কলম্বাসে একেনবাবু
তিন দিন হল নিউ ইয়র্ক থেকে কলম্বাসে বেড়াতে এসেছি, একেনবাবু এখনও দাড়ি কামিয়ে উঠতে পারেননি। ওঁর মুখে অবশ্য খোঁচা-খোঁচা দাড়ি সব সময়েই থাকে, কিন্তু তার কারণটা অন্য। ওঁর ভোঁতা ব্লেডের একটা কালেকশন আছে। প্রতিদিন তার থেকে একটা বেছে নিয়ে ক্ষৌরকর্ম সারেন। অনেক বুঝিয়েও ওঁকে নতুন ব্লেড কেনাতে পারিনি। বেশি চাপ দিলে বলেন, “কী হবে স্যার নতুন ব্লেডে, এই তো মুখের ছিরি!”
এরকম সেন্টিমেন্টাল কথা শুনে বাধ্য হয়ে একটা অসত্য ভাষণ করতে হয়। “বেশ তো চেহারা আপনার, নিজেকে এত অসুন্দর মনে করেন কেন?”
কিন্তু উনি-আমি দু-জনেই জানি, সৌন্দর্যের পরীক্ষায় পাশ করাতে হলে ওঁকে প্রচুর গ্রেস মার্ক দিতে হবে। বেঁটে, টিংটিঙে চোয়াড়ে টাইপের চেহারা, চুলগুলো উশকোখুশকো খাড়া খাড়া, জামাকাপড়গুলোর কোনোটার সঙ্গে কোনোটার সামঞ্জস্য নেই… একটাই শুধু মিল, সবগুলোই কোঁচকানো আর নোংরা। মোদ্দা কথা, অত্যন্ত আন-ইম্প্রেসিভ। তার ওপর অফুরন্ত বাজে বকেন আর লোকদের উলটোপালটা প্রশ্ন করে নানান সমস্যার সৃষ্টি করেন। এরকম একটি লোকের সঙ্গে কেন আমরা থাকি, সে নিয়ে আমি আর প্রমথ মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে গবেষণা করি। গবেষণাটা অবশ্য মজা করার জন্যেই, কারণ এই এক বছরেই একেনবাবুর সত্যিকারের মূল্যটা আমরা বেশ বুঝে গেছি। এরকম একজন ক্ষুরধার ডিটেকটিভ সারা নিউ ইয়র্ক শহরে আর একজনও আছেন কিনা সন্দেহ। তবে গোয়েন্দাগিরি করতে একেনবাবু নিউ ইয়র্কে আসেননি, এসেছেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ক্রিমিনোলজির ওপর রিসার্চ করতে। আমার সঙ্গে ওঁর প্রথম যখন যোগাযোগ হয়, তখন তো আমি জানতামও না উনি একজন গোয়েন্দা! পুরো ব্যাপারটা ‘ম্যানহাটানে মুনস্টোন’ উপাখ্যানে আমি বিশদ করে লিখেছি।
যাক সে-কথা। সংক্ষেপে, একেনবাবু, প্রমথ আর আমি নিউ ইয়র্ক শহরে ম্যানহাটানের বাসিন্দা। আমি এন-ওয়াই-ইউ, মানে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াই, প্রমথ পোস্ট-ডক করছে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে।
যদিও প্রথমে লিখেছি কলম্বাসে বেড়াতে এসেছি, উদ্দেশ্যটা কিন্তু নিছক বেড়ানো নয়। কাজের সূত্রে মাঝে মাঝে আমাকে কামাসে আসতে হয়। এবারের কাজ ছিল শুধু একটা লেকচার দেওয়া, যেদিন এসেছি সেদিনই চুকিয়ে ফেলেছি। কয়েকটা দিন এখন ঘুরে বেড়াব। এই জন্যেই প্রমথ আর একেনবাবুকে পাকড়াও করে আনা। একেনবাবুকে অবশ্য পাকড়াও করতে হয়নি, কারণ টিকিটটা পেয়েছেন ফ্রি-তে। আগে বহুবার কলম্বাসে এসেছি বলে এয়ারলাইন একটা কমপ্লিমেন্টারি টিকিট দিয়েছিল। ফ্রি-তে কিছু পেলেই একেনবাবু উৎসাহিত হন। প্রমথর আসার তেমন ইচ্ছে ছিল না, নিতান্ত আমাদের চাপে পড়ে এসেছে।
সত্যি কথা বলতে কি, কলম্বাসে বিশেষ কিছু দেখার নেই। কথাটা শুনলে কলম্বাসবাসীরা চটে যাবে, কিন্তু নিউ ইয়র্ক হল আমেরিকার ফাইনান্সিয়াল ক্যাপিটাল আর কালচারাল সেন্টার। কলম্বাসে ওয়ালস্ট্রিট নেই, ব্রডওয়ে নেই, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম নেই, মেসিজ হেরল্ড স্কোয়ার বা টিফানিজ-এর মতো দোকান নেই। তবে এটা ঠিক শহরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাড়িঘরদোর অনেক সস্তা। এখানে কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়ালে এর মধ্যেই একটা বাড়ি কিনে ফেলতে পারতাম! প্রথম দিন শহর পরিক্রমা করে এটাই হল আমাদের কনক্লুশন।
আমাদের কথা ছিল পরের দিন সকালে ‘বব এভান্স’ রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করতে যাব। প্রমথ ঘোষণা করল, একেনবাবু দাড়ি না কামালে ও যাবে না। প্রমথর এই গোঁয়ার্তুমির জন্যই দাড়ি না কামানোর রহস্যটা উদ্ধার হল। একেনবাবু কাঁচুমাচু মুখে জানালেন যে, ওঁর ব্লেডগুলো নিউ ইয়র্কে ফেলে এসেছেন। প্রমথ ধমকাল, “কী হাড়কেপ্পন লোক মশাই আপনি, একটা ব্লেড কিনতে পারেন না?”
