কলতলার কাব্য

কলতলার কাব্য

বেশ জুতসই আহারের পর ওদের বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছিলাম যে, আমাদের রাজনৈতিক অবস্থাটা নিতান্তই শোচনীয়। নথ-সঞ্চালনে বিরক্তি প্রকাশ করিয়া ওরা বলিল, হ্যাঁ, তোমাদের আবদার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে; গাঁটের পয়সা খরচ করে সরকার বাহাদুর রাস্তায় রাস্তায় জলের কল পর্যন্ত করে দিলে, তবু তোমাদের মন পায় না! অনেক বুঝাইলাম যে, এক মাইল, আধ মাইলের মধ্যে এক-একটা কল বসাইয়া সরকার বাহাদুর জলপ্রার্থীদের মধ্যে কলহ-দ্বন্দ্বেরই সৃষ্টি করিয়াছে মাত্র, আর এই কলহ সৃষ্টিই সকল বিষয়ে সরকারের মূল নীতি; কিন্তু যেখানে যুক্তির নমুনা উক্তরূপ, সেখানে আর বৃথা বাক্যব্যয় করিয়া কি হইবে? বিশেষত যেখানে হারিয়াই খানিকটা তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেখানে জিতিবার জেদটাই বা করে কোন্ মূঢ়?

একটু নিশ্চিন্ত থাকিলে বাঙালী হয় রাজনীতি, না হয় কাব্যের আলোচনা করিয়া থাকে। প্রথমটিতে নিরুৎসাহ হইয়া আজ এই জলের কল সম্পর্কে যে একটা ব্যাপার ঘটিয়াছিল, তাহাই লিপিবদ্ধ করিতেছি।

টিটাগড়ের স্টেশনে এবং কোম্পানির চটকলের মাঝের সুদীর্ঘ রাস্তাটার মধ্যখানে সিংহমুখো একটা জলের কল বোধ হয় অদ্যাবধি দাঁড় করানো আছে। রাস্তাটার দুই পাশে এখন ছোট বড় অনেকগুলো বাড়ি উঠিয়াছে। কিন্তু পূর্বে, দীর্ঘান্তরালে দুই-একটা দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তখন যে কোনো সময়েই লক্ষ্য করিলে দেখা যাইত, কলটি দশ- বারোটি ঘড়া, বালতি ও অন্যান্য জলপাত্রে পরিবৃত—একটিতে ক্ষীণ ধারায় জল গড়াইয়া পড়িতেছে এবং কয়েকজন পশ্চিমা স্ত্রী ও পুরুষ বাংলার দুঃখ-কষ্ট ও নিজ নিজ মুল্লুকের সুখৈশ্বর্যের গল্প করিতেছে। একটা পাত্র ভরিয়া গেলে ‘ভাজা’ অর্থাৎ পালা লইয়া একচোট বচসা হইত। যে জিতিত সে-ই ন্যায়কে স্বপক্ষে করিয়া নিজ পাত্রটা জলের মুখে বসাইয়া দিত, এবং প্রায়শ দেখা যাইত, যাহার রূপা-গালার বিচিত্র চুড়িপরা হাতখানা বেশি খেলে বিজয়লক্ষ্মী সেই অঙ্গনারই সঙ্গিনী হইতেন।

দুপুরবেলায় এ দৃশ্যপট বদলাইয়া যাইত। তখন আর লোকের ভিড় থাকিত না। নিকটের নারিকেল বৃক্ষটা হইতে দুই-একটা রৌদ্রতপ্ত কাক নামিয়া আসিয়া, কলের শান ভাঙিয়া যেখানে যেখানে জল জমা হইয়াছে, সেখানে দুই-এক চুমুক জল পান করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিত। এই সময় প্রায়ই দেখা যাইত, কলসিটি মাথায় লইয়া একটা চৌদ্দ-পনরো বৎসরের পশ্চিমা মেয়ে দক্ষিণ দিকের একটা রাস্তা দিয়া মন্থর গতিতে আসিয়া কলতলায় উপস্থিত হইত। মুখের উপর তাহার এমন একটি কৌতুক-চঞ্চলতার ভাব ফুটিয়া থাকিত, যাহা দেখিলে স্বতঃই মনে হইত, কি গ্রীষ্ম, কি শীত, কি বর্ষা সকল ঋতুরই দিনগুলো দ্বিপ্রহরের এই সময়টা, তাহার নিকট বসন্তের আকারেই বর্তমান। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এত অসময়ে নিরিবিলিতে আসিলেও বেচারা নিরুপদ্রবে কখনও তাহার গাগরীখানি ভরিয়া লইতে পারিত না। কারণ, লোক না থাকিলেও তাহার আগমনের পূর্ব হইতেই কলের পাশে দুইটি ঘড়া বসানো থাকিত এবং সে আসিয়া কল টিপিলেই “আরে হামারা ভাজা, হামারা ভাজা” বলিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে একটা ছেলে ছুটিয়া উপস্থিত হইত; প্রথম প্রথম মেয়েটা কিছুই বলিত না। কলসিটি সরাইয়া লইবার ভঙ্গিমায় বিরক্তির লক্ষণ পরিস্ফুট করিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিত। ছেলেটা কলসিতে খানিকটা জল জমা হইলে সেই জল দিয়া কলসিটা উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া ধুইয়া লইয়া আবার ভর্তি করার জন্য বসাইয়া দিত। ইহাতে অসহিষ্ণুভাবে মুখটা ঘুরাইয়া লইয়া অর্ধস্ফুট স্বরে বালিকা বলিত, “ই সব হারামজাদগি।” ছেলেটা কোনাদিন মৃদু হাসিয়া সে বিরক্তিতে ইন্ধন যোগাইত। আর কোনোদিন বা সাফাই দিত, “আরে ভাই, গাগরী ধিপল বা, ধোই না?”

বচসাটা কোনো কোনো দিন বাড়িয়াও যাইত। মেয়েটা প্রশ্ন করিত, এতক্ষণ পর্যন্ত কলসিটা রোদে বসাইয়া রাখিতেই বা কে মাথার দিব্য দিয়াছিল? এ সবই হারামজাদগি। ছেলেটা উত্তর দিত, গুরমিন্টীকে রাজমে নিজের ইচ্ছা ও সুবিধা-মতো কাজ করিবার সকলেরই অধিকার আছে; যাহার না বনে, সে ঘরের ভিতর ঘোমটা টানিয়া বসিয়া থাকিলেই পারে। ইত্যাদি।

কিন্তু ছেলেটার অবাধ প্রতিপত্তি অধিক দিন চলিল না। একদিন ভাজা লইয়া গোলমাল করিতে গেলে বালিকা কলসিটা কলের মুখে চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “হাম না হটায়ব, দেখি কৌনাকে অখতিবার বা!” ছেলেটা হতভম্ব হইয়া গেল, মুখে বলিল, “আরে ই ঔরৎ, না জমাদার বা!” কিন্তু কার্যত কিছুই করিতে সাহস করিল না। মেয়েটা সেইরূপ জিদের সহিতই কলসিটা ভরিয়া লইয়া সেটা মাথায় বিড়া দিয়া বসাইয়া লইয়া গটগট করিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় কথা রাখিয়া গেল, “হাম হারামজাদগি তোড়ব, হাঁ!”

