‘কলমীর দল’

‘কলমীর দল’*

অবতার যখন আসেন, একা আসেন না। রাজা যেমন একা চলেন না, সঙ্গে তাঁর কয়েকজন সভাসদ চাই, ভগবানেরও তাই। তিনি যখন অবতীর্ণ হন, সঙ্গে কয়েকজন লীলাসহচর নিয়ে আসেন। আমরা শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশুখ্রীষ্ট, শ্রীচৈতন্য—সব অবতারের বেলাতেই এটা দেখি। শ্রীরামকৃষ্ণও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি এসেছেন, সঙ্গে এনেছেন আরও একদল মানুষ। এমন মানুষ—যাঁদেরকে ঠিক সাধারণের সাথে মিশিয়ে ফেলা যায় না। শ্রীরামকৃষ্ণ এঁদের জন্য বিশেষ ব্যস্ত, এবং এঁরাও শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য পাগল। যখন প্রথম দেখা হচ্ছে তখন থেকেই প্রত্যেকে তাঁর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছেন। অনেকেরই মনে হচ্ছে : এ কার কাছে এলাম ! যেন কতদিনের চেনা ! এমনকি নিজেদের বাবা-মার ভালবাসাও তুচ্ছ মনে হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের ভালবাসার কাছে। বস্তুত, তাঁরা হয়তো জানতেন না, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ তখনই জানতেন যে, এঁদের জীবন তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁকে কেন্দ্র করেই এঁদের জীবন। যে উদ্দেশ্যে তাঁর আবির্ভাব, তা সার্থক হয়ে উঠবে এঁদের সাহায্যে। এ যেন একটা নাটকের দল—অবতার স্বয়ং তার প্রধান চরিত্রে। এই নাটকের নায়ক তিনি। আর সবাই আছেন বিভিন্ন পার্শ্বচরিত্রে। কেউ হয়তো খুব লম্বা একটা অংশ অভিনয় করছেন— নায়কের প্রায় সমান অংশ তাঁর। আবার কেউ হয়তো ছোট একটা অংশে অভিনয় করছেন। কিন্তু সবাই-ই সেই নাটকে অংশ নিচ্ছেন। নায়কের জীবন, নায়কের চরিত্র বা নায়কের যেটা মূল বক্তব্য সকলের সম্মিলিত অভিনয়ে সেটা আরও পরিস্ফুট হয়ে উঠছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের প্রধানত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একদলে আছেন তাঁর অন্তরঙ্গ ত্যাগী-সন্তানরা। নরেন, রাখাল, বাবুরাম প্রভৃতি। অধিকাংশই যুবক এবং স্কুল-কলেজের ছাত্র।** আর একদলে আছেন তাঁর গৃহী-ভক্তরা। ঠাকুরের আকর্ষণ কিন্তু ঐ যুবক-ভক্তদের প্রতিই বেশী। বলছেন : এরা সূর্যোদয়ের আগে তোলা মাখন। সূর্যের তাপ লাগলে মাখন গলে যায়। এঁদের উপরে সেই তাপ লাগেনি অর্থাৎ সংসারের তাপ এখনও পড়েনি এঁদের উপর। তাই ত্যাগ, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য জমাট বেঁধে রয়েছে এঁদের মধ্যে। ঠাকুর বিশেষ ভালবাসেন এঁদের। ভালবাসেন এবং তীক্ষ্ণ নজরে রাখেন। তাঁদের আধ্যাত্মিক জীবন যাতে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। আগলে রাখেন বিপদ-আপদ থেকে। তাঁর স্নেহ দুর্বলের স্নেহ নয়। রাতে কেউ বেশী রুটি খেয়ে ফেললে তিনি বিরক্ত হন। কারন, বেশী খেলে ঘুম পাবে। রাত ঘুমনোর জন্য নয়, সাধনার জন্য। রাতে জাগে তিন জন—যোগী, ভোগী এবং রোগী। এঁরা বালযোগী—রাতের ঘুম এঁদের সাজে না। তাই মাঝ রাতে ঘুম ভাঙিয়ে এঁদের কাউকে পঞ্চবটীতে বা কাউকে হয়তো গঙ্গাতীরে পাঠিয়ে দেন সাধনভজন করতে। সামান্য হেরফের হলেও কঠোর শাসন করেন। ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ভিন্ন আর কোন প্রসঙ্গ করতে নেই, বলে দেন। সত্যকথা কলির তপস্যা। তাই ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যে কথা বলতে নিষেধ করেন। এঁদের এক এক জনের এক এক প্রকৃতি, এক এক ‘ঘর’। সবাইকে তিনি তাঁর উপযোগী করে শিক্ষা দেন। একজনকে যা উপদেশ দেন, অন্যকে হয়তো তা বলেন না। কিন্তু সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যান নিঃশ্রেয়সের দিকে। এঁদের সম্বন্ধে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তিনি বলেন। সেগুলি সব ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু সেগুলি যে সত্য তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। কারণ, এঁদের সম্বন্ধে তাঁর অনেক ভবিষ্যদ্বাণী পরে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। এঁদের কাউকে কাউকে তিনি বলছেন ‘ঈশ্বরকোটি’। সবাইকে বলছেন না, কয়েকজনকে বলছেন। কেন তিনি বেছে বেছে কয়েকজনকে এরকম বললেন বোঝা যায় না। তবে সবাই-ই যে অ-সাধারণ, সবাই-ই যে অতি উচ্চমার্গের মানুষ, সবাই-ই যে তাঁর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ-তাঁদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা আচার-আচরণ থেকে বোঝা যায়।

যোগীন্দ্র সম্বন্ধে বলছেন ; কৃষ্ণসখা অর্জুন। পরে তিনি স্বামী যোগানন্দ হলেন, শ্ৰীশ্ৰীমার কত সেবা করলেন। ত্যাগী-সন্তানদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে অল্প বয়সে দেহত্যাগ করলেন। খুব সংক্ষিপ্ত জীবন, কিন্তু অদ্ভুত জীবন। যেমন শুদ্ধ তেমনি পবিত্র। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন : আমাদের মধ্যে ঠিক ঠিক কামজিৎ যোগীন।

আর একজন সম্বন্ধে ঠাকুর বললেন : শ্ৰীমতীর অংশ—হাড় পর্যন্ত শুদ্ধ। তিনি বাবুরাম মহারাজ। স্বামীজী সন্ন্যাসনাম দিয়েছিলেন স্বামী প্রেমানন্দ। ঠাকুরের যখন ভাব হত তখন সকলের স্পর্শ সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু বাবুরাম মহারাজ তাঁকে স্পর্শ করতেন, কারণ, তাঁর শুদ্ধ দেহ। ‘নৈকষ্যকুলীন’, ঠাকুরের ‘দরদী’। ঠাকুরকে ঐ অবস্থায় স্পর্শ করবার যোগ্যতা তাঁর ছিল। স্বামীজীর দেওয়া ‘প্রেমানন্দ’ নামও সার্থক হয়েছিল তাঁর জীবনে। তাঁর ভালবাসার আকর্ষণে যুবক-ভক্তরা দলে দলে মঠে ছুটে আসতেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র, তাঁরা অনেকেই পরে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগ দিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গে কত ধর্মপ্রচার করেছেন তিনি। তিনি যখন শেষবার পূর্ববঙ্গে গেছিলেন (১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দ), তখন তাঁকে দেখবার জন্য, তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য এত লোক হত যে, গান্ধীজীর জনসভাতেও অত ভিড় হত না। স্বামীজী তাঁকে বলে গেছিলেন : পূর্ববঙ্গটা তোর জন্য রইল। সত্যিই প্রেমানন্দজীর প্রেমে গোটা পূর্ববঙ্গ যেন ভেসে গেছিল। তাঁর শরীর যাওয়ার পর মাস্টারমশাই (‘কথামৃত’কার, ‘শ্রীম’) বলেছিলেন : ঠাকুরের প্রেমের দিকটা চলে গেল।

আর একজন হলেন, শরৎ মহারাজ—সন্ন্যাসনাম স্বামী সারদানন্দ। তাঁর কোলে বসে ঠাকুর দেখেছিলেন কতটা ভার বইতে পারেন তিনি। পরে সবাই দেখেছে তাঁর ভারবহনের পরীক্ষা। রামকৃষ্ণসঙেঘর ভার এবং শ্রীশ্রীমার ভার দুই-ই তিনি সুষ্ঠুভাবে বহন করেছিলেন ! সঙ্ঘের প্রথম সাধারণ সম্পাদক তিনি। আবার মায়ের সেবক ছিলেন। শ্রীশ্রীমা বলতেন : শরৎ আমার ভারী। আমার মাথার মণি। শরৎ মহারাজ বলতেন : আমি মায়ের দ্বারী। অত্যন্ত ধীরস্থির, কোন কিছুতে বিচলিত হতেন না। স্বামীজী বলেছিলেন : বেলে মাছের রক্ত ওর। কিছুতেই তাতে না। শ্রীশ্রীমা একসময় তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন : নরেনের (স্বামীজীর) পর এত বড় প্রাণ আর একটিও পাবে না। ব্রহ্মজ্ঞ হয়তো অনেকে আছেন, শরতের মতো এমন হৃদয়বান দিলদরিয়া লোক ভারতবর্ষে নেই, সমস্ত পৃথিবীতে নেই। অদ্ভুত চরিত্র এই সারদানন্দের। যেমন হৃদয়, তেমনি পাণ্ডিত্য, আবার তেমনি কর্মক্ষমতা। ধীর, স্থির, প্রশান্ত এবং নিরলস। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ তাঁরই রচনা।

আবার আর একজন যুবক-ভক্তকে কুস্তি করে জয় করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। পরবর্তীকালে তিনিই হলেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। দীর্ঘ দেহ। সুস্থ, সবল—নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। দুশো ডন আড়াই-শো বৈঠক দেন রোজ। ঠাকুর তাঁকে বললেন : আমার সঙ্গে কুস্তি লড় তো দেখি। তিনি প্রথম প্রথম ইতস্তত করছেন। শেষে দেখেন যে ঠাকুরই পালোয়ানের মতো তাল ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে আসছেন। তখন আর কি করেন ? তিনিও এগোলেন তাল ঠুকে। ঠাকুরকে দুহাতে ধরে একেবারে অতি সহজে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন। ঠাকুরকে হারিয়ে দিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানানন্দজী পরে বলতেন : সেদিন তিনিই আমাকে হারিয়েছিলেন। সেই যে আমি তাঁকে দেয়ালে ঠেসে ধরেছিলাম, তখন তিনি আমার কি করলেন জানি না—কিন্তু বেশ বুঝলাম, একটা শক্তি আমার মধ্যে ঢুকল, আমি তাঁর বশ হয়ে গেলাম। কাজেই, আমিই তো হেরেছি—তিনি আমাকে কিনে নিয়েছেন ! বেলুড় মঠে যে শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দির আমরা দেখি, তারই তত্ত্বাবধানে এই মন্দির হয়েছিল। ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন তিনি। স্বামীজী মন্দিরের পরিকল্পনা করে গেছিলেন, মোটামুটি সেই পরিকল্পনা-অনুযায়ী পরে তিনি এই মন্দির করেছিলেন।

এইসব যুবক-ভক্তদের ঠাকুর অনেক সময় জিজ্ঞাসা করতেন : আমাকে তোমার কি মনে হয় ? কেউ হয়তো বলল : আপনাকে সাক্ষাৎ ভগবান মনে হয়। ঠাকুর খুব খুশি। কেন খুশি হচ্ছেন ? কারণ, এঁরা তাঁর জন্মজন্মান্তরের সাথী, আপনার জন। কতদিন পরে তিনি তাঁদের দেখছেন, তাঁরাও তাঁকে দেখে চিনেছেন—তাই আনন্দ। মহাপুরুষ মহারাজ (স্বামী শিবানন্দ) বলতেন : ঠাকুরকে দেখেই তাঁর ‘মা’ বলে মনে হয়েছিল। পরে মহাপুরুষ মহারাজ বলতেন : মা-বাবা সব তিনি। রোমাঁ রোলাঁকে লেখা একটা চিঠিতে বলেছিলেন : শ্রীরামকৃষ্ণ যে কী, কত বড়, তা আমি এখনও বুঝতে পারিনি। তবে তাঁর কৃপায় তাঁর জীবদ্দশাতেই আমি তিন বার সমাধি-সুখ উপলব্ধি করেছি এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। তাঁর এই ‘মহাপুরুষ’ নাম স্বামীজীর দেওয়া। স্বামীজী বুঝেছিলেন, বিরাট আধার—তাই এই নাম দিয়েছিলেন।

যাঁদের কথা বললাম, এ ছাড়াও আছেন স্বামী নিরঞ্জনানন্দ—নিরঞ্জন মহারাজ। ঠাকুর যাঁর সম্বন্ধে বলতেন, নিত্য নিরঞ্জন—এতটুকুও অঞ্জন নেই, আর যাঁর সরলতার খুব প্রশংসা করতেন। আছেন অদ্বৈতানন্দ মহারাজ বা বুড়োগোপাল মহারাজ—ঠাকুরের চেয়েও যিনি বয়সে বড় ছিলেন। আছেন স্বামী অদ্ভুতানন্দ বা লাটুমহারাজ—শ্রীরামকৃষ্ণের miracle ! রাম দত্তের বাড়িতে ভৃত্য হয়ে এসেছিলেন বিহার থেকে। ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে জীবনের ধারা পালটে গেল। আছেন খোকা মহারাজ, শশী মহারাজ, গঙ্গাধর মহারাজ, সারদা মহারাজ, হরি মহারাজ ও কালী মহারাজ—সন্ন্যাসনাম যথাক্রমে—সুবোধানন্দ, রামকৃষ্ণানন্দ, অখণ্ডানন্দ, ত্রিগুণাতীতানন্দ, তুরীয়ানন্দ এবং অভেদানন্দ। আর আছেন স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বামী ব্রহ্মানন্দ।

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ সম্বন্ধে স্বামীজী বলতেন যে, দাস্য-ভক্তির পরাকাষ্ঠা হচ্ছে শশী। তাঁর ঠাকুর-পুজো একটা দেখবার মতো জিনিস ছিল। যারা সেই পুজো দেখত, তাদের মনে হত ঠাকুর যেন সাক্ষাৎ তাঁর সামনে রয়েছেন। ঠাকুরের মহাসমাধিব পর অন্যান্য গুরুভাইরা সবাই পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তখন বরাহনগর মঠ আগলে ছিলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। কোনদিন মঠ ছেড়ে যাননি। অথচ পরে স্বামীজী যখন বললেন তাঁকে মাদ্রাজে যেতে, একবাক্যে চলে গেলেন। খুব গোঁড়া ছিলেন শশী মহারাজ। দক্ষিণভারতের লোকও খুব গোঁড়া। স্বামীজী তাঁদের বলেছিলেন : আমি এমন একজনকে এখানে পাঠাব, যিনি গোঁড়ামিতে তোমাদেরও হার মানাবেন। তোমাদের সবচেয়ে গোঁড়া ব্রাহ্মণের চেয়েও তিনি গোঁড়া, অথচ পুজো, শাস্ত্রজ্ঞান, ধ্যান-ধারণা এসব দিক দিয়ে তিনি অতুলনীয়। দক্ষিণভারতে রামকৃষ্ণ-আন্দোলন প্রচারে শশী মহারাজের বিরাট ভূমিকা। শশী মহারাজের দেহত্যাগের পর স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন : একটা দিক্‌পাল চলে গেল, দক্ষিণ দিকটা যেন অন্ধকার হয়ে গেল। এখনও সেখানে সবাই তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কত কষ্ট করে সেখানে ছিলেন। একদিন এত অসহ্য মনে হয়েছে যে, স্বামীজীর ছবির দিকে তাকিয়ে অভিমান করে বলছেন : তোমার জন্যই তো আমি এই কষ্ট পাচ্ছি। পরক্ষণেই আবার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে স্বামীজীর কাছে ক্ষমা চাইছেন। স্বামীজী কিন্তু তখন দেহত্যাগ করেছেন। খুব পণ্ডিত ছিলেন, শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন অনেক। মাদ্রাজে বক্তৃতা করতেন। কোনদিন হয়তো দুর্যোগের জন্য একজনও আসেননি। তিনি কিন্তু যথারীতি শাস্ত্রব্যাখ্যা করে যেতেন, মনে করতেন, ঠাকুরকে শোনাচ্ছেন। এত অর্থকষ্ট ছিল যে, ঠাকুরের সেবা-পুজো চালানোও কঠিন হত। একদিন এমন হয়েছে যে, ঠাকুরের জন্য কিছু জোটেনি। তখন তিনি ঠাকুরকে বলছেন : আমাকে পরীক্ষা করছ ? ঠিক আছে, সমুদ্রের তীর থেকে বালি এনে তোমাকে ভোগ দেব, তারপর সেই বালিই প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করব। যদি গলা না নিতে চায়, আঙুল দিয়ে ঠেলে গলা দিয়ে নামাব। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা করতে হয়নি। অভাবনীয়ভাবে এক ভক্ত কিছু জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। শশী মহারাজ আর শরৎ মহারাজ এই দুজনের সম্বন্ধে ঠাকুর বলেছিলেন যে, তাঁদের তিনি যীশুখ্রীষ্টের সঙ্গে দেখেছিলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ একসময় বলেছিলেন : দিগ্বিজয়ী শঙ্করের মতো শশী মহারাজের প্রভাব দক্ষিণভারতে জ্বলজ্বল করছে।

শশী মহারাজ যেমন দক্ষিণভারতে রামকৃষ্ণ-আন্দোলন প্রচারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন, তেমনি ঠাকুর-স্বামীজীর ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র মন্ত্র প্রথম কার্যকর করেছিলেন স্বামী অখণ্ডানন্দ। দুঃখী-দরিদ্রের জন্য অখণ্ডানন্দের প্রাণ কাঁদত। তিনি একবার পায়ে হেঁটে মুর্শিদাবাদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। দাদপুর বলে একটা গ্রামে গিয়ে তিনি দেখলেন ; একটি অল্পবয়সী মুসলমান মেয়ে কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : কেন কাঁদছ, মা ? সেই মেয়েটি উত্তর দিল : আমি কলসী করে জল আনছিলাম। হাত থেকে পড়ে কলসীটা ভেঙে গেছে। আমাদের এই একটা মাত্র কলসী। এখন বাড়ি ফিরে গেলে মা মারবে। অখণ্ডানন্দ আরও খবর পেলেন যে, সেখানে দুর্ভিক্ষ চলছে—মেয়েটিও কয়েকদিন ধরে অভুক্ত আছে। তাঁর কাছে কয়েক আনা পয়সা ছিল, তিনি তখন তাই দিয়ে মেয়েটিকে একটি কলসী আর কিছু চিঁড়ে-মুড়কি কিনে দিলেন। যেই কিনে দিয়েছেন, অমনি চারদিক থেকে অভুক্ত ছেলেমেয়েরা তাঁকে ঘিরে ধরেছে : আমাকে দাও, আমাকে দাও। তখনই তিনি বাকি পয়সা দিয়ে ওদেরও কিছুটা চিড়ে-মুড়কি কিনে দিলেন। সেই রাত্রিটা তিনি সেখানেই থাকলেন। পরদিন সকালে দাদপুর ছাড়িয়ে যতই এগিয়ে যেতে লাগলেন, ততই দেখতে পেলেন, শুধু ঐ গ্রামই নয়, চারপাশের আরও অনেক গ্রামেই দুর্ভিক্ষ। তিনি ভাবলেন সেই এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। কারণ, এই কষ্ট চোখে দেখা যায় না। কিন্তু কেবলই মনে হতে লাগল, কে যেন তাঁকে পেছন থেকে টেনে ধরছে। তখন সেখানেই একটা গ্রামে তিনি থেকে গেলেন। আলমবাজার মঠে চিঠি দিয়ে সব জানালেন, আর দিনরাত ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন যাতে এদের দুঃখ-কষ্টের কিছু প্রতিকার হয়। এর কিছু পরে ১৮৯৭ সালের মে মাসে সারগাছির কাছে মহুলা গ্রামে তিনি রিলিফের কাজ শুরু করলেন। স্বামীজী খুব উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখলেন। অখণ্ডানন্দও প্রাণ ঢেলে কাজ করে যেতে লাগলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙঘবদ্ধ সেবাকাজ সেই প্রথম। পরবর্তীকালে সারগাছিতে একটা অনাথ-আশ্রম গড়ে উঠেছিল। স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। এই শ্লোকটা তিনি প্রায়ই আবৃত্তি করতেন:

ন ত্বহং কাময়ে রাজ্যং ন স্বর্গং নাপুনর্ভবম্‌।

কাময়ে দুঃখপ্তানাং প্রাণিনামার্তিনাশনম্‌ ॥

—আমি রাজ্য চাই না, স্বর্গ চাই না, মুক্তিও চাই না। আমার কাম্য শুধু এই যে, দুঃখী মানুষদের আর্তি যেন দূর হয়।

স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দজী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এর প্রথম সম্পাদক। প্রাণান্ত পরিশ্রম করে তিনি সেই পত্রিকা বের করতেন। ‘উদ্বোধনে’র জন্য তখন একটা ছোট ছাপাখানা ছিল। কিন্তু এত অর্থাভাব যে, বেতন দিয়ে কোন কর্মচারী নিয়োগ করার উপায় নেই। ত্রিগুণাতীতানন্দজী নিজেই ছাপাখানার সব কাজ করতেন। রাত জেগে কাজ করতেন। পাছে ঘুমিয়ে পড়েন, সেইজন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতেন। শ্রীশ্রীমাকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। একবার শ্রীশ্রীমা গরুরগাড়ি করে কোথাও যাচ্ছেন, তিনিও আছেন সঙ্গে। মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। জ্যোৎস্না রাত। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন রাস্তার উপরে বিরাট একটা গর্ত। গাড়ি যদি সেটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায় তাহলে গাড়িতে ঝাঁকুনি লাগবে, মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ গিয়ে সেই গর্তের উপরে শুয়ে পড়লেন আর গাড়োয়ানদের বললেন, তাঁর শরীরের উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে। ঠিক সেই সময়ই অবশ্য মা জেগে গেলেন। বললেন : করছ কি ? উঠে এস। তারপর হেঁটে মা ঐ জায়গাটুকু পার হলেন। স্বামীজী দেহত্যাগ করার আগে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, ত্রিগুণাতীতানন্দজীকে আমেরিকায় পাঠাবেন। সেই অনুযায়ী ত্রিগুণাতীতানন্দজী ১৯০৩ সালে আমেরিকা যান। সেখানে সানফ্রানসিসকোয় থেকে তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি সেখানে একটা হিন্দু-মন্দির গড়ে তুলেছিলেন। পাশ্চাত্যে সেটাই প্রথম হিন্দু-মন্দির। সেখানেই ত্রিগুণাতীতানন্দজীর শরীর যায় একটা আকস্মিক দুর্ঘটনায়। তাঁর এক ছাত্র উন্মাদ হয়ে গেছিল। নাম ভাবরা। তাঁকে লক্ষ্য করে সে বোমা ছোড়ে। সে তৎক্ষণাৎ মারা গেল আর ত্রিগুণাতীতানন্দজী সাংঘাতিকভাবে আহত হলেন। অসহ্য যন্ত্রণা। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সেই অবস্থাতেও তিনি ভাবরার খোঁজখবর নিচ্ছেন। কোন অভিযোগ নেই তার প্রতি। বলছেন : আহা ! নির্বোধ বেচারা ! প্রায় পনের দিন কষ্টভোগ করে তিনি শরীর রাখলেন। যেদিন দেহত্যাগ করলেন, সেদিন স্বামীজীর জন্মতিথি।