“ক’দিন বাদেই তো ফিরে যাব স্যার।”
“তা বলে এ-ক’দিন দাড়ি কামাবেন না! নিন, আমার এই ব্লেডটা নিন।”
একেনবাবু লজ্জা-লজ্জা মুখে ব্লেডটা নিয়ে দাড়ি কামাতে কামাতে বললেন, “অ্যামেজিং ব্লেড স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং-একবারে ক্ষুরধার! দাড়ি কামাচ্ছি না মাখন কাটছি বোঝার উপায় নেই!”
.
আমরা যে হোটেলে আছি সেখান থেকে বেরিয়ে রুট থার্টি থ্রি দিয়ে কয়েক মাইল গেলেই বব এভান্স রেস্টুরেন্ট। ওখানকার সসেজ খুব বিখ্যাত। আমরা স্প্যানিশ স্টাইলের অমলেট, সসেজ, হোম ফ্রাই (ছোটো ছোটো করে কাটা আলু ভাজা) আর কফি নিলাম। স্প্যানিশ স্টাইলের অমলেট আবার কী? সেটা নির্ভর করছে কার রেসিপি আপনি ব্যবহার করছেন তার ওপর। বব এভান্স বানায় বেল-পেপার, পেঁয়াজ, টমাটো, মাশরুম আর চিজ দিয়ে। যারা ঝাল পছন্দ করে তাদের জন্য হালেপেইনো পেপারের কয়েকটা টুকরো লাগিয়ে দেয়।
খেতে খেতে একেনবাবু মন্তব্য করলেন, “একটা জিনিস খেয়াল করেছেন স্যার, এখানে খাবার জায়গা অসংখ্য, যেদিকে তাকান সেদিকেই রেস্টুরেন্ট! এখানকার লোকেরা কি বাড়িতে রান্না করে না?”
কারণটা আমি জানতাম। কলম্বাস হচ্ছে আমেরিকার রেস্টুরেন্ট ক্যাপিটাল। বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্ট কোম্পানিগুলো নতুন কোনো খাবার বাজারে চালু করার আগে এখানে ট্রায়াল দেয়। এখানে খাবারটা যদি চলে, তাহলেই অন্যান্য শহরে সেগুলো চালু করে। কোম্পানিগুলোর ধারণা কলম্বাসে যদি কিছু চলে, তাহলে আমেরিকার অন্যান্য জায়গাতেও সেটা চলবে। কথাটা নিশ্চয় কিছুটা সত্যি। আমেরিকার অনেক বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্ট চেইন-এর শুরু এই কলম্বাস থেকে। একেনবাবুকে এটা জানাতেই উনি বললেন, “বাঃ, বেশ সায়েন্টিফিক থিংকিং তো… ইন্ডিয়াতে কিন্তু এটা চলবে না।”
প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“কারণ ইন্ডিয়াতে জিভের কোনো কমন স্বাদ নেই স্যার। এই দেখুন, সাউথ ইন্ডিয়াতে চলবে ইডলি-ধোসা, নর্থে মোগলাই খানা, কিন্তু কলকাতায় শাক-চচ্চড়ি। এখানকার হ্যামবার্গার বা পিৎজার মতো কোনো ইউনিভার্সাল খাবারই নেই।”
আমি একবার ভাবলাম কথাটার প্রতিবাদ করব, কিন্তু করলাম না। একেনবাবুর যা বাজে-বকা স্বভাব। এই নিয়ে এক ঘণ্টা কান ঝালাপালা করে দেবেন! প্রমথও দেখলাম চুপ করে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। একেনবাবু কিন্তু রেস্টুরেন্ট প্রসঙ্গ ছাড়লেন না। খানিক বাদেই বললেন, “যাই বলুন স্যার, একটা ভালো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কিন্তু এখানে দেখলাম না।”
“কটা ভারতীয় এখানে থাকে যে গণ্ডায় গণ্ডায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট থাকবে?” প্রমথ আর চুপ করে থাকতে পারল না।
“তা বললে শুনব কেন, স্যার। এদিকে বলছেন এটা রেস্টুরেন্ট ক্যাপিটাল, অথচ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নেই! কেন স্যার, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট তো নিউ ইয়র্কে খুব চলে। আমি বলব, ওরা আমেরিকার কার কী ভালো লাগবে ঠিক জানে না!”