পরদিবস আসিয়া দেখিল, কলটাতে কলসির বালাই নাই। ঠোঁটে একটু বিজয়ের হাসি ফুটাইয়া বলিল, “হুঁ, বউয়া ডেরায়ল বাড়ন”; অর্থাৎ বাছাধন ভয় পেয়েছেন; তাহার পর ধীরেসুস্থে বেশ করিয়া মুখটা ধুইয়া রাঙা করিয়া মুছিল, আলগা টিকুলিটা আন্দাজে ভ্রু দুইটির মাঝখানে চাপিয়া বসাইয়া দিল এবং কলসিটা কলের মুখে বসাইয়া নারিকেল গাছের পাতলা ছায়ায় গিয়া বসিয়া রহিল। ছেলেটা তখনও আসিল না। তাহার আগমনের রাস্তায় এক- একবার নজর ফেলিয়া মেয়েটি বলিল, “আরে আইহন কাঁহাসে? হাম কি সে জানানী হতি?” অর্থাৎ আসিবেন কোথা হতে, আমি কি সেই মেয়েমানুষ?

কলসি ভরিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল; সে উঠিবার কোনো প্রয়াস করিল না। একটা খোলামকুচি লইয়া মাটিতে তাহার দেশী খেলার আঁকর কাঁটিতে লাগিল ও মাঝে মাঝে চোখ তুলিয়া এক-এক বার এদিক ওদিক দেখিয়া লইতে লাগিল। যখন প্রায় আধ কলসি জল পড়িয়া গিয়াছে, সে উঠিয়া গেল এবং “পানি সব ধিপ গইল বা” বলিয়া সমস্ত জলটা ফেলিয়া দিয়া আবার টাটকা ও ঠাণ্ডা জলের জন্য কলসিটা লাগাইয়া পূর্ববৎ গিয়া বসিয়া রহিল।

এমন সময় দেখা গেল, দুই হাতে দুইটা কলসি ঝুলাইয়া সেই হারামজাদা ছেলেটা আসিতেছে। দেখিতেই যা দেরি, মেয়েটা লড়াইয়ে মোরগের মতো উগ্রভাবে দাঁড়াইয়া উঠিল এবং ত্রস্তপদে কলে পৌঁছিয়া বিনাবাক্যবয়ে নিজের কলসিটা চাপিয়া ধরিয়া গ্রীবা বাঁকাইয়া ছেলেটার পানে স্পর্ধিত নেত্রে চাহিয়া রহিল; ভাবটা—আজ একচোট দেখিয়া লইবে সে।

ছেলেটা আস্তে আস্তে কলসি দুইটা শানের এক পাশে রাখিল এবং শান্তভাবে একটু হাসিয়া বলিল, “আজ তো আর ভাজার কথাই ওঠে না, তবে এত ভয় কেন? নাও, তুমিই ভরে নাও, আমি দাঁড়িয়ে দেখি।’

বালিকা তাহার মুখের দিকে একটু চাহিয়া রহিল, তাহার পর একটু অপ্রতিভের মতো কলসি ছাড়িয়া বলিল, “না না, সে কথা নয়, তবে অনেকটা যেতে হয়, আর এই রোদে—”

হাসিয়া ছেলেটা বলিল, “হ্যাঁ, তোমার বাসা আর দূর নয়! যে জানে না, তাকে বোঝাওগে; আমি এই শহরেরই লোক, মুন্নাকাক্কার বাড়ি আর চিনি না? না, তোমায় এই নতুন দেখা আমার?”

বিস্মিতভাবে মুখটা একটু তুলিয়া মেয়েটা আবার ধীরে ধীরে নোয়াইয়া লইল! রৌদ্রে যতটা ঘামা উচিত ছিল, তাহারও বেশি বেচারা ঘামিয়া উঠিতেছিল। কাল তাহার ছিল পূর্ণ জয়, আর আজ আসিয়া অবধি অন্তরে বাহিরে সে যেন পরাজিত হইয়া চলিয়াছে। সকলের অপেক্ষা তাহাকে সঙ্কুচিত করিতেছিল এই পরিচয়টা, কারণ সেটা তাহার তেমন গৌরবের নয়; তাহার চাঞ্চল্য, কৌতুকপ্রিয়তা ও নিঃসঙ্কোচ ভাব পাড়ায় তাহাকে বাতাহিয়া অর্থাৎ পাগলী নামে খ্যাত করিয়া রাখিয়াছিল। সে কথাটা এই লক্ষ্মীছাড়া সবজান্তা ছেলেটাও যে জানে, এটা তাহার কেমন রুচিকর বলিয়া বোধ হইল না।

নেহাত অপরাধীটির মতো বেচারা পূর্ণায়মান কলসিটির পানে চাহিয়া রহিল। ক্ষণেক পরে বোধ হয় একটু সাহস সঞ্চয় করিয়াই বোঝার মতো জড়তাটা দূর করিবার জন্য বলিল, “যদি ততই জান মুন্নাকাক্কাকে তো ওদিকে বড় একটা যাও না যে?”

ছেলেটা মেয়েটার পানে চাহিয়া ছিল; ঠোঁট টিপিয়া একটু হাসিয়া বলিল, “কি করতে যাব আর? মুন্নাকাক্কাকে দেখলে তো আর পেট ভরবে না। যাকে দেখলে কিছু ক্ষিদে মেটে, তাকে তো সামনে দেখতেই পাচ্ছি।”

মেয়েটা একেবারে সপ্তমে চড়িয়া উঠিল! ক্ষিপ্ত ক্রোধের একটা দীর্ঘ ‘কি’ টানিয়া কলসি ছাড়িয়া খাড়া হইয়া দাঁড়াইল এবং তাহার কৈশোর-অবসানের কটাক্ষে যতটা দাহ ছিল, সমস্ত দিয়া ছেলেটার পানে অপলক নেত্রে চাহিয়া রহিল।