স্বামী অভেদানন্দ এবং স্বামী তুরীয়ানন্দও স্বামীজীর আহ্বানে বিদেশে বেদান্ত প্রচার করতে গেছিলেন। স্বামীজী যখন প্রথমবার পাশ্চাত্যে গিয়ে আছেন, তখনই স্বামী অভেদানন্দজীকে ডেকে পাঠান তাঁর কাজে সাহায্য করবার জন্য। ঠাকুরের সন্তানদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশী দিন বিদেশে প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন। খুব বড় বাগ্মী ও পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর লেখা অনেক বইও আছে। ঠাকুর তাঁর সম্বন্ধে বলতেন : নরেনের পরই ওর বুদ্ধি।

স্বামীজী যখন দ্বিতীয়বার বিদেশ যাবেন তার আগে তুরীয়ানন্দজীকে বলেছিলেন : হরিভাই, ঠাকুরের কাজের জন্য বুকের রক্ত বিন্দু বিন্দু দিয়ে আমি একেবারে মৃতপ্রায় হয়েছি। তোমরা কি আমার একাজে একটুও সাহায্য করবে না—কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে ? হরি মহারাজকে আগেও স্বামীজী বলেছিলেন বিদেশ যেতে। তখন তিনি রাজী হননি। কিন্তু স্বামীজীর এরকম কথার উপরে এবার আর ‘না’ বলতে পারলেন না। স্বামীজীর সঙ্গে তিনিও আমেরিকায় গেলেন। স্বামীজী এর আগে তাঁর ভক্তদের বলেছিলেন : আমি তোমাদের কাছে এতদিন বক্তৃতা করেছি, এখন এমন একজন গুরুভাইকে পাঠাব যাকে দেখে তোমরা বুঝবে সেগুলোকে কিভাবে জীবনে পরিণত করতে হয়। তুরীয়ানন্দজীকে বললেন : Lead the life. তুমি শুধু তোমার জীবন দেখাও। আমি পাশ্চাত্যজগৎকে ক্ষাত্রবীর্য দেখিয়েছি, বক্তৃতায় তাদের মুগ্ধ করেছি। তুমি তাদের ব্রাহ্মণের আদর্শ দেখাও। স্বামীজী দেশে ফিরে আসার পরও তিনি সেখানে থেকে গেলেন। সেখানে তিনি ‘শান্তি-আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করলেন সানফ্রানসিসকোর কাছে এক জায়গায়। যখন তিনি ধর্মপ্রসঙ্গ করতেন একেবারে অন্তর্মুখ হয়ে যেতেন, মাঝে মাঝে উচ্চারণ করতেন হরি ওঁ তৎ সৎ, শিব শিব। রাস্তা দিয়ে যখন যেতেন তখনও অনেক সময় ধর্মপ্রসঙ্গ করতে করতে এমন মেতে যেতেন যে, পারিপার্শ্বিক সবকিছু ভুলে যেতেন। পথচারীরা হয়তো তাঁর হাবভাব দেখে বা তাঁর কথা শুনে হাসছে, কিন্তু তাঁর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কয়েক বছর বিদেশে থেকে তিনি কাজ করলেন। তাঁর কাজ যখন বেশ জমে উঠেছে, তখন তাঁর স্বামীজীকে দেখবার খুব ইচ্ছে হল। ভারতবর্ষ রওনা হলেন তিনি। কিন্তু ফেরার পথে যখন তিনি রেঙ্গুনে, তখন স্বামীজীর দেহত্যাগের খবর পেলেন। তাঁর মন খুব ভেঙে গেল। ঠিক করলেন, আর বিদেশে যাবেন না। অবশিষ্ট জীবন তিনি সাধনভজন করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। অসুস্থ অবস্থায়ও দেখা যেত, তিনি প্রশান্ত আছেন। দেহবোধ নেই। তাঁর কার্বাঙ্কল হয়েছিল—সেই কার্বাঙ্কল অপারেশন করবার সময় তিনি শরীর থেকে মনটা তুলে নিতেন, ডাক্তার ক্লোরোফর্ম ছাড়াই অপারেশন করতেন। তিনি বসে থাকতেন—নির্বিকার, যেন অন্য কারও শরীরে অস্ত্রোপচার হচ্ছে।

বাস্তবিক, এঁদের সকলের জীবনই অদ্ভুত। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন বহুরূপে বিভক্ত হয়ে এঁদের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর ছাঁচে গড়া এঁদের জীবন। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বলেছিলেন : এঁদের মতো সন্ন্যাসী সারা পৃথিবীতে নেই। একথা বলেছিলেন এঁদেরই একজন স্বামী অদ্বৈতানন্দকে, যখন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণর কাছে সাধুসেবা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সত্যিই তাই। ত্যাগে, প্রেমে, সাধনায়, সিদ্ধিতে এঁরা সবাই অতুলনীয়। অলোকসামান্য পুরুষ এঁরা। এঁদের প্রত্যেকের জীবনই গভীর অনুধ্যানে, বারবার আলোচনা করবার। কিন্তু এখানে তাঁদের মধ্যে শুধু দুজনের সম্বন্ধে একটু বিশদভাবে আলোচনা করব। ঐ দুজনের একজন হচ্ছেন স্বামীজী—ঠাকুরের প্রধানতম যন্ত্র। অপরজন স্বামী ব্রহ্মানন্দ—ঠাকুর যাঁকে ‘মানসপুত্র’ বলতেন।

ঠাকুর তাঁর পার্ষদদের মধ্যে যে কজনকে ‘ঈশ্বরকোটি’ বা ‘নিত্যসিদ্ধ’ বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এঁরা দুজন ছাড়াও ঠাকুর ঈশ্বরকোটি বলেছেন আরও পাঁচজনকে। তাঁরা হলেন : স্বামী যোগানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী নিরঞ্জনানন্দ, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ এবং ভবনাথ। ঈশ্বরকোটি অর্থাৎ ঈশ্বরকল্প পুরুষ। অবতারের প্রায় সমান তাঁরা। এই নিত্যসিদ্ধ বা ঈশ্বরকোটি সম্বন্ধে ঠাকুর অনেক কথা ‘কথামৃতে’ বলেছেন। বলছেন : সাধারণ লোক হচ্ছে মাছি—ফুলে বসে আবার বিষ্ঠাতেও বসে। কিন্তু নিত্যসিদ্ধরা মৌমাছি—শুধু ফুলে বসে, মধু পান করে, অন্য কোথাও বসে না। নিত্যসিদ্ধ হরিরস পান করে, বিষয়রসের দিকে যায় না।(১-৫-২) সাধারণ সাধকদের সাধ্যসাধনা করে সিদ্ধ হতে হয়। তাদের আগে ফুল, তারপরে ফল। সাধারণ নিয়ম যেটা। কিন্তু নিত্যসিদ্ধরা সেই নিয়মের ব্যতিক্রম। তাদের আগে সিদ্ধি, তারপরে সাধনা। (তাঁদের) সাধন ভজন পরে। সাধনের আগে ঈশ্বরলাভ। যেমন লাউ কুমড়োর আগে ফল, তার পরে ফুল। (২-৮-২)।

নিত্যসিদ্ধরা জন্মাবধি ঈশ্বরকে চায়। সংসারের কোনকিছু তাঁদের ভাল লাগে না। ঠাকুর হোমাপাখীর সঙ্গে তাঁদের তুলনা করছেন। হোমাপাখী এক ধরনের কাল্পনিক পাখী। বলছেন : বেদে আছে, হোমাপাখীর কথা।(২-১৬-১) পারস্য দেশের উপকথাতেও এই হোমাপাখীর কথা পাওয়া যায়। এবং ইরানের যে বর্তমান বিমান সংস্থা তার নাম এই হোমাপাখীর নামে—Homa Airlines। ঠাকুর কি করে জানলেন এই পাখীর নাম, ভাবলে অবাক হতে হয়। বলছেন : হোমাপাখী খুব উঁচু আকাশে থাকে। ঐ আকাশেই ডিম পাড়ে। এত উঁচুতে থাকে যে ডিম অনেকদিন ধ’রে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে ডিম ফুটে যায়। তখন ছানাটি পড়তে থাকে। অনেকদিন ধ’রে পড়ে। পড়তে পড়তে চোখ ফুটে যায়। যখন মাটির কাছে এসে পড়ে, তখন তার চৈতন্য হয়। তখন বুঝতে পারে যে, মাটি গায়ে ঠেকলেই মৃত্যু। পাখী চিৎকার ক’রে মার দিকে চোঁচা দৌড়। মাটিতে মৃত্যু, মাটি দেখে ভয় হ’য়েছে ! এখন মাকে চায় ! মা সেই উঁচু আকাশে আছে। সেই দিকে চোঁচা দৌড় ! আর কোন দিকে দৃষ্টি নাই।* (ঐ) নিত্যসিদ্ধরা ঐ হোমাপাখীর মতো। সমস্ত মন তাঁদের ঈশ্বরের দিকে। শুকদেবের সম্বন্ধে যেমন শোনা যায়, এই সংসারের ভয়ে তিনি মাতৃগর্ভ থেকে বেরোতে চাইলেন না। বারো বৎসর মাতৃগর্ভে থাকলেন। তারপর যদিও বা মাতৃগর্ভ থেকে বেরোলেন, বেরিয়েই সোজা ছুটলেন অরণ্যের দিকে—না, সংসারে থাকব না, অনিত্য সংসার, মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পাছে এই অনিতাকেই নিত্য মনে করে বসি, সেই ভয়ে আমি পালাচ্ছি।

ঠাকুর বলছেন : নিত্যসিদ্ধ একটি থাক আলাদা। (১-৫-২) একটা স্বতন্ত্র গোত্রের মানুষ এঁরা। এরা কখনও সংসারে আসক্ত হয় না। যেমন প্রহ্লাদ। (ঐ) প্রহ্লাদ জন্ম থেকেই হরিভক্ত। অথচ তার বাবা হিরণ্যকশিপু হরির নাম শুনতে পারেন না। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে পাঠালেন ষণ্ড আর অমর্কের কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে। তাদেরকে বলে দিলেন, এ যেন আর কৃষ্ণের নাম না শোনে বা কৃষ্ণের কথা না বলে। কিন্তু প্রহ্লাদের এমনই অবস্থা যা কিছু পড়ে, কৃষ্ণের কথা মনে পড়ে যায়। বলছে :

অক্ষরে অক্ষরে শিশুর কৃষ্ণ পড়ে মনে।

উদ্দীপন হয় প্রেমধারা দুনয়নে ॥

হিরণ্যকশিপু তার উপর খুব চটে গেলেন। এই ছেলেকে মেরেই ফেলবেন তিনি। পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, হাতীর পায়ের নীচে ফেলে দিলেন, সাপ ছেড়ে দিলেন, আরও কতভাবে চেষ্টা করলেন—কিন্তু কিছুতেই প্রহ্লাদকে মারা গেল না। তখন হিরণ্যকশিপু তাকে জিজ্ঞেস করলেন ; তোকে বাঁচায় কে ? প্রহ্লাদ উত্তর দিল। আমার হরি আমাকে বাঁচান।—কোথায় তোর হরি ? —সর্বত্র তিনি বিরাজ করছেন। —এই যে স্তম্ভ, এর মধ্যেও হরি আছে ? —হ্যাঁ, এর মধ্যেও তিনি আছেন। এই শুনে হিরণ্যকশিপু পদাঘাত করলেন সেই স্তম্ভে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন এক নৃসিংহমূর্তি। সেই মৃর্তি হত্যা করল হিরণ্যকশিপুকে। ঠাকুর বলছেন : প্রহ্লাদ নিত্যসিদ্ধ। কেউ তাঁকে শিখিয়ে দেয়নি ! একটা প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর জন্ম। অথচ জন্ম থেকেই তাঁর সমস্ত মনটা ঈশ্বরের দিকে। অবতারের সঙ্গে যারা আসে, তারা নিত্যসিদ্ধ, কারু বা শেষ জন্ম। (২-১৬-১) নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল ; এরা সব নিত্যসিদ্ধ, ঈশ্বরকোটি। এদের শিক্ষা কেবল বাড়ার ভাগ। (১-৭-৬) অনেকের সাধ্যসাধনা ক’রে একটু ভক্তি হয়, এদের কিন্তু আজন্ম ঈশ্বরে ভালবাসা। যেন পাতাল ফোঁড়া শিব—বসানো শিব নয়। (১-৫-২)

এই প্রসঙ্গে পুরনো দিনের একটা কথা উল্লেখ করছি। আগে বেলুড় মঠে উৎসবে দেখা যেত, কোথা থেকে বাউলেরা সব আসত নানা ধরনের পোশাক পরে। তাদের ডাকতে হত না—তারা আসত, গাইত, চলে যেত। একবার ঐরকম এক বাউলের দল এসে একটা অদ্ভুত গান গেয়েছিল। গানের ভাবার্থটা হল এই : ঠাকুরের যাঁরা পার্ষদ—নরেন্দ্রনাথ, রাখাল, বাবুরাম প্রভৃতি—এঁরা প্রত্যেকেই এত বিরাট যে এঁরা যদি আলাদা আসতেন, এঁরাই অবতার হিসেবে পুজো পেতেন। একসাথে এসেছেন, তাই এঁদের বুঝতে পারা যাচ্ছে না। বাস্তবিক, এঁদের মতো লোক তো আমরা সচরাচর দেখি না। যুগ যুগ পরে এঁদের মতো মানুষ পৃথিবীতে আসেন। কাজেই এঁদের যদি কেউ অবতার বলে, তাহলে সেটা খুব অতিকথন হয় না। স্বামী বিবেকানন্দের মতো লোক যে-কোন দেশের যে-কোন সমাজের পক্ষে গৌরব। ঠাকুর যে বলছেন, নিত্যসিদ্ধদের আজন্ম ভক্তি—স্বামীজীরও দেখি তাই। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরে ভক্তি। বিশেষ করে ভালবাসেন শিবকে। শিব সন্ন্যাসী, তাই এই আকর্ষণ। দুরন্ত শিশু, একবার যদি কোন কারণে ক্ষেপে যায় তাকে শান্ত করা খুব কঠিন। কিন্তু কেউ যদি বলে ‘এরকম করলে শিব তোকে কৈলাসে যেতে দেবে না’—সঙ্গে সঙ্গে ‘বিলে’ (বিলে তাঁর ছেলেবেলার নাম) শান্ত। তিনি যে খেলাধুলা করছেন, তাতেও বৈশিষ্ট্য। ‘ধ্যান ধ্যান’ খেলছেন। অন্য সঙ্গীদের কাছে সেটা খেলা, কিন্তু তাঁর কাছে সত্যিই ধ্যান। ধ্যানে তন্ময় হয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাহ্যজ্ঞান চলে যাচ্ছে। একদিন একটা সাপ এসে হাজির। বিষাক্ত সাপ। সঙ্গীরা সব ভয়ে পালাল—কিন্তু বিলে ধ্যানস্থ, বাহ্যজ্ঞানশূন্য। সাপ এসে চলে গেল—বিলে জানতেও পারল না। স্বামীজীর যে ধ্যানের ছবি আমরা দেখি, তার ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি। স্বামীজী তখন বিদেশে। ফটো তুলতে নিয়ে গেছিলেন স্বামীজীকে তাঁর অনুরাগীরা। স্বামীজী ঐ ভঙ্গিতে বসেছেন—সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানস্থ। আজন্ম তিনি ধ্যানসিদ্ধ। ধ্যান তাঁর সহজাত। শুধু ধ্যানই নয়, তাঁর মধ্যে যে গুণগুলি আমরা পরবর্তী জীবনে দেখে মুগ্ধ হয়েছি, সে সবই তাঁর সহজাত। সেই শৈশবেই দেখছি তাঁর হৃদয়বত্তা। বাড়িতে ভিখারি এসেছে, বিলে যা পাচ্ছে, সব দিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির ওপরতলায় আটকে রাখা হল একটা ঘরে—তাতেও নিস্তার নেই। জানলার ফাঁক দিয়ে মায়ের যত শাড়ী-কাপড় আছে রাস্তায় ভিখারিকে দিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলে যখন পড়ছেন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি কি ভালবাসা। আবার সেইসময় থেকেই তিনি নেতা। নেতৃত্বে তাঁর জন্মগত অধিকার। বন্ধু-বান্ধবরা তাঁর কথা শুনছে। তিনি যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাই মেনে নিচ্ছে। যেমন প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তেমনি সাহস। একটি ছেলে ঘোড়ার গাড়ির তলায় চাপা পড়েছে, প্রায়, সবাই বলছে ‘গেল গেল’, কিন্তু কেউ এগোচ্ছে না। বিলে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, স্কুলের ছাত্র,—হৈচৈ শুনেই ছুটে গেল, নিজের জীবন বিপন্ন করে ছেলেটিকে বাঁচাল। পাড়ায় একটা গাছের ডালে উঠে বিলে তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দোল খেত। একজন বৃদ্ধ প্রতিবেশী ভাবলেন, এরা কোন-না-কোন দিন ঠিক গাছ থেকে পড়ে ঘাড় ভাঙবে। বারণ করলে তো শুনবে না, তাই ভয় দেখিয়ে বললেন : ওরে, তোরা ঐ গাছে চড়ছিস, জানিস না তো ঐ গাছে একটা ব্রহ্মদৈত্য আছে, তোদের ঘাড় মটকে দেবে ! ব্যস্‌, পরদিন থেকে গাছ ফাঁকা— আর কেউ গাছে চড়েনি। বিলে কিন্তু ঠিক গাছে উঠে দোল খাচ্ছে। সঙ্গীদের একজন এসে বলছে : বিলে, তুমি আবার গাছে উঠেছ ? ব্রহ্মদৈত্য তোমার ঘাড় মটকে দেবে না ? বিলে উত্তর দিচ্ছে : দূর বোকা, আমরা কতবার গাছে চড়েছি, ব্রহ্মদৈত্য যদি গাছে থাকতই বুড়ো বলবার আগেই আমাদের ঘাড় মটকে দিত। বন্ধুবান্ধব মিলে নৌকোয় বেড়াচ্ছেন—এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে বমি করে ফেলেছে নৌকোয়। এই নিয়ে মাঝিদের সঙ্গে ঝগড়া। মাঝিরা কিছুতেই নৌকো পরিষ্কার করবে না, পয়সা দিলেও না। বলছে : তোমরা যদি পরিষ্কার না করে দিয়ে যাও তাহলে নৌকো ঘাটে ভিড়োব না। বিলে এদের মধ্যে বয়সে ছোট। সে এইসব ঝগড়াঝাঁটি শুনছে আর ভাবছে কি করা যায়। নৌকো তীরের অনেকটা কাছাকাছি এসেছে, কোন্‌ ফাঁকে সে নৌকো থেকে লাফ দিয়ে তীরে গিয়ে উঠেছে। তীরে সে দেখেছে কয়েকজন ইংরেজ সৈন্য বেড়াচ্ছে। ছুটে গিয়ে তাদের ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। ইংরেজ সৈন্যরা আসতেই মাঝিরা ভয় পেয়ে ছেলেদের ছেড়ে দিয়েছে। এইরকম উপস্থিত বুদ্ধি ছোটবেলা থেকে। আবার দেখছি, যাচাই না করে কোন কিছু মেনে নেন না। বাবা ওকালতি করেন—বিভিন্ন জাতের মক্কেলরা আসে তাঁর কাছে। তাঁদের একেক জনের জন্য একেকটা হুঁকো। বিলে শুনেছে, এক জাতের লোক যদি আর এক জাতের লোকের হুঁকো খায়, তাহলে নাকি জাত যায়। জাত যাওয়া ব্যাপারটা কি ? কি করে জাত যায় ? এটা তাঁর প্রশ্ন। একদিন যখন কেউ কোথাও নেই, তখন চুপি চুপি গিয়ে বিলে সব হুঁকোগুলো টেনে চলেছে আর দেখছে, জাত কি করে যায়। এমন সময় বাবা এসে উপস্থিত, জিজ্ঞেস করলেন : কি করছিস্‌ রে বিলে ? বিলে উত্তর দিচ্ছে : জাত কি করে যায় দেখছি।

আমরা দেখছি, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন। দেখামাত্র বুঝতে পারছেন এই হবে তাঁর প্রধান লীলাসহচর। প্রথম দর্শন সুরে মিত্রের বাড়িতে। নরেন্দ্রনাথ সেদিন কয়েকটা গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তাঁকে। দ্বিতীয় দর্শন দক্ষিণেশ্বরে। সেদিন দেখা হতেই শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন ; এত দেরি করে আসতে হয় ? আমি তোমার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। আবার বলছেন : আমি জানি, তুমিই সেই ঋষি, নররূপী নারায়ণ। নরেন্দ্রনাথ তো ধরে নিলেন : এ নির্ঘাত পাগল। আমি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে—আর আমাকে বলছে নররূপী নারায়ণ ! কিন্তু আবার দেখলেন, যখন অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আর কঠিন কঠিন সব আধ্যাত্মিক তত্ত্ব অত্যন্ত সহজভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। নরেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন : আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন ? শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন : হ্যাঁ, দেখেছি, তোমাকে যেমন দেখছি, তার চেয়েও আরও স্পষ্টভাবে। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন নরেন্দ্রনাথ। এ প্রশ্ন তিনি আগে আরও অনেকের কাছে করেছেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেও করেছিলেন—কেউ এমন স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি। খুব সমস্যায় পড়ে গেলেন তিনি। এই লোকটি তো ভারী অদ্ভুত ! একে পাগল বলে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। কারণ, এঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ অদ্ভুত পবিত্র, শিশুর মতো সরল ; অথচ কিছুক্ষণ আগেই তাঁর সামনে হাতজোড় করে যেসব কথা বলেছেন, তাতে এঁকে সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থও বলা যায় না। নরেন্দ্রনাথ তখন সিদ্ধান্ত করলেন যে, লোকটি mono maniac—অর্ধোন্মাদ। তাহলেও লোকটি ভাল এবং অন্যের থেকে আলাদা।