একেনবাবু সব কিছুই এমন তির্যকভাবে দেখেন, মাঝে মাঝে বিরক্তি লাগে। কিন্তু ওঁর সঙ্গে তর্কাতর্কি জুড়লাম না। প্রমথ আবার একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক ভদ্রলোক আমাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে থেমে গেল।
প্রথমে চিনতে পারিনি, কিন্তু নামটা বলতেই মনে পড়ল। গত বছর যখন এসেছিলাম আলাপ হয়েছিল। ডক্টর অনাদি রায়, ওহায়ও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ান। সেবার ওঁকে দেখেছিলাম হাসিখুশি, উৎসাহে টগবগ করছেন। এবার মনে হল বেশ মিইয়ে গেছেন— একটু যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্তও। “কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করে প্রমথ আর একেনবাবুর সঙ্গে ওঁর পরিচয় করিয়ে দিতেই উনি একটু অদ্ভুতভাবে একেনবাবুর দিকে তাকালেন। তাতে আমি কিছুমাত্র অবাক হলাম না, একেনবাবুকে দেখে সবারই এরকম রিয়্যাকশন হয়। ওঁর চেহারার সঙ্গে গোয়েন্দা- ইমেজটা একেবারেই মেলানো যায় না। প্রমথ আবার একেনবাবুকে নিয়ে আমার চেয়ে অনেক বেশি হাসিঠাট্টা করে। ডঃ রায়কে বলল, “আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? উনি কিন্তু সত্যিই একজন ডিটেকটিভ, তবে ছদ্মবেশে আছেন!”
ডঃ রায় থতমত খেয়ে বললেন, “না না, তা নয়। আসলে আমি একজন ডিটেকটিভ খুঁজছি।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, কী ব্যাপার?”
আমার প্রশ্নের উত্তরে ডঃ রায় যা বললেন তা এতই অবিশ্বাস্য, আমার মনে হল ভদ্রলোকের মাথায় একটু গণ্ডগোল হয়েছে। যাই হোক, ঘটনাটা হল… উনি এক মাস আগে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে কলকাতায় যান। দিন কুড়ি ওখানে ছিলেন। তারপর এখানে ফিরে এসে যখন কাজকর্ম শুরু করলেন, ওঁর মনে হতে লাগল ওঁর অনুপস্থিতিতে কেউ বাড়িতে এসে ঢুকছে।
প্রমথ জিজ্ঞেস করল, কী করে উনি সেটা বুঝলেন? উত্তরে ডঃ রায় বললেন, বাড়িতে ফিরে এসে উনি দেখতেন যে টুকিটাকি জিনিসগুলো কেমন যেন একটু অন্য জায়গায়! যেমন অ্যাশট্রেটা উনি সব সময়ে টেবিলের ঠিক মধ্যিখানে রাখেন, বাড়িতে ফিরে দেখেন সেটা টেবিলের এক কোনায় রয়েছে। দুটো ফুলদানি বুকশেলফের ওপরে দু-দিকে থাকত। সে-দুটোও যেন একটু সরানো। কৃষ্ণনগরের একটা মাটির পুতুল এনেছিলেন দেশ থেকে—সেটা তো ভেঙে টুকরো টুকরো! ক্লজেটে রাখা জামাকাপড়ও একটু যেন অবিন্যস্ত, মনে হয় কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। প্রথম দিন ব্যাপারটাকে পাত্তা দেননি, ভেবেছিলেন বোধহয় জেটল্যাগ। দেশ থেকে ফিরে দু-এক দিন চোখে এত ঘুম-ঘুম থাকে সব কিছু ঠিকঠাক খেয়ালও থাকে না। কিন্তু ফিরে আসার দু-দিন পরে উনি যখন পুরোপুরি নর্মাল, বাড়ি ফিরে এসে দেখেন ওঁর সুটকেস খুলে কেউ ঘেঁটেছে! ড্রেসার-ড্রয়ারের ভেতরগুলোও বেশ ওলটপালট। আর যেটা খুবই ডিস্টার্বিং, সেটা হল ওঁর নতুন কোলাপুরি চটিটা কেউ ছুরি দিয়ে ফালাফালা করে গেছে!
“আপনি পুলিশে খবর দিয়েছিলেন স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। “দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ যখন শুনল কিছুই চুরি যায়নি, তখন আর পাত্তা দিল না। ওদের ধারণা আমি দরজা-জানলা খোলা রেখে কলেজে গেছি। আর পাড়ার কোনো দুষ্টু ছেলে ঘরে ঢুকে এই দুষ্কর্মটি করেছে!
“আপনার কী ধারণা স্যার?“
“আমার কোনো ধারণাই নেই। তবে আমি শিওর জানলা-দরজা দুটোই আমি বন্ধ করে গেছি। প্রথম দিন যদিও-বা না করে থাকি পরের দিনগুলোতে নিশ্চয় করে গেছি।”
“ক’বার এরকম কেউ বাড়িতে ঢুকেছে বলে আপনার মনে হয় স্যার?”
“অন্তত বার চারেক আমি শিওর, জিনিসপত্র এদিক-ওদিক হতে দেখেছি।”
“আপনার বাড়ির চাবি কি আর কারো কাছে আছে?” এবার আমি প্রশ্নটা করলাম।
“আমার এক বন্ধু সত্য, মানে সত্য গুপ্ত— ওর কাছে একটা ডুপ্লিকেট আছে। প্রতি বছর যখন দেশে যাই বা বাইরে কোথাও যাই, ও মাঝে মাঝে এসে দেখে যায় বাড়িটা ঠিকঠাক আছে কিনা। ওর বাড়ির একটা চাবিও আমার কাছে থাকে।”
“আপনার বন্ধু আপনার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করছেন না তো!” আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল।
“কেন করতে যাবে! তার ওপর আমার এই শোকের সময়!” ডঃ রায় আমার কথায় একটু বিরক্তই হলেন। “ইন ফ্যাক্ট, সত্যও এ ব্যাপারে বেশ উদ্বগ্ন!”