ছেলেটা অবিচলিতই রহিল। সকৌতুক দৃষ্টিতে সঙ্গিনীর অনলবর্ষী নয়নের দিকে চাহিয়া বলিল, “তোমার যে সবই উছলে পড়ছে—তোমার রাগ—কলসিতে জল—আর আর—থাক্, সর, আমায় ভরে নিতে দাও এখন।”

মেয়েটার ঠোঁট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল। প্রথম খানিকটা একটা কথাও উচ্চারণ করিতে পারিল না, তাহার পর হঠাৎ বাঁধ ভাঙিল এবং ‘ঝাড়ু মারা’ হইতে আরম্ভ করিয়া যতগুলি গালাগাল একদমে মনে পড়িল, সবগুলি অনর্গল আওড়াইয়া সে কলসিটাকে বাঁকা কাঁখে সজোরে বসাইয়া দিল এবং ঝাঁকানির চোটে জল ছিটাইতে ছিটাইতে গৃহের অভিমুখিনী হইল।

ফণা ধরিলেই সাপকে মানায়। এই প্রচণ্ড বালিকার সহজ সৌন্দর্য ছেলেটা বোধ হয় উপভোগ করিতেছিল; সে খানিকটা চলিয়া গেলে গলা উঁচাইয়া কহিল, “তোমার নামটা কি বলে যাও, এসব গালাগালির জন্যে মুন্নাকাক্কার কাছে নালিশ করতে হবে। ‘বাতাহিয়া’ বললে তো আবার একচোট ক্ষেপে উঠবে।”

মেয়েটা দৃপ্তভাবে ঘুরিয়া দাঁড়াইল। রক্তিম মুখটা দুলাইয়া দুলাইয়া বলিল, “করিস নালিশ মুন্নাকাক্কার কাছে, আমি ভয় করি না। বলিস, লছিয়া আমায় ঝাড়ু মেরেছে, আর খড়ের নুড়ো দিয়ে আমার বাঁদুরে মুখটা পুড়িয়ে দিয়েছে; বলিস—একশো বার বলিস।”

সে আবার সবেগে ঘুরিয়া পূর্ববৎ চলিতে লাগিল।

.

মুন্নাকাক্কার কাছে কোনো পক্ষেরই নালিশ রুজু হইল না, এবং এই অপ্রিয় ঘটনার পর হইতে দুইজনে যে মুখ-দেখাদেখি কি কথাবার্তা বন্ধ হইল, এমনও নয়। বর্ষা আসিয়া পড়ায় দেখাশুনাটা অবশ্য প্রতিদিনই ঘটিয়া উঠিত না। যেদিন জল নামিত সজোরে, লছিয়ার সেদিন প্রায়ই আসা হইত না। মুন্নাই ভিজিয়া ভিজিয়া কলসি ভরিয়া লইয়া যাইত। ছেলেটা নিজের নিরিবিলি দোচালা হইতে ব্যাপারটা দেখিত; আস্তে আস্তে ভিতরে যাইয়া কলসি দুইটা নাড়িয়া দেখিত—যদি সামান্যও জলের শব্দ হইত, বলিত, “আজ বাসিয়ে পানিসে চলি; আরে কৌন ভিঙে একচুক পানি লাগি।” যদি কলসিটা একেবারেই ঢনঢন করিত, বাধ্য হইয়া ভিজিতে ভিজিতে সিকি কি আধা ভাগ ভরিয়া চলিয়া আসিত; এবং মুখখানি বর্ষার মেঘের মতো মলিন করিয়া হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া থাকিত।

বাহির হইতে যতদূর বোঝা যায়, এরূপ অবস্থা লছিয়ার মনে কোনো ভাবের ঢেউ তুলিত না। তাহার কারণ, তাহার মনটা ছিল স্বভাবত আত্মস্থ—বাহিরের সহিত তাহার আদান-প্রদান ছিল অল্পই। নিজের কয়েকটা খেয়ালের নিগূঢ় সাহচর্যের মধ্যে সে বেশ নিশ্চিন্তভাবে তাহার দিনগুলো কাটাইতেছিল। তাহার বয়সের সহিত সেগুলির কোনো সামঞ্জস্য আছে কি না, এসব কথা ভাবিয়া দেখিবার তাহার অবসর বা চৈতন্য ছিল না; এবং লোকে যদি কোনো গরমিল আবিষ্কার করিয়া তাহাকে ‘বাতাহিয়া’ আখ্যা দেওয়া উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া থাকে তো করুক—সে গ্রাহ্য করিত না।

একটু—খুব সামান্য ব্যতিক্রম ঘটাইত কলতলাটা। সেইখানে ব্যয়িত তাহার জীবনাংশে আশা-বিষাদের একটা অজ্ঞাতপূর্ব মিশ্র অনুভূতি জাগিয়া উঠিতেছিল। সেটাকে সে যে পূর্ণভাবে নিজের হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতেছিল এমন নয়, সেটা শুধু ধরা- ছোঁওয়ার বহির্ভূত একটা অস্পষ্ট আকারে তাহার উদ্দাম মনটাতে ছায়াপাত করিয়া মিলাইয়া যাইত। তাহার এমন ভাষা ছিল না যে, সে আভাসটুকুকে একটা আকার দিয়া বুঝিতে- সুঝিতে পারে—কারণ, যৌবন স্বীয় আগমনের সঙ্গে আর সকলকে যে শব্দসম্ভার দিয়া চৈতন্য ও স্পন্দন দান করে, লছিয়াকে তাহা দিবার অবসর পায় নাই। কলতলার একটা টান ছিল, সেটা বেদনার টান কি সুখের এবং তার উদ্ভবই বা কোনখানে সেটা সে বুঝিতে পারিত না; তাই কলতলা ছাড়িয়া সে বাঁচিত কি মরিত বলা কঠিন; তবে বাড়ি আসিলে তাহার সহজ প্রাত্যহিক জীবনের পাশে কলের স্মৃতি আসিয়া তাহাকে বিব্রত করিতে পারিত না, এটা ঠিক; মনটা ছিল তাহার বীণার মতো –একটা ঘা পড়িলে একটু রণরণিয়া উঠিত বটে, কিন্তু তাহার স্মৃতি সে বহন করিয়া রাখিতে পারিত না।

এক-একদিন লছিয়া বুড়ার সহিত ঝগড়া করিয়া নিজেই জল ভরিতে আসিত। বুড়াকে বলিত, “জলে ভিজে ভিজে তুই যদি মরিস, তা হলে আমি দাঁড়াব কোথা? সবাইকে তো পেটে পুরে বসে আছিস; কাউকেও রেখেছিস কি?”

বুড়া বিষণ্ণভাবে মাথাটা নাড়িয়া বলিত, “ঠিক বাত, ঠিক বাত, তবে কথা এই লচ্ছি, তুই বা যদি জ্বরে পড়িস, তা হলে তোর যে একটা বন্দোবস্তের কথা কদিন থেকে আমি ভাবছি, সেটাতেও যে বাগড়া পড়ে যাবে!”