এদিকে শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু নরেনের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই তার জন্য পাগল। সবসময় ‘নরেন নরেন’ করছেন। একদিন বাবুরাম মহারাজ রাত্রে দক্ষিণেশ্বরে রয়েছেন। ঠাকুরের ঘরেই রয়েছেন। তখনও তিনি জানেন না নরেন্দ্র কে। দেখছেন যে, সারারাত ঠাকুর ‘নরেন নরেন’ করছেন আর নরেনের জন্য কাঁদছেন। বলছেন : নরেনের জন্য বুকের ভিতরটায় গামছা নিঙড়ানোর মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। বাবুরাম মহারাজ ভাবছেন; এই নরেন লোকটি তো ভারী নিষ্ঠুর ! এত ভালবাসেন ইনি আর এঁকে এত কষ্ট দিচ্ছে ? নরেন্দ্র মাঝে মাঝে এইজন্য তিরস্কারও করতেন তাঁকে। বলতেন : হরিণের কথা ভেবে ভরত রাজা যেমন হরিণ হয়েছিলেন, আপনারও সেইরকম অবস্থা হবে। কেন আপনি আমার জন্য এত ভাবেন ? হাজরামশাইও তাঁকে খোঁটা দিতেন। এসব শুনে ঠাকুরের মাঝে মাঝে আবার ভাবনা হত। বলছেন : (একদিন) গাড়ি ক’রে বলরামের বাড়ি যাচ্ছি এমন সময় পথে মহা ভাবনা হলো। বললুম, ‘মা, হাজরা বলে, নরেন্দ্র আর সব ছোকরাদের জন্য আমি অত ভাবি কেন ; সে বলে, ঈশ্বরচিন্তা ছেড়ে এ সব ছোকরাদের জন্য চিন্তা করছ কেন ? এই কথা বলতে বলতে একেবারে দেখালে যে তিনিই মানুষ হ’য়েছেন। শুদ্ধ আধারে স্পষ্ট প্রকাশ হন। (২-৬-১) মা দেখিয়ে দিলেন যে, এঁদের ভিতরে ঈশ্বরের প্রকাশ দেখছ তুমি, তাই এঁদের এত ভালবাস। ঈশ্বর সর্বত্রই আছেন, কিন্তু শুদ্ধ আধারে তাঁর বেশী প্রকাশ। নরেন্দ্র, রাখাল, বাবুরাম, তারক এইসব যুবক-ভক্তদের জন্য ঠাকুর ব্যাকুল কেন ? কারণ, এঁদের মধ্যে ঈশ্বরের বেশী প্রকাশ, এঁরা শুদ্ধসত্ত্ব। এঁদের এক একজনকে পাওয়ার জন্য তিনি পাগল। ঐ যে লাটু সে তো গরীবের ছেলে—লেখাপড়া শেখেনি, বিহার থেকে এসেছে, চাকরি করতে এসেছে। রাম দত্তের গৃহভৃত্য। সেখানেই থাকত। মাঝে মাঝে দু-একটি জিনিস নিয়ে ঠাকুরের কাছে আসত। ঠাকুর দেখেই চিনেছেন : শুদ্ধ আধার। বলছেন : ওকে দেবে আমার কাছে ? রেখে দিলেন তাঁকে নিজের কাছে। নরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলতেন : সাক্ষাৎ অগ্নিস্বরূপ। ওর মধ্যে জ্ঞানের অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে। মায়া ওর ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না। যা খাবে তাই ও হজম করে ফেলবে। ও আর সবার থেকে স্বতন্ত্র। অন্যদের জন্য কত বাছবিচার করছেন—কিন্তু নরেন্দ্রের ক্ষেত্রে অনেক সময় সেসবের ব্যতিক্রম করছেন। কারণ, সে সবচেয়ে বড় আধার। অন্যরা সবাই বড়—কিন্তু তাঁর মতো নয় !

ঠাকুর বলছেন : মা যখন আমাকে দেখিয়ে দিলেন যে এরা সব শুদ্ধ আধার, তাই আমি এদের জন্য ব্যাকুল হই, তখন হাজরার উপর রাগ কর্তে লাগলুম। বললুম, শালা আমার মন খারাপ ক’রে দিছ্‌লো। আবার ভাবলুম, সে বেচারীরই বা দোষ কি, সে জানবে কেমন করে ? (ঐ) তারপর বলছেন : আমি এদের জানি, সাক্ষাৎ নারায়ণ। নরেন্দ্রের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। দেখলুম, দেহবুদ্ধি নাই। (ঐ) অবাক হয়ে গেছিলেন নরেন্দ্রকে দেখে। ভাবছেন : কলকাতায় তো সব বিষয়ী লোকের বাস। সেখানে এত বড় সত্ত্বগুণী আধার থাকা সম্ভব ? একটু বুকে হাত দিতেই বাহ্যশূন্য হয়ে গেল। হুঁশ হ’লে বলে উঠলো, ‘ওগো, তুমি আমার কি করলে ? আমার যে মা-বাপ আছে !’ (ঐ) স্বামীজী যখন দ্বিতীয়বার দক্ষিণেশ্বরে যান, তখনকার ঘটনা এটা। গিয়ে দেখেন যে, ঠাকুর তাঁর ঘরে খাটে বসে আছেন। তাঁকেও খাটে বসিয়েছেন। কথাবার্তা বলছেন। এমন সময় ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে একটু একটু করে এগিয়ে আসছেন তাঁর দিকে আর বিড়বিড় করে কি বলছেন। কাছে এসে হঠাৎ তাঁর বুকে পাটা তুলে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ দেখলেন ; ঘরবাড়ি সব কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে উঠলেন : এ কি করছ তুমি ? আমার যে বাবা-মা আছে। তখন ঠাকুর আবার বুকে হাত দিয়ে বললেন : থাক, এখনই দরকার নেই, ধীরে ধীরে হবে। বলছেন : যদু মল্লিকের বাড়িতেও ঠিক ঐ রকম হয়েছিল। (ঐ) সেদিন ঠাকুর স্পর্শ করা মাত্র নরেন্দ্রনাথ বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আর সেইসময় ঠাকুর তাঁকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিলেন, তিনি কে, কোথা থেকে এসেছেন, কি উদ্দেশ্যে এসেছেন, ইত্যাদি। নরেন্দ্র সম্বন্ধে তার আগেও কিছু কিছু দর্শন হয়েছিল ঠাকুরেব—এদিন তিনি সেগুলো মিলিয়ে নিয়েছিলেন। এসেছিলেন তো তাঁর জন্যই ! বলছেন : অদ্বৈতের হুঙ্কারে নাকি চৈতন্যদেব মর্তে এসেছিলেন। তেমনি, এবারও নরেনের জন্যই সব। নরেনের জনাই তিনি এসেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলছেন ; সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষি। নরেন আসবার আগেই একদিন তিনি দেখেছিলেন যে, কোথায় যেন চলে গেছেন। বলছেন : সেটা ‘অখণ্ডের ঘর’। অর্থাৎ অদ্বয় ব্রহ্মের এলাকা, নিগুন নিরাকার ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন যেসব ঋষি, তাঁদের এলাকা। ঠাকুর বলছেন : সেখানে গিয়ে দেখলাম ঋষিরা সব সমাধিস্থ হয়ে বসে আছেন, আর এক দেবশিশু গিয়ে এক ঋষির গলা জড়িয়ে বলছেন : আমি যাচ্ছি, তোমাকেও যেতে হবে। সেই ঋষি চোখ খুললেন, কথা বললেন না কিছু, কিন্তু বোঝা গেল যে, সম্মতি জানালেন। সেই ঋষিই হচ্ছেন স্বামীজী। আর ঠাকুর স্বয়ং হচ্ছেন ঐ দেবশিশু। জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক তাঁদের। কত যুগে যুগে তাঁরা এসেছেন। সেইজন্য দেখামাত্র চিনতে পেরেছেন। প্রথম সাক্ষাৎ থেকেই ভালবাসা। আপনার জন। তাঁকে ছাড়া থাকবেন কি করে ? বলছেন ; ক্রমে তাকে দেখবার জন্য ব্যাকুলতা বাড়তে লাগলো, প্রাণ আটু-পাটু করতে লাগলো। তখন ভোলানাথকে বললুম, হ্যাঁগা, আমার মন এমন হচ্ছে কেন ? নরেন্দ্র ব’লে একটি কায়েতের ছেলে, তার জন্য এমন হচ্ছে কেন ? (ঐ) ভোলানাথ হচ্ছেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মুহুরী, পরে তিনি খাজাঞ্চী হয়েছিলেন। ভোলানাথ বললে, এর মানে ভারতে আছে। (‘ভারতে’ অর্থাৎ ‘মহাভারতে’।) সমাধিস্থ লোকের মন যখন নীচে আসে, সত্ত্বগুণী লোকের সঙ্গে বিলাস করে। সত্ত্বগুণী লোক দেখলে তবে তার মন ঠাণ্ডা হয়। এই কথা শুনে তবে আমার মনের শান্তি হলো। মাঝে মাঝে নরেন্দ্রকে দেখবো ব’লে ব’সে ব’সে কাঁদতুম। (ঐ) এত আকর্ষণ নরেনের প্রতি !

শাস্ত্রে বলে সমাধি হয়ে গেলে মানুষের আর একুশ দিন কোন রকমে শরীরটা থাকবে। কারণ, শরীরটা থাকে কোন একটা বাসনা থাকলে। সমাধিমান পুরুষের কোন বাসনা নেই। তাই সমাধির একুশ দিন পরে শরীরটা নষ্ট হয়ে যায় তাঁদের। কিন্তু অবতারপুরুষ বা অবতারকল্প পুরুষ যাঁরা, তাঁরা সমাধির পরেও লোককল্যাণের বাসনা রেখে দেন। সেই বাসনাটা নিয়ে তাঁরা শরীরধারণ করে থাকেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের মতোই চলেন ফেরেন, কিন্তু ‘সাধারণ’ নন তাঁরা। আমাদের মাপকাঠিতে যদি আমরা তাঁদের বিচার করতে চাই, তাহলে ভুল করব। নিয়ম কাদের জন্যে ? সাধারণ মানুষের জন্যে। কিন্তু সমাধিস্থ পুরুষ বা ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ সব নিয়মের ঊর্ধ্বে। কুলার্ণবতন্ত্রে বলছে : ‘পরব্রহ্মণি বিজ্ঞাতে সমস্তৈর্নিয়মৈরলম্‌’— যে পরব্রহ্মকে লাভ করেছে, তার জন্য কোন নিয়ম নেই। ‘তালবৃন্তেন কিং কার্যং লব্ধে মলয়মারুতে’— যখন মলয়-বায়ু বয়ে যাচ্ছে তখন আর তালপাতার কি দরকার ? যখন মানুষ পরমার্থলাভ করেছে, তখন তার আর বেতালে পা পড়ে না। সে যা কিছু করে, তাই ছন্দ, তাই সুন্দর, তাতেই লোকের কল্যাণ হয়। ভুল করেও এরা লোকের ক্ষতি করতে পারে না। কুলার্ণবতন্ত্রেই আছে : ‘যোগী লোকোপারায় ভোগান্‌ ভ‌ুঙ্‌ক্তে ন কাঙ্ক্ষয়া । অনুগৃহ্নন্‌ জনান্ সর্বান্ ক্রীড়েচ্চ পৃথিবীতলে’—তাঁরা যা কিছু করছেন, লোককল্যাণের জন্য করছেন। এছাড়া তাঁদের মনে আর কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ এই যে নরেন্দ্রের জন্য এত আকুলিবিকুলি করছেন—তার কারণ হল নরেন্দ্র ভাল আধার। হয়তো নরেন্দ্রনাথও জানতেন না, বাড়ির লোকও জানতেন না—কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ একদৃষ্টে দেখেই তা বুঝেছিলেন। সেইজন্যে চেয়েছিলেন, তৈরী হোক সে—মহৎ কাজ করবে। নরেন্দ্রনাথের জীবন শুধু একটা পরিবারের জন্য নয়, শুধু একটা দেশের জন্যও নয়—সমস্ত জগতের জন্য। তাই তাঁর জন্য ব্যস্ত। তাঁকে তোষামোদ করছেন, এও আমরা বলতে পারি। ভাল আধার, পাছে নষ্ট হয়ে যায় তাই অনেক সময় তোষামুদি করেও তাঁকে ডেকে নিয়ে আসছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে দুর্বলতা। কোথাকার একটা ছেলে, তার জন্য কেন চিন্তা করছেন অত ? ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে ডুবে থাকুন না ! ঈশ্বরচিন্তা নিয়েই তো ছিলেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় এসেছিলেন লোককল্যাণের জন্য। মা দেখিয়ে দিয়েছেন এই নরেন্দ্রনাথ তাঁর প্রধান যন্ত্র হবে। এঁকে সামনে রেখে, এঁর ভিতর দিয়ে তাঁর নরলীলা সার্থক হয়ে উঠবে, তাই এত ব্যাকুল হচ্ছেন নরেন্দ্রনাথের জন্য। কুলার্ণবতন্ত্রে বলছে : ‘যত্র যত্র গজো যাতি তত্র মার্গো যথা ভবেৎ। কুলযোগী চরেৎ যত্র স সন্মার্গঃ’—তন্ত্রমতে যাঁরা সিদ্ধ হয়েছেন তাঁরা কুলযোগী। হাতি যেমন যে-পথ দিয়ে যাচ্ছে সেটাই পথ—পথ করে নিয়ে যায় সে, আগের থেকেই কোন পথ তৈরী না থাকলেও তার চলে, তেমনি সিদ্ধপুরুষ যে-পথ দিয়ে যাবেন, সেইটিই হবে পথ। তাঁরা সাধারণের পথ অনুসরণ করবেন না ; সাধারণ মানুষই তাঁদের পথ অনুসরণ করে চলবে। শ্ৰীরামকৃষ্ণের এই ব্যবহার—এই যে নরেন বা অন্যান্য যুবক-ভক্তদের জন্য ব্যাকুলতা—হাজারামশাই বা অন্য কেউ কেউও হয়তো এর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর সমালোচনা করার অধিকার তাঁদের নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মানুষ যা কিছু করেন, তার পিছনেই একটা মহৎ উদ্দেশ্য থাকে।

আমরা দেখি, প্রথম থেকেই ঠাকুর নরেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলছেন : আমার নরেনের ভিতর একটুও মেকি নেই। সহস্রদল পদ্ম নরেন। খাপখোলা তলোয়ার। যা সামনে পড়ে কচ্‌কচ্‌ করে কেটে দেয়। নরেন্দ্র কাহাকেও কেয়ার করে না। আমার সঙ্গে কাপ্তেনের গাড়ীতে যাচ্ছিল—কাপ্তেন ভাল জায়গায় ব’সতে বললে—তা চেয়েও দেখলে না।(১-৭-৬) যে-কোন এক জায়গায় বসলেই হল, এই ভাব। আমারই অপেক্ষা রাখে না! (ঐ) আমাকেও গ্রাহ্য করে না নরেন্দ্র। খুব গর্বের সাথে একথা বলছেন ঠাকুর। এই গর্ব সাধারণ সংসারী পিতাও অনুভব করেন যখন দেখেন যে, ছেলে সপ্রতিভ হচ্ছে, তার ব্যক্তিত্ব জেগে উঠছে। আবার যা জানে, তাও বলে না—পাছে আমি লোকের কাছে বলে বেড়াই যে, নরেন্দ্র এত বিদ্বান। (ঐ) ঠাকুরের আবার এটা খুব ছিল—সর্বত্র নরেনের প্রশংসা করে বেড়াতেন। একদিন নরেনের সামনেই বলে বসলেন: যে-শক্তির জোরে কেশব সেন বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন, ঐরকম আঠারোটা শক্তি নরেনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। নরেন্দ্রনাথ তো শুনেই খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন : কি বলছেন আপনি ? এসব শুনে লোকে বলবে আপনি নির্ঘাত উন্মাদ। কোথায় জগদ্বিখ্যাত কেশব সেন আর কোথায় আমার মতো একজন স্কুলের ছোঁড়া।

ঠকুর বলছেন : কি করব ? মা আমাকে দেখিয়ে দিলেন যে। মা তো আমাকে সত্যি ছাড়া মিথ্যে দেখান না। মা যে মিথ্যে দেখাননি, ভবিষ্যতে আমরা অবশ্য তার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু সেইসময়েই ঠাকুর কি করে একথা বললেন, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। কারণ, নরেন্দ্রনাথকে তখন আর কজন চেনে ? একজন বুদ্ধিমান যুবক, সপ্রতিভ যুবক—এই পর্যন্ত তাঁর পরিচয়। আর তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা আসতেন, তাঁরা সবাই-ই যে তাঁকে প্রশংসা করতেন তাও নয়। তাঁর পাড়া-প্রতিবেশী অন্য অনেকে বরং তাঁকে ভুলই বুঝত। বলত যে, ডেঁপো ছেলে। বি এ পাস করেছে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। শরৎ মহারাজ, তাঁর গুরুভাই, তিনি যখন প্রথম দেখেছিলেন নরেন্দ্রকে, তখন তিনিও ভুল বুঝেছিলেন। তখনও তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে আসেননি—নরেন্দ্রকে তিনি জানেন না। একদিন গেছেন এক বন্ধুর বাড়িতে। সেই বন্ধুর আবার খুব সুনাম নেই। সবার মুখে শুনেছেন যে, তাঁর বন্ধু বখে গেছেন। সেটা সত্যি কি মিথ্যা যাচাই করবার জন্যই তিনি সেদিন বন্ধুর বাড়িতে গেছেন। গিয়ে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছেন। ভেতরে খবর পাঠিয়েছেন, কিন্তু বন্ধুর দেখা নেই। এমন সময় দেখলেন, তাঁরই সমবয়স্ক এক যুবক সেখানে ঢুকলেন। তাঁর চুল, পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ পরিপাটী। ঘরের মধ্যে ঢুকেই তিনি একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। আর গুন্‌গুন্‌ করে একটা হিন্দী গান গাইতে লাগলেন। শরৎ মহারাজের দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, এই বাড়িতে তাঁর খুব যাতায়াত আছে। শরৎ মহারাজ মনে মনে ভাবছেন : বুঝেছি, এঁর মতো লোকের সাথে মিশেই আমার বন্ধু খারাপ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সেই বন্ধু ভিতর থেকে এসেছেন। সেই বন্ধুও তাঁর সাথে দু-একটা কথা বলেই সেই যুবকটির সাথে আলোচনায় মেতে গেলেন। তাঁর দিকে আর ফিরেও তাকালেন না। শরৎ মহারাজ আর কি করেন ? বসে বসে কিছুক্ষণ দুজনের আলোচনা শুনলেন, তারপর চলে এলেন। এর কিছু পরে শরৎ মহারাজ যখন দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেছেন, ঠাকুরের কাছে প্রায়ই নরেন্দ্রের প্রশংসা শোনেন। তখনও চেনেন না তাঁকে। একদিন গিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁর বাড়িতে। গিয়ে তো একেবারে অবাক। সেই বন্ধুর বাড়িতে সেদিন যাঁকে দেখেছিলেন, তিনিই নরেন্দ্রনাথ :