আমি দেখলাম প্রমথ অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আমাদের আবার ব্রেকফাস্ট খেয়েই কিংস আইল্যান্ড যাবার প্ল্যান। কিংস আইল্যান্ড খুব বড়ো একটা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। জায়গাটা কাছেও নয়, কলম্বাস থেকে গাড়ি করে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ।
আমি ডঃ রায়কে বললাম, আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে। বিকেলে ফিরে এসে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব। কিংস আইল্যান্ডের কথাটা আর বললাম না। পাছে ভাবেন ওঁকে সাহায্য না করে আমরা অ্যামিউজমেন্ট পার্কে মজা করতে যাচ্ছি!
কিংস আইল্যান্ড যাবার পথে প্রমথ মন্তব্য করল, “লোকটা উন্মাদ। নইলে এরকম অদ্ভুত ঘটনা কেউ কোনোদিন শুনেছে, চুরি না করে বাড়ির জিনিসপত্র ঘেঁটে চোর চলে যাচ্ছে!”
একটা বিদেশি গল্পে ঠিক এরকম একটা ঘটনার কথাই পড়েছিলাম, কিন্তু তার শেষটা ঠিক কী ছিল মনে করতে পারলাম না। তাই একটু মজা করেই বললাম, “হয়তো চুরি করার মতো পছন্দসই কিছু পায়নি।”
“তোর মুণ্ডু! চোরের আবার পছন্দ-অপছন্দ কী রে!” প্রমথ ধমক লাগাল। একেনবাবু দেখলাম চুপচাপ। আমি ঠাট্টা করে বললাম, “কী মশাই, রহস্যের মধ্যে একেবারে ডুবে গেছেন মনে হচ্ছে। আমাদের কথা কানেই তুলছেন না!”
একেনবাবু চমকে উঠে বললেন, “ছি ছি, কী যে বলেন স্যার, রহস্য আবার কোথায় পাব?”
প্রমথ ছাড়ল না। বলল, “আমাদের কথা একটু শুনলেই রহস্যের গন্ধ পেতেন।”
একেনবাবু কান চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “আপনারা স্যার দু-জনেই বড্ড ঠাট্টা করেন!”
কথাটা এমনভাবে বললেন আমরা দু-জনেই হেসে উঠলাম।
.
কিংস আইল্যান্ড থেকে ফেরার পথে সারাটা পথ ভুট্টার খেত দেখতে-দেখতে একেনবাবু বললেন, “ধুউউস, এখানে কিংস আইল্যান্ড ছাড়া আর কিছুই নেই স্যার।”
“মিড ওয়েস্টে ভুট্টার খেত ছাড়া আপনি আর কী আশা করেছিলেন?”
“কে জানে স্যার। তবে যাই বলুন, আমাদের নিউ ইয়র্কই ভালো।”
এটা কিন্তু একেনবাবুর একটা বিরাট পরিবর্তন। এতদিন বলতেন, ‘আপনাদের নিউ ইয়র্ক’
প্রমথ ঠাট্টা করার লোভসংবরণ করতে পারল না। বলল, “বাঃ, যেই নিউ ইয়র্ক ভালো হল, সঙ্গে-সঙ্গে সেটা ‘আমাদের নিউ ইয়র্ক’ হয়ে গেল। আর খারাপ হলেই ‘আপনাদের নিউ ইয়র্ক”!”
“কী যে বলেন স্যার!” বলে একেনবাবু একটা সিগারেট ধরালেন। ওঁর এই বদ অভ্যাসটা আমি আর প্রমথ এতদিন চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না, যখন-তখন সিগারেট ধরাবেন! সিগারেট যে শুধু ওঁর শরীরের পক্ষে খারাপ তাই নয়, যারা ওই ধোঁয়ার গন্ধ শুঁকছে তাদের পক্ষেও খারাপ- হাজার বার বলেও কোনো লাভ হয়নি। যেটা হয়েছে সেটা হল, আজকাল ধোঁয়াটা ছাড়েন মুখ ঘুরিয়ে, যাতে সোজাসুজি আমাদের নাকে এসে না লাগে। ভাবটা তাতেই ওঁর দায়িত্ব খতম! গাড়িতে সবাই বসে আছি বলে কাচ নামিয়ে বাইরে ধোঁয়াটা ছাড়লেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “কী স্যার, এক বার ডঃ রায়ের ওখানে যাবেন নাকি?”
প্রথমে ধরতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম, “কোন ডঃ রায়?
