কলেজিয়েট স্কুলের সহপাঠীরা
কলেজিয়েট স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে কয়েকজনের কথা বেশ ভালো মনে আছে। তাদের কেউ কেউ এখন বেঁচে নেই, কারো কারো সঙ্গে আটত্রিশ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর আর দেখা হয়নি, আবার কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়েছে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় এবং তারো পরে, আমি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি তখন, বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সূত্রে। এই শেষের দলের মধ্যে নাজির আহমেদ আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওর গোটা পরিবারেরই একজন কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলাম আমি। নাজির ছিল সেকালের ঢাকার সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব মীর্জা আবদুল কাদেরের ভ্রাতুষ্পুত্র। কাদের সর্দার তখন বেসরকারি নগর প্রশাসনের অন্যতম স্তম্ভ, নাটক-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র প্রভৃতির উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক, নেপথ্যে থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রেও সক্রিয়। ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সকল কাজে তিনি তাঁর স্নেহের উদার হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। নাজিরের বড় ভাই নাসির আহমেদকে আমি নিজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো দেখতাম। নাজিরের ছোট ভাই চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান ও নাট্যকার সাঈদ আহমেদ ছিল আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ওদের মধ্যে একমাত্র সাঈদ আহমেদ ছাড়া আজ আর কেউ বেঁচে নেই। আমার সহপাঠী বন্ধু নাজির মারা গেল এই সেদিন।
স্কুল ছাড়ার পর নাজিরকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়েও পাই। সে তখন শৌখিন মঞ্চাভিনেতা হিসেবে রীতিমতো বিখ্যাত। এটা হলো ১৯৪৩-৪৪ সালের কথা। তখন ঢাকায় কোনো প্রেক্ষাগৃহে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা ছিল না। তবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে এবং দু’চারটি মহল্লার ক্লাবের উদ্যোগে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে বার্ষিক নাটক মঞ্চস্থ হতো। অবধারিতভাবে শীত মৌসুমে। কেউ কেউ তাদের অভিনয় নৈপুণ্যের গুণে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে অন্যত্রও অতিথি অভিনেতা হিসেবে অংশগ্রহণ করত। চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধেই নাজির আহমেদ একজন শক্তিশালী ব্যতিক্রমী আঙ্গিকের অভিনেতা হিসেবে নিজের জন্য একটা বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিল। সে সময় বহু নাটকে অভিনয় করে হাবিবুল হক (বাবু ভাই), মুজিবুর রহমান খান, আব্দুল খালেকও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তখন ঢাকায় অভিনীত হতো কলকাতার মঞ্চসফল বিধায়ক ভট্টাচার্য, দ্বিজেন্দ্রনাল রায়, মন্মথ রায়, শচীন সেনগুপ্ত প্রমুখের জনপ্রিয় নাটকগুলো। নার্সিং হোম নামক একটি নাটকে নাজির প্রধান চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিল। পরে যখন এসব বিষয়ে আরেকটু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ ঘটে তখন বুঝতে পারি যে সে সময় নাজিরের অভিনয়ভঙ্গির ওপর অহীন্দ্র চৌধুরীর অভিনয়কলার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিল; কিন্তু নাজির ধীরে ধীরে একটা স্বকীয় ঢঙ-ও তৈরি করে নিয়েছিল।
১৯৪৪-এ আমি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করি! তারপর নাজিরের সঙ্গে আবার দেখা হয় কলকাতায়। খুব সম্ভব ১৯৪৫-এর জুন মাসে। তখন সে অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা বেতার কেন্দ্রে চাকরি করছে। আদি ঢাকার মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারের একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে সেদিনের ওই পরিবেশে কেমন করে শুধু নিজের গুণে কলকাতা বেতারের মতো উন্নাসিক একটি প্রতিষ্ঠানে নিজের জন্য সম্মানের স্থান অধিকার করে নিতে পেরেছিল সেকথা ভাবতে আজও আমার অবাক লাগে। নাজিরের বাচনভঙ্গি ছিল নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কথার মধ্যে ঝোঁক ও বিরতিদানের ক্ষেত্রে সে ছিল দক্ষ। তার শরীরের গড়ন ছিল হালকা-পাতলা, কিন্তু কণ্ঠস্বরটি ছিল ভরাট। বক্তব্য বিষয় ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সে ওই কণ্ঠস্বরকে আকর্ষণীয়ভাবে ওঠাতে-নামাতে পারত, পারত তাকে তীক্ষ্ণ বা কেমল করে তুলতে। সোনালি কণ্ঠস্বরের বালক অভিধাটি সে তার কলকাতার বেতার জীবনেই অর্জন করে ফেলেছিল। ভারতীয় বেতারের অন্যতম কর্মকর্তা প্রখ্যাত জেড. এ. বোখারীর বিশেষ স্নেহভাজন ছিল নাজির। নাজির আমাকে একদিন বোখারী সাহেবের ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি এবং তাঁর তরুণী কন্যা নাজিরের সঙ্গে নিজেদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো আচরণ করেছিলেন এবং নাজিরের বন্ধুরূপে আমার সঙ্গেও। আমি তখন সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এমন একটা চাকরি যার সঙ্গে কবিতা-নাটক- সঙ্গীত কেন, কোনোরকম শিল্পকলারই, ক্ষীণতম যোগ নেই। কিন্তু যে চাকরিই করি না কেন অন্তর তাগিদেই আমি সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রথম থেকেই ঘনিষ্ঠ সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলাম। সে যোগাযোগ আজ অবধি শুধু অক্ষুণ্ণ থাকেনি, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর ঢাকা বেতারকে নতুনভাবে সংগঠিত করার কাজে নাজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষভাবে বেতারের নাট্যশাখাটিকে একটা শক্ত ভূমিতে দাঁড় করাবার জন্য সে প্রভূত পরিশ্রম করেছিল। সে সময় অবশ্য আমার চাইতে আমার ছোট ভাই মুনীরের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মুনীরকে দিয়ে নাজির ঢাকা বেতারের জন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক অণু-নাটক লিখিয়ে নিয়েছিল।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও নাজির আহমেদের তাৎপর্যময় অবদান ছিল। নাজিরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৯৭৬ সালে। লন্ডনের বুশ হাউসে, বিবিসি কেন্দ্রে। সে তখন সস্ত্রীক যুক্তরাজ্যে বাস করছে। এক রকম স্থায়ীভাবেই বিবিসির বাংলা বিভাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তার। মাঝে-মধ্যে অনুষ্ঠানও করত, পরামর্শ ও সহযোগিতা দিত। বহুদিন পর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে বিদেশের মাটিতে দেখা হয়ে ভীষণ ভালো লেগেছিল। বুশ হাউসের রেস্তরাঁয় বসে কফি খেতে খতে বোধহয় দু’তিন ঘণ্টা আন্তর্জাতিক শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা ও দেশের নানা গল্পে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। নাজির ছাড়াও ওই আড্ডায় এসে যোগ দিয়েছিল, সারাক্ষণ না হলেও ছাড়াছাড়াভাবে—কিছু সময়ের জন্য, সিরাজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নুরুল ইসলাম, কমল বোস, শ্যামল লোধ, দীপঙ্কর।
কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রজীবনের কথা বলতে গিয়ে নাজিরের প্রসঙ্গ ধরে অন্য অনেক স্মৃতিচারণ হয়ে গেল। এবার আবার ত্রিশের দশকের শেষ ক’বছরে ফিরে যাই। কলেজিয়েট স্কুল আর ঢাকা কলেজের ছাত্রজীবনের দিনগুলোতে।