শরৎ মহারাজ লীলাপ্রসঙ্গে বলছেন যে, নরেন্দ্রের মধ্যে এমন কিছু কিছু অসাধারণত্ব ছিল যার জন্য লোকে তাঁকে এরকম ভুল বুঝত। ‘অন্তর্দৃষ্টিশূন্য জনসাধারণ শ্ৰীযুত নরেন্দ্রের অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসকে দম্ভ বলিয়া, অসীম তেজস্বিতাকে ঔদ্ধত্য বলিয়া এবং কঠোর সত্যপ্রিয়তাকে মিথ্যা ভান অথবা অপরিণত বুদ্ধির নিদর্শন বলিয়া ধারণা করিয়াছিল। লোকপ্রশংসালাভে তাঁহার একান্ত উদাসীনতা, স্পষ্টবাদিতা, সর্ববিষয়ে নিঃসঙ্কোচ স্বাধীন ব্যবহার এবং সর্বোপরি কোন কার্য কাহারও ভয়ে গোপন না করা হইতেই তাহারা যে ঐরূপ মীমাংসায় উপনীত হইয়াছিল, একথা নিঃসন্দেহ। অথচ ঠাকুরকে কিন্তু আমরা দেখছি, কখনও তিনি নরেন্দ্র সম্বন্ধে কোন ভুল ধারণা করেননি। একটা সময় হয়েছিল, যখন সবাই নরেন্দ্রনাথকে ভুল বুঝেছিল। এমনকি যাঁরা তাঁকে ভালবাসেন, তাঁরাও। কিন্তু ঠাকুর তখনও নরেন্দ্রনাথকে ভুল বোঝেননি। ভবনাথ কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে তাঁর কাছে বলেছিলেন : নরেনের যে এমন হবে, একথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। ঠাকুর খুব রেগে গেছিলেন একথা শুনে, বলেছিলেন : চুপ কর, মা আমাকে বলেছে, নরেন কখনও ওরকম হতে পারে না। আর কখনও এসব বললে তোদের মুখ পর্যন্ত দেখব না।—এত আস্থা তাঁর নরেনের উপর। নরেন্দ্রনাথ সেইজন্য পরে বলতেন : একমাত্র ঠাকুরই আমাকে প্রথম দেখার পর থেকে সব সময় সমানভাবে বিশ্বাস করে এসেছেন, আর কেউই না—এমনকি নিজের মা-ভাইরাও নয়। তাঁর এই বিশ্বাস-ভালবাসাই আমাকে চিরকালের মতো বেঁধে ফেলেছে। ঠাকুর বলছেন : (নরেন্দ্রের) মায়ামোহ নাই।—যেন কোন বন্ধন নাই !⋯একাধারে অনেক গুণ ; গাইতে, বাজাতে, লিখতে, পড়তে ! এদিকে জিতেন্দ্রিয়,—ব’লেছে বিয়ে কোরবো না। (ঐ) সবদিকেই সে অনন্য। নরেন্দ্র বেশী আসে না। সে ভাল। বেশী এলে আমি বিহ্বল হই। (ঐ) এত ভালবাসা নরেন্দ্রের প্রতি যে, নরেন্দ্র এলে কি করবেন ঠিক করে উঠতে পারতেন না। একঘর লোক বসে আছে—নরেন্দ্রের দিকে চেয়ে সব কথা বলতেন। অনেক সময় নরেন্দ্রকে দেখামাত্রই সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন। এ ভালবাসা তো মায়িক ভালবাসা নয়। নরেন্দ্রের ভেতর-বার দেখতে পাচ্ছেন তিনি। দেখছেন, বিরাট আধার, শুদ্ধ আধার। মায়ার আবরণ একটুও নেই। তাই দেখে তাঁর উদ্দীপন হচ্ছে—সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন। এত ভালবাসা নরেনের প্রতি, অথচ নিষ্ঠুরও হয়েছেন তাঁর প্রতি, তাঁকে পরীক্ষা করতে ছাড়েননি। আমরা জানি, নরেন্দ্রনাথই শ্রীরামকৃষ্ণকে বাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর বিছানার নীচে টাকা রেখে। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণও নরেন্দ্রনাথকে বাজিয়ে নিতে ছাড়েননি। একবার তিনি কথা বলা বন্ধ করে দিলেন নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। অন্যদের সাথে কথা বলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বলেন না। নরেন্দ্রনাথ আসেন, চুপ করে বসে থাকেন, চলে যান। প্রায় একমাস এরকম চলল। শেষে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : আচ্ছা, আমি তো তোর সাথে কথা বলি না, তবুও তুই আমার কাছে আসিস কেন ? নরেন্দ্রনাথ উত্তর দিচ্ছেন : আমি কি আপনার কথা শুনতে আসি ? আপনাকে ভালবাসি, তাই আসি। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : আমি তোকে ‘বিড়ে’ করছিলাম (অর্থাৎ পরীক্ষা করছিলাম)। তোর মতো আধারই এতটা সহ্য করতে পারে। অন্য কেউ হলে কবে দূরে সরে যেত। নরেন্দ্রনাথের মনোভাব হচ্ছে : আপনাকে ভালবাসি বলে আপনার কাছে আসি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনার সব কথা মেনে নেব।

বস্তুত, নরেন্দ্রের এই যে যাচাই করবার প্রবণতা এ কিন্তু সবচেয়ে বেশী খুশি করত শ্রীরামকৃষ্ণকেই। ঐ যে বলছেন, নরেন ‘আমারই অপেক্ষা রাখে না’—এর মধ্যে একটা সুপ্ত প্রশ্রয় রয়েছে। তিনি চাচ্ছেন না, তিনি যা বলবেন নরেন বিনা প্রতিরোধে তা মেনে নেবে। কারণ, তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন, নরেনকে লোকশিক্ষা দিতে হবে। সে তাঁর চিহ্নিত যন্ত্র। একদিন সমস্ত পৃথিবী তার কথা শুনবে। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী, ভারতবর্ষের শাশ্বত বাণী, নরেন্দ্রনাথই পোঁছে দেবে সকলের কাছে। বর্তমান যুগের মানুষ যুক্তিবাদী মানুষ। যুক্তির উপর যা প্রতিষ্ঠিত নয়, তাকে এযুগের মানুষ মানতে চায় না। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, নরেন্দ্রনাথকে তাদের কাছে ধর্মপ্রচার করতে হবে। সেইজন্য চাইছেন নরেন্দ্রনাথ নিজেও যুক্তির পথ ধরেই অগ্রসর হোক। ধর্মের মধ্যে অযৌক্তিক কিছু নেই। এমন কেউ যেন না ভাবেন যে, যিনি যুক্তিবাদী তাঁর জন্য ধর্ম নয়। হয়তো সেই যুক্তি বস্তুবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে-যুক্তি খাটে, তার থেকে আলাদা। কিন্তু যিনি যুক্তি পছন্দ করেন, তাঁর জন্যও ধর্ম। যুক্তির পথ ধরে তিনি ধর্মপথে এগিয়ে যেতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে সেইভাবে গড়ে তুলছেন। তাকে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন : নরেন্দ্রনাথ তর্ক করুক। আমাদের শাস্ত্রে বলছে : পরিপ্রশ্নেন। বারবার প্রশ্ন কর, বারবার প্রশ্ন করে তত্ত্ববস্তু সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা করে নাও। নরেন্দ্রনাথ তাই করছেন। তিনি হয়তো গিরিশ ঘোষ, ডাক্তার সরকার বা অন্য কারও সাথে তর্ক করছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তা উপভোগ করছেন। কারণ, তিনি দেখছেন নরেন্দ্রনাথ প্রকৃত জিজ্ঞাসু। শুধু তর্ক করার জন্য সে তর্ক করছে না। অনেক সময় নিজেই নরেন্দ্রনাথের সাথে অন্যের তর্ক বাধিয়ে দিচ্ছেন। তারপর তর্ক যখন চরমে উঠেছে বা শুষ্ক তর্কে পর্যবসিত হতে চলেছে, তখন নিজেই সিদ্ধান্তটা বলে দিচ্ছেন। অদ্ভুত তাঁর শিক্ষাপ্রণালী ! সেই শিক্ষকই সবচেয়ে বড় শিক্ষক যিনি ছাত্রকে বুঝতে দেন না যে শেখাচ্ছেন। ছাত্রের স্বাধীন বিচারের পথে যে বাধাগুলি আছে সেগুলি যাতে দূর হয়ে যায়, তিনি শুধু সেই চেষ্টাই করেন। আজকাল দুটো কথা শোনা যায় : ‘impose’ আর ‘expose’। ‘impose’ করা অর্থাৎ চাপিয়ে দেওয়া। আজকালকার চিন্তাবিদ্‌রা বলেন : একটা চিন্তাকে জোর করে কখনও কারও উপর চাপিয়ে দিতে নেই, তাতে ভাল ফল হয় না। তার চেয়ে সেই চিন্তাটাকে তার সামনে ‘expose’ করে দাও। অর্থাৎ চিন্তাটাকে তার সামনে তুলে ধরে তুমি সরে দাঁড়াও। এবার সে তার স্বাধীন বুদ্ধি ব্যবহার করুক, সেই চিন্তাটাকে ওজন করে দেখুক। যদি সেই চিন্তার মধ্যে গ্রহণযোগ্য কিছু থাকে, তাহলে তা সে গ্রহণ করবে। এইভাবে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, সেটাই ঠিক ঠিক স্থায়ী হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ সেইভাবে শিক্ষা দিতেন। আদর্শ শিক্ষক তিনি। জোর করে কারও উপর তিনি কিছু চাপিয়ে দিতেন না। নরেন্দ্রনাথ প্রথম প্রথম অদ্বৈতবাদ মানতেন না। কিন্তু ঠাকুর জানতেন যে, পরে তিনি মানবেন। তাই নরেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে এলেই তিনি এমন সব গ্রন্থ পাঠ করতে বলতেন, যাতে অদ্বৈতবাদের কথা আছে। নরেন্দ্র পড়তে না চাইলে বলতেন : তুমি নিজে মান বা না মান, আমার জন্য পড়। নরেন্দ্র হয়তো অনেক গান ঠাকুরকে শোনালেন। কিন্তু সব শেষে ঐ গানটি না শুনলে ঠাকুরের তৃপ্তি হত না—যো কুছ্‌ হ্যায় সো তৃহী হ্যায়। যা কিছু সব তুমি, সব ঈশ্বর। ঠাকুর এইভাবে চেষ্টা করতেন, নরেন্দ্রনাথের যাতে অদ্বৈতবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আসে। কিন্তু কোন সময় বলতেন না যে, আমি বলছি, তুমি মেনে নাও, মানতে হবে তোমাকে। শেষে যখন কিছুতেই কিছু হল না, তখন নরেন্দ্রনাথকে দেখিয়ে দিলেন যে, সব ঈশ্বর। নরেন্দ্রনাথ একদিন হাজরামশায়ের কাছে বসে বিদ্রুপ করছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে : বলেন কি উনি ? সব ঈশ্বর ? ঘটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর, যা কিছু দেখছি সব ঈশ্বর ? আমরা সকলেই ঈশ্বর ? এ কখনও হতে পারে ? দুজনে মিলে হাসাহাসি করছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ শুনতে পেয়েছেন তাঁদের কথা। টলতে টলতে, পরনের কাপড়টা বগলে নিয়ে তিনি সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন : ‘তোরা কি বলছিস্‌ রে ? ’—অর্ধবাহ্যদশা। হাসতে হাসতে এসে নরেন্দ্রকে স্পর্শ করে তিনি সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ দেখলেন : বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সব ব্রহ্ম। বাড়িতে ফিরে গেলেন। মা খেতে দিচ্ছেন—তিনি দেখছেন, যিনি খেতে দিচ্ছেন, খাবার জিনিস, থালা, বাটি, তিনি নিজে—সব এক। দু-এক গ্রাস খেয়ে চুপ করে বসে আছেন। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, ঘোড়ার গাড়ি আসছে—অন্যসময় ঘোড়ার গাড়ি দেখলে সরে যেতেন, পাছে ধাক্কা লাগে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ধাক্কা লাগলেই বা কি, আমিও যা, সে-ও তো তাই। জগৎটাকে মনে হচ্ছে স্বপ্নবৎ। তিন দিন তাঁর এই অবস্থা ছিল। ঠাকুর তাঁকে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিলেন, অদ্বৈতবাদ কি। এর পর থেকে তিনি আর অদ্বৈতবাদ সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন তোলেননি। কি করে তুলবেন ? যে জিনিসটাকে দেখিনি, সেটা সম্বন্ধেই আমরা নানারকম জল্পনা-কল্পনা তর্ক-বিতর্ক করি। কিন্তু যখন অপরোক্ষানুভূতি হয়, তখন সব প্রশ্ন থেমে যায়। ঠাকুর তাঁকে দেখিয়ে দিলেন যে, সব ব্ৰহ্ম। অদ্বৈতবাদ সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ রইল না তাঁর।

ধীরে ধীরে সব মানলেন নরেন্দ্রনাথ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন : ভবতারিণী আমার সাথে কথা বলেন। নরেন্দ্রনাথ উড়িয়ে দেন সেকথা : ওসব আপনার মনের ভুল। আরও কত কি বলেন। কিন্তু সেই কালীকেও মানলেন নরেন্দ্রনাথ। পিতৃবিয়োগ হয়েছে। কোন চাকরি যোগাড় করতে পারছেন না। অত্যন্ত আর্থিক কষ্টে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে এসে বললেন : মা তো আপনার কথা শোনে, আপনি মাকে বলুন যাতে আমার একটা চাকরি হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : তুই নিজে বল্‌ না কেন ? তুই বললে মা শুনবেন। আজ অমাবস্যা। আজ রাত্রে মা-র কাছে গিয়ে যা বলবি তাই শুনবেন মা। রাত্রিবেলায় নরেন্দ্রনাথ গেলেন মা-র মন্দিরে। গিয়ে দেখলেন ; কই, মাটির প্রতিমা তো নয়। এ তো দেখছি চিন্ময়ী। দশ দিক আলো করে মা সাক্ষাৎ বিরাজ করছেন সম্মুখে। বিভোর হয়ে গেলেন নরেন্দ্রনাথ। ভুলে গেলেন যে, চাকরি চাইতে এসেছেন। বললেন ; মা, আমাকে বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও, জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও। বারবার তিন বার ঠাকুর তাঁকে পাঠালেন মন্দিরে। প্রতিবারই বললেন : জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও। কিছুতেই মা-র কাছে বিষয়সুখ চাইতে পারলেন না। লজ্জায় মুখ বুজে এল। ঠাকুর তখন বললেন : ঠিক আছে, তোর বাড়ির লোকের মোটা ভাত-কাপড়ের কখনও অভাব হবে না। সারারাত নরেন্দ্রনাথ সেদিন গান করলেন : মা ত্বং হি তারা। তুমি ত্রিগুণধরা পরাৎপরা। আর ঠাকুরের কী আনন্দ ! পরদিন যে আসছে, তাকেই ডেকে বলছেন : জান, নরেন্দ্র কালী মেনেছে।

ধীরে ধীরে সব মেনেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ভক্তরা সবাই-ই মনে করেন যে, তিনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) অবতার; কিন্তু নরেন্দ্রনাথের সন্দেহ যায় না। কি করে সম্ভব ? যিনি স্বয়ং ঈশ্বর তিনি এসেছেন এই চৌদ্দপোয়া শরীরটার ভিতরে ? বিশ্বাস হতে চায় না। শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর এই সন্দেহ। এদিকে প্রাণপণে সেবা করছেন অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণের। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি ভালবাসায় কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু অবতার বলে মেনে নিতে পারছেন না ঠিক। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের কাছে বসে আছেন। কথা বলতে পারেন না ঠাকুর। আর কয়েকদিন মাত্র বাকী লীলাবসানের। নরেন্দ্রনাথ তখনও মনে মনে ভাবছেন : এখন এই অবস্থায় উনি যদি নিজের মুখে বলেন যে, উনি অবতার, তাহলে বিশ্বাস করব। যেই ভাবা, সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলে উঠলেন : ওরে, এখনও তোর সংশয় ? যে রাম যে কৃষ্ণ আগে লীলা করে গেছেন, তিনিই এবার এই শরীরে রামকৃষ্ণ। তবে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়। আর সন্দেহ করতে পারলেন না নরেন্দ্রনাথ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। পরবর্তীকালে দেখছি স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন : নিরক্ষরের পায়ে মাথা বিকিয়ে দিয়েছি। সত্যিই মাথা বিকিয়ে দিয়েছিলেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণকেও দেখি, যখন স্থূলদেহে ছিলেন তখন তো বটেই, দেহরক্ষার পরেও কত ভাবে আগলে রাখছেন তাঁকে। নরেন্দ্রনাথ তখন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। নানা নাম নিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাজীপুরে এসে দেখা পওহারীবাবার সঙ্গে। এঁর কথা স্বামীজী পরেও অনেকবার বলেছেন বিভিন্ন বক্তৃতায়। শুধু এঁর উপরেই একটা বক্তৃতা আছে তাঁর। পওহারীবাবা—‘পও’ মানে বাতাস। লোকে বলে যে তিনি কিছু খান না, শুধু বাতাস খেয়ে থাকেন—তাই তাঁর নাম পওহারীবাবা। পওহারীবাবাকে দেখে স্বামীজীর খুব ভাল লেগে গেছে। স্বামীজীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটা খোলা মন সবসময় তাঁর ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তাঁর যে ভালবাসা, সে তো কোন ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা নয়—আদর্শের প্রতি। যে আদর্শকে তিনি ভালবাসেন সেই আদর্শ মূর্ত দেখেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে—তাই তাঁকে ভালবাসছেন। সেই আদর্শ যদি আর এক জনের মধ্যে প্রকাশ পেতে দেখেন, তাহলে তাঁকেও তিনি শ্রদ্ধা করবেন।—এই তাঁর ভাব। পওহারীবাবার সঙ্গ করে তাঁর খুব ভাল লেগে গেছে। ঠিক করেছেন তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেবেন, রাজযোগ শিখবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, পওহারীবাবার কাছে দীক্ষা নেবেন দিনে ভেবেছেন, আর রাত্রিতে দেখছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। কোন কথা বলছেন না শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন ; চোখ দেখে মনে হচ্ছে, কত ব্যথা পেয়েছেন তিনি। এরকম পর পর কয়েক রাত শ্রীরামকৃষ্ণ এলেন তাঁর কাছে। কোন কথা হয়নি। কিন্তু স্বামীজীর সম্বিৎ ফিরল—খুব লজ্জা পেলেন তিনি ; আর গেলেন না পওহারীবাবার কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে। সেইসময়কার একটা চিঠিতে তিনি লিখছেন ; আর কোন মিঞার কাছে যাব না—শ্রীরামকৃষ্ণের কোন জুড়ি নেই।—একেবারে আত্মসমর্পণ তখন। পরবর্তীকালে একটা কবিতায় তিনি এই ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন :

গাই গীত শুনাতে তোমায়,

… … …

ছেলেখেলা করি তব সনে,

কভু ক্ৰোধ করি তোমা’ পরে,

যেতে চাই দূরে পলাইয়ে,

শিয়রে দাঁড়ায়ে তুমি রেতে,

নির্বাক্‌ আনন, ছল ছল আঁখি,

চাই মম মুখপানে।

অমনি যে ফিরি, তব পায়ে ধরি,

কিন্তু ক্ষমা নাহি মাগি।

তুমি নাহি কর রোষ।

পুত্র তব, অন্য কে সহিবে প্রগল্‌ভতা ?

ঐ কবিতাতেই স্বামীজী বলছেন : ‘বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর’— তুমিই আমার বাণী। আমার কণ্ঠে বসে তুমিই কথা বলেছ। একটা চিঠিতে লিখছেন : ‘I am a voice without a form’ — আমি দেহহীন এক কণ্ঠস্বর। কার কণ্ঠস্বর ? তোমার—শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর স্বামী বিবেকানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণই কথা বলেছেন স্বামীজীর ভিতর দিয়ে। স্বামীজী বলছেন : আমি যা কিছু বলেছি তার মধ্যে সত্য বা কল্যাণকর কিছু যদি থেকে থাকে সেগুলি শ্রীরামকৃষ্ণের। আর ভুলত্রুটি যদি কিছু থেকে থাকে, সেগুলি আমার।—একথা অতিশয়োক্তি নয়। গুরুভক্তির উচ্ছ্বাস নয়। সম্পূর্ণ সত্য। কারণ, স্বামী বিবেকানন্দকে জগৎ পেয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য। তিনিই নরেন্দ্রনাথকে জগতের কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। নরেন্দ্রনাথকে তিনি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন : তুই কি চাস্‌ বল্ দেখি ? নরেন্দ্রনাথ উত্তর দিয়েছিলেন : আমি চাই শুকদেবের মতো নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে থাকতে। মাঝে মাঝে সমাধি থেকে নেমে শরীরটা রক্ষার জন্য একটু খাব, আবার সমাধিতে ডুবে যাব। শ্রীরামকৃষ্ণ খুব তিরস্কার করেছিলেন তাঁকে : ছি ছি, এত হীনবুদ্ধি তোর ! আমি ভেবেছিলাম, কোথায় তুই একটা বড় বটগাছের মতো হবি, সবাই এসে তোর ছায়ায় আশ্রয় পাবে, তা নয়, তুই শুধু নিজের মুক্তি চাস্‌ ? পরবর্তীকালে দেখি, সেই স্বামীজীই বলছেন : যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও অভুক্ত থাকবে, ততক্ষণ আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো। শিষ্যদের বলছেন : তোমরা যদি নিজের মুক্তি চাও নরকে যাবে ! অন্যের মুক্তি চাও, সকলের মুক্তি চাও—তাহলেই তোমার মুক্তি। বিদেশে যাওয়ার আগে স্বামীজী তুরীয়ানন্দকে বলেছিলেন : হরিভাই, আমি এখনও তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না। কিন্তু এটা দেখছি যে, আমার হৃদয়টা খুব বড় হয়ে গেছে, আর আমি অপরের দুঃখে দুঃখবোধ করতে শিখেছি। স্বামীজীর মানবপ্রেম আমাদের মুগ্ধ করে—কিন্তু আমরা দেখলাম, তাঁর মানবপ্রেম শ্রীরামকৃষ্ণেরই অবদান।

বস্তুত, শুধু মানবপ্রেম নয়, যত উচ্চ চিন্তা, যত উচ্চ ভাব, সবই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। মহাসমাধির আগে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সর্বস্ব নরেনকে দিয়ে ফকির হয়ে গেছিলেন। সেই শক্তির জোরে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বজয় করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাব, তিনি ভাষা। শ্রীরামকৃষ্ণ সূত্র, তিনি তার ভাষ্য। এক সত্তা তাঁরা—যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি। ধর্মমহাসভায় আবির্ভূত হলেন। অজ্ঞাতকুলশীল সন্ন্যাসী। ছোট্ট একটা বক্তৃতা করলেন। কিন্তু একেবারে নতুন সুরে। অন্য সবাই নিজের নিজের ধর্মের প্রশংসা করে গেছেন। কিন্তু স্বামীজী বললেন ঠাকুরের সেই কথা ; যত মত তত পথ। সব ধর্ম সমান। সব ধর্ম সত্য—যা ভারতের শাশ্বত বাণী। সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল—এ তো অদ্ভুত কথা শুনছি ! এত সুন্দর, এত উদার ! রাতারাতি তিনি সমস্ত আমেরিকায় বিখ্যাত হয়ে গেলেন। সেই রাতে এক ধনী পরিবারে তিনি আছেন। রাজার মতো সম্মানে তাঁকে রাখা হয়েছে। কিন্তু স্বামীজী সারারাত ঘুমোতে পারছেন না। বিছানা ছেড়ে মাটিতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন : মা, এখানে এত সুখ, এত ঐশ্বর্য। আর আমার দেশের লোক একমুঠো খেতে পায় না। আমি মানযশ চাই না। আমি আমার দেশবাসীর সেবা করতে চাই। আমায় দেখিয়ে দাও, কিভাবে আমি তাদের সেবা করতে পারি। কী অদ্ভুত মানুষ স্বামীজী ! তাঁর মেধা দেখে পৃথিবীর জ্ঞানীগুণীরা মুগ্ধ হয়েছেন। অধ্যাপক রাইট বলেছিলেন : সূর্যের যেমন কোন পরিচয় দরকার হয় না, স্বয়ংপ্রকাশ সে, আপনিও তেমনি। বলেছিলেন : ইনি এমন প্রতিভাবান যে, আমাদের দেশের সব অধ্যাপককে একত্র করলেও এঁর সমান হবে না।—শঙ্করের মেধা তাঁর। আবার বুদ্ধের হৃদয়। সকলের প্রতি তাঁর প্রেম। বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। কিন্তু জগৎ মিথ্যে নয় তাঁর কাছে—‘ব্রহ্মময়ং জগৎ’, ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’— এই তাঁর বাণী। বলছেন : ‘⋯the only God I believe in, the sum total of all souls,’—সকলের আত্মার সমষ্টিরূপে যে ভগবান আছেন, একমাত্র সেই ভগবানেই আমি বিশ্বাস করি। ‘and above all, my God the wicked, my God the miserable, my God the poor of all races, of all species, is the special object of my worship.’— বিশেষভাবে আমি সেই ঈশ্বরের পুজো করি, যে-ঈশ্বর দুষ্টের মধ্যে, আর্তের মধ্যে, গরীবের মধ্যে। আর্ত নারায়ণ, দরিদ্র নারায়ণ, চোর নারায়ণ—সবাই নারায়ণ তাঁর চোখে। বলছেন : ‘We are the servants of that God who by the ignorant is called MAN.’—আমরা সেই ভগবানের সেবক, অজ্ঞ লোকেরা ভুল করে যাঁকে মানুষ বলে থাকে। মানুষ নয়, ভগবান। তাঁকে নিবেদিতা জিজ্ঞেস করেছিলেন : আপনার জীবনের আদর্শ কি ? স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন : যদি সংক্ষেপে বলতে হয়, তাহলে আমার আদর্শ এই—মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের প্রচার এবং জীবনের সব কাজে সেই দেবত্বকে কিভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তার পথ দেখানো। চণ্ডীদাস বলেছেন : সবার উপরে মানুষ সত্য। স্বামীজীর মতবাদেও মানুষেরই জয়গান। সবার উপরে মানুষ সত্য—কারণ মানুষই ভগবান। জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবের সেবা —যে-বাণী তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।

জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি—সব মিলিয়ে স্বামীজী এক অতুলনীয় মানুষ। সিস্টার ক্রিস্টিন বলছেন : অনেক যুগ পর পর পৃথিবীতে এক এক জন লোকের আবির্ভাব হয়। তাঁরা এ জগতের মানুষ নন। তাঁরা ‘Wanderer from another sphere’—অন্য এক জগৎ থেকে হঠাৎ তাঁরা এসে পড়েন। স্বামীজী সেইরকম একজন ব্যক্তি। অমর্তলোক থেকে তিনি হঠাৎই এসে পড়েছেন। সেই জগতের জ্যোতি, সেই জগতের শক্তি এই মাটির জগতে নিয়ে এসেছেন। নজরুল তাঁর সম্বন্ধে বলছেন :

যজ্ঞাহুতির হোম-শিখাসম

তুমি তেজস্বী তাপস পরম।

ভারত-অরিন্দম, নমো নমঃ, বিশ্ব-মঠ-বিহারী॥

যজ্ঞের শিখার মতো পবিত্র তিনি। ‘শুদ্ধম্ অপাপবিদ্ধম্‌’। জ্ঞানের অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে তাঁর ভিতরে। কোন মলিনতা তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারছে না। এক জায়গায় স্বামীজী বলছেন : জগতের শ্রেষ্ঠ কোন সুন্দরী নারী যদি আমার দিকে অনুচিত দৃষ্টিতে তাকায় সেই মুহূর্তেই সে আমার চোখে একটি ব্যাঙে পরিণত হয়ে যাবে। এই তাঁর জীবন, এই তাঁর চরিত্র। ধর্মমহাসভায় সেই প্রথম ভাষণের পরে যখন স্বামীজীকে সবাই ঘিরে ধরেছে, তখন এক বৃদ্ধা একপাশে দাঁড়িয়ে স্বামীজীকে দেখছেন। দেখছেন যে, তরুণ স্বামীজীর সঙ্গে মেয়েরা দলে দলে গিয়ে হ্যাণ্ডসেক করছে। তিনি তখন মনে মনে ভাবছেন : বাছা, তুমি যদি এই আক্রমণে মাথা ঠিক রাখতে পার, তাহলে বুঝব, তুমি ভগবান। পরে সেই মহিলাই বলছেন : আমি সেদিন এইকথা ভেবেছিলাম। তারপর কাগজে তাঁর কথা পড়েছি, নিজে গেছি তাঁর কাছে, পরীক্ষা করে বুঝেছি, ইনি অদ্ভুত— অপাপবিদ্ধ। স্বামীজী যখন থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে আছেন, পাহাড়ের উপর দিয়ে অন্ধকারে ভিজতে ভিজতে রাত্রিবেলা দুই মহিলা তাঁর কাছে এসেছেন। সিস্টার ক্রিস্টিন ও মিসেস ফাঙ্কি। তাঁরা তাঁকে বলছেন : আজ যদি যীশুখ্রষ্ট থাকতেন, তাহলে তাঁর কাছে যেমনভাবে গিয়ে উপদেশ প্রার্থনা করা উচিত হত, আমরা তেমনিভাবে আপনার কাছে এসেছি। তিনি নেই কিন্তু আপনি সেই যীশুখ্রীষ্টের মতো মানুষ। তাই আমরা আপনার কাছে এসেছি। —অন্য কেউ হলে এ কথা শুনে গর্ববোধ করতেন। কিন্তু স্বামীজী বলছেন : আহা ! আমার যদি সত্যি সত্যি যীশুখ্রীষ্টের মতো শক্তি থাকত ! তাঁর মতো আমি যদি পারতাম এক্ষুনি তোমাদের মুক্ত করে দিতে !—কী বিনয় !

স্বামী অভেদানন্দের জন্মতিথি উপলক্ষে কলকাতায় একবার একটা ঘরোয়া সভা হয়েছিল। অনেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন—আমিও ছিলাম। মনে আছে, অভেদানন্দজী সেদিন স্বামীজী সম্বন্ধে বলেছিলেন : স্বামীজীকে যেদিন বিলেতে প্রথম দেখলাম, অবাক হয়ে গেছিলাম। কী ব্যক্তিত্ব, কী পাণ্ডিত্য ! ভাবছিলাম, এই কি সেই নরেন—যাঁর সঙ্গে একসাথে থেকেছি, শাস্ত্র নিয়ে কত তর্ক-বিতর্ক করেছি, ঝগড়া করেছি ! ব্যক্তিত্ব তাঁর বরাবরই ছিল, কিন্তু এতটা ছিল না। এসব ঈশ্বরের অনুগ্রহ ছাড়া হয় না। —যেমন বুদ্ধি, তেমনি হৃদয়, তেমনি কর্মশক্তি, তেমনি ব্যক্তিত্ব। সব দিক দিয়েই স্বামীজী অনন্য। রোমাঁ রোলাঁ বলছেন : আমি স্বামী বিবেকানন্দকে দেখিনি বা তাঁর বক্তৃতা শুনিনি। কিন্তু আজও যখন আমি তাঁর বক্তৃতাগুলি পড়ি, আমার শরীরের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো শিহরণ খেলে যায়। তখন ভাবি, যাঁরা এ কথাগুলি তাঁর মুখ থেকে সরাসরি শুনেছিলেন, তাঁদের না জানি কী অনুভূতি হয়েছিল ! আবার বলছেন, স্বামীজী কোন জায়গায় দ্বিতীয় স্থানে আসীন, এ কথা আমি ভাবতেই পারি না। বস্তুত, সবক্ষেত্রেই তিনি শীর্ষস্থান অধিকার করে থাকতেন। দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, দেশের বিবিধ সমস্যা—সব বিষয়েই তাঁর অধিকার। যে-কোন বিষয়েই আলোচনা বা তর্ক হোক, তাঁর সঙ্গে কেউ পেরে উঠত না।

কত গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন স্বামীজী, কিন্তু আবার শিশুর মতো সরল। সবসময় আনন্দে আছেন, অন্যকেও মাতিয়ে রাখেন আনন্দে। অন্যের সামান্যতম দুঃখও তাঁকে বিচলিত করে, কিন্তু নিজের শত দুঃখেও তিনি অবিচল থাকেন। শরীর সারানোর জন্য দার্জিলিঙে আছেন, এমন সময় কলকাতায় প্লেগ বাধল। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ছুটে এলেন। অর্থাভাব। বললেন : দরকার হলে মঠের জমি বিক্রি করেও রোগীর সেবা করব। একটি চিঠিতে লিখছেন : লোকে আমাকে মনে করেছে ঠক, জোচ্চোর। তবুও আমি হৃদয়ের রক্ত মোক্ষণ করে কাজ করে চলেছি তাদেরই জন্য, যারা আমাকে আঘাত করেছে। আমরা সাধারণ লোক মনে করি, স্বামীজী আমেরিকায় গিয়ে বক্তৃতা করলেন, লোকে তাঁকে জানল—তারপর আর তিনি কি কষ্ট করলেন ? শুধু সাফল্য আর সাফল্য। কিন্তু সে সময়কার ইতিহাস যদি আমরা পড়ি তাহলে দেখব, আমেরিকায় অনেকেই যেমন তাঁর বন্ধু হয়েছিলেন, শত্রুও কম হয়নি। বিশেষত ক্রিশ্চান মিশনারীরা এবং এ দেশের ব্রাহ্মরা নানাভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। মিথ্যা অপবাদ, কুৎসা, এমনকি তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত হয়েছিল। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ বইতে সেসব বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে। কিন্তু স্বামীজী সর্বাবস্থায় অবিচল। যারা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যে কুৎসা রটাচ্ছে তাদেরকে তিনি অভিসম্পাত করছেন না। বলছেন : ঈশ্বর তাঁদের কল্যাণ করুন, তাঁদের সুমতি দিন। এত ঝড়-ঝাপটার ভিতর দিয়ে তিনি গেছেন অথচ সবসময় তিনি প্রশান্ত। বস্তুত, জীবনে সুখ বা বিশ্রাম কতটুকু পেলেন ? সারা জীবন তো কাজ করেই গেলেন। সারা জীবন তাঁর সংগ্রাম—যুদ্ধ ! একটুও বিশ্রাম করেননি। নিজেই বলতেন যে, রাত্রে ভাল ঘুম কমই হয়েছে। এত পরিশ্রম করেছিলেন যে, অকালে শরীর ভেঙে পড়েছিল। অথচ কতই বা তাঁর বয়স হয়েছিল ? মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সেই চলে গেলেন। যেটা এখানে বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, সমস্ত পৃথিবীর সমস্যা নিয়ে তিনি তো মাথা ঘামাচ্ছেন, আর কত দুঃখ-কষ্ট তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে, অথচ সবসময় তিনি আনন্দে মেতে আছেন। কতরকম রঙ্গরস করছেন তিনি। এও বোধহয় তিনি গুরুদেবের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর যিনি গুরু, তিনি তো একেবারে রসিক-চূড়ামণি। স্বামীজী সেই দিক দিয়েও তাঁর সার্থক সন্তান। একবার এক ফরাসী ভদ্রলোক এসেছিলেন মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে। আমি তখন সেখানে ছিলাম। তাঁকে আমি আশ্রম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি আর স্বামীজীর সম্বন্ধে কিছু কিছু বলছি। স্বামীজীর একটা ছবি দেখে তিনি মন্তব্য করলেন : But he looks smug. —এঁর মুখে তো বেশ একটা তৃপ্তির ছাপ ! স্বামীজীর চেহারা তো বেশ হাসিখুশি, সেটা তাঁর পছন্দ নয়। অনেকের এরকম একটা ধারণা আছে যে, ধর্মপথে যে চলবে তাকে শুষ্ক, শীর্ণ, নিরানন্দ হতে হবে, কারণ, এই জগৎ দুঃখময়, আনন্দ করবার কোন অধিকার নেই তার। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য। আমরা বলি, যিনি ধার্মিক তিনি হবেন আনন্দময় পুরুষ। তিনি নিজে আনন্দে থাকবেন, তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা আসবেন, তাঁদের মধ্যেও সেই আনন্দ তিনি সঞ্চারিত করবেন। স্বামীজী তার সার্থক দৃষ্টান্ত। সবসময় আনন্দে মেতে আছেন। অনেকে প্রশ্ন করত ; স্বামীজী, আপনি কি কখনও গম্ভীর হতে পারেন না ? স্বামীজী বলতেন : হ্যাঁ, হই তো ! যখন পেট কামড়ায়—তখন খুব গম্ভীর হই। স্বামীজী যখন বিদেশে আছেন, তখন একবার একজন তাঁকে একটা গল্প বলেছে যে, একজন রেডইণ্ডিয়ানের স্ত্রী মারা গেছে। স্ত্রীকে কবর দেবে, তার জন্য কফিন যোগাড় হয়েছে। কফিনের পেরেক আনতে গিয়ে এক মহিলাকে দেখে তার খুব ভাল লেগে গেছে। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু সেই মেয়েটি রাজী হয়নি। তখন সে বলছে : ঠিক আছে, দেখা যাবে। আবার আসব, তখন দেখব কেমন করে আমায় ফিবিয়ে দাও। তারপরে একদিন সে মাথায় পালক এঁটে খুব করে তেল মেখে আবার সেখানে গেছে। এত তেল মেখেছে যে, গাল বেয়ে তেল গড়িয়ে পড়ছে। তার ধারণা তেল মাখাতে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, এইবার আর মেয়েটি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। স্বামীজীর এই গল্পটা খুব পছন্দ। সেই সময় একজন শিল্পী স্বামীজীর একটা ছবি আঁকছিলেন। তৈলচিত্র। স্বামীজীকে নিয়ে তাঁর ভক্তরা গেছেন সেই ছবিটা দেখতে। গিয়ে দেখেন যে, কিছুটা তেল গড়িয়ে স্বামীজীর ছবির ঠিক গাল পর্যন্ত এসেছে। স্বামীজী তাই দেখে বলছেন : Oh,going to marry ? —সেই রেডইণ্ডিয়ানটার মতো বিয়ে করতে যাচ্ছে বুঝি ? —এইরকম মানুষ স্বামীজী। একবার একজনের বাড়িতে গেছেন। এদেশের ঘটনা এটা। অনেকে আছেন, মিষ্টি এসেছে তাঁদের জন্য—জিবেগজা। সবাই ভাগ করে খাবেন এই কথা। স্বামীজীকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে কিছুটা। তিনি খাচ্ছেন, খুব ভাল লেগেছে, আরও একটু পেলে ভাল হয়। করেছেন কি, একটা উচ্ছিষ্ট গজা সেই গজার পাত্রের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ফেলে দিয়ে বলছেন : যাঃ, সমস্তটাই তো এঁটো হয়ে গেল, এ তো আর কেউ খেতে পারবে না, তাহলে আমাকেই তো খেতে হবে সবটা। এই বলে তিনি নিজের দিকে পাত্রটা টেনে নিলেন। এইরকম মজার লোক স্বামীজী। শিশুর মতো সরল। ভেতর-বার সমান। একটা ঘটনা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে কিরকম অকপট ছিলেন স্বামীজী। পাশ্চাত্যদেশ থেকে ফিরে তিনি যখন মাদ্রাজে বেদান্ত সম্বন্ধে বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছেন, তখন সেখানকার গোঁড়া ব্রাহ্মণরা অনেকে সেটা পছন্দ করেননি। তাঁরা বললেন : স্বামীজী তো জন্মসূত্রে শূদ্র, কাজেই বেদপ্রচারের অধিকার তাঁর নেই। এই ধরনের কথা স্বামীজী একদম সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বললেন : আমি যদি শূদ্র হই—আপনারা। তবে পারিয়ারও অধম (‘Pariah of Pariahs’)। পরের দিন খবরের কাগজে স্বামীজীর এই কথা ছাপা হয়ে গেল, বেশ হৈচৈ হল এই নিয়ে। এই ঘটনার অনেকদিন পরে স্বামীজী আলমোড়ায় গেছেন। বরিশালের অশ্বিনী দত্তও তখন সেখানে আছেন। খুব বিখ্যাত লোক অশ্বিনী দত্ত। ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। ঠাকুরকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। স্বামীজী যে আলমোড়ায় আছেন অশ্বিনীবাবু খবরের কাগজে দেখেছিলেন। তবে দেখা হয়নি তখনও। তাঁর রাঁধুনীর কাছে শুনেছেন যে, এই শহরে এক অদ্ভুত সাধু আছেন। তিনি ইংরেজী জানেন আর ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। একদিন তিনি দূর থেকে দেখলেন : ঘোড়ায় চড়ে একজন সাধু এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, একজন সাহেব এসে তাঁর ঘোড়াটা ধরল, আর তিনি লাফ দিয়ে নেমে ভিতরে চলে গেলেন। অশ্বিনীবাবু বুঝলেন, ইনিই স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি সেই বাড়ির সামনে গিয়ে একজন যুবক সাধুকে জিজ্ঞেস করলেন। এখানে নরেন্দ্র দত্ত বলে কেউ আছে ? সাধুটি বিদেশী, সে জানত না স্বামীজীর ঐ-নাম। সে বলল : না, এখানে নরেন দত্ত বলে কেউ নেই। এদিকে স্বামীজী ভিতর থেকে তাঁর গলা শুনেই চিনতে পেরেছেন। বলছেন ; আসুন, সোজা ভিতরে চলে আসুন। অশ্বিনীবাবু ভেতরে গেলেন। তারপর দুজনের নানা বিষয়ে অনেক কথা হতে লাগল। কথায় কথায় অশ্বিনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন : আচ্ছা, এটা কি সত্যি যে, মাদ্রাজের ব্রাহ্মণদের আপনি বলেছিলেন, আমি যদি শুদ্র হই, তবে আপনারা পারিয়ারও অধম ? স্বামীজী বললেন : হ্যাঁ, বলেছিলাম। অশ্বিনীবাবু বললেন : কিন্তু আপনার মতো লোকের পক্ষে কি ওরকম বলা ঠিক হয়েছে ? স্বামীজী সঙ্গে সঙ্গে বলছেন : কে তা বলেছে ? আমি তো কখনও বলিনি যে ঠিক করেছিলাম। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল, তাই অমন কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। অশ্বিনীবাবু তখন বললেন : আজ আমি বুঝতে পারলাম, কেন আপনি বিশ্ববিজয়ী হয়েছেন আর কেন আপনাকে ঠাকুর এত ভালবাসতেন ! —ভুল করেছেন বুঝতে পেরেছেন, অকপটে সেটা স্বীকার করলেন। এরকম ছোটখাট ঘটনা দিয়েই তো মানুষের ঠিক ঠিক বিচার হয়। মহাসমাধির আগে স্বামীজী বলেছিলেন : আজ যদি আর একটা বিবেকানন্দ থাকত তাহলে বুঝতে পারত, বিবেকানন্দ কি করে গেল। বাস্তবিক, তিনি যে কত বড় আমরা এখনও তা বুঝতে পারিনি। তিনি নিজেই তাঁর তুলনা ! স্বামী ওঙ্কারানন্দ (অনঙ্গ মহারাজ, এক সময় রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের সহাধ্যক্ষ ছিলেন) বলতেন ; আমরা যখন প্রথম মঠে যাতায়াত করি, স্বামীজীর বই পড়ি, তাঁর ছবি দেখি, তখন ভাবতাম, আমাদেরও তো ঐ-রকম স্বাস্থ্য আর পড়াশুনোও তো কিছু আছে—স্বামীজী বি. এ. পাস করেছিলেন, আমি এম. এ. পাস—স্বামীজীর চেয়ে আরও এক পা এগিয়ে যাব আমরা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখছি, কোথায় স্বামীজী আর কোথায় আমরা ! সারা জীবন কাটিয়ে দিলাম তবু তাঁকে বুঝতেই পারলাম না। আর তাঁকে ছোঁয়া ? সে তো কল্পনাই করতে পারি না।

মিস ম্যাকলাউডের কথা অনেকেই জানেন। এঁকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। স্বামীজীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। স্বামীজীও খুব স্নেহ করতেন তাঁকে। তাঁর সংগঠন-ক্ষমতার খুব প্রশংসা করতেন। এঁর যে কত অবদান এই রামকৃষ্ণ মিশনের পিছনে, তা আমরা জানিও না। বহুদিন তিনি বেলুড় মঠে ছিলেন। ইউরোপ আমেরিকার সব বড় বড় লোকের সাথে তাঁর আলাপ ছিল। আমরা দেখেছি, ভাইসরয় আসছেন তাঁর সঙ্গে মঠে দেখা করতে। স্বামীজীকে এই মহিলা জিজ্ঞেস করেছিলেন : কিভাবে আমি আপনার কাজে লাগতে পারি ? স্বামীজী বলেছিলেন : ভারতবর্ষকে ভালবাস। আমরা দেখতাম, মঠে কুলি-মজুররা গঙ্গার ধারে মাটি কাটছে, তিনি একটা উলটো করা ঝুড়ির উপরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সব দেখছেন। কেউ যদি বলত : কি করছেন আপনি ? তিনি উত্তর দিতেন : ভারতবর্ষকে ভালবাসছি। আমরা তাঁকে ডাকতাম—ট্যান্টিন, পিসীমা। তাঁর জন্মদিনে আমরা তাঁর কাছে যেতাম, কেক-টেক খেতাম। জন্মদিনে তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম : পিসীমা, তোমার বয়স কত হল ? সাধারণত মহিলাদের কেউ এরকম প্রশ্ন করে না। কিন্তু পিসীমা আপনজন, তাঁকে এরকম বলা চলে। তিনি হয়তো বলতেন; এই চল্লিশ হল ! —দেখেই কিন্তু বোঝা যাচ্ছে অনেক বেশী বয়স ! আমরা ঠাট্টা করে বলতাম : তোমাদের দেশের মেয়েরা তো বয়স চুরি করে, আসল বয়স বলে না, তুমিও বুঝি তাই করছ ? তিনি বলতেন : না, তা নয়। স্বামীজীকে যেদিন প্রথম দেখেছি, সেইদিনই আমার প্রকৃত জন্মদিন। ওইদিন থেকে আমি আমার বয়সের হিসাব করি। তার আগে কি আর মানুষ ছিলাম ! মিস ম্যাকলাউড সারা পৃথিবী ঘুরেছিলেন। বার্নার্ড শ-এর সঙ্গে তাঁর খুব বন্ধুত্ব ছিল। তিনি বলতেন : দু-জনের ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। একজন জার্মানির কাইজার, অপরজন স্বামী বিবেকানন্দ। আর একটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা তিনি বলতেন স্বামীজীর সম্বন্ধে : তোমরা স্বামীজীকে এখন বুঝবে না। দেশ যদি কোনদিন স্বাধীন হয়, তখন বুঝবে। বুঝবে যে, কী মানুষ তিনি ছিলেন ! আমাদের দেশে যদি তিনি জন্মাতেন, দেখতে কী সম্মান তাঁকে আমরা দিতাম। মাথার মণি করে রাখতাম তাঁকে। কিন্তু তোমাদের দেশ—এ এক আত্মবিস্মৃত দেশ। নিজেকে চেনে না, নিজের মানুষকে চেনে না—নিজের যে নেতা, তাঁকে সম্মান দেয় না !