এ কথাটা লছিয়া মোটেই বরদাস্ত করিতে পারিত না। একেবারে অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিত, মুখ ভেঙাইয়া বলিত, “বন্দোবস্ত! বন্দোবস্ত! আমার বন্দোবস্ত করলে ওই হাড়কখানা আগলাবে কে? শেয়াল-কুকুরে? বুড়ো বয়সে তোর মতিচ্ছন্ন ধরেছে, তা আমার বুঝতে বাকি নেই। তা দেখি, আমি আগে যমের সঙ্গে তোর বন্দোবস্ত করি, কি তুই আমার বন্দোবস্ত করিস!”

বর্ষা গেল, শীত গেল, বসন্ত ফিরিয়া আসিল। জলের ভিড় আবার জমিয়া উঠিতে লাগিল এবং এই জমায়েতের সুখ-দুঃখ, বাংলার নিন্দা এবং মুল্লুকের তারিফ প্রভৃতি সেই পুরাতন গল্পের মধ্যে একটা নূতন বিষয় মাঝে মাঝে আলোচিত হইতে লাগিল—সেটা সুনরা ও লছিয়ার পরিবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা। সকলেই নাসিকা কুঞ্চিত করিতে লাগিল, ভূ কপালে উঠাইতে লাগিল, একাল-সেকালের তুলনা করিতে লাগিল এবং সবশেষে নির্লিপ্তভাবে এই অভিমতই প্রকাশ করিতে লাগিল যে, যাহার নাতনী তাহারই যখন চাড় নাই তো অপরের মাথা ঘামাইয়া ফল কি?

প্রকৃতই, সুনরা ও লছিয়া একটু বাড়াইয়া তুলিয়াছে। তাহাদের কলতলার কলহ দুই- একটা লোক জড় না হওয়া পর্যন্ত আজকাল আর থামে না, আর তাহাদের গল্পহাসি শুরু হইলেও একটু বিবেচক লোকের চক্ষে তাহা কেমন-কেমন ঠেকে। এমন কি সুনরা জ্বরে পড়িলে লছিয়া দুই-একবার তাহার জল যোগাইয়া, তাহার পটলের ঝোলের পথ্য পর্যন্ত রাঁধিয়া দিয়া আসিয়াছে। মুন্নাও যে কথাটা নেহাত না জানিত, এমন নয়, কারণ জল তুলিতে যাইয়া সুনরার গৃহে এসব উপলক্ষে যেটুকু বিলম্ব হইত, লছিয়া তাহার একটা মনগড়া জবাবদিহি দিবার চেষ্টা করিত।

সুনরা কিন্তু কখনও পাল্টা ভিজিট দেয় নাই—লছিয়া জ্বরে মরণাপন্ন হইলেও নয়। মনস্তত্ত্ববিদ্রা বোধ হয় বলিবেন, তাহার মনে গলদ ছিল বলিয়া সে এতটা খোলা-প্ৰাণ হইতে পারিত না। কথাটা অসম্ভব নয়, হইতেও পারে। তবে লছিয়া ভাল হইয়া যদি মুখভার করিয়া অনুযোগ করিত, সুনরা বলিত, সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত তাহাকে খাটিতে হয়, তাহার কি নড়িবার জো আছে! যদি মনটা লছিয়ার ভাল দেখিত, কখনও কখনও একটু যোগও করিয়া দিত, “আর তোমার অসুখ হলে আমিই কি এমন ভাল থাকি লচ্ছি যে, দু পা হেঁটে দেখে আসব?”

লছিয়া বলিত, “আচ্ছা, জ্বর-বোখার শুধু আমার জন্যে কালীমাঈ তোয়ের করেন নি, তখন দেখা যাবে।”

অনেক দিন এই ভাবেই গেল, তার পর একদিন এই ঘটনাটি ঘটিয়া বসিল।—

সেদিন ছিল দোল-পূর্ণিমা। কলের ছুটি, ঘরও খালি—লোকগুলা রাস্তায় পিচকারির উৎসবে মাতিয়া বেড়াইতেছে। শ্লীল-অশ্লীল নানাবিধ গীতে, হাসির উন্মাদ হররায় আর বেয়াড়া খঞ্জনি-বাঁধা ঢোল ও করতালির সৃষ্টিছাড়া আওয়াজে এই অল্প-পরিসর জায়গাটা গমগম করিয়া উঠিয়াছে। এত লোক যে এখানে ছিল, তাহা ভাবিয়া উঠা যায় না।

সুনরাও ময়লা কাপড়ের উপর একটা নূতন পিরান চড়াইয়া, মাথায় একটা ধোপদুরস্ত ফুলদার হালকা টুপি পরিয়া, রঙ আবীর ও কাদা মাখিয়া, মুখে কালি লেপিয়া, সঙ্গীদের পালাক্রমে গাধায় চড়াইয়া ও বারকতক নিজেও চড়িয়া সমস্ত সকালটা কাটাইল। একটা রসিক ছেলে সুনরা ও লছিয়াকে উদ্দেশ করিয়া বিচিত্র ছন্দে গান বাঁধিয়া আনিয়াছিল। সুনরা প্রথমটা বেজায় চটিল, দল ছাড়িবে বলিয়া ভয় দেখাইল, তাহার পর সরস গানটার মাদকতা যখন তাহার মনটা ভিজাইয়া দিল, সকলে পরামর্শ করিয়া লছিয়ার নামটা বাদ দিয়া ঘণ্টা দুইয়েক ছয় পংক্তির গানটা লইয়া গলার শিরা ফুলাইয়া শহরময় খুব একচোট চিৎকার করিয়া ফিরিল।

আন্দাজ একটার সময় তাহারা বাড়ি ফিরিল।

এক আনা দামের ছোট গোল আরশিটা ঝুড়ির ‘পেটরা’ হইতে বাহির করিয়া নিজের মুখটা দেখিতেই সুনরা হাসিয়া ফেলিল এবং তাহাতে দাঁতন-দিয়া-মাজা সাদা দাঁতগুলা বাহির হইয়া পড়ায় আরও যে একটা নূতনতর রূপ খুলিল, তাহাতে তাহার হাসির মাত্রাটা আরও বাড়িয়া গেল। মাথা দুলাইয়া দুলাইয়া নিজের প্রতিচ্ছায়াটাকে বলিল, “লছিয়া দেখলে আজ আর তোমায় আস্ত রাখবে না।”

তাহার পর জামা-টুপি খুলিয়া বদলদাবা করিল এবং এক হাতে কলসিটা ঝুলাইয়া কলের দিকে চলিল।

দূর হইতে দেখিতে পাইল, রঙ-কাদা-মাখা গোটা চার-পাঁচ ছোট চ্যাংড়া ছেলের সহিত লছিয়া তুমুল বিবাদ জুড়িয়া দিয়াছে। তাহারাও গা না ধুইয়া ছাড়িবে না, লছিয়ারও জিদ—কোনমতেই তাহাদের কলতলা নোংরা করিতে দিবে না। পাটের কোম্পানি যখন এই সব ‘নেশাবাজ’ গুণ্ডাদের পুষিতেছে, তখন তাহারা কলের ভিতরকার ভাল পুকুরটাতে গিয়া স্নান করুক না, কে মানা করে? ভালা আদমি’র মেয়েছেলেরা যেখানে খাবার জল লইতে আসে, সেখানে হারামজাদগি করিতে আসার কি অধিকার তাহাদের?

সুনরা পা চালাইয়া আসিয়া পৌঁছিল; আওয়াজ ভারী করিয়া প্রশ্ন করিল, “কা ভইল রে?”

ছেলেগুলা সমস্বরে বলিয়া উঠিল, “দেখ না সুন্দর ভাইয়া, বাতাহিয়ার বদমাসি।”

“বাতাহিয়ার বদমাসি! আর তোরা সব যত ভালমানুষ, না? কলতলাটা সব উচ্ছন্ন দিতে এসেছিস। পালা, না হলে বসালুম কিল।–” বলিয়া সুনরা কৃত্রিম রোষ দেখাইয়া দুই- একটা ছেলেকে ধরিতে গেল; দল ভাঙিয়া ছেলেগুলা দিগ্বিদিকে ছুট দিল। একটা ছেলে নিরাপদ ব্যবধানে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আর তুমি গা ধুলে বুঝি দোষ নেই? নিজের চেহারার দিকে একবার দেখ দেখি!”

“আরে, আবার তর্ক করে!”—বলিয়া সুনরা আর একটা তাড়া দিল! আর কেহ দাঁড়াইতে সাহস করিল না, অনেক দূরে গিয়া হাততালি দিয়া ছন্দোবন্ধে গাহিতে লাগিল—”

“বাতাহাইয়াকে পিছে সুন্দর বাতাহা ভেলন বা—”

হাঙ্গামাটা থামিয়া গেলে কৃতজ্ঞতার বদলে লছিয়া সুনরার মুখের পানে চাহিয়া নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “অনমন বন্দরকে মাফিক দেখাবতাড়।” অর্থাৎ ঠিক বাঁদরের মতো মানাইয়াছে।

সুনরা বিকট হাসি হাসিয়া ফেলিল। তাহার পর হঠাৎ গম্ভীর হইয়া বলিল, “দেখ্‌ লছিয়া, আজ আমার মনটা অন্য ধরনের, বেশি ঘাঁটাস নি। হোলির দিন, তোর গালগুলোও এত মিষ্টি লাগছে যে, না জানি কি হতে কি হয়ে যায় শেষে!

লছিয়ার মেজাজ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া গেল। চোখ পাকাইয়া সিধা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “খবরদার, কার সঙ্গে কথা কইছিস মনে থাকে যেন! তোদের সব কাণ্ডকারখানা দেখে আর ছেলেগুলোর ব্যবহারে আমার নিজের মনেরই ঠিক নেই, এর ওপর যদি মাতলামি করিস আমার সামনে—”

সুনরা দুষ্টামির হাসি হাসিয়া বলিল, “মাতলামি! শিউলি যদি তালের রস খাইয়ে বলে—মাতলামি করিস না, তবেই তো গেছি। আজ সকাল থেকে আমি তোর নেশায় ভরপুর হয়ে আছি লছিয়া—ধর্ম জানেন, আর কোনো নেশা করি নি—তোর ভাবনার রস খেয়েছি, তোর গানের রস খেয়েছি, তাই বলছি, তোর কথার রস খাইয়ে আমায় আর বেসামাল করিস না—”

লছিয়া রাগে চিৎকার করিয়া উঠিল, বলিল, “বড় বাড় বেড়েছিস সুনরা, চুপ কর্ বলছি, যদি এখনও মুখ না সামলাস তো তোর উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়াব, আমি এক্ষুনি লোক জড় করে তোর যে দশা আজ পর্যন্ত হয় নি, তাই করাব।”

সুনরা শান্তভাবে বলিল, “দেখ লছিয়া, আমাদের দুজনের মধ্যে যে ঝগড়া, তাতে কি লোক ডাকা উচিত? আপোস করে নেওয়াই—”

লছিয়া রাগে অন্ধপ্রায় হইয়া গিয়াছিল; কিছু না পাইয়া উন্মাদের মতো গালাগালি করিতে করিতে কলের মাথার উপর হইতে সুনরার পিরানটা টানিয়া ফ্যাসফ্যাস করিয়া ছিঁড়িয়া দিল এবং তাহাতেও তৃপ্তি না হওয়ায় নিজের কলসিটা কলের শানের উপর আছাড় দিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়িমুখো হইল।

সুনরা ছেলেটাকে আজ ভূতে পাইয়াছিল। নিজের ছেঁড়া জামাটা একবার চোখের সামনে মেলিয়া দেখিল, ভাঙা কলসিটার দিকে চাহিল, তাহার পর ছুটিয়া গিয়া রোরুদ্যমানা লছিয়ার হাতটা ধরিয়া নিতান্ত বেদনা-মিনতি স্বরে বলিল, “লছিয়া, ঢের তো হয়েছে, মাফ কর্; ফিরে চল্, তোর কলসিটা কিনে দিই।”

কথাটা অবশ্য সমস্ত শোনানো গেল না, কারণ হাত ধরিতেই লছিয়া গলা চিরিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল এবং ঝাঁকি দিয়া ছাড়াইয়া লইয়া সজোরে সুনরার গালে বিরাশি- সিক্কার একটা চড় বসাইয়া দিল, লাথি ছুঁড়ল এবং রাগের আধিক্যে আর ‘পাদমপি’ চলিবার সামর্থ্য না থাকায় রাস্তার মাঝে বসিয়া চুল ছিঁড়িয়া, জামা ফাঁড়িয়া এক কুরুক্ষেত্র-কাণ্ড বাধাইয়া দিল।

সুনরা হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, এমন সময় কানের কাছে গুরুগম্ভীর আওয়াজ হইল, “ই সব কৌ—ন বাত বা?” এবং সুনরা নিজে ফিরিয়া দেখিবার পূর্বেই বক্তা দৃঢ়মুষ্টিতে তাহাকে ফিরাইয়া পুনরপি প্রসন্ন করিল, “সুন্দর ই সব কৌন বাত বা? ভালা আদম কহলাবতাড় না।” অর্থাৎ ভদ্দরলোক বলে তোমাকে সবাই জানে তো? তবে কি এ কাণ্ডকারখানা?