বলেই অবশ্য খেয়াল হল উনি অনাদি রায়ের কথা বলছেন। তখন বললাম, “আপনি ডঃ রায়কে সিরিয়াসলি নিয়েছেন নাকি? আমার তো মনে হল, একটু খ্যাপা খ্যাপা হয়ে গেছেন।”
প্রমথ মন্তব্য করল, “একটু খ্যাপা খ্যাপা! একেবারে সার্টিফায়েড ইনসেইন!” তারপর একেনবাবুকে বলল, “আপনারা যেতে চাইলে যান। আমি হোটেলে গিয়ে বিছানায় চিৎপাত হচ্ছি।”
কিংস আইল্যান্ডে ঘোরাঘুরি করে আমারও খুব টায়ার্ড লাগছিল। তাই একেনবাবুকে বললাম, “কেন সময় নষ্ট করবেন খামোখা।”
“কিন্তু ভদ্রলোককে যে বললেন ফিরে এসে যোগাযোগ করবেন! উনি নিশ্চয় অপেক্ষা করে থাকবেন স্যার।”
কী মুশকিল! এরকম কত কথাই তো কত লোককে বলি! সব কথাই কি রাখতে হবে? কিন্তু একেনবাবুকে কে বোঝায়! এমন ঘ্যানঘ্যান শুরু করলেন বাধ্য হয়ে হোটেলে ফিরে ডঃ রায়কে ফোন করলাম।
ডঃ রায় ফোন পেয়ে খুব খুশি। “এক্ষুনি আসুন,” বলে বাড়ির ডিরেকশন দিয়ে দিলেন।”
.
ডঃ রায়ের বাড়ি কলম্বাসের শহরতলি ওয়ার্দিংটনে। শুনেছিলাম বিয়ে-থা করেননি, একাই থাকেন। ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন। বাড়িতে ঢুকেই ডান দিকে বিশাল বসার ঘর। ঘরের ঠিক মাঝখানে চৌকো কফি টেবিল ঘিরে একটা সোফা, লাভ-সিট আর একটা লেজি-বয় চেয়ার। আমরা সেখানে গিয়ে বসতেই ডঃ রায় বললেন, “একটু চা করি আপনাদের জন্য?”
“একদম না স্যার।” একেনবাবু ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলেন।
আমিও বললাম, “না, না, আমরা চা খেয়েই এসেছি।”
“এই প্রথম এলেন, কিছুই খাবেন না?”
“তাতে কী হয়েছে, দ্বিতীয় বার যখন আসব, তখন না হয় খাব।” আমি হেসে বললাম।
.
কফি টেবিলের মাঝখানে বেশ বড়োসড়ো একটা চিনেমাটির অ্যাশট্রে। একেনবাবুর চোখ ইতিমধ্যে সেদিকে চলে গেছে। কথাবার্তা কিছু না বলে অ্যাশট্রেটা উলটে পালটে খানিকক্ষণ দেখলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি নতুন কেনা স্যার?”
আমরা চিনি বলে একেনবাবুর ব্যবহারে আজকাল আর আশ্চর্য হই না। কিন্তু ডঃ রায় একটু থতমত খেয়ে বললেন, “না, ঠিক নতুন নয়। গত বছর তাইওয়ান থেকে কিনেছিলাম।”
একেনবাবু দুলে-দুলে মাথা নাড়লেন, “ঠিক, এই তো ‘মেড ইন তাইওয়ান’ লেখা। এক বছরের পুরোনো বললেন স্যার, তাই না? কিন্তু দেখতে একদম নতুন।” তারপর নাকের সামনে একটু ধরে বললেন, “মনে হয় ব্যবহারই করা হয়নি।”
ডঃ রায় আমার দিকে এক বার তাকালেন, ভাবটা কার পাল্লায় পড়েছি! মুখে বললেন, “তা একদিক থেকে নতুনই। এবার দেশ থেকে ফিরে পুরোনো অ্যাশট্রেটা খুঁজে না পেয়ে এটাকে বাক্স থেকে বের করেছি।”
“খুঁজে পাননি মানে? ওটা কি চুরি হয়েছে স্যার?”
“চুরি হতে যাবে কেন? আমার বন্ধু সত্য, যাকে আমি অ্যাপার্টমেন্টটা দেখাশোনা করতে বলেছিলাম, সেই ওটাকে নিয়ে গেস্ট রুমে রেখে দিয়েছিল। তাই এসে খুঁজে পাইনি।”
আমি অ্যাশট্রেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আজ সকালে কি এই অ্যাশট্রের কথাই বলছিলেন? এটাকে সরিয়ে কেউ অন্য কোথাও রেখেছিল?”
“অন্য জায়গা মানে, টেবিলের ওপরেই ছিল। তবে আমি যেরকম ঠিক মাঝখানে রাখি, সেখানে ছিল না। ছিল টেবিলের একদম সাইডে।”
“আপনি শিওর স্যার টেবিলের ঠিক মাঝখানে রেখে বেরিয়েছিলেন?”
“নিশ্চয়।” মনে হল একেনবাবুর প্রশ্নে উনি একটু বিরক্ত। “আমি কোনো কিছু অগোছালো অবস্থায় রাখি না।” সেটা বোঝাতেই বোধহয় অ্যাশট্রেটা সরিয়ে আবার ঠিক মধ্যিখানে এনে রাখলেন।
ওঁর এই দাবিটা মনে হয় ভুল না। ঘরের প্রতিটি জিনিস একেবারে নিখুঁতভাবে সাজানো। সব কিছুই সিমেট্রিক্যাল! বুককেসের ওপর দুটো ফুলদানি যেন ইঞ্চি মেপে দু-পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিন দেয়ালে তিনটে ছবি রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি আর একজন অচেনা বয়স্কা মহিলার- সবগুলোই টাঙানো হয়েছে দেয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর, একইরকম উঁচুতে। ছবির সাইজগুলোও মনে হয় একদম এক। দরজার সামনের পাপোশটা পর্যন্ত সযত্নে ঠিক কপাটের মধ্যিখানে বসানো। আমরা ঢোকার পর পায়ে লেগে একটু সরে গিয়েছিল। সেটাও এর মধ্যে স্বস্থানে আনা হয়েছে!
“আপনার ফুলদানিটা একটু দেখি স্যার,” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই একেনবাবু সোফা থেকে উঠে পড়লেন। ডঃ রায়ের বিস্মিত চোখের সামনে ফুলদানিটা একটু পরীক্ষা করলেন। ওঁর দেখাদেখি আমিও বিজ্ঞের মতো দ্বিতীয় ফুলদানিটা হাতে তুললাম। পেতলের ওপর সূক্ষ্ম কাজ করা ফুলদানি, বেশ ভারী। দামি ফুলদানি যেমন হয় আর কী! বুককেসের ওপর ফুলদানিগুলো আবার রাখতেই ডঃ রায় এসে দুটোকে আবার একটু অ্যাডজাস্ট করে রাখলেন। বুঝলাম অত্যন্ত অবসেসিভ ক্যারেকটার।
বুককেসে এক বার চোখ বুলিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কৃষ্ণনগরের পুতুলটা কোথায় ছিল স্যার?”
“এই যে পাশের এটাজেয়ারে… ঠিক এইখানে।” বলে ডঃ রায় এটাজেয়ারের তৃতীয় তাকটা দেখালেন। অজস্র পুতুল সেখানে সাজানো। একটাও দেশের তৈরি নয়, মনে হয় স্পেন বা সাউথ আমেরিকার পুতুল। মাঝখানে একটু জায়গা ফাঁকা— সেখানেই কৃষ্ণনগরের পুতুলটা ছিল।
“ওখান থেকে পড়েই ভেঙে গিয়েছিল স্যার?”
“তাই তো মনে হয়। ঠিক নীচেই মেঝেতে টুকরোগুলো পড়েছিল।”
“টুকরোগুলো আছে স্যার?”
“না, ফেলে দিয়েছি। কেন বলুন তো?”
একেনবাবু মাথাটা একটু চুলকে বললেন, “এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। মনে হচ্ছে স্যার, আপনি পুতুল খুব ভালোবাসেন… এতগুলো পুতুল!”
“না না, পুতুল কেনার আমার কোনো বাতিক নেই। এগুলো সবই পাওয়া এক কলিগের কাছ থেকে। সে পাততাড়ি গুটিয়ে যখন ব্রাজিল ফিরে গেল আমাকে পুতুলগুলো দিয়ে গেল। বন্ধুর দেওয়া, তাই রেখে দিয়েছি।”
“কিন্তু কৃষ্ণনগরের পুতুলটা স্যার?”
“ওটা মায়ের ঘরে বহুদিন ছিল। সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু- তাই নিয়ে এসেছিলাম আমি নিজে পেতলের জিনিস ভালোবাসি, দেশে গেলে ওগুলোই কিনি। কিন্তু এবার কেনাকাটা করার মানসিক অবস্থা ছিল না।”
“তা তো বটেই স্যার, আপনার মা চলে গেলেন- খুবই স্যাড। আচ্ছা স্যার, দেয়ালের ওই ছবিটা কি আপনার মায়ের?”
“হ্যাঁ।”
“খুবই সুন্দরী ছিলেন উনি।
ডঃ রায় একটু চুপ করে থেকে বললেন, “হ্যাঁ, তা ছিলেন। আনার মধ্যে ওটাই শুধু এনেছি এবার, আর সেই পুতুলটা। ছবিটাও আনা হত না, যদি না ফোটো স্টুডিও-র মালিক মিস্টার শেঠ সাহায্য করতেন। শেষ সময়ে দু-দিনের মধ্যে পরিচিত একজনকে দিয়ে বাঁধিয়ে দিলেন।”
“চমৎকার ফ্রেম স্যার, তাই আরও চোখে পড়ছে!”
“দুঃখের ব্যাপার কী জানেন?” ব্যথিতভাবে ডঃ রায় বললেন, “ছবি বাঁধানোর টাকাটাও ভদ্রলোককে দেবার সুযোগ পাইনি, আমাকে চিরঋণী করে রেখে গেলেন!’
“একটু বুঝিয়ে বলুন স্যার।”
“টাকা নিতে আমার বাড়ি আসার পথে মিস্টার শেঠ গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছি, প্রথমে মায়ের মৃত্যু, তারপর মিস্টার শেঠের। এখন মনে হচ্ছে এটাই ছিল নিয়তি। এতদিন হইচই করে কাটিয়েছি, এখন তার মাশুল গুনছি!”
“এই মিস্টার শেঠ আপনার খুব বন্ধু ছিলেন?” প্রশ্নটা এবার আমি করলাম।
“উনি সত্য-র বহুদিনের বন্ধু, সেই সূত্রেই আলাপ। কিন্তু দেশে গেলে প্রতি বছর দেখা করতে আসতেন আর বন্ধুর জন্যে একটা কিছু উপহার পাঠাতেন। প্লেনে ওজনের রেস্ট্রিকশন থাকে— সব সময়ে হালকা প্যাকেটই পাঠাতেন। এবার আমার মায়ের এই ব্যাপার, তাই সেটাও পাঠাননি। একটা চিঠি দিয়েছিলেন- এবার আর কিছু পাঠালাম না বলে। যাতে বন্ধু ভুল না বোঝে। সব সময়েই কিছু না কিছু নিয়ে আসি তো।”
“এরকম বন্ধু পাওয়া দুর্লভ।” আমি বললাম।
“হ্যাঁ, ওঁর মৃত্যুতে সত্য ভীষণ আপসেট।”
বুঝতে পারছিলাম ডঃ রায় নিজেও কম আপসেট নন।
আমি যখন কথা বলছি একেনবাবু তখন ঘরের বড়ো জানলাটা একটু দেখছেন। ডঃ রায়কে বললেন, “সামনের দরজাটাই বাড়িতে ঢোকার একমাত্র পথ, তাই তো স্যার?”
“না, পেছনে প্যাটিওর দরজা দিয়েও ঢোকা যায়, কিন্তু সেটা সব সময়ে বন্ধ থাকে।”
“তাই নাকি স্যার! একটু দেখব?”
“নিশ্চয়।” বলে ডঃ রায় কিচেনের পাশে প্যাটিওর স্লাইডিং দরজার কাছে নিয়ে গেলেন। দরজাটা বন্ধ আর স্লাইডিং-এর জায়গায় একটা লাঠি বসানো। অর্থাৎ, কেউ যদি স্লাইডিং পাল্লার লকটাও কায়দা করে খোলে, লাঠি থাকার জন্যে পাল্লাটা স্লাইড করতে পারবে না।
“এক্কেবারে ফুল প্রুফ স্যার!” একেনবাবু সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন।
.
আর বিশেষ কোনো কথা হল না। আমরা যখন বেরোচ্ছি তখন দরজার মুখে দেখি একজন অচেনা ভদ্রলোক।
“এই যে সত্য, এসে গেছ!” বলে ডঃ রায় আমাদের সঙ্গে সত্য গুপ্তের পরিচয় করিয়ে দিলেন। একেনবাবু নিউ ইয়র্কের ডিটেকটিভ শুনে সত্য গুপ্ত ডঃ রায়কে বললেন, “ভালো করেছ, এসব রহস্য ভেদ করা কলম্বাস পুলিশের কর্ম নয়।”
তারপর আমাদের উদ্দেশ করে বললেন, “অনাদি যখন দুপুরে কলেজে থাকে ওর বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে ঘুরে যাই, যদি ব্যাটাদের ধরতে পারি! নো লাক সো ফার! যাই হোক, দেখে-শুনে আপনি কী বুঝলেন?” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন সত্য গুপ্ত।
একেনবাবু ঘাড় ঘষতে ঘষতে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বললেন, “ভেরি কনফিউজিং স্যার, ভেরি কনফিউজিং!”
“আমিও তাই ভাবছিলাম,” সত্য গুপ্ত বললেন, “কনফিউজিং বলে কনফিউজিং! কেউ ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘেঁটে চলে যাচ্ছে, অথচ কিছু চুরি করছে না। এক হতে পারে কিছু খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। কিন্তু কী সেটা?”
“একদম ঠিক, সেটাই সিক্সটি-ফোর ডলার কোয়েশ্চেন!” আমি বললাম।
.
ফেরার পথে একেনবাবু একেবারে চুপচাপ, মনে হল একটু অন্যমনস্ক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী এত ভাবছেন?”
একেনবাবু উত্তর না দিয়ে বললেন, “দেখছেন স্যার, এখানকার হাইওয়েগুলো কীরকম ফাঁকা-ফাঁকা? সারা শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। নিউ ইয়র্কে এটা ভাবাই যায় না।”
আমি বললাম, “কথা এড়াচ্ছেন কেন? নিশ্চয় কিছু একটা ভাবছেন, আর সেটা হাইওয়ের কথা নয়।”
উত্তর পেলাম না।
.
পরদিন সকালে একেনবাবু ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুলে হুলুস্থুলু বাঁধালেন, “কী আশ্চর্য স্যার, ওহায়ও স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস যে আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো সেটা তো জানতাম না?”
প্রমথ হোটেল-রুমের কফিগুঁড়োর প্যাকেট খুলে বানানো তিতকুটে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “জানলে কী হাতি-ঘোড়া হত শুনি?”
“তা নয় স্যার, তবে ক্যাম্পাসটা এক বার ভালো করে দেখা উচিত, হাজার হোক নাম্বার ওয়ান তো!”
“আপনি গেলে বাপিকে নিয়ে যান মশাই, আমি যাচ্ছি না!” প্রমথ বলল, “সব ক্যাম্পাসই এদেশে এক বড়ো বড়ো বিল্ডিং আর মাঠ। আর ওহায়ও স্টেট যখন, মাঠে কিছু গরু-ভেড়াও চরে বেড়াচ্ছে দেখবেন। ছাত্র ছাড়াও মিড ওয়েস্টের আসল গরু!”
“তুই চুপ কর!” আমি প্রমথকে ধমক লাগালাম। নিউ ইয়র্কে থেকে থেকে ও ব্যাটা আরও উন্নাসিক হয়েছে! একেনবাবুকে বললাম, “যেতে চান তো এখনি চলুন। লাঞ্চের পরে আমার একটা কাজ আছে।”
“বেশ তো স্যার। একটা ফোনের অপেক্ষা করছি। সেটা পেলেই রওনা দেব।”
“কার ফোনের অপেক্ষা করছেন?”
“ডঃ রায়ের। সকালে একটা জিনিস জানতে চেয়ে ওঁকে ফোন করেছিলাম।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা বেজে উঠল। ডঃ রায়েরই ফোন। ফোনে কী বললেন জানি না, কিন্তু একেনবাবু দেখলাম দারুণ উত্তেজিত! “এই ইম্পর্টেন্ট শব্দটাই তো মিস করে গিয়েছিলেন স্যার। আর কিছু কি এনেছিলেন? আর কিচ্ছু না? ঠিক আছে স্যার, আমরা এক্ষুনি আসছি।”
“চলুন স্যার, ডঃ রায়ের বাড়িতে আবার যেতে হবে।” আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“কী ব্যাপার বলুন তো? সেটা না বললে আমি একচুল নড়ছি না!
“ওই যে স্যার, ডঃ রায় সেদিন বললেন না, মিস্টার শেঠ সত্যবাবুকে লিখেছিলেন, ‘এবার কিছু পাঠাচ্ছেন না’? সেটা ঠিক লেখেননি স্যার, লিখেছিলেন ‘এবার আলাদা করে কিছু পাঠাচ্ছেন না’। বিগ ডিফারেন্স স্যার, ভেরি বিগ ডিফারেন্স।”
প্রমথকে ইতিমধ্যেই ডঃ রায়ের বাড়িতে যা ঘটেছে জানিয়েছি। ও চট করেই ধরতে পারল। বলল, “তার মানে যা পাঠাবার অন্য কিছুর সঙ্গে পাঠাচ্ছেন।”
“এক্স্যাক্টলি স্যার! আর একটা মাত্র জিনিসই মিস্টার শেঠ পাঠিয়েছিলেন, সেটা হল ডঃ রায়ের মায়ের ফ্রেমে বসানো ছবি। মনে হচ্ছে সব রহস্য সেই ফ্রেমের মধ্যেই লুকোনো।”
.
ডঃ রায়ের বাড়ি পৌঁছে ছবিটা নামিয়ে পেছনটা খুলতে বেশি সময় লাগল না। ব্রাউন পেপারটা কাটতেই কার্ডবোর্ডের পেছনে আঠা দিয়ে আটকানো কমসে কম তিরিশ-চল্লিশটা হিরের টুকরো!
ডঃ রায়ের মুখ দেখলাম হাঁ হয়ে গেছে!
“কী দেখছেন স্যার,” একেনবাবু ডঃ রায়কে বললেন। “আপনার বন্ধু এই সত্য গুপ্ত হচ্ছেন একজন স্মাগলার। আপনার মতো নিরীহ লোকেদের ঘাড় ভেঙে উনি স্মাগলিং চালাতেন।”
“মাই গুডনেস, এতদিনের বন্ধু, ওয়েল এজুকেটেড!” ডঃ রায় আর কিছু বলতে পারলেন না।
আমি বললাম, “মিস্টার শেঠ চিঠিতে ছবিটার কথা উল্লেখ করলেন না কেন, তাহলে সত্য গুপ্তকে কৃষ্ণনগরের পুতুল ভাঙতে হত না, কোলাপুরি চটিটাও কাটতে হত না। ধরে নিচ্ছি হিরে খুঁজতেই ওই কীর্তিগুলো উনি করেছেন।”
“খেপেছেন স্যার, সেটা লেখা যায় নাকি! চিঠিটা যদি পুলিশের হাতে পড়ত!”
“ফোন করে তো জানাতে পারতেন! না সেখানেও ফোন ট্যাপ হতে পারে ভেবেছিলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“হু নোজ স্যার! হয়তো ভেবেছিলেন পরে জানাবেন, কিন্তু তার আগেই তো তিনি ডেড অ্যান্ড গন!” তারপর ডঃ রায়কে বললেন, “আপনার এই বন্ধু স্যার, অত্যন্ত ধুরন্ধর। আপনি এখানে আসার পরও আপনি যখন বাড়ির বাইরে থাকতেন, চোর ধরার অছিলা করে আপনার বাড়িতে ঢুকতেন, আর তন্নতন্ন করে হিরেগুলোকে খুঁজতেন। উনি জানতেন ওঁর এই বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারটা প্রতিবেশীদের কারও না কারোর নজরে আসবে। কিন্তু উনি তো লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করছেন না, আপনাকে জানিয়েই করছেন!”
ডঃ রায় একেবারে স্তব্ধ!
“সত্যি স্যার, আপনার মস্ত ভাগ্য, এত বছর আপনি কাস্টমসের হাতে ধরা পড়েননি! এক বার ভাবুন তো ধরা পড়লে কী হত! এরকম আর বন্ধুদের উপকার করতে যাবেন না স্যার, তিনি যত এজুকেটেডই হোন। আর আমরা এখানে থাকতে থাকতেই পুলিশকে ফোন করুন।”