কতদিন আগে তিনি (মিস ম্যাকলাউড) একথা বলেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্বামীজীকে কতটুকু সম্মানই বা আমরা দিয়েছি ? তাঁর জীবিত-অবস্থায় আমরা তাঁর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। যে-দক্ষিণেশ্বর তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। কারণ, তিনি সমুদ্র পার হয়েছিলেন, সাহেবদের সঙ্গে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করেছিলেন। আর তিনি কি করেছেন আমাদের জন্য ? গোটা জাতিটাকে জাগিয়ে তুলেছেন। শুধু জাগিয়েই তোলেননি, পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতের জন্য একটা সম্মানের আসন তৈরী করে দিয়েছেন। আর, এসব তিনি করেছেন সেই যুগে, যখন বিদেশীরা তো বটেই, আমরাও ভারতবর্ষকে ঘৃণা করতাম। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন : বিবেকানন্দের মতো এত বড় একটা প্রতিভা যদি শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে না আসত, তাহলে জগতের আরও কল্যাণ হত। বিরাট একজন বিপ্লবী হয়ে যেতেন তিনি। সমস্ত জগৎ তাঁকে সম্মান করত। তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এরকম কথা বলেছেন। তিনি তো মার্কসবাদী ছিলেন, তিনি তাঁর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামীজীকে দেখেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি, বিপ্লব তিনি সত্যিসত্যিই ঘটিয়েছেন। তবে সে বিপ্লব অন্য রকমের। মানুষ-গড়ার বিপ্লব। মানুষকে তিনি বলেছেন : তুমি ক্ষুদ্র নও, তুমি অপবিত্র নও, তুমি নিত্য-শুদ্ধ-পবিত্র, তুমি ঈশ্বর, তুমি অসীম, তুমি ব্ৰহ্ম। তাঁর বিপ্লব আরও বড় বিপ্লব—মানুষকে দেবতা বানানোর বিপ্লব।

স্বামীজীর কথা ইচ্ছে করেই একটু বিস্তৃতভাবে আলোচনা করলাম, কারণ তিনিই তো ঠাকুরের প্রধানতম যন্ত্র। স্বামীজীর পরেই বলতে হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দের কথা। রামকৃষ্ণ সঙেঘ ঠাকুর, মা, স্বামীজীর ঠিক পরেই যাঁর স্থান তিনি হলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। আমরা স্বামীজীর কথা জানি, কিন্তু স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা রাখাল মহারাজের কথা সবাই জানেন বলে মনে হয় না। ঠাকুর তাঁকে বলতেন, মানসপুত্র। একদিন ঠাকুর মা ভবতারিণীকে বলছেন : মা, বিষয়ী লোকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার জিভ জ্বলে গেল, আর পারি না। মা বললেন : আসবে, শুদ্ধসত্ত্ব ভক্তরা সব আসবে। তারপর একদিন দেখেন যে, বটতলায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্নে হৃদয়কে বলেছেন কথাটা। হৃদয় বলছে : মামা, তোমার ছেলে হবে। শুনে ঠাকুর চমকে উঠলেন : সে কি রে ? আমার ছেলে হবে কি রে ? আর একদিন দেখলেন যে, মা (শ্রীশ্রীজগদম্বা) একটি ছেলেকে তাঁর কোলে বসিয়ে দিয়ে, বলছেন : এটি তোমার ছেলে। সাধারণ সংসারী-ভাবে ছেলে নয়, ত্যাগী মানসপুত্র। তখন ঠাকুর নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর রাখাল মহারাজ যেদিন প্রথম এলেন, সেদিন আর একটা অদ্ভুত দর্শন হল ঠাকুরের ঠাকুর জানতেন না যে, রাখাল আসছেন। কিন্তু দেখলেন যে, গঙ্গার উপরে একটি প্রস্ফুটিত পদ্ম। সেই পদ্মের উপরে শ্রীকৃষ্ণ বালকরূপেতে আছেন আর তাঁর হাত ধরে নাচছে আর একটি ছেলে। অপূর্ব শোভা ! ঠিক সেই মুহূর্তে রাখাল এলেন—ঠাকুরের ভক্ত মনোমোহনের সঙ্গে। মনোমোহন মিত্রের বোনের সঙ্গে রাখালের বিয়ে হয়েছিল। ঠাকুর দেখেই চিনলেন, এই সেই বালক যাকে একটু আগে দেখেছেন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। রামকৃষ্ণদেব তো শ্রীকৃষ্ণ। তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার। জিজ্ঞেস করলেন : কি নাম তোমার ? ‘রাখাল’। রাখাল ! —খুব অবাক হয়ে গেলেন। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। ঠাকুর বুঝলেন : এই তাঁর মানসপুত্র। সাদরে গ্রহণ করলেন তাঁকে। রাখাল বিবাহিত ছিলেন। আশ্চর্য, যেটা অন্যের ক্ষেত্রে বন্ধনের কারণ হয়, তাঁর ক্ষেত্রে সেটাই মুক্তির কারণ হয়েছিল। কারণ, শ্বশুরবাড়ির সূত্রেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর যিনি শাশুড়ী, মনোমোহন মিত্রের মা, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের খুব ভক্ত ছিলেন। রাখাল দক্ষিণেশ্বরে আসার কয়েকদিন পরে মনোমোহন মিত্র রাখালের স্ত্রীকে নিয়ে এলেন। ঠাকুর রাখালের স্ত্রীকে দেখে বললেন : বিদ্যাশক্তি। তারপর তাঁকে নহবতে শ্রীশ্রীমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন টাকা দিয়ে পুত্রবধূর মুখ দেখতে।

রাখাল মহারাজ কঠোর তপস্যা করতেন আর ঠাকুরের কাছে তিন-চার বছরের ছেলের মতো থাকতেন। বয়স হয়েছে তখন আঠারো কিংবা উনিশ, কিন্তু দৌড়ে গিয়ে ছোট ছেলের মতো ঠাকুরের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যেন ঠাকুর তাঁর জননী। ঠাকুর হয়তো বললেন, পান সেজে নিয়ে আয় ! উত্তরে রাখাল বললেন, পারব না। ঠাকুর হাসছেন। ছেলে তো, বাপকে এরকম বলতে পারে। কেউ হয়তো রাখালের সম্বন্ধে কোন অভিযোগ করেছে, ঠাকুর বলছেন : রাখালের দোষ ধরতে নেই, ওর গলা টিপলে দুধ বেরোয়। এত স্নেহ রাখালের প্রতি। আবার শাসনও করতেন। একদিন কালীমন্দির থেকে প্রসাদী মাখন এসেছে—রাখাল আগেই সেটা খেয়ে ফেলেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তিরস্কার করছেন ; তুই তো ভারী লোভী। আর একদিন রাখাল মহারাজকে বলছেন : তোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না কেন রে ? তুই কি কোন কুকাজ করেছিস ? প্রথমে মনে করতে পারছিলেন না রাখাল মহারাজ, পরে মনে পড়ল, ঠাট্টাচ্ছলে একটা মিথ্যে কথা বলেছিলেন। ঠাকুর বলছেন : না, মিথ্যে কথা কখনও বলবি না—ঠাট্টাচ্ছলেও না। আর একদিন ঠাকুরকে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন, ঠাকুর কি বলেছেন, রাগ করে চলে যাচ্ছেন দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে। কিছুদূর গিয়েই মনে হল, পা-টা ভারী হয়ে গেছে, আর এগোতে পারলেন না, ফিরে এলেন। ঠাকুর বললেন : কি রে যেতে পারলি ? গণ্ডি কেটে রেখেছিলাম। স্নেহ করছেন, আবার শাসনও করছেন। এইভাবে তাঁকে গড়ে তুলছেন। একসময় ঠাকুর বলছেন : আজকাল রাখালের কিরকম সুন্দর অবস্থা হয়েছে দেখ ! সবসময় মনে মনে জপ করছে। কোথায় সে আমার সেবা কববে—না, আমাকেই উন্টে তার সেবা করতে হয়। মানসপুত্র, কিন্তু কঠোর তপস্যা করেছিলেন, ঠাকুরের দেহরক্ষার পর বিশেষ করে। একবার বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : আপনি এত ধ্যানজপ করছেন কেন ? তিনি তো আপনাকে সবই দিয়ে গেছেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন : তাঁর কৃপায় যেসব দর্শন বা অনুভূতি হয়েছে সেগুলি এখন আয়ত্ত করবার চেষ্টা করছি মাত্র। একসময় তিনি অজগরবৃত্তি অবলম্বন করে থাকতেন। অজগর খাওয়া-দাওয়ার জন্য নড়াচড়া করে না—যা মুখের কাছে আসে, তাই সে খায়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বৃন্দাবনে আছেন অজগরবৃত্তি অবলম্বন করে। ‘যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টঃ’। কোনদিন আহার জোটে, কোনদিন জোটে না। আবার মৌনব্রত অবলম্বন করে আছেন। শীতকাল। একদিন একজন শেঠ একটা কম্বল দিয়ে গেল তাঁর কাছে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ দেখলেন, কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর আর একজন এসে তাঁকে কিছু না বলেই সেটা নিয়ে পালাল। ব্রহ্মানন্দের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, ঈশ্বরের উপরে নির্ভর করে আছেন, নির্বিকার।

বড় অদ্ভূত সম্পর্ক ছিল স্বামীজী আর ব্রহ্মানন্দের মধ্যে। ঠাকুরের কাছে আসবার আগেই দুজনের পরিচয় ছিল। রাখাল মহারাজের জন্ম বসিরহাটের কাছে শিককুলীন গ্রামে। ওখানকার জমিদার ছিলেন তাঁর বাবা। সেখানে এখন একটি সুন্দর আশ্রম হয়েছে। রাখাল মহারাজ ইংরেজি শিখবেন বলে কলকাতায় পড়াশুনো করতে এলেন। থাকতেন সিমলায়, ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে পড়তেন। স্বামীজীও সিমলার ছেলে। কাজেই দুজনের পরিচয় হল। দুজনে এক আখড়ায় কুস্তি লড়তেন। এক সাথে ব্রাহ্মসমাজে যেতে আরম্ভ করেন। দুজনের মধ্যে রাখাল মহারাজই আগে ঠাকুরের কাছে আসেন। নিরাকারবাদী ছিলেন, ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে সাকার-উপাসনার প্রতিও তাঁর একটা শ্রদ্ধা এল। কালীমন্দিরে যান, প্রণাম করেন। স্বামীজী প্রথম প্রথম মূর্তিপূজা বিশ্বাস করতেন না, রাখাল মহারাজকে তিনি বকাবকি করতেন : এ কি ? তুমি ব্রাহ্মসমাজের সভ্য, প্রতিমাকে প্রণাম করছ ? ঠাকুর জানতে পেরে স্বামীজীকে বলছেন : দেখ, ওর যদি মূর্তিপুজোতে বিশ্বাস হয়ে থাকে, তবে কেন তুমি ওকে এভাবে তিরস্কার করছ ? কারও ভাবে আঘাত করতে নেই। একদিন ঠাকুর বললেন : রাখালের রাজবুদ্ধি আছে—ও একটা রাজত্ব চালাতে পারে। স্বামীজী বুঝে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে, বললেন : আজ থেকে ওকে আমরা ‘রাজা’ বলে ডাকব। সেই থেকে তাঁর নাম হল রাজা। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে ‘রাজা মহারাজ’ বা ‘মহারাজ’ বলতে স্বামী ব্রহ্মানন্দকেই বোঝায়। স্বামীজী যখন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করলেন তখন রাজা মহারাজকে করলেন সভাপতি। বিদেশে স্বামীজীকে ভক্তরা যত টাকাকড়ি দিয়েছিলেন সে সব তিনি এনে স্বামী ব্রহ্মানন্দের হাতে তুলে দিলেন, বললেন : এ তোমার জিনিস, আমি এতদিন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এবার তোমাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দ সম্বন্ধে বলতেন : আধ্যাত্মিকতায় ও (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) আমাদের সকলের বড়। আমেরিকা থেকে ফিরে স্বামীজী রাজা মহারাজকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করছেন, বলছেন ; গুরুবৎ গুরুপুত্রেষু—গুরুর পুত্র গুরুর মতোই সম্মানীয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দও কিরকম প্রত্যুৎপন্নমতি—সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বলছেন : জ্যেষ্ঠভ্রাতা সম পিতা। স্বামীজী বয়সে কয়েকদিন বড় ছিলেন ওঁর থেকে—তাই বলছেন, বড় ভাইও পিতার মতোই সম্মানের যোগ্য। কত কাহিনী ! অপূর্ব কাহিনী সব ! আর কী ভালবাসা দুজনের মধ্যে ! স্বামীজী বলতেন : আমাকে সবাই ছাড়তে পারে, কিন্তু রাজা আমাকে কখনও ছাড়বে না। আর দুনিয়ায় কেউ যদি আমার গালাগালি সহ্য করে থাকে সে একমাত্র রাজা। স্বামীজী হয়তো কাজকর্ম নিয়ে রাজা মহারাজকে বকেছেন। পরক্ষণেই আবার অনুশোচনা ! রাজা মহারাজকে গিয়ে বলছেন ; রাজা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, তোমায় গালাগালি করেছি ! রাজা মহারাজ বলছেন : তাতে কি হয়েছে ? আমাকে ভালবাস বলেই তো বকেছ ! এরকম ভালবাসা দুজনের মধ্যে। যখন স্বামীজীর দেহত্যাগ হল, রাজা মহারাজ বলেছিলেন : সামনে থেকে যেন হিমালয় পাহাড় অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাজা মহারাজ তো ঠাকুরের মানসপুত্র—ঠাকুরের সাথে তাঁর অনেক সাদৃশ্য। সাদৃশ্য বলতে শুধু চেহারার সাদৃশ্য বলছি না—প্রকৃতিগত সাদৃশ্যও ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব, তাঁর চালচলন, তাঁর আচার-আচরণ, তাঁর চরিত্র সবকিছুর প্রতিফলন স্বামী ব্রহ্মানন্দের মধ্যে দেখা যায়। তাঁর ত্যাগী-সন্তানদের সবার মধ্যেই অবশ্য দেখা যায়—তবে বিশেষভাবে দেখা যায় ব্রহ্মানন্দের মধ্যে। ঠাকুরের মুহুর্মুহুঃ ভাব হত—মহারাজেরও হত। প্রায় সবসময়ই উনি আত্মস্থ হয়ে থাকতেন। মঠে অনেক সময় সাধু-ব্রহ্মচারীরা ঠাকুরঘরে না গিয়ে তাঁর ঘরে বসে ধ্যান করতেন। মহারাজকে দেখছেন সামনে। ধ্যানের একটা জীবন্ত রূপ দেখতে পাচ্ছেন। তাই সেখানে বসে ধ্যান করলে তাঁদের আরও ভাল ধ্যান হত। মহারাজের মন প্রায় সবসময়ই অন্তর্মুখী থাকত। চোখ অর্ধনিমীলিত। হয়তো তিনি ইজিচেয়ারে বসে গড়গড়ার নলটা হাতে ধরে রয়েছেন, কিন্তু তামাক পুড়ে যাচ্ছে। বাইরের জগৎটা দেখতে পাচ্ছেন না, মনটা অন্য রাজ্যে বিচরণ করছে। ঐ তামাকের সূত্র ধরে মনটাকে হয়তো একটু নীচে নামিয়ে আনলেন—ঠাকুর যেমন সমাধি ভাঙার সময় ‘জল খাব’ বলে মনটাকে নামিয়ে আনতেন। তখন দেখলেন, একঘর লোক সামনে বসে আছে। কতক্ষণ থেকে বসে আছে। —কিন্তু তিনি যেন নতুন দেখছেন তাঁদের, চট করে যেন চিনে উঠতে পারছেন না। তাঁর যে-সমস্ত ছবি আছে তাতেও এটা বেশ বোঝা যায়। চোখ দেখেই মনে হয় যে, অন্যরকম দৃষ্টি, আমাদের মতো নয়। চোখ খোলা—কিন্তু বহুদূরে কি যেন তিনি দেখছেন। জগৎকে ছাড়িয়ে জগতাতীতকে দেখছেন তিনি। ঠাকুর যে ‘ফ্যালফেলে’ দৃষ্টির কথা বলেছেন ‘কথামৃতে’, সেই দৃষ্টি।

একসময় বড় বড় ওস্তাদ সব স্বামী ব্রহ্মানন্দকে গান শোনাবেন বলে বেলুড়মঠে যেতেন। গান বুঝতেন ভাল। ওস্তাদ তাঁকে গান শোনাচ্ছেন আর তিনি ইজিচেয়ারে বসে আছেন। চোখ বুজে আছেন। গান শুনছেন কি শুনছেন না বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের যে গান, এ বই পড়া জিনিস তো নয়, এ অন্তরের সৃষ্টি। একজন ইংরেজ পণ্ডিত বলছেন, ভারতীয় সঙ্গীতের যে notation (স্বরলিপি) আমি লিখে নিচ্ছি, তার সঙ্গে গান মিলছে না। একই গান, একই notation —একজন একরকমভাবে করছেন, আবার আর একজন যখন গাইছেন, অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। আসলে গান প্রাণের সম্পদ। গায়কের ভাব, তাঁর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয় গানের মধ্যে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ চোখ বুজে বসে আছেন, তাঁর সামনে গান হয়ে যাচ্ছে। তিনি শুনছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু গানের এত সমঝদার তিনি যে, যখন একটা উৎকর্ষের মুহুর্ত আসত, সুর যখন প্রাণের সম্পদে পরিণত হত, তখন হঠাৎ তিনি চোখটা খুলে ঘাড়টা একটু দোলাতেন। সঙ্গীতশিল্পী মনে করতেন : আমি ধন্য। এই যে সৃষ্টিটা আমি করলাম, এ সাধারণ লোক হয়তো বুঝতে পারবে না, কিন্তু একজনও অন্তত বুঝতে পেরেছেন। আমার চেষ্টা সার্থক।

ঠাকুরের ত্যাগী বা গৃহী-সন্তানরা সবাই তাঁকে সত্যি সত্যিই ঠাকুরের ছেলে বলে মনে করতেন। সেই হিসাবে তাঁকে সম্মান ও আদরযত্ন করতেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ কয়েকদিনের জন্য মাদ্রাজে গেছেন। সেখানে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ আছেন। মাদ্রাজ মঠের ভার তাঁরই উপর দেওয়া আছে। ঠাকুরের সেবা-পুজোর ব্যাপারে অত্যন্ত গোঁড়া তিনি। একদিন একজন ভক্ত কিছু ফল এনেছেন ঠাকুরকে নিবেদন করতে। রামকৃষ্ণানন্দ সব ফল নিয়ে গিয়ে মহারাজকে (স্বামী ব্রহ্মানন্দকে) দিচ্ছেন। সবাই অবাক ! —ঠাকুরের জন্য ফল আনা হল, সেই ফল মহারাজকে দিয়ে দিলেন ? রামকৃষ্ণানন্দ বললেন : মহারাজ খেলে ঠাকুরেরই খাওয়া হল। মহারাজ ঠাকুরের পুত্র, পুত্র খেলে পিতারই খাওয়া হয়। গিরিশ ঘোষের সন্দেহ হয়েছে : সত্যিই কি ঠাকুর অবতার ? ঠাকুর তখন স্থূলশরীরে নেই। এতদিন নিজেই জোর গলায় প্রচার করে বেড়িয়েছেন : শ্রীরামকৃষ্ণ যে অবতার, তোমরা এই গিরিশ ঘোষকে দেখে বিশ্বাস কর ! কি ছিলাম, কি হয়েছি ! কে ঘটাল এই অলৌকিক কাণ্ড ? —শ্রীরামকৃষ্ণ। তাই তাঁকে আমি অবতার বলছি। —এত বিশ্বাস ! কিন্তু হঠাৎ সন্দেহ এসে গেছে—সত্যি সত্যিই তিনি অবতার ছিলেন তো ? প্রচণ্ড মনোবেদনা হচ্ছে : কেন আমার এরকম হল ? অনেকে এলেন তাঁর কাছে। ঠাকুরের সন্তানরা অনেকে এলেন—কিন্তু ঐ সন্দেহ, ঐ অবিশ্বাস আর যায় না। শেষে রাজা মহারাজ এলেন। তিনি এলেন, কি দু-একটা কথা বললেন, ব্যস্‌, সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল। আবার সেই বিশ্বাস। গিরিশ ঘোষ বলছেন : এ একমাত্র রাজাই পারে, আর কেউ পারে না।

একটা ঘটনা বলছি, বোঝা যাবে শ্রীশ্রীমা কিভাবে দেখতেন তাঁকে। আবার শ্রীশ্রীমাকে তিনি কি চোখে দেখতেন সেটাও একটু বোঝা যাবে এ থেকে। অদ্ভুত একটা চিত্র, ভাবতে ভাল লাগে। আমাদের একজন স্বামীজী (স্বামী বিজয়ানন্দ—পশুপতি মহারাজ) সেই সময় উপস্থিত ছিলেন, তাঁর কাছে শোনা। তিনি রাজা মহারাজের নাম শুনেছেন—তখনও দেখেননি। এক বন্ধুর কাছে শুনলেন, রাজা মহারাজ অমুক তারিখে অমুক ট্রেনে ভুবনেশ্বর যাবেন, হাওড়া স্টেশনে ঐসময় গেলে তাঁর দেখা পাওয়া যাবে। ঐদিন ঐসময় তিনি হাওড়া স্টেশনে গেছেন। এদিকে শ্রীশ্রীমাও ঐ একই দিনে, একই সময়ে হাওড়া স্টেশনে এসেছেন। জয়রামবাটী যাচ্ছেন—হাওড়া থেকে ট্রেনে করে বিষ্ণুপুর যাবেন। ইনি শ্রীশ্রীমার কথা জানেন না। মহারাজের জন্য অপেক্ষা করছেন। মহারাজ এলেন গাড়ি করে। কুচবিহারের মহারাজার বিরাট সাদা রঙের রোলস রয়েস গাড়িতে চেপে তিনি এলেন। স্টেশনে ঢুকে নিজের গাড়ির দিকে না গিয়ে সোজা গেলেন মা-র গাড়ির কাছে। ইনিও যাচ্ছেন পিছনে পিছনে। মহারাজ যাচ্ছেন মাকে প্রণাম করতে, আর কাঁপছেন। মা-র কমপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপরে একেবারে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ; প্ল্যাটফর্মের উপরে কত ময়লা, কত ধুলো—সেদিকে কোন খেয়াল নেই। প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়েছেন আর মা বলছেন : বাবা, ভুবনেশ্ববে যাচ্ছ, সাবধানে থেকো। জল ফুটিয়ে খেও কিন্তু। মা তো—ছেলে যতই বড় হোক, মা তাকে চিরকালই মনে করে শিশু। আর স্বামী ব্রহ্মানন্দ ? ‘হ্যাঁ মা, হ্যাঁ মা’ বলতে বলতে পিছনে হাঁটছেন ! মা-র দিকে পিছন ফিরে নয়—মা-র দিকে চোখ রেখে হাতজোড় করে পিছিয়ে যাচ্ছেন। কী অদ্ভুত সম্পর্ক ! ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। শ্রীশ্রীমাও তাঁকে ঠাকুরের মানসপুত্র হিসেবে দেখতেন। একবার মা কাশীতে সব ত্যাগী-সন্তানদের একটা করে কাপড় দিয়েছেন। রাজা মহারাজও তখন কাশীতে আছেন। অন্য সবাইকে সাধারণ সুতির কাপড় দিয়েছেন, কিন্তু রাজা মহারাজকে দিয়েছেন রেশমী কাপড়। একজন জিজ্ঞেস করেছেন : কেন এরকম তফাত করলেন ? মা উত্তর দিচ্ছেন : ‘রাখাল যে ছেলে।’ সবাই তাঁর সন্তান। কিন্তু রাজা মহারাজ ঠাকুরের মানসপুত্র। তাই তাঁকে একটু বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতেন। মা বলতেন : রাখাল সাক্ষাৎ নারায়ণ। একদিন ভানুপিসী* রসিকতা করে রাখাল মহারাজকে একটা ছড়া বলেছেন। কৃষ্ণের সম্বন্ধে ছড়া। তিনি তো ব্রজের রাখাল, কৃষ্ণসখা তিনি। কৃষ্ণকে মনে পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভাবস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেক চেষ্টা করে তাঁর সেই ভাব ভাঙানো হল। তখন মা বলেছিলেন ভানুপিসীকে : পিসী, তুমি তো সামান্য নও। যে রাখাল মহাসাগর, তাকেও তুমি তোলপাড় করে দিলে ? রাজা মহারাজকে বলছেন ‘মহাসাগর’। এত শক্তিধর পুরুষ তিনি!

রাজা মহারাজের চরিত্রের আর একটা দিক উল্লেখ করে তাঁর প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই। সেটা হচ্ছে তাঁর রসিকতা। এমনিতে খুব গুরুগম্ভীর। কিন্তু স্বামীজীর মতো তিনিও নানারকম রঙ্গরস করতেন। মঠে আছেন মহারাজ। একদিন মহারাজের একটু বদহজম হয়েছে। সেবককে বললেন : রাত্রে তিনি কিছু খাবেন না। সেবক হচ্ছেন, স্বামী নির্বাণানন্দ* (সুয্যি মহারাজ)। মহারাজের জন্য কিছু সন্দেশ রাখা ছিল। সেটা তিনি মহারাজের ঘরের পাশের ঘরে একটা পাত্রে চাপা দিয়ে রেখেছেন, পরদিন মহারাজের শরীর ভাল থাকলে তাঁকে দেবেন। পরদিন সকালে বাবুরাম মহারাজ এসেছেন মহারাজের খোঁজখবর নিতে। মহারাজ বাবুরাম মহারাজকে বলছেন—ছোট ছেলে যেভাবে নালিশ করে, ঠিক সেইভাবে—দেখ না, আমার খিদে পেয়েছে, অথচ আমাকে এখনও কিছু খেতে দেয়নি। বাবুরাম মহারাজ ডেকেছেন সুয্যি মহারাজকে : এ কী ! এখনও মহারাজকে কিছু খেতে দাওনি। সুয্যি মহারাজ তাড়াতাড়ি ছুটে গেছেন পাশের ঘরে সন্দেশ আনতে। ঢাকা খুলে দেখেন, একটাও সন্দেশ নেই। এদিক-ওদিক খুঁজলেন, কোথাও নেই। অথচ আর কিছু নেইও যে দেবেন। এদিকে দেরি দেখে বাবুরাম মহারাজ ডাকছেন সুয্যি মহারাজকে। সুয্যি মহারাজ গিয়ে বললেন সব কথা। বাবুরাম মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন : ঢাকা দেওয়া ছিল তো ঠিক ? বেরাল-টেরাল আসেনি তো ? রাজা মহারাজ তখন বলছেন : হ্যাঁ বাবুরামদা, খুব বড় একটা বেরাল এসেছিল। বেরালটা এসে ঢাকা খুলে সব সন্দেশ খেয়ে আবার ঢাকাটা ঠিকমতো বসিয়ে চলে গেছে। ‘বড় বেরাল’ বলার সময় নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। অর্থাৎ উনিই সব সন্দেশগুলো খেয়ে রেখেছেন। ভোরবেলায় খুব খিদে পেয়েছিল, তখন চুপি চুপি গিয়ে সব সন্দেশ খেয়ে ফেলেছেন।

একদিন সকালবেলা মহারাজ মঠের জমিতে পায়চারি করছেন। এমন সময় একটি ছেলে এসে তাঁকে বলেছে : আমি সাধু হব, স্বামী ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে দেখা করতে চাই। মহারাজ বুঝলেন, এ তাঁকে চেনে না ; একটু মজা করা যায় তাহলে। বললেন : ‘ঐদিকে যাও, দেখবে টেবিলের পাশে একজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট বসে আছেন, উনিই হচ্ছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ।’ ছেলেটি গিয়ে মহাপুরুষ মহারাজকে প্রণাম করে বলেছে : আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মহাপুরুষ মহারাজ বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছেন কিছু গোলমাল আছে, জিজ্ঞেস করলেন : ‘যার কাছে এসেছ তার নাম কী ?’ ‘স্বামী ব্রহ্মানন্দ’। ‘স্বামী ব্রহ্মানন্দ ঐ মাঠে বেড়াচ্ছেন।’ ‘আজ্ঞে তিনি বলে দিলেন আপনিই স্বামী ব্রহ্মানন্দ।’ না, আমি নই, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ঐ মাঠে বেড়াচ্ছেন।’ ছেলেটি আবার গেছে মহারাজের কাছে। মহারাজ বলছেন : ‘না না, আমি নই ; মহাপুরুষরা অনেক ছলনা করে থাকেন, তোমাকে ধরা দিচ্ছেন না ; আবার গিয়ে তাঁকে ধর, কিছুতেই ছাড়বে না।’ আবার সে গেছে মহাপুরুষ মহারাজের কাছে। মহাপুরুষ মহারাজ এবার তাকে খুব করে বকে দিয়েছেন। আবার এসেছে সে মহারাজের কাছে। মহারাজ বলছেন : ‘তোমাকে তো বললুম, মহাপুরুষরা ছলনা করে থাকেন, এমনকি মারধর পর্যন্ত করেন, তুমি তাতেও ছাড়বে না, পা আঁকড়ে পড়ে থাকবে।’ ছেলেটির কিন্তু আর সাহস নেই যে মহাপুরুষ মহারাজের কাছে যায়। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার। তখন মহারাজ বললেন ; ‘আচ্ছা, ওখানে যাও, তুমি এখন মঠে থাকবে।’ —এইরকম মজা করতেন তিনি। আর বাচ্চাদের খুব ভালবাসতেন। তাদের সাথেও নানারকম মজা করতেন। একদিন বলরামবাবুর বাড়িতে আছেন মহারাজ। সেই বাড়িতে তখন বেশ কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে আছে। মহারাজ বলে পাঠিয়েছেন সব বাচ্চাকে তাঁর ঘরে পাঠিয়ে দিতে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মহারাজ অন্ধকারের মধ্যে একটা ভালুকের চামড়া গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাচ্চারা তাঁর ঘরে এসে তাঁকে দেখেই ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। একটি ছেলে কিন্তু পালাল না। মহারাজ তাকে খুব স্নেহ করতেন। ভয়ে তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে—তবু সে দু-হাত বাড়িয়ে মহারাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর বলছে : ‘আমি জানি তুমি মহারাজ।’ মহারাজ তখন ভালুকের সাজ খুলে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন। রঙ্গরসের ব্যাপারে তাঁর মাথা থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব বুদ্ধি বের হত।

মহারাজের জন্মদিনে এখনও মঠে একটা খাবার দেওয়া হয়—উইলিয়াম ভট্‌। মহারাজের নামকরণ সেটা। উইলিয়াম ভট্‌টা কি জিনিস ? —ওনাকে হয়তো যা খেতে দেওয়া হয়েছে, সব খেতে পারেননি—ফল, দুধ, মিষ্টি কিছুটা হয়তো রয়ে গেছে। সেসব তিনি তখন একটা বাটিতে একসাথে মিশিয়ে নিজে একটু চেখে দেখতেন, তারপর অন্যদেরও দিতেন। এই জিনিসটার তিনি নাম দিয়েছিলেন উইলিয়াম ভট্। আবার আছে ‘মোগলাই চা’। চা-এর পাতা দুধে ভিজিয়ে চা হবে—জলে ভিজিয়ে নয়। আর তার মধ্যে নানা রকমের মশলা—জাফরান, লবঙ্গ, এলাচ ইত্যাদি দেওয়া হবে। এই হচ্ছে ‘মোগলাই চা’। তাঁর রঙ্গরসের আর একটা ঘটনা বলি। একবার তিনি উড়িষ্যার কোঠারে আছেন। স্বামী আখণ্ডানন্দকে ডেকে পাঠিয়েছেন সারগাছি থেকে। সেখানে অখণ্ডানন্দ অনাথ-আশ্রম চালান, খুব কষ্ট করে থাকেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাই অখণ্ডানন্দকে বলেছেন : তুমি এস, এখানে কয়েকদিন বিশ্রাম করবে। অখণ্ডানন্দ এসেছেন তাঁর কাছে। খুব হাসিঠাট্টা গল্প চলছে নিজেদের মধ্যে। এঁরা যখন সব একত্র হতেন, তখন মনে হত যেন কয়েকটি স্কুলের ছেলে একসাথে জড়ো হয়েছে। আমি নিজেই এরকম দৃশ্য দেখেছি—স্বামী অভেদানন্দ আর স্বামী অখণ্ডানন্দকে—একজন আর একজনকে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন : সেই সেবারের কথা মনে আছে ? সেবারে এই এই হয়েছিল না ? দুজনে কত মজার গল্প করছেন। এঁরা দুজনেও নিজেদের মধ্যে খুব আনন্দ করছেন—স্বামী ব্রহ্মানন্দ আর স্বামী অখণ্ডানন্দ। কিন্তু অখণ্ডানন্দ কেবলই পালাই পালাই করেন : আমাকে ছেড়ে দাও, অনেক কাজ সেখানে। ছেলেরা সব রয়েছে, কে দেখবে তাদের। ব্রহ্মানন্দও কিছুতেই ছাড়বেন না। আজ নয়, কাল, আজকে দিনটা খারাপ-নানারকম ছলছুতো করে ওঁকে আটকে রেখেছেন। একদিন অখণ্ডানন্দ যাবেনই ঠিক করেছেন। যাবে যদি যাও—স্বামী ব্রহ্মানন্দ বললেন। রাতের ট্রেন। পালকি করে স্টেশনে যেতে হয়। রাখাল মহারাজ ওঁকে খাইয়ে-দাইয়ে পাল্কিতে চাপিয়ে দিয়েছেন। স্বামী অখণ্ডানন্দ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে পাল্কিতে চেপেছেন। খাওয়ার পর তো—একটু বোধহয় ঢুলুনিও এসেছে। পাল্কি-বাহকেরা তাঁকে এদিক-সেদিক খুব ঘুরিয়েছে। স্বামী অখণ্ডানন্দ দেখছেন, দূরে একটা বাড়ি, বেশ আলো জ্বলছে। ভাবছেন, এটাই বোধহয় স্টেশন হবে। ঠিক বুঝতে পারছেন না কোথায় যাচ্ছেন। খানিক পরে পরিচিত কণ্ঠে শুনলেন : এই যে ভাই, তুমি ফিরে এলে তাহলে। দেখেন যে, স্বামী ব্রহ্মানন্দ আলো নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। অর্থাৎ পাল্কিওয়ালাদের কখন তিনি চুপি চুপি বলে দিয়েছিলেন অখণ্ডানন্দজীকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে আবার সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। অখণ্ডানন্দজী তো খুব চটে গেলেন : এ তোমাদের ভারী অন্যায়। তোমরা বোঝ না কিছু, কত কাজ। রাজা মহারাজ বললেন : তা আমি কি করব, তোমাকে তো আমি বিদায় দিয়েছিলাম, তুমি নিজেই তো আবার ফিরে এলে—এরকম রঙ্গরসপ্রিয় ছিলেন তিনি। কত মজার মজার গল্প রয়েছে তাঁর সম্বন্ধে। তাঁর মনটা সবসময় উঁচুতে উঠে থাকত, অর্থাৎ ভাবসমাধিতে ডুবে থাকত। কিন্তু ভাবসমাধিতে মন সবসময় থাকলে শরীর টেকে না। তাই তাঁর গুরুভাইরা এবং অন্যান্য সাধুরা চেষ্টা করতেন তাঁর মনটাকে নীচের দিকে টেনে রাখতে। এই সব রঙ্গরস তাতে সাহায্য করত। রামকৃষ্ণ মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় পঁচিশ বছর তিনি তার সভাপতি ছিলেন—১৯২২ সাল পর্যন্ত। ঐ যে ঠাকুর বলেছিলেন ‘রাজবুদ্ধি’ আছে—সেকথা প্রমাণ করেছিলেন। সুষ্ঠুভাবে এই সঙ্ঘকে চালিয়েছেন। সঙ্ঘের বিস্তার করেছেন। সঙ্ঘের তখন শৈশব-অবস্থা। আর্থিক কষ্ট, রাজরোষ—আরও কত রকমের অসুবিধে। সবকিছুর মধ্যে ধীর স্থির প্রশান্ত। সঙ্ঘকে একটা দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। আবার সঙ্ঘগুরুরূপে কত মানুষকে কৃপা করেছেন তিনি। নিঃশ্রেয়সের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁদের।

এবার একটু গৃহী-সন্তানদের সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করি। গৃহী-সন্তানদের মধ্যে ভবনাথ আর পূর্ণকে ঠাকুর ঈশ্বরকোটি বলেছেন। ভবনাথ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি গুপ্তযোগী ছিলেন। গার্হস্থ্যজীবন যাপন করেও তিনি সন্ন্যাসীর মতন ছিলেন। পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, তাঁর সম্বন্ধে ঠাকুর খুব বড় কথা বলেছেন। বলেছেন যে, নরেনের যে ঘর ওরও সেই ঘর—সেই ঘরে নরেনের ঠিক পরেই ওর স্থান। মাস্টারমশাই আর বলরাম বসুর সম্বন্ধে বলেছেন যে শ্রীচৈতন্যের সাঙ্গোপাঙ্গদের সাথে তাঁদের দেখেছেন। মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন : তোমার চৈতন্যভাগবত পড়া দেখে তোমায় চিনেছি। তাঁকে দিয়ে ‘কথামৃত’ লেখালেন ঠাকুর। ঠাকুরের সঙ্গে যেসব কথোপকথন হত, তা তিনি ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। তখন বই হিসেবে বের করবেন ভাবেননি। নিজের জন্য লিখে রাখতেন। নিজে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। পরে জানাজানি হয়ে গেল। সবাই বলল ; এ জিনিস ছাপানো উচিত। অপূর্ব সম্পদ ! সকলের মধ্যে এ ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। ছাপালেন তিনি। শ্রীশ্রীমা আশীর্বাদ করলেন ; ‘কথামৃত’ পাঠ শুনে মনে হল ঠিক যেন ঠাকুরই কথা বলছেন। এর চেয়ে বড় সার্টিফিকেট আর কি হতে পারে ? স্বামীজীও খুব প্রশংসা করেছিলেন। আরও অনেকে প্রশংসা করেছিলেন। আজ ঘরে ঘরে ‘কথামৃত’ ছড়িয়ে পড়েছে। নিঃসন্দেহে তিনি ভাগ্যবান পুরুষ। কারণ, সবাই তাঁর যন্ত্র হলেও যে যন্ত্রকে তিনি তাঁর কাজের জন্য বেশী ব্যবহার করেন, সেই যন্ত্র নিশ্চয়ই ধন্য। সেই হিসেবে ‘শ্রীম’ বিশেষ ভাগ্যবান পুরুষ।

আবার আর এক ভাগ্যবান পুরুষ হচ্ছেন বলরাম বসু। ভাগ্যবান এই জন্যে যে ঠাকুর যখন কলকাতায় আসতেন তখন এঁর বাড়িতেই উঠতেন। বলরাম বসুর বাড়িকে ঠাকুর বলতেন, তাঁর ‘দ্বিতীয় কেল্লা’। বলতেন : বলরামের অন্ন শুদ্ধ অন্ন। তাঁর বাড়ি এখন রামকৃষ্ণ মঠের অন্তর্ভুক্ত। এই বলরামমন্দিরে ঠাকুর কত লীলা করেছেন। ‘কথামৃতে’ তার কিছু কিছু বর্ণনা আছে। এক জায়গায় ‘শ্রীম’ বর্ণনা করছেন : ‘ধন্য বলরাম ! তোমারই আলয় আজ ঠাকুরের প্রধান কর্মক্ষেত্র হইয়াছে। কত নূতন নূতন ভক্তকে আকর্ষণ করিয়া প্রেমডোরে বাঁধিলেন, ভক্তসঙ্গে কত নাচিলেন, গাইলেন। যেন শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীবাসমন্দিরে প্রেমের হাট বসাচ্ছেন ?’ পুঁথিকার* তাঁর সম্বন্ধে বলছেন :

বিনয়েতে সদা নত ভূমির উপরে ॥

হাসিমাখা ধীরি কথা কভু উচ্চ নয়।

নানা গুণে অলঙ্কৃত হৃদয়-নিলয় ॥

ঘটে কত ভক্তিভরা নহে বলিবার।

তারপরে আবার বলছেন ;

শ্রীপ্রভুর লীলামধ্যে যত ভক্তে জানি।

ভক্ত বলরামে এক অগ্রগণ্য মানি ॥

ভক্তমধ্যে যদ্যপিহ ছোট বড় নাই।

বেশী কৃপা যেইখানে তাঁরে বড় গাই ॥

ভক্তের মধ্যে ছোটবড় নেই। আমরা সে বিচার করতে পারি না। কি করে করব ? বেগুনওয়ালা হীরের দর বলতে পারে না। তবে যদি দেখি, কারও প্রতি প্রভুর বিশেষ কৃপা, তাহলে বুঝতে পারি যে, সে উঁচু আধার। সেই দিক দিয়ে দেখলে বলরাম বসু নিশ্চয়ই বড় আধার, কারণ তাঁর উপর শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ কৃপা। যখন বলরাম বসুর স্ত্রী খুব অসুস্থ, শ্রীশ্রীমাকে ঠাকুর বলছেন, তাঁকে দেখে আসতে। শ্রীশ্রীমা বলছেন : যাব কিসে ? গাড়ি-পাল্কি কিছু নেই। ঠাকুর বলছেন : সে কী ! আমার বলরামের সংসার ভেসে যাচ্ছে আর তুমি এরকম বলছ ? হেঁটে যেতে হলেও যাবে। এত ভালবাসা বলরাম বসু এবং তাঁর পরিবারের প্রতি। স্বামীজী এবং অন্যান্য গুরুভাইরাও খুব শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন তাঁকে। যখন তাঁর দেহত্যাগ হয়, তখন স্বামীজী পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। তিনি সংবাদ পেয়ে কাঁদতে লাগলেন। একজন বলছেন : সন্ন্যাসী হয়েও আপনি কাঁদছেন ? মৃত্যু হয়েছে একজনের তো কি হয়েছে ? তখন স্বামীজী বলছেন : সাধু হয়েছি বলে কি আমার বুকটা পাষাণ হয়ে গেছে ? আমি কাঁদব না ? এমন একজন ভক্ত, আমাদের এমন একজন গুরুভাই চলে গেল—আমি কাঁদব না ?