সুনরা দেখিল, কলকলায় খানিকটা ভিড় জমিয়া উঠিয়াছে এবং সেটা তাহার দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে; তাহার প্রশ্নকারী স্বয়ং হলুমান মাহতো—তাহাদের ‘মানজন’, অর্থাৎ মোড়ল।

লছিয়া তেমনিই জোর গলায় চিৎকার করিতেছিল, “সাজা দাও ওকে, ও ভদ্দরলোকের মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে, কলসি ভেঙে দিয়েছে; দেশ থেকে তাড়াও ও হারামজাদাকে! আমি আর এ দেশে থাকতে চাই না; এখানকার ‘মানজনে’র মুখে ছাই দিয়ে, সমাজের মুখে ছাই দিয়ে, আর ও হারামজাদার মুখে নুড়ো জ্বেলে, আজই এ দেশে ঝাড়ু মেরে চলে যাব আমি। আর সেই হতভাগা বুড়ো মড়াটারও একটা ব্যবস্থা করব, যে নিজের নাতনীর ইজ্জত রাখতে পারে না।”

কথাগুলায় বৃদ্ধ হলুমান মাহতো স্থির গাম্ভীর্য হইতে হঠাৎ সপ্তমে চড়িয়া উঠিল, সুনরাকে একটা জবরদস্তি ঝাঁকানি দিয়া বলিল, “ঠিক কথাই তো; দাঁড়া এখানে তুই, উপযুক্ত সাজা তোকে দেওয়া হবে।” ছেলেমেয়েগুলো বেজায় ঠাট্টা গালাগালি লাগাইয়া দিয়াছিল, তাহাদের বলিল, “একে ঘিরে দাঁড়া, যেন পালায় না।”

সুনরা পলাইবার কোনো লক্ষণ না দেখাইয়া গম্ভীরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। হলুমান রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে লছিয়াকে হইয়া স্নেহভরে তাহাকে একবার বুকে চাপিল, গায়ের ধূলা ঝাড়িয়া দিল এবং তাহার কাপড়-জামাগুলা গুছাইয়া দিয়া মুন্নার বাসার দিকে চলিল; পিছন ফিরিয়া সুনরাকে বলিল, “চল্, এগো, আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে, আর অসহ্য হয়ে পড়েছে।”

.

দোল-পূর্ণিমার রাত্রি।

মানজন হলুমান মাহতোর বাসার সামনে প্রকাণ্ড অশ্বত্থগাছটার তলায় পঞ্চায়েত বসিয়াছে। মাঝখানে একটা তাড়ির কলসি, গোতাকতক কাঁচের গেলাস; চারিদিকে সমাজের বিজ্ঞেরা বসিয়া। সুনরার বিচার হইবে, সে বিধিমত এক পাশে করজোড়ে দাঁড়াইয়া।

বেজায় গোলমাল হইতেছিল। নেশা চড়াইয়া হাত দুইটা তুলিয়া হলুমান “সুন্দর, বলে, অব ভাই সবকে সামলে বোল, কাহে তু লচ্ছি-মাইকে দেহমে হাত চড়হয়লৈ রহ।” অর্থাৎ সমাজ ভাইদের সামনে বল তুমি, লচ্ছি-মায়ের গায়ে কেন হাত দিয়েছিলে!

সুনরা তেমনিই চুপ করিয়া রহিল, না রাম, না গঙ্গা—কিছুই বলিল না।

হলুমান তাগাদা দিল, “কহ, কহ, হোঅ!”

তখন স্থির পরিষ্কার কণ্ঠে সুনরা বলিল, “উঁ হমনিকে মেহরারু বা।” অর্থাৎ আমার স্ত্রী ও।

কথাটাতে সভাতে হৈ-হৈ পড়িয়া গেল এবং ‘মার হারামজাদকো’, ‘পিটো বদমাইশকো’ গোছের কয়েকটা অশুভসূচক ভাঙা ভাঙা কথা বেশি বেশি শোনা যাইতে লাগিল। কয়েকটা ছেলে দাঁড়াইয়া উঠিয়া শক্ত জমিটার উপর নিজের লাঠি ঠুকিয়া তাহাদের উৎকট অভিমত জ্ঞাপন করিল। বিজ্ঞেরা বোধ হয় কথাটা তেমন হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না, তাই এক এক চুমুকে বুদ্ধিটা চাঙ্গা করিয়া লইল। মুন্নার নেশাটা একটু বেতরহ হইয়া পড়িয়াছিল। টলিতে টলিতে দাঁড়াইয়া বলিল, “হারামজাদা, তোর জিবটা উপড়ে নোব এখনই।”

একজন তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া দিল। হলুমন সুনরাকে বলিল, “নেশা করে তোর আজ মতিগতি ঠিক নেই, আমি টের পাচ্ছি। বুঝেসুঝে কথা বলবার চেষ্টা করিস ভাইদের সামনে।”

সুনরা মাথাটা সিধা করিয়া বলিল, “সুনরা তাড়ি খেয়েছে—এ কথা কেউ বলতে পারে না। গলায় আমার বৈষ্ণবের কণ্ঠি—সেটা দেখেও ও-কথাটা বলায় ধর্মকে গাল দেওয়া হয়েছে। আমি ঠিকই আছি, আর লছিয়া যে আমার স্ত্রী—এ কথাও খাঁটি।”

মুন্না আবার ঠেলিয়া উঠিতেছিল, পাশের একজন লোক হাতটা চাপিয়া ধরিয়া বসাইয়া দিল এবং এক গেলাস ভর্তি করিয়া বলিল, “ধর, মাথা ঠাণ্ডা কর, এটা ঘাবড়াবার সময় নয়।”

সুনরা বলিল, “আমি সমস্ত কথা বলে যাচ্ছি, মুন্নাকাক্কা মিলিয়ে দেখুন ঠিক কি না, আর লছিয়াও তো সামনে আছে, কিছু কিছু তারও মনে থাকতে পারে।”

লছিয়ার নামে মুন্নার সিক্ত মনে স্নেহটা বোধ করি উদ্বেলিত হইয়া উঠিল, তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “লচ্ছি, আমার কাছে এসে বস তুই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যে ননীর পা দুটো তোর ভেঙে যাচ্ছে, সে আর আমি প্রাণ ধরে দেখতে পারছি না।”

নাক সিঁটকাইয়া লছিয়া বলিল, “বেশ আছি আমি আর আদর দেখাতে হবে না; তাড়ির গন্ধের মধ্যে গিয়ে বসতে পারি না। যত সব মাতাল বসেছে; বিচার হবে উনুনের পাঁশ!”

মুন্না প্রাণ খুলিয়া হাসিয়া ফেলিল এবং অন্য মাতব্বরেরা যোগ দিল। একজন হাসির মধ্যে হঠাৎ থামিয়া বলিল, “লচ্ছি-মাই আজ বড় চটে আছে, ছেলেটাকে জবরদস্ত সাজা দিতে হবে।”

সুনরার প্রতি হুকুম হইল, “বল্ তোর কি বলবার আছে?

সুনরা বলিতে লাগিল, “আমার প্রকৃত নাম মোতীলাল, সুন্দর নয়; বাড়ি আমার বালিয়া জেলার গজরাজপুর গ্রামে। বাপের নাম ছিল সন্তোখী—”

মুহূর্তের মধ্যে মুন্নার ভাবটা বদলাইয়া গেল, নামটা শুনিয়াই সে উঠিয়াছিল, আস্তে আস্তে সুনরার সামনে গিয়া একেবারে মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া দুই মিনিট ধরিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “লচ্ছি, আয়, দেখি, দেখ দেখি, তুই কি কিছু চিনতে পারিস? আমার যেন মনে হচ্ছে—”

লছিয়াও মাথার কাপড়টা তুলিয়া দিয়াছিল, গালের উপর ঘোমটাটা টনিয়া দিয়া মাথাটা পিছনে ঘুরাইয়া, গলাটা নামাইয়া বলিল, “হাম কি জানি?”

মুন্না ফিরিয়া আসিয়া আর আধ গেলাস শেষ করিল, তাহার পর সুনরাকে বলিল, “আচ্ছা, বলে যা, দেখি আর সব মেলে কি না!”

সুনরা কৌতূহলস্তব্ধ সভার ঔৎসুক্য বাড়াইয়া বলিতে লাগিল, “আমাদের গ্রাম থেকে দশ ক্রোশ দূরে মঝৌলিতে আমার বিবাহ হয়। সে প্রায় দশ বৎসরের কথা। নেহাত ছেলেমানুষ ছিলাম বলে সব কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে শুধু শ্বশুরবাড়ির সামনে প্রকাণ্ড বটতলাটার নীচে আমার পাল্কীটা নেমেছিল। রাস্তায় ভয়ানক বৃষ্টি হয়েছিল বলে কি একটা ছুতো করে বাবা শ্বশুরের সঙ্গে খুব একচোট ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিলেন এবং শ্বশুরের পক্ষ থেকে মারামারির ভয় দেখিয়ে আমার জবরদস্তি বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। সেই তুমুল বর্ষা আর ভীষণ ঝগড়া ও গোলমালে রাতের সব কথা মনে থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু মুন্নাকাক্কা বোধ হয় এই সব পরিচয় থেকেই টের পাবেন যে, আমি মিথ্যা কথা বলছি না। সে সময়ের মুন্নাকাক্কার চেহারাটা বেশ মনে পড়ে, কেননা উনিই আমায় পাল্কি থেকে চ্যাংদোলা করে গাজুরি বাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁর চেহারা তখন ছিল পালোয়ানের মতো—গালে গালপাট্টা দাড়ি ছিল, হাতে লোহার একটা বালা ছিল; আমার বেশ মনে পড়ে, প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে আমি চিৎকার করতে করতে ওঁরই বুকে মুখ গুঁজেছিলাম। আজ আমায় ভগবান ভুলেছেন, সুতরাং সবাই ভুলবে; তবে আমি যে বুকে একদিন আশ্রয় পেয়েছিলাম, তার আশা কখনও ছাড়ব না।”

সুনরা থামিল। একটু চুপ করিয়া আবার আরম্ভ করিতে যাইতেছিল। মুন্না আর থাকিতে পারিল না, হাত দুইটা বাড়াইয়া সুনরার পানে ছুটিল, বলিল, “আবার তোকে বুকে নিই, আয় মোতিয়া, আর সেসব পুরনো কথা তুলে আমায় পাগল করিস না

হলুমান মাহতো তাহাকে ধরিয়া ফেলিল, কহিল, “মাথা ঠাণ্ডা কর দোস্ত। আরে কে ও তা কে জানে? সে সব কথা অন্য লোকে জেনে নিতে পারে না?’ সভার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হো ভাই সব, ঠিক বোলতানি কি না?”

সকলেই সমস্বরে বলিল, “ঠিক বাত, বহুত ঠিক, বহুত ঠিক।”

একজন প্রাচীন এ পর্যন্ত রায় দিল, “আজকালকার জমানা—কত লোক কত মতলবে ঘুরছে, কে জানে? লচ্ছি-মাইয়ের লছমীর মতো চেহারা দেখলে অনেক ছেলেই এসব কথা প্রাণ দিয়ে খুঁজে বার করতে পারে। আমি জিজ্ঞাসা করি, যদি বিয়েই করেছিলি তো এতদিন কোন্ জাহান্নামে নিজের সমর্থ পরিবার ছেড়ে ছিলি রে হতভাগা?”

সুনরা বলিল, “সে কথাও বলছি। বিয়ের প্রায় চার বছর পরে, আমার বয়স তখন তেরো কি চোদ্দ হবে, চা-বাগানের এক সেপাই আমাদের গ্রামে এসে উপস্থিত হয়। এসে গ্রামের যে জোয়ান জোয়ান ছেলেগুলো ছিল, সেগুলোকে খুব ভজাতে আরম্ভ করলে। গ্রামের এক প্রান্তে সে বাসা নিয়েছিল। দলে দলে আমরা সেখানে জুটতাম, তার পয়সায় খাওয়া-দাওয়া নেশাভাঙ করতাম, আর চা-বাগানের গল্প শুনতাম। শিকারের দল যখন বেশ জমে এসেছে, সেপাইটা একদিন সকলের সামনে একটা প্রকাণ্ড খাতা খুলে ধরলে আর বললে, নাও, একে একে সই কর; দু বছরের শর্ত, তবে আমি যখন মাঝখানে আছি, যার যখন খুশি ছেড়ে চলে আসতে পার, সাহেবকে আমি মুঠোর মধ্যে রেখেছি, উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। আর বেশি দেরি করা চলে না, কাল ভোরের গাড়িতেই রওনা হতে হবে। কাল সাহেবের তার এসেছে, আমার জন্যে কাজকর্ম সব বন্ধ। আরও অনেক কথাই বললে, অনেক লোভই দেখালে, সব এখন মনে পড়ে না। সেদিন আমাদের নেশার মাত্রাটা বেশি হয়েছিল, প্রায় সবাই সই করলে; যারা করলে না, তারা যাতে গ্রামটাকে সতর্ক করে না দিতে পারে, সেজন্যে বেশি আগ্রহ করে তাদের নেশাটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হল। সকালের গাড়িতে আমরা কজন রওনা হলাম।

“চা-বাগানে এসে দেখলাম, চার বৎসরের জন্য সকলের পায়ে শিকল আঁটা।”

“আমি খালি সাবুত দিতে বসেছি; সেখানে চারটে বছর কি দুঃখে কি যন্ত্রণায় কেটেছিল, তা আর বলে কি হবে? মোট কথা, মহাবীরজীর কৃপায় কটা বছর জেল-খাটার মতো কাটিয়ে দিলাম। অনেক ফন্দি করে আবার শর্ত লেখা থেকে বাঁচলাম এবং ভাঙা শরীর, ভাঙা মন নিয়ে গ্রামে ফিরে এলাম।

“খবর নিলাম বাবা মারা গিয়েছে, মা মারা গিয়েছে, ভাই সংসার চালাচ্ছে। ঘরে যেতে আর মন সরল না। সন্ধ্যার সময় বাড়ির সামনে দিয়ে শ্বশুরবাড়ির রাস্তা ধরলাম; কেউ চিনতে পারলেন না। পিপরতলায় বঢ়ঠাকুরকে প্রণাম করে বললাম, যতদিন না রোজগার করে ফিরে আসছি, অভাগা সংসারটাকে তুমিই দেখো ঠাকুর।”

সুনরার গলা ধরিয়া আসিতেছিল, একটু থামিল। মুন্না ফোঁসফোঁস করিয়া কাঁদিতেছিল, ভাঙা গলায় বলিল, “মোতি, আউর সাবুত দেবেকে না পড়ি রে, আ তু হামরা ছাতিমে। লচ্ছি—”  

লছিয়া অশ্বত্থগাছের আড়ালে কখন আশ্রয় লইয়াছে, কোনো উত্তর দিল না। সুনরা বলিতে লাগিল—”

“শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দেখলুম, সেখানেও সব ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। অনেক খোঁজ করে পাওয়া গেল, লছিয়াকে নিয়ে মুন্নাকাক্কা বাংলা মুল্লুকে এসেছে, কোন কলে কাজ করে। বাড়িতে আর টান নেই, আসে না কখনও

“তারপর এই দুবছর কত কলে ঘুরেছি, কত সন্ধান করেছি, কাকে বলি? শেষকালে আজ বছর খানেকের বেশি হতে চলল, এখানে এসেছি! খোঁজ করি, কোনো ফলই হয় না। শেষে একদিন কলতলায় লছিয়াকে দেখলাম। কোন্ সেই ছেলেবেলায় একবার দেখেছি, ঠিক যে চিনতে পারলাম তা বলতে পারি না, তবে মনে একটা খটকা লেগে রইল। সন্ধান লাগাতে থাকলাম। অনেক খবর ইয়ার-দোস্তদের কাছে পাওয়া গেল। অনেক খবর জল নিতে গিয়ে কলতলায় লছিয়ার কাছে পাওয়া গেল; ওটা ভারী বেহায়া হয়ে পড়েছে, হাউ- হাউ করে সব কথাই বলত। মোটের ওপর, আমার আর কোন সন্দেহ রইল না যে, মহাবীরজী মুখ তুলে চেয়েছেন।”

হলুমান মাহতো বলিল, “সে-সব নয় মানলাম, কিন্তু এতদিন জেনেশুনে তোর জরুকে নিস নি কেন? সেজন্যে তোর পঞ্চভাইয়েরা তো কোনমতেই মাপ করতে পারে না।”

সুনরা বলিল, “সে পঞ্চভাইদের মর্জি; তবে তারও যে একটা কারণ না আছে এমন নয়। দেখলাম আমি তো একেবারে বিলল্লা, ঘরবাড়ি নেই, হাতে একটা কানা কড়ি নেই, সব দিন বোধ হয় ঠিক ভাতও জোটে না, এর মধ্যে ও বেচারীকে এনে আর কষ্ট দিই কেন? রোজ দেখাশোনা তো হচ্ছেই, খবর তো পাচ্ছিই। ও দাদার কাছে সুখে আছে, থাক্; বরং ওর জন্যে যে খরচটা হত সেটা জমিয়ে জমিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাক। এক-একদিন অবশ্য মনে হত, সব কথা খুলে বলি, কিন্তু ভয় হত, যদি কেউ বিশ্বাস না করে; তা হলে যেটুকু আশা মনের মধ্যে আছে, তাও ভেঙে যাবে; নিজের মেহেরারুকে বোধ হয় জন্মের মতো হারাতে হবে। আর একটা কথা যা মনে হত, তা পঞ্চভাইদের সামনে না বললে মনে পাপ থেকে যাবে, সেটা এই—ভাবতাম লছিয়াকে সরিয়ে নিলে মুন্নাকাক্কা অন্য কোনো আত্মীয়কে জোটাবে, কি পোষপুত নেবে! তা হলে মুন্নাকাক্কার সব টাকা, যার ওপর লছিয়ার সুখ এতটা নির্ভর করছে—”

মুন্না আর কথাটা আর শেষ করিতে দিল না। তাড়াতাড়ি টলিতে টলিতে সুনরার হাতটা ধরিয়া টানিয়া আনিয়া নিজের কাছে বসাইল, হাসিতে হাসিতে বলিল, “আরে তুই চিরকেলে দুষ্টু, আমি খুব জানি।” তাহার পর হলুমানকে বলিল, “দোস্ত খানিকটা সিঁদুর আনতে বল, মোতিয়া নতুন করে লছিয়ার কপালে লাগিয়ে দিক। ছেলেটা সব কথাই বলেছে ঠিক; আর মিছে বললেও আমার লচ্ছির একটা বিলি করতে হবে তো? আমি আর কদিন? কি হো ভাই সব?”

সকলে বলিল, “হুঁ হুঁ, ঠিক বাত, ঠিক বাত।”

হলুমান মাহতো কিন্তু একটু বাঁকিয়া দাঁড়াইল, কহিল, “কিন্তু তা হলেও যে নিজের স্ত্রীকে জেনেশুনেও এতদিন নেয় নি, আর দ্বিতীয়ত, স্ত্রী হলেও রাস্তায় যে তার গায়ে হাত দিয়েছে; তার জন্যে ভায়েরা ওকে ক্ষমা করতে পারে না। ওর সাজা—ওকে একদিন শহরের সব ভায়েদের ভাত তাড়ি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *