ফেলিয়া দিয়া বলিলেন—‘আজ মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? মনে হচ্ছিল কারুর জন্যে অপেক্ষা করছ।’
কল্পনা বলিল—‘না। মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমার মতো মেয়েকে আশ্রয় দিতে পারে এমন কেউ রাস্তা দিয়ে যায় কিনা। তারপরেই আপনাকে দেখতে পেলাম। আপনার অনেক ছবি দেখেছি, চিনতে কষ্ট হল না। ভাবলাম, একটা রাত্রির জন্য যদি কেউ আশ্রয় দিতে পারে তো সে আপনি। তাই এসেছি। দেবেন আশ্রয়?’
চিরযৌবনবাবু উঠিয়া গিয়া কল্পনার কাঁধের উপর হাত রাখিলেন—‘শুধু এক রাত্রির জন্যে নয়, সারা জীবনের জন্যে যদি আশ্রয় চাও, তাও দিতে পারি।’
কল্পনা ঊর্ধ্বমুখী হইয়া বিভক্ত ওষ্ঠাধরে চাহিল—‘সত্যি বলছেন?’
চিরযৌবনবাবু হৃদয়ের দ্রুত স্পন্দন দমন করিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন—‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে—’
উদ্দীপ্তকণ্ঠে কল্পনা বলিল—‘কে বলে বয়স হয়েছে? আপনি চিরযুবা—চিরনবীন—’
ঠক্ ঠক্! ঠক্ ঠক্—!
রূঢ় শব্দে চিরযৌবনবাবু ধড়মড় করিয়া ইজি-চেয়ারে উঠিয়া বসিলেন। কেহ দ্বারের কড়া নাড়িতেছে। তাঁহার কল্পনার সাবান-বুদ্বুদ এই শব্দের আঘাতে ফাটিয়া গেল।
আলো জ্বালিয়া তিনি দ্বার খুলিলেন।
সামনে দাঁড়াইয়া আছে সেই যুবতী যাহাকে ঘিরিয়া তিনি এতক্ষণ কল্পনার জাল বুনিতেছিলেন। সঙ্গে এক যুবা। প্যাণ্টুলুনের উপর পুল-ওভার; ডাম্বেলভাঁজা চেহারা। চোখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি।
যুবতীর বুকের কাছে কাপড়ের পুঁটুলি; সে এক হাত মুক্ত করিয়া চিরযৌবনবাবুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল—‘ঐ বুড়োটা!’
যুবক উগ্রস্বরে বলিল—‘কি রকম জানোয়ার তুমি হে! বুড়ো হয়েছ এখনও ভদ্রতা শেখোনি? ভদ্রমহিলা একলা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর তুমি ড্যাম্ স্কাউন্ড্রেল—’
মহিলা বলিলেন—‘আমার পম্পম-এর অসুখ করেছে তাই, নইলে কুকুর লেলিয়ে দিতুম।’
পম্পম নামধারী ক্ষুদ্র কুকুর নিজের নাম শুনিয়া যুবতীর বাহুবদ্ধ বস্তুপিণ্ডের ভিতর হইতে ঝাঁকড় মাথা তুলিল, চিরযৌবনবাবুকে ধমক দিয়া বলিল—‘ভুক্ ভুক্—’
চিরযৌবনবাবু অভিভূতের মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন। এই সময় হোটেলের ম্যানেজার উপরে আসিয়া বলিলেন—‘কি হয়েছে মশাই? কি হয়েছে—?’
যুবক বলিল—‘এই বুড়োটা! আমার স্ত্রীকে অপমান করেছে। আমার কুকুরটার অসুখ করেছিল, তাই আমার স্ত্রী তাকে নিয়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমার অফিস থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছিল, ইতিমধ্যে বুড়োটা—’ যুবক চিরযৌবনবাবুর দিকে ঘুষি পাকাইয়া বলিল—‘বুড়ো বলে বেঁচে গেলে, নইলে আজ ঠেঙিয়ে পাট করে দিতুম।’
ম্যানেজার বলিলেন—‘হাঁ হাঁ, বলেন কি, উনি একজন বিখ্যাত—’
যুবক বলিল—‘ড্যাম বিখ্যাত। —ডোম চামার লোচ্চা—’
চিরযৌবনবাবু আর সহ্য করিতে পারিলেন না। সশব্দে দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন।
ঘর অন্ধকার করিয়া তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন। ওই বুড়োটা! ওই বুড়োটা! ওই বুড়োটা!—তাঁহার কর্ণে ধ্বনিত হইতে লাগিল। তিনি বুড়া হইয়াছেন, সকলেই তাহা দেখিতে পাইতেছে। অথচ—প্রকৃতির এ কি পরিহাস! তাঁহার মন বুড়া হয় নাই কেন? মন কেন এখনও সরস সজীব আছে, যৌবনের রঙিন নেশায় বিভোর হইয়া আছে?
কেন? কেন? একি দুর্বিষহ বিড়ম্বনা!
১৯ বৈশাখ ১৩৬১