আর একজন অদ্ভুত ভক্ত নাগমশায়। পূর্ববঙ্গের লোক, ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ গ্রামে থাকতেন। ডাক্তার ছিলেন। ঠাকুরের কাছে যেদিন এলেন, সেদিন শুনলেন ঠাকুর বলছেন : অতটুকু একটা ডাক্তারী-বাক্সের মধ্যে যাদের মন পড়ে থাকে, তারা কি করে বিরাট ঈশ্বরকে ধারণা করবে ? সেদিনই বাড়ি ফিরে ডাক্তারী-বাক্স পুকুরের জলে ফেলে দিলেন। দীনতার প্রতিমূর্তি ছিলেন নাগমশায়। গিরিশ ঘোষ এক জায়গায় খুব সুন্দর তুলনা করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ আর নাগমশায়ের। বলছেন : মায়া দুজনকে বাঁধতে পারেনি—স্বামীজীকে আর নাগমশায়কে। স্বামীজী বড় হতে হতে এত বড় হলেন যে মায়া তার দড়ি দিয়ে তাঁকে আর বাঁধতে পারল না—মায়ার দড়িতে কুলাল না। আর নাগমশায় ছোট হতে হতে এত ছোট হয়ে গেছেন যে, মায়ার দড়ির ফাঁক দিয়ে তিনি গলে বেরিয়ে গেলেন। মায়া তাঁকেও বাঁধতে পারল না। বিবাহিত ছিলেন নাগমশায়। কিন্তু সাধারণ সংসারীদের সঙ্গে তাঁর বিরাট তফাত। অনাসক্ত হয়ে সংসারে ছিলেন। সবসময় ঈশ্বরে নির্ভর করে থাকতেন। আর কী ভক্তি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি ! ঠাকুরের শেষ অসুখের সময় আমলকী খেতে চেয়েছেন ঠাকুর। আমলকীর সময় নয় সেটা—আমলকী পাওয়া যাবে না। কিন্তু নাগমশায় বেরিয়ে পড়লেন আমলকীর খোঁজে। তিন দিন চান নেই খাওয়া নেই—কোথা থেকে খুঁজে খুঁজে সেই আমলকী এনে ঠাকুরকে দিলেন। শ্রীশ্রীমাকেও খুব ভক্তি করতেন। একবার মায়ের জন্য এক ঝুড়ি আম নিয়ে এসেছেন। সে আম দিয়েছেন মাকে। মা তারপর প্রসাদ দিয়েছেন তাঁকে। কিন্তু কে খাবে ? তাঁর দেহজ্ঞানই নেই। প্রসাদী একটুকরো আম শুধু মাথায় ঘষছেন। আর একবার বাগবাজারে মায়ের কাছে এসেছেন, প্রসাদ খেয়ে সেই শালপাতাটাও খেয়ে ফেলেছেন, কারণ তাতে মা-র প্রসাদ ছিল। মা-র কাছে যখন যেতেন তখন নিজেকে স্থির রাখতে পারতেন না। ভাবে-আবেগে থরথর করে কাঁপতেন। একবার মা নিজ হাতে তাঁকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। মা একটা কাপড় দিয়েছিলেন তাঁকে। সেটা তিনি না পরে মাথায় জড়িয়ে রাখতেন। বলতেন : বাপের চেয়েও মা দয়াল। অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের চেয়েও শ্রীশ্রীমার বেশী দয়া। শ্রীশ্রীমা তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন : কত ভক্তই আসছে, কিন্তু এঁর মতো একটিকেও দেখলাম না। তাঁর জীবনে অনেক সুন্দর সুন্দর ঘটনা আছে। এমনিতে খুব দীনভাবে থাকতেন, কিন্তু প্রয়োজন হলে তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে পারতেন। একবার তাঁর গ্রামেরই একজন প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে এসে কিছু না জেনে শুধু শোনা কথার ভিত্তিতে ঠাকুরের নিন্দা করে যাচ্ছেন। নাগমশায় প্রথমে তাঁকে ভালভাবে নিষেধ করলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনবেন না—সমানে ঠাকুরের নিন্দা করে যাচ্ছেন। তখন তিনি রেগে গিয়ে সেই ভদ্রলোককে জুতো দিয়ে মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এই খবরটা গিরিশবাবুর কাছে পৌছে গেছে। নাগমশায়ের সাথে দেখা হতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন : আচ্ছা, আপনি তো মশায় কখনও জুতো পরেন না, তাহলে জুতো দিয়ে মারলেন কি করে ? নাগমশায় বললেন : কেন ? ওরই জুতো দিয়ে ওকে মেরেছি। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই ভদ্রলোক কিন্তু দু-একদিন পরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে নাগমশায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছিলেন। আর একবার অর্ধোদয়যোগ এসেছে। পুণ্যার্থীরা সব কলকাতায় আসছে গঙ্গাস্নান করবে বলে। উনি কলকাতায় ছিলেন, চলে গেলেন নিজের গ্রামে। বাবা তাঁকে তিরস্কার করে বললেন : সবাই কলকাতায় যাচ্ছে, আর তুই চলে এলি ? তিনি বললেন : বিশ্বাস থাকলে মা-গঙ্গাই ভক্তের বাড়িতে আসবেন। তারপর যখন সেই অর্ধোদয়যোগ এল, তখন হঠাৎ দেখা গেল, কোথা থেকে উঠোনের এক ধার দিয়ে জলের ফোয়ারা বেরুচ্ছে। গ্রামের লোক সবাই ছুটে এল সেই জল মাথায় দিতে। নাগমশায় নিজেও মাথায় দিলেন সেই জল। এই ঘটনার অনেকেই প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন সেদিন। স্বামীজী এই ঘটনার কথা শুনে বলেছিলেন : তার আর আশ্চর্য কি ? তিনি সিদ্ধসঙ্কল্প মহাপুরুষ। তাঁর মতো মহাপুরুষের ভক্তির জোরে এরকম হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। স্বামীজী বলতেন : গোটা পূর্ববঙ্গ নাগমশায়ের আধ্যাত্মিকতায় জ্বলজ্বল করছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁদের সবার জীবনেই বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু কারও কারও মধ্যে এমন স্বাতন্ত্র্য রয়েছে যে, অন্যদের সঙ্গে কোনমতেই মিলিয়ে ফেলা যায় না তাঁদের। যেমন, স্বামী বিবেকানন্দ। তেমনি একটি স্বতন্ত্র চরিত্র হচ্ছেন গিরিশ ঘোষ। গিরিশ ঘোষ শুদ্ধসত্ত্ব ভক্ত নন। বরং একেবারে বিপরীত। অত্যন্ত প্রতিভাবান। তীক্ষ্ণবুদ্ধি। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, প্রখ্যাত নাট্যকার, প্রখ্যাত অভিনেতা—কিন্তু নেশা করেন, আরও হয়তো অন্যায় কাজ করেন, কখন কি গালিগালাজ করবেন ঠিক নেই তার। নিজেই গর্ব করে বলেন ; এমন পাপ নেই যা আমি করিনি। অথচ আবার দেখছি কী অদ্ভুত ভক্তি, কী অদ্ভুত বিশ্বাস ! ঠাকুর বলতেন : পাঁচসিকে পাঁচআনা ভক্তি। ভক্তি যেন উপচে পড়ছে। তাঁর ‘চৈতন্যলীলা’ একসময় সমস্ত কলকাতাকে ভক্তিরসে প্লাবিত করে দিয়েছিল। এমন সুন্দর সুন্দর গান তাতে যে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। ভেতরে খুব গভীর ভক্তি-বিশ্বাস না থাকলে মানুষ সেইসব গান রচনা করতে পারে না। অথচ বাইরে মানুষটি অন্যরকম। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চরিত্র এই গিরিশ ঘোষ। তাঁর জীবনী পড়লে দেখা যাবে যে, প্রচুর নাটকীয় উপাদান আছে সেখানে। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা বোসপাড়ার দীননাথ বসুর বাড়িতে। ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় দেখেছিলেন : দক্ষিণেশ্বরে একজন পরমহংস আছেন, তাঁর কাছে কেশব সেন যান, অন্যান্য অনেক ব্রাহ্মরাই যান। একদিন শুনলেন, দীননাথ বসুর বাড়িতে সেই পরমহংস এসেছেন। গেলেন তাঁকে দেখতে। শ্রদ্ধা-ভক্তি যে কিছু ছিল, তা নয়—স্বাভাবিক একটা কৌতূহল শুধু। গিয়ে দেখলেন যে, কেশব সেনও সেখানে আছেন। সন্ধ্যা হয়েছে, একজন একটা আলো রেখে গেল সামনে। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন ভাবস্থ ছিলেন, বারবার জিজ্ঞেস করছেন : আচ্ছা, সন্ধ্যা হয়েছে ? কিন্তু গিরিশ ঘোষ তো তখন আর সেসব জানেন না। তিনি ভাবলেন : এ এক ঢং। বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে, সামনে আলো জ্বলছে, তবুও বুঝতে পারছেন না সন্ধ্যা হয়েছে কিনা !—তিনি আর সেখানে থাকার প্রয়োজন মনে করলেন না, চলে এলেন। মনে মনে একটা অশ্রদ্ধার ভাব নিয়েই এলেন। দ্বিতীয় বার দেখা হল, বলবাম বসুর বাড়িতে। কাছাকাছি বাড়ি দুজনের। শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছেন সেখানে। —গিরিশ ঘোষকেও নিমন্ত্রণ করেছেন বলরাম বসু। এবার বোধহয় ধারণা একটু পাল্টাল। কেননা, গিরিশ ঘোষের ধারণা ছিল, পরমহংসরা কারু সাথে কথা-টথা বলেন না, কাউকে নমস্কার করেন না—খুব অনুরোধ করলে কাউকে হয়তো পদসেবা করার অনুমতি দেন। কিন্তু এঁকে দেখলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। এই পরমহংস একেবারে বন্ধুর মতো কথা বলেন, নতুন কেউ এলে বারবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাঁকে নমস্কার করেন। দীনতার প্রতিমূর্তি যেন ! একটুও অহঙ্কার নেই। তৃতীয়বার ঠাকুর নিজেই গেছেন গিরিশ ঘোষের কাছে—স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে। গিরিশ ঘোষ তাঁকে নমস্কার করতে যাচ্ছেন, তার আগেই ঠাকুর তাঁকে নমস্কার করলেন। গিরিশ ঘোষ প্রতি-নমস্কার করলেন—আবার নমস্কার করলেন ঠাকুর। গিরিশ ঘোষ আবার প্রতি-নমস্কার করলেন, ঠাকুরও আবার নমস্কার করলেন। এইভাবে বেশ কয়েকবার চলল—নমস্কার আর প্রতি-নমস্কার। শেষে গিরিশ ঘোষ নিরস্ত হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের নমস্কারের কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন। পরে একসময় গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন : রামচন্দ্র তীর-ধনুক দিয়ে জগৎ জয় করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ জগৎ জয় করেছিলেন বাঁশি বাজিয়ে, আর শ্রীরামকৃষ্ণ জগৎ জয় করবেন প্রণাম-অস্ত্রে। কেন বলছেন ? কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণের কোন ঐশ্বর্য নেই। সব ঐশ্বর্য গোপন করে এসেছেন তিনি। তাঁর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অহংকার-শূন্যতা। বলছেন : আমি জানি যে, আমি কিছুই জানি না। আমি গুরু নই, আমি কিচ্ছু নই। আমি রেণুর রেণু। বস্তুত, এই দীনতা ছিল বলেই আজ তিনি জগৎপূজ্য। গিরিশচন্দ্র সেইজন্য বলছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জগৎ জয় করবেন প্রণাম-অস্ত্রে। ক্রমশ গিরিশচন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের আরও কাছে এলেন। শ্রীরামকৃষ্ণই তাঁকে কাছে টেনে নিলেন। ধীরে ধীরে তিনি বুঝলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ অবতার। আর যখন বুঝলেন, তখন একেবারে আত্মসমর্পণ। শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি বকলমা দিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই বলেছিলেন বকলমা দিতে। গিরিশ ঘোষ বলছেন : বকলমা দিয়ে ভেবেছিলাম যে, ব্যস্, আর কিছু করতে হবে না, এবার থেকে আমার হয়ে উনিই সব করবেন। কিন্তু এখন বুঝছি ঠিক ঠিক বকলমা দেওয়া কত কঠিন। প্রতি পদক্ষেপে চিন্তা করতে হচ্ছে : এই যে এটা করছি, এটা আমি অহংবুদ্ধি থেকে করছি, নাকি তাঁর উপরে নির্ভর করে করছি ? বকলমা না দিলে হয়তো সকাল-সন্ধ্যা দু-একবার তাঁর নাম করেই পার পেয়ে যেতাম। এখন দেখছি, সব-সময় তাঁর স্মরণমনন করছি। ঠাকুর তাঁকে বলছেন : ভক্ত ভৈরব। যোগ-ভোগ দুই-ই আছে। স্বামী অদ্বৈতানন্দ মহারাজ যখন ঠাকুরের সব ত্যাগী-সন্তানদের একটা করে গেরুয়া দিলেন, একটা কাপড় বেশী হল। ঠাকুর সেটা তুলে রাখলেন—গিরিশের জন্য।* একবার গিরিশ ঘোষ বললেন : ভাবছি, থিয়েটার ছেড়ে দেব। ঠাকুর নিষেধ করলেন : না, লোকশিক্ষা হয় ওতে। নিজেই গেছিলেন গিরিশ ঘোষের ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আশীর্বাদ করে বলেছিলেন : আসল-নকল এক দেখলাম। গিরিশ ঘোষ গর্ব করে বলতেন : আমি বাগবাজারের গিরিশ ঘোষ, এমন পাপ নেই যা করিনি। যদি জানতাম শ্রীরামকৃষ্ণ কৃপা করবেন, তাহলে আরও পাপ করে নিতাম। সত্যিই, গিরিশ ঘোষের সব পাপ শ্রীরামকৃষ্ণ নিয়েছিলেন। তিনি বলতেন : গিরিশের পাপ গ্রহণ করে আমার এই ব্যাধি (ক্যানসার)।

আরও কত ভক্ত আছেন ঠাকুরের। রাম দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, আরও কত জন। আবার মহিলা ভক্তরা আছেন—গোলাপ-মা, গৌরী-মা, গোপালের মা প্রমুখ। একদিকে নরেন, রাখাল প্রভৃতি ত্যাগী-সন্তান, অন্যদিকে গিরিশ ঘোষ, মাস্টারমশাই প্রভৃতি গৃহী-সন্তান, একদিকে পুরুষ-ভক্তরা অন্যদিকে স্ত্রী-ভক্তরা—সবাইকে নিয়ে ঠাকুরের একটা অদ্ভুত সমাজ। অবতারপুরুষ তো সকলের জন্য। সকলের এক-একটা ভূমিকা আছে। একথা আমরা বলতে পারি না যে গিরিশ ঘোষের কোন ভূমিকা নেই, রাম দত্ত বা সুরেন্দ্র মিত্রের কোন ভূমিকা নেই। সুরেন্দ্র মিত্র বরানগর মঠের বাড়ি ভাড়া দিতেন। আজকে যে বিরাট রামকৃষ্ণ মঠ-মিশন দেখছি, প্রথম গড়ে উঠেছিল তাঁর টাকায়। সেকথা সবাই আমরা জানি। গিরিশ ঘোষ কত ভাবে সাহায্য করেছেন মঠের ভাইদের। ঠাকুরের শেষ সময় টাকা পয়সার হিসেব নিয়ে গৃহী-ভক্তদের মধ্যে একবার মনোমালিন্য হয়েছিল। গিরিশ ঘোষ তখন বলেছিলেন : বাড়ির প্রতিটা ইট পর্যন্ত বিক্রি করে ঠাকুরের সেবা করব। রাম দত্ত কত ভাবে ঠাকুবের প্রচার করেছেন। তিনিই তো নরেন্দ্রনাথকে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। গৌরী-মাও কত ভাবে ঠাকুরের ভাব প্রচার করেছেন—বিশেষত মেয়েদের মধ্যে। স্বামীজী বিদেশ থেকে গৌরী-মার প্রশংসা করে চিঠি লিখেছেন। কাজেই সবারই এক-একটা ভূমিকা আছে। কারও কাঠবিড়ালীর ভূমিকা, কারও হয়তো খুব বড় ভূমিকা। সবাই স্বামী বিবেকানন্দ নন কিংবা সবাই নাগমশাই নন—কিন্তু সবাই অনন্যসাধারণ, সবার চরিত্রই আমাদের কাছে প্রেরণাস্বরূপ। এঁদের সকলের জীবনের কেন্দ্রে রয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। নিজের নিজের ক্ষেত্রে বসে তাঁরা যুগাবতারের লীলাপুষ্টি করেছেন। এঁদের মধ্যে যে-সম্পর্ক তা তো আজকের নয়—চিরকালের। যুগে যুগে ভগবানের সঙ্গে এঁরা এসেছেন, যুগে যুগে এঁরা ভগবানের সঙ্গে আসবেন। সত্যিই কলমীর দল, একটাকে টানলে সবটা এসে যায়।

আকর-তালিকা

 । ভক্তমাল, ৭ম মালা, দেব সাহিত্য কুটীর, ১৩৮৪

 । কুলার্ণবতন্ত্র, ৯/২৮

 । ঐ, ৯/৭৫

 । ঐ, ৯/৮১

 । লীলাপ্রসঙ্গ, ২য় ভাগ, ১৩৮৬, ‘ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ’, পৃঃ ১২২-২৩,

 । বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৩৮৩, পৃঃ ২৭২-৭৩

 । C. W., Vol. V, 1964, p. 136

 । Ibid., Vol. VIII, 1959, p. 349

* ঠাকুর মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন : ‘তোমায় চিনেছি—তোমার চৈতন্য ভাগবত পড়া শুনে। তুমি আপনার জন—এক সত্তা—যেমন পিতা আর পুত্র। এখানে সব আস্‌ছে—যেন কলমীর দল,—এক জায়গায় টানলে সবটা এসে পড়ে। পরস্পর সব আত্মীয়—যেমন ভাই ভাই।’ (কথামৃত, ৪-৮-২) শ্রীশ্রীমায়ের সূত্রেও জানা যায় : ‘ঠাকুর বলেছিলেন যে একশ বছর পরে আবার আসবেন। এই একশ বছর ভক্তহৃদয়ে থাকবেন। ⋯আমি বললুম, “আমি আর আসতে পারব না।” লক্ষ্মী বলেছিল, “আমাকে তামাককাটা করলেও আর আসব না।” ঠাকুর হেসে বললেন, “যাবে কোথা ? কলমীর দল, এক জায়গায় বসে টানলেই সব এসে পড়বে।” ‘ (মায়ের কথা, ২য় ভাগ, পৃঃ ৯৮)

** ব্যতিক্রম শুধু স্বামী অদ্বৈতানন্দ আর স্বামী অদ্ভুতানন্দ। স্বামী অদ্বৈতানন্দ প্রৌঢ় ছিলেন। বয়সে শ্রীরামকৃষ্ণের চেয়েও বড়। স্বামী অদ্ভুতানন্দ যুবক ছিলেন, কিন্তু ‘ছাত্র’ ছিলেন না। স্কুল-কলেজে তিনি কখনও পড়েননি।

* যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণে ‘আকাশবিহগঃ’ নামে একরকম পাখীর উল্লেখ আছে। ‘অন্তরিক্ষেহপি জায়ন্তে আকাশবিহগাদয়ঃ’—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ, উপশম প্রকরণম্‌, ৫/১৪/৩১ (বাসুদেব লক্ষ্মণ শাস্ত্রী পান্সীকার সম্পাদিত সংস্করণ অনুযায়ী)। এই শ্লোকাংশের একটি টীকায় শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত হোমাপাখীর বর্ণনাটি হুবহু লক্ষ্য করা যায় : ‘আকাশবিহগাঃ ক্ষুদ্ৰপক্ষিবিশেষান্তে হি সদা ভ্রমন্তোহন্তরিক্ষ এব প্রসূয়ন্তে প্রসূতং চাণ্ডমধঃপাতাৎ প্রাগেব ভিত্বা নিৰ্গতাঃ শাবকাঃ সদ্যঃ সংজাতপক্ষা অন্তরিক্ষমেবোৎপত্য) ভ্রমম্ভীতি লোকপ্রবাদপ্রসিদ্ধম্‌।’ (আনন্দবোধস্য তাৎপর্যপ্রকাশনামকটীকা) বঙ্গানুবাদ : আকাশবিহগ হল একরকম ছোট পাখী। তারা সবসময় আকাশেই উড়তে উড়তে প্রসূত হয় এবং প্রসূত অণ্ড বা ডিমটি নীচে মাটিতে পড়বার আগেই ফুটে যায় এবং তা থেকে নির্গত শাবকদের সঙ্গে সঙ্গেই পাখা গজিয়ে যায় আর তারা আকাশেই উড়ে উড়ে বেড়ায়—এটি লোকপ্রবাদে প্রসিদ্ধ।

* ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমার পূত-সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাঁর আসল নাম মানগরবিনী। পরবর্তীকালে তা প্রথমে মানু এবং পরে ভানুতে পরিণত হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি জয়রামবাটীতে মায়ের বাড়ির কাছেই। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। গ্রামসম্পর্কে তিনি ছিলেন মায়ের পিসী। মাকে তিনি একবার চতুর্ভুজারূপে দেখেছিলেন। মায়ের শরীররক্ষার কিছুদিন আগেই তিনি পরলোকগমন করেন।

* স্বামী ব্রহ্মানন্দের প্রিয় সেবক ও দীক্ষিত-সন্তান। মহাপ্রয়াণের আগে স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন ‘তোর ব্রহ্মজ্ঞান হবে।’ পরে স্বামী শিবানন্দও তাঁকে একই আশীর্বাদ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদদের পরবর্তীকালের রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাসে ইনি একজন উজ্জ্বল আধ্যাত্মিক জ্যোতিষ্ক। দুই ‘মহাপুরুষের’ ঐ দুর্লভ আশীর্বচন তাঁর জীবনে সার্থক হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘকাল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহাধ্যক্ষ পদে বৃত থেকে গুরুরূপে তিনি বহু নরনারীর আধ্যাত্মিক জীবনের ভাব গ্রহণ করেছেন। ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে চুরানব্বই বছর বয়সে তিনি দেহরক্ষা করেন।

* অক্ষয়কুমার সেন। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি’র রচয়িতা। শ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত। কাশীপুরে ঠাকুরের ‘কল্পতরু’ হওয়ার দিন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ঠাকুর তাঁকে মহামন্ত্র দিয়ে কৃপা করেন। স্বামীজী তাঁকে মজা করে ‘শাঁকচুন্নী মাস্টার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। স্বামীজী তাঁর রচিত ‘পুঁথি’র উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন।

* আর একমতে, ঐ গেরুয়া দেওয়া হয়েছিল ছোট গোপাল বা হুটকো গোপালকে। এ প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য : একবার মঠের সন্ন্যাসীরা স্বামীজীকে কুণ্ডল, বিভূতি, জটা, ত্রিশূল প্রভৃতির সাহায্যে যোগী সাজিয়েছেন। স্বামীজী কিছুক্ষণ সেই বেশে থাকবার পর নিজের বেশভূষা খুলে গিরিশ ঘোষকে যোগীর সাজে সাজিয়ে দিয়ে বললেন : ‘পরমহংসদেব (শ্রীরামকৃষ্ণ) বলতেন, “ইনি ভৈরবের অবতার।” আমাদের সঙ্গে এঁর কোন প্রভেদ নেই।’ (স্বামি-শিষ্য-সংবাদ, ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৮) এ থেকে মনে হয়, ঐ গেরুয়া সম্ভবত গিরিশ ঘোষই পেয়েছিলেন। স্বামী গম্ভীরানন্দজী প্রণীত ‘ভক্তমালিকা’ প্রথম ভাগে গিরিশ ঘোষের নামই দেওয়া